Sunday, September 20, 2015

বারবার তারা কেন জয়ী হবে?

আবুল মোমেন

এই যে লিবিয়া ইরাক এবং সম্প্রতি সিরিয়া থেকে দলে দলে মানুষ দেশত্যাগী হয়ে পাড়ি দিচ্ছে তার মূলে গেলে কোন চেহারাগুলো ভেসে উঠবে তা যেন ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দ বুঝতে পারছে না। ব্রিটেন ওদের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি অনুদার মনোভাব নিয়েছে। উত্তর-পশ্চিমের সুইডেন দুয়ার খুলতেই নারাজ। ফ্রান্সও দুয়ার এঁটে বসে থাকতে চাইছে। জার্মেনি-অষ্ট্রিয়ার সরকারি ঔদার্য অবাধ ছিল না, উদ্বাস্তুর সংখ্যা লাখ ছোঁয়ার আগেই তটস্থ হয়ে ওরা সীমানা বন্ধ করে দিয়েছে। মনের কথা খুলে বলেছেন হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী - মুসলমান উদ্বাস্তু নিতে তাঁর আপত্তি আছে। তাঁর মনোভাব হচ্ছে তাঁরই মত পুরো ইউরোপেরও আপত্তি থাকা উচিত।
লিবিয়া ইরাক সিরিয়া থেকে হঠাৎ বাঁধভাঙা ঢলের মত দারা-পুত্র-পরিবার নিয়ে মানুষ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ছাড়তে চাইছে কেন? আর কেউ না বুঝলেও ইউরোপেরই তো জানার কথা। 
তিনটি দেশে যে অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তার মূলে কারা? এসব অঞ্চলে যে আইএস আর আইএসআইএল নামে মুসলিম জঙ্গি সংগঠন সৃষ্টি হয়ে মানবতা ও মানবসভ্যতার বিরুদ্ধে তা-ব চালাচ্ছে তাদের এই সুযোগটা তৈরি করে দিয়েছে কারা? কারাইবা তৈরি করেছিল আল-কায়েদা, তালেবান? কারা পেছনে ছিল ওসামা বিন লাদেন কিংবা মোল্লা ওমর অথবা জওয়াহিরি-বকরদের উত্থানের পিছনে? একটু খবরাখবর যারা রাখেন তারা অবশ্যই জানেন কোন দেশগুলোর অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি অস্ত্রব্যবসায়? মানুষ এও জানে ডব্লিউএমডি বা গণবিধ্বংসী অস্ত্র মওজুদের অজুহাত তুলে কারা স্থিতিশীল দেশ ইরাক আক্রমণ করে সাদ্দামকে হত্যা করে ইরাকে বর্তমান গৃহযুদ্ধের নৈরাজ্য সৃষ্টির মূলে। মানুষ জানে গণতন্ত্রের নামে লিবিয়া-আফগানিস্তানে উপজাতীয় বিবাদ উশকে গৃহযুদ্ধের অবস্থা তৈরি করেছে কোন মিত্রশক্তি। আজ সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে হটানোর নামে কারা সে দেশের স্থিতিশীলতা ভেঙে দিয়ে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে? তা কি কারো অজানা? আজকের ইউরোপ অভিমুখী উদ্বাস্তু পরিবারগুলো তো এসব গৃহযুদ্ধেরই বলি।
অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রই এই মারাত্মক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টির মূল কারিগর। ব্রিটেন-ফ্রান্স-জার্মেনি মৈত্রী সূত্রে গণতন্ত্রের নামে এসব আগ্রাসনে অংশ নিয়েছে। সুইডেন খুচড়ো অস্ত্রের ব্যবসায়ে শীর্ষদের অন্যতম। কে না জানে গৃহযুদ্ধে ব্যবহৃত হয় এরকম অস্ত্রই। আইএসের কাছ থেকে কিংবা দস্যুতায় লিপ্ত গোষ্ঠীগুলোর কাছে থেকে তেল কিনছে যে সব বহুজাতিক কোম্পানি তাদের মালিকানা কাদের সেসবও সবারই জানা। আর ইতিহাসের পাতা ধরে পিছিয়ে গেলে জানা যাবে কীভাবে ব্রিটেন-ফ্রান্স-স্পেন-পর্তুগাল ছাড়াও হল্যাণ্ড-বেলজিয়ামের মত ছোট ছোট ইউরোপীয় দেশও একসময় এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপনের জন্যে হামলে পড়েছিল। আমরা জানি কী পাশব নৃশংসতায় তারা সব লুটে নিয়েছে উপনিবেশগুলোর। ছোট্ট প্রশ্ন - আজ পর্যন্ত সেসব বহুজাতিক কোম্পানির আড়ালে তেল ও অন্যান্য খনিজের ওপর প্রভুত্ব বজায় রাখছে কারা? মানুষ তো সব জানে। ইউরোপের বিত্ত, ঐশ্বর্য আর নাগরিকদের উচ্চমানের জীবনের পিছনে বিপুল পুঁজির যোগান এসেছে কীভাবে সে ইতিহাস আজ কারো অজানা নেই।
