Saturday, July 2, 2016

ক্ষমতা ও ভীতির রাজনীতির ফাঁদে গণতন্ত্র ও দেশ



আবুল মোমেন

গুপ্তহত্যা সমাজে সব ধর্মের সব স্তরের মানুষের মধ্যে একটা আতঙ্ক যে ছড়িয়ে দিয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু সমাধানের ক্ষেত্রে আর দশটা রাজনৈতিক ইস্যুর মত এ বিষয়েও গোটা সমাজ চেনা ফর্মুলার মধ্যে আটকে যাচ্ছে। ফর্মুলাটা সত্যিই সবার অতিচেনা - ইসলামি জঙ্গিবাদীরা এসব ঘটাচ্ছে আর তাদের মদত দিচ্ছে বিএনপি-জামায়াত জোট। না, এর ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর কিছু নেই, এতে সত্যতা অবশ্যই আছে।
কিন্তু মুশকিল হল এ ফর্মুলায় সত্যতা থাকলেও তা কোনো সমাধান দিতে পারে না। যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতকে কাঠগড়ায় তুলে কিছু অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া যাবে, এমনকী হয়ত জামায়াতকে নিষিদ্ধও করা যাবে। কিন্তু তাতে মুক্তিযুদ্ধের ও ইতিহাসের দায় চুকানো হবে, ধর্মীয় কট্টরপন্থার রাজনীতি শেষ হবে না। ক্রসফায়ারের মাধ্যমে কিছু অপরাধী জঙ্গিকে পাল্টা খুন করেও কি জঙ্গিবাদের যুক্তিকে পরাস্থ করা যাবে? তাদের ডাকে কিছু মানুষের সাড়া দেওয়ার বাস্তবতা পাল্টে যাবে? জামায়াত-বিএনপিকে শায়েস্তা করতে গিয়ে সরকার বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে হেফাজতের দিকে - অর্থাৎ একইরকম বা অধিকতর ধর্মীয় কট্টরপন্থার দিকে। তাবলীগ জামায়াত ধর্মীয় চরমপন্থা চর্চা না করলেও নিবিঘ্নে যা প্রচার করছে তা গোঁড়া ধর্মীয় মতাদর্শ এবং তাতে বর্তমান বাস্তবতায় ধর্মীয় চরমপন্থাই মদত পাবে।
ক্ষমতাবান ও ক্ষমতার প্রসাদভুক্তদের নিরাপত্তা কোনো ব্যবস্থার সাফল্য কি গৌরব কোনটাই প্রকাশ করে না। কারণ কেবল সেই ব্যবস্থাই কাম্য যেখানে ক্ষমতাহীনও নিরাপদ। সরকার বা কোনো পক্ষই আপাতত সেই ব্যবস্থার কথা ভাবছে না। নয়ত সকলকে নিরাপত্তা প্রদানে অপরাগতা প্রকাশ করত না সরকার।
আপাতদৃষ্টিতে এটা বিএনপির বেকুবি যে তারা মধ্যপন্থার রাজনীতির সুযোগ হাতছাড়া করে জামায়াত ও অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলের সাথে মৈত্রী গড়ে নিজেদের ঘাড়ে অন্যের অর্থাৎ কট্টরপন্থীদের অপরাধের দায় তুলে নিচ্ছে। কেন তারা এটা করছে? কারণ তারা দেখছে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে দোষী শাব্যস্ত করলেও হেফাজতের মত অন্য কট্টরপন্থীদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করছে। এমনকি সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে বিএনপিকে ছাপিয়ে অধিকতর ধার্মিক এবং ধর্মের বিষয়ে প্রায় গোঁড়া মতাদর্শীদের মতই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। নিজের পিঠে ধর্মনিরপেক্ষতার ছাপ নিতে আওয়ামী লীগ একবিন্দুও রাজি নয়। তাহলে তারা কী করে মুক্তচিন্তার পরিসর ও ব্যক্তিদের রক্ষা করবে? হ্যাঁ, বাংলাদেশের