Tuesday, September 26, 2017

কোচিং-নোটবই বন্ধের আইন ও আমাদের শিক্ষার সংস্কৃতি

আবুল মোমেন

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ২০০৯ সালেই জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করে। এ কমিটি পরের বছর ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে সরকারের কাছে জমা দেয়। পাকিস্তান আমল থেকে এদেশে অসংখ্য শিক্ষা কমিশন হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে গঠিত শিক্ষা কমিশনের সংখ্যাও ছয় সাতটির মত হবে। সব কটি নিয়ে কোনো-না-কোনো মহল থেকে বিতর্ক উঠেছিল এবং এগুলো প্রকাশিত হওয়ার পরপর নানা আলোচনা ও বিতর্কের মুখে হিমাগারে ঠাঁই পেয়েছিল। এবারই প্রথম প্রাথমিক কিছু বিতর্ক সত্ত্বেও শিক্ষানীতিটি শেষ পর্যন্ত গৃহীত হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী উদ্যোগী হয়ে বিভিন্ন মহলের আপত্তি শুনেছেন ও তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
প্রায় সর্বমহল কর্তৃক গৃহীত এই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়োজনীয় শিক্ষা আইনের খসড়া প্রণয়নে কমিটি গঠিত হয় ২০১১ সালে। কাজটা অবশ্যই সহজ ছিল না, কারণ প্রায় দুই শত বছর ধরে চলে আসা একটি শিক্ষাব্যবস্থায় বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনার সুপারিশ ছিল এতে। এটি একটি বিশদ বিষয়, আমরা আজকে কোচিং-টিউশন-নোটবই নিষিদ্ধের সুপারিশেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।
এই আইনটিকে আমরা স্বাগত জানাই এবং আশা করব এটি খসড়াতে আটকে থাকবে না, যথাযথ প্রস্তুতিসহ কার্যকর হবে। কেননা কেবল আইন করলেই তো হবে না, তার বাস্তবায়ন জরুরি। আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অপরাধ দমনের জন্যে প্রচুর আইন আছে, কিন্তু তাতে অপরাধ বন্ধ হচ্ছে না। অনেক সময় আইন বাস্তব কারণেই প্রয়োগ করা যায় না, আবার বাস্তব কারণেই অনেক আইনি নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করা সম্ভব হয় না। বিষয়গুলোর গভীরতা ও জটিল বাস্তবতা আমাদের বিবেচনায় থাকতে হবে।
এদেশে প্রাইভেট টিউশনের ঐতিহ্য প্রায় আধুনিক স্কুল শিক্ষার সমবয়সী। অর্থাৎ এটি প্রায় দু’শ বছরের পুরোনো প্রথা। কীভাবে এটি গড়ে ওঠে? এই গ্রাম ও কৃষিপ্রধান দেশে আধুনিক স্কুল শিক্ষার সূচনা হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় কলকাতা মহানগরীতে। দেখাদেখি অন্যান্য ছোটবড় নগরেও ধীরে ধীরে স্কুল চালু হয়। এইখানে একটা বিষয় মনে রাখতে বলব। সাধারণত কৃষিপ্রধান গ্রামীণসমাজ শিল্পপ্রধান নাগরিকসমাজের তুলনায় ইনফর্মাল বা অনানুষ্ঠানিক (সেই সাথে অপ্রতিষ্ঠানিকও বটে) হয়ে থাকে। এই সংস্কৃতির দুর্মর প্রভাব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ও রক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের সাম্প্রতিককালের দুর্বলতা থেকেও প্রকাশ পায়।
দেখা যাচ্ছে এ দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিকাশের সাথে সাথেই শিক্ষার অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাও সহায়ক ধারা হিসেবে গড়ে উঠেছিল। প্রথম পর্যায়ে প্রথম প্রজন্ম থেকেই গ্রামীণ পরিবারগুলো সন্তানের শিক্ষার জন্যে শহরে আত্মীয়/পরিচিত পরিবারের সহায়তা নিয়েছে। তারাও এমন জায়গীরকে (বা লজিং মাস্টার) স্বাগত জানিয়েছে মূলত নিজেদের শিশুসন্তানদের লেখাপড়ার একজন তদারককারী পাওয়ার আশায়। এ নিয়ে বহু ঘটনা ও কাহিনী বাংলাসাহিত্যে এবং বাংলা চলচ্চিত্রে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এ কেবল শিক্ষাবঞ্চিত পরিবারের প্রথম প্রজন্মের জন্যেই সত্য ছিল না, দেখা যাচ্ছে ঠাকুরপরিবারের মত শিক্ষিত সংস্কৃতিমনা শহুরে পরিবারেও গৃহশিক্ষক রাখার রেওয়াজ ছিল - তাঁদের কেউ বাড়িতে থাকতেন কেউ সময় ধরে এসে বাড়ির শিশুদের পড়িয়ে যেতেন। এর সরস বর্ণনা রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলাতে পাওয়া যাবে। এই প্রথা গত দু’শ বছরে কখনো বন্ধ হয় নি।
এই প্রথা টিকে থাকার কারণ একাধিক। প্রথমত - অনেকের সাথে দ্বিমত হতে পারে, তবে আমার ধারণা এটিই গুরুতর কারণ - আমাদের সমাজ ( তাই পরিবার এবং ব্যক্তিও) কখনো শিক্ষার মৌলিক, প্রধান ও চরম লক্ষ্য যে আজীবন শিক্ষার্থী থাকার দক্ষতা ও  প্রণোদনা অর্জন তা কখনো বুঝতে পারে নি। যে ভাষা ও জ্ঞানচর্চার সূচনা স্কুলে হয় তার মূল উদ্দেশ্য হল ভবিষ্যতের পরিণত মানুষটাকে বুনিয়াদি আবেগ-অনুভূতি-উপলব্ধির সাথে পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণ-যুক্তিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতায় উত্তীর্ণ করা।
কিন্তু শিক্ষার এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সমাজ ও সরকার কারো বিবেচনায় না থাকায় কালে কালে শিক্ষার লক্ষ্য জ্ঞান ও জ্ঞানভিত্তিক দক্ষতা অর্জন থেকে সম্পূর্ণ সরে কেবলমাত্র পরীক্ষা ও তাতে কৃতিত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এর ফলে সমাজের যে সনাতন জ্ঞানবিমুখ এবং পর্যবেক্ষণ-যুক্তি-বিশ্লেষণ বিমুখ ভাবাবেগ-নির্ভর প্রবণতা ছিল তার পালেই একতরফা জোরেসোরে হাওয়া লেগেছে, এবং তা আদতে দু’শ বছর ধরেই চলছে। এর প্রভাব পুরো সমাজ-জীবনের সর্বক্ষেত্রেই আজো প্রকটভাবে উপস্থিত। এর ওপর আজকাল পরীক্ষার ফলাফলের সাথে শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি, স্কুলে সরকারি সাহায্যকে যুক্ত করে দেওয়ায় পরীক্ষামুখী পাঠচর্চায় একেবারে জোয়ার চলছে। সংশ্লিষ্ট সকলের ভাবনাতে এর বাইরে আর কিছুই নেই বলে মনে হয়।
শিক্ষাবাজারে (দু:খিত এই শব্দবন্ধ প্রয়োগের জন্যে) জ্ঞানের পরিবর্তে পরীক্ষার ফলই একমাত্র কাক্সিক্ষত ‘সামগ্রী’ হওয়ায় একে ঘিরেই বাজারের প্রবণতাগুলো নির্ধারিত হবে এটাই স্বাভাবিক। এই বাজারই অধিকতর সাফল্যের সাথে চতুর পসরা সাজাতে সাজাতেই তৈরি করে নিয়েছে কোচিং সেন্টার নোটবই এবং উদ্ভাবন করেছে পরীক্ষা-দক্ষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া - নিরন্তর মডেল টেস্ট, যা কোচিং সেন্টারের মূল কাজ। শুনেছি প্রতিযোগিতার বাজারে ব্যবসা ধরে রাখার জন্যে কোনো কোনো কোচিং সেন্টার কৃতী ছাত্রদের (থুড়ি পরীক্ষার্থীদের) ট্যাবও উপহার দিচ্ছে। এরই উপজাত হিসেবে দেখা দিয়েছে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ফলাফল প্রভাবিত করার মত শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট নানা দুর্নীতি। শিক্ষা যেহেতু মানুষ তৈরির কাজ তাই এক্ষেত্রে সৃষ্ট সব দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থা আদতে আত্মঘাতী। বলতেই হবে যে ব্যবস্থা শিক্ষার্থীকে পরীক্ষার্থীতে রূপান্তরিত করে তার গলদগুলো ঠিক না করে কেবল আইন দিয়ে শিক্ষার নেতিবাচক উপদ্রবগুলো কি বন্ধ করা যাবে?
সমস্যা আরো রয়েছে। উপরের বিষয়টি অনেকাংশে শিক্ষার সংস্কৃতির বিষয়, কিন্তু এতে কাঠামোগত সমস্যাও বিস্তর। এ দেশে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত আদর্শ  অবস্থার চেয়ে এখনো অনেক পিছিয়ে। সরকার চেষ্টা চালাচ্ছেন বটে কিন্তু এখনো সরকারি স্কুলেই শ্রেণিকক্ষে প্রায় একশ ছাত্র নিয়ে একজন শিক্ষককে হিমশিম খেতে দেখা যায়। শ্রেণিকক্ষে অধিক ছাত্র এবং স্কুলসময় প্রয়োজনের (বা আদর্শের) তুলনায় কম হওয়াও স্কুলে যথাযথ পাঠদানের অন্তরায়। তার ওপর রয়েছে শিক্ষকদের দক্ষতার ও কর্মস্পৃহার ঘাটতি। সর্বোপরি তো রয়েছে নিরন্তর পরীক্ষার চাপ। সবরকম ঘাটতি ও চাপ পূরণের জন্যে কোচিং ও সহায়ক গ্রন্থের দ্বারস্থ হচ্ছেন সকলে। বলাই বাহুল্য, পরিস্থিতির সুযোগ নিতে ছাড়ছেন না কোনো পক্ষ, শিক্ষকরাও নয়। এভাবে সবার সহযোগিতা ও ভুল সিদ্ধান্তের যোগফল হল আজ স্কুলের চেয়ে কোচিং সেন্টার, শিক্ষকের চেয়ে টিউটর, পাঠ্যবইয়ের চেয়ে নোটবই এবং শিক্ষার চেয়ে পরীক্ষা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যে ব্যবস্থায় পরীক্ষার একাধিপত্য চলে সেখানে আইন প্রয়োগ ও পুলিশি অভিযান চালিয়ে কি কোচিং-টিউশন-নোটবই বন্ধ করা যাবে? বাজারের চাহিদা ও ব্যাপকতা এবং শিক্ষার প্রকৃত চাহিদা তৈরির ব্যর্থতার এই বাস্তবতায় এসব পরিপূরক-সহায়ক এবং লাভজনক ব্যবস্থা ভিন্ন চেহারায় টিকে থাকবে বলেই আশংকা হয়।
সমাজের বিদ্যমান বাস্তবতার বিচারে বলছি আইন প্রয়োগের সাথে সাথে বা মাধ্যমে আমরা কি শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ঠিকভাবে নির্ধারণ করে চলতে পারব? পরীক্ষার ক্রমবর্ধমান চাপে পিষ্ট স্কুলশিক্ষা থেকে যে গ্রন্থাগার ও বিজ্ঞান গবেষণাগারের ব্যবহার, নিয়মিত সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, এমনকি খেলাধূলা ও শিক্ষা সফর, স্কুল ম্যাগাজিন প্রকাশ (বা দেয়াল পত্রিকা তৈরি) প্রায় নীরবে হারিয়ে গেছে তার ক্ষতি নিয়ে আমরা কি সচেতন? কীভাবে স্কুলশিক্ষায় মেধাবী উদ্যোগী তরুণরা যুক্ত হবে তার কোনো পরিকল্পনা কি আছে আমাদের? এদিকে পরীক্ষার আশু তাগিদ এবং বিপরীতে স্কুলে যথার্থ শিক্ষাদানের মত সময় ও সুযোগের অভাব, শিক্ষকের অদক্ষতা, পরিবারের শিক্ষার সব দায়িত্ব অন্যের ওপর অর্পণের মনোভাবের যোগফল হল শিক্ষার উল্টোযাত্রা। বাজারে সৃষ্ট এই চাহিদা যেহেতু রাতারাতি দূর হবে না তাই হয়ত আইন প্রণয়নের পর দৃশ্যমান কোচিং সেন্টার অদৃশ্য হবে, গাইডবই নিষিদ্ধ পুস্তকের রূপ ধারণ করবে, শিক্ষকরা পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়িয়ে নেপথ্যে কাজ চালাবেন। বলা যায় পুরো প্রক্রিয়াটা আরো অনানুষ্ঠানিক রূপ নেবে। আর এই ইনফর্মাল সমাজ সেটা লুফে নেবে। হয়ত সন্তানের সুশিক্ষা (অর্থাৎ পরীক্ষায় ভালো ফল) নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত বিভ্রান্ত পুলিশ সদস্যরাও এ বাস্তবতায় করণীয় নির্ধারণেও একইভাবে দুশিন্তায় ও বিভ্রান্তিতে থাকবেন। পুরো প্রক্রিয়াটা লেজেগোবরে হলে আমরা কি বিভ্রান্ত হব না, এমনকি দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হব না?
শিক্ষাকে পণ্যে রূপান্তরের কাজ প্রায় সম্পন্ন হওয়ার পরে কাজটা আরো কঠিন হয়ে পড়েছে; কোচিং নোটবই প্রাইভেট টিউশনের নিদান হিসেবে খসড়া আইনে স্কুলের ব্যবস্থাপনায় স্কুল সময়ের পরে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী সরকার নির্ধারিত ফিতে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সরকারি স্কুলগুলোতে দুই পর্বে স্কুল হয়, তার ওপর অনেক স্কুলেই কলেজ চালু হয়েছে। এ অবস্থায় নিম্ন আয়ের ক্লান্ত শ্রান্ত অনুদ্দীপ্ত (demotivated) শিক্ষককূল এতে কি আকৃষ্ট হবেন? আর সরকার ও গণমাধ্যমের আশকারায় পরীক্ষার ফল নিয়ে মত্ত ‘ভালোছাত্র’, তাদের ফলানুরাগী ও তাতেই মশগুল অভিভাবকরা এবং শিক্ষা নিয়ে অন্ধ চিন্তায় আচ্ছন্ন সমাজ কি হঠাৎ আইনের চোখ রাঙানিতে ঘুম থেকে জেগে উঠবে? প্রত্যাশাটায় বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিনা তা আইন কার্যকর হলেই বোঝা যাবে।

