Sunday, November 13, 2016

সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নিয়ে আগাম ভাবনা

আবুল মোমেন

চট্টগ্রাম শহরের জনসংখ্যার হিসেব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এক মত হতে দেখা যায়  না - ৪৫ থেকে ৬০ লাখ পর্যন্ত শোনা যায়। আমরা ধরে নিতে পারি ৫০ লাখ। একটা তথ্য দিয়ে কথাটা শুরু করি।
দু’মাস আগে গিয়েছিলাম পাশের ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায়। জনসংখ্যা ৬ লাখ। আমরা চট্টগ্রামের সঙ্গীত সংগঠন রক্তকরবীর অনুষ্ঠান করলাম রবীন্দ্রভবনের দুই নম্বর মিলনায়তনে। এই আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলে আসনসংখ্যা ৬শর বেশি। ভবনের প্রধান হলের ধারণ ক্ষমতা এগারশর বেশি। রাস্তার বিপরীত দিকে আছে সুকান্ত একাডেমি। তাতে ৩৫০ আসনের আধুনিক মিলনায়তন ছাড়াও লাইব্রেরি, গ্যালারি রয়েছে। পাঁচ বছর আগে ওখানে সেমিনার করেছিলাম রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবাষির্কী উপলক্ষে। এর বাইরে আছে নজরুল কলাক্ষেত্র - এই আধুনিক মিলনায়তনটিতে আসন সংখ্যা নয়শ। টাউন হলও বেশ ভালো। পুরোনো রাজবাড়িতে জাদুঘরের পাশাপাশি সংস্কার করে আধুনিক মিলনায়তনও তৈরি হয়েছে।
একটি শহরের নাগরিক জীবনে সুস্থ আনন্দ ও বিনোদনের জন্যে আধুনিক মিলনায়তন অপরিহার্য। মিলনায়তনের সংখ্যা, সুযোগ-সুবিধা ও তার মান দেখে বোঝা যায় নগরটি সাংস্কৃতিকভাবে অত্যন্ত জীবন্ত।
আগরতলার চেয়ে জনসংখ্যার বিচারে প্রায় আট গুণ বড় চট্টগ্রাম শহরে একটি মাত্র আধুনিক মিলনায়তন আছে, থিয়েটার ইন্সটিটিউট, যার আসনসংখ্যা মাত্র ২৮০। এছাড়া শিল্পকলা একাডেমির কিছু সংস্কার ও আধুনিকায়ন হয়েছে। কিন্তু আসন সংখ্যা সেই ৩০০-৩৫০।
এককালে যখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মিলনায়তনের রেওয়াজ ছিল না তখন চট্টগ্রামে অন্তত ৪টি মিলনায়তন বেশ চালু ছিল - মুসলিম হল, ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউট, ওয়াপদা মিলনায়তন, জেমসেন হল। এছাড়া সেন্ট প্লাসিডস্ ও সেন্ট মেরিজ স্কুলের মিলনায়তনও বিভিন্ন সময়ে নাটকসহ সাংস্কৃতিক কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এসব মিলনায়তনে তখন নিয়মিত নাটক ও বিচিত্রানুষ্ঠান হত। বর্তমানে দুটি মাত্র মিলনায়তন চালু থাকলেও তাতে কিন্তু প্রতি সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান থাকে না। অন্যান্য হল, মুসলিম হল, জেমসেন হল, ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউটের ব্যবহার আর তেমন হয় না। বলা যায় নগরে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে ভাঁটা চলছে। এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মিলনায়তনগুলোতেও আগের মত সাংস্কৃতিক কার্যক্রম হয় না। শুনেছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মোজাম্মেল স্মৃতি মিলনায়তনটি অব্যবহার্য পড়ে থাকতে থাকতে তার মেঝেতে ঘাস গজিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত হলটি পরিত্যক্তই হয়েছে কি?
সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের এই ভাঁটার কালে এখানকার ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোও ধুঁকে ধুঁকে চলছে। অধিকাংশ নাটকের দল নামসর্বস্ব - কালেভদ্রে মঞ্চে নাটক করে।
চট্টগ্রাম বেতার ও টেলিভিশনও মান বজায় রেখে চলতে পারছে না। এই বাস্তবতায় মেধাবী তরুণ শিল্পীরা সকলেই ঢাকামুখী হয়ে পড়েছে। এর ফলে ঢাকার বাইরে সারাদেশের সবকটি জেলা শহরই সাংস্কৃতিকভাবে ক্ষয়িষ্ণু, প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম দেশের প্রধান বন্দর নগরী হিসেবে গড়পড়তা সবার মধ্যে থাকার কথা নয়, এটা চট্টগ্রামের দুর্ভাগ্য।
আজকে জঙ্গিবাদের উত্থানের ফলে সকলেই উপলব্ধি করছেন যে দেশের সব জেলায় সর্বত্র সাংস্কৃতিক উজ্জীবন প্রয়োজন। সে হিসেবে দেশের দ্বিতীয় প্রধান নগরী ও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের দিকে সবার মনোযোগ দেওয়া দরকার।
আশার কথা সরকার অর্থাৎ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় মুসলিম হল ও শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে একটি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স হলে ভালো হয়। এখানে একটি অন্তত হাজার আসনের মূল মিলনায়তন, একটি চারশ আসনের নিরীক্ষামূলক নাটকের হল, একটি তিনশ আসনের সেমিনার হল, একটি একশ আসনের লেকচার হল, একটি প্রদর্শনী কক্ষ, একটি নগর জাদুঘর, একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনী কক্ষ, একটি সংস্কৃতি বিষয়ক লাইব্রেরি এবং একটি সাংস্কৃতিক আর্কাইভ থাকলে ভালো হয়। তাছাড়া বেশ কিছু মহড়া কক্ষ, সভাকক্ষ থাকতে পারে। সম্ভব হলে জনা বিশেকের সাংস্কৃতিক দল থাকার উপযোগী ডরমিটরি, চারজন বিশিষ্ট ব্যক্তি থাকার মত অতিথি কক্ষ থাকা দরকার। আর থাকবে ভালো মানের কেন্টিন।
আমরা আশা করব চট্টগ্রামকে বুঝ দেওয়ার মত কোনো সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স-এর কথা সরকার ভাবছেন না। একটি বিকাশমান আধুনিক নগরীর চাহিদা বিবেচনা করেই এটি তৈরি হওয়া দরকার।
প্রধান মিলনায়তন ও নাট্য মিলনায়তন এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে ব্যালে নৃত্যসহ বিদেশি সাংস্কৃতিক দলের অনুষ্ঠান ও অত্যাধুনিক নিরীক্ষামূলক নাটক এতে মঞ্চায়ন করা সম্ভব হয়।
এটিকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম যেন সাংস্কৃতিকভাবে জেগে ওঠে সেটাই চট্টগ্রামের মানুষের মাথায় রাখা দরকার। কেবল স্থাপনা বা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কিছুই হবে না যদি না স্থানীয় মানুষ মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করে কমপ্লেক্সকে চাঙ্গা রাখতে পারেন, নাগরিকদের সুস্থ বিনোদন দিতে পারেন।
এটি পরকিল্পনার জন্যে যোগ্য ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিতে হবে। মূল একজন পরিচালক ছাড়াও নাটক ও সঙ্গীত বিভাগের দু’জন উপ-পরিচালক থাকতে পারেন। এছাড়া প্রয়োজনীয় অফিস স্টাফ তো থাকবেনই। 
শেষ কথা হল কেবল ভবন তৈরি করলে চলবে না, এখানে বছরব্যাপী কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দও থাকতে হবে। নয়ত অনেক অর্থের বিনিয়োগ অনর্থক হয়ে যাবে। কারণ নিজস্ব আয় দিয়ে উন্নত মানের সংস্কৃতি চর্চা সম্ভব নয়। পৃথিবীর কোনো দেশেই তা হয় না এর জন্য সবসময়ই ভর্তুকির প্রয়োজন হয়। এ বিষয়টি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।

****