Monday, October 19, 2015

শিক্ষামন্ত্রীর অসহায়তা ও হতাশা

আবুল মোমেন

পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে উদ্ভূত সমস্যাকে সরকার পাশ কাটাতে চাইছে। শিক্ষামন্ত্রীর একটি মন্তব্যে বোঝা যায় তাঁরা অনন্যোপায়। সম্প্রতি তিনি বলেছেন - যত সুপার টেকনোলজি ব্যবহার করা হোক না কেন প্রশ্নপত্র ফাঁস পুরোপুরি ঠেকানো যাবে না। যারা অপরাধী তারা সুপার টেকনোলজির চেয়েও এগিয়ে থাকে (দৈনিক ইত্তেফাক, ৩ অক্টোবর, ২০১৫)। শিক্ষামন্ত্রীর কথায় ফাঁসের সত্যতার স্বীকৃতি মেলে, যদিও স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় অস্বীকৃতির সংস্কৃতি ধরেই চলছে।
যে তরুণরা ফাঁস হওয়া প্রশ্নের ভিত্তিতে গৃহীত পরীক্ষা বাতিলের দাবি তুলেছে তাদের দাবির নৈতিক ন্যায্যতা অনস্বীকার্য। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা থেকে আমরা বুঝতে পারি এখানে আদতে কচি-মাথার নীতিবোধ আর পাকা-মাথার বাস্তববুদ্ধির টানাপোড়েন চলছে।
সরকার হয়ত ভাবছে এ পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করা হলে কৃতকার্য হয়ে ভর্তি হওয়া ছাত্ররা না পাল্টা আন্দোলনে নামে। রীতিমত সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে পড়ে যাবে সরকার। এই সম্ভাব্য বিপদ তারা ডেকে আনতে চাইছে না।
নাগরিকসমাজ নিশ্চয় ফাঁস বা দুর্নীতিমুক্ত পরীক্ষা এবং নৈতিক ন্যায্যতার পক্ষেই থাকবে। কিন্তু এটি একটি ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন বলে ক্ষতিগ্রস্ত অকৃতকার্য ছাত্রদের পক্ষে ব্যাপক ছাত্র-তরুণ ও নাগরিকসমাজের সক্রিয় ভূমিকা ঘটবে কিনা সন্দেহ। নৈতিকভাবে দুর্বল সমাজ অনবরত ছোটবড় নৈতিক ত্রুটিকে উপেক্ষা করে এবং আপস করেই চলতে অভ্যস্ত।
শিক্ষামন্ত্রী তাঁর সততার ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রেখেছেন, যা আজকের দিনে রাজনীতিবিদদের মধ্যে দুর্লভ। তাঁর সরল উক্তির মধ্যে এ সমাজে সৎ মানুষের অসহায়তা ফুটে উঠেছে। এইখানে আমি মনে করি নাগরিকসমাজের দায়িত্ব রয়েছে। কেননা সমাজে সততা অসহায় এতিম থাকবে, বিশেষত শিক্ষার ক্ষেত্রে, এটা কি মেনে নেওয়া যায়?
অন্যান্য ক্ষেত্রের কায়েমি স্বার্থের তুলনায় পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের দুর্নীতির ফলাফলে পার্থক্য রয়েছে। এর সাথে একদিকে ছাত্র-তরুণদের বৈষয়িক ও নৈতিক স্বার্থ জড়িত আর অন্যদিকে শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটির প্রশ্ন যুক্ত। আমরা অনেক কাল ধরে বলে আসছি শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য যদি হয়ে ওঠে পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া তাহলে শিক্ষা নিয়ে দুর্নীতির চক্র সহজে ভাঙা যাবে না। কিন্তু পাকেচক্রে আমরা সেই চক্রের জালেই আটকেছি। আজকে গোটা শিক্ষাব্যবস্থা - প্রাথমিক থেকে  - স্নাতকোত্তর পর্যন্ত - মূলত সম্পূর্ণভাবে পরীক্ষাকেন্ত্রিক হয়ে পড়েছে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে পরীক্ষার সম্পর্ক যে অঙ্গাঙ্গী, অন্যোন্যনির্ভর, তা সকলেই মানবেন। বিভিন্ন পর্বান্তে বা চূড়ান্ত পর্বের শেষে সনদ ও ডিগ্রি শিক্ষার ফসল বৈকি। কিন্তু তার মূল্য কি ব্যক্তিনিরপেক্ষ, অর্থাৎ মানুষটির চাইতেও বেশি?
শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের ধারণা এবং অনুসৃত নীতির কারণে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই আজ পরীক্ষাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। এ কারণে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সকলেরই একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে পড়েছে পরীক্ষার ফলাফল। ফলাফল-নিবেদিত ব্যবস্থায় পরীক্ষায় সফল হওয়ার জন্যে উল্লিখিত ত্রিপক্ষ সবসময় মরিয়া হয়ে থাকে। সবাই যেন রেসের ঘোড়া - প্রথম হওয়ার জন্যে টগবগ করে ছুটছে। জয়ের জন্যে সবার সম্মিলিত উদগ্র চাহিদার ফলে পরীক্ষাকে ঘিরে জুয়াড়িদের আবির্ভাব হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সফল হওয়ার সহজ ও কার্যকর পন্থার সন্ধান করতে করতে স্কুলকেও পাশ কাটিয়ে পরীক্ষায় সিদ্ধিলাভের দক্ষ মোক্ষম পদ্ধতি ও ক্ষেত্র তৈরি করে নিয়েছে এই আক্কেলমন্দরা - তার নৈতিক ভিত্তি না থাকুক। গড়ে উঠেছে নোটবই ব্যবসা কোচিং সেন্টার এবং মডেল টেস্ট পদ্ধতি। মানতেই হবে বাজার অর্থনীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ব্যবস্থা। এখন উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ছাত্রদের ফরজ কাজ - নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শ্রেণিকক্ষে পাঠগ্রহণ নয় - কোচিং সেন্টারে উপস্থিত থাকা ও অবিরত মডেল টেস্ট দিয়ে পরীক্ষার্থী হিসেবে দক্ষ ও পোক্ত হয়ে ওঠা। নকল বন্ধের জন্যে নোটবই বন্ধ করার জেহাদে নেমেছিলেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, কিন্তু ব্যবস্থার কারণে পরীক্ষার্থীদের ক্রমবর্ধমান ক্ষুধা ও চাহিদা মেটাতে শিক্ষা-জুয়াড়িদের নোটবইসহ সব ব্যবসা বেশ জাঁকিয়েই চলছে। 
এভাবে আমরা একেবারে নিচের শ্রেণি থেকে ছাত্রদের শিক্ষার্থী সত্তার অকালমৃত্যু ঘটিয়ে তাদের পরীক্ষার্থী সত্তার বিকাশ ঘটাচ্ছি - সেটা শেষ পর্যন্ত উগ্র রূপই ধারণ করে এবং পরিণতিতে মানবিক মূল্যবোধ, সামান্য নীতিবোধেরও আকাল দেখা দেয়। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি একে অন্যের দেখাদেখি ভীত-বিভ্রান্ত অভিভাবকরা কোনো ঝুঁকিতে যেতে চান না। একেবারে প্রথম শ্রেণি থেকেই সন্তানকে কোচিং সেন্টারের বা বাড়তি গৃহশিক্ষকের জিম্মায় দিয়ে হাঁপ ছাড়েন। পুরো স্কুল জীবনে পিএসসি-জেএসসি-এসএসসি শিশুর অবসর, বিনোদন, খেলাধূলা, বেড়ানো, সৃজনশীল কাজ, সাহিত্যপাঠ, এমনকি বাবা-মা-স্বজনদের সাথে নির্মল সময় কাটানো সবকিছুই শিকেয় ওঠে। এভাবে কেবল ছাত্রের মানুষ হওয়া কঠিন হচ্ছে তা নয়, সংশ্লিষ্টদের এবং এই তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে সৃষ্ট ভাগ্যান্বেষণের সুযোগ নিতে তৎপর ‘বুদ্ধিমানদের’ মন্যুষ্যত্ব বোধ ক্রমেই বিলুপ্ত হবে। ফলে প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা দুর্নীতি পিছু ছাড়বে না।