***


Saturday, August 19, 2017

ইতিহাসে-বর্তমানে বঙ্গবন্ধু

আবুল মোমেন

১.
বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মকে কেবল ইতিহাসের পটে রেখে স্মরণ করলে তাঁকে আংশিক পাওয়া যাবে। তাঁকে পাওয়া ও বোঝা পূর্ণতা পাবে একই সাথে তাঁর অর্জন ও অবদানকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন করলে। আমরা সংক্ষেপে এই দু’ভাবেই তাঁকে বোঝার চেষ্টা করতে পারি।
গ্রামবাংলার সাধারণ ঘরের একটু রগচটা বালকটির (তাঁর ভাষায় মাথা গরম) মধ্যে কিছু অসাধারণ গুণ দেখতে পাই। ছেলেটি সে বয়সেই পরের হিতৈষী ছিল, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস ছিল তার, প্রয়োজনে দলবল নিয়ে প্রতিকারের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্দীপনাও তার ছিল। এসব ঘটনায় প্রকাশ পাওয়া চারিত্রিক গুণাবলি তার ভবিষ্যত পরিণতির ইঙ্গিত দেয়। ছেলেটা সাহসী, নেতৃত্ব গুণের অধিকারী, ন্যায়ের প্রতি তার পক্ষপাত সহজাত এবং সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বোধে সে আন্তরিক। পরে আমরা দেখতে পাই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতায়ও তিনি সমসাময়িক অনেকের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন ।
জুন ১৯৬৬ থেকে মার্চ ১৯৭১ - এই ন্যূনধিক পাঁচ বছরে দক্ষ সংগঠক ও তরুণ নেতা হিসেবে খ্যাত  শেখ মুজিব তাঁর চেয়ে বয়সে প্রবীণ, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অগ্রসর কিংবা জেলজুলুম খাটা ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় পোড় খাওয়া সকল নেতাকে ছাপিয়ে পূর্ববাংলার জনগণের অবিসংবাদী নেতা হয়ে উঠেছিলেন। ’৪৭ থেকে ছয়দফার আন্দোলনের পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও পূর্ব পাকিস্তনের প্রাদেশিক রাজনীতির নানা উত্থানপতনে জর্জরিত ইতিহাস রাজনীতিকদের সম্পর্কে জনমনে অনাস্থা ও হতাশার জন্ম দিয়েছিল। বিপরীতে শেখ মুজিবের উত্থানপর্বের ইতিহাসে দেখি জনমানুষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি আস্থা ফিরে পেলো, রাজনীতিকে ঘিরে আশার আলো দেখতে শুরু করল। এভাবে জনগণের ঐকান্তিক ভালোবাসায় শেখ মুজিব কেবল বঙ্গবন্ধু উপাধি পেলেন তা নয়, তিনিই জন-ইতিহাসের নেতা ও নায়ক হয়ে  উঠলেন।
একাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে যখন রাজনৈতিক হাওয়া তপ্ত হতে শুরু করে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচনের রায়ের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে কিনা সে সন্দেহ জোরদার হতে থাকে এবং পূর্ববাংলার ছাত্র-তরুণদের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা পাকিস্তান-বিরোধী স্বাধীনতার চেতনায় রূপ নিতে থাকে তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্ব আরো পোক্ত ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। তিনি হয়ে উঠলেন জাতির আশা ও সংগ্রামের প্রতীক। তাঁর নেতৃত্বের প্রতি মানুষের আস্থা এত প্রগাঢ় হয়েছিল যে একদিকে স্বভাবত কোন্দলপ্রবণ বাঙালি সব বিবাদ ও ক্ষুদ্র স্বার্থ ভুলে ঐক্যবদ্ধ জাতিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। অন্যদিকে, তাঁর নেতৃত্বে আস্থা রাখতে পেরে মানুষ এতটাই উজ্জীবিত হয়েছিল যে সহজাত শান্তিপ্রিয় ও ঘরকুনো প্রকৃতির বাঙালি রূপান্তরিত হল এক বীরের জাতিতে। প্রকৃত বীরের মতই তারা লক্ষ্য অর্জনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারেও প্রস্তুত ছিল, ঠিক যেমন তাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবেরও প্রস্তুতি ছিল জাতির কল্যাণে দেশের স্বাধীনতার জন্যে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের।
নেতা ও জনতার এই সম্মিলনের ফল মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা এবং সার্বভৌম বাংলাদেশ।
২.
স্বাধীনতার পরে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে শুরু করল - জনমনের পরিবর্তনের বিবেচনায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা ঘটেছিল খারাপের দিকে। পাকিস্তানের নির্জন কারাবাস থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসা বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এক সম্পূর্ণ নতুন গৌরবের অভিজ্ঞতায় পোড় খাওয়া তাঁর জনগণের মধ্যে যেন নয়মাসে এক অদৃশ্য ব্যবধান বা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল। ক্রমে সেটা দৃশ্যমান হতে থাকল। এক দল স্বাধীনতার মাধ্যমে জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগকে নিজেদের পাতে টানবার চেষ্টায় প্রায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। তারা স্বভাবতই স্বাধীনতার কৃতিত্ব, মুক্তিসংগ্রামের উত্তরাধিকার ও ক্ষমতার প্রসাদের ভাগ নিতে ক্ষমতাসীন দলেই আশ্রয় নিল।
আরেক দল স্বাধীনতার মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজের বিপ্লবী পরিবর্তনের জন্যে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারকে অংকুরেই চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিপ্লবের স্বপ্ন বাস্তবায়নে নেমে পড়েছিল। একাত্তরের ফেব্রুয়ারি-মার্চে বঙ্গবন্ধু নিশ্চয় জাতীয় ঐক্য দেখতে পেয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় প্রবাসে আওয়ামী লীগের বিভক্ত বিবদমান অধিকাংশ নেতা-কর্মীদের এড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ক্ষুদ্র একটি দলকে নিয়ে ভারতীয় ঝানু আমলা ও কূটনীতিকদের সহযোগিতায় যেভাবে কঠিন সময় সফলভাবে পাড়ি দিয়েছেন এবং এই সময়ে সমমনা দলের সমন্বয়ে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে জাতীয় ঐক্যের ছাতাটি বহাল রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সে অভিজ্ঞতা সকলের অনুধাবনের অবকাশ যেন বঙ্গবন্ধুসহ অনেকেই পাননি। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সেই ঐক্যের ধারাকে বজায় রেখে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার যে সুযোগ তৈরি করেছিল সেটার চেয়ে তিনি ১৯৭০-এর নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি সংসদীয় গণতন্ত্রের ওপরই আস্থা রাখলেন। চিরকালের গণতান্ত্রিক নেতার পক্ষে সমাজের বিপ্লবী ক্রান্তিকালের চাহিদা অনুধাবন ও অনুসরণ সম্ভবত স্বাভাবিক ছিল না। বিভাজনে সৃষ্ট আস্থার সংকট ও  অস্থিতিশীলতা সুযোগসন্ধানী ষড়যন্ত্রীদের সক্রিয়তার সহায়ক হয়েছিল। বাহাত্তরের ভুল বঙ্গবন্ধু পঁচাত্তরে সংশোধন করতে চেয়েছিলেন বাকশাল গঠন করে। যে নেতা রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রদানে বরাবর সময় নির্বাচনে তুখোড় ছিলেন তাঁর যেন এবার রাজনৈতিক চালে দেরি হয়ে গেল। ষড়যন্ত্রকারীরা প্রত্যাঘাত হানতে এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছিল।
পচাত্তরের আগস্টের ধ্বংস্তূপ থেকে উঠে এসেছিল ষাটের দশকে প্রত্যাখ্যাত ও একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তানি ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার রাজনীতি। তার মুখপাত্র হলেন প্রথমে আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক এবং পরে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ জিয়াউর রহমান। এ দু’জনের বাহ্য পরিচয় এবং ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে তাদের ভূমিকার সাথে বাংলাদেশের পরবর্তী দশকগুলোর রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনাপ্রবাহ বিচার করে বোঝা যায় পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক ঘটনাবলি এত দ্রুততার সাথে এগিয়েছিল যে, তার সাথে জনগণ ও সমাজমানসের পরিবর্তন তাল মেলাতে পারে নি। চোখের সামনে এদেশেবাসীর সবচেয়ে বড় অর্জন গণমুখী দেশপ্রেমিক রাজনীতি ক্রমে ক্ষমতার বৃত্তে বাঁধা পড়ে গেল, আদর্শ ও নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটে কালো টাকা ও পেশিশক্তির সাথে গাঁটছাড়া বাঁধল। সমাজে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষতার বাতাবরণ নষ্ট হয়ে গেল, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ও ভূমিকা প্রাধান্য পেতে থাকল, ধীরে ধীরে পরমতসহিষ্ণুতার পরিবেশও আর থাকল না।
৩.
এই পরিবর্তন ঘটতে ঘটতে এবং বুঝতে বুঝতে ইতিহাসের পটে পরিস্কার হয়ে ওঠে যে পঁচাত্তর আমাদের জাতীয় জীবনে এক বিভাজন-রেখা। এরপরে, বিশেষত গত এক দশকে, অর্থনৈতিক উন্নতি ভালোই হচ্ছে, কিন্তু রাজনৈতিক অবনতি ও অবক্ষয় সেই থেকেই চলছে। পঁচাত্তরেই রাজনৈতিক পটভূমি থেকে আমাদের রাজনীতির সবচেয়ে সাংগঠনিক-প্রতিভা দূরদর্শী তাজউদ্দিন হারিয়ে গিয়েছিলেন, আর সে বছর নভেম্বরে তিনি ও অপর তিন জ্যেষ্ঠ নেতার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ অনেকটাই নেতৃত্বশূন্য হয়ে যায়। তৎকালীন অপরাপর জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেক দোলাচল আমরা দেখেছি, দু:সময়ে বেগম জোহরা তাজউদ্দিনের সাহসী ভূমিকাও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে লক্ষ্য করেছি। কিন্তু তখন দিনে দিনে এটিও পরিস্কার হয়ে ওঠে যে কেবল আওয়ামী লীগ নয় দেশের প্রকৃত গণতান্ত্রিক সংগ্রামে এদেশের মানুষের প্রেরণার উৎস একজনই - তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
বঙ্গবন্ধু সংগঠনের কর্মী থেকে নেতা হয়েছিলেন, কিন্তু সেখানেই যতি টানেননি, হয়ে উঠেছিলেন জাতির নেতা, জনগণের নায়ক, কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ইতিহাসের দায় - তার জন্যে জীবনের ঝুঁকি নিতে কুণ্ঠিত হননি। তাঁর ভূমিকা বিশাল ও বৈচিত্র্যময়, তাঁর ব্যক্তিত্ব বহুমাত্রিক, তাঁর চিন্তা ও কর্ম ছিল লক্ষ্যাভিমুখী এবং ক্রমেই তাঁর রাজনীতি দেশ ও  জাতির সামগ্রিকতায় বিকশিত হয়েছে। হিন্দু মুসলিম, ধনী-দরিদ্র, উচ্চশিক্ষিত-শিক্ষাবঞ্চিত, উন্নতরুচির শিল্পী সাহিত্যিক-স্থূলরুচির ব্রাত্যজন, নারী-পুরুষ, শিশু-বয়স্ক সকল মানুষ তাঁর মধ্যে আস্থার একজনকে পেয়েছে, তাঁর সাথে প্রেম-প্রীতি-স্নেহের বন্ধন বোধ করেছে। দিনে দিনে তাঁর জীবনকালের অপারগতা-অপূর্ণতার দায় ইতিহাস মুছে মুছে উজ্জ্বল করে তুলেছে বঙ্গবন্ধুর ইতিবাচক অবদানসমূহ।
ক্ষমতার লড়াই ক্রমশ রাজনীতির পরিসর সংকীর্ণ করে তোলে, ক্রমেই স্বার্থ তথা তাৎক্ষণিক লাভ-ক্ষতির বিচারের উর্দ্ধে জাতীয় ও চিরায়ত চেতনা - যাকে আমরা আদর্শ ও নীতি বলে থাকি - হারিয়ে ফেলে। রাজনীতি ক্ষমতা, বিত্ত, প্রতিপত্তির বেশি কিছু দেওয়ার শক্তিও হারিয়ে ফেলে। অথচ জাতির চেতনার সংকটই তো গভীর, ক্রমে গভীরতর হচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, বৈষম্য - এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে কে রাজনীতি ছাড়া? আত্মকেন্দ্রিকতা, জঙ্গিবাদ, ভোগসর্বস্বতা, মাদক ও নেশার সর্বনাশ কি পুলিশ প্রশাসন তাড়াতে সক্ষম সুস্থ সঠিক গঠনমূলক রাজনীতি ছাড়া?
জনগণের রাজনীতি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, দেশের রাজনীতি করেছিলেন তিনি, জাতির ভাগ্য নির্মাণের ক্ষমতা ছিল সে রাজনীতির, তাতে রাজনীতিকদের দলীয় সংকীর্ণতার উর্দ্ধে ওঠা সম্ভব ছিল, বর্তমানের অর্জন ও বাস্তবতা ছাপিয়ে ভবিষ্যতের সম্ভাবনার বিকাশ ঘটানোর ঔদার্য ছিল সে রাজনীতির।
আজ আর্থিক সংকট খানিকটা ঘুচলেও মানবিক সংকট বাড়ছে। এ সময়ে দলের ও দলের বাইরে সতীর্থ রাজনীতিবিদদের আলোকোজ্জ্বল বলয়ের মধ্যমণি বঙ্গবন্ধুর হাস্যোজ্জ্বল মুখাবয়বের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে।

