Thursday, August 29, 2013

যুক্তি তর্ক গল্প

আবুল মোমেন

আঠার বছর আগে চট্টগ্রামের পত্রিকায় সর্বশেষ কলাম লিখেছিলাম। তখন কাজ করতাম দৈনিক পূর্বকোণে। ১৯৯৫ সনের মাঝামাঝি দৈনিক পূর্বকোণ ছেড়ে আসি। তারপর তিন বছর ভোরের কাগজে লিখেছি। এরপর টানা পনের বছর দৈনিক প্রথম আলোয় কলাম লিখেছি। সাপ্তাহিক কলাম লেখার রেওয়াজ থাকলেও শেষ কয়েক বছর প্রতি পক্ষে একবার লিখেছি। সে হিসেবে নিয়মিত কলাম লেখার অভ্যাস চলেছে ১৯৮৬-র ফেব্র“য়ারি থেকে। সে প্রায় সাতাশ বছর হতে চলল। বলা যায় সহস্রাধিক কলাম লিখেছি এ পর্যন্ত।
তবে এরও আগে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সনে ভাষা সৈনিক ও একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসি নি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’র রচয়িতা মাহবুব উল আলম চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত দৈনিক স্বাধীনতায় সহকারি সম্পাদক হিসেবে সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় দুই-ই লিখেছি। এ ছিল সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে - হয়ত তিন মাস। কারণ তখনও এম. এ. পাশ করা হয় নি। ১৯৭৮ সনে ওয়াহিদভাই - বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সঙ্গীতগুণী ওয়াহিদুল হক - চট্টগ্রামে এসে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি লাইফ প্রকাশ করলে আমি পড়া শেষ করে ও মাস্টারি ছেড়ে তাতেও সহকারি সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হই। তখনও সাপ্তাহিক কলাম লিখেছি, ইংরেজিতে। তবে সে-ও ছিল স্বল্পকালীন মেয়াদের সাংবাদিকতা - আট মাস স্থায়ী হয়েছিল। তারপর ১৯৮৬ থেকে টানা সাংবাদিকতায় আছি।
যখন থেকে নিয়মিত কলাম লিখছি, অর্থাৎ ১৯৮৬ সনের ফেব্র“য়ারিতে দৈনিক পূর্বকোণে লেখার মাধ্যমে যার সূচনা, তখন থেকেই আমার কলামের নাম যুক্তি তর্ক গল্প। মূলত সমকালীন রাজনীতি নিয়ে লিখি, কখনও সামাজিক ইস্যুও কলামের বিষয় হয়। ক্বচিৎ লিখি আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে।
সবসময় সমাজের অগ্রগতি না হলেও কিংবা অগ্রগতি আশানুরূপ গতিতে না হলেও, সমাজ কখনও থেমে থাকে না। ইতিহাসও তেমনি। অর্থাৎ সমাজ ও ইতিহাস উভয়ই গতিময়, পরিবর্তনশীল, এবং দুয়ের অগ্রগতিই কাম্য। এ নিয়ে রক্ষণশীলদের বাধার মুখে সমাজে টানাপোড়েন চলে, ইতিহাস কখনও শান্ত প্রায়স সংকুল হয়ে ওঠে। সমকালীন মানুষের পক্ষে তার সঠিক ব্যাখ্যা করা সবসময় সম্ভব হয় না। তাতে অনেক গল্পকথা, অতিকথা এবং নানা কথা চালু হয়। এ সবই মানুষের মুখে মুখে রচিত ও চালু হয়। তাতে দ্বিমত হওয়াই স্বাভাবিক, তর্ক জমে ওঠা খুবই সঙ্গত। সমাজ, ইতিহাস, রাজনীতি, এমনকি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সাহিত্য ইত্যাদি নিয়েও তর্ক কত প্রকার ও কি কি তা সাম্প্রতিক কালের বাংলাদেশের মানুষ খুব ভালো করেই জানে। তর্কের কোনো শেষ নেই। শুনেছি টেলিভিশনের কোনো কোনো টক-শোই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। টক-শো জনপ্রিয় হচ্ছে মূলত দুই বা তার অধিক কথকের তর্কাতর্কির কারণে।
তর্কের খাতিরে তর্ক অবশ্য উপকারে আসে না। তাতে সমাজের অপকারই হয়। তাই তর্কের মূল ভিত্তি হওয়া দরকার যুক্তি। যুক্তি দিয়ে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করা জরুরি। সেক্ষেত্রে দেখা যাবে তর্ক আমাদের মীমাংসা বা সমাধানের পথেই নিয়ে যাবে। এটা হবে অগ্রগতি।
এরকই একটি ইচ্ছা থেকে আমি কলাম লিখি। আর তাই কলামের নামকরণ করেছি - যুক্তি তর্ক গল্প। নামটি একেবারে মৌলিক নয়। বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্রকার ঋত্ত্বিক ঘটকের শেষ ছবিটির নাম যুক্তি তক্ক গপ্পো। নামটা সেখান থেকেই পাওয়া, কেবল পশ্চিমবঙ্গীয় আঞ্চলিক শব্দ তক্ক ও গপ্পোর পরিবর্তে প্রমিত বাংলা তর্ক ও গল্প শব্দ দুটি পছন্দ করেছি। তবে এই নামকরণ সম্পর্কে একান্ত নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে আমার। সেটাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। 
সমাজে অনেক বিষয়ে তর্ক চলছে, নতুন নতুন ইস্যু যুক্ত হচ্ছে তাতে। এটা একটি প্রাণবন্ত সমাজের জন্যে স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু আমাদের জন্যে দুর্ভাগ্যের বিষয় হল এখানে তর্কে যুক্তির চেয়ে গল্পকথা টেনে আনা হচ্ছে বেশি। তাতে কোনো তর্কই সুষ্ঠুভাবে মীমাংসিত হয় না। আমরা বহুকালের পুরোনো ধারণা, চিন্তা, বিশ্বাস, সংস্কার আজও বয়ে বেড়াচ্ছি। এমনকি বিপুল ত্যাগ ও রীতিমত মুক্তিযুদ্ধ করে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেও পুরোনো তর্কের নিষ্পত্তি ঘটাতে পারছি না। কথাটা ব্যাখ্যা করে বলি।
