Saturday, February 1, 2014

শেখ হাসিনা একাই খেললেন, তারপর?

আবুল মোমেন

তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত সংসদীয় উপ-কমিটির সুপারিশ অগ্রাহ্য করে নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে বস্তুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ক্ষমতার রাজনীতির নিয়ন্ত্রণভার এককভাবে নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। এটি কি বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে বড় কোনও পরিবর্তনের মাইলফলক হতে যাচ্ছে? পরিবর্তনটা কোনদিকে হবে - উত্তরণের, নাকি অধঃপাতের? এ প্রশ্নটা এখন অনেকের মনে ঘুরপাক খাবেই।
সমাজের নীরব সংখ্যাগুরু মানুষ সম্ভবত খারাপ কিছুর আশঙ্কা করেছে। কারণ শেখ হাসিনা সেই সিদ্ধান্ত ও পরবর্তী ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির সব ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এককভাবে, দলীয়ভাবে তা ছিল একতরফা, এসব বাস্তবায়নের পথ ছিল জবরদস্তিমূলক ও এসবের চূড়ান্ত পরিণতিতে যে নির্বাচন- তা ছিল বস্তুত প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন, মোটামুটি ভোটারবিহীন। এসব ঘটনাবলিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো উপেক্ষিত, এমনকী পদদলিত হয়েছে, সাধারণ নৈতিকতা লঙ্ঘিত হয়েছে। তাই নির্বাচন এবং দশম সংসদ ও নতুন সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সরকার ও ক্ষমতাসীন জোটের দিকে নৈতিকতা ও বৈধতার প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া যায়, মিথ্যাচার ও কর্তৃত্ববাদী জবরদস্তি শাসকের অপবাদ দেওয়া যায়। এসবই বিরোধীদলীয় নেতাদের মুখে, জনগণের আলাপে, গণমাধ্যমে এখনও ব্যাপকভাবে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এতসব নেতিবাচক সমালোচনা কুড়িয়েও বর্তমান সরকারের নিজেকে দুর্বল ভাবার বাস্তব কোনও কারণ ঘটেনি। বরং যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো- যারা সারা বিশ্বে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়নে সদা উৎসুক ও তৎপর থাকে এবং বাংলাদেশেও বরাবর সেভাবেই ভূমিকা পালন করে এসেছে ও বিশেষভাবে দশম সংসদের নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট সংঘাত এবং অচলাবস্থার সময় সোচ্চার ও সক্রিয় ছিল, তারাও দেখা যাচ্ছে, এখন আলোচনা-সমঝোতা ও নতুন নির্বাচনের কথা নামমাত্র বলে বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার কথাই দ্ব্যর্থহীনভাবে জানাতে উৎসুক। এভাবে তাদের মূল ভরসার দেশগুলোর পিছু হটা দেখতে নিশ্চয় বিএনপি নেতৃত্ব প্রস্তুত ছিল না। তাছাড়া বাংলাদেশের জনগণের রাজনীতি-সচেতনতা নিয়েও সবার ভরসা অনেক বলে বিরোধীপক্ষ তাদের মোটামুটি জনসমর্থিত দাবিতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে জনগণের ব্যাপক সাড়া প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু তারা সেভাবে সাড়া দিচ্ছে না, নিজ-নিজ নিরাপদ অবস্থানে থেকে মতামত দিলেও বিএনপির ডাকে পথে নামছে না। এখন প্রশ্ন হল, কেন এমন ঘটছে বা ঘটেছে?
সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার এতসব মোক্ষম ইস্যু থাকা সত্ত্বেও তা দানা না বাঁধার দায় তো প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকেই নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্রদের মন প্রথম পর্যায়ে জামায়াত সম্পর্কে নমনীয় থাকলেও শেষ পর্যন্ত তাদের পক্ষে আনতে শেখ হাসিনা ও তার জোট সক্ষম হয়েছে। অথচ বিএনপি এদের মুখাপেক্ষী হয়েও শেষ পর্যন্ত জামায়াতের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার নীতিই বহাল রেখেছে। তাতে এ ইস্যুটা কোনওভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক রাখার পাশাপাশি জামায়াতের নেতিকরণের কাজটি অনেকটাই সফল হয়েছে। তবে এ সাফল্যের কৃতিত্ব ততটা আওয়ামী লীগের নয়, যতটা একদিকে তরুণসমাজ ও সুশীলসমাজের এবং অন্যদিকে খোদ জামায়াতের। নাগরিকসমাজের মনোভাবকে আন্তর্জাতিক মহল উপেক্ষা করতে পারে না। আর সর্বশেষ আন্দোলনে প্রধানত জামায়াতের ক্যাডারদের ভূমিকা নির্মমভাবে গণবিরোধী ও ধ্বংসাÍক হওয়ায় এবং এর ধর্মীয় সংখ্যালঘুবিরোধী সাম্প্রদায়িক ভূমিকা প্রকট হওয়ায় পশ্চিমা বিশ্বের জন্য তাকে সমর্থন করা মুশকিল ছিল। জামায়াত এ ধরনের হিংসাÍক ধ্বংসাÍক রাজনীতি পরিহারের কোনও ইশারা দেয়নি, আর বিএনপি তাদের ত্যাগ করার পরামর্শে কান দেয়নি। ফলে অন্তত সাময়িকভাবে বিএনপি তার সম্ভাব্য মিত্রদের সমর্থন থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
এদিকে জনগণের জন্যও একইভাবে যেমন পেট্রলবোমার মর্মান্তিক পরিণতি মেনে নেওয়া কঠিন ছিল, তেমনি কঠিন হয়েছে অবরোধের ফলাফলের ভোগান্তি দীর্ঘদিন সহ্য করা। সম্ভবত জনগণের সচেতন অংশটির মনোভাবও জামায়াত সম্পর্কে নমনীয় নেই আর। তাদের বিএনপির প্রতি অনীহা নেই। কিন্তু ভরসাও নেই দলটির ওপর। ভরসা দুর্বল হয়েছে নানাভাবে। বিএনপির আন্দোলন চলে গেছে জামায়াতের হাতে- যারা জেহাদি জোশের প্রচারণা চালিয়ে একশ্রেণীর তরুণকে নিরীহ মানুষ মারতে উস্কে দিয়ে কসুর করে না। এর দায় মানুষ নেবে না। দ্বিতীয়ত, বিএনপি রাজপথে জঙ্গি আন্দোলনের ডাক দিয়ে তাতে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়নি- হয় শান্তভাবে কারাবরণ করেছে, নয়তো আÍগোপন করে আÍরক্ষা করেছে। ফলে একদিকে সংসদ ও নির্বাচন বর্জন করে, অন্যদিকে কারাবরণ ও পলাতক হয়ে বস্তুত তারা রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে দিয়েছে বহু আগে থেকেই। এতে সমর্থক ও ক্ষমতায় পরিবর্তনপ্রত্যাশীদের কাছে বারতাটি এসেছে যে, নিজ দলের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের প্রতি বিএনপি নেতৃত্বের বিশ্বাস এবং অঙ্গীকার আদতে দৃঢ় নয়। এই একটি ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা দুঃসময়ের পরীক্ষায় একেবারে শতভাগ উত্তীর্ণ। আর খালেদা জিয়া থেকে বিএনপির জেলা নেতা- সবাই তাদের সমর্থকদের আশাহত করেছেন। কথায় বলে- দৌড়ে যে ঘোড়াটি পিছিয়ে পড়ে, তার থেকে সমর্থন তুলে জয়ী ঘোড়ার ওপরই বাজি ধরতে চায় মানুষ।
শেখ হাসিনা যেভাবে বিজয় অর্জন করে চলেছেন, তার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে- সে কথা আগেই বলেছি। কিন্তু যেনতেন প্রকারের বিজয়ও টিকে যায় যদি উপযুক্ত কোনও স্থান থেকে চ্যালেঞ্জ না আসে। বিএনপি এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে, আর জামায়াত হচ্ছে সেই কার্যকারণ- যা দ্বিধারী ছুরির মতো নিজের ও সঙ্গী বিএনপির সমর্থনের ওপর কোপ দিয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে- স্যামসনের যেমন শক্তির উৎস ছিল তার চুল, বিএনপির হল ক্ষমতা। ক্ষমতা হারিয়ে দলটি শক্তিহীন হয়ে সরকারের ওপর রাগ করে জনগণকে দুর্ভোগে ফেলে স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছে। এতে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সরকারকে দুর্ভোগে ফেলার বা অচল করে দেওয়ার ভাবনা সম্পূর্ণ বাদ গেছে। আর এর ফলে জনদুর্ভোগ কমাতে সরকার শক্ত হাতে বিএনপিকে দমনের সুযোগ পেয়ে গেছে। সুযোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে জামায়াত সম্পূর্ণ নাশকতানির্ভর রাজনীতি করতে গিয়ে। এর জের ধরে পুলিশ-র‌্যাবের ‘বন্দুকযুদ্ধ’ পর্ব এখনও চলছে। এ নিয়ে মানবাধিকারকর্মীদের কণ্ঠ শোনা গেলেও জনগণের উদ্বেগ নেই।
