Monday, January 6, 2014

এবার নির্বাচনের পরিণতির পরিণতি নিয়ে ভাবতে হবে

আবুল মোমেন


নির্বাচনের আগের দিনের জন্যে যখন লিখছিলাম তখন জানা ছিল যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বন্ধ করার আর উপায় নেই। তাই বলেছিলাম ক্ষমতাসীন দলের জন্যে নির্বাচনের ফলাফল আর গুরুত্বপূর্ণ নয়, তারও চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি সামলানো। এও বলেছি তার বর্তমান একলা-চলো নীতি বজায় রেখে সেটা প্রায় অসম্ভব।
কিন্তু আওয়ামী লীগ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে যা করল তা তাদের অন্ধ সমর্থকদেরও বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। আমি বারবার লিখেছি যে বর্তমান বাস্তবতায় নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ব্যাপক কারচুপি ঘটিয়ে ফলাফলে গুণগত পরিবর্তন এনে পার পাওয়া সম্ভব নয়। সামরিক শাসকরা মূলত সামরিক বাহিনীর সমর্থনে-সহযোগিতায় এ কাজ করেছে। কিন্তু তা-ও শেষ রক্ষ হয় নি, তাদের দুই দলকেই সেই কালিমা বহন করে যেতে হচ্ছে, হবে। তখন তো পর্যবেক্ষক আর গণমাধ্যমের ভূমিকা এত প্রসারিত ও শক্তিশালী ছিল না। এখনকার বাস্তবতায় রাষ্ট্রযন্ত্রকে এভাবে ব্যবহার করা এক প্রকার অসম্ভব।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ যদি দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে চায় তাহলে তা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাবে বলে আমার ধারণা। প্রথমত, পাকিস্তান আমল থেকেই আওয়ামী লীগ গড়ে উঠেছিল পূর্ব বাংলার আপামর জনগণের রাজনৈতিক মুখপাত্র হিসেবে। আমি এ নিয়ে দীর্ঘ ব্যাখ্যায় যাব না এখানে। তবে বলতে পারি এ নির্বাচনের ফলে তার সেই ভাবমূর্তি ক্ষুণণ হল এবং ভূমিকা ব্যাহত হবে। কারণ যে আওয়ামী লীগকে মানুষ জানত জনসম্পৃক্ত দল হিসেবে তারা আজ জনগণকে তোয়াক্কাই করল না, তাদের ভোটাধিকারকে করল অমর্যাদা। বোঝা গেল, দলের সমর্থকেদের নির্বাচনে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করাও হয়নি, কারণ যেকোনো হিসেবে এ দলের অন্তত ৩৫% সমর্থক-ভোটার আছে। তারা যে ভোটাধিকার প্রয়োগ করল না সে দায় তো নেতৃত্বকেই নিতে হবে। তাছাড়া খোলামেলাভাবে একথাও বলা যায়, দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জন্যে আওয়ামী লীগ ভিন্ন অন্য দল পছন্দের সুযোগ না থাকায় এরা এ দলের ভোটব্যাংক হিসেবেই পরিচিত হয়েছে। কেন্দ্রভেদে দেশে সংখ্যালঘু ভোটার শতকরা ১৫ থেকে ৫০ ভাগ পর্যন্ত আছে। প্রকৃত ভোট বলে দিচ্ছে ভীতসন্ত্রস্ত ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ভোটাধিকার প্রয়োগের ঝুঁকি নেয় নি। অর্থাৎ সরকার ও সরকারি দল তাঁদের মধ্যে ভয়-কাটানোর মত নিরাপত্তার আস্থা সৃষ্টি করতে পারে নি। সরকারে থাকলেই যে বাস্তবের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, এটি তারই প্রমাণ।