আবুল
মোমেন
ইদানীং
দেশে সাফল্য চর্চার ও সাফল্যের আপন ঢোলটি বাজানোর প্রতিযোগিতা চলছে। গণমাধ্যম হন্যে
হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে সাফল্যের কাহিনি, এর নায়ক এবং নায়িকাদের।
না,
এতে দোষের কিছু নেই। কেবল প্রশ্ন হল, কে কোন্ মানদণ্ডে সফল, মানদ- কীভাবে কারা স্থির
করছেন? শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের সাম্প্রতিক সাফল্যের কথা জোর গলায় সবাই বলে যাচ্ছি,
কিন্তু তলিয়ে দেখলে সত্যিই কি সাফল্যেরই চিত্র ফুটে ওঠে? গবেষণা ভিন্ন কথা বলছে। কেননা
শিক্ষা তো শিক্ষাই। পিএসসিতে জিপিএ৫ কত লক্ষ জন পেল তারও চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল
ঐ স্তরের অর্জন-লক্ষ্যগুলো তাদের ঠিকঠাক মতো অর্জিত হয়েছে কিনা। প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে
কাজ করে এমন একাধিক সংস্থার সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যাচ্ছে ২০১৪ সনে প্রাথমিক সমাপনীতে
৪২% ছাত্র ইংরেজিতে ঈ-উ মান পেয়েছে, অংকে অর্ধেকের বেশি ছাত্রের অবস্থা খারাপ, মাতৃভাষাতেও
অর্জন-মান ভালো নয়। মাদ্রাসার ছাত্ররা আরবিসহ তিন ভাষাতেই অদক্ষতা নিয়ে পাশ করেছে।
তারও চেয়ে ভয়াবহ বিষয় হল যেসব ছাত্র নানাবিধ কোচিং, প্রাইভেট টিউটর, নোটবই, গাইডবই
নির্ভর করে পড়েছে অর্থাৎ কেবল স্কুলের ওপর নির্ভর করে থাকে নি, তারাই ফলাফল ভালো করেছে।
এর অর্থ একদিকে বিনিয়োগে সমর্থ পরিবারের ছেলেমেয়েরা ভালো করছে আর অন্যদিকে স্কুলগুলো
ছাত্রদের দক্ষ করে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে।
কিন্তু
পিএসসি নিয়ে আসল উদ্বেগ হল শিশুবয়সে জিপিএ৫ অর্থাৎ সাফল্যের দৌড়ে লিপ্ত হয়ে পড়ায় ছেলেমেয়রা - প্রধান শিক্ষকদের ভাষ্য অনুযায়ী - প্রচণ্ড চাপের মধ্যে পড়ে গেছে, এতে প্রকৃত শিক্ষা
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অথচ পরীক্ষায় পাশ করা সহজ হয়ে যাচ্ছে, শিক্ষায় পারিবারিক ব্যয় বাড়ছে
এবং পুরো শিক্ষাই পরীক্ষাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে, মুখস্থ ও নোটবই-কোচিং-নির্ভরতা বেড়ে চলেছে।
বস্তুতপক্ষে আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই, একেবারে প্রথম শ্রেণি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত,
সম্পূর্ণ পরীক্ষা-কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। তাতে ছাত্ররা আদতে সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তরই