***

Monday, July 10, 2017

চরমপন্থা দমানোর পরিবেশ তৈরি করতে হবে

আবুল মোমেন

হলি আর্টিজানে হামলার বছর পূর্তিতে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে যখন ভাবছিলাম দেশে জঙ্গি সৃষ্টির কারণ কী তখন স্বভাবতই প্রথমে মনে এসেছে সঠিক শিক্ষা ও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার সুযোগের কথা। হয়ত ব্যাখ্যা দিয়ে বলা যায় সঠিক শিক্ষা বলতে কি বোঝায়, কেন আমাদের পরীক্ষাকেন্দ্রিক মুখস্থনির্ভর ব্যবস্থাকে সঠিক শিক্ষা বলা যাচ্ছে না। হয়ত বিস্তৃত করে কলাচর্চা ও জীবনশৈলীর নানা দিকের দৃষ্টান্ত দিয়ে সুস্থ সংস্কৃতি বলতে কী বোঝাতে চাই তা-ও আলোচনায় আনা যায়। কিশোর-তরুণদের প্রসঙ্গে খুব গুরুত্বপূর্ণ অথচ উপেক্ষিত একটি বিষয় তাদের মনের সবচেয়ে জোরালো আবেগের সাথে যুক্ত। সেটা হল তাদের নিজেকে ছাপিয়ে ওঠার আকাক্সক্ষা। কিশোর বয়স থেকে তারুণ্য পর্যন্ত মানুষের মনের মধ্যে এই বোধ খুব জোরালোভাবে কাজ করে। ঐকান্তিক আবেগ কিংবা বলা যায় প্রেরণাই তাদের মহত্ত্বের সাধনায় অনুপ্রাণিত করে। এ সময় যদি সঠিক পথনির্দেশ এবং যথার্থ কাজে তাকে যুক্ত করা না যায় তাহলে অতৃপ্ত প্রেরণার তীব্র আবেগ তাদের ভুল পথেও নিয়ে যেতে পারে। সংবেদনশীল কিশোর-তরুণ (কিশোরী ও তারুণীসহ বোঝাচ্ছি) মন যদি এই উচ্চ আদর্শের রসদ বা পুষ্টি পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজ থেকে না পায় তাহলে তার মনে যে শূন্যতা এবং হতাশা তৈরি হবে সেটার অভিঘাতও হবে তীব্র, যা তার ব্যক্তিত্বে ভাঙচুর ঘটাতে পারে, এতে তৈরি হতে পারে তার গভীর মানসিক সংকট।
একসময় সব স্কুলে প্রভাতী সমাবেশ হত। আমার অভিজ্ঞতায় দেখি তাতে জাতীয় সঙ্গীত ছাড়াও একটি দেশাত্মবোধক গান হত, শপথবাক্য পাঠ করা হত, তার আগে হাল্কা ব্যায়ামের শৃঙ্খলায় ছাত্রদের মনকে এতক্ষণের ছুটাছুটি, দুষ্টামি ও কলরব থেকে একটু ভাবগম্ভীর আয়োজনের জন্যে প্রস্তুত করা হত। কাজটা সহজেই হতে পারত প্রধানত প্রধান শিক্ষককের উপস্থিতির ফলে, কারণ তিনি নিজ ব্যক্তিত্বের গুণে ছাত্র-শিক্ষকদের সমীহ ও শ্রদ্ধা পেতেন। এর পরে বলতে হবে দক্ষ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ক্রীড়া শিক্ষকদের পরিচালনা, নিত্যদিনের সযতœ শিক্ষণের গুণে শ্রেণি শিক্ষকের ভূমিকা এবং শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় অন্যান্য শিক্ষকম-লীর সক্রিয় উপস্থিতির কথা। কখনো বিশেষ দিনে বা উপলক্ষে প্রধান শিক্ষক ছাত্রদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতেন, সাধারণত মহৎ কোনো মানুষ বা উপলক্ষ কিংবা স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের কারো কোনো বড় ও মহৎ অর্জন-অবদানের প্রসঙ্গ টেনে মানবিক গুণাবলি বা সাফল্য অর্জনে ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করতেন।
সেকালে এর বাইরে স্কুলে কাব, স্কাউট ও গার্লস গাইড ছিল যেখানে সদস্য হয়ে মানব ও দেশ সেবার মত মহৎ কাজের জন্যে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করার প্রণোদনা মিলত। এছাড়াও মুকুল ফৌজ, পরে খেলাঘর, কচিকাঁচার আসর প্রভৃতিতে যোগ দিয়েও দেশ ও মানুষের জন্যে কাজের সুযোগ তৈরি হত। এগুলো এবং আরো অসংখ্য পাড়ার ক্লাব, পাঠাগার ইত্যাদি কিশোর-তরুণদের জীবনে নিজেকে ছাপিয়ে ওঠার সুযোগ করে দিত। এসব সংগঠনে তারা যথার্থ নেতা পেয়েছে, যৌথভাবে আনন্দময় বিনোদনের সুযোগ পেয়েছে, সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে নিজেকে সবার মাঝে মেলে ধরবার এবং স্বীকৃতির সুযোগ পেত, বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ের মত জাতীয় দুর্যোগে ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজেরও সুযোগ এসে যেত। শিশু-কিশোরদের কচি মনের এসবই হল সাধ পূরণের যথার্থ খোরাক। তাদের মনের সুষ্ঠু বিকাশের জন্যে এসবই প্রয়োজন। ছাত্র রাজনীতিও একসময় তরুণদের দেশ ও মানবসেবার বড় সুযোগ করে দিয়েছিল।
আজকে যারা ধর্মীয় জঙ্গীবাদের দিকে ঝুঁকছে তারা অনেকেই স্কুলে হয়ত সঠিক প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষকম-লী পেয়েছিল, তাদের স্কুলে প্রভাতী সমাবেশও হয়ত গুরুত্বের সাথে হত, তারা অনেকেই হয়ত গানবাজনা, সংস্কৃতি চর্চাও করেছে, কিন্তু তারপরেও কেন তারা বিভ্রান্ত হল, বিপথে গেল? তার উত্তরে বলব তারা যা পায় নি তাহল নিজেকে ছাপিয়ে ওঠার অর্থাৎ মহৎ কোনো সাধনায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ। কিশোর ও তরুণদের জীবনে এই যে মস্ত বড় একটা শূন্যতা তৈরি হল এর দায় কি সমাজের বড়রা এড়াতে পারব? আজ স্বাধীনতার পরে পূর্বাপর সবটা বিচার করলে কি অস্বীকার করতে পারব দেশের শিশু-কিশোর-তরুণদের মনের মহত্ত্বের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা পূরণের পথ যে আমরাই রুদ্ধ করে দিয়েছি?
কথা হল সুস্থ সাংস্কৃতিক বাতাবরণে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে শিক্ষা হয় প্রাণবন্ত, নানান বিষয়বৈচিত্র্যে তার মন বহুতর ভাবনা, সৃজন ও উপভোগের জন্যে তৈরি হয়ে ওঠে। এমন পরিবেশ থেকে সাধারণত কেউ সংকীর্ণ চিন্তা ও অন্ধবিশ্বাসের গণ্ডিতে আটকে পড়ে না। সে জীবন ও জগতের মধ্যে বৈচিত্র, বহুমুখিতা, বিকাশমানতা, পরিবর্তনশীলতা নবায়নযোগ্যতা এবং আতশকাঁচের মত বহুবর্ণিল রূপ ও রসের সন্ধান পেয়ে যায়। সে বাঁচার আনন্দ এবং জীবনের তাৎপর্য খুঁজে পায়। এমন মানুষ গোঁড়া কিংবা চরমপন্থী হতে পারে না। আমরা কেন শিক্ষার চরিতার্থতা ভাবলাম একমাত্র পরীক্ষার ফলাফলে? বই, পোশাক, নগদ টাকা, খাবার - এসবের মধ্যেই শিশু-কিশোরের মানুষ হয়ে ওঠার সকল সংকটের সমাধান ভাবলাম? পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ালাম, হয়ত বৃত্তির অর্থমূল্যও বাড়াব, জিপিএ৫ এর সংখ্যা হয়ত বাড়তে থাকবে (এ বছর যদিও কমেছে), সব মানুষই হয়ত জেএসসি এসএসসি পাশ করবে একদিন - কিন্তু তাতে কি কিশোর-তরুণদের নিজেকে ছাড়িয়ে ওঠার আকাক্সক্ষা পূরণ হবে? এভাবে হয় না বলে তাদের মনে বিভ্রান্তির ঝড়ো মেঘ জমতে পারে। তাদের বিপথগামিতাও বন্ধ হয় না, জঙ্গিবাদে দীক্ষগ্রহণ এবং আত্মঘাতী পথে হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও দূর হয় না।
শিক্ষাকে যেমন কেবলমাত্র পরীক্ষার ফলের উচ্চাশা তথা চাহিদা পূরণের গ-িতে আবদ্ধ করেছি তেমনি সমাজেও পরিণত মানুষের জন্যে বৈষয়িক সাফল্যের চাপ পূরণই জীবনের একমাত্র ব্রত হয়ে উঠেছে। তার ফলাফলের একটা চরম দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজ সবার অলক্ষ্যে কখন যে চেতনা থেকে অন্ধ বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে তা কেউই বলতে পারব না। চেতনা বহুতর ভাবনা ও ধারণাকে গ্রহণ করতে  পারে, আর তাতেই একাত্তরে বামপন্থী-মধ্যপন্থী-ডানপন্থী সকলেই এক হতে পেরেছিল, যে বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে এই চেতনা প্রতিনিধিত্ব করে তা লালন-হাছনের মত সহজিয়া সাধক, রবীন্দ্রনাথের মত সৃষ্টিশীল বিশ্বাসী, নজরুলের মত বৈচিত্র্যময় অধ্যাত্ম সাধক, নিষ্ঠাবান মুসলিম মওলানা মাসুদকে এক কাতারে আনতে পারে। বাঙালির হাজার বছরের মনীষার ঐতিহ্য তো এই মানবতাবাদী চেতনাই যা মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শই অন্তর্গত। কিন্তু এটাকে ক্ষমতাসীন দল ও তার সমর্থকরা নিছক বিশ্বাস, অন্ধ-বিশ্বাসে পরিণত করছে। এক অন্ধবিশ্বাসের বিপরীতে আরেক অন্ধবিশ্বাসের উত্থান প্রায় অবশ্যম্ভাবী, যা কার্যত প্রতিদ্বন্দ্বী অন্ধবিশ্বাস।
বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির বাম ও মধ্য কোনো অংশই ধর্মপ্রাণ মুসলিম-প্রধান দেশের জনগণকে আলোকনের মাধ্যমে যুগোপযোগী মানসে ঋদ্ধ করে তোলার কাজটি করে নি। উভয় পক্ষই এক্ষেত্রে ভিন্নভাবে নিরুত্তর থেকেছে - বাম অংশ বিষয়টি এড়িয়ে কেবল বাঙালির মানবিক ঐতিহ্যের বয়ান দিয়ে গেছে আর মধ্যপন্থীরা (যার মূল প্রতিনিধি আওয়ামী লীগ) ধর্মবাদীদের সাথে আপসের পথেই চলছে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এক অন্ধবিশ্বাসে পরিণত করছে। সমাজে জ্ঞানচর্চার প্রকৃত পরিবেশ থাকছে না, এতে শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চার পথও সংকীর্ণ হয়ে আসছে।
চেতনার বিপরীতে যে অন্ধবিশ্বাস তার মৌলিক প্রবণতাই হল জবরদস্তি, তার ঝোঁক যুক্তি ও চিন্তার বিস্তারের পরিবর্তে বলপ্রয়োগের দিকে, তার অনিবার্য পরিণতি সংকীর্ণতা, অবক্ষয় এবং সংঘাত। অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যেমন তেমনি ইসলামের প্রকৃত চেতনার মধ্যেও ঔদার্য ও মানবিকতার স্থান নিশ্চয়ই অনেকখানি। কিন্তু জঙ্গিরা তাদের তৎপরতার মাধ্যমে ইসলামের এই সত্যরূপকেই অস্বীকার করছে।
তাই বলব ইরাক ও লিবিয়ায় পশ্চিমের অন্যায় হস্তক্ষেপে সেসব দেশে ভয়ঙ্কর মানবিক বিপর্যয়ের পরে এই মুসলিম-প্রধান দেশের - প্রতিক্রিয়াশীল অন্ধবিশ্বাসীদের প্রতিক্রিয়ার কথা না ভাবলেও - সংবেদনশীল কিশোর-তরুণদের প্রতিক্রিয়ার কথা তো ভাবা উচিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এরকম দূরদর্শী ভাবনা আমাদের নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের মনে সহজে আসে না যেভাবে আসে নি একাত্তরে। সেদিন রণাঙ্গনে অস্ত্রচালনা, হত্যা, রক্ত ও মৃত্যুযন্ত্রণার অভিজ্ঞতার পরে ঘরছাড়া এসব তরুণদের পুনরায় ঘরে ফেরানো এবং তাদের অতৃপ্ত স্বপ্নপূরণের জন্যে দেশ পুনর্গঠনের মত বৃহৎ মহৎ কাজে দলমত নির্বিশেষে তাদের লাগানোয় ব্যর্থতা এবং তার খেসারত কি আমরা উপলব্ধি করি? সেই ব্যর্থতার ফলে তারুণ্যের উৎশৃঙ্খলতা, বেপরোয় ভূমিকা, কখনো সন্ত্রাস ও অপরাধে জড়ানো, চরমপন্থায় ঝোঁকার প্রবণতার সূচনা হয়েছিল এদেশে।
তবে ইসলামি চরমপন্থা ও জঙ্গিবাদ সম্পর্কে আরো কথা বলতে হবে। এ নিয়ে বিস্তারিত পৃথক কলামে লেখা যাবে। এখানে কেবল এটুকু বলা যায় এই চরমপন্থার পিছনে তিনটি প্রধান কারণ আছে - ১. ইসলামি শাস্ত্রের বিভিন্ন পাঠে এর পক্ষে যেসব বক্তব্য আছে তার বর্তমান বিজ্ঞান-প্রযুক্তি উৎকর্ষের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সুষ্ঠু যুগোপযোগী ব্যাখ্যা সমেত পাঠ আলেমরা দিতে পারেন নি; ২. সৌদি আরবসহ উত্তর আফ্রিকা ও আরবভূখণ্ডের মুসলিম দেশগুলোর ইসলামের কট্টরপন্থী ভাষ্যকে আঁকড়ে রাখা, যা তারা মূলত জনগণের বিরুদ্ধে তাদের রাজতন্ত্রী/স্বৈরশাসনকে রক্ষা করার জন্যে কাজে লাগছে। এ কাজে তাদের রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা পুঁজিবাদী বিশ্বের (এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ইজরায়েলের সাথেও) পারস্পরিক স্বার্থরক্ষার সম্পর্ক; ৩. তেল-গ্যাস সমৃদ্ধ মুসলিম দেশে পুঁজিবাদী পশ্চিমের স্বার্থের স্বরূপ তাদের ইরাক-লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপে ফাঁস হওয়ায় সচেতন সংবেদনশীল তরুণদের মনে সৃষ্ট তীব্র অভিঘাত ও প্রতিক্রিয়া।
এসব বিষয় বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে। তবে আজকের আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায় শিক্ষাকে ঠিক পথে ঢেলে সাজানো জরুরি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সবকটা বন্ধ জানালা খুলে দিতে হবে, কিশোর-তরুণদের জন্যে নিজেকে ছাপিয়ে ওঠার আকাক্সক্ষা পূরণের আনন্দ ও তৃপ্তির সুযোগ তৈরি করতে হবে, এবং ইসলামের সহিষ্ণু উদার শিক্ষায় বিজ্ঞান-প্রযুক্তিরও যে স্থান রয়েছে (আধুনিক পশ্চিমা বিজ্ঞানের গোড়ায় মুসলিম বিজ্ঞান সাধকদের অবদান স্মরণীয়) তা আলোচনায় আনা প্রয়োজন।
যে কোনো চরমপন্থা মোকাবিলা করা সম্ভব, তবে তার জন্যে ধৈর্য, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা এবং ঔদার্য প্রয়োজন। অন্ধবিশ্বাস অন্য কোনো অন্ধবিশ্বাসের জগদ্দল ভাঙতে পারে না - এ কথাটা মানতে হবে।