পালের গোদা আজ অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র এবং তারা যথেষ্ট ধূর্ততার সঙ্গে কাজ চালাচ্ছে। দেখুন মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে কতকগুলোতে - সৌদি আরব, কুয়েত, আরব আমিরাত প্রভৃতিতে - আছে তাদের বশংবদ সরকার। সেখানে নিজেদের স্বার্থে তেলের ব্যবসা চালিয়ে যেতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। অতএব এসব দেশে অগণতান্ত্রিক সরকার বহাল থাকলেও  গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কোনো তাগিদ তাদের নেই, মানবাধিকার নিয়ে মাথাব্যথা নেই। উত্তর আফ্রিকা ও মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও আধুনিক জীবনব্যবস্থায় অগ্রগামী ছিল লিবিয়া ও ইরাক। তদুপরি এ দুটি দেশের সরকার-প্রধান সাদ্দাম হোসেন ও মুয়ামার গাদ্দাফি ছিলেন স্বাধীনচেতা, এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। তাই এসব দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিম অস্থির হয়ে পড়েছিল। সরাসরি হস্তক্ষেপ করে দেশ দুটি তছনছ করে দিয়েছে। ইরান আর সিরিয়াকে বাগে আনতে না পেরে বড়ই পেরেশানে  আছে পশ্চিম। অবশেষে সিরিয়ার ব্যাপারে ধৈর্য রক্ষা করা গেল না। আক্রমণে এগিয়ে এলো আইএস - স্বার্থ সিদ্ধি হচ্ছে পশ্চিমের।  আর এরই খেসারত হিসেবে এত মানুষের ঢল ইউরোপ অভিমুখে। যুক্তরাষ্ট্র জানে উত্তর আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে তার দেশে ঢোকা সম্ভব নয়। যদি যায় তো ভূমধ্যসাগর অথবা তুরস্ক হয়ে ইজিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাবে মানুষ। ফলে তার গায়ে আঁচড়টিও লাগবে না। 
সাম্প্রতিক উদ্বাস্তু ঢলকে এসব অঞ্চলে পশ্চিমের হস্তক্ষেপ ও ভুল নীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। কিন্তু এও আমরা জানি জাতিসঙ্ঘ বলুন আর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা বা শরণার্থী কমিশন বলুন সর্বত্রই ওদের স্বার্থ বিবেচনার মানুষ রয়েছেন। তদুপরি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের সমর্থকরাই পাল্লায় ভারি। তারা তো শক্তি ও বিত্তের জোরে বিশ্বব্যবস্থাটা নিজেদের মত করে সাজিয়ে নিয়েছে।
পশ্চিমা উন্নত জীবন ও গণতন্ত্রের স্বপ্ন  দেখিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে বিশ্বশক্তির ভারসাম্যই শুধু নষ্ট করা হয় নি, তৃতীয় বিশ্বের স্বতন্ত্র অস্তিত্বও বিলীন হয়েছে এতে। গণতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতির ধুয়া তুলে একমেরু বিশ্বের নেতারা তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশকেই শক্ত স্বাধীন অবস্থানে থাকতে দিচ্ছে না। এভাবেই ভেঙে গেছে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে আফ্রো-এশীয় সংহতি পরিষদের, শক্তিহীন ও গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে আফ্রিকান ঐক্য সংস্থা, আরব লীগ, ওআইসির মত সংগঠনগুলো। বরং ডব্লিউটিও এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর ভূমিকা জোরদার করে পশ্চিমই এককভাবে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় চলে এসেছে।