নাগরিকসমাজের বড় একটি অংশ ১৯৭৫ সালের পর থেকেই পুনরায় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ভিত্তিতে অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠন ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশ-পরিচালনার গুরুত্ব অনুধাবন করে আসছে। তারা কখনও মাঠ ছাড়েননি। তাদের জেদেই শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক এবং নাগরিকসমাজ এই আদর্শের প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। তার প্রকাশ হিসেবে আমরা দেখছি বিএনপি-আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলকে এই আদর্শের ভিত্তিতে দুটি জোটে বিভক্ত করেছে, আর সব পেশাজীবী সংগঠনে বিভক্তি ঘটিয়েছে। এসব সংগঠনের জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন বহুকাল ধরেই এ বিভক্তির ভিত্তিতে হয়ে এখন কোনও-কোনওটি স্থায়ীভাবে পৃথক সংগঠনের রূপ নিয়ে আর নির্বাচনেও একে অন্যের মোকাবিলা করতে রাজি নয়। জাতীয় রাজনীতি যেহেতু পুরো দেশ নিয়ে এবং দেশের একটি সরকার গঠন নিয়ে- সেহেতু এখানে সে সুযোগ হচ্ছে না, মুখোমুখি হতেই হচ্ছে। কিন্তু নির্বাচনের পর ঠিকই সংসদ বর্জনের মাধ্যমে মোকাবিলা না করার সংস্কৃতি চালিয়ে গেছে দলগুলো।
সম্প্রতি গণজাগরণ মঞ্চের উত্থানের পর দেশের নবপ্রজšে§র মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি আস্থার প্রকাশ ঘটেছে। বিএনপি এই উদীয়মান শক্তিকে একেবারেই পাত্তা দেয়নি, বিপরীতে ঘনিষ্ঠ হয়েছে জামায়াত-হেফাজত প্রভৃতি ধর্মব্যবসায়ী প্রতিক্রিয়াশীল দলের সঙ্গে। সমাজের প্রায় সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়া এ বিভক্তির চর্চা ক্রমেই রাজনীতিকে সহিংস করে তুলেছে, নাগরিক জীবনকে করে রেখেছে অস্থির। এ পরিণতি থেকে এটা পরিষ্কার- যদি আমাদের সমাজ এই অস্থিতিশীলতা ও সহিংস রাজনীতির অবসান চায়, তাহলে সমাজের বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা ও তর্ক উš§ুক্ত রাখতে হত। কিন্তু সেটি প্রায় তিন যুগেও হল না। শেখ হাসিনা গতবার বিপুল বিজয়ের পর ক্ষমতায় থেকেই বিষয়টির নিষ্পত্তি চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন। বিরোধী দলের ভ্রান্ত রাজনীতি ও সাংগঠনিক দুর্বলতায় তাতে আপাতত সফলও হয়েছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, চাপিয়ে দেওয়া হলেও এই সমাধান তেমন দুর্বল হয়নি। দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে গণজোয়ার না হলেও সমর্থনের ভিত বেশ ব্যাপক, তারা শেখ হাসিনার সমাধানকে মন্দের ভালো ও সাময়িক সমাধান হিসেবে গ্রহণ করেছে। দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক মহলও একইভাবে এ সমাধান মেনে নিয়েছে।
তবুও বিরোধী দলের জন্য সুযোগ রয়েছে। তা রয়েছে মানুষের মনের ‘মন্দের ভালো’ বোধের ভাবাবেগ ও বিগত নির্বাচনটিকে সাময়িক সমাধান ভাবার মধ্যে। এ সত্ত্বেও এদের আন্দোলনে টানতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে, সময় নিয়ে ধাপে-ধাপে আন্দোলন তুঙ্গে তুলতে হবে। আর আওয়ামী লীগকে শেষ রক্ষা করতে হলে একচেটিয়া ক্ষমতার সর্বনাশা পরিণতি রোধ করতে ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের বেপরোয়া নেতাকর্মীদের সামলাতে হবে, সুশাসনের পথ উš§ুক্ত করতে হবে, দুর্নীতিরোধে সর্বাÍক ব্যবস্থা নিতে হবে এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯-দলীয় জোটের সঙ্গে অর্থপূর্ণ সংলাপ চালাতে হবে। সম্ভবত, এসব কাজে শেখ হাসিনাকে একক কেন্দ্রীভূত হুকুমদারির নেতৃত্ব থেকে সরে অংশীদারী নেতৃত্বের পথে হাঁটতে হবে। কেননা তা না হলে নেতৃত্ববঞ্চিত বিভিন্ন স্তরের নেতাদের উপদলীয় কোন্দল আর দায়িত্বমুক্ত থেকে ক্ষমতার প্রসাদ লুণ্ঠনে মত্ত হওয়া থেকে বিরত রাখা কঠিন হবে। তাই শেখ হাসিনার জন্য কাজটা কঠিন সন্দেহ নেই। তবে সে পথেই টেকসই ও সুদূরপ্রসারী সমাধান মিলবে।