আবুল মোমেন
সামাজিক সমস্যাগুলো সাধারণত জটিল প্রকৃতির
হয়ে থাকে। সহজ ও দ্রুত সমাধান পাওয়া কঠিন। এই যে দেশে কিশোর অপরাধ এবং ধর্ষণ বাড়ছে,
সামগ্রিকভাবে লোভ-হিংসা-সন্ত্রাস বেড়ে চলেছে তার সবটাই ব্যক্তির বা মানুষের প্রবণতার
ফল নয়। পরিবেশ-প্রতিবেশের কথাও ভাবতে হবে। কিছুদিন আগেও এদেশে মানুষের জীবনে প্রকৃতির
প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। শিশু বয়স থেকেই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমাদের জীবনে প্রকৃতির
প্রভাব ছিল কার্যকর। এটি বাইরে থেকে সৌন্দর্য দেখার আলগা ব্যাপার নয়, জীবনযাপনের সাথে
জড়িয়ে থাকা অন্তর্গত বিষয়। শুনেছি একটি বাঘের ৫ বর্গমাইলের মত বিচরণ ক্ষেত্র প্রয়োজন
হয়, তেমনি লিঙ্গ-নির্বিশেষে শৈশব থেকে বার্ধক্য
পর্যন্ত মানুষেরও তো প্রয়োজন উপযুক্ত বিচরণক্ষেত্র। একসময় শিশু প্রয়োজনীয় জায়গা পেত
বলে বয়সোচিত স্বভাববশত দৌড়েই কোথাও যেত, গাছে চড়ত ফল খেতে, প্রজাপতি-ফড়িঙের সাথে নিত্য
খেলত। তার চোখে প্রকৃতি কেবল সৌন্দর্যের ডালি খুলে ধরত না, পরাগায়ন-অঙ্কুরোদ্গম, মঞ্জরির
ফলে রূপান্তর, কলি থেকে ফুল ফোটা, প্রাণীদের প্রেম-সঙ্গমসহ জীবনের নানা রহস্য খুলে
ধরত। পরে স্কুলের পড়ার সাথে চোখে দেখা অভিজ্ঞতা মিলিয়ে সে পরিণত হয়ে উঠত। আজকালকার
শহুরে ফ্ল্যাটবাড়ির মত ঘরের দরজা যখনতখন বন্ধ হয়ে বিচ্ছিন্নতা ও নি:সঙ্গতার সংকট তৈরি
করত না। ছোটদের পড়া-পরীক্ষা, বড়দের শ্রম-কাজ ছাড়া বাকি সময়টা ছিল গল্পগাছা, সাঁতারকাটা,
গানে-ক্রীড়ায় নিজের মত বিনোদনের জন্যে বরাদ্দ। জীবন কাটত অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে।
শিশু ও কিশোরদের মধ্যে বয়সোচিত যেসব শারীরিক চাহিদা তৈরি হয়, তার পেছনে যদি দুষ্টুমি-বদমাইশি
থাকেও তা প্রকৃতির সান্নিধ্যে নানা চ্যালেঞ্জ উৎরাতে গিয়ে খরচ হয়ে যেত। তাছাড়া সেই
গ্রামীণ, এমনকি মফস্বলি পরিবেশে সামাজিক জীবনে ছেলে-মেয়ে বা নারী-পুরুষ একেবারে বিচ্ছিন্ন
ছিল না, প্রায়ই কাজের সূত্রে, কখনো অবকাশের সময়ে বয়স্ক নারী-পুরুষ নিজেদের মধ্যে সহজ
সুস্থ সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখতেন। আত্মীয়তায় কিছু সম্পর্কই ছিল যার ভিত্তি ঠাট্টা
ও রঙ্গ। অনেক নারী ছিলেন এতে তুখোড়। এর মধ্যে উভয়ের জন্যে সৃজনশীলতার যেমন সুযোগ থাকে
তেমনি তাতে অপর লিঙ্গের সাথে সহজ মেলামেশার সাবলীল সুস্থতাও বজায় থাকত। এমন পরিবেশেও
কখনো যে ব্যত্যয় ঘটত না তা নয়। তবে ব্যত্যয় তো ব্যত্যয়ই, দুর্ঘটনাই। এখনকার মত ঠাণ্ডা
মাথার নীল নকশার অমানবিক বর্বরতা তখন অকল্পনীয় ছিল।