আমার তো মনে হয় মর্যাদা ও স্বার্থ রক্ষার জন্যে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশসমূহের উচিত হবে জাতিসঙ্ঘের পাশাপাশি নিজেদের একটি স্বতন্ত্র জাতিসঙ্ঘ গড়ে তোলা। ইউএনওর পাশাপাশি ইউএনএএ বা ইউনাইটেড ন্যাশনস্ অব এশিয়া অ্যা- আফ্রিকা গঠিত হওয়া উচিত। ইতোমধ্যে চীন যেভাবে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প হিসেবে আরেকটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে তেমন সব উদ্যোগ নিতে হবে। নিজেদের বিবাদ মিটিয়ে চীন এসব উদ্যোগে ভারত ও জাপানকে সম্পৃক্ত করতে চাইছে। তাতে অগ্রগতিও আছে, যুক্ত হবে রাশিয়া - যেদেশটি ইউরোপ ও এশিয়ায় ছড়িয়ে আছে। ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া গুরুত্বপূর্ণ সদস্য দেশ হতে পারে।
এশিয়া আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার এইসব দেশের বিকল্প শক্তি দাঁড় করাবার সামর্থ্য রয়েছে। এসব দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে, ক্ষমতার স্থিতি নষ্ট হতে থাকলে সন্দেহ করতে হবে যে তার পেছনে পশ্চিমের স্বার্থান্ধ সাম্রাজ্যবাদের হাত আছে কিনা। কারণ, অতীতের এবং সাম্প্রতিক কালের সব ঘটনার পেছনেই তাদের হাত ও কারসাজি তো জলজ্যান্ত সত্য বিশ্ববাসীর সামনে। দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তি মানুষ মানবিক ও উদার হলেও রাষ্ট্রশক্তি শেষ পর্যন্ত স্বার্থান্ধ হয়ে পড়ে। ফলে আরও সাবধানতা দরকার। ওরা বারবার ধর্মের কার্ড খেলে চলেছে, উত্তরোত্তর কট্টর জঙ্গি পন্থীদের ভরসা করছে ও উশকে দিচ্ছে। মুখে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের বুলি আওড়ালেও এসব কি কোথাও তারা বাস্তবায়ন করেছে, করতে পেরেছে যেসব দেশে হাজার হাজার মানুষ খুন হয়েছে আর লাখ লাখ মানুষ মাতৃভূমি ত্যাগে বাধ্য হয়েছে এর খেসারত হিসেবে? না, তারা পারে নি, কারণ গণতন্ত্র রফতানি-যোগ্য পণ্য নয়। একইভাবে মানবাধিকার বা আইনের শাসনও রফতানি করা যায় না। তা সংশ্লিষ্ট জনগণকেই অর্জন ও আদায় করতে হয়। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুতে সে প্রক্রিয়াকে তারা বরং ব্যাহত করেছে।
ধর্মের আফিমের মত ব্যবহার গরিব দেশে এখনও কার্যকর - এটা মস্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়। উগ্র ও জঙ্গি ধর্মপন্থার আড়ালে সাম্রাজ্যবাদ নতুন নতুন কায়দায় ঠিকই তার স্বার্থ হাশিল করে যাচ্ছে। এতে মানুষের সত্যিকারের ধর্মবোধ, মানবিক নৈতিকতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অযথা বিঘ্ন ঘটছে। সাম্রাজ্যবাদ অবশ্যই বরাবরই চতুর ধূর্ত খেলোয়াড়। কিন্তু বারবার তারাই জয়ী হবে?

