Saturday, June 3, 2017

শুভাকাঙ্ক্ষীর বিস্ময়-ভরা প্রশ্ন

আবুল মোমেন

২০০৯ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের বিজয়ের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে জামায়াত ও ধর্মান্ধ শক্তিকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিতাড়ন করা সম্ভব হয়েছে। এর পরে সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করে একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে তাদের সাথে রাষ্ট্রের দূরত্ব আরো বেড়েছিল।
কিন্তু ১৯৭৯ থেকে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় পুনর্বাসিত জামায়াত ও ধর্মীয় কট্টরপন্থার রাজনৈতিক শক্তি এতদিনে অনেক বেড়েছে। এ সময় মধ্যপ্রাচ্যেও  অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটে এবং তারা এদেশে ধর্মভিত্তিক দল ও সামাজিক উদ্যোগের জন্যে আর্থিক সহায়তা দিতে শুরু করে। দেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তিগুলো এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। তারা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিজেদের অর্থনৈতিক শক্তি এবং সামাজিক প্রভাব বাড়িয়েছে।
যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ বিজ্ঞান ও আলোকনের শিক্ষাকে যথাযথভাবে ধারণ করে নি সেখানে ধর্ম প্রায়ই অন্ধবিশ্বাস ও সংস্কারে পরিণত হয়। শিক্ষার মাধ্যমেও সনাতন এই ধ্যানধারণা ও ভাবনার গ-িভাঙা যায় নি। বাংলাদেশ জ্ঞানচর্চায় একটা গণ্ডিবদ্ধ চক্করের মধ্যে আটকে পড়েছে। ফলে রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়ে এবং তা ব্যবহার করে ধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তিকে এ থেকে দূরে রাখা গেলেও তারা কিন্তু সমাজকে দখলে রাখতে সক্ষম হয়।
পরিহাসের বিষয় হল যে আওয়ামী লীগ জামায়াত ও সংশ্লিষ্টদের ক্ষমতা থেকে বাইরে রেখেছে, আইনের মাধ্যমে অপরাধের চরম শাস্তি দিচ্ছে সেই দলই সমাজের বৃহত্তর অংশের প্রতিনিধিত্বশীল দল হিসেবে সামাজিক অঙ্গনে এদের দ্বারাই প্রভাবিত হচ্ছে। আজ সামাজিক ক্ষেত্রে সে অর্থে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, এমনকি হেফাজতের মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই।
আমরা লক্ষ্য করছি বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের সাথে মুখোমুখি বিরোধের কৌশল পাল্টে দলের অনেককেই প্রতিপক্ষ ক্ষমতাসীন দলে যোগ দিতে উৎসাহিত করছে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বামপন্থীরা দলে দলে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিল। সে ধারা এই সেদিন পর্যন্ত বজায় ছিল। কিন্তু এখন হাওয়া উল্টো বইছে।
হেফাজতে ইসলামের দাবি মেনে ন্যায় বিচারের প্রতীক গ্রিক দেবি থেমিসের মূর্তি অপসারণ এবং তার আগে পাঠ্যবইয়ে কিছু লেখার রদবদল করেছে সরকার। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কি গুণগত পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে? বিষয়টা তলিয়ে দেখা দরকার।
আওয়ামী লীগ কেবল যে ভোটের রাজনীতি করে তা নয়, দেশের বৃহত্তর গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তারা সবসময় অবস্থান নিয়েছে কখনো জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের মত কঠিন ঝুঁকিপূর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে বড় সাফল্যের ভিৎ রচনাও করেছে।