মানুষের ব্যবহারিক জীবনের পরিবর্তন ঠেকানো যায় না। এক জীবনে আমরা পায়ে-হেঁটে-চলা মানুষ আজ গাড়ি চড়ছি, বিমানে চড়ছি; পুকুরে জাল দিয়ে মাছ ধরে খেতে অভ্যস্ত মানুষ ফ্রিজ-ডিপফ্রিজ ব্যবহার করছি; হাতপাখার মানুষ বৈদ্যুতিক ফ্যান ছেড়ে এখন শীতাতপ যন্ত্রে আরাম করছি; পান্তাভাতের স্বাদ ভুলে চিনে খাবারে মজেছি, এমনি আরও অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে। ব্যবহারিক জীবনে যেসব পরিবর্তনে আমরা অভ্যস্ত হয়েছি তার পেছনে প্রযুক্তির ভূমিকার কথা আমরা জানি। কিন্তু নিত্যনতুন এসব প্রযুক্তি আসছে কোত্থেকে? তার পেছনে কাজ করছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানই মানুষের জানার পরিধি ও জ্ঞানের জগৎ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। তার ফলে যুক্তিসঙ্গতভাবেই অনেক ধারণা ও বিশ্বাস সেকেলে হয়ে খারিজ হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীদের অনেক তত্ত্বের সাথে তৎকালীন ধর্মীয় নেতাদের সংঘাত বেধেছিল, সে আমরা জানি। গেওর্দানো ব্র“নোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, গ্যালিলিও গেলিলেইকে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু জ্ঞান হচ্ছে আলো, আর যুক্তি সেই আলোর রশ্মি - একে চূড়ান্তভাবে থামানো, চাপা দেওয়া সম্ভব নয়।
মানুষের ব্যবহারিক জীবনের পরিবর্তনের পিছনে যে বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তির দর্শন আছে তাকে বুঝতে না পারলে এবং বুঝে ধারণা না করলে সেই সমাজের মানস পুরোনো ও তামাদি হয়ে যাবে। সে সবসময় পিছনে থাকবে, অগ্রসর উন্নত সমাজের অনুকরণ করে একটি দ্বিতীয় মানের জীবনে ঘুরপাক খেতে থাকবে।
দীর্ঘদিন এ বিষয়ে যতœ না নেওয়ায় আমাদের উচ্চতর জ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠানে, এমনকি বিদ্বৎসমাজের অবক্ষয় ও পিছিয়ে থাকা চোখে পড়ার মত। আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় - যা একসময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ছিল - বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিঙে একশতের মধ্যেও আসে না। আমাদের মেডিক্যাল বলুন, প্রকৌশল বিদ্যাচর্চা বলুন সব ক্ষেত্রেই এই অবস্থা। বাস্তবটা আরও বোঝা যাবে এই তথ্য থেকে - গত শতকের ষাট সত্তর দশকে মালয়েশিয়া থেকে ছাত্ররা উচ্চ শিক্ষার জন্যে আমাদের দেশে আসত, আর আজ পরিস্থিতি ঠিক উল্টো। আমাদের ছাত্ররা সেখানে উচ্চশিক্ষার জন্যে যাচ্ছে।
আমাদের সমাজমানস তামাদি হয়ে পড়েছে। আমরা রাষ্ট্র পাল্টেছি, কিন্তু সমাজ বদলাতে পারি নি, অভ্যাসে-ব্যবহারে হয়ত বদলেছি, কিন্তু চিন্তায় ভাবনায় বদলাই নি। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিকরা কিন্তু সমাজবদলের কথাই বলেছিলেন।
এখানে একথাটাও বলা দরকার। মানুষের জীবনে যুক্তির পাশাপাশি বিশ্বাসেরও জায়গা আছে। বিশ্বাসের ভিত্তিতে বন্ধন তৈরি হয়, মানুষ শিকড়বদ্ধ হয়, আর যুক্তি তাকে বিকশিত ও প্রস্ফুটিত হওয়ার পাথেয় দেয়। মানুষের বিশ্বাসকে ঘিরে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক ভালোবাসার, বৈরাগ্য ও আধ্যাত্মিকতার, গভীর ধর্ম বোধের বীজ বিবর্তিত বিকশিত হয়।
আজকে আমাদের সমাজে সত্যিকার অর্থে বিশ্বাসের সংকট চলছে। কপটতা, মিথ্যাচার এবং মোনাফেকিতে মানুষ ব্যাপক হারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। এ সমাজ মানবধর্ম পালন করছে না। তাই বলা যায়, সঠিক পথে সামষ্টিকভাবে কোন ধর্মই পালিত হচ্ছে না। ধর্মান্ধতা, ধর্মব্যবসায় আর যাই হোক ধর্ম পালন হয়।
বিজ্ঞানেও নেই ধর্মেও সংকট - ফলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের দিকে এগুচ্ছে সমাজ। এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সবাই ভুক্তভোগী, সবাই এ নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু কেবল নিজেকে শোধরাচ্ছি না।
মানুষ হিসেবে বড় হয়ে তবে জাতি হিসেবে সার্থক হতে পারব। নিজের বিশ্বাসকে জীবনের ইতিবাচক অবলম্বন হিসেবে পেতে হলে যুক্তির পথে চলতে হবে, আমি নিজের জন্যে এবং পাঠকদের জন্যে সেই পথেরই সন্ধান করি।
এই অনুসন্ধানী পথে সহযাত্রী হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে আজকের ও আগামী দিনের সকল সহযাত্রীকে জানাই আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা, এবং তাদের মাধ্যম দেশবাসীকে - সুপ্রভাত, সুপ্রভাত বাংলাদেশ।

Wednesday, August 21, 2013

নাগরিক সমাজ দায়িত্ব এড়াতে পারে না

আবুল মোমেন

দু বছরের অস্বাভাবিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং দুটি স্বল্প মেয়াদের সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দিলে গত তেইশ বছরের মধ্যে কুড়ি বছর দেশ দুই নেত্রীর অধীনে শাসিত হয়ে আসছে।
দেশ শাসন করলেও কখনও তাঁরা দু’জন দেশ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন নি, বা করতে পারেন নি কিংবা করতে চান নি। জনসভার ভাষণে অবশ্য তাঁরা একে অপরের সমালোচনার জবাব দিয়েছেন। কখনও একের মন্তব্যের সমালোচনা করেছেন অন্যে। জনসভার এই চর্চায় অবশ্য দূরত্বই বাড়ে, আলোচনার সম্ভাবনা যায় কমে। দুই নেত্রীর কাছে সুশীল সমাজের এটি একটি প্রধান চাওয়া। বিগত তেইশ বছরে দুই নেত্রীর মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ যে হয় নি তা নয়, কিন্তু সেসব সাধারণ সৌজন্য বিনিময়ের বেশি আলোচনা পর্যন্ত গড়ায় নি।
শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দু’জনেই প্রায় একই সময়ে রাজনীতিতে এসেছেন। এসেছেন তাঁরা নিজ নিজ বিপর্যস্ত দলের হাল ধরবার জন্যে। ফলে দু’জনেই দলীয় সভানেত্রীর ভূমিকা নিয়ে প্রত্যক্ষ দলীয় রাজনীতি শুরু করেছেন। তবে এখানে বলতে হবে, শেখ হাসিনা এক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে আছেন। বঙ্গবন্ধু-কন্যা হিসেবে তিনি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেই বড় হয়েছেন এবং ছাত্রজীবনে সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতি করেছেন। উপমহাদেশের রাজনৈতিক ধারা থেকে বলা যায়, কোনো একসময় তাঁর জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার সম্ভাব্যতা বরাবরই ছিল।
খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন। স্বয়ং জিয়াউর রহমান প্রথমে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বিশেষ পরিস্থিতিতে জাতীয় পরিচিতি পান এবং পরে বিশেষ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন ও তারপরে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। একজন সামরিক কর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আসার বিষয়টি একেবারেই আকস্মিক। তাঁর স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুর পর তাঁকে বিএনপি নেতৃবৃন্দ জিয়ার শূন্যতা পূরণ ও দলীয় ঐক্য ধরে রাখার জন্যে সভানেত্রীর পদ দিয়ে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। আর পঁচাত্তরের পরে আওয়ামী লীগে উপদলীয় কোন্দল মাথাচাড়া দিচ্ছিল। জিয়া-এরশাদের নির্যাতনে দলে সংকট বাড়ছিল, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গতিশীল নেতৃত্বে ফিরে আসার জন্যে তৎকালীন নেতৃবৃন্দ শেখ হাসিনাকেই দলীয় প্রধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনা ধীরে ধীরে দলে তাঁর একক ও একচ্ছত্র নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিপরীতে বেগম জিয়ার নেতৃত্বের বিষয়টি খুব স্পষ্ট নয়, তিনি সহযোগীদের পরামর্শ কতটা নেন, কতটা পুত্র তারেকের ওপর নির্ভর করেন তা বোঝা যায় না। তবে বিএনপির গঠনতন্ত্রের এবং তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার কারণেই তিনিও একক ও একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করেন।
দুই নেত্রী যেভাবে একক ও একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তা নিয়ে আপাতত বলার কিছু নেই। কিন্তু যে দু’জন মানুষের ওপর দেশ ও দেশবাসীর ভাগ্য নির্ভর করছে তাঁরা যে দেশ নিয়ে পরস্পর কোনো আলোচনাই করতে পারছেন না তাতে দেশের ক্ষতি হচ্ছে। কারণ যে কোন দেশের শাসনব্যবস্থায় ধারাবাহিকতা দরকার। গণতন্ত্রে এটি আরও অপরিহার্য। আলাপ-আলোচনা ছাড়া এ কাজ তো সম্ভব নয়। এর ফলেই আমাদের রাজনীতিতে বিদেশি কূটনীতিকদের বারবার নাক গলাতে দেখি, আবার আমাদের রাজনীতিকদেরও বিদেশিদের কাছে গিয়ে নালিশ জানাতে দেখি, এবং মাঝে মাঝে সেনা-সমর্থিত অসাংবিধানিক সরকারের আবির্ভাবও ঘটে যাচ্ছে।
কিন্তু কুড়ি বছরেও দুই নেত্রীর বৈঠক সম্ভব না হওয়ায় এখন বোধহয় সময় এসেছে এর কারণ খুঁজে বের করে বিকল্প কোনো পথ খুঁজে দেখা।
সচেতন নাগরিকের চোখে দুই দলের মধ্যেকার আস্থার সংকট ধরা পড়বেই। বোঝা কঠিন নয় আওয়ামী লীগের পক্ষে জেনারেল জিয়ার কিছু ভূমিকা মেনে নেওয়া কঠিন। প্রথমত, বঙ্গবন্ধুর স্ব-স্বীকৃত খুনীদের বিচার না করে বরং প্রজাতন্ত্রের মূল্যবান চাকুরি দিয়ে পুরস্কৃত করা। দ্বিতীয়ত, ১৫ আগস্টের হত্যার বিচার থেকে তাদের অব্যাহতি দিয়ে জারিকৃত ইণ্ডেমনিটি আইন বহাল রাখা। তৃতীয়ত, নিষিদ্ধ ঘোষিত যুদ্ধাপরধীদের দল জামায়াতকে বৈধতা দান ও পুনর্বাসিত করা। চতুর্থত, মুক্তিযুদ্ধের দালালদের পুনর্বাসিত করা ও দালাল আইন সম্পূর্ণ রহিত করা। পঞ্চমত, মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণের পথ থেকে সরে এসে পাকিস্তানি ধারার ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার রাজনীতির প্রচলন।
এর সাথে যদি বেগম জিয়ার বিগত আমলের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা এবং দশ ট্রাক অস্ত্র মামলাকে বিবেচনায় নিই তাহলেও কয়েকটি গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। একুশে আগস্ট হামলার মূল টার্গেট ছিলেন বেগম জিয়ার প্রতিপক্ষ শেখ হাসিনা। সেদিন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমানসহ বাইশজন আওয়ামী লীগ-কর্মী নিহত হয়েছিলেন। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এই হামলার সাথে কেবল নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির লোক জড়িত ছিল না, এদের অনেকের জামায়াত কানেকশন ছিল এবং বিএনপির এমন কোনো কোনো নেতার পৃষ্ঠপোষকতা ছিল যাঁদের যোগাযোগ ছিল হাওয়া ভবনের সাথে। আর দশ ট্রাক অস্ত্রের ঘটনায় বিএনপি ও জামায়াতের একাধিক মন্ত্রী-নেতার যোগাসাজশের বিষয় তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।
এখন জাতীয় পর্যায়ে আরও প্রশ্ন উঠে আসছে। যে কোনো বিবেচনায় জামায়াতে ইসলামি যুদ্ধাপরাধীদের দল, এ দল একাত্তরের ভূমিকার ভুল স্বীকার করে নি। বরং ধর্মকে ব্যবহার করে বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে দেশে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানো এবং দেশে নাশকতা, উত্তেজনা ও হানাহানি সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিএনপি জামায়াতে ইসলামিকে নিয়ে জোট গঠন করেছে। এই বাস্তবতায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় গেলে জামায়াত-নেতারা মন্ত্রীও হবেন। তারা হেফাজতে ইসলামের মত একটি ধর্মান্ধ ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে অরাজকতা সৃষ্টিতে উৎসাহ দিতে কুণ্ঠিত হয় নি।
এসব প্রশ্নের সদুত্তর সুশীল সমাজ যদি নাও চায়, একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে যদি আওয়ামী লীগ চায় তাহলে তাকে তো দোষ দেওয়া যাবে না।
আমরা জানি দখলদারি, টেণ্ডারবাজি বা ক্ষমতার জন্যে দলীয় কোন্দল ও হানাহানি দু’দলে  একইভাবেই চলে। এতে জনগণের ভোগান্তি হয় তাও সবাই স্বীকার করবেন। কিন্তু এর বাইরে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড, ইতিহাস বিকৃতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী ভূমিকা, যুদ্ধাপরাধীদের মদত দেওয়ার মত ঘটনার কি বিহিত হবে?
মনে হচ্ছে শেখ হাসিনা এখন নির্বাচনে পরাজিত হলেও তাঁর অবস্থান থেকে নড়তে চাইছেন না, কারণ তিনি মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় যে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছেন তা নিয়ে আপোস করতে চান না। কথা হল, তাহলে কী হবে? 
আমার মনে হয়, নির্বাচনের আগে অত্যন্ত জরুরি হল - বিএনপির দাবি নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনা এবং তার বিপরীতে আওয়ামী লীগের দাবি হওয়া উচিত জামায়াত ও ধর্মান্ধ শক্তি সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করা। কেননা, গণতন্ত্র তো কেবল নির্বাচন আর পাঁচ বছর পরপর সরকার পরিবর্তন নয়। গণতন্ত্রের অন্যতম বিষয় হল ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমানাধিকার নিশ্চিত করা, একটি অসাম্প্রদায়িক নাগরিক সমাজ গঠন, আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করা ইত্যাদি। এ বিষয়ে সুরাহা না হলে হয়ত নির্বাচন হবে, নতুন সরকার আসবে, কিন্তু অবিশ্বাস ও অনাস্থা, সংঘাত ও হানাহানি, অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা চলতেই থাকবে।
দেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান চাইলে এ বিষয়ে নাগরিকসমাজকে কথা বলতে হবে ও উদ্যোগ নিতে হবে।

Monday, August 19, 2013

শূন্যতায় তুমি শোকসভা

আবুল মোমেন

আজকের দিনটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে বিশেষভাবে স্মরণ করার দিন। ১৯৭৫ সালের এইদিনে ঘাতকরা তাকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। তারপর থেকে বাংলাদেশ যেন এক অভিভাবকহীন পরিবার - ছন্নছাড়া, দিগভ্রান্ত। 
একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালালে বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়। সে রাতেই বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে, কিন্তু তারই নেতৃত্বে, মুক্তিযুদ্ধ চলেছিল। পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুদণ্ডের হুমকির মধ্যে তিনি প্রিয় দেশ ও দেশবাসীর কাছ থেকে শারীরিকভাবে অনেক দূরে ছিলেন।
সেদিন বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তার সহকর্মীদের যোগ্য নেতৃত্ব ও ভারতের সহায়ক সরকারের সহযোগিতায় আমরা অত্যন্ত কঠিন সেই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম গৌরবের সঙ্গে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে যা সম্ভব হয়েছিল পঁচাত্তরে তার মৃত্যুর পরে তা সম্ভব হয়নি। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, কেন? একাত্তরে তাকে ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল, সেটাই কি কারণ? একাত্তরে তার পক্ষে যোগ্য নেতৃত্ব দেওয়ার মতো মানুষ ছিলেন, যেমন তাজউদ্দিন আহমদসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ, সেটাই কি কারণ? এ দুটি কারণই সত্য বলে মনে হয়। 
কিন্তু তারও চেয়ে সত্য তৃতীয় একটি কারণ। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড কেবল বঙ্গবন্ধু বা তার পরিবারের বিরুদ্ধে সংঘটিত একটি অপরাধ ছিল না; এ ছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অংশ; খন্দকার মুশতাক এই ষড়যন্ত্রের একজন অংশীদার, বাংলাদেশের ইতিহাসের দ্বিতীয় মীর জাফর। 
পটপরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে বায়ান্নো থেকে বিপুল ত্যাগ ও দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে জাতির অর্জিত আদর্শ ও মূলনীতিগুলো বিসর্জন এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্ন তছনছ করে দিয়ে প্রত্যাখ্যাত পাকিস্তানি ধারার ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা ও ধর্মান্ধ       চিন্তাচেতনা ও সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করে। কেবল তা-ই নয়, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সংস্কৃতিকর্মীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ নির্যাতনও  চালায়। এরই ধারাবাহিকতায় জেনারেল জিয়া সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে মুসলিম ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার প্রাধান্য দিতে শুরু করেন। এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী এবং ধর্মান্ধ দলসমূহকে রাজনৈতিকভাবে পুনরুজ্জীবিত ও সেসব দলের নেতৃবৃন্দকে সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত করেন। জিয়ার পরে এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আর সংবিধানে ধর্মীয় পরিচয় লাগিয়ে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক চেহারা পাল্টে দিলেন। নব্বইয়ের পরে ক্ষমতায় এসে বেগম জিয়া একই ধারাই অব্যাহত রাখেন।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত দীর্ঘ দু-দশক ধরে বঙ্গবন্ধুর নাম গণমাধ্যমে, পাঠ্যবই ও অন্যান্য প্রচারণা থেকে মুছে দেওয়া হয়, তার ৭ মার্চের ভাষণ নিষিদ্ধ থাকে। অন্যান্য জাতীয় নেতাদের কথাও অনুচ্চারিত থেকে যায়। ফলে এ সময়ে দেশে নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়, যারা এ দেশের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারেনি। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দিন বা মুক্তিযোদ্ধাদের যে ভূমিকা তা ঠিকভাবে জানতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধে ও স্বাধীনতা অর্জনে কারা ছিল বন্ধুরাষ্ট্র, এ সময় ভারত-সোভিয়েতের ভূমিকা ইত্যাদিও জানা হয়নি তাদের। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয়, ভূমিকা এবং বিপরীতে রাজাকার-আলবদর ও অন্যান্য দালালদের কী ভূমিকা তা-ও ঠিকভাবে জানানো হয়নি। চীন, সৌদি আরব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতিবাচক ভূমিকার কথাও তারা জানতে পারেনি।
ফলে কুড়ি বছরের বিভ্রান্তিকর অপপ্রচারের মাধ্যমে দেশের ইতিহাস সম্পর্কে মানুষের মনে বিভ্রান্তি এবং বিতর্কের জন্ম দেওয়া সম্ভব হয়েছে। আজও আমরা এই বিভ্রান্তি ও বিতর্কের জের টানছি, এবং তার খেসারত দিয়ে যাচ্ছি। এ যেন সত্যিকারের অভিভাবকহীন এক ছন্নছাড়া পরিবারের দিগভ্রান্ত পদচারণা চলছে।
পরিস্থিতি আজ এ রকম যে, একজন দেশদ্রোহী ও যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গে সরকার পরিচালনার ব্যর্থতাকে গুলিয়ে ফেলছি আমরা। অপরাধের সঙ্গে অপারগতাকে এক করে ফেলছি। চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতাকে এক কাতারে রাখছি। 
আমরা জানি, স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন, এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, নবগঠিত অনভিজ্ঞ সরকার ও প্রশাসন পরিচালনার মতো দুরূহ কাজ করতে হয়েছে। সেই সঙ্গে একদিকে দেশের অভ্যন্তরে ওঁত পেতে থাকা পরাজিত শক্তির এদেশীয় দোসরদের চক্রান্ত এবং অন্যদিকে অতি-উৎসাহী উচ্চাভিলাষী মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতাও মোকাবিলা করতে হয়েছে। আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরাজিত পাকিস্তান, তার বন্ধুরাষ্ট্র চীন ও সমর্থক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশসমূহ মিলে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল বাংলাদেশকে বিপদগ্রস্ত করার  চেষ্টা করে গেছে। এদেরই অপতৎপরতার ফলে ১৯৭৪-এ দুর্ভিক্ষ হয়েছে, গোলাম আজমগং প্রশ্রয় পেয়েছে ও জামায়াতসহ অসংখ্য ধর্মান্ধ দল শক্তি সঞ্চয় করেছে। এভাবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনে অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা এবং ক্রমে চরম মনোভাবের এক বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। আজকের দিনে বাংলাদেশের এই অস্থির বর্তমান ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে আমরা যে অভাব প্রতিদিন অনুভব করি তা হল একজন যোগ্য নেতার, একজন যথার্থ অভিভাবকের। আর তখন স্বভাবতই মনে পড়ে যায় বঙ্গবন্ধুর কথা। মনে পড়ে যায় কীভাবে ইতিহাসের উজান বেয়ে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এ দেশের মানুষের নয়নমণি, একমাত্র নেতা, পরম নির্ভর অভিভাবক। 
তার জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েই তার আরব্ধ কাজ সম্পন্ন করতে হবে। মৃত্যুদিবসে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করব জাতির এই চরম সংকটকালে তার একজন যোগ্য উত্তরসূরি রাজনৈতিক নেতার জন্য প্রার্থনা জানিয়ে।


Monday, August 5, 2013

গণতান্ত্রিক রাজনীতি কি সন্ত্রাসের কাছে হার মানবে?

আবুল মোমেন 

বড় রাজনৈতিক দলের ছাত্র-যুবনেতাদের পারস্পরিক খুনোখুনির ঘটনা নতুন নয়। দেশের নানান অঞ্চল থেকে এমন খবর প্রায়ই আসে। ঢাকায় মিল্কি হত্যার ঘটনাটি সংলগ্ন মার্কেটের সিসিটিভির ক্যামেরার কল্যাণে বাড়তি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। গণমাধ্যমের ভাষায় ফিল্মি কায়দায় মাত্র ১৪ সেকেণ্ডে ঘটা হত্যাকাণ্ড! গুলি করে মানুষ মারতে হয়ত এক সেকেণ্ডই যথেষ্ট।
বিপরীতে মিল্কির কথিত হত্যাকারী তারেকের হত্যাকাণ্ডটি লোকচক্ষুর আড়ালে হওয়ায় এটি হয়ে থাকল কেবল একটি তথ্য।
কিন্তু মিল্কি বা তারেকের হত্যাকাণ্ড নয়, ফিরে যাব প্রথম কথাটিতে। যে দুটি দল এদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যায় সে দুই দলেই ছাত্র-যুব নেতাদের অন্তর্দলীয় কোন্দল এখন চরম আকার নিয়েছে। কখনও কখনও দ্বিদলীয় সংঘর্ষে তারা জড়িয়ে পড়ে। তবে উপদলীয় কোন্দলের ঘটনাই বেশি ঘটছে।
এই প্রাণঘাতি কোন্দলের পিছনে কাজ করে ক্ষমতার ভাগ, দলে ও এলাকায় আধিপত্য, অবৈধ উপার্জনের বখরা নিয়ে দ্বন্দ্ব। এ পর্যায়ে প্রথমত রাজনীতির সাথে সন্ত্রাসের সংযোগ ঘটে, দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক কর্মী ও অপরাধীর মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়। এক সময় রাজনীতিকরা ক্ষমতা ও বিত্তের আধিপত্য বজায় রাখার জন্যে কর্মীদের মাধ্যমে পেশাদার সন্ত্রাসী জোগাড় করতেন। এখন সন্ত্রাসীরা আর ভাড়া খাটে না - একদিকে তারা রাজনৈতিক দলে ঢুকে পড়েছে আর অন্যদিকে দলীয় কর্মীদের অনেকেই এদের সংস্পর্শে এসে সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়েছে।
সোমালিয়া-আফগানিস্তানে ওয়ারলর্ডদের কথা শুনেছি। তারা দেশ ধর্ম জাতি স্বাধীনতা এইসব বড় বড় লক্ষ্যের কথা বলে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। আমাদের দেশে ছোটমাপের ওয়ারলর্ড তৈরি হয়েছে, যাদের লক্ষ্যও ছোট - নিজের জন্যে দলে ভালো পদ, একটু ক্ষমতার ভাগ, অর্থবিত্তের নিত্য যোগান। ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তার এই মানুষগুলোর কিছু অনুসারীও থাকে যারা তাদের অবৈধ উপার্জনের সহায়ক শক্তি এবং সে উপার্জনের উচ্ছিষ্টের ওপর জীবন ধারণ করে। হয়ত গোপনে লক্ষ্য থাকে একদিন নিজেও তার বসের মত ক্ষমতা অর্জন করবে, রোয়াব দেখাবে।
কখন থেকে রাজনীতিতে এই পেশিশক্তি ও কালোটাকা-নির্ভর নেতাদের আবির্ভাব হল? এটা জানা দরকার।
মুক্তিযুদ্ধ সর্বপ্রথম আমাদের তরুণদের ব্যাপকহারে অস্ত্রের সাথে পরিচয় ঘটিয়েছে, বাড়ি ছেড়ে তারা রণাঙ্গনের অভিজ্ঞতা পেয়েছে, তখনই যুদ্ধ, হত্যা, রক্ত, মৃত্যুর সাথে পরিচয় ঘটেছে। মানবজীবনের এ কোন স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা নয়। স্বাধীনতার পরে অনেকেই অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেলেও অনেক মুক্তিযোদ্ধা তা পারে নি। তখনই রাজনীতিতে অস্ত্র ও অস্ত্রবাজদের ব্যবহার কিছু কিছু ঘটতে শুরু করে। আমাদের নেতৃবৃন্দ এই অস্থির উচ্চাভিলাষী তরুণদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর বা সংশোধনের পথ দেখায় নি।
তবে পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে পঁচাত্তরের পরে, যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে জেনারেল জিয়া সেনাতন্ত্র চালু করলেন। তাঁর ও এরশাদের আমলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার প্রক্রিয়ায় রাজনীতিতে কালোটাকা, অবৈধ অস্ত্র এবং অনিয়মের পথ খুলে যায়।
দুই আমলেই সর্বোচ্চ চাপ ছিল আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ব্যবস্থা সবই আক্রান্ত হয়েছিল এ সময় প্রায় দেড় দশক ধরে। পাশাপাশি নিজেদের রাজনৈতিক উত্থান নিশ্চিত করার জন্যে তারা জামায়াত ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছে, যুদ্ধাপরাধ থেকে দায়মুক্তি দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার করেছে। কিন্তু এটুকুতেই তাদের রাজনৈতিক অপকর্ম শেষ হয় নি। রাজনীতিতে কালোটাকা, সামরিক হস্তক্ষেপ, নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসনকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার, রাজনীতিতে ঘুষ-দুর্নীতি ও ক্ষমতার সর্বোচ্চ অপব্যবহার এবং আধিপত্য বিস্তারের জন্যে প্রয়োজনে সশস্ত্র ক্যাডার সৃষ্টিসহ গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথকে কলুষিত-কদর্মাক্ত করেছে।
এর সাথে পাল্লা দিয়ে অস্তিত্ব রক্ষা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগে জেলায় জেলায় জন্ম নিয়েছে বিতর্কিত ব্যক্তিরা। স্বৈরাচারের পতন হয়েছে, দেশে গণতন্ত্র এসেছে, কিন্তু সামরিক স্বৈরাচারের সৃষ্ট রাজনৈতিক ব্যাধির সংক্রমণ, ক্ষত, পুঁজ আমরা এখনও বহন করে চলেছি। তারই সর্বশেষ নমুনা যুবলীগের মিল্কি বা তারেকের মৃত্যু।
নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবি, হরকতুল জিহাদের মত দলগুলো বিএনপি-জাপার রাজনীতির ধারাবাহিকতাতেই উঠে এসেছিল। কেবল এরা নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ে বারবার বর্ণিত হয়েছে জামায়াতে ইসলামি একটি সন্ত্রাস-নির্ভর দল যারা কিনা বিএনপির প্রধান মিত্র।
১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত রাজাকার ও আলবদরের মত ঘাতক বাহিনী গঠন করে, শান্তি কমিটির মত দালাল সংগঠন গড়ে তুলে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, জবরদস্তি চালিয়ে এবং হিন্দুদের মুসলমান বানানোর মত জঘন্য সব যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হয়েছিল। ১৯৭১-এর পত্রপত্রিকার খবরে এবং জামায়াত নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতেই তাদের এসব অপরাধের সাক্ষ্য রয়েছে। তারা এদেশে রাজনীতি করতে চায় কিন্তু দেশ ও দেশবাসীর বিরুদ্ধে কৃত অপরাধের জন্যে ক্ষমা চাইতে রাজি নয়, ভুল স্বীকারে আগ্রহী নয়। তারা মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে বাংলাদেশকেই অস্বীকার করে, তারা সংবিধানের নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। এদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নস্যাৎ করে তালেবানি বিপ্লব ঘটাতে চায়। তাদেরকে দীর্ঘকাল পোষণ করার পরিণতিতে দেশে হেফাজতিদের মত ধর্মান্ধ শক্তির উত্থান ঘটেছে যারা কেবল নারীবিদ্বেষ নয় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ (পবিত্র কোরান পোড়ানোসহ) নারী নির্যাতনের মত সন্ত্রাসে জড়িয়ে যাচ্ছে। আর ক্ষমতার লোভে বিএনপি এইসব অপশক্তির সাথে আঁতাত করেছে।
দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে সন্ত্রাসমুক্ত করার পথে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধর করার দাবি অনেক দিনের। আপাতত নির্বাচন কমিশনে দলের নিবন্ধন বাতিল হল।  কিন্তু আজ জামায়াত নিষিদ্ধ হলেও রাজনীতি সন্ত্রাসমুক্ত হবে না। দুর্নীতি ও সন্ত্রাস হাত-ধরাধরি করে প্রশাসন ও সমাজের সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে। তা আশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে গণতান্ত্রিক রাজনীতি থেকেও। সেটা বন্ধ করতে হবে।
স্বৈারাচার বিরোধী আন্দোলনের অধ্যায় নব্বইতে শেষ হয়েছে। সেই দেড়দশকে যেসব সশস্ত্র ক্যাডারদের উত্থান হয়েছে তাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আত্মস্থ করার চেষ্টা সুফল দেয়নি। বরং গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সেটি একটি ধারা হয়ে বসেছে। বড় দলের ছাত্র-যুব সংগঠনে এ ধরনের নেতা-পাতিনেতার উদ্ভব অহরহ হয়ে চলেছে। তারাই মিল্কি, তারাই তারেক, তারাই তাদের ঊর্ধতন নেতা। দেখা যাচ্ছে ওয়ার্ড পর্যায়ের রাজনীতি এভাবে কলুষিত-বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। তার প্রভাব ক্রমেই উপরের স্তরেও ছড়িয়ে পড়ছে।
দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে জামায়াতের মত সন্ত্রাস-নির্ভর সংগঠন নিষিদ্ধ হতে পারে, কিন্তু সেই সাথে গণতান্ত্রিক দলগুলোর সন্ত্রাস-নির্ভরতা বন্ধ করতে না পারলে লাভ হবে না। এ দুটোই আজ সময়ের চাহিদা।