Monday, September 14, 2015

মিলানেও উচ্চারিত হল সংস্কৃতির গুরুত্বের কথা

আবুল মোমেন

আরব বিশ্বে ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের যোদ্ধাদের হাতে একের পর এক প্রাচীন সাংস্কৃতিক নিদর্শন ধ্বংস হওয়ার পর রণাঙ্গনের বাইরেও প্রতিকার নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক যে সংস্থাটি মানবসভ্যতার এসব মূল্যবান প্রত্নসম্পদ রক্ষার কাজে নিয়োজিত সেই ইউনেস্কো সঙ্গতভাবেই এগিয়ে এসেছে। এরই রেশ ধরে ইতালির সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রী বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন ডেকেছিলেন মিলানে। মিলান এক্সপো ২০১৫-এর সম্মেলন কক্ষে এটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে আমাদের সংস্কৃতি সচিবের সাথে আমারও যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল।
এতকাল সাংস্কৃতিক নিদর্শন রক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা দুর্ঘটনা অথবা পাচারকারীদল। কিন্তু এরকম স্বেচ্ছাপ্রণোদিত পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ এক অভাবিত ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। এরকম পরিস্থিতি অভিনব, এরকম প্রতিপক্ষও কল্পনাতীত ছিল সকলের। মিলানে আলোচনার একটি মোদ্দা শিরোনাম ছিল : জাতিসমূহের মধ্যে সংলাপের উপকরণ হিসেবে সংস্কৃতি। এতে উপস্থিত ৮৫টি দেশের মন্ত্রী বা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের মধ্যে দু’দিনে (৩১ জুলাই ও ১ আগস্ট) ৫৭ জন কথা বলেছেন। প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ সময় ছিল ৪ মিনিট করে। ইতালির সংস্কৃতি ও পর্যটন বিষয়ক মন্ত্রী ও লেখক দারিও ফ্রান্সেসচিনি এতসব কেউকেটা ব্যক্তিদের সামলেছেন ভালোভাবেই। মিনিটখানেকের বেশি বাড়তি সময় কেউ নিতে পারেন নি। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রীকে বরাদ্দ সময়ের মধ্যেই কথা শেষ করতে হয়েছে। মাইক্রোফোনে কলম বেশ জোরেই ঠুকে সময়-সচেতন করেছেন সকলকে। বক্তৃতায় প্রত্যেকেই নিজ নিজ সংস্কৃতির মানবিক ঐতিহ্যের দিক তুলে ধরেছেন, পাশাপাশি সংস্কৃতি আদানপ্রদানের গুরুত্বও স্বীকার করেছেন। বাঙালি সংস্কৃতির মানবিক ঐতিহ্যের ধারা এবং বর্তমান সরকারের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী কঠোর ভূমিকার কথা আমাদের দিক থেকে সংস্কৃতি সচিব ভালোভাবে তুলে ধরেছেন।
মানবিক সংস্কৃতির ধারা ও সাংস্কৃতিক সম্পদ রক্ষা যে যুদ্ধের মাধ্যমে সম্ভব নয় তা সকলেই বুঝতে পারছেন। এটি কেবল স্থানীয় কিছু মানুষের সচেতনতাতেও সম্ভব হচ্ছে না। এর জন্যে সকলের চিন্তার নৈকট্য দরকার এবং তাই সব দেশ মিলে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলা জরুরি। এভাবে একটি সম্মিলিত বৈশ্বিক প্রয়াস দ্রুত প্রণীত ও বাস্তবায়িত হওয়া দরকার। সেই তাগিদ থেকেই মিলানের এ সম্মেলন।
বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের এ উপলব্ধি উপস্থিত নগণ্য আমাকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছে। এর একটি বিশেষ কারণ আছে। ১৯৭৫-এর পট-পরিবর্তনের পর দেশে যখন আমাদের জন্যে দমবন্ধ-করা পরিবেশ তখন তেমন কিছু না ভেবে শিশুদের আনন্দে-সৃজনে মাতিয়ে রাখার যে কাজ শুরু করেছিলাম তা পাঁচ বছরের মধ্যে শিশুশিক্ষার কাজে টেনে নিয়েছিল আমাদের। কাজটার প্রাথমিক তাড়না এসেছে প্রতিষ্ঠান রক্ষার প্রয়োজনে। তার সাথে ছিল শিশুদের মানসগঠনে বুনিয়াদ তৈরিতে ভূমিকা রাখার তাগিদ। বুঝতে পারছিলাম শিক্ষা হল মূল জায়গা, সেখানে কাজ না হলে তাদের মনে স্থায়ী প্রভাব ফেলা যাবে না।