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও ক্ষমতা দখলে রাখার যে রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি দেশে চালু রয়েছে আওয়ামী লীগ ছিল এতকাল তার বাইরে গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির প্রধান অবলম্বন। এখন থেকে আওয়ামী লীগও বিএনপি-জাপার মত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে জনগণের রাজনৈতিক শক্তির অবলম্বন হিসেবে দুর্বল হয়ে গেল। এই সূত্রে দ্বিতীয় বিষয়টি হল নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত রাখার জন্যে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে নির্বাচনকালীন চলমান পরিস্থিতির কোনো পর্যায়েই ন্যূনতম আস্থায় নেয় নি বলে আগামী দিনগুলোতে - অন্তত আওয়ামী লীগ যতদিন ক্ষমতায় থাকবে - বিএনপি ও জামায়াতের জোট অব্যাহত থাকবে। এটি গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ ক্ষুণœ করবে কিন্তু তার দায় বহুলাংশে পড়বে আওয়ামী লীগের ওপর। তৃতীয়ত, এখন যদি আওয়ামী লীগ দ্রুত বিএনপির সাথে আলোচনার পথ খুলতে না পারে তবে ক্রমবর্ধমান বিরোধিতার তপ্ত রাজনীতি উভয় পক্ষেই মধ্যপন্থী নমনীয় গোষ্ঠীকে কোনঠাসা ও নিষ্ক্রিয় করে দেবে এবং উভয় দিকে অগণতান্ত্রিক অরাজনৈতিক শক্তির প্রাধান্য বাড়বে। আর তাতে জামায়াতের জন্যে নতুনভাবে রাজনীতির পথ খুলে যাবে। অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান হারে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের নিপীড়ক ভূমিকায় নির্ভরশীল হয়ে আওয়ামী লীগেরও রাজনৈতিক সাংগঠনিক শক্তি কমতে থাকবে।
এরকম বাস্তবতার পটভূমিতে যদি কোনোভাবে জোটবদ্ধ বিএনপি ক্ষমতায় আসে তবে জামায়াত বা জামায়াতি প্রতিক্রিয়া ও প্রতিহিংসা সামাল দেওয়া বিএনপির পক্ষেও কঠিন হবে বলে আশংকা করি। তাতে দেশ বিপর্যয়ের কোনদিকে যাবে, হানাহানি কোন পর্যায়ে গড়াবে তা আন্দাজ করাও মুশকিল।
ফলে ভাবতে হবে কীভাবে এই সম্ভাব্য নৈরাজ্যের পরিণতি ঠেকানো / এড়ানো যায়।
বলা বাহুল্য একতরফা নির্বাচনের ট্রেনে চেপে - স্বেচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে - যে গন্তব্যে আওয়ামী লীগ ও দেশ পৌঁছেছে তার প্রায় সবটা দায় ট্রেনের চালক হিসেবে আওয়ামী লীগের ওপরই এসে পড়বে। নিশ্চয় বিরোধী পক্ষে নৃশংসতা ও হিংসার নেতিবাচক রাজনীতির সমালোচনা হবে, কিন্তু তা যেহেতু মূলত প্রতিক্রিয়ারই প্রকাশ তাই রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের সক্রিয় অংশের দিকে আঙ্গুল উঠবেই।
তবে বিএনপিও দেশের বড় ও বিকল্প গণতান্ত্রিক দল হিসেবে সমালোচনা এড়াতে পারবে না। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় থেকে রাজনৈতিক অঙ্গন পুরোটাই দখল করে নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। আমার ধারণা কীভাবে এই প্রতিকূলতার মধ্যেও মাঠে উপস্থিত ও সক্রিয় থেকে খেলার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া যায় তা নিয়ে বিএনপি-নেতৃত্ব বিশেষ ভাবনাচিন্তা করে নি। তারা আড়াল থেকে চোরাগোপ্তা আক্রমণের পথ ধরল, যা তাদের স্বাভাবিক খেলা নয়। আওয়ামী লীগ তাদের মাঠ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যে বারবার মূল যে অস্ত্রটি ব্যবহার করেছে তা হল বিএনপিকে উত্তেজিত করে তোলা। আর এই ফাঁদে বারবারই পা দিয়েছে বিএনপি নেতৃবৃন্দ, বিশেষত দলীয় সাংসদরা। এভাবে তারা নিজেদের অপরিপক্কতারই পরিচয় দিয়েছেন। তাদের জন্যে শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারত আইয়ুবের জাতীয় সংসদে মুষ্টিমেয় বিরোধী সাংসদদের ভূমিকা। মাত্র