এভাবে বেড়ে উঠে অধিকাংশ শিশু প্রায়ই কৃতিত্বের সাথে বিভিন্ন পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ ডিগ্রিধারী ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-উকিল-আমলা হলেও সমাজচিত্র কি বলছে? ভালো মানুষের আকাল দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না? এভাবে চললে সব প্রতিষ্ঠান, সব ব্যবস্থা ঘুণে ধরবে। চকমিলানো রাস্তা, ভবন বাড়বে, চকচকে-ঝকঝকে মানুষ হয়ত বাড়বে, তবে দখলদারি, জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি, নেশা, প্রশ্নপত্র ফাঁস ইত্যাদি থামবে না।
প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো যাবে না? - বালাই ষাট্, এমন কথা মানতে নেই! বাঙালি এতটা অক্ষম জাতিতে পরিণত হয়নি। কেননা এ ফাঁস কার গলায় শক্তভাবে লাগছে? অবশ্যই ভবিষ্যত প্রজন্মের গলায় এবং পরিণামে দেশের।
আমাদের ধারণা শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা সঠিক হলে এবং সে অনুযায়ী মানুষ, অবশ্যই কর্মদক্ষ মানুষ, তৈরিতে যথার্থ পদ্ধতির আশ্রয় নিলে দুর্নীতির ফাঁসে শিক্ষাকে ফাঁসি দিতে হয় না। শিক্ষার প্রতিটি স্তরের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অত্যন্ত পরিস্কার। বিষয়টি বুঝে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত আমাদের সবার জন্যে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। বিষয়টা সরকার বা শিক্ষামন্ত্রী যে বোঝেন না তা নয়। বোঝেন বলেই ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সনেই শিক্ষা কমিশন গঠন করেন, তিন মাসের মধ্যে কমিটি খসড়া রিপোর্ট দেয় এবং আনন্দের বিষয় ছিল অতীতের ধারা ভেঙে এ প্রতিবেদনটি সর্বমহল গ্রহণ করেছে। এটি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে কথা থাকলেও মোটের ওপর এটি ধরে এগিয়ে গেলে শিক্ষার ব্যাধি - মুখস্থ, নোটবই, পরীক্ষা ও ফল-কেন্দ্রিকতা কাটিয়ে ওঠা যেত। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পরীক্ষা অবশ্যই থাকবে। কিন্তু থাকবে আরও অনেক কিছুর সাথে অনুশীলনের অংশ হিসেবে। ঘন ঘন পরীক্ষার ফলে জ্ঞানানুশীলনের ধারাবাহিকতায় বাধা বা ছেদ পড়তে থাকলে শিক্ষার্থী এবং সংশ্লিষ্ট সকলে অভ্যস্ত হয়ে যায় প্রশ্নের উত্তর-আকারে জ্ঞানের বিষয়টিকে দেখতে। জ্ঞানের বা বিষয়ের অখ-তা ও ধারাবাহিকতা সম্পর্কে তাদের ধারণা তৈরি হয় না। এরকম ব্যবস্থায় অভ্যস্ত মানুষের পক্ষে, বড় হয়েও, কোনো পূর্ণাঙ্গ বই পড়া, জটিল ব্যাখ্যা বা দূরূহ বিষয় ধৈর্য ধরে পড়া, শোনা বা বোঝার অভ্যাস তৈরি হয় না। এতে মানুষটার সর্বনাশ হয়ে যায়, কারণ এতে  শিক্ষার যে চূড়ান্ত লক্ষ্য একজন মানুষকে মানুষ হিসেবে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করা এবং তাই প্রকৃত স্বাধীন এবং তাই আত্মবিশ্বাসী ও আত্মমর্যাদাশীল ব্যক্তির যোগ্যতা দেয়া, তা সম্পূর্ণ বিফলে যাবে। কেবল একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষের বিবেচনা ও দায়িত্ব বোধ তৈরি হয় এবং তাই নিজের নিজের মর্যাদার পরোয়া করেন। অর্থাৎ মানুষ হিসেবে তাঁর চরিত্র গঠিত