রুশো ও রবীন্দ্রনাথসহ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ-দার্শনিকগণ
বারবার বলেছেন প্রকৃতি মানুষের শ্রেষ্ঠ পাঠশালা। এটি প্রথম ও আদি পাঠশালা। মনে রাখা
দরকার যে-পশ্চিমকে আমরা প্রায় অন্ধভাবে অনুকরণ করছি তারা কিন্তু নগরকে প্রকৃতিবঞ্চিত
করে নি, করে না। ইদানীং বরং অনেক নগরীতে রীতিমত
প্রাকৃতিক বনও রাখা হচ্ছে, পার্কগুলো কেবল রাইডে ঠাসা নয়, প্রকৃতির নানা উপাদানে সাজানো
যা মানুষের শরীর-মনকে আরাম দেয়, শান্ত রাখে। মার্কিন দার্শনিক এমার্সন প্রকৃতির মধ্যে
যে আধ্যাত্মিক আনন্দ মেলে মানব-জীবনে তার ইতিবাচক ভূমিকাকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী এবারে নির্বাচিত হয়ে বলেছেন
গ্রামও নগর হয়ে উঠবে। প্রশ্ন হল কোন নগর? যে নগর মাঠ, উঠান, খোলা প্রাঙ্গণ কেড়ে নেয়? যেখানে প্রকৃতির অনুক্ষণ
চলমান জীবনলীলা থেকে শিশু-বালক-যুবা-বৃদ্ধদের বঞ্চিত রাখা হয়? যেখানে সমাজজীবন ভেঙে
দিয়ে সব স্বাভাবিক সম্পর্কের অবসান ঘটে? যেখানে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই বিচ্ছিন্নতা
ও নি:সঙ্গতার শিকার হচ্ছে? নাগরিক জীবনে যেসব বিনোদনের ব্যবস্থা থাকা দরকার আজ তা খুবই
অল্প আছে, যা আছে তা অত্যন্ত চড়ামূল্যে ভোগ করতে হয়। আমরা আম নাগরিকদের জন্যে শস্তার
সিনেমাও তো চালু রাখতে পারি নি। সারাদেশের সবার জন্যে নিশ্চিত করা দরকার মানসম্পন্ন
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা, উপার্জনের পথ এবং বিনোদনের মাধ্যম। এগুলো ছাড়া পথঘাট, ফ্ল্যাটবাড়ি,
পয়:নিষ্কাশন, সেতু-কালভার্ট, এমনকি স্কুল-মাদ্রাসাও উন্নত মানুষের নিশ্চয়তা দিতে পারবে
না। ব্যক্তিপুরুষের জীবনে যদি যৌনতাই বিনোদনের, পৌরুষও শৌর্য-বীর্য প্রকাশের একমাত্র
ক্ষেত্র হয়ে ওঠে তাহলে সেই সমাজে এমন অনাচার ঠেকানো মুশকিল হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে আমরা দেখছি
অভিভাবকদের মধ্যে আজকাল যেমন সন্তানকে গল্প বলার তেমনি শিল্পকলার রসগ্রহণের ক্ষমতা
কেবলই কমছে, এমনকি নিজেদের মধ্যে রঙ্গ-রসিকতার সামর্থ্য ও রুচিও ক্রমহ্রাসমান। একটু
খেয়াল করলেই দেখা যাবে সন্তানের জন্মদিন, পরীক্ষার ভালো ফল, নিজেদের বিবাহবার্ষিকী
ইত্যাদিসহ সকল উদযাপনের একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠছে খাওয়া - ভূরিভোজ। খাওয়ার সাথে পাল্লা
দিচ্ছে কেনাকাটা, গৃহসজ্জা, নিজেদের পোশাক অলঙ্কার ইত্যাদি। এসব স্থূল চাহিদা চরিতার্থ
করতে বড়লোকেরা ছুটছেন বিদেশে। রঙ্গরসিকতার বা শিল্পকলার রস উপভোগের আগ্রহ/ক্ষমতা নেই
বললেই চলে। মিশেল ফুকো তাঁর তিন খণ্ডের বিখ্যাত গ্রন্থ দ্যা হিস্ট্রি অব সেক্সুয়ালিটির