অল্প কয়েকজন মানুষ কীভাবে তাঁদের তুখোড় সমালোচনামূলক বিশ্লেষণধর্মী বক্তব্যের মাধ্যমে আইয়ুব সরকারের স্বরূপ উন্মোচন ও সরকারকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়তেন তা সে আমলের পত্রিকায় এখনও ধরা আছে। বিভিন্ন মতাদর্শের এই মানুষগুলো, যেমন শাহ আজিজ, মিজান চৌধুরী, ফরিদ আহমদ, মাহবুবুল হক প্রমুখ এ কাজে দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিতেন। বস্তুত মুষ্টিমেয় এই কজন মানুষের বক্তব্যই পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হত। আইয়ুববিরোধী রাজনৈতিক চেতনা বিস্তারে তা বড় ভূমিকা রেখেছিল। অবশ্য আজকাল সাংসদদের মান যে জায়গায় নেমেছে তাতে এ ভূমিকা পালন কঠিন। কিন্তু তার দায়ও তো তাদের দলেরই।
পরেও আলোচনার সুযোগগুলো বিএনপিরই লুফে নেওয়া উচিত ছিল। কারণ যেকোনো বিচারে যে কোনো অবস্থায় এবার বিএনপিরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু গণমাধ্যমের সামনে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরার কোনো সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেন নি বিরোধী নেত্রী বা তাঁর নেতৃবৃন্দ। তারা এর পরিবর্তে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতকে রক্ষা করার পথ গ্রহণ করেছে। তাতে দেশের বিরোধী রাজনীতি আর নিয়মতান্ত্রিক থাকল না, প্রধানত জামায়াত-শিবিরের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়ে সন্ত্রাস ও নাশকতার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এটি গণতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির দায়িত্বহীনতা কিংবা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা প্রমাণ করে। তারই পরিণতিতে মূলত দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জনবিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে।
সাধারণত সরকারি দল ক্ষমতা ভোগে ব্যস্ত থাকে বলে তার এক ধরনের জনবিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়ে যায়। জনগণকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করা ও রাখার দায় মূলত বিরোধী দলই পালন করে থাকে। বস্তুত দীর্ঘকাল বিরোধী অবস্থানে রাজনীতি করার কারণেই আওয়ামী লীগ দেশের জনসম্পৃক্ত বড় দলে পরিণত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে প্রায় আট বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা ভোগ করে দলটি তার জনসম্পৃক্ততার বৈশিষ্ট্য হারাতে বসেছে এবং ১৯৪৭ পরবর্তী অন্যান্য সব সরকারের মতই কর্তৃত্বপরায়ন হয়ে উঠেছে। মনে রাখতে হবে ৭২-৭৫ আমলেও আওয়ামী লীগ তার ভ্রান্ত রাজনৈতিক কৌশলের কারণে কর্তৃত্বপরায়ন হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তাতে শেষরক্ষা হয়নি। নৃশংসতা, অরাজকতা ও দীর্ঘমেয়াদী অপশাসনের কবলে পড়েছিল দেশ। আমাদের আশংকা আবারও যদি আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠতে থাকে তার পরিণতি দেশের জন্যে শুভ হবে না।
দেশ সত্যিই একটি বিপজ্জনক বাঁকে আছে এখন, এ থেকে কীভাবে বিচক্ষণতা ও দূরদশিতার সাথে সন্তর্পণে একে নিরাপদ অবস্থানে নেওয়া যাবে আজ আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের সেটাই অগ্রাধিকারের সাথে ভাবতে হবে।