হয়। তেমনি মানুষ প্রশ্ন ফাঁস করাকে হীন কাজ বলে বুঝতে পারেন, এবং বড় কথা হল, এর সাথে নিজেকে যুক্ত করতে তাঁর রুচি ও নৈতিকতায় বাধবে। ভালো মানুষ ও মানবিক সমাজ নির্মাণে উপযুক্ত শিক্ষাকে অগ্রাধিকার না দিলে পুলিশ-র‌্যাব-ডিবি, সিসিক্যামেরা-টহলদারি-নজরদারি, জঙ্গিবাদ-নেশাগ্রস্ততা-অপরাধ, রাজনীতির দেউলিয়াপনা-সংস্কৃতির সংকট-সমাজের অবক্ষয় এবং কর্তৃত্ববাদী শাসন ইত্যাদি কেবল বাড়তে থাকবে। তখন হয় মনে হবে প্রশ্নপ্রত্র ফাঁস কোনো গুরুতর বিষয় নয় অথবা তা জেনেও এ উৎপাত মেনে নিতে হবে। 
এটা আদতে গুরুতর বিষয়। কেননা এতে সমাজে শিক্ষার সংকট লেগেই থাকবে, তেমনি থাকবে জাতির চরিত্র গঠনের সমস্যা। প্রশ্ন হল যে কথাটা আমরা জানি এবং মানি, যে কারণে ক্ষমতায় এসে সরকার শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিল, তিনমাসে প্রতিবেদন প্রণয়ন এবং সে বছর থেকেই তা ধাপেধাপে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল তাকে কেন উপেক্ষা করা হচ্ছে? আমরা জানি না অর্থের অভাবে না অন্য কোনো কারণে সরকার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে হাত দিচ্ছে না। তবে এটা স্পষ্টভাবে বলা যায়, বাজেটে শিক্ষাখাতে জিডিপির তিন শতাংশের নিচে বরাদ্দ রেখে সংখ্যাগত উন্নতি সম্ভব হলেও গুণগত মান অর্জন সম্ভব নয়। তার জন্যে অন্তত আন্তর্জাতিক মান ৬% বিনিয়োগ প্রয়োজন। বর্তমান পরীক্ষার ফলের পিছনে ছুটে সংখ্যাগত সাফল্য আসবে, কিন্তু গুণগত মান অর্জন ঠেকে থাকবে। এ বাস্তবতায় যে একদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের ঠেকানো যাবে না এবং অন্যদিকে সমস্যার জবাব দিয়ে গুণগত মান অর্জনের অভীষ্ট পথে চলা সম্ভব নয় তা বুঝে শিক্ষামন্ত্রীকে বারবার হয় অসহায়তা নয়ত হতাশা প্রকাশ করতে হবে। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।

Thursday, October 1, 2015

সিরিয়া সংকটের সমাধান ইউরোপের হাতে

আবুল মোমেন

২০১১ সালে সিরিয়ায় যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হয় তখন সে দেশের জনসংখ্যা ছিল ২২ মিলিয়ন বা দুই কোটি ২০ লক্ষ। গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে এযাবৎ ৪০ লক্ষ মানুষ দেশান্তরিত হয়ে শরণার্থী হয়েছেন। আরও ৮০ লক্ষ মানুষ দেশের ভিতরেই উদ্বাস্তু হয়েছেন। হিসেব কষলে দেখা যায় দেশটির অর্ধেকের বেশি মানুষ গত ৪ বছরে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। আর দেশান্তরী হতে গিয়ে রক্ষণশীল হিসেবেও অন্তত তিন হাজার মানুষ ভূমধ্য ও ইজিয়ান সাগরে ডুবে মারা গেছেন, যাদের মধ্যে শিশু আয়লান কুর্দি ও তার বোন এবং তাদের মত অসংখ্য শিশুও রয়েছে।
আমরা দেখেছি সাদ্দাম হোসেন-উত্তর ইরাকে পুনর্গঠনের কাজ স্থানীয় বিবদমান গোষ্ঠীর ভ্রাতৃঘাতী হানাহানির কারণে বারবার কেবল ব্যাহত হয়নি, এক অর্থে তা ব্যর্থ হতেই চলেছে। সেখানে শূন্যতা সৃষ্টি না হলে ইসলামিক স্টেট কীভাবে ইরাকে এত শক্তিশালী হয়, এতটা জায়গা দখলে নেয়, এত নৃশংসতা চালায়?
