আবুল মোমেন
মানসম্পন্ন শিক্ষাই এখন সরকারের লক্ষ্য।
সরকারি জরিপেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদের মান আশানুরূপ পাওয়া যায় নি। আর অতি
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের একটি জরিপে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে র্যাংকিং প্রকাশিত হয়েছে তাতে
বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই এক হাজারের মধ্যে স্থান পায় নি। ফলে মানতেই হবে শিক্ষার
সব স্তরেই মানের সমস্যা রয়েছে। তবে বুঝতে অসুবিধা হয় না সমস্যার সূচনা একেবারে গোড়া
থেকে অর্থাৎ প্রাথমিক পর্যায় থেকেই।
একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় আমাদের শিশু
ও তরুণদের মেধার ঘাটতি নেই। এর একটি বড় প্রমাণ হল বিদেশে সঠিক সুযোগ সুবিধা পেলে ছেলেমেয়ে
নির্বিশেষে খুব ভালো ফলাফল করে থাকে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত এবং
স্কুল সময়ের স্বল্পতা শ্রেণিকক্ষে ভালো পাঠদানের পথে বড় বাধা। এছাড়া পাঠাগার, বিজ্ঞানাগারের
সংকট ও তা যথাযথভাবে ব্যবহারের জন্যে প্রয়োজনীয় লোকবল ও সদিচ্ছার অভাবও কম বড় সমস্যা
নয়। এছাড়া খেলার মাঠ ও সংস্কৃতি চর্চার সুযোগবিহীন কেবল পরীক্ষানির্ভর এই শিক্ষার সামগ্রিক
পরিবেশ শিশু ও তরুণদের সুস্থ ও সুষ্ঠু মানসবিকাশের
অনুকূল নয়। এসব বাধা দূর ও চাহিদা পূরণ না করে আমরা হয়ত মানসম্পন্ন শিক্ষার লক্ষ্য
অর্জন করতে পারব না।
এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে সামগ্রিকভাবে
আমাদের দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক চেতনার ও পরিবেশের যে মান তা যথাযথ শিক্ষার জন্যে
উপযুক্ত নয়। এমন একটি মন্তব্য নিশ্চয় ব্যাখ্যা দাবি করে। আমরা লক্ষ্য করি এ সমাজে মিথ্যা
ও কপটতার সংস্কৃতি এমন জোরালোভাবে প্রচলিত যে জীবনাচরণে অতি ধর্মভীরু ব্যক্তিও অনায়াসে
এতে শরিক হন। অসত্যের সূচনা হয় সন্তানের জন্ম তারিখ বা বর্ষ নিয়ে। দেখা যাচ্ছে ভর্তি
হওয়ার সময় জন্মনিবন্ধন সনদ দাখিল করা বাধ্যতামূলক হওয়া সত্ত্বেও সন্তানের বয়স কমানোর
অভ্যাস যাচ্ছে না। টাকার বিনিময়ে জন্ম তারিখ পরিবর্তন করে একটি জন্ম সনদ তৈরি করে নেওয়া
যায়। তাতে শিশুর শিক্ষার্থীজীবন শুরু হয় মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে। এই বদভ্যাসটা অভিভাবক-শিক্ষকসহ
সমাজের মজ্জাগত হয়ে গেছে। এটি তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে যখন শিক্ষার প্রায় একমাত্র
লক্ষ্য ছিল সরকারি চাকুরি। সন্তান যাতে একবারে না পারলে কয়েকবারের চেষ্টায় হলেও চাকরিতে
ঢুকতে পারে এবং অবসরের সময়ও যেন একটু পেছানো যায় সেটাই থাকে অভিভাবক-শিক্ষকদের বিবেচনায়।
মানুষের এই দুর্বলতাকে বাস্তব প্রয়োজন হিসেবে বিবেচনা করে এর মধ্যে অনৈতিকতার দোষ ধরতে
যায় না সমাজ।
কিন্তু মিথ্যা ও কপটতার সাথে আপস করে সমাজ
কখন যে নিজের অজান্তে অপরাধ-অনৈতিকতার সঙ্গে আপস করে চলতে অভ্যস্ত হয়ে যায় তা নিজেও
টের পায় না। সামনে ক্রীড়া ক্লাব রেখে পেছনে ক্যাসিনো পরিচালনা, সামনে ব্যবসায়িক অফিস
রেখে টেণ্ডারবাজি, রাজনৈতিক নেতার পরিচয়ে মাস্তানি সবই যে সমাজে ব্যাধির মত ছড়িয়ে পড়েছে
তার কারণ সমাজ এরকম কপটতা ও অনিয়ম-অনৈতিকতার
সাথে বসবাসে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। টাকা এবং ক্ষমতা এ সমাজে সমীহ আদায়ে এতটাই সফল যে যারা
এভাবে চলছে তারা মাথা উঁচু করেই চলে এবং অন্যরা তাদের বিষয়ে নীরব থাকাই শ্রেয় ভেবেছেন।
এ থেকে শিশুরা যে বারতা পায় তা কোনোভাবেই ভালো শিক্ষা হতে পারে না। মোটকথা সমাজের প্রশ্রয়ে,
অনুমোদনেই দেশে এতসব অনিয়ম, অনৈতিকতার বিস্তার ঘটেছে। নয়ত সামান্য ব্যক্তিগত লাভের
জন্যে সরকারের পাঁচজন সচিব কী করে ভুয়া সনদ দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সুবিধা আদায় করতে
চাইতে পারেন? বেশির ভাগ বড় দুর্নীতি তো শিক্ষিত মানুষের দ্বারাই সংঘটিত হচ্ছে, লালিত
হচ্ছে। মিথ্যাচার, কপটতা, অনিয়ম, অনৈতিকতার পথে শিক্ষা কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারছে
না। তাহলে এ কেমন শিক্ষা, কিংবা এ কেমন শিক্ষিতের সমাজ?
সকলেই জানি এবং বলে থাকি কেবল ডিগ্রি ও
সনদপত্র অর্জন শিক্ষা নয়। শিক্ষা যেমন কর্মসংস্থানে বা উপার্জনের দক্ষতা অর্জনে সহায়ক
হবে তেমনি একজনের নৈতিক ও উন্নত রুচিবোধসম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠতে সহায়ক হবে। এমন মানুষের
জীবনব্যাপী জ্ঞানার্জনের চাহিদা, ভালো কিছু করা ও ভালোর সাথে থাকার আগ্রহ থাকবে। নিজেকে
বা সমাজকে ফাঁকি দিয়ে ভালো সাজার কপটতা তিনি ঘৃণা করবেন। কিন্তু আমাদের শিক্ষা এমন
মানসিকতা ও বৈশিষ্ট্য অর্জনের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে নানা
রকম প্রকল্প নিচ্ছেন, বিপুল অর্থ ব্যয় করছেন, কিন্তু সমাজ যে সুশিক্ষাকে ধারণ করার
মানস ও চেতনার বাইরে পড়ে আছে সেদিকে কারোর খেয়াল নেই। এভাবে, রবীন্দ্রনাথের খেদোক্তি
উদ্ধৃত করে বলা যায়, আমাদের শিক্ষার সবটাই লোকসানি মাল।
আমি জানি না কেউ কেউ অপ্রাসঙ্গিক মনে করবেন
কিনা, কিন্তু আমি চার দশকের বেশিকাল শিশুশিক্ষায় কাটিয়ে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সঠিক
সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছাড়া সকল শিক্ষার্থীর সঠিক শিক্ষা অর্থাৎ যথাযথ মানুষ হয়ে
ওঠা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কারণ পারিবারিক পরিবেশ থেকে অল্প কিছু শিক্ষার্থীই সঠিক
উদ্দীপনা ও পথনির্দেশ পেতে পারে। অধিকংশই তো নির্ভর করবে সামাজিক পরিবেশের ওপর। ফলে
এর জন্যে অনেক দূরদর্শী ভাবনা ও সংবেদনশীল চিন্তা ও পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে। যদি
ঘরের বাইরে রাস্তায় পা দিয়েই শিশুর প্রাথমিক পরিচয় হয় যানবাহন-পথচারিদের বিশৃঙ্খলার
সাথে এবং সেটাই যদি তার নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা হয় তাহলে তার ধারণা হবে যে বাইরের জগৎ,
যেটি বড়দের জগৎ, আদতে এরকম বিশৃঙ্খল। ক্রমে অভিজ্ঞতা থেকেই তার মনে এমন ধারণাই বদ্ধমূল
হবে। বড় হতে হতে অন্যান্য অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সে বড়দের জগতের কপটতা, মিথ্যাচার, অনিয়ম,
অপরাধের সাথেও পরিচিত হবে। বাধ্য হবে এগুলোর সাথে সহবাস করতে। মনে রাখা দরকার নীতি-নৈতিকতা
কেউ পুথিগত বিদ্যা থেকে অর্জন করে না। হাজারবার ‘সদা সত্য কথা বলিবে’ আর ‘উন্নত চিন্তা
ও সরল জীবনই আদর্শ’ এমন বাক্য লিখলেও কোনো কাজ হবে না যদি বাস্তব জীবনে তাকে ক্রমাগত
ভিন্ন চিত্র দেখতে হয় এবং এর সাথে আপস করে চলতে হয়। ফলে জননেতা, সমাজনেতাদের এসব বিষয়ও
ভাবতে হবে।
পশ্চিমের সমাজ-জীবন ও সংস্কৃতির অনেক বিষয়ই
আমাদের সাথে মেলে না, শরীর বা খাদ্য নিয়ে তাদের সংস্কার কম এবং নানা বিষয়ে আমাদের তুলনায়
তাদের সমাজের অনুমোদন অনেক বেশি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তাদের সমাজে কপটতা, মিথ্যাচার,
নিয়ম ভাঙার অভ্যাস সাধারণভাবে নেই। তাতে সমাজে উন্নত শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ বজায় থাকে।
প্রাসঙ্গিক একটি দৃষ্টান্ত টেনে লেখাটা
শেষ করব, আমাদের সমাজ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনায় বিভক্ত এবং এই বিভাজন দীর্ঘদিনের
চর্চায় সমাজমানসে বিরোধ ও বিদ্বেষ লালন করছে। স্বাধীনতার পর থেকেই এ অবস্থা চলছে, চলে
আসছে। আমাদের নেতৃত্ব কখনও এ বিষয়টি বিবেচনায় নেয় নি যে স্বাধীন দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মকে
সুনাগরিক হিসেবে তৈরির পথে বিদ্বেষ ও বিরোধচর্চা দীর্ঘায়িত করা ঠিক কিনা। যারা মুক্তিযুদ্ধের
বিরোধিতা করেছিলেন, যারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত তাদের অবশ্যই বিচার
হতে হবে এবং সর্বোচ্চসহ উপযুক্ত শাস্তিও পেতে হবে। কিন্তু এ কাজগুলো যেহেতু সমাজে
নানা রকম ক্ষত সৃষ্টি করে তাই দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের মামলা চালানো ঠিক নয়। বঙ্গবন্ধু
যেভাবে চেয়েছিলেন উচিত ছিল সেভাবে দ্রুত বিচার এবং সাধারণ ক্ষমার ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহার
ঘটিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই অধ্যায়টি চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া। সেটিই সঠিক পথ। অস্ত্রোপচারের
সময় চেতনানাশক ব্যবহার করে শল্যবিদের চেষ্টা থাকে দ্রুততম সময়ে কাজটা শেষ করা। ক্ষত
শুকানোই আসল কাজ, তাকে জিইয়ে রাখা নয়। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও রাজনীতিতে মাঠপর্যায়ে,
এমনকী সংসদে হয় স্তাবকতার নয়ত বিদ্বেষের সুর একইভাবে চলতে থাকে। যে শিশু জন্ম থেকে
এমন রাজনৈতিক ভাষণ-বিবৃতি-কথোপকথন শুনে বড় হয় সে কী শিক্ষা পাবে রাজনীতি সম্পর্কে?
এতো কেবল রাজনীতির সবক নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক শিক্ষাও বটে। তারা জানছে সমাজ জুড়ে প্রতিপক্ষতা,
বিরোধ, বিভেদ ও বিদ্বেষই চলে। এমনকী ধর্মীয় ওয়াজেও বিদ্বেষপূর্ণ কথাবার্তার প্রাধান্য
ও প্রাবল্য থাকে। যে সমাজমানসের মধ্যে শিশু বেড়ে ওঠে তার লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য নিয়েই তো
সে বড় হবে। চলমান এ পরিবেশে সহিষ্ণুতা, ঔদার্য, ক্ষমা ও মহত্বের মত গুণ অর্জিত হবে
না। ফলে শিক্ষার উচ্চতর লক্ষ্য অর্জনের পথে সমাজ নিজেই বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আমরা ভুলে যাচ্ছি কিংবা একদমই গুরুত্ব
দিচ্ছি না যে, শিক্ষায় অসত্য বা অর্ধসত্যের স্থান নেই। এখানে প্রয়াসটাই হচ্ছে সত্য
জানার, ন্যায় বোঝার, বিবেচনাবোধ অর্জনের, বিশ্লেষণী ক্ষমতা বৃদ্ধির এবং আরও আরও এমন
সব দক্ষতা ও গুণাবলি অর্জনের যা শিক্ষার্থীকে পরিণত বয়সেও উন্নত জীবন নির্মাণে সহায়তা
দেবে। তাতে একদিন সমাজ সত্যিই উন্নত মানুষের সমাজে পরিণত হবে। এখন আমাদের পক্ষে যে
উন্নয়ন সম্ভব তা ভৌত অবকাঠামো আর যাপিত জীবনের বস্তুগত মান বাড়াতে সক্ষম কিন্তু উন্নত
সমাজের উন্নত মানুষ সৃষ্টি থেকে যাবে দূর অস্ত।
***