Sunday, August 2, 2015

ছাত্রলীগের সম্মেলনের সূত্রে

আবুল মোমেন
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দু’দিনব্যাপী জাতীয় সম্মেলন গতকাল (২৬ জুলাই) শেষ হয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেবল প্রধান অতিথি হিসেবে ছাত্রসংগঠনের এ সম্মেলন উদ্বোধন করেন নি, বক্তৃতায় সংগঠনটির অভিভাবক হিসেবে দায় ও দায়িত্ব নিয়ে কথা বলেছেন। আমরা জানি জিয়াউর রহমান প্রবর্তিত নিয়ম অনুযায়ী সব ছাত্র সংগঠনই কোনো-না-কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন। এই বিধানের অনেক সমালোচনা থাকলেও দেশের আরও কয়েকটি খারাপ বিধানের মত স্বৈরাচার-প্রণীত এ বিধানটিও রয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগ করেছেন এবং প্রাক্তনী হিসেবে তাঁর পক্ষপাত থাকাও স্বাভাবিক। কিন্তু মুশকিল হল তিনি প্রধানমন্ত্রী, দলমত-নির্বিশেষে সবার প্রতি - অবশ্যই অপরাধী বা দেশদ্রোহী ব্যতীত - তাঁর আচরণ ও ভূমিকায় সমতাই কাম্য। এমন উন্নত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিচয় আমরা কি কোনো পর্যায় থেকেই কখনোই পাব না?
আরও মুশকিল হল প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী এবং ছাত্রলীগের সভাপতি ও অন্যান্য নেতার বক্তৃতায় অতীতের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র ছাত্রলীগের গৌরবময় ভূমিকার কথাই  বার বার উল্লেখ করা হয়েছে। প্রত্যেকের বাগ্মিতার নানা পর্যায়ে এ মনোভাবই ফুটে উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে দুটি কথা বলা যায়। প্রথমত, ঐতিহাসিকভাবে কথাটা সত্য নয়; দ্বিতীয়ত, তাই যদি সত্য হবে তবে ছাত্রলীগের এই একলা চলোরে নীতি কি সমর্থনযোগ্য? পঞ্চাশের দশক থেকেই গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে আরও বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠন মাঠে সক্রিয় ছিল। কখনও তাদের সমর্থকের সংখ্যাগত আয়তন ছাত্রলীগকে ছাপিয়েছে, তারও চেয়ে বড় কথা দীর্ঘদিন এমন বেশ কয়েকটি সংগঠনের সাথে ছাত্রলীগ কাঁধ মিলিয়ে কাজও করেছে। এসব কথা অস্বীকৃত হলে, অনুচ্চারিত থাকলে এখনকার ছাত্র-তরুণরা ভুল বারতা পাবে, আর এখনকার ছাত্রলীগ কর্মীরা নিজেদের এককভাবে সফল গৌরবের অধিকারী ভাববে। বর্তমান বাস্তবতায় এটা ক্ষমতার নানা বিকারে আক্রান্ত ছাত্রলীগের জন্যে যথাযথ পথনির্দেশক বক্তব্য হয়েছে বলে মনে করা কঠিন।
বাংলাদেশের রাজনীতির - এমনকি গণতান্ত্রিক রাজনীতিরও - যেসব দুর্বলতা ও মন্দ দিক আছে তার মধ্যে কয়েকটি বরাবর প্রকটভাবেই ধরা পড়ে। নিজের দল সম্পর্কে ফাঁপিয়ে বলা, অন্যদের বাদ দিয়ে অতীতের সব কৃতিত্ব নিজেদের ভাগে রাখা, এবং সর্বশেষ না হলেও নিকৃষ্ট একটি হল, নিজ দলের আচরণ, ভোগদখল তথা অধিকার ও কায়েমি স্বার্থের অবস্থানকেই প্রাধান্য দেওয়া। তাতে কোনো রকম গণতান্ত্রিকতা চালিয়ে নেওয়া মুশকিল। কাছাকাছি মতাদর্শের রাজনৈতিক শক্তি, যেগুলো জাতীয় পর্যায়ে না হলেও স্থানীয়ভাবে অন্তত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-কেন্দ্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছাত্রলীগের সমকক্ষ বা তাদের ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রাখে সেগুলোকে দমানোকে বহুকাল ধরে ছাত্রলীগ অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এভাবে সুদিনে ছাত্রলীগ  বরাবর একাকীই থেকেছে, কেবল যখন সামরিক স্বৈরাচারের আমলে চরম প্রতিকূলতায় পড়েছে, তখন সর্বদলীয় কমিটি করেছে। কিন্তু অনুকূল পরিবেশে এবং নির্বাচনের সময় বিরুদ্ধতায় যথেষ্ট কঠোর থেকেছে যাতে তাদের একক আধিপত্য বজায় থাকে।
কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা হল, দেশে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও প্রগতির অনেক প্রতিপক্ষ মাঠে সক্রিয় যাদের অনেকেই সম্ভবত আজ আন্তর্জাতিক জঙ্গি সন্ত্রাসবাদের সাথেও যুক্ত আছে। এমনিতেই মুসলিম-প্রধান দেশে পঁচাত্তর পরবর্তীকালে দুই  স্বৈরাচার ও বেগম জিয়ার দুই দফা শাসনের সুবাদে মুসলিম জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে দেশে। বৃহৎ শক্তির বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনীতির কারণে সাধারণভাবেই মুসলিমমানসে ক্ষোভ ও ক্রোধ তৈরি হয়েছে। এর রাজনৈতিক বহি:প্রকাশ যে কোনো সুযোগে ঘটতেও পারে। এক কথায় বলা যায় আইউব-জিয়া-এরশাদের মত সামরিক শাসকদের আমলের চেয়েও বর্তমান বাস্তবতা অনেক জটিল এবং কঠিন অনিশ্চয়তায় ভরা। বেগম জিয়ার বিএনপির রাজনীতি আওয়ামী লীগ ও প্রগতির শক্তির বিরুদ্ধে এই সম্ভাব্য অপশক্তিকে কাজে লাগাতে পারে - অন্তত অতীতের অভিজ্ঞতা তাই বলে।
ফলে সমাজে গণতন্ত্রের সংগ্রাম অনেক বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন আজ। অতীতে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টির সাথে সাথেই ছাত্রলীগসহ অন্যান্য প্রগতিশীল দল জোটবদ্ধ আন্দোলনে নেমেছিল বলেই স্বাধীনতা অর্জনসহ অন্যান্য সাফল্য এসেছিল।
জিয়া-এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছিলেন এবং তা ধরে রাখার জন্যে জবরদস্তি ও দখলদারির রাজনীতি চালু করেছিলেন। এর বিরুদ্ধে প্রায় একই কৌশলেই এগুতে হয়েছে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগকে। কিন্তু তখন ছাত্রলীগ সমমনা প্রগতিশীল দলগুলোকে কোনো অবস্থাতেই ছাত্রসংসদের নির্বাচনে বিজয় অর্জনের সুযোগ দিতে চায় নি। বিপক্ষশক্তি তো এ কৌশলেই এগুতে চেয়েছে, আখেরে ছাত্রলীগসহ সকলের সংগঠন নষ্ট হয়েছে, সামগ্রিকভাবে ছাত্ররাজনীতি প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। একটা সময়ের পর থেকে এদেশে আর কোনো পর্যায়েই ছাত্রসংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হচ্ছে না। যে পর্যায় থেকে নাগরিকরা গণতন্ত্রের সবক নেবেন, নেতা হওয়ার প্রশিক্ষণ পাবেন সেখানে গণতন্ত্রের চাকাই রুদ্ধ হয়ে গেল। যত স্বচ্ছ ব্যালেট বাক্সের ব্যবস্থা হোক না কেন একেবারে সাধারণ সদস্যদের নির্ভেজাল মতামতের ভিত্তিতে দলের কর্মকর্তা নির্বাচিত হওয়া সম্ভব বলে কারও বিশ্বাস হয় না।
অথচ বর্তমান জঙ্গিবাদ, ধর্মান্ধ রক্ষণশীলতার মাত্রা ছাড়িয়ে ওঠার আশংকার তলা থেকে দেশকে ধর্ম ও মত চর্চার সুস্থ আবহসহ একটি যথাযথ গণতান্ত্রিক বাতাবরণ উপহার দেওয়া জরুরি অগ্রাধিকার কর্ম বলে মনে করি। আর তা শুরু হতে পারত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছাত্রসংসদের নির্বাচন দিয়ে। কেবল একটি বিধান জারি করা দরকার যে, কোনো ছাত্রসংগঠন ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার নীতি ও কর্যক্রম নিয়ে বৈধতা পাবে না। ফৌজদারি অপরাধে আদালতে শাস্তিপ্রাপ্তদের জন্যে নিষেধাজ্ঞা তো এখনও রয়েছে। সঙ্গে যুক্ত করতে হবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্যে সর্বস্তরে নিয়মিত ছাত্র হতে হবে এবং তাই প্রার্থীর বয়স কখনও ২৫ এর বেশি হতে পারবে না।
ছাত্রলীগকে মাত্র দুটি বিষয় শিখতে হবে - প্রয়োজনে সমমনা দলগুলোর সাথে আধিপত্য নয়, সমতার ভিত্তিতে জোট গঠন করে নির্বাচন করা এবং সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনে পরাজয় মর্যাদার সঙ্গে গ্রহণ করা।
সেই সাথে ছাত্রলীগ এবং অন্যান্য সকল দলকে দুটি বিষয় ভুলতে হবে - কোনো পর্যায়ে কোনো অবস্থাতে দখলদারির মানসিকতা দেখানো এবং দখল বা কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্যে কোনো রকম অবৈধ পন্থা - জবরদস্তি বা সন্ত্রাসে জড়ানো - বন্ধ করতে হবে। তাহলে এ পর্যায়ে অন্তত গণতন্ত্রের পথ সুগম হবে। স্বভাবতই এর প্রভাব বৃহত্তর জাতীয় প্রেক্ষাপটেও শুভই হবে।
আমার মনে হয় কাজটা কঠিন নয়। কেবল ধারা পাল্টানোর ব্যাপার। বুঝি, শেখ হাসিনাকেই এটা চাইতে হবে, সূচনা করতে হবে।

***