***


Saturday, June 3, 2017

শুভাকাঙ্ক্ষীর বিস্ময়-ভরা প্রশ্ন

আবুল মোমেন

২০০৯ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের বিজয়ের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে জামায়াত ও ধর্মান্ধ শক্তিকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিতাড়ন করা সম্ভব হয়েছে। এর পরে সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করে একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে তাদের সাথে রাষ্ট্রের দূরত্ব আরো বেড়েছিল।
কিন্তু ১৯৭৯ থেকে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় পুনর্বাসিত জামায়াত ও ধর্মীয় কট্টরপন্থার রাজনৈতিক শক্তি এতদিনে অনেক বেড়েছে। এ সময় মধ্যপ্রাচ্যেও  অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটে এবং তারা এদেশে ধর্মভিত্তিক দল ও সামাজিক উদ্যোগের জন্যে আর্থিক সহায়তা দিতে শুরু করে। দেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তিগুলো এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। তারা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিজেদের অর্থনৈতিক শক্তি এবং সামাজিক প্রভাব বাড়িয়েছে।
যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ বিজ্ঞান ও আলোকনের শিক্ষাকে যথাযথভাবে ধারণ করে নি সেখানে ধর্ম প্রায়ই অন্ধবিশ্বাস ও সংস্কারে পরিণত হয়। শিক্ষার মাধ্যমেও সনাতন এই ধ্যানধারণা ও ভাবনার গ-িভাঙা যায় নি। বাংলাদেশ জ্ঞানচর্চায় একটা গণ্ডিবদ্ধ চক্করের মধ্যে আটকে পড়েছে। ফলে রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়ে এবং তা ব্যবহার করে ধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তিকে এ থেকে দূরে রাখা গেলেও তারা কিন্তু সমাজকে দখলে রাখতে সক্ষম হয়।
পরিহাসের বিষয় হল যে আওয়ামী লীগ জামায়াত ও সংশ্লিষ্টদের ক্ষমতা থেকে বাইরে রেখেছে, আইনের মাধ্যমে অপরাধের চরম শাস্তি দিচ্ছে সেই দলই সমাজের বৃহত্তর অংশের প্রতিনিধিত্বশীল দল হিসেবে সামাজিক অঙ্গনে এদের দ্বারাই প্রভাবিত হচ্ছে। আজ সামাজিক ক্ষেত্রে সে অর্থে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, এমনকি হেফাজতের মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই।
আমরা লক্ষ্য করছি বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের সাথে মুখোমুখি বিরোধের কৌশল পাল্টে দলের অনেককেই প্রতিপক্ষ ক্ষমতাসীন দলে যোগ দিতে উৎসাহিত করছে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বামপন্থীরা দলে দলে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিল। সে ধারা এই সেদিন পর্যন্ত বজায় ছিল। কিন্তু এখন হাওয়া উল্টো বইছে।
হেফাজতে ইসলামের দাবি মেনে ন্যায় বিচারের প্রতীক গ্রিক দেবি থেমিসের মূর্তি অপসারণ এবং তার আগে পাঠ্যবইয়ে কিছু লেখার রদবদল করেছে সরকার। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কি গুণগত পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে? বিষয়টা তলিয়ে দেখা দরকার।
আওয়ামী লীগ কেবল যে ভোটের রাজনীতি করে তা নয়, দেশের বৃহত্তর গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তারা সবসময় অবস্থান নিয়েছে কখনো জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের মত কঠিন ঝুঁকিপূর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে বড় সাফল্যের ভিৎ রচনাও করেছে।
শেখ হাসিনা সেই পথ থেকে সরে এসেছেন এমনটা ভাবার কারণ ঘটেছে বলে মনে করি না। তাঁর পথ এবং সময়টা আগের তুলনায় জটিল এবং কঠিন। বর্তমানে সারা বিশ্বে উদারনৈতিক চেতনার ভাঁটা চলছে এবং রক্ষণশীল রাজনীতি জোরদার হচ্ছে। তাতে ধর্ম ও জাতিগত উগ্রতা বড় ভূমিকায় থাকছে। দেশে জনসংখ্যা বেড়েছে আড়াই গুণ, সেভাবে কর্মসংস্থান হয়নি। বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির আগ্রাসন এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার চাপের মধ্যে দেশকে এগিয়ে নিতে হচ্ছে। এসব বিষয়ও বিবেচনায় রাখতে হবে।
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শের আপস বা চিন্তাচেতনার পশ্চাদাপসরণ যেমন সত্য তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয় নাগরিকসমাজের সামগ্রিক অবক্ষয়। বস্তুত এই অবক্ষয়ের কারণেই আওয়ামী লীগসহ সকল রাজনৈতিক শক্তিরও অবক্ষয় ঠেকানো যায় নি।
কথা হল জনগণের মধ্যে যদি প্রগতিচেতনায় ভাঁটা পড়ে, যদি সমাজের অগ্রসর অংশ কেবলই হোঁচট খেতে থাকে, কিংবা অকেজো হয়ে পড়তে থাকে তাহলে জনগণের দল আওয়ামী লীগ কোথা থেকে শক্তি পাবে? তাগিদ বোধ করবে প্রগতির পতাকা সমুন্নত রাখার?
এ কথাও ভুললে চলবে না ২০১২ সনের ৫ মে হেফাজতের সমাবেশ গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তিকে ভালোরকম চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। কিন্তু তাকে প্রতিহত করার কাজ গণজাগরণ মঞ্চ বা প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি করতে পারে নি, তা করেছিল রাষ্ট্রশক্তি। রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম চালানোর যে অবকাশ থাকে তা কিন্তু রাষ্ট্রের থাকে না। তা হয়ে যাবে রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন। আমরা জানি, হেফাজতকে রাষ্ট্র পুলিশি অ্যাকশনে এবং মামলা, গ্রেফতারসহ দমনমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমেই বাগে এনেছিল। কিন্তু এই প্রক্রিয়াতে সরকার যেন স্বস্তি বোধ করে নি। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল আওয়ামী লীগ প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাটিকে বেগবান করার বিষয়ে যতœবান হচ্ছে না। বরং ক্ষমতা সংহত ও দৃঢ় করার জন্যে ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সাথে আপসের পথেই পা বাড়িয়েছে। অনেকের ধারণা আগামী জাতীয় নির্বাচনকে  মাথায় রেখে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এপথেই চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক্ষেত্রেও বলা দরকার, সাধারণ ধারণা হল হেফাজত বা অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দল আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি আস্থায় নেবে না এবং খুব সম্ভবত ভোটও দেবে না। এদিকে এদের সাথে নানাবিধ আপসের কারণে হতাশ হয়ে পড়ছে প্রগতিচেতনার সাধারণ মানুষ ও তরুণ সমাজ।
সাধারণ মানুষ ও তরুণদের মধ্যে ধর্মান্ধতার চেয়েও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মানবিক বোধ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অনেক বেশি কাজ করে। এদের মধ্যে পরিণতচিন্তার অনেকেই হয়ত নানা দিক বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটকেই ভেটে দেবে। কিন্তু তরুণ সমাজের ক্ষেত্রে বাস্তবতা তেমন না-ও হতে পারে। এতে আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে দুভাবে - তাৎক্ষণিক ভোটের হিসেবে এবং তরুণদের সমর্থন ও আগ্রহ হারিয়ে দীর্ঘমেয়াদে। আমাদের মনে হয় যে ধরনের মোর্চাই আওয়ামী লীগ করুক না কেন তাকে কেবলমাত্র নির্বাচনী জোটে বা ভোটের মধ্যে এবং সরকার পরিচালনায় সীমাবদ্ধ না রেখে রাজনৈতিক কার্যক্রম পর্যন্ত প্রসারিত করা দরকার।
এদেশের প্রগতির যাত্রা কোনোকালে একক  কোনো দলের নেতৃত্বে হয় নি, তা সবসময় হয়েছে বহু দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে বাস্তবতা এরকমই। ছয়দফার আন্দোলন ব্যতীত বাকি সকল আন্দোলন-সংগ্রামের সূচনা করেছে বামপ্রগতিশীল  ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো। আজ এসব সংগঠন ক্ষুদ্র, দুর্বল ও বহুধাবিভক্ত।
এ বাস্তবতায় এসব দল ছাড়াও নানাবিধ নাগরিক শ্রেণী তৎপর হয়েছে, সরব রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সরকারের নৈকট্য ঘটছে হেফাজতের সাথে আর এদের সাথে তৈরি হয়েছে দূরত্ব, দিনে দিনে তা বাড়ছে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ন্যায়বিচারের প্রতীক মূর্তি অপসারণ বা পাঠ্যবইয়ে রদবদল নিয়ে সৃষ্ট এ দূরত্ব সহজে ঘুচবে বলে মনে হয় না। বরং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কয়লাভিত্তিক অন্যান্য বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে এ দূরত্ব আরো বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি।
বামপ্রগতিশীল কিছু দলকে সরকারে রেখে মোটামুটি নিষ্ক্রিয় রাখা হয়েছে, আবার অন্যদের প্রবল বিরোধিতা ও সমালোচনার মাধ্যমে দূরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সরকার কি নানাভাবে মদদ জুগিয়ে হেফাজত ও সমমনাদের শক্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে না? ওরা অনেক বিষয়ে সরকারকে ডিক্টেট করছে এবং সফল হচ্ছে। অর্থাৎ সরকারে না থেকেও এরা সরকারের অংশ আর জাসদ ইনু ও ওয়ার্কাস পাটি সরকারের অংশীদার হয়েও যেন সরকারের বাইরে। এটা কি কাকতলীয় ঘটনা?
এই কাকতালের মূল্য কে দেবে? শেখ হাসিনা? আওয়ামী লীগ? নাকি জনগণ?
ভবিষ্যতের জন্যে অনেকগুলো প্রশ্ন জমা হচ্ছে। এর অর্থ মানুষ যথেষ্ট বিভ্রান্ত, হতাশ এবং সংস্কারাছন্ন! যখন চারিদিকে উন্নয়নের ডামাডোল চলছে তখন যদি জনগণের বিভ্রান্তি, হতাশা ও সংশয় বাড়ে তবে সুস্থ গণতান্ত্রিক মানবিক ধারার রাজনীতি বেগবান হতে পারবে না।
রাজনৈতিক স্থবিরতার মধ্যে সুবিধাবাদ, প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং দুর্নীতিই তলে তলে গতিশীল ও শক্তিশালী হয়। বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে, সমাজে এমন মানুষের ভীড় বাড়ছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার ক্ষমতায় থাকতে এবং উন্নয়নের জোয়ার বজায় রাখতে গিয়ে কি শেষ পর্যন্ত চেতনার পরাজয় মেনে নেবে?
বঙ্গবন্ধু-কন্যা ২০০৯-এ ক্ষমতায় আসার আগে এবং পরে অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন। ২০০৪ সনে গ্রেনেড হামলা থেকে প্রাণে বেঁচেছেন, তাঁকে হত্যার জন্যে এখনো নিশ্চয় মুফতি হান্নানের মত অনেকেই সক্রিয় আছে। আর ক্ষমতায় আসার পরপর বিডিআর বিদ্রোহ, তারপরে বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন, পদ্মাসেতু নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের  ষড়যন্ত্র - সবকিছুই তিনি ভালোভাবে উৎরে গেছেন। হেফাজতে এসে তিনি  হোঁচট খাবেন? যারা কিনা নারীকে তেঁতুলের সাথে তুলনা করে ভোগের সামগ্রী বৈ আর কিছু মনে করে না এমন পচা শামুকে পা কাটবেন?
এটা হয়ত প্রশ্ন, হয়ত বিস্ময়সূচক অভিব্যক্তি। তবে তা আমার একার নয়, অনেকের যারা তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী।


***

Wednesday, May 17, 2017

কোন্ চেতনায় দেশের প্রকৃত উন্নয়ন ঘটবে?

আবুল মোমেন

জেনারেল এরশাদ কি বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারবেন? তাঁর বয়সের কথা - সম্ভবত এখন ৮৫-৮৬ চলছে - একেবারে বাদ দেওয়া যাবে না। তাছাড়া দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মামলাগুলো থেকে তাঁর নিস্কৃতির ব্যবস্থা হলেও এরশাদ কি স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ফিরে পাবেন? বাংলাদেশের ইতিহাসে দুই সামরিক শাসকের মধ্যে এরশাদের জন্যেই এ কাজটা কঠিন বেশি। এর বাইরে থাকল সাম্প্রতিক রাজনীতিতে তাঁর সুবিধাবাদ ও অস্থিরমতিত্বের নানা কা-। জনমনে এরও প্রভাব রয়েছে এবং তাঁকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে কোনো মহলই নিতে চাইবে না, যেমন চায় নি ও নেয় নি খোদ আওয়ামী লীগও। তাঁকে তারা ব্যবহার করেছে, করছে।
আদতে ক্ষমতাসীন দলের মতির ওপরই এরশাদের ভাগ্য নির্ভর করে। ফলে তাঁর জোট গঠন এবং সরকারের কাছ থেকে দূরে সরে স্বাধীন অবস্থান গ্রহণের প্রক্রিয়াকে মানুষ - অন্তত অনেকেই  - পাতানো খেলা হিসেবেই নেবে। এরশাদ নিজেও ক্ষমতাসীন অবস্থায় আ স ম  আবদুর রবকে দিয়ে বহুদলীয় জোট গঠন করিয়ে তাঁর নির্ভরযোগ্য বিরোধী দল বানাতে চেয়েছিলেন। লোকে এ জোটকে গৃহপালিত বিরোধী দল বলত এবং এই প্রক্রিয়ার সাথেই আ স ম রবের রাজনৈতিক জীবনের কার্যকারিতারও ইতি ঘটে।
এরশাদের রাজনৈতিক জীবন টিকে আছে বস্তুত ক্ষমতার প্রসাদেই। উত্তরবঙ্গে তাঁর যে নিজস্ব ভোটবলয় ছিল তা অস্তায়মান। তাঁর ও তাঁদের পরিবারের প্রতি সেখানকার মানুষের মায়া থাকলেও তাতে এমন জোয়ার থাকবে না যে তাঁরা ছাড়াও দলের অন্য প্রার্থীরাও বিজয়ী হবেন।
এরশাদ ও তাঁর জোট বস্তুত ফুটো বেলুন, তালি দিয়ে তা খুব বেশি দূর ওড়ানো যাবে না। এরশাদ যেমন আবদুর রবকে খাড়া করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে বাদ দিয়ে ভোটের গণতন্ত্র চালু রাখতে চেয়েছিলেন সম্ভবত আওয়ামী লীগ এবার তাঁকে সামনে এনে একই পন্থায় বিএনপিকে মাইনাস অথবা সাইজ করতে চাইছে। এটা ক্ষমতাসীনদের একটি পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ নিশ্চয় - কদ্দুর কাজে লাগে তা দেখতে চাইছেন তাঁরা। এর মধ্যে আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্যে মুখিয়ে থাকা বিএনপিকে বিরক্ত করা হবে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের লাভালাভ নিয়ে চরম সংশয়ে তথা সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যেও রাখা হবে। এতে নির্বাচনে অংশ নিলেও বিএনপির পক্ষে সর্বশক্তি ও সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হবে না। প্রধান প্রতিপক্ষকে অপ্রস্তুত বা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে রেখে নির্বাচনে আনতে পারলে তা আওয়ামী লীগের মন:পুত হবে।
এরশাদ বিএনপির বিকল্প শক্তি হিসেবে জনগণের আস্থা পাবেন না। অর্থাৎ চলমান এই প্রক্রিয়ার সুফল সরাসরি আসার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু পরোক্ষ ফল যে আওয়ামী লীগ পাবে না তা নয়। বিএনপির মূল অনুপ্রেরণা - বেগম জিয়া ও তারেক জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যত ও ভূমিকাকে চাপে রাখার অস্ত্র হাতে রেখেছে ক্ষমতাসীন দল। তাঁদের মামলার গতিপ্রকৃতি থেকে মানুষ এটা বুঝতে পারে। এর চরম পদক্ষেপ হতে পারে তাঁরা দুজনই মামলায় শাস্তি পেয়ে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষিত হতে পারেন। বর্তমান বাস্তবতায় দলে এর ফল হতে পারে সেনাপতির অনুপস্থিতিতে হতোদ্যম সৈন্য বাহিনির মত।
এইখানে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এরকম অবস্থায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কখনো মাঠ ছাড়ে নি, বরং আন্দোলনকে প্রায় নৈরাজ্যের পথে নিয়ে দাবি আদায়ে সক্ষমতা দেখিয়েছে। কিন্তু যে দল ক্ষমতার প্রসাদ পাওয়ার জন্যে ভীড় করে আসা নানা মত-পথের মানুষের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে তার পক্ষে জিয়ার উত্তরসুরী ব্যতীত অন্য কারো নেতৃত্বে দলে ঐক্য রক্ষা ও সে দলকে নিয়ে জানবাজী রেখে লড়াই চালানো সম্ভব নয়। এটা গত দশ বছরে ভালোভাবে প্রমাণিত হয়েছে যদিও নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও মাঠের লড়াইয়ে মূল ভূমিকা পালন করেছিল আওয়ামী লীগই। বিএনপি তাতে শরিক থেকে লাভবান হয়েছিল।
বিএনপর এই অন্তর্নিহিত দুর্বলতা আওয়ামী লীগ ভালোভাবেই জানে। আর মামলা-মোকদ্দমা ও পুলিশি অ্যাকশানে তাদের কাবু করে রেখে এর প্রমাণও তারা পেয়েছে।
বর্তমান বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ আরো কিছু বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে। আঞ্চলিক রাজনীতি, বিশেষত ভারতের সমর্থন এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতায় দুই প্রধান দলের মধ্যে আওয়ামী লীগই সবার অপেক্ষাকৃত পছন্দের দল। এমনকি হেফাজতের প্রতি সরকারের সাম্প্রতিক পক্ষপাতমূলক ভূমিকা এই সমর্থনকে আরো জোরদার করবে। এর বিরুদ্ধে দেশে যে প্রগতিচেতনার রাজনীতি ও সমাজভাবনা আছে তাকে বিএনপি প্রতিনিধিত্ব করে না, এবং করবেও না। এ অবস্থায় তারা চাইবে ধর্মীয় কার্ডটি আরো ভালোভাবে খেলে ও খেলিয়ে ভোটারদের পক্ষে টানতে। অর্থাৎ আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে ইসলামি রাজনীতি ও ইসলামি দলগুলোর পোয়াবারো হবে। এরশাদের জোটের ৫৮ দলের মধ্যে পঞ্চাশের অধিক হল নামসর্বস্ব ইসলামি দল, বিএনপি জোটেও তারাই সংখ্যায় বেশি। আওয়ামী লীগও এধারার বাইরে থাকল না, তারা খোদ হেফাজতের সাথে মৈত্রী করে নিয়েছে।
রাজনীতির এই সাম্প্রতিক গতিধারায় আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষমতায় থাকা সহজ হবে মনে হলেও এর মূল্য গুণতে হবে অনেক। আওয়ামী লীগই এতকাল এদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, তাই তার সাথেই চলেছে এদেশের প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি-সংস্কৃতিধারা। কিন্তু ক্রমে প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর জন্য আওয়ামী লীগের দরজা খুলে যাওয়ায়  সে ধারায় বিশ্বাসী লোকজন লীগে ঢুকে পড়ছে। আবার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা, এবং আগামীতেও ক্ষমতায় থাকার সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলে ক্ষমতার প্রসাদলোভী সুবিধাবাদী রাজনীতিকরাও এ দলে ভীড় করছে। দলের ক্ষমতায় টিকে থাকার এজেণ্ডাটির অগ্রাধিকার বরাবর এদের জন্যে প্রশ্রয় হিসেবে থাকবে এবং দিনে দিনে দলের অভ্যন্তরে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল চেতনার অংশ কোণঠাসা ও দুর্বল হতে থাকবে। এতে আওয়ামী লীগের রাজনীতির যে রূপান্তর ঘটছে তা বাংলাদেশকে তার গৌরবময় সহনশীল মানবিক সমাজের ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারে। বস্তুত এই বিচ্যুতি শুরু হয়ে গেছে। তার জোরালো আলামত সমাজে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় উগ্রতা ও তা পালনের বাহ্য আড়ম্বর সমাজজীবনে সংখ্যালঘুদের অবস্থানকে অনিশ্চিত, অনিরাপদ করছে ও তাদের দৈনন্দিন জীবনে অস্বস্তি সৃষ্টি করছে। সংখ্যালঘুদের অব্যাহত দেশত্যাগে এটা বোঝা যায়। এ অবস্থায় সমাজে মুক্তচিন্তাই যে কেবল চাপে পড়ছে তা নয় প্রকৃত জ্ঞানচর্চার পরিবেশও বিনষ্ট হচ্ছে। সমাজে অন্ধবিশ্বাস, সংস্কার ও মূঢ়তা এবং ক্ষমতা, অর্থ ও পেশিশক্তির দাপট বাড়ছে। এসবের আলামতও অস্পষ্ট নয়।
এখন প্রশ্ন হল, স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতক পরে দেশের এই পরিণতিই কি কাম্য ছিল, কাম্য হতে পারে? মুশকিল হল, এসব নিয়ে আওয়ামী লীগের ভাবনা কি তা জানারও উপায় নেই, কারণ সেখানে একক সিদ্ধান্তেই সব চলছে। শেখ হাসিনা আপাতত বুদ্ধিজীবী, শিল্পীসাহিত্যিক, নাগরিকসমাজকে দূরে ঠেলে রেখেছেন। হতে পারে আমলাদের হাতে ক্ষমতা বেশি, ধর্মীয় নেতাদের পিছনে সমর্থক বেশি, কিন্তু সমাজকে এগিয়ে নিতে ক্ষমতাবান ও অন্ধ সমর্থকের চেয়ে বেশি প্রয়োজন চিন্তাশীল সৃজনশীল মানুষের ভূমিকা। তাদের মধ্যেও সুবিধাবাদী তোষামুদে প্রকৃতির লোক থাকতে পারে, আছেও, কিন্তু ছদ্মাবরণ ভেদ করে খাঁটি মানুষদের খুঁজে নেওয়া ও তাদের পরামর্শ নেওয়াই তো নেতৃত্বের বড় কাজ। অতীতের দিকে তাকালে বাংলাদেশের গড়ে ওঠার কালে গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীদের এ ধরনের সংযোগ এবং তার ফলাফল জাতি দেখেছে, তাতে উপকৃত হয়েছে।
বাংলাদেশের জন্যে বর্তমান সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্ন হল - দেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগুবে নাকি মুসলিম জাতীয়তার কট্টরপন্থার সাথে আপসের রাজনীতির খেসারত দেবে? অর্থনৈতিক ও বৈষয়িক উন্নতির মধ্যেও একটি দেশ ও তার জনগণ চেতনায় পিছিয়ে যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের ধনী উন্নত দেশগুলো মানবসভ্যতায় কোনো অবদান রাখতে পারছে না। বাংলাদেশ আজ সেই রকম এক অন্ত:সারহীন উন্নয়ন বা শুভঙ্করের ফাঁকির সামনে পড়ছে। এই ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে এখন থেকেই দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ ও সচেতন নাগরিকদের ভাবা উচিত।
***