শেখে। ফলে কোনো বিষয়েই তাদের পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জিত হয় না। এটি পরীক্ষায় পাশ করা এবং
জিপিএ৫ পাওয়ার পদ্ধতি হতে পারে, কিন্তু জ্ঞানার্জনের পথ হতে পারে না। এভাবে জ্ঞানভিত্তিক
সমাজ তৈরি সম্ভব নয়।
এই
ব্যবস্থার ভিতর দিয়েও কিছু মেধাবী ছাত্র বেরিয়ে আসতে পারে, তারা দেশে-বিদেশে স্বদেশের
মুখ উজ্জ্বল করে। আমরা গৌরবের সাথে তাদের সাফল্য উদযাপন করতে থাকি। অমর্ত্য সেন তাঁর
সর্বশেষ গ্রন্থ দ্য কান্ট্রি অব ফার্স্ট বয়েজ-এ একে নাম দিয়েছেন ফার্স্ট বয় সিনড্রোম।
এ প্রবণতার ফলে শিক্ষায় আম ছাত্রদের অন্তত প্রাথমিকের সকল অর্জন-লক্ষ্য পূরণ এবং শিক্ষায়
সবার জন্যে সমান সুযোগ সৃষ্টির মত দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। অথচ
জাতিসঙ্ঘ, ইউনেস্কো এবং ইউনিসেফের সদস্য-রাষ্ট্র হিসেবে এবং শিশু অধিকার সনদের স্বাক্ষরকারী
দেশ হিসেবে এসব দিকে নজর দেওয়ার কথা ছিল। সেই সনদ অনুযায়ী (আর্টিকেল ৩১) আমরা তো তাদের
খেলাধূলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, শিল্পচর্চা ও অন্যান্য বিনোদনমূলক ব্যবস্থা করে দেওয়ার
জন্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু আমরা বরং শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে তাদের সেসব অধিকার
একে একে হরণ করে নিচ্ছি। এসবই পিএসসি-জেএসসি এবং জিপিএ-৫ এর দৌরাত্ম্যের নিষ্ঠুর ফলাফল।
আমরা দৃশ্যমান সাফল্যের পিছনে ছুটতে ছুটতে তার পেছনে লুকিয়ে থাকা অদৃশ্যপ্রায় কিন্তু
নিতান্ত বাস্তব সংকটগুলো দেখতে পাই না বা দেখতে চাই না। কিন্তু তার প্রতিফল তো দীর্ঘমেয়াদী
এবং ভয়ঙ্কর। কারো শৈশব যদি ভয়ঙ্কর চাপের মধ্য দিয়ে কাটে এবং যে সাফল্যের জন্যে সে
চাপটা নেয় তা যথাযথভাবে অর্জিত না হলে তার মনের অবস্থা কী হতে পারে আমরা কি সেটা ভাবি?
অধিকাংশের জন্যে এটাই তো পরিণতি। যে শিশু না খেলে না গেয়ে না এঁকে তার কল্পনাকে না
ছুটিয়ে, অবসরকে ইচ্ছামতো একটু না কাটিয়ে কেবল পরীক্ষার প্রস্তুতিতে আর পরীক্ষা দিয়ে
কাটায় তার মনে কত ক্ষোভ কত বেদনা কত হীনম্মন্যতার বীজ জমা হয় তা আমরা খেয়াল করি না।
কেবল বলি সমাজে এত অস্থিরতা কেন, সবাই কেন স্বার্থপর হয়ে উঠছে, হয়ে পড়ছে হিংসুটে ঝগড়াটে,
স্বার্থপর এবং নিষ্ঠুর? কেনইবা বাড়ছে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ?
আমাদের
সমাজে গবেষণার গুরুত্ব নেই বললেই চলে। ফলে বর্তমান কাজের পরিণতি বুঝতে পারি দূর ভবিষ্যতে
যখন ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে যায়। ফলে তাৎক্ষণিক সাফল্য দেখাতে পারলেও আখেরে খুব লাভ
হয় না আমাদের।
বিনামূূল্যে
সবার জন্যে প্রাথমিক শিক্ষা দিতে আমরা সাংবিধানিকভাবেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, কিন্তু এ প্রতিশ্রুতি
কীভাবে পালন করব তা তো কেবল ঘোষণার বিষয় নয়, কর্ম ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনা এবং দেশের
বাস্তব অবস্থার ভিত্তিতেই নির্ধারণ করতে হবে। শিক্ষা মূলত একটি সামাজিক কাজ। অর্থনৈতিকভাবে
বহুধাবিভক্ত এ সমাজে নানা রকম বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। সরকারও দীর্ঘকাল ধরে তার সাথে তাল
মিলিয়েই চলেছে। ফলে শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারও বৈষম্য ও বিভক্তিকে জিইয়ে রাখছে। প্রাথমিক
পর্যন্ত অন্তত একধারায় শিক্ষা প্রচলনের অঙ্গীকার পূরণে সরকার হাল ছেড়ে দিয়েছে বলেই
মনে হয়। মাধ্যমিকেও সরকারই বৈষম্য পুষছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের (ব্যানবেইজ) জরিপেই দেখা
যাচ্ছে ক্যাডেট কলেজে ছাত্রপিছু সরকারের বার্ষিক ব্যয় যা বেসরকারি স্কুলে তা কুড়ি ভাগের
এক ভাগও নয়। এতটা বৈষম্য রেখে মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়া কি সম্ভব! আজ পর্যন্ত কিছুতেই
আমরা শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জাতীয় আয়ের অভীষ্ট ৬ শতাংশে পৌঁছুতে পারলাম না। তা রয়েছে
৩ শতাংশের কাছাকাছি। এ সরকার শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে যে আশাবাদ সৃষ্টি করেছিলেন আজ ছয়
বছর পরেও তার মৌলিক সুপারিশ পূরণে এগুনো যায় নি।
সরকার
মাধ্যমিক পর্যন্ত সব ছাত্রকে প্রতি বছর বিনামূল্যে বই দিচ্ছেন। এটা একটি চমকপ্রদ অর্জন
নিঃসন্দেহে। কিন্তু এর কয়েকটি দিক নিয়ে সত্যিই ভাবা দরকার। সত্যিকারের শিক্ষিত মানুষ
তথা শিক্ষিত জাতি তৈরি করতে হলে তাদের পড়াশুনা কেবল পাঠ্য বইয়ের মধ্যে সীমিত করে রাখলে
চলবে না। কিন্তু আশৈশব পড়াশুনার যে পরীক্ষাকেন্দ্রিক পদ্ধতির ভিতর দিয়ে তারা বেড়ে ওঠে
তাতে আমাদের বাস্তবতা হল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত
কেউই আর পাঠ্যবইও পড়ে না, অন্য বই পড়া দূরের কথা। তারা কেবল প্রশ্নের উত্তর শেখে। বস্তুতপক্ষে
এই প্রক্রিয়ায় কারো পাঠাভ্যাস তৈরি হয় না। অমর্ত্য সেন তাঁর পূর্বোক্ত বইয়ের নাম প্রবন্ধে দেখিয়েছেন উনিশশতকের মাঝামাঝি (১৮৭২)
জাপানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যখন শুরু হয় তখন তাদের দেশে বইয়ের প্রকাশনায় বিপ্লব ঘটে যায়। দেখা যাচ্ছে ১৯১৩ নাগাদ, যখন জাপান যুক্তরাষ্ট্র
বা ব্রিটেনের চেয়ে অনেক দরিদ্র, তখনই ব্রিটেনের চেয়ে অনেক বেশি এবং আমেরিকার চেয়ে দ্বিগুণেরও
বেশি বই ছাপছে। যদিও তাদের জনসংখ্যা তখন যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেকেরও কম।
ফলে
এ প্রসঙ্গে আমার দ্বিতীয় বক্তব্য হল, যেহেতু একদিকে সরকারের সামর্থ্য সীমিত আর অন্যদিকে
অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে এবং সচেতনতা বাড়ার ফলে সন্তানের
শিক্ষায় বিনিয়োগে আগ্রহ বেড়েছে তাই সকলকে বিনামূল্যে বই দেওয়ার অর্থ হয় না। নয়ত এবারের
মত বইয়ের মুদ্রণ-বাঁধাইয়ের মান খারাপ হওয়া ঠেকানো যাবে না। এ বছর অনেক বই শিশুরা পুরো
বছর টেকাতে পারবে না, কোনো কোনো বই পড়া দুষ্কর। বরং স্কুলভিত্তিক জরিপ চালিয়ে শুধুমাত্র
অভাবী পরিবারের সন্তানদেরই বিনামূল্যের বই দেওয়া উচিত। আর সামর্থ্যরে ভিত্তিতে বইয়ের
মূল্য প্রদানে সরকার অভিভাবকদের বিভিন্ন মাত্রায় রেয়াত দিতে পারেন। তাতে যে সাশ্রয়
হবে সে টাকা শিশু-কিশোরদের উপযোগী বইয়ের প্রকাশনায় ভতুর্কি দেওয়া যায়, স্কুলে স্কুলে
পাঠাগার গঠনে বিনিয়োগ করা যায়।
বই
নিয়ে তৃতীয় কথাটি হল - প্রতি বছর নতুন বই দিতেই হবে? আমাদের বহুকালের সংস্কৃতি হল বৃহত্তর
পরিবারের বড় জনের বই ছোটরা পড়বে, এমনকি স্কুল উদ্যোগী হয়ে বই সংরক্ষণ করে তা বিতরণও
করতে পারে। এ জন্যে বইয়ের কাগজ ও ছাপা-বাঁধাইয়ের মান উন্নত হতে হবে। তবে এ ব্যয় বছর
বছর সকলকে বিনামূল্যে সব বই দেওয়ার চেয়ে অনেক কম হবে, কিন্তু উপকার হবে ঢের বেশি। শুধু
যে বছর পাঠক্রমে পরিবর্তন আসবে সে বছর সবার জন্যে নতুন বই ছাপালেই চলবে।
এতে
চতুর্থ বিষয়টি পরিষ্কার হবে। এ বিষয়ে অধ্যাপক কায়কোবাদ প্রথম আলোয় তাঁর সাম্প্রতিক
একটি লেখায় আলোকপাত করেছেন। আমি আরেকটু যোগ করছি। সম্প্রতি একটি জার্মান গবেষণাপত্রে
পড়েছিলাম সহনীয় মাত্রার পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারও নিষিদ্ধ করে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে
শুধু কাগজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে বছরে বন কাটার পরিমাণ যে হারে বাড়বে তাতে কয়েক
বছরেই বিশ্ব বনশূন্য হয়ে যাবে। শুধু তা নয়, কাগজ তৈরি করতে যেসব রাসায়নিক ব্যবহার হয়
তা বর্জ্য হয়ে পানিতে মেশে এবং ফলে নদী ও জলাশয় দূষণের মাত্রা দ্রুত বাড়তে থাকবে। তাই
জোর দিতে হবে পুনর্ব্যবহারযোগ্য পলিথিন ব্যবহারের ওপর আর মানুষকে শেখাতে হবে ব্যবহৃত
ব্যাগ যথাস্থানে পরিত্যাগের বিষয়টি। সম্প্রতি বিবিসিতে ফিচার ছবি দেখেছিলাম ভারতে কীভাবে
ব্যবহৃত পলিথন সংগৃহীত হয় এবং তা পুনরায় ব্যবহার করে মগ, জগ ও অন্যান্য সামগ্রী তৈরি
হয়।
সাফল্যের
ঝলক দিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে চিন্তাকে বিরাম দিয়ে লাভ নেই, আমাদের চাই টেকসই সাফল্য, ফার্স্টবয় সিনড্রোমে (এ ক্ষেত্রে জিপিএ৫ সিনড্রোম)
না ভুগে বিবেচনায় নিতে হবে সবার স্বার্থ, সবার সাফল্যকে। বিবেচনায় নিতে হবে দূর ভবিষ্যতের
পরিণতিও। তবেই শিক্ষাচিন্তায় কেন বনের গাছের কথা, দেশের নদীর কথাও প্রাসঙ্গিক তা আমাদের
বিবেচনায় আসবে।
***