জনমানসের দ্বিপক্ষীয় যে বিভাজন তাতে সঙ্গতকারণেই মুক্তচিন্তা ও প্রগতিচেতনার মানুষজন জামায়াত-সংশ্লিষ্ট বিএনপির সাথে যেতে পারে না, তাদের থাকতে হবে আওয়ামী লীগের সাথেই। কিন্তু নিশ্চয় তারা উত্তরোত্তর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কিছু নেতার বাইরে সারাদেশে সর্বস্তরে এ দলের নেতা-কর্মীদের সংস্কৃতির মধ্যে রূপান্তর ঘটছে, বাঙালির চিরায়ত মানবিক সংস্কৃতির চর্চার ক্ষেত্রগুলোতে এরা যেন আগন্তুক, তাদের মনোযোগের ক্ষেত্র প্রধানত বিত্তার্জন এবং সেই সাথে ধর্মীয় সংস্কৃতির মূলস্রোতের গড্ডলিকায় গা ভাসিয়ে রাখা। এরা সমাজপরিবর্তন বা সমাজপ্রগতির পথে অন্তরায় হওয়াই স্বাভাবিক।
বাঙালির যে সমাজ একদিন ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে অসাম্প্রদায়িক উদার মানবিক সংস্কৃতি ও রাজনীতির পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল তার এই দশা কীভাবে হল? আমাদের  চোখের সামনেই তো এটা ঘটল। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখার জন্যে পাকিস্তানি ধারার রাজনীতি ও আনুষঙ্গিক সংস্কৃতি ফিরিয়ে এনেছিল। তাদের নিজস্ব কোনো রাজনৈতিক দর্শন ছিল না - এ ছিল আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তির হাতে ক্ষমতা সংহত করার কৌশল।
স্বভাবতই মাঠে আওয়ামী লীগ বিরোধী সবচেয়ে সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি জামায়াতকে তারা মিত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ অর্থনীতির যোগসাজশে আশির দশক থেকে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো দ্রুত সমাজে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ক্ষমতার বিচারে এটি আওয়ামী লীগের দু:সময়, কিন্তু তখন সমাজ থেকে প্রগতিপন্থী সকল সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং বামদলগুলো বিএনপি-জাপার স্বৈরশাসন বিরোধী ব্যাপক আন্দোলন চালিয়ে গেছে। এ সময় এদের সাথে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। ফলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে থাকলেও সমাজে তাদের রাজনীতি এবং অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতির ধারাটিই ছিল মূলধারা, তাই শক্তিশালী। ওরা ক্ষমতা আঁকড়ে ছিল নিছক স্বৈরাচারী জবরদস্তির মাধ্যমে। ঐ সময় একাধিক নির্বাচনেও এটা পরিস্কার বোঝা গেছে ক্ষমতাসীনদের কারসাজিতে জনপ্রিয় ধারার পরাজয় ঘটছে।