Sunday, May 14, 2017

শিক্ষায় সংস্কৃতির পাঠ জরুরি

আবুল মোমেন

আমাদের দেশে শিশুমাত্রই উপেক্ষিত, সুস্থ শৈশব থেকে তারা বঞ্চিত। হতদরিদ্র-দরিদ্র পরিবারের শিশুর বঞ্চনার বাস্তবতা আমরা জানি, কিন্তু ধনীর সন্তানও কি আদর্শ শৈশব কাটাতে পারে? তাদের হয়ত ভোগ-আস্বাদনের সুযোগ সীমাহীন, কিন্তু শিশুর আনন্দের প্রধান উৎস তো অংশগ্রহণমূলক কাজে (বা খেলায়)। সেখানে অধিকাংশের জীবনই কাটে বন্দিদশায়, একাকীত্বে। সচরাচর শিশু খেলনার অপেক্ষায় থাকে না, কিন্তু খেলনা পেতে নিশ্চয় তার ভালো লাগে। অনেক বাবা-মা শিশুর এই দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে তার সাথে খেলার বদলে তাকে খেলনার প্রলোভন দেখিয়ে তার কাছ থেকে শৃঙ্খলা আদায় করেন (চুপ করে বসে থাকা, দ্রুত খাওয়া ইত্যাদি)। বড়রা শিশুর 'দুর্বলতা'কে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে নিজের কার্যসিদ্ধি করলেও পরিণামে শিশুর মধ্যে কাক্সিক্ষত জিনিস আদায়ের দরকষাকষির মনোবৃত্তি উশকে তোলেন। তাতে  সম্পর্কের সারল্য ও স্বতস্ফূর্ততা চোট খায়, এর মধ্যে উভয় পক্ষে চালাকির প্রবণতা ঢুকতে থাকে।
শিশুর মনোজগৎ সরল বলেই সৎ, সততার সারল্যেই ফোটে তার সৌন্দর্য। তুলনায় বড়দের জগৎ অনেক জটিল এবং বিস্তর কৌশল, বহুতর দায়, বিচিত্র সব ভাবনা এবং নানান বিবেচনার প্রভাবে সেটা নিছক সাদা-কালোয় তৈরি নয়। সে জন্যে শিশুর সাথে চলা ও খেলার সময় বড়দের একটু সতর্ক অর্থাৎ বাড়তি বিবেচনা মাথায় রাখতে হবে। বাঙালি সমাজ তা করে না। বাঙালি সমাজমানসের কিছু মজ্জাগত বৈশিষ্ট্য আছে যা শিশুর সুষ্ঠু বিকাশের জন্যে নেতিবাচক - যেমন, সমাজটা কপটতায় অভ্যস্ত, নৈতিক মূল্যবোধের বিষয়ে উদাসীন (মুখে খুব বলে, কিন্তু আচরণে সম্পূর্ণ উদাসীন), এ সমাজ পক্ষপাতদুষ্ট, সহজাত ঔদার্য ও সহিষ্ণুতার শক্তি হারিয়ে ফেলছে। শিশুর প্রতি চরম নিষ্ঠুরতার অনেক দৃষ্টান্ত আমরা সম্প্রতি দেখেছি।
আমরা দৈনন্দিন জীবনে ভুলে যাই যে শিশু এমন এক অসীম সম্ভাবনাময় পাত্র যার আধেয়সমূহ কেবল সরল নয়, কাঁচা, সুপ্ত, উন্মুখ অর্থাৎ গ্রহণ ও বিকাশের জন্যে হন্যে হয়ে আছে। এ সময় তার নিজের বিচারক্ষমতা দুর্বল, দূরদর্শিতাও তার কাছে কাম্য হতে পারে না। কিন্তু হস্তক্ষেপমুক্ত থেকে শিশু যদি কেবল সঠিক জিনিস পায়, ন্যায্য কথাটাই শুনতে পায় তাহলে বিচারবোধ, দূরদর্শিতাসহ তার সব দক্ষতা ও মূল্যবোধই বিকশিত হবে।
সেটাই পথ, সেই পথে চলার আয়োজনটাই জরুরি। হয়ত এখান থেকে আমরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে শিশুর জন্যে সমতাভিত্তিক সুষ্ঠুবিকাশের মানবিক স্বর্গীয় বাস্তবতা তৈরি করা সম্ভব ( যা বাস্তবে ঘটেছিল) তার কথা টানতে পারি। কিন্তু সে আলোচনা শিশুর বিকাশের প্রসঙ্গ ছাড়িয়ে রাজনৈতিক দিকেই মোড় নেবে। আজকে আমরা সেদিকে যাব না।
আমাদের ধারণা বর্তমান বাস্তবতাতেও শিশুর বিকাশে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া সম্ভব। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের চ্যালেঞ্জটাও আমাদের জন্যে কম বড় ছিল না। সীমাবদ্ধ জমি ও পুঁজির স্বল্পতার বিপরীতে ক্রমবর্ধমান মানুষের যে চ্যালেঞ্জ তা আমরা ভালোভাবে উৎরেছি, কেবল যে চালে উদ্বৃত্ত হয়েছি তা নয়, সব্জি, মাছ, ফলেও প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছি। এ বিপ্লব ঘটেছে নিজেদের অর্থায়নে, পরিশ্রমে, দক্ষতায় ও প্রযুক্তির ব্যবহারে। কৃষিবিপ্লবের মতই শিক্ষাবিপ্লব দরকার।
খাদ্যের চাহিদা যেহেতু জৈবিক তাই প্রাণিমাত্রই তা বোঝে। জ্ঞান খাদ্যের মত বস্তু নয়, বিমূর্ত বিষয়, এর পরিমাপের ব্যবস্থাটি কৃত্রিম, জ্ঞানের নিজস্ব প্রকৃতি হল এর অব্যাহত বিকাশ। তাই জ্ঞান হল চর্চার বিষয়, এর উদ্ভাবন নবায়ন, নিত্য পরিমার্জন অপরিহার্য। এর নিছক চর্চার আনন্দই হল মৌলিক, তা যদি পরীক্ষার ফলের অর্থাৎ পরিমাপের কৃত্রিম ব্যবস্থার ফাঁদে আটকে পড়ে তবে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায়।
আর তার খেসারত দিতে হচ্ছে সমাজকে  - এটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ হয়ে উঠছে না। জ্ঞানের বিচারে এ সমাজ অনেকাংশে তামাদি - অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষ বেশির ভাগ বিষয়ে পুরোনো ধ্যানধারণা, বিশ্বাস আঁকড়ে আছেন। সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিলেও এটিই বাস্তবতা। জ্ঞান হল অসীম এবং জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হবে নানা আলোচনা ও তর্কবিতর্কের মাধ্যমে প্রাণবন্ত, মুক্ত, বিকাশমান। কিন্তু আমাদের সমাজমানসে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার এখনো দৃঢ়মূল শুধু নয়, যেটুকু জ্ঞানচর্চা হয় তা পদ্ধতির কারণে কার্যত বিশ্বাসে, কখনো অন্ধবিশ্বাসে রূপান্তরিত হয়। এভাবে বলা যায় সমাজটা অনুসন্ধিৎসায়, যুক্তিতে তথা জ্ঞানের অজানা নতুন পথে দু:সাহসী অভিযানের জন্যে একেবারেই প্রস্তুত নয়। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ও তাতে ছাত্র-শিক্ষকের সংখ্যা বাড়লেও সমাজ বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার অনুকূল নয়। আর নয় বলেই এখানে যে কোনো স্তর থেকে যে কোনো  শিক্ষার্থী যে কোনো অন্ধবিশ্বাসে দীক্ষিত হতে পারে। ধর্মীয় চরমপন্থা যা সম্প্রতি জঙ্গিবাদে প্রকাশ পাচ্ছে তার প্রচারণাকে প্রতিরোধের মত পাল্টা যুক্তি-ভাবনা বর্তমান বিদ্যায় কুলাবে না।
জ্ঞানের দিক থেকে এটি স্থবির, এবং যেহেতু স্থবিরতা প্রাণজ বস্তুকে পচন ও ক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেয়, তাই এ সমাজের অবস্থাও সেরকমই হচ্ছে। দালানকোঠা নির্মাণকেই গুরুত্ব দিচ্ছি, আরাম ও ভোগ, বিলাস ও বিনোদন গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রাণের বিকাশ, জ্ঞানের আনন্দ মোটেও পাত্তা পাচ্ছে না। এটা সংস্কৃতির সংকট, যা শিশুকাল থেকেই শিক্ষার মাধ্যমে পাওয়ার কথা।
শিক্ষার একটা সংস্কৃতি আছে যেমন সব বিষয়ের থাকে। শিক্ষার সংস্কৃতির নিহিত চাহিদা হল মুক্ত পরিবেশ, অংশগ্রহণের অবাধ সুযোগ, প্রকাশের স্বাধীনতা।
তাই স্কুল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র ভাবলে তার অনুকূল সাংস্কৃতিক পরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্যে শিক্ষার দুটি দিক নিয়ে ভাবা জরুরি -
১.       প্রশ্নের উত্তর-নির্ভর পরীক্ষাকেন্দ্রিক বিদ্যাচর্চার স্থলে জ্ঞানচর্চার জন্যে ভাষা (বাংলা ও ইংরেজি) ও গণিতে দক্ষতা ও পাঠ্যসূচি অনুযায়ী নানা বিষয়ে জ্ঞানার্জন হবে শিক্ষার মূল লক্ষ্য।
২.       সেই লক্ষ্য অর্জনে সাফল্যের জন্যে চাই জ্ঞানচর্চার সাথে সাথে আত্মপরিচয়ের শিকড়ের সাথে শিশুমনের সংযোগ ঘটা। সে লক্ষ্যে চাই -
  ক.   দেশ ও জনগোষ্ঠীর ইতিহাস-জ্ঞান, বিশ্বসভ্যতার ইতিহাস, মানুষের অর্জন ও অবদান সম্পর্কে ধারণা;
   খ.     নিজের দেশজ সংস্কৃতির সাথে সম্যক পরিচয় এবং বিশ্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা;
  গ.   সৃজনশীলতার চর্চা এবং নিজের ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলাচর্চা ও এসবের রসাস্বাদনের দক্ষতা অর্জন;
   ঘ.    চর্চার মাধ্যমে যুক্তি, বিচার, বিবেচনা, বিশ্লেষণের সক্ষমতা অর্জন;
   ঙ.    মানবিক গুণাবলি এবং নাগরিকের অধিকার, দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা।
সবিনয়ে বলব, দ্বিতীয় ধারার কাজকে সহশিক্ষামূলক কাজ বলে দূরে ঠেলে রাখলে চলবে না। এসব শিক্ষার প্রান্তিক বিষয় নয়, শিক্ষার অনুষঙ্গী নয়, প্রাসঙ্গিক বিষয় এবং জরুরি ও অন্তর্গত বিষয়। এ পর্যায়ে শিশুরা দল বেঁধে নানা কাজে অংশগ্রহণ করবে, যেমন  - খেলা, নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিজ্ঞান প্রকল্প, দেয়াল পত্রিকা, প্রকৃতিপাঠ, বিতর্ক ইত্যাদি। এসব চর্চা হলে শিক্ষার সংস্কৃতি ধীরে ধীরে অর্জিত হবে। লক্ষ্য ঠিক থাকলে কাজ বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়। কৃষক যদি দ্বিগুণ ও ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য জোগান দিয়ে যেতে পারে তাহলে শিক্ষিত তরুণরা মিলে কেন পারবে না শিক্ষায় গুণগত রূপান্তর ঘটাতে?
আমরা জানি ঠিক যেমন জমির স্বল্পতার বিপরীতে জনসংখ্যার আধিক্য ছিল বড় সংকট তেমনি ছাত্রের তুলনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মানসম্পন্ন শিক্ষকের রয়েছে সংকট। আমরা বুঝি রাতারাতি পরিবর্তন আনা সম্ভব নয় । তবে শিক্ষাকে কৃষির সাথে সবটা মেলানো না গেলেও এক ফসলা জমিকে যেমন তিনফসলা করা গেছে তেমনি এক স্কুলকে তিন শিফ্টে চালানো যায় - দুটি শিফ্টে নিয়মিত লেখাপড়া হবে আর বিকেল-সন্ধ্যার শিফ্টে সংস্কৃতির পাঠ চলবে। সংস্কৃতি শব্দটা এখানে আমরা এর ব্যাপকার্থে প্রয়োগ করছি যা মানুষের মন-মানসিকতা, রুচি, নীতিবোধ উন্নত করে জীবনকে আলোকিত করবে।
এ পাঠ হয়ত শিক্ষকরা দিতে পারবেন না। এর জন্যে প্রয়োজন হবে শিক্ষাকর্মীর। আমরা যেন ভুলে না যাই, ষাটের দশকে ছাত্রকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিক কর্মীরাই ছিলেন পরিবর্তনের মূল শক্তি। আজ যদি উন্নত দেশ গঠনে শিক্ষিত জাতির প্রয়োজনে শিক্ষায় বিপ্লব ঘটাতে হয় তবে চাই উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক দক্ষ শিক্ষাকর্মীর দল। তারা হবেন পরিবর্তনের কারিগর ও রূপকার। আর এই সংস্কৃতিপাঠের জন্যে আমাদের থাকবে কর্মপরিকল্পনা, পাঠক্রম ও পুস্তিকাসহ উপকরণ।
এভাবে চর্চার উপকার এই যে শিশুর মন ও মনন অনেক রকম বিষয় এবং শিল্পকলার সাথে পরিচিত হবে ও তা উপভোগের জন্যে তৈরি হতে থাকবে। বড় হতে হতে তাদের মানসে অনেক অবলম্বন তৈরি হবে ভিতর-বাইরের কু-প্রবৃত্তির তাড়না ও প্রলোভন প্রতিরোধের জন্যে। মৌলবাদ, নেশার হাতছানি প্রতিরোধে কিংবা যৌবনের উন্মেষকালে মানবজীবনের বৃহত্তর পরিসরে নিজেকে খাপখাইয়ে নেওয়ার কাজটিও তাদের জন্যে অনেক সহজ হবে। শিক্ষার সাথে সংস্কৃতির পাঠ যুক্ত হলে এভাবে মানুষ তার জৈব তাড়না ও মনের অন্ধ সংস্কারের জাল ছিন্ন করার মত আলোর অস্ত্র হাতে পায়।
তাই ভবিষ্যতের কথা ভেবেই শিক্ষায় সাংস্কৃতিক পাঠের বিষয় অন্তর্ভুক্তির কথা জরুরিভিত্তিতে ভাবতে হবে।
সরকার শিক্ষা নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছেন। বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর চিন্তাভাবনাও চলছে।  আমরা আশা করব বর্তমান বাজেটে অন্তত ইউনিসেফ-নির্ধারিত জিডিপির ২০% এবং বার্ষিক বাজেটের ৬% ভাগ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হবে। এর বাইরে আশা করি সরকারি অর্থায়নে এবং আন্তর্জাতিক অর্থসংস্থার সহায়তায় শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে আরো প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।


