Thursday, June 25, 2015

ক্রিকেট কীর্তির সূত্র ধরে

আবুল মোমেন

ক্রিকেটে বাংলাদেশ আর তলানির দেশ নেই। বড় দলের তকমা লাগবে এবার। কেমন হেসেখেলে দুটি ম্যাচে হারিয়ে দিল ভারতকে। সামনে ধবল ধোলাই বা বাংলাওয়াশের হাতছানি। যেভাবে খেলছে দল তাতে সে সম্ভাবনাটাই বেশি বলে মনে হচ্ছে সবার। সত্যি বলতে কি এই বদলে-যাওয়া বাংলাদেশকে দেখে ভারতীয় দলের খেলোয়াড় এবং টিম ম্যানেজমেন্ট রীমিত থ’ হয়ে গেছে। ওদের ম্যানেজার রবি শাস্ত্রী বাকপটু মানুষ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু পরাজয়ের পর থেকে মিডিয়াতে তাঁর টুঁ শব্দটিও শোনা যাচ্ছে না।
ভারতের সাথে এবারের ক্রিকেট লড়াইটার যেন বাড়তি উত্তেজনার পটভূমি রয়েছে। তা সবার জানাও আছে। সেই বিশ্বকাপে আম্পায়ারের অবিচারের ক্ষতটা সারানো দরকার ছিল বাংলাদেশের। ক্ষতটিকে আবার কাঁচা করেছে ভারতীয় বৈদ্যুতিন মাধ্যমের একটি বিজ্ঞাপনও। তবে যারা ক্রিকেটের অন্দরের খবর রাখেন তাদের মনে বিশেষ ক্ষোভ ছিল অন্য একটি কারণে। বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা পেয়েছে বারো বছরের  বেশি হতে চলল, অথচ এখনও ভারতের মাটিতে কোনো সিরিজ খেলার আমন্ত্রণ পায় নি। বর্তমানে ক্রিকেটের পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়ায়ও রীতিমত দুটো সিরিজ খেলা হয়ে গেছে। ভারতই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্ট খেলেছে ঢাকার মাটিতে। বাংলাদেশের টেস্ট খেলুড়ে দেশের স্বীকৃতির সময় ভারতীয় ক্রিকেট জগতের বড় সংগঠক জগমোহন ডালমিয়া আইসিসির সভাপতি। শোনা যায় এ স্বীকৃতি পেতে বাংলাদেশের প্রতি তাঁর মনোভাব ছিল অনুকূল। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডেরও সমর্থন পেয়েছিল বাংলাদেশ। এ কথা আমরা অবশ্যই মনে রাখি, মনে রাখব।
কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটের অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতা বাংলাদেশ যেন আর পাচ্ছে না। এ যেন বড় প্রতিবেশীর সাথে ছোট প্রতিবেশীর সম্পর্কের টানাপোড়েনের সেই পুরোনো ইতিহাস। এমনটা পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও দেখা যায়। বাংলাদেশের সাথে ভারতের ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক এতটাই বাস্তব, পুরোনো এবং চলমান যে তাকে কারুরই অস্বীকার করবার উপায় নেই। পাকিস্তান এই সম্পর্ককে অস্বীকারের ধারা বজায় রাখতে গিয়ে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উভয় দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আজ অবধি দেশটি স্থিতিশীল হল না। স্বাধীনতার সত্তর বছর পরেও সুষ্ঠু কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা দাঁড়ায় নি, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান মারাত্মক, পুরোনো সামন্তব্যবস্থা এখনও চলমান। তদুপরি ধর্মীয় মৌলবাদ ও সশস্ত্র জঙ্গিবাদ সমাজজীবনকে পঙ্গু করে রেখেছে। এখনও ক্রিকেটে স্বীকৃত কোনো দল পাকিস্তানে খেলতে যাচ্ছে না।