কাজ শুরু করে বুঝতে পারলাম প্রথাগত শিক্ষার ধারা আমাদের কাজে আসবে না। নিজেদের পথ নিজেদেরই তৈরি করতে হবে। মাটি তৈরি না করেই শিশু-চারার কাছে ফল চাওয়ার যে প্রচলিত ধারা তা আমাদের অন্যায় এবং নিষ্ঠুরতা বলে মনে হয়। আমরা দুটো বক্তব্যের ওপর জোর দিয়েছিলাম - ভয়হীন আনন্দময় পরিবেশে শিক্ষা এবং পরোৎকর্ষ (perfection) নয় অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি। অভিভাবকদের ডেকে বললাম আমাদের ওপর আস্থা রাখতে, ব্যক্তিগতভাবে আমি ও অধ্যক্ষা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের জিম্মাদার হতে চাইলাম। আমাদের কথা ছিল - এ বয়সে অন্তত তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ওরা কেবল গ্রহণ, সংগ্রহ ও সঞ্চয় করবে - এর পরিমাপের দায়িত্ব থাকবে কেবল স্কুলের। স্কুলই দেখবে তাদের ভাণ্ডারে কতটা ছড়া, কবিতা, গল্প, নানা তথ্য, বিভিন্ন ধারণা, জ্ঞানের কথাবার্তা জমা পড়ছে এবং যা জমছে তার মান কেমন। এ পর্যায়ে তাদের গোগ্রাসে নিতে দিন - সব ইন্দ্রিয় পূর্ণ সত্তায় নিতে থাকুক। আমরা বলেছিলাম, একটু চ্যালেঞ্জ দিয়েই, ওদের ভিত্তির পরিসরটা আমরা অনেক বড় ও গভীর করে দেব, তাতে বড় হয়ে কোনো পর্যায়েই আর তাদের ঠেকতে হবে না। তারা নিজের শক্তিতেই এগিয়ে যাবে। প্রথম বছরে আমাদের ওপর আস্থা রাখলেন ১৫ জন অভিভাবক। তারা নানা রকম পরিবার থেকে এসেছেন - উচ্চশিক্ষিত চাকুরে, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, মাঝারি দোকানদার, তবে বেশির ভাগ ছিল নিম্নমধ্যবিত্ত চাকুরে পরিবারের ছেলেমেয়ে। বলাই বাহুল্য, অভিভাবকরা নিশ্চিন্ত ছিলেন না, এরকম নিরীক্ষাপ্রবণতার ঝুঁকিটা তাঁদের সবসময় ভাবিত রাখত। অধ্যক্ষা হিসেবে শীলা মাঠে থেকে অভিভাবকদের প্রাত্যহিক চাপ সামলে গেছে। সবার কথা ছোট্ট পরিসরে বলা যাবে না, প্রথম যে ছাত্রটি ভর্তি হয়েছিল, টিঅ্যাণ্ডটির সীমিত আয়ের চাকুরে পিতার সন্তান, সে এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের প্রধান। এভাবেই আমরা চলেছি, এবং চেয়েছি চালিয়ে যেতে। 
আমরা চেয়েছি ওদের মনের সবকটা জানালা সবসময় খোলা রাখতে। পরীক্ষা এক ধরনের কপাট, আবদ্ধতা তৈরি করে। একে বড় করে তুলে বাধার প্রাচীর বানিয়ে কোনো চাপ তৈরি করতে চাই নি। প্রত্যেক ছাত্র গাইতে পারত, আবৃত্তি পারত, গল্পবলা, বিতর্ক - সবই পারত (এখনও স্কুলে ছাত্রসংখ্যা অনেক বাড়ার পরও বেশিরভাগই পারে)। পঁচিশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে প্রাক্তনীদের স্বতস্ফূর্ত ও সপ্রতিভ সব পরিবেশনা দেখে উপস্থিত বহুজাতিক কোম্পানির এক প্রধান কর্তাকে এদের এই সপ্রতিভতা ও পারঙ্গমতা চমকে দিয়েছিল।
এসবই শিশুদেরই কৃতিত্ব। আমরা কেবল তাদের সুপ্ত ক্ষমতাগুলো জাগিয়ে তুলতে ও রাখতে চেয়েছি, চেষ্টা করেছি অনাহুত অন্যায্য চাপের কারণে এসব যেন নষ্ট না হয়।
আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই আমরা বাইরেও একটু বলতে থাকলাম - শিশুশিক্ষা মূলত একটি সাংস্কৃতিক কাজ। গানবাজনা বা কলা (art) অর্থে নয়, সৃজনশীলতা, সুরুচি, সৌন্দর্য এবং মাত্রাজ্ঞানের মত গুণের চর্চা ও তা আয়ত্ত্ব করাই সংস্কৃতি চর্চা। নীতিবোধ ও মানবিকতার বিষয়ে সংবেদনশীলতাও এতে তৈরি হয়ে যায়। এই শেখার নৈপুণ্য মেলে কেবল যথার্থ সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে। তাই শিক্ষার সুফল পাওয়ার শর্ত হল উপযুক্ত মানবিক সাংস্কৃতিক বাতাবরণ নির্মাণ। ফুলকিতে আমরা এই চেষ্টাই করেছি। প্রাথমিকে এভাবে তৈরি হলে তারা পরবর্তী উচ্চতর ধাপগুলো যোগ্যতার সাথে পেরুতে পারে।