***

Wednesday, April 26, 2017

অস্বীকৃতি বা আপসে সমস্যার সমাধান মিলবে কি?

আবুল মোমেন

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন সভায় দাঁড়িয়ে কওমি মাদ্রাসার জঙ্গি-সম্পৃক্ততার অভিযোগ খারিজ করে সাফাই বক্তব্য দেন তখন সরকারি মনোভাবের বার্তা পাওয়া যায়। তাঁর ভাষণের দুদিন আগেই যাঁকে সবচেয়ে দূর্ধষ জঙ্গি নেতা হিসেবে ফাঁসি দেওয়া হল তিনি দেশে আলিয়া মাদ্রাসায় পড়লেও উচ্চ শিক্ষা নিয়েছেন কওমি মাদ্রাসার পীঠস্থান দেওবন্দে। পরবর্তীকালে জঙ্গি হামলায় ও জঙ্গি আস্তানায় নিহত কয়েকজনেরও কওমি মাদ্রাসার ছাত্র/সাবেক ছাত্র পরিচয় উঠে এসেছিল। এদের গ্রেফতার, নিহত হওয়া, বিচার সব কাজেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুক্ত ছিল।
কেউ বলে না যে কওমি মাদ্রাসামাত্রই জঙ্গি তৈরির আস্তানা। কিন্তু সুস্থ সংস্কৃতিচর্চাবিহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইংরেজিমাধ্যম স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ের মতই মাদ্রাসাগুলো ধর্মীয় জঙ্গিবাদ চর্চার ক্ষেত্র হয়ে পড়ার শংকাই বেশি। ইদানীং মূলধারার বাংলামাধ্যম স্কুলেও পরীক্ষা ও মুখস্থবিদ্যাকেন্দ্রিক শিক্ষার দাপটে সহশিক্ষামূলক সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখান থেকেও বিভ্রান্ত তরুণ তৈরি হতে পারে যাদের কেউ কেউ জঙ্গিবাদে দীক্ষা নিচ্ছে না তা-ও নয়।
সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শূন্য-সহিষ্ণুতা বা জিরো টলারেন্স নীতি পালনের অঙ্গীকার করেছে। কিছু জঙ্গি বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তি পেয়েছে, বেশ কিছু জঙ্গি আইনশৃঙ্খলা বাহিনির অভিযানে প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতার আলোকে বলা যায় তাতে জঙ্গি হয়ে ওঠার প্রবণতা বন্ধ হয় নি। গত দুমাসে দেশের আনাচে-কানাচে অনেক জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়া গেছে, সকল জঙ্গি নির্মূল হয় নি, ধরা পড়ে নি। বোঝা যায় দেশের ভিতরে সক্রিয় রয়েছে এক বা একাধিক জঙ্গি গোষ্ঠী। এক দল তরুণ বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী, বিশেষত আইএসের সাথে যুক্ত হতে চাইছে।
সরকার জঙ্গি দমনে কড়া লাইনে থাকলেও দেশে জঙ্গি সৃষ্টির বাস্তবতা মোকাবেলায় দুএকটি ভালো উদ্যোগ নিলেও তা ছিল সীমিত এবং সাময়িক। লক্ষাধিক মওলানার জঙ্গি-বিরোধী ফতোয়া বা শুক্রবারে সব মসজিদে ধর্মের উদার মানবিক সম্প্রীতির বাণী তুলে ধরে খুৎবা পাঠের উদ্যোগ ভালোই ছিল। কিন্তু তা যথাযথভাবে ব্যবহৃত হয়নি, অব্যাহত থাকে নি। তাছাড়া এও এক ধরনের নিবারণমূলক কাজ - পরোক্ষ বুদ্ধিবৃত্তিক এ বারতার গুরুত্ব স্বীকার করেও বলতে হবে যে-তরুণরা জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হচ্ছে এটুকু তাদের আত্মঘাতী ধ্বংসাত্মক পথ থেকে নিবৃত্ত করার জন্যে যথেষ্ট নয়।
আমাদের ভাবতে হবে কীভাবে এবং কখন কেউ চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ে। এমন নয় যে আমাদের দেশে চরমপন্থীদের জঙ্গি তৎপরতা আগেও ঘটে নি। কট্টর বাম রাজনৈতিক দর্শন থেকে সৃষ্ট এসব জঙ্গিবাদ কখনো উপদলীয় কোন্দলে এবং বেশির ভাগ সময় সরকারি বাহিনির নিষ্ঠুর দমনপীড়নে এক পর্যায়ে নি:শেষিত হয়েছে। কিন্তু ধর্মীয় জঙ্গিবাদ তা নয়, এর ভিত্তি যে বিশ্বাস তাতে আল্লাহ ও নবীকে টানা যায়, পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অনুমোদন দেখানো যায়, ইসলামের ইতিহাস থেকে দৃষ্টান্ত নেওয়া যায়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পুঁজিবাদী (খ্রিস্টান) পশ্চিমের ভূমিকার (মূলত মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে) দোহাই দেওয়া যায়, বর্তমান কালের ভোগবাদিতার যে উৎকট রূপ মানুষের জীবনকে অমানবিক করে তুলছে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর যাথার্থ্যও তুলে ধরা যায়, তদুপরি এ ভূমিকা ইহকাল ছাপিয়ে পরকাল অবধি বিস্তৃত - পৃথিবী ছাড়িয়ে বেহেস্ত পর্যন্ত। ফলে কেবল তাদের কৃতকর্ম - মানুষ খুন করা - বা অপরাধের গণ্ডিতে  ও মানদণ্ডে এদের বিচার করলেই হবে না। এভাবে ঘটনা ঘটানোর পরে অর্থাৎ অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পরে কাউকে কাউকে ধরা যাবে বা নির্মূল করা হবে। কিন্তু এতে এসব তরুণদের - তাদের মত আরো লাখো তরুণের - মনের ক্ষোভ, ক্রোধ, প্রতিজ্ঞা, প্রত্যয়, অভীপ্সা অর্থাৎ দেশের বিরাট তরুণমানসের একটি বড় ধারাকে বোঝার এবং তাদের সন্তুষ্ট করার জরুরি কাজটা আরব্ধ থেকে যাবে। পুলিশি ব্যবস্থা, আইনি প্রক্রিয়া বা নিছক অস্বীকৃতি এ ইস্যুটি মোকাবিলার মূল পথ নয়।
আমরা দেখছি সমাজের অনেকের কাছেই এটি ধর্মীয় ইস্যু, অনেকেই ভাবছেন সাংস্কৃতিক ইস্যু, কেউ কেউ গণ্য করছেন রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে। ইস্যুটি জটিল, কারণ এটি উপরে উল্লিখিত সব বিষয়েরই সমাহার। ধর্ম যদি হয় এর উৎস, তবে রাজনীতি প্রায়োগিক অবলম্বন, আর সংস্কৃতি সঠিকভাবে চর্চা না হলে এই মানসের আদলেই রূপান্তরিত হবে। বাঙালি সমাজে কোনো ধর্মই শাস্ত্রীয় রক্ষণশীলতার ধারায় বিকশিত হয় নি, যে কারণে দুশত বছরের বেশি চর্চা সত্ত্বেও ওয়াহাবি পন্থা, কওমি মাদ্রাসার প্রভাব সমাজে ব্যাপক বিস্তৃতি পায় নি। হিন্দু সমাজেও ব্রাহ্মণ্যবাদের চেয়ে  গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধারার প্রেম ও ভক্তিবাদের প্রভাব হয়েছে  বেশি।
এ বাস্তবতায় ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র বাংলার মানুষকে টানে নি, ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান ভেঙে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটেছিল। গত চার দশকে দেশে এবং বিদেশে অনেক পরিবর্তন হয়েছে - তা হয়েছে ধর্মীয় চেতনায়, রাজনৈতিক মতাদর্শ ও কৌশলে এবং শিল্প ও সংস্কৃতিচর্চা ও এর সমঝদারিতে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকেই পশ্চিমা পুঁজিবাদী বিশ্বের জড়বাদী বা বস্তুবাদী সমাজে মতাদর্শের অবসান হয়। তারা সব ধরনের মতাদর্শিক বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যেন বস্তুবাদ-ভোগবাদের বিশ্বায়ন ঘটিয়েছে। এর প্রথম প্রকাশ ঘটে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পরপর কট্টরপন্থী সুন্নিদের দিয়ে একদিকে শিয়া ইসলামের বিপ্লবযাত্রা রুদ্ধ করা এবং সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করার প্রয়াসে - ইরানে তাদের প্রয়াস ব্যর্থ হলেও আফগানিস্তানে সফল হয়েছে। সামরিক-রাজনৈতিক তথা জঙ্গি কূটনীতির মাধ্যমে তারা আফগানিস্তান থেকে  পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত মুসলিমপ্রধান দেশগুলিতে কট্টরপন্থীদের উত্থানে অস্ত্র-অর্থ দিয়ে সহায়তা করে এমন এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যাতে এসব দেশের তরুণরা বিভ্রান্তির মধ্যে থাকে। বিভ্রান্তির ক্ষোভ কট্টর জঙ্গিবাদে মুক্তি খোঁজে, আর তখন তাদের থেকে সৃষ্ট জঙ্গি যোদ্ধাদের তাদেরই প্রথম স্রষ্টা ও মদতদাতা পশ্চিম প্রকাশ্যে হত্যা করতে পারে।
পশ্চিমের দ্বিতীয় আগ্রাসনের পথ হল অর্থনীতি। বিশ্ব অর্থনীতির কর্তৃত্ব ধরে রাখার জন্যে তারা যে কোনো ছলের আশ্রয় নিতে পারে। বাজার অর্থনীতি, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নতুন কানুন, বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফের চাতুরিপূর্ণ ভূমিকা - যা কিছুটা পদ্মাসেতুর সূত্রে সম্প্রতি ফাঁস হয়েছে - এবং ভোগবাদিতা, পণ্যাসক্তি ও কাম-ক্রোধ-সন্ত্রাস-নির্ভর এক বিনোদন-বাণিজ্যের পসরা সাজিয়ে এ যেন গ্রিক পুরানের কুহকিনী সার্সির বিস্তৃত জাল। সবই এর মধ্যে ধরা পড়েছে। আগেই উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশের সাধারণের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষোভ, ক্ষুধা, কামনা, ক্রোধ, লোভের তাড়নার পারদ চড়ানো হয়েছে। এদের অনেকেই জঙ্গিবাদের আশ্রয় নিচ্ছে, কেউ নেশার ফাঁদে পা দিচ্ছে, কারো কাছে নিজ ধর্ম পালনের চেয়ে বিধর্মী’ নিধন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, কেউ স্থূল ভোগে তলিয়ে যাচ্ছে । এটা স্বাভাবিক মানুষের কাজ নয়।
হ্যাঁ, আমাদের সমস্যাগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে হবে, চিন্তা বিনিময় করতে হবে এবং সবশেষে সবদিক বিবেচনায় নিয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।
প্রথমেই আমাদের মানতে হবে সমাজমানসে, বিশেষত তরুণদের মানসে নানা বিষয়ে ক্ষোভ, কিছু ক্রোধ ও হতাশা এবং অনেক বিষয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। এর পেছনে মূল দায়ি হল বর্তমান  শিক্ষাব্যবস্থা আর আদর্শ ও নীতিহীন রাজনীতি।
কিশোর-তরুণদের মূল ভূমিকা শিক্ষার্থীর। সেই শিশু-কিশোর-তরুণের জীবনের মূল প্রবণতা হল সক্রিয়তা - মস্তিষ্কে ও শরীরে - যা ঘটে অংশগ্রহণ ও অংশীদারিত্বের মাধ্যমে উদ্ভাবনে, সৃজনে, উপভোগের আনন্দে। আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় তাদের জন্যে বরাদ্দ হলে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা, তারা কেবল অন্যের লেখা (সৃজন করা) উত্তর মুখস্থ করবে, অন্যের প্রশ্নের জবাব হিসেবে তা লিখবে এবং জিপিএ৫ পাবে। এটা মোটেও সৃজনশীল আনন্দময় প্রক্রিয়া নয়। শিশু-কিশোরদের সাফল্য উদযাপনে বড়রা যে উৎসব ও আনন্দের আবহ তৈরি করেছেন তাতে শিশু-কিশোর-তরুণরাও অংশ নেয়। কিন্তু এ হল সাফল্যের নেশা, কারণ প্রকৃত সাফল্য আসে নিজের কল্পনা, পরিশ্রম, কর্ম সম্পাদনের অভিজ্ঞতা থেকে। তার সুযোগ এ ব্যবস্থায় নেই। শিক্ষা কেবল টেক্সটবইয়ে আবদ্ধ থাকলেও চলবে না, একজন ছাত্রকে তার নানামুখী প্রবণতা ও সম্ভাবনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, সেগুলো চর্চা করার সামর্থ্য সম্পর্কে তাকে আত্মবিশ্বাসী করা এবং তারপর এই সাফল্যের মূল্যায়ন ও উদযাপন তাকে আনন্দের মাধ্যমে এক টেকসই ইতিবাচক ও বহুমুখী মানসের সন্ধান দেবে। ব্যক্তিমানসের সংকোচনে ব্যবহার করলে ধর্মের প্রতিও অবিচার করা হয়। ব্যক্তিমানসকে উন্মোচন, সৃজনশীল, আনন্দময় ও ইতিবাচক করে তোলা ধর্মেরও কাজ। ধর্মের নামে অনেকেই মানুষের এই সার্বিক বিকাশের পথ রোধ করে দাঁড়াতে চান। অবদমন মানুষের জন্যে মনস্তাত্ত্বিক সংকট তৈরি করে থাকে। তাতে সমাজে অতৃপ্ত বাসনা ও নানা রূপ অবদমনজাত বিকারের প্রকাশ দেখা যায়। আজ রাজনীতি ধর্মকে ব্যবহার করছে আবার কেবলমাত্র জাগতিক তথা সংকীর্ণ স্বার্থেই রাজনীতির ব্যবহার ঘটছে। তাতে সমাজমানসে সত্য ও অসত্যের ধারণা, ভালো ও মন্দ মানুষের ফারাক, পাপ ও পুণ্যের চেতনা অস্পষ্ট হয়ে পড়ছে। সমাজ দিব্যি অপরাধের সাথে আপস করছে, অপরাধীকে নিয়ে বসবাস করছে। এমন বিভ্রান্ত মানুষের সমাজে রাজনীতি যেমন তেমনি ধর্মও  নানা ক্ষুদ্র স্বার্থে ব্যবহৃত হতে থাকে।
সংস্কৃতি শব্দটা নিয়ে আমাদের মনে ব্যাপক বিভ্রান্তি আছে। সংস্কৃতি আমাদের জীবনযাপন প্রণালীর সাথেই সম্পৃক্ত - পোশাক-খাবার-ভাষা-আচরণ-অনুষ্ঠান সবকিছু নিয়েই সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এসবই ঠিকভাবে শিখতে হয়। সবসময় বলে বলে হয় না, নিজে করে গড়ে আয়ত্ব করলে তা-ই হয় টেকসই। বাসায় জীবনযাপনের মাঝে ব্যক্তিসত্তা আর স্কুলে অনেকের সাথে মিলে সামাজিক সত্তা তৈরি হবে সংস্কৃতিবোধে ও রুচিতে সম্পন্ন হয়ে। বাসায় জীবনযাপনের সৌন্দর্য তৈরি হবে, স্কুলে জীবন উদযাপনের দক্ষতা আয়ত্ব হবে। এ বিষয়টা আরেকটু বিস্তারে লিখতে হবে স্বতন্ত্র একটি লেখায়।