সেদিক থেকে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। সম্প্রতি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে। দু’দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত নানান চুক্তির জন্যেই কেবল এ কথা বলছি না। এবারই প্রথম অর্থনৈতিক সম্পর্ককে দু’দেশের সীমার বাইরে আঞ্চলিক পরিসরে বিস্তৃত করেছেন দু’দেশের নেতৃত্ব। এতে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলের ধারণা স্পষ্ট হয়ে উঠছে, যাতে ভারত বাস্তব কারণেই বড় শরিক, কিন্তু অন্যান্য প্রতিবেশীরাও সঙ্গে থাকছে।
ভারত-পাকিস্তান চিরবৈরিতার কারণেই প্রতিষ্ঠার পরে তিন দশকের বেশি অতিবাহিত হলেও সার্ককে কার্যকর করা গেল না। প্রয়োজন পড়ছিল একে পাশ কাটিয়ে হলেও বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভূটানের মধ্যে অন্তত বাণিজ্যিক সংযোগ প্রতিষ্ঠিত করা। ভূটান ও নেপাল ল্যাণ্ডলকড্ বা ভূমিবদ্ধ দেশ, ভারতের পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যও তাই। তাদের জন্যে অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী হবে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পেলে। এবারে সেই পথের জট খুলতে শুরু করেছে।
চীনও আমাদের কাছের দেশ - ভৌগোলিক এবং ব্যবসায়িক ও উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে। বহুদিন ধরেই চীন চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পূর্বাঞ্চলীয় কুংমিং প্রদেশ পর্যন্ত একটা যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিল। ফলে চীন চায় বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্র বন্দর বানানোয় শরিক হয়ে সাগর ঘিরে সৃষ্ট নতুন বাণিজ্যিক সম্ভাবনায় ভালোভাবে শরিক হতে। বঙ্গোপসাগরে চীনের এই সবল উপস্থিতির সম্ভাবনা আবার জাপান এবং ভারতকে কিছুটা শংকিত করে তুলেছে। আ মাদের বন্ধুপ্রতিম তিনটি শক্তিশালী দেশের মধ্যেকার এই টানাপোড়েনের মধ্যমণি বাংলাদেশ। এখানে বাংলাদেশের জন্যে জটিল আবার গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক তৎপরতার অবকাশ তৈরি হয়েছে। এবারে বাংলাদেশকে কূটনীতিতে সত্যিকারের পরিপক্কতা দেখাতে হবে, অনেকটা যে পরিপক্কতা আমাদের ক্রিকেটাররা দেখাল খেলার মাঠে। তারা দক্ষতা, একাগ্রতা, বিচক্ষণতা মিলিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেও কেমন করে জয়ী হতে হয়।
পাকিস্তান একসময় কূটনৈতিক ভূমিকা পালন করে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের বরফ গলানোর কাজ করেছিল। চীন-ভারত শীতল সম্পর্কও বেশ পুরোনো। তবে নয়াভারত গড়ে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এসে নরেন্দ্র মোদী চীনের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক ও গতিশীল করে নিতে চান। বাংলাদেশ উভয় দেশেরই বন্ধুত্ব কামনা করে, জাপানকেও পাশে পেতে চায়। তাদের মধ্যেকার স্বার্থের দ্বন্দ্বে আমরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হই সেদিকটা দেখাই আমাদের বড় কাজ। এ কাজ খানিকটা সহজ হবে যদি আমাদের আঞ্চলিক সহযোগিতার পরিসর আরও বাড়িয়ে নিতে পারি আমরা। তাতে ভারত-চীন, ভারত-জাপান সম্পর্কও সহজ হবে এবং কার্যকর থাকবে। বাংলাদেশ এ উদ্যোগের মূল লিয়াজোঁর ভূমিকা পালন করতে পারে ।
ভারত ছাড়া মিয়ানমারই অপর একটি দেশ যার সাথে আমাদের সীমান্ত সংযোগ রয়েছে। তাদের সাথে সমুদ্র সীমার বিবাদ আন্তর্জাতিক আদালতে মিটলেও দেখা যাচ্ছে দু’দেশের সম্পর্ক কিছুতেই সহজ হচ্ছে না। পথের বাধা হয়ে আছে রোহিঙ্গা সমস্যা। সেনাশাসিত মিয়ানমারে এমন এক বৌদ্ধ উগ্রবাদের জন্ম হয়েছে যা সেদেশের ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জন্যে মারাত্মক হয়ে উঠেছে। সরকারি বাহিনির ভূমিকাও একই। হিংসাত্মক আক্রমণের শিকার হয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানরা মাতৃভূমি ত্যাগে বাধ্য হচ্ছে। প্রাচীন বার্মার আরাকান অঞ্চলে বাঙালি মুসলমানের বসতি বহুকালের পুরোনো ব্যাপার। মধ্যযুগে আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের চর্চা হয়েছে - আলাওল, সৈয়দ সুলতান, মাগন ঠাকুররা এ সভারই সদস্য ছিলেন। ফলে বোঝা যায় এখানে বাঙালি এবং মুসলমানদের বসতি কয়েকশ বছরের পুরোনো ব্যাপার। চট্টগ্রামের শঙ্খনদীর দক্ষিণাংশের সাথে সামাজিক যোগাযোগও পুরোনো। এসব অস্বীকার করে কেবল ধর্মের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ও অনিশ্চিত জীবনের পথে ঠেলে দেওয়া কিছুতেই সমর্থন করা যায় না। বিষয়টা দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। এটি এখন আন্তর্জাতিক মহল ও কোরামেও আলোচিত বিষয় নয়ত বাংলাদেশের জন্যে এটি একটি বিষফোঁড়া হয়ে থাকবে। এখনই সময় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করে মিয়ানমারের সঙ্গেও সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের নতুন যুগের সূচনা করার।
মিয়ানমার ক্রিকেট খেলে না, তবে ফুটবল খেলে এবং ভালোই খেলে। ক্রিকেটের মত আমাদের ফুটবলেরও উন্নতি ঘটিয়ে মিয়ানমারের সাথে ফুটবল-কূটনীতি শুরু করা যায়। ভারতের সাথে ক্রিকেট নিয়ে আপাতত প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গাটা বড় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের সাথে তাদের জয়ের অভ্যস্ত ধারায় কেবল ছেদ পড়ে নি, রীতিমত ভবিষ্যতের জন্যেও বেশ বড় প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠার হুঁশিয়ারি দিল বাংলাদেশ। তবে সবারই মনে রাখতে হবে খেলার মাঠে ছোটবড় সবার সম্ভাবনাই সমান। প্রতিদ্বন্দ্বিতা না জমলে খেলার মজাই তো নষ্ট হয়। বাংলাদেশ এখন সেই মানে পৌঁছেছে যেখানে তাদের সাথে খেলাটা যেকোনো দলের জন্যেই চ্যালেঞ্জিং, ফলাফল আগেভাগে বলা সম্ভব নয়।
ক্রিকেট ময়দানে ভারত এখন থেকে বাংলাদেশকে কেবল যোগ্য প্রতিযোগীই ভাববে না, সমীহও করবে। এই বারতার ইতিবাচক দিকটিই যেন আমরা দেখি। আর যেন রাষ্ট্রের অন্যান্য সব ক্ষেত্রেও সবার সমীহ অর্জনের মতো করে নিজেদের তৈরি করি। মনে রাখতে হবে ক্রিকেটের মধ্যেই দু’দেশের সকল হিসেবনিকেশ সীমাবদ্ধ নয়। একটি দেশের পরিচিতি যেমন অনেক ব্যাপ্ত, বৈচিত্র্যময় তেমনি দুই দেশের সম্পর্কের পরিসরও অনেক বড়, অনেক বিচিত্র বন্ধন ও সম্ভাবনায়ও জড়ানো।

***