শেখ হাসিনা সেই পথ থেকে সরে এসেছেন এমনটা ভাবার কারণ ঘটেছে বলে মনে করি না। তাঁর পথ এবং সময়টা আগের তুলনায় জটিল এবং কঠিন। বর্তমানে সারা বিশ্বে উদারনৈতিক চেতনার ভাঁটা চলছে এবং রক্ষণশীল রাজনীতি জোরদার হচ্ছে। তাতে ধর্ম ও জাতিগত উগ্রতা বড় ভূমিকায় থাকছে। দেশে জনসংখ্যা বেড়েছে আড়াই গুণ, সেভাবে কর্মসংস্থান হয়নি। বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির আগ্রাসন এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার চাপের মধ্যে দেশকে এগিয়ে নিতে হচ্ছে। এসব বিষয়ও বিবেচনায় রাখতে হবে।
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শের আপস বা চিন্তাচেতনার পশ্চাদাপসরণ যেমন সত্য তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয় নাগরিকসমাজের সামগ্রিক অবক্ষয়। বস্তুত এই অবক্ষয়ের কারণেই আওয়ামী লীগসহ সকল রাজনৈতিক শক্তিরও অবক্ষয় ঠেকানো যায় নি।
কথা হল জনগণের মধ্যে যদি প্রগতিচেতনায় ভাঁটা পড়ে, যদি সমাজের অগ্রসর অংশ কেবলই হোঁচট খেতে থাকে, কিংবা অকেজো হয়ে পড়তে থাকে তাহলে জনগণের দল আওয়ামী লীগ কোথা থেকে শক্তি পাবে? তাগিদ বোধ করবে প্রগতির পতাকা সমুন্নত রাখার?
এ কথাও ভুললে চলবে না ২০১২ সনের ৫ মে হেফাজতের সমাবেশ গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তিকে ভালোরকম চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। কিন্তু তাকে প্রতিহত করার কাজ গণজাগরণ মঞ্চ বা প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি করতে পারে নি, তা করেছিল রাষ্ট্রশক্তি। রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম চালানোর যে অবকাশ থাকে তা কিন্তু রাষ্ট্রের থাকে না। তা হয়ে যাবে রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন। আমরা জানি, হেফাজতকে রাষ্ট্র পুলিশি অ্যাকশনে এবং মামলা, গ্রেফতারসহ দমনমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমেই বাগে এনেছিল। কিন্তু এই প্রক্রিয়াতে সরকার যেন স্বস্তি বোধ করে নি। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল আওয়ামী লীগ প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাটিকে বেগবান করার বিষয়ে যতœবান হচ্ছে না। বরং ক্ষমতা সংহত ও দৃঢ় করার জন্যে ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সাথে আপসের পথেই পা বাড়িয়েছে। অনেকের ধারণা আগামী জাতীয় নির্বাচনকে  মাথায় রেখে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এপথেই চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক্ষেত্রেও বলা দরকার, সাধারণ ধারণা হল হেফাজত বা অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দল আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি আস্থায় নেবে না এবং খুব সম্ভবত ভোটও দেবে না। এদিকে এদের সাথে নানাবিধ আপসের কারণে হতাশ হয়ে পড়ছে প্রগতিচেতনার সাধারণ মানুষ ও তরুণ সমাজ।
সাধারণ মানুষ ও তরুণদের মধ্যে ধর্মান্ধতার চেয়েও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মানবিক বোধ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অনেক বেশি কাজ করে। এদের মধ্যে পরিণতচিন্তার অনেকেই হয়ত নানা দিক বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটকেই ভেটে দেবে। কিন্তু তরুণ সমাজের ক্ষেত্রে বাস্তবতা তেমন না-ও হতে পারে। এতে আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে দুভাবে - তাৎক্ষণিক ভোটের হিসেবে এবং তরুণদের সমর্থন ও আগ্রহ হারিয়ে দীর্ঘমেয়াদে। আমাদের মনে হয় যে ধরনের মোর্চাই আওয়ামী লীগ করুক না কেন তাকে কেবলমাত্র নির্বাচনী জোটে বা ভোটের মধ্যে এবং সরকার পরিচালনায় সীমাবদ্ধ না রেখে রাজনৈতিক কার্যক্রম পর্যন্ত প্রসারিত করা দরকার।