যত দিন গেছে, দেশের অর্থনৈতিক বা মানুষের বৈষয়িক উন্নতি হলেও, সামাজিক সংকট ঘনীভূত হয়েছে। সামরিক ও ছদ্ম সামরিক শাসন তো বটেই এমনকি গণতান্ত্রিক আমলেও এ সংকট কেবল ঘনিয়েছে। এর প্রতিষেধক যে যথার্থ শিক্ষা তা কেউই তেমন ভাবেন নি। এক সময় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ, মাদক ও অপরাধ মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে অনেককেই ভাবিত করেছে। প্রচলিত শিক্ষার সীমাবদ্ধতা নজরে পড়ল এবং মানসম্পন্ন আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা একটি বড় কাজ বলে মনে করলেন অনেকেই। এ ধারায় দেশের অগ্রণী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট প্রতিষ্ঠা করল নালন্দা ২০০১ সনে। এ স্কুল এখন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অনেকেরই মনোযোগ পাচ্ছে। এটা আশার কথা। কিন্তু এ দেশে যে স্কুলগামী ছাত্রের সংখ্যা চার কোটির অধিক। তাদের পরীক্ষামুখী মুখস্থ বিদ্যার দু:স্বপ্নের (আইনস্টাইনের ভাষায়) মধ্যে ফেলে রেখে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি উদ্যোগ কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারবে সমাজে!
তবে আশার কথা সরকারের ভিতরেই অনেকেই বিষয়টা নিয়ে ভাবছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সচেতন, সংস্কৃতিমন্ত্রী বিষয়টা বোঝেন ও কিছু করতে আগ্রহী, এবং শিক্ষামন্ত্রীসহ মন্ত্রি-পরিষদের আরও অনেকেই হয়ত এ নিয়ে ভাবেন। সচিবালয়েও কর্মকর্তাদের অনেকের মধ্যে ইতিবাচক ভাবনা রয়েছে। আমরা বুঝি অভ্যস্ত ধারা থেকে নতুন একটি ধারায় আসার ঝুঁকি নিয়েও তাঁদের ভাবনা-দুর্ভাবনা রয়েছে। এটা আদতে আলাপ-আলোচনা ও মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষামূলক কাজ করে ক্রমে সর্বত্র বাস্তবায়নের বিষয়। তবে কোনো অবস্থাতেই সময়ক্ষেপণের সুযোগ নেই। মাত্রাতিরিক্ত পরীক্ষার অব্যাহত মুখস্থের প্রবণতাই কেবল বাড়ছে না চাপের মধ্যে থাকা ছাত্রদের মাদক ও ধর্মান্ধতাসহ অন্যান্য ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে। নিজেদের জানাবোঝার ঘাটতি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই হচ্ছে না এবং পুঞ্জিভূত ঘাটতির বিপুল ফাঁক নিয়ে তারা সর্বোচ্চ শিক্ষার দুয়ারে এসে রীতিমত হোঁচট খাচ্ছে। সেখানে তৈরি হয়েছে জ্ঞানের দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ এক বাস্তবতা।
মিলানের সম্মেলন থেকে কেন ফুলকির কথায় এসেছি সেটা আশা করি পরিষ্কার হয়েছে। পচাত্তরের পটপরিবর্তন এবং পরবর্তী অবক্ষয়ের মুখে ত্রিশ বছর আগে যে কথাটি ফুলকি বলেছিল, আজ দ্যাখা যাচ্ছে তা অন্য এক ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে বিশ্বনেতৃবৃন্দের চিন্তায়ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে।
আসলে একজন মানুষ যতটা সামাজিক জীব ততটাই সাংস্কৃতিক প্রাণী। শিক্ষা, ধর্ম, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, খাদ্য, সজ্জা, ভাষা, শিল্প - মানুষের চর্চিত ও আচরিত এবং সৃষ্ট ও কৃত সকল কর্ম মিলে তৈরি হয় তার সংস্কৃতি। এর গোড়াপত্তন শৈশবে না হলে সর্বনাশ, কারণ এসময়ই মনোজগতের ভিৎ তৈরি হয়ে যায়। বিষয়টা ফ্যাল্না নয়, জাতির ভবিষ্যত এবং দেশের অগ্রগতির সাথেই এটি যুক্ত।