***

Thursday, April 20, 2017

অনেক ধোঁয়াশা থেকে গেল


আবুল মোমেন

হেফাজতে ইসলামের মূল ঘাঁটি চট্টগ্রাম। তাদের বিরোধী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতেরও শক্ত অবস্থান চট্টগ্রামে। চার বছর আগের প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে হেফাজত এখন সরকারের, অন্তত সরকার প্রধান ও তাঁর কোনো কোনো ঘনিষ্ঠ নেতাদের আস্থায় রয়েছে। কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে সাধারণ ধারার সর্বোচ্চ অর্থাৎ - স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সমমানের বলে স্বীকৃতি দিতে সম্মত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তড়িঘড়ি করে এ বিষয়ে সরকারি প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রির এই স্বীকৃতি দিতে সম্মত হয়েছিল। সে সময় তারা অবশ্য প্রয়োজনীয় দাপ্তরিক ও আইনগত কাজ সম্পন্ন করতে পারে নি। তবে বোঝা যাচ্ছে দেশের প্রধান দুই দলই এ বিষয়ে একমত।
আমরা জানি বাংলাদেশে শিক্ষায় সর্বোচ্চ স্নাতকোত্তর এবং এর ওপরের (যেমন পিএইচডি) ডিগ্রি দেওয়ার বৈধ প্রতিষ্ঠান হল বিশ্ববিদ্যালয় অন্তত এতকাল তাই ছিল। পুরোনো পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে চলে, তাদের স্বায়ত্বশাসনের অধিকার থাকলেও কিছু নিযন্ত্রণ আছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু কওমি মাদ্রাসাকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির ব্যবস্থা ছাড়া। পত্রিকা মারফৎ জানা গেছে বিভিন্ন ধারার কওমি মাদ্রাসাগুলো মিলে তড়িঘড়ি করে একটি বোর্ড গঠন করেছে যেটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রির পরীক্ষা গ্রহণ করবে ও সনদপত্র দেবে।
সরকারের সাথে সমঝোতার ফলে উচ্চতর ডিগ্রি প্রদানের জন্যে গঠিত এই বোর্ডের ক্ষমতায়ন করবে সরকার। কিন্তু যথাযথ অ্যাকাডেমিক ও মানবসম্পদের ব্যবস্থাপনা ছাড়া এর মর্যাদা ও কার্যকারিতা কি প্রশ্নসাপেক্ষ থাকবে না? বোর্ডকে পরীক্ষা দেওয়ার মত ক্ষমতাও না হয় সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে দিতে পারবে, কিন্তু উচ্চতর ডিগ্রির সাথে জ্ঞানচর্চার যে উচ্চতা, তার জন্যে যে আয়োজন ও সক্ষম ব্যক্তিবর্গের প্রয়োজন তা কখন কীভাবে পূরণ হবে এসব বিষয় ধোঁয়াশায় থেকে গেল। কওমি ধারার মাদ্রাসাগুলো যেহেতু সরকারের কোনো রূপ তদারকি বা হস্তক্ষেপ ছাড়া নিজস্ব নিয়মে ও আওতায় চলছে তাই এ সংক্রান্ত তথ্যগুলো সাধারণভাবে মানুষের জানা নেই। তাদের শিক্ষার মান, শিক্ষকবৃন্দের যোগ্যতা ইত্যাদিও কোনো পাব্লিক বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের তদারকিতে নেই।
কিন্তু নতুন ব্যবস্থায় তারা যতই সরকারে প্রতিনিধিত্ব, তদারকি মুক্ত থাকতে চান না কেন ডিগ্রিটি যেহেতু প্রকাশ্যে দেওয়া হবে, এই ডিগ্রিপ্রাপ্তরা সমমানের ডিগ্রিপ্রাপ্তদের সাথে চাকুরির দৌড়ে থাকবেন তাই এসব আর আড়াল বা নিরঙ্কুশভাবে তাঁদের আওতায় থাকবে না। সনদপ্রাপ্ত ছাত্ররা চাকুরিপ্রার্থী হলে তাঁদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান এবং সেই সূত্রে ব্যবস্থাপনার তথ্যাদি জনগণের যাচাইয়ের মুখোমুখি হবে। তাঁদের নিজস্ব বোর্ডের স্বীকৃত  এই ডিগ্রি সরকার মানবেন, কিন্তু এর বাইরে - দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক মহল? সে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের সব স্তরের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সরকার জাতিসঙ্ঘের সহ¯্রাব্দ লক্ষ্য পূরণে সফল হয়েছে কিন্তু টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য বা এসডিজি অর্জনের ক্ষেত্রে বেশ সমস্যায় রয়েছে। কারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে মান অর্জনই মূল লক্ষ্য তথা মূল চ্যালেঞ্জ। আমাদের প্রাথমিক থেকে এম. এ. পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই মানের সংকট চলছে। দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই আন্তর্জাতিক রেটিঙে পাঁচশর মধ্যেও নেই। আমাদের গবেষণায় বিশ্বমানের অর্জন বিশেষ নেই। ইসলামি ধারাতেও নেই। এখন দরকার শিক্ষাকে গোড়া থেকে গুছিয়ে নেওয়া, সব ধারার শিক্ষার বুনিয়াদ শক্তিশালী করা, প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রন্থাগার, লাইব্রেরিসহ সবরকম সুযোগসুবিধা বাড়ানো ও এগুলোর ব্যবহার নিশ্চিত করা, শিক্ষকদের উপযুক্ত শিক্ষা ডিগ্রি প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা। এসব বিষয় উপেক্ষা করা হলে আখেরে লাভ বিশেষ হবে না।
শিক্ষার মূল কাজ জ্ঞানার্জন, ডিগ্রি ও সনদপত্র অর্জন নয়। এ ডিগ্রি ও সনদ হল জ্ঞানার্জনের ফলাফল। কিন্তু আমাদের সমাজে প্রকৃত জ্ঞানার্জন ও জ্ঞানচর্চা ভীষণভাবে উপেক্ষিত আজ। ব্রিটিশ আমলে মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত এক কমিটির একজন সদস্য দু:খ করে বলেছিলেন, আমাদের মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষার আধেয় ও ব্যবস্থা বাদশাহ আলমগীরের আমলে পড়ে আছে। তাঁর কথা সেদিন শোনা হয় নি। তবে বিভিন্ন সময়ে আলিয়া ও সাধারণ মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার হয়েছে। এ ধারার অধিকাংশ মাদ্রাসায় গ্রন্থাগার ও বিজ্ঞান গবেষণাগার, কম্প্যুটার ল্যাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যদিও সব ধারার প্রতিষ্ঠানের মতই এখানেও এসবের ব্যবহার সীমিত এবং ডিগ্রিসনদ ও মুখস্থবিদ্যার বাইরে সত্যিকারের জ্ঞানচর্চা হচ্ছে না। ফলে সেদিক থেকে হয়ত বলা সম্ভব অন্য দশটা ধারার মতই ওরাও চলবে।
তাতেও অবশ্য সমস্যা মেটে না। কারণ ইতোমধ্যে সংবাদপত্রে যেসব তথ্য বেরিয়েছে তাতে দেখা যায় জঙ্গিদের একটি বড় অংশ কওমি মাদ্রাসা থেকে এসেছে। এরকম অভিযোগ বাড়তে থাকলে সরকার কতদিন চুপ করে থাকতে পারবে? যে কোনো সরকারের বড় দায় হল  দেশে আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখা, শান্তি বজায় রাখা। বর্তমান সরকারের একটি ঘোষিত নীতি হল জঙ্গিবাদের ব্যাপারে  শূন্য সহিষ্ণুতা বা জিরো টলারেন্স। এ অবস্থান দেখিয়েই পশ্চিমা পুঁজিবাদী বিশ্বের সমর্থন আদায় করছে সরকার। ফলে এ ক্ষেত্রে সবটাই যে সরকারের হাতে আছে তা-ও নয়।
কিন্তু মোদ্দা যে কথাটা ধোঁয়াশা হিসেবে থেকে গেল তা হল তাড়াহুড়ার মধ্যে গঠিত বোর্ডই কি স্নাতকোত্তর ডিগ্রিটা দিচ্ছে?
এতকাল ডিগ্রি ও  স্নাতকোত্তর ডিগ্রি কোনো স্বীকৃতি বিশ্ববিদ্যায় থেকেই নেওয়া যেত, বোর্ড  স্নাতকের নিচের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাব্লিক পরীক্ষার সনদ দিতে পারত। এই যে কওমি মাদ্রাসার উদ্যোগে গঠিত বোর্ড ডিগ্রি ও সনদ দেবে তার স্বীকৃতি তারা দেবে, কিন্তু অন্যরা কেন দেবে সেটা পরিস্কার নয়। আদতে এম. এ. ডিগ্রির স্বীকৃতি ও মর্যাদা আদায় করতে হলে কওমি মাদ্রাসাকে কিছু চাহিদা পূরণ করতে হবে। শিক্ষকদের স্বীকৃত এম. এ. ডিগ্রির প্রশ্ন উঠবে, শিক্ষকদের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গবেষণা ও গবেষণালব্ধ ডিগ্রির প্রশ্ন উঠবে, প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত পাঠাগার, গবেষণাগার থাকা দরকার, নিয়মিত সেমিনার-সিম্পোজিয়াম হওয়া প্রয়োজন। জ্ঞানের আদান-প্রদানের ব্যবস্থা থাকা চাই। এসব তো একলা চলো রে কিংবা আলাদা চলার নীতিতে অটল থাকলে করা সম্ভব হবে না। ডিগ্রি যেহেতু প্রকাশ্যেই দিতে হবে, এর প্রক্রিয়াটিও প্রকাশ্যই হতে হবে এবং এ নিয়ে নানা মহলের মূল্যায়ন, আলোচনা, সমালোচনাও শুনতে হবে। গঠনমূলক আলোচনা সমালোচনাকে স্বাগতও জানাতে হবে। তবে সবকিছুর আগে দশ লক্ষ ছাত্রকে যে স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে তার মর্যাদা ও বৈধতার প্রশ্নটি ভালোভাবে সমাধান করতে হবে। প্রশ্নবিদ্ধ ডিগি, কিংবা নিজস্ব একটি সনদপত্রের মূল্য সমাজে বা আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিষ্ঠিত হবে না।
ধোঁয়াশামুক্ত হয়ে পুরো বিষয়টি বোঝার জন্যে ভবিষ্যতের দিকেই তাকাতে হবে আমাদের।


***

Saturday, April 15, 2017

আপসের পথে কি সমাধান মিলবে?