দুর্ভাগ্যের বিষয় নব্বইয়ের গণআন্দোলনের বড় দুর্বলতা ছিল এর মাধ্যমে বিএনপি গণতান্ত্রিক দলের মর্যাদা পেয়ে যায় আর আওয়ামী লীগ ভোটের রাজনীতির জন্যে দলের নীতিতে রূপান্তর ঘটাতে শুরু করে। তবে তখনও সমাজে আওয়ামী লীগ ও অসাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহের ভূমিকা ও জোরই ছিল বেশি। কিন্তু ঠিক পরীক্ষামুখী শিক্ষার মতই ভোটকেন্দ্রিক রাজনীতি ক্রমে সংস্কৃতি থেকে বিযুক্ত হতে থাকল। দেখা গেল গণতান্ত্রিক আমলেই রাজনীতিতে পরিবর্তনের ধারাটা একতরফা ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে - জনগণ ক্রমেই উপেক্ষিত হয়েছে এবং হচ্ছে। কারণ দ্বিদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির সুস্থ ধারা তৈরির ঝুঁকি নিতে বড় দুই দলের কোনোটিই সাহস করল না। ফলে দিনে দিনে আমরা ক্ষমতাকে ঘিরে এক ভীতির রাজনীতির ফাঁদে আটকে যাচ্ছি।
ক্ষমতাবানই ভীতির রাজনীতির সূচনা করে থাকে এবং এদেশে তা শুরু হয়েছে জিয়ার মাধ্যমে। জিয়া ক্ষমতায় এসেছেন জেল হত্যার অব্যবহিত পরে এবং দেখা গেল তিনি এই হত্যাকারীদের - যারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুরও হত্যাকারী - সাথে দরকষাকষিতে অংশ নিয়েছেন এবং রফা হিসেবে তাদের রাষ্ট্রীয় চাকুরি দিয়েছেন তথা পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। ফলে তাঁর জন্যে ক্ষমতার বাইরে থেকে স্বাভাবিক রাজনীতি করার উপায় অন্তত মুক্তিযুদ্ধের ফসল এই বাংলাদেশে থাকল না। তাঁকে যুগপৎ নির্বাচন দিয়ে এবং ফলাফল সপক্ষে রেখে নিজের ক্ষমতা ও নিরাপত্তা সংহত করতে হয়েছে। একদল মাথা গরম সেনা কর্মকর্তার অবিমৃষ্যকারিতার শিকার হয়ে জিয়া নিহত (তথা ক্ষমতাচ্যুত) হওয়ায় শহীদের মর্যাদায়, অন্তত সমাজের একটা অংশের কাছে, আদৃত হতে থাকলেন। নতুবা তাঁর পক্ষেও স্বৈরাচারী শাসনের দায়ে বিচার এড়ানো সম্ভব হত না। উত্তরাধিকারের রাজনীতিতে বেগম জিয়া এই নেতিবাচক ভীতির রাজনীতিকে টেনে এনেছেন। সুস্থ প্রতিপক্ষতার গণতান্ত্রিক রাজনীতির কথা তিনি বা তাঁর সঙ্গীরা কেউ ভাবেন নি। আর পঁচাত্তর-পরবর্তী ঘটনাগুলোর নির্যাস তো আওয়ামী লীগের জন্যে ছিল গরল। তা হজম করাকে দলের নতুন নেতৃত্ব নিজেদের অক্ষমতা তথা দুর্বলতার প্রকাশ গণ্য করেছে। তারা সর্বাত্মক প্রতিপক্ষতার পথ ধরেছেন। কিন্তু সেটি যে আদতে ভীতির মনস্তত্ত্বকেই প্রকাশ করে সেটা তারা মোটেও বিবেচনায় নেন নি।
বঙ্গবন্ধুসহ প্রথম প্রজন্মের আওয়ামী লীগ নেতাদের অধিকাংশ এসেছেন মুসলিম লীগ থেকে। তাঁরা ধর্মচর্চা করবেন এ তো স্বাভাবিক। তবে গণতান্ত্রিক রাজনীতি যে সেক্যুলার, ধর্মনিরপেক্ষ (ধর্মহীন নয়) সেটা তাঁরা জানতেন এবং মানতেন। কিন্তু ক্ষমতা হারানোর ভয়ে এখন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা প্রথমত ধর্মচর্চার বিষয়টিকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তুলেছেন এবং ওলামালীগ গঠন, হেফাজতকে প্রশ্রয় দেয়া, মুক্তচিন্তার সমালোচনা, মাদ্রাসাসহ শিক্ষার যুগোপযোগী আধুনিকায়নে অনীহার মাধ্যমে কট্টরপন্থা এবং ধর্মব্যবসায়ীদের সাথে কার্যকর কোনো ব্যবধান রাখছে না। তদুপরি গণতন্ত্র যে আদর্শিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার শর্তাধীন সেটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে যাচ্ছে। রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হলে সমাজ কোনোভাবেই ধর্মহীন হয় না, কারণ আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনজীবনে রাষ্ট্রের ভূমিকা থাকে ক্ষুদ্র পরিসরে, বৃহত্তর অংশে সমাজই দাপটের সাথে ভূমিকা পালন করে। মুশকিল হল, আমাদের রাজনৈতিকদলগুলো সরকার গঠন করে সমাজকেও রাষ্ট্রের অধীনস্থ করে সকল ক্ষমতা হস্তগত করতে চায়। সর্বাত্মক ক্ষমতার ভোগ-দখল ঠিক রাখার জন্যে জবাবদিহিতার পথ বন্ধ করতে হয় এবং তাতে খুলে যায় দুর্নীতির হাজারও পথ। তাই এদেশে গণতান্ত্রিক সরকার দ্রুত দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং সরকার প্রধানের একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
আদতে ভীতির রাজনীতি নিজস্ব তাগিদেই দলে একক ক্ষমতাধর ব্যক্তি তৈরি করে। এখানে সব ধরনের স্বাধীন মতামতের প্রতি ভীতি ও সন্দেহ কাজ করে। জঙ্গিবাদীদের হামলায় এবং সরকারের স্পষ্ট ঔদাসীন্যে এ সমাজে এ সময়টা মুক্তচিন্তা, প্রগতিচিন্তা ও উদারমানবতাবাদের জন্যে সবচেয়ে কঠিন দুঃসময়। এদিকে খোলামেলা মতামতের প্রতি ভীতি এতটা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দুই বড় দলের কোনোটিই মায় তাদের ছাত্র সংগঠনের কমিটি গঠনের দায়ও কাউন্সিলরদের হাতে দিতে সাহস পায় না। তাও ন্যস্ত হয় মূল দলপ্রধানের হাতে। সম্ভবত এগুলোর শাখা সংগঠনও নেত্রী বা তাঁর বিশ্বাসভাজনদের দ্বারাই গঠিত হয়। এভাবে ছাত্রকর্মীরা স্ব স্ব গ্রুপের লাঠিয়ালে পরিণত হয়। ভীতির সংস্কৃতিতে ক্ষমতা হারানোর ভয় জাঁকিয়ে বসে এবং ক্ষমতার জন্যে যে কোনো আপসই কাম্য হয়ে ওঠে। বড় দুই দলের ক্ষমতা হারানোর পারস্পরিক ভীতির মনস্তত্ত্বের মধ্যে যে ভূমিটি উর্বর হয়েছে তাহল ধর্মীয় মৌলবাদ। কারণ এই পুরো সময়টায় আন্তজার্তিকভাবে - অনেকটাই পশ্চিমের ভ্রান্ত নীতি ও স্বার্থান্ধ ভূমিকার কারণে - ইসলামি মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ পরিপুষ্ট হয়েছে। কিন্তু আমাদের তো আন্তর্জাতিক মদতের দোহাই দিয়ে পার পাওয়ার উপায় নেই। সমস্যা আমাদের সমাধানও আমাদেরই খুঁজে বার করতে হবে।
এর জন্যে বড় দুই দলকেই একে অপরের কাছ থেকে ক্ষমতা হারিয়েও স্বাভাবিক রাজনীতি চর্চার ভরসা পেতে হবে। তারা সে ভরসার জায়গা তৈরি করতে না পারলে গণতন্ত্রের বিকৃতি এবং ক্ষমতার (আদতে ভীতির) বিকার ঠেকানো যাবে না।

***



1 comment:

  1. কিন্তু ক্ষমতা হারানোর ভয়ে এখন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা প্রথমত ধর্মচর্চার বিষয়টিকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তুলেছেন এবং ওলামালীগ গঠন, হেফাজতকে প্রশ্রয় দেয়া, মুক্তচিন্তার সমালোচনা, মাদ্রাসাসহ শিক্ষার যুগোপযোগী আধুনিকায়নে অনীহার মাধ্যমে কট্টরপন্থা এবং ধর্মব্যবসায়ীদের সাথে কার্যকর কোনো ব্যবধান রাখছে না।-
    একদম সত্যি কথা-

    ReplyDelete