***

Monday, September 7, 2015

ধিক্কারের অধিক


আবুল মোমেন

এটা ছবি?
এটা কি শিশুর ছবি?
না, এটা তো ধিক্কার,
ধিক্কারের অধিক,
তিরস্কার -
আমাকে তোমাকে
পৃথিবীসুদ্ধ মানুষকে।

ভূমধ্যসাগর কেন হবে
আয়লানের প্রতিপক্ষ বলো,
যুদ্ধবাজ জঙ্গি মুসলিম আর
আপন পাপের প্রায়শ্চিত্তে বিমুখ
উদাসীন গৃধ্নু প্রতীচী
যুগপৎ ইতিহাস থেকে বর্তমানে
যোগসূত্র বেঁধেছে যখন!

এটা ছবি?
এটা কোনো ছবি হলো?
যা কিছু দেখছি প্রতিদিন
এর একটিও ছবি নয়,
ভুলেও ভেবো না এরা শুধু ছবি,
সব কটি ধিক্কার এরা,
ধিক্কারের অধিক
তিরস্কার।

 লোকেই দিয়েছে নাম ছবিটিকে
- ভেসে যাওয়া মানবতা।
সেই সাথে বলো
সভ্যতার অবনত পতাকার প্রতিচ্ছবি।
তোমরা ভুলো নি নিশ্চয়
ইতিহাস -
এসবই তো মানচিত্র ভাগের
সেই পুরোনো খেলার
শেষ-দৃশ্যের ছবি।
লোভ আর নিষ্ঠুরতার
অবিনত আগ্রাসনে ক্লান্ত শ্রান্ত
মাথাহেঁট - ন্যায় ও জয়ের
অস্তরবি।
এসবই মনুষ্যত্ব বলিদানের
বিয়োগান্ত মর্মান্তিক
অন্তিম সময়ের
ধাবমান দৃশ্যাবলী।
যবনিকা - টলতে টলতে ধীরে
এগিয়ে আসছে
সভ্যতার ভগ্নস্তূপ জুড়ে।