আবুল মোমেন

স্বাধীনতার কিছু আগে থেকে, বিশেষত ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পরের দুবছরে, আওয়ামী লীগের যে রূপান্তর ঘটেছিল তার গুরুত্ব স্বাধীনতার পরেও বিবেচিত হলে ভালো হত। অর্থাৎ তখন সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার লক্ষ্যাদর্শে সিপিবি ও ন্যাপসহ আরো প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী দলের সাথে আওয়ামী লীগের যে রাজনৈতিক-আদর্শিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা স্বাধীনতার পরেও ধরে রাখা উচিত ছিল। এসময়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগকে ঘিরে বাঙালি জাতীয়তাবাদী বামপ্রগতিশীল চেতনার যে প্লাটফর্ম গড়ে উঠেছিল তা আরো পোক্ত হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরে আওয়ামী লীগ এককভাবে ক্ষমতাসীন দলে পরিণত হল। তৎকালীন সোভিয়েত-বলয়ের শক্তিশালী দল হিসেবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিতে গিয়ে সিপিবি ও ন্যাপ (মোজাফ্ফর) বি টিমে পরিণত হল। এ পরিণতি পরবর্তীকালে এদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির জন্যে ক্ষতির কারণ হয়েছিল। কেবল দেশের নয় খোদ আওয়ামী লীগের রাজনীতিও যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা এখনকার বাস্তবতায় ভালোই বোঝা যাচ্ছে।
তরুণদের তো চাহিদা থাকেই আদর্শের রাজনীতির। তারুণ্য সবসময়ই নিজের ক্ষুদ্র গণ্ডিকে ছাপিয়ে গিয়ে বৃহৎ ও মহৎ কিছু অর্জনে শরিক হতে চায়।  এদিক থেকে দেশ ও মানুষের কল্যাণে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম তাকে টানে। আর তাই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এদেশের তরুণরা দলমত-নির্বিশেষে অকুতোভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বীরের সর্বশ্রেষ্ঠ ভূমিকা হল আত্মত্যাগের মাধ্যমে বিজয় অর্জন। তারই স্বীকৃতি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে এমন বিজয়ী শহীদদের আমরা বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দিয়েছি।
মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়ই ছাত্রলীগের মধ্যে আদর্শিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। স্বাধীনতার পরে এই অর্জনকে আরো বড় ও মহৎ অর্জনে রূপান্তরের স্বপ্ন থেকে ছাত্রলীগ থেকে অসংখ্য মেধাবী তরুণ বেরিয়ে এসে জাসদ ছাত্রলীগে যোগ দিয়েছিল। স্বাধীনতার পরপর এটিই ছিল আদর্শের টানে তরুণদের নিজেকে ছাপিয়ে ওঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নের বড় প্লাটফর্ম। আমরা জানি, নেতৃত্বের ভুল ও দুর্বলতায় তরুণদের এ অভিযান সফল হয় নি, অসংখ্য তরুণ এর বলি হয়েছে। স্বাধীনতার পরে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন আর কখনো তরুণদের কাছে আদর্শিক রাজনীতির প্লাটফর্মের মর্যাদা বা আকর্ষণ ফিরে পায় নি। গত শতকের আশির দশকে, বিশেষত ইরানের ইসলামি বিপ্লবের (১৯৭৯) পরে, বাংলাদেশেও এরকম বিপ্লবের স্বপ্ন দ্যাখানো সম্ভব হয়েছিল। এতে তরুণদের একাংশ আকৃষ্ট হয়েছিল। তবে বাংলাদেশের আবহমানকালের সমাজসংস্কৃতি ঠিক গোঁড়া ধর্মান্ধ রাজনীতির জন্যে প্রস্তুত ছিল না।
সমাজসংস্কৃতির এই অসাম্প্রদায়িক মানবিক বুননে একটা রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন জিয়াউর রহমান। তিনি অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি ধারার ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের রাজনীতি চালু করলেন। এ সময় বোঝা গেল বাঙালিসমাজ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বামপ্রগতিশীল ধারার রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক চিন্তাচেতনাকে এগিয়ে নিলেও ইসলাম নিয়ে তার ধ্যানধারণা বিশ্বাসের গ-ি ছাপিয়ে মননশীল আলোচনার উপযুক্ত ছিল না - মুসলিম সমাজের সংস্কৃতির স্বরূপ কি, কোনটি মুসলমানের করণীয়, করণী নয় ইত্যাদি নিয়ে তার মনে নানা বিভ্রান্তি-সংশয় এবং চিন্তার জড়তা ও ভীরুতা কাজ করে। এই বাস্তবতায় নির্বাচনী রাজনীতিতে এ ধরনের ভোটারদের মন পেতে রাজনৈতিক দলের জন্যে ইসলাম ধর্ম একটি বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়াল। স্বভাবতই আওয়ামী লীগ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশে মুসলিম সংখ্যগরিষ্ঠ মানুষের দল হিসেবেই ভূমিকা পালন করতে চাইল। সম্ভবত  সেটা পেরেও গেল।
খানিকটা বিভ্রান্তিকর মনে হলেও এ কথা এখনো সত্য এদেশে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতি ও আধুনিক শিক্ষা-সংস্কৃতির যে চর্চা রয়েছে তা সম্ভব হচ্ছে দেশে আওয়ামী লীগ দলটি এখনো বড় দল হিসেবে সক্রিয় রয়েছে বলেই। কিন্তু গভীর আশংকার সাথে যে প্রশ্নটি ওঠে তা হল আওয়ামী লীগ যে আপসের রাজনীতির পথে চলেছে তাতে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মধ্যে যে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের উপাদান রয়েছে তার ভারসাম্য রক্ষা করা কি সম্ভব? আগুন নিয়ে খেলার পরিণতিই ডেকে আনবে কিনা সে শংকা থেকেই যায়। হেফাজত ও কওমি মাদ্রাসার প্রতি যে ধরনের ঔদার্য দেখানো হচ্ছে তার সুদূরপ্রসারী পরিণতি কী হবে তা দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির সংকট থেকেই বোঝা যাবে।
ধর্ম নিয়ে আলোচনার ভিত্তি হল  বিশ্বাস - সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আচার অনুষ্ঠান ও অন্যান্য সামাজিক সাংস্কৃতিক রেওয়াজ-চর্চা নিয়ে আলোচনা, বিতর্কের পথও বন্ধ করে রাখা হয়েছে যদিও মুসলিমসমাজের মধ্যেই এসব বিষয়ে অনেক বিভেদ ও বিবাদ বর্তমান। বিপরীতে চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অহরহ সমালোচিত ও বিতর্কিত হচ্ছে। আশির দশক থেকে কখনো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কখনো সামাজিক ঔদার্যে-প্রশ্রয়ে বাঙালিসমাজকে একটি নিরেট মুসলিমসমাজে রূপান্তরিত করার সাংস্কৃতিক অভিযান চলেছে। একটি দৃষ্টান্ত দেব। এমন অভিযানের ফলেই বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রিকসা-বাস-ট্রাক বা গণপরিবহন পেইন্টিঙের ঐতিহ্যবাহী ধারাটির অবসান হয়েছে। একে ধর্মবাদীদের এক নীরব বিপ্লব বলা যেতে পারে। বাঙালি রমণী, এমনকি গ্রামীণ নারীও যে ক্রমে শাড়ি ছেড়ে সালোয়ার-কামিজে অভ্যস্ত হচ্ছে তার পেছনে কাজকর্মের সুবিধার যুক্তির সাথে ধর্মীয়প্রচারণাও কাজ করছে।
পঞ্চাশ ও ষাটের এবং সত্তরের দশকের সাথে আজকের সমাজচিত্রের তুলনা করলে এই পরিবর্তনগুলো বোঝা যাবে।
আবার এই বাস্তবতাটাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে পঞ্চাশ, ষাট এবং সত্তরের দশকেও আমাদের নাগরিকজীবন কেটেছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের বামপ্রগতিশীল প্রতিবাদী রাজনীতির বাতাবরণে। প্রতিবাদী রাজনীতিতে আদর্শ ও ইতিহাসের দায় এবং নৈতিকতা ও ত্যাগের ভূমিকা থাকে। কিন্তু একথা ঠিক আজ পৃথিবী জুড়ে ধর্মীয় ও জাতিগত চেতনার দাপট বাড়ছে। প্রতিবেশী ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ক্রমেই সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে। তার প্রতিক্রিয়া এদেশে দেখা দেবে তা-ই স্বাভাবিক। আবার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ মিলে যে শক্তিশালী পশ্চিমা বিশ্ব সেখানেও উগ্র জাতীয়তাবাদের সাথে - কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইসলামের বিরুদ্ধে - ধর্মীয় জোশের উপাদান জোরদার হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আধিপত্যবাদী পদক্ষেপের ফলে তাদের ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী একটা রূপ দাঁড়িয়েছে। যতই সৌদি আরব, কুয়েত, আমিরাত, জর্ডান, তুরস্কের সরকার এদের পক্ষাবলম্বন করুক না কেন আজ যে মুসলিম তরুণরা জঙ্গিবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে তার কারণ পশ্চিমের এই ভূরাজনৈতিক ভূমিকা এবং উপরোল্লিখিত মুসলিম দেশের পশ্চিমা তোষণ নীতি। এই বাস্তবতার আলোকে তাদের মধ্যে মুসলিমসমাজের পক্ষে ও ইসলামের মর্যাদার প্রশ্নে ন্যায়যুদ্ধের তাগিদ তৈরি হচ্ছে।
সরকার একদিকে পুলিশি (অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন) ব্যবস্থার মাধ্যমে জঙ্গিদের দমন করতে আর অন্যদিকে ইসলামি মতাদর্শের সংগঠন গোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে ইসলামের জঙ্গিবাদ বিরোধী রূপটি তুলে ধরে জঙ্গিলাইনে তরুণদের মগজধোলাই বন্ধ করতে চাইছেন। এই পথে কত দূর যাওয়া যাবে সে প্রশ্ন উঠবেই। জঙ্গি দমনের পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াত জোটকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার যে এজেণ্ডা সরকারের রয়েছে এ পথে তা পূরণ হলেও সরকার, ক্ষমতাসীন জোট এবং শিক্ষাসহ সামাজিক বিকাশের অন্যান্য উপাদানগুলো ক্রমেই তার অসাম্প্রদায়িক রূপ হারাতে থাকবে। বাঙালির চিরায়ত মানবিক সংস্কৃতির ঐতিহ্য ভীষণভাবে চাপে পড়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, ধর্মভিত্তিক যেসব সংগঠনের সাথে সরকার ও আওয়ামী লীগ সখ্য করছে তারা রাজনৈতিকভাবে জামায়াতের মত সংগঠিত না হলেও ধর্মীয় চিন্তার দিক থেকে একইভাবে গোঁড়া ও ধর্মান্ধ। ইতোমধ্যে তারা নিজেদের শক্তিরও পরিচয় দিয়েছে পাঠ্যবইয়ে সাম্প্রদায়িক বিবেচনায় রদবদল ঘটাতে সরকারকে বাধ্য করে। এবার তারা পয়লা বৈশাখ ও মঙ্গলশোভাযাত্রার বিরুদ্ধে নেমেছে। অন্যদিকে সরকার তাদের সাথে আপস করে চলতে গিয়ে উচ্চতর ডিগ্রির ন্যূনতম চাহিদার বিষয়টি বিচারে না নিয়েই কওমি ধারার সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে স্বীকৃতি দিয়ে একটা গোঁজামিল দিয়ে ভোটের উপকার করছেন, না ইসলামের নাকি দেশের?
এ প্রেক্ষাপটে কিছু সোজাসাপ্টা কথা বলা যায়। আমাদের যে উন্নতি হচ্ছে, গড় আয়ু বৃদ্ধি, মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পাওয়া, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে যোগাযোগ ও ব্যবসায়ের বিকাশ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি হল বিজ্ঞান।
কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যথার্থ বিজ্ঞান চর্চায় মনোযোগী নয়। মূল কারণ সমাজমানসই বিশুদ্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অনুকূল নয়। আদতে সমাজে আমরা ভোগের চাহিদা তৈরি করতে পারলেও জ্ঞানের চাহিদা তৈরি করতে পারি নি। ইসলামে যদিও  জ্ঞানচর্চার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তা সত্ত্বেও না-সরকারের আনুকূল্যপ্রাপ্ত না-সরকারের প্রতিকূলতার সম্মুখীন ধর্মীয় দলের কোনটিই প্রকৃত জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় আগ্রহী নয়। জ্ঞানচর্চার যথার্থ পরিসর তৈরি কোনো ক্ষেত্রেই আমরা করতে পারি নি - বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, মাদ্রাসায় তো নয়ই। সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে ডিগ্রির স্বীকৃতি থেকে কি সুফল শিক্ষার্থী পাবে!
বাংলাদেশের উন্নতিকে টেকসই করার লক্ষ্য (এসডিজি) পূরণ করতে হলে ধর্ম নিয়ে যারা রাজনৈতিক ফায়দা উশুল করতে চায় তাদের সাথে আপস করে পথ চলে লাভ হবে না। তাতে ইসলামচর্চারও কাক্সিক্ষত উন্নতি অর্জিত হবে না।
গোড়ার কথায় ফিরে গিয়ে বলতে হবে গোটা বিশ্ব আজ যে কালান্তরের সম্মুখীন তা দীর্ঘদিনের আদর্শহীন ক্ষমতার রাজনীতির মাধ্যমে মোকাবিলা করা যাবে না। আদর্শের এই শূন্যতায় মুসলিম দেশের তরুণদের একটি অংশ বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকছে।
তারাও তরুণ এবং তারাও তো নিজের চেয়ে বড় ও মহৎ কাজে যুক্ত হতে চায়, তাদের সামনে গণতান্ত্রিক রাজনীতি তেমন কিছু দাঁড় করতে পারে নি। এই ব্যর্থতার খেসারত দিতে হচ্ছে আমাদের এবং সারা বিশ্বের দেশে দেশে। আমরা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে তারুণ্যের অপচয় প্রত্যক্ষ করেছি একবার। আজ প্রায় চার দশক পরে ইসলামের নামে আরেকবার একই ধরনের ট্র্যাজেডি ঘটতে দেখছি। এমনটা কি আমরা ঘটতে দিতে পারি?
গোঁজামিল দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না, জঙ্গি মেরে এই প্রবণতা শেষ করা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশ হল মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে একটি ব্যতিক্রমী দেশ। এখানকার মানুষ ধর্মভীরু, ধর্মচর্চায় উৎসাহী, আবার চিরায়ত মানবতাবাদী ঐতিহ্যের প্রতিও আগ্রহী। এ মানুষের পক্ষে সংকটাপন্ন বিশ্বে মানবতার পক্ষে নতুন বাণী হাজির করা সম্ভব যা সকল অমানবিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তরুণদের উদ্দীপ্ত করতে পারে। মূলধারার রাজনীতিকে নানা কৌশল ও আপসের চিন্তা বাদ দিয়ে স্পষ্টভাবে মানবিক মহৎ আদর্শের গণতান্ত্রিক রাজনীতির কথা ভাবতে হবে।


***

Sunday, March 26, 2017

একাত্তরের চেয়েও সময় এখন প্রতিকূল

আবুল মোমেন

১৯৭১ সনে যখন আমরা মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছি তখন দেশের এবং বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা কেমন ছিল?
এক কথায় বলা যায়, তা ছিল আমাদের অনুকূল। যদিও পাকিস্তান আমাদের ওপর ভয়াবহ অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল এবং আন্তর্জাতিকভাবে পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও প্রতিবেশী চীন আমাদের বিপক্ষে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিল তবুও বলব, সামগ্রিকভাবে দেশের ও বিশ্বের রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল আমাদের অনুকূল।
একাত্তরের উদ্ভব হল সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের পক্ষে এদেশের জনগণ বিপুলভাবে সমর্থন দেওয়ার ফলে। এ ছিল জনগণের ঐক্য ও জাগরণের ফল। এর সূচনা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ছেষট্টিতে ছয়দফা কর্মসূচি দেওয়ার পর। এটি যদিও আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ছিল তবুও এর প্রতি দলমত-নির্বিশেষে জনগণের সমর্থন পাওয়া গিয়েছিল। মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নেতা মেনেছিল। তাঁর সাহসিকতা, অঙ্গীকার এবং জনগণের প্রতি ভালোবাসা দিনে দিনে মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়েছে এবং তারা বুঝেছে ইনিই হলেন বাঙালির মুক্তির কাণ্ডারি। গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেদিন ন্যাপ-সিপিবির সমর্থন। তাতে ছাত্রদের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে ওঠার পথ সুগম হয় এবং ছয়দফার পাশাপাশি ছাত্রদের এগারদফা বাঙালির স্বাধীনতার যাত্রাপথকে সুগম করে তোলে। ছাত্রদের মধ্যে এমন এক ঐক্য তