Thursday, February 19, 2015

চট্টগ্রাম মাতৃভাষা সংগ্রামেও পিছিয়ে ছিল না

আবুল মোমেন

ভাষা আন্দোলনের মাসে ভাষার কথায় আসা যাক। এ প্রজন্মের তরুণদের জানা প্রয়োজন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রামের ভূমিকা অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল। ঢাকার পাশাপাশি একই সময়ে চট্টগ্রামেও গঠিত হয়েছিল ভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এ পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন তখনকার তরুণ বামপন্থী কবি ও সংস্কৃতিকর্মী মাহবুবউল আলম চৌধুরী। যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন যুবলীগের সংগঠক ও পরবর্তীকালে বিখ্যাত শ্রমিক নেতা  চৌধুরী হারুনর রশিদ। এ সময় এ আন্দোলনে বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন যুবলীগের তরুণ কর্মীরা।
এই সাথে মনে রাখতে হবে সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের দাবি নিয়ে ভাষা আন্দোলনে শরিক হয়েছিল তমদ্দুন মজলিশও। এর দুই শীর্ষনেতা, পরবর্তীকালে বাংলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ আবুল কাশেম এবং তরুণছাত্র ও পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ১৯৬৬ সনে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় অকালপ্রয়াত ড. মাহফুজুল হকও ছিলেন চট্টগ্রামের মানুষ।
বায়ান্নর একুশে ফেব্র“য়ারি ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ ও অসংখ্য ছাত্র হতাহত হওয়ার খবর শুনে চট্টগ্রাম বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। পরের দিন বাইশে ফেব্র“য়ারি লালদিঘির মাঠে সভা ডাকে ভাষা সংগ্রাম পরিষদ। সেদিন রাতেই কবি মাহবুবউল আলম চৌধুরী প্রচণ্ড জ্বরের ঘোরের মধ্যে রচনা করেন একুশের প্রথম কবিতা - ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। জ্বরের প্রচণ্ডতায় তিনি নিজের হাতে লিখতে পারেন নি। মুখে মুখে বলে গেছেন আর সঙ্গী চৌধুরী হারুন তা লিখে নিয়েছিলেন। কবিতাটি দীর্ঘ, বক্তব্যপ্রধান, আবেগপ্রবণ, আবার সেই সাথে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় লক্ষ্যপূরণের দৃঢ়সংকল্পে মানুষকে উদ্দীপ্ত করতে সক্ষম। মুসলিম লীগ সরকার প্রেস থেকেই এটির মুদ্রিত কপি বাজেয়াপ্ত করে, কবিতাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং মুদ্রাকর ও প্রকাশককে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু তখন তো ভাষা আন্দোলনের আবেগ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কবিতাটি যেন ছাইচাপা আগুন। আজ এটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক সম্পদ আমাদের।
চট্টগ্রামে ধীরে ধীরে সর্বস্তরের মানুষ ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। কেবল শহরে নয় বিভিন্ন মহকুমা ও থানা শহরে স্কুল-কলেজকে কেন্দ্র করে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল আন্দোলন। সাহিত্যিক আবুল ফজল, কবিয়াল রমেশ শীল, তরুণ লেখক সুচরিত চৌধুরীসহ সর্বস্তরে এ আন্দোলনের পক্ষে মানুষ অবস্থান নিয়েছিল। অন্তত আমার জানা মতে আজও চট্টগ্রাম শহরে দু’জন ভাষা সৈনিক জীবনসায়াহ্নে উপনীত হয়ে দিনযাপন করছেন - এঁদের একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী এ কে এম এমদাদুল ইসলাম এবং অন্যজন বিশিষ্ট সমাজসেবক কৃষ্ণগোপাল সেন।
বাংলাভাষার চর্চা ও প্রসার নিয়ে চট্টগ্রামের গর্ব করার মত আরও বিষয় রয়েছে। মধ্যযুগে যখন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা স্তিমিত তখন দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ আরাকান রাজসভায় রীতিমত বাংলাসাহিত্যের রাজসিক দরবার চলছে। আলাওল, সৈয়দ সুলতান, মাগন ঠাকুর প্রমুখ তাঁদের সাহিত্য রচনা করে যাচ্ছিলেন যেগুলো আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে পড়া হয়।
শুধু সাহিত্যচর্চা নয়, ভাষার অধিকার রক্ষার জন্যে সুদূর সপ্তদশ শতাব্দীতে চট্টগ্রামের অন্তর্গত সন্দ্বীপ থেকে এক কবি বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রতিবাদী আওয়াজ তুলেছিলেন। সন্দ্বীপের সেই কবি আবদুল হাকিম রীতিমত তিরস্কার করে লিখেছিলেন - ‘ যেসব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি/ দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়/ নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়।’
তাঁর কবিতায় মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা কী তীব্র, আর এর অবহেলাকারীদের প্রতি কী কঠোর ধিক্কার না প্রকাশ পেয়েছে।
এই উত্তরাধিকার মনে রেখে আমরা যেন বর্তমানকে একবার দেখি এবং ভবিষ্যতে মাতৃভাষা সুরক্ষার জন্যে নিজেদের করণীয় ঠিক করি।

এ কোন্ পথে চলেছে ওরা?

আবুল মোমেন

নিরীহ মানুষকে হাত বেঁধে চোখ বেঁধে ছুরি দিয়ে জবাই করা কি ইসলামের শিক্ষা হতে পারে? তারা অন্য ধর্মাবলম্বী হলেও? কোনো বন্দি মুসলমানকে পুড়িয়ে হত্যা করা কি ইসলাম? শিয়াপন্থী মুসলমানের মসজিদে বোমা হামলা চালিয়ে নির্বিচারে তাদের হত্যা করা কি ধর্মসম্মত কাজ হতে পারে?
ইসলামের শিক্ষা এটা নয়। নবীজীর শিক্ষাও এটা নয়। যে প্রাচীন গোত্রভিত্তিক হানাহানি বন্ধ করার জন্যে হযরত মোহাম্মদ (স:) ইসলাম ধর্ম প্রবর্তন করেছেন এরা ঠিক সেই কাজই করছে। অর্থাৎ এক শ্রেণীর মুসলমানকে ফিরিয়ে নিচ্ছে আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে। তারা বর্বর যুগ ফিরিয়ে আনতে চাইছে। এবং তা চাইছে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে। ওরা যে কাজ করছে তা জেহাদ নয়, ধর্মযুদ্ধ নয়, শ্রেফ বর্বরতা।
বরং এদের অবিমৃষ্যকারিতার জন্যে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার আরব মুসলিম বিশ্বে হস্তক্ষেপের সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার অভাবে আজ সারা পৃথিবীর - একটি-দুটি ব্যতিক্রম ব্যতীত - মুসলিম দেশে দেশে অস্থিরতা, হানাহানি, দুর্যোগ চলছে।
এর মধ্যে ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ ছিল ব্যতিক্রম। এখানে বরাবর মানবিক ঔদার্য প্রাধান্য পেয়েছে। সুফী ও সাধকদের ধর্মীয় সহনশীলতা ও মানবপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে আমাদের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে। সে কারণে আরব বিশ্বের তুলনায় আমাদের দেশে শিক্ষা বিস্তার ঘটছে দ্রুত, স্বাস্থ্য খাতে চমকপ্রদ উন্নয়ন ঘটেছে, মানুষের গড় আয় এবং আয়ু উভয়ই বেড়েছে। আমাদের রয়েছে মুক্ত গণমাধ্যম, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার। এদেশের ভূমিজ সন্তান যারা তাদের ধর্ম যা-ই হোক সকলে বরাবর শোষণ-বঞ্চনা-দু:শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। তারই ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ, এবং এ কারণেই আমাদের অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু এদেশেও কিছু মানুষ ধর্মান্ধতার পশ্চাৎপদ চিন্তা জোর করে চাপিয়ে দিতে চায়। তারা দু:শাসক পাকিস্তানের দোসর হিসেবে হত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠনে অংশ নিয়েছে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। আর আজও নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করতে চায় বাংলাদেশের অগ্রগতি।