হায় পয়গম্বর, হায় যীশু
হায় হায় সক্রেটিস
কী হাল দেখি তোমাদের
অনুসারীদের?
এক দল খুনে লিপ্ত, মুখর ধ্বংসে,
অন্যরা গা বাঁচাতে উদ্গ্রীব!

মানবতা নয়, আপন
মনুষ্য পরিচয়ও নয়,
সবকিছু জমে জমে তলিয়ে যাচ্ছে
ভূমধ্যসাগরের অতল সুনীলে।
শিশু নয়, ওরা নয় নারী,
নয় যেন একটিও মানুষ ওখানে -
ভয়-পাওয়া তাড়া-খাওয়া যারা
ছুটছে ওখানে, শূন্য চোখে
ওদের বারতা একটিই -
সভ্যতার ঘণ্টা বেজেছে,
ছুটি হয়ে গেছে।
যে ওখানে শুয়ে আছে
সে কিন্তু আয়লান কুর্দি নয় -
ছিন্ন পাপড়ি ওটি
উড়ে এসে ভেসে এসে
পড়েছে ওখানে।
প্রাণ দিয়ে বহন করেছে
সাধ্য ছিল যতটুকু
ওর ছোট্ট দেহের
পাপার্ত এ পৃথিবীর
অবশিষ্ট পুণ্যটুকু।

ওরা তো শিশু নয়.
জলের জিম্মায় প্রাণ রেখে
জননী মৃত্তিকায়
ফুটে আছে
শুভ্র পারিজাত ফুল,
জবাব দিচ্ছে তোমাদের
খুনে-স্বভাবের আর
টেনে খুলে দিচ্ছে
মুখোশ সবার -
তোমার আমার। আর
হাটে হাড়ি ভেঙে জানিয়ে দিয়েছে
সভ্যতার নামে যত জারিজুরি।

দেবশিশু লজ্জায় মুখ নিচু
করে আছে।
এত শূন্য ফাঁপা মানুষের কাছে
তার নেই কোনো প্রত্যাশা।
বাবাকে বাঁচার শেষ আকুতিতে
ধ্বনিত হয়েছে শিশুকণ্ঠে
ধিক্কারের রুদ্র ভাষা।
তারপর খুলেছে অর্গল।
অবশেষে সভ্যতার শ্লেষ্মা ঝেড়ে
আড়মোড়া ভেঙেছে ইউরোপ,
যদিও ওপাড়ে দলপতি
এখনো নিশ্চুপ।
কথা হল, কতটা জাগবে
সবার বিবেক? বলি,
কতদূর, কতদিন স্থায়ী হবে
জাগরণ?

তোমাদের বুদ্ধি বটে
ওকে ভাবো কুর্দি আয়লান শুধু
বেহদ্দ বেকুব যত -
এখন ও শুধুই ধিক্কার,
বিবেকের ছিন্ন পাপড়ি।
মুখ নিচু করে উপুড় শরীরে
প্রত্যাখ্যান করেছে ব্যর্থ
আমাদের। আর ওর
নিথর ভাষায় সোচ্চার
শুয়ে আছে যে শরীর
সেটি কোবানি শিশুর নয়,
দগদগে মোটা অক্ষরে
লিখেছে সে
প্রত্যাখ্যান।
ওটি শিশু নয়,
শুধ্ইু তজর্নি
দ- ঘোষণার আগে
উঁচানো আঙুল।
শিশুর বারতা সামান্যই -
ধিক্কার তোমাদের,
ধিক্কারের অধিক
তিরস্কার।
৫-৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫
চট্টগ্রাম