(যৌনতার ইতিহাস) সূচনাতেই ইউরোপে নারী-পুরুষ সম্পর্ক এবং যৌনতার সকল বিষয় নিয়ে ভিক্টোরীয়
মূল্যবোধের প্রভাবে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে যে গোপনীয়তার সংস্কৃতি চালু হয়েছে তাকে পরবর্তীকালের
বিপর্যয়ের জন্যে দায়ি করেছেন।
অপরাধ ও ধর্ষণে যেহেতু ছেলেরাই বেশি জড়িয়ে
পড়ছে তাই তাদের কথাই বলি আজকে। নারীবাদী লেখিকা আঁদ্রিয়া নাঈ তো বলেই বসেছেন - পুরুষ
জৈবিকভাবে ধর্ষণে সক্ষম, তাই সে ধর্ষণ করে। ধর্ষণ ঠেকাতে আমরা পুরুষকে নির্বাসনে পাঠাতে
পারব না, কিন্তু তার ধর্ষণপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। যে বয়সে বালকের যৌন প্রবৃত্তি
ও বোধ জাগে তখন যদি তাকে প্রকৃতি ও সংস্কৃতির স্বাভাবিক আবহ থেকে বঞ্চিত করে সংকীর্ণ
গণ্ডিতে বন্দি করি তবে তার মধ্যেও বুল ফাইটের ষাঁড়ের মত পুঞ্জিভূত কাম-ক্রোধ-লোভ জমবে,
যা যে কোনো সুযোগেই আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। শিশু ও বালকের জীবন থেকে মাঠ ও প্রকৃতি,
আকাশ-জল-আলো-হাওয়া কেড়ে নিয়ে তাদের ফ্ল্যাটে, স্কুলে, কোচিং সেন্টারে এবং পড়া মুখস্থ
ও পরীক্ষা তথা জিপিএ৫-এর কারাগারে বন্দিজীবন কাটাতে বাধ্য করা হচ্ছে। এটি কখনো সশ্রম
কারাদ-, কখনো ফাঁসির আসামির মত নির্জন কনডেম সেলের জীবন। তাদের জীবনে নিছক অবকাশ, নাটক-গান,
খেলা-সৃজনশীল আনন্দে কাটানোর সময় নেই বললেই চলে। অবকাশহীন তাদের এ জীবন, একঘেয়ে, গতানুগতিক।
শিশুরা কারো নেতৃত্বে-নির্দেশনায় অধিকাংশ সময় কাটাবে বটেই, কিন্তু সেটি তাদের স্বাধীনতা,
সৃজনশীলতা, সম্পর্ক তৈরির সহজাত প্রবণতা ইত্যাদির প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ালে এর চেয়ে মন্দ
আর কিছু হতে পারে না। আমাদের সংসারে, স্কুলে মন্দ কাজটাই নিয়মে দাঁড়িয়েছে।
আমরা যে কোনো সমস্যা কাটাতে কঠোর আইন আর
কঠোর শাস্তির দ্বারস্থ হতে চাইছি। তাতে আপত্তি নেই, কিন্তু তা থাকবে ধর্ষণ ও খুনের
মত অপরাধের জন্যে। কিন্তু শিশুর মানুষ হওয়ার পথরুদ্ধ করে ক্রসফায়ারে বিপুল মানুষ মেরেও
তো কিশোর অপরাধ ও ধর্ষণের সংকট থেকে বেরুনো যাবে না। নৈতিকতার বাণী দুবেলা কানের কাছে
কপচে গেলেও কাজ হবে না। বিধাতাই তাকে শরীর দিয়েছেন, শরীরে-মনে চাঞ্চল্য সৃষ্টির উৎস
দিয়েছেন। তাকে ইন্দ্রিয়, প্রবৃত্তি ও হরমোন গ্রন্থি দিয়েছেন যা তার মধ্যে অপর লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণের বোধ তৈরি করে। একি তার অনভিপ্রেত
কোনো বিকার? নিশ্চয় নয়। দরকার যথাসময়ে তাকে সঠিক পরামর্শ দেওয়া, খুব গুরুত্বপূর্ণ হল
সংবেদনশীল সাহচর্য। যিশুখ্রিষ্টের দ্বাদশ শিষ্যের অন্যতম সেন্ট অগাস্টিনের জবানবন্দি
পড়লে জানা যাবে বয়:সন্ধিকালে যৌনচেতনা জাগার পরে তিনি কি কষ্ট পেয়েছেন, কীরকম পাপবোধ
ও মনোযাতনায় ভুগেছিলেন। ষাটের দশকে পড়েছিলাম ব্রিটিশ লেখক কলিন উইলসনের বহুল পঠিত বই
সেক্স অ্যা- দ্য ইন্টেলিজেন্ট টিনেজার (যৌনতা ও বুদ্ধিমান বালক)। ঝাপসা মনে পড়ছে এতে
নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে চালাকচতুর বালকের যৌনতা মোকাবিলার অভিজ্ঞতার বয়ান ছিল। টলস্টয় ও মহাত্মা গান্ধী তাঁদের আত্মজৈবনিক বইয়ে
কম বয়সে যৌনতায় নিজেদের বিহ্বলতা-বিড়ম্বনার কথা খুলে বলেছেন। তাঁরা কেউই পথ হারান নি,
কারণ জীবনে আরো বহুতর ক্ষেত্র ক্রমেই উন্মোচিত হয়েছে তাঁদের জীবনে। তাছাড়া তাঁরা বড়
আদর্শের সন্ধান পেয়েছিলেন এবং মানুষের কল্যাণে বড় মাপের চিরস্থায়ী কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
বালক বয়সে মানুষ বীর হতে চায়, বড় মাপের বীরত্বব্যঞ্জক কাজ করে তাদের অহং তৃপ্ত হয়।
তাই ক্ষুদিরাম বসুরা ১৪ বছরেরই হয়, কিশোর রুমিরা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হতে ছুটে যায়। আর
পথ প্রদর্শকের অভাবে অনেকেই উইপোকার মত আগুনে ঝাঁপ দিয়ে পুড়ে মরে।
স্কুলে স্কুলে গিয়ে খবর নিয়ে জেনেছি আজকাল
ছেলেরা সুযোগ পেলেই আনরুলি বা উশৃঙ্খল হয়ে ওঠে। শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষের শৃঙ্খলা রাখতে
হিমশিম খান। তাঁদের হাতে একমাত্র অস্ত্র পড়া ও পরীক্ষার চাপ প্রয়োগ - অর্থাৎ কড়া আইন
ও কঠিন শাস্তির মত তাঁরাও কঠিন পড়া ও কঠিন পরীক্ষার চাপই প্রয়োগ করছেন। হয়ত ক্রসফায়ারের
মত টিসি ধরিয়ে বিদায় দিচ্ছেন কেউ কেউ। এতো সমাধান নয়। তাদের এ বয়সে নিজের ক্ষুদ্র গণ্ডি
ছাপিয়ে ভাবার ও করার মত আদর্শ, দর্শন এবং কর্মের জোগান দিতে হবে।
সমাধানের কাজ খুব যে জটিল ও সুদূরপ্রসারী
তা নয়। শিশু ও বালকরা তাদের বাস্তবের নায়কদের, প্রেরণাদায়ী আদর্শ ও কাজ খুঁজে ফিরছে।
কিন্তু সমাজ তাদের সামনে প্রকৃত নায়ক - তিনি নারীও হতে পারেন, বরং এ বয়েসি ছেলেদের
জীবনে নেত্রী হিসেবে তরুণীই বেশি কার্যকর - হাজির করতে পারছে না। ব্যর্থ হচ্ছে উপযুক্ত
আদর্শ ও কাজের সন্ধান দিতে। যেদিন সমাজ এর গুরুত্ব বুঝবে, অস্ত্রবাজ, টেণ্ডারবাজ, ক্ষমতান্ধদের
সরিয়ে আদর্শবাদী, জ্ঞানী, সৃজনশীল, ত্যাগী তরুণ-তরুণীদের সামনে আসার সুযোগ করে দেবে
সেদিনই সমাজের আরোগ্য লাভ শুরু হবে। একবার আরোগ্যের সঠিক ঔষধ পেলে শরীরের রোগ যেমন
সারতে সময় লাগে না, সমাজের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই।
***