আমাদের মনে হয় বাংলাদেশের সচেতন মানুষের কয়েকটি বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে। প্রথমত বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু, এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মে মুসলমান এবং সাধারণজন যে কোনো মানদণ্ডে ভালো মুসলমান। তারা দেশের অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষের সাথে সহাবস্থানে     অভ্যস্ত। দ্বিতীয়ত, এদেশের মানুষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চায়, তাতে একাধিক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবে, কোনো দলের আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতা (তবে ধর্মহীনতা নয়) হলে কোনো দলের আদর্শে ধর্মীয় চেতনা (তবে ধর্মান্ধতা নয়) স্থান পেতে পারে। কিন্তু সবার লক্ষ্য হতে হবে দেশের উন্নয়ন, দেশের ভবিষ্যত। দেশের মানুষের ইচ্ছা এবং সে ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে তারা যে ইতিহাস রচনা করেছে সেটাকেও মর্যাদা দিতে হবে সবার।
তৃতীয়ত, বর্তমান বিশ্বের মুক্তবাজার বা বিশ্বায়নের চাপ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে একা থাকা যাবে না। তাহলে পিছিয়ে পড়তে হবে। আমাদের বহির্বিশ্বে বন্ধুরাষ্ট্র থাকবে, তবে লক্ষ্য রাখতে হবে দেশের সার্বভৌমত্ব যেন ক্ষুণœ না হয়। মর্যাদার হানী না হয় এবং দেশের স্বার্থও যেন বজায় থাকে। অর্থাৎ দেশ পরিচালনায় সরকারকে যেমন প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে তেমনি জনগণকেও একইভাবে পরিণত বুদ্ধির প্রমাণ দিতে হবে। সেই সাথে স্মরণ করিয়ে দেব, পশ্চিমের পুঁজিবাদী বিশ্ব সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিয়ে থাকে তাদের আর্থিক স্বার্থের ওপর। তারা ইরাক ও লিবিয়ায় আক্রমণ চালিয়েছে শুধুমাত্র নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে। সেদেশের জনগণকে চারম ভোগান্তি ও অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিতে এতটুকু কার্পণ্য তারা করে নি। একই ঘটনা ঘটছে প্যালেস্টাইন নিয়ে, আফগানিস্তান নিয়ে।
বাস্তবতা অত্যন্ত কঠিন। বস্তুত মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্যে এখন কঠিন একটি সময় যখন তাদের চরম ধৈর্য, গভীর প্রজ্ঞা এবং যথার্থ দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে। মানুষ পুড়িয়ে, অবরোধ-হরতাল করে, র‌্যাব-পুলিশ ব্যবহার করে, জেল-জুলুম অত্যাচার চালিয়ে, বিবৃতি আর মানববন্ধন করে দায় সারার চেষ্টা করলে হবে না। সমস্যাটা বুঝতে হবে দেশের এবং বৈশ্বিক পটভূমিতে, দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের নিরিখে, দেশীয় সামাজিক পটভূমিতে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতির ভিত্তিতে। এই দু:সময়ে মাথা গরম করার সুযোগ নেই, ঠাণ্ডা মাথায় সঠিক কৌশল ঠিক করেই সামনে এগুতে হবে।
আমার মনে হয় এ সময় প্রকৃত আলেম-ওলেমাদের এগিয়ে এসে ইসলামের সঠিক পথের কথা বলতে হবে। রাজনীতির ক্ষেত্রে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের পথ খুঁজে বের করতে হবে।