এদেশের প্রগতির যাত্রা কোনোকালে একক  কোনো দলের নেতৃত্বে হয় নি, তা সবসময় হয়েছে বহু দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে বাস্তবতা এরকমই। ছয়দফার আন্দোলন ব্যতীত বাকি সকল আন্দোলন-সংগ্রামের সূচনা করেছে বামপ্রগতিশীল  ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো। আজ এসব সংগঠন ক্ষুদ্র, দুর্বল ও বহুধাবিভক্ত।
এ বাস্তবতায় এসব দল ছাড়াও নানাবিধ নাগরিক শ্রেণী তৎপর হয়েছে, সরব রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সরকারের নৈকট্য ঘটছে হেফাজতের সাথে আর এদের সাথে তৈরি হয়েছে দূরত্ব, দিনে দিনে তা বাড়ছে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ন্যায়বিচারের প্রতীক মূর্তি অপসারণ বা পাঠ্যবইয়ে রদবদল নিয়ে সৃষ্ট এ দূরত্ব সহজে ঘুচবে বলে মনে হয় না। বরং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কয়লাভিত্তিক অন্যান্য বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে এ দূরত্ব আরো বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি।
বামপ্রগতিশীল কিছু দলকে সরকারে রেখে মোটামুটি নিষ্ক্রিয় রাখা হয়েছে, আবার অন্যদের প্রবল বিরোধিতা ও সমালোচনার মাধ্যমে দূরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সরকার কি নানাভাবে মদদ জুগিয়ে হেফাজত ও সমমনাদের শক্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে না? ওরা অনেক বিষয়ে সরকারকে ডিক্টেট করছে এবং সফল হচ্ছে। অর্থাৎ সরকারে না থেকেও এরা সরকারের অংশ আর জাসদ ইনু ও ওয়ার্কাস পাটি সরকারের অংশীদার হয়েও যেন সরকারের বাইরে। এটা কি কাকতলীয় ঘটনা?
এই কাকতালের মূল্য কে দেবে? শেখ হাসিনা? আওয়ামী লীগ? নাকি জনগণ?
ভবিষ্যতের জন্যে অনেকগুলো প্রশ্ন জমা হচ্ছে। এর অর্থ মানুষ যথেষ্ট বিভ্রান্ত, হতাশ এবং সংস্কারাছন্ন! যখন চারিদিকে উন্নয়নের ডামাডোল চলছে তখন যদি জনগণের বিভ্রান্তি, হতাশা ও সংশয় বাড়ে তবে সুস্থ গণতান্ত্রিক মানবিক ধারার রাজনীতি বেগবান হতে পারবে না।
রাজনৈতিক স্থবিরতার মধ্যে সুবিধাবাদ, প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং দুর্নীতিই তলে তলে গতিশীল ও শক্তিশালী হয়। বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে, সমাজে এমন মানুষের ভীড় বাড়ছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার ক্ষমতায় থাকতে এবং উন্নয়নের জোয়ার বজায় রাখতে গিয়ে কি শেষ পর্যন্ত চেতনার পরাজয় মেনে নেবে?
বঙ্গবন্ধু-কন্যা ২০০৯-এ ক্ষমতায় আসার আগে এবং পরে অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন। ২০০৪ সনে গ্রেনেড হামলা থেকে প্রাণে বেঁচেছেন, তাঁকে হত্যার জন্যে এখনো নিশ্চয় মুফতি হান্নানের মত অনেকেই সক্রিয় আছে। আর ক্ষমতায় আসার পরপর বিডিআর বিদ্রোহ, তারপরে বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন, পদ্মাসেতু নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের  ষড়যন্ত্র - সবকিছুই তিনি ভালোভাবে উৎরে গেছেন। হেফাজতে এসে তিনি  হোঁচট খাবেন? যারা কিনা নারীকে তেঁতুলের সাথে তুলনা করে ভোগের সামগ্রী বৈ আর কিছু মনে করে না এমন পচা শামুকে পা কাটবেন?
এটা হয়ত প্রশ্ন, হয়ত বিস্ময়সূচক অভিব্যক্তি। তবে তা আমার একার নয়, অনেকের যারা তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী।


***