সিরিয়া আপাতত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের শেষ টার্গেট। সাদ্দাম, গাদ্দাফির মত বাশার আসাদকে এ পর্যায়ে তারা সর্বশেষ শিকার হিসেবে দেখতে চায়। বাশারকে রাশিয়া সমর্থন দিচ্ছে, ইরানও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তবে  গুরুত্বপূর্ণ হল রাশিয়ার ভূমিকা ও সমর্থন। রাশিয়া কি পরাশক্তি হিসেবে তার হৃতসম্মান পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে সিরিয়াকেই পরীক্ষার গিনিপিগ হিসেবে বেছে নিচ্ছে? গিনিপিগের ওপর পরীক্ষা চালালে নিজের তেমন ক্ষতি নেই। পুতিন বলেছেন সিরিয়াকে বাশার ও ইসলামি স্টেটের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে। বিপরীতে পশ্চিমা মিত্রশক্তির বক্তব্য হল, সিরিয়ার জন্যে দুটিমাত্র বিকল্প নয়, তৃতীয় বিকল্পটিই একমাত্র পথ। বাশার এবং ইসলামি স্টেট উভয়কেই পরাভূত করে উদারপন্থী বাজার অর্থনীতির সমর্থক সরকার বসাতে হবে। এতে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার আশংকা এবং সিরিয়াবাসীর দুর্দশা অন্তহীন হয়ে উঠবে। ভয় হয় ভাবতে আরও কত লক্ষ মানুষের প্রাণ গেলে এবং দেশ গেলে তবে সিরিয়াবাসীর ‘বন্ধুরা’ শান্ত হবে।
বাঙালি কবির বাণী শিরোধার্য করেও কুহকিনী আশার ছলনে একটু হলেও সাড়া দেওয়া যায়। কারণ ইউরোপের শরণার্থী নেওয়ার এবং মানবতার দু:খজনক বিপর্যয় সহ্য করার ক্ষমতার শেষপ্রান্ত দেখা যাচ্ছে। তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির ওপর সুবিন্যস্ত মলাট ভেতরকার সংকট ও তিক্ত চেহারা আর ঢাকতে পারবে না। কিন্তু ইউরোপ কি সভ্যতার বড়াই এমনি ছেড়ে দেবে? এখানেই সিরিয়াবাসীর জন্যে সামান্য সম্ভাবনার আলো দেখা যাচ্ছে।
আবার ইউরোপে কিছু মৌলিক সংকটও দেখা দিয়েছে। যুক্তরাজ্য ই ইউ থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তা ছাড়ে নি, নতুন নির্বাচনও গ্রিসের সংকট থামাতে পারবে না এবং খোদ ইউরোপের পূর্ব ও পশ্চিমের দেশের মধ্যে বিভেদ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এগুলোকে এড়িয়ে ইউরোপ কীভাবে সব দিক রক্ষা করবে তাই সামনের কয়েকটি দিনে দেখতে হবে। সময় খুবই কম। তাদের অত্যন্ত দ্রুততার সাথে সমস্যার জট খুলতে হবে এবং সম্ভবত চির-ধরা ঐক্যের বাঁধনটা সময়মত সারাতে হবে। এ ছাড়া ইউরোপের জন্যে অন্য বিকল্প  নেই বলেই মনে হয়।
জার্মেনি ইউরোপীয়  ঐক্যের নেতার ভূমিকা নিয়েছে, চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল তাঁর চেষ্টা থামান নি। ফ্রান্স প্রাথমিক দ্বিধা কাটিয়ে সঙ্গে থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু সিরিয়া সংকট এবং তা থেকে উদ্ভূত অব্যাহত শারণার্থী প্রবাহ তাদের যেন ভাববারও সময় দিচ্ছে না। কৌশল নির্ধারণে এবং তা নিয়ে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তের জন্যে যে দূতিয়ালি, সংলাপ-আলাপ চালাতে হয় তার ফুরসৎ নেই। শরণার্থীর চাপে গ্রিস, বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, হাঙ্গেরি জেরবার। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং পশ্চিমের সাথে সম্পর্কে টানাপোড়েন বাড়ছে। ইউরোপের স্বার্থে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ দ্রুত থামা দরকার। যুদ্ধ থামানো কি সমাধান? রাশিয়ার জন্যে হ্যাঁ, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে না। এখনও অবস্থা এরকমই।
এ পর্যায়ে একমাত্র এই ভয়াবহ মানবিক ট্র্যাজেডি থামাতে পারে ইউরোপ, তার নিজের প্রয়োজনের জরুরি তাগিদ থেকে। ইউরোপে অস্থিরতা চলতে থাকলে, অনৈক্যই সত্য হয়ে দাঁড়ালে গোটা বিশ্বের ভবিষ্যত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আমরা জানি না  ইউরোপের দেশগুলো যুগপৎ ঐতিহাসিক ও মানবিক এই দায়িত্ব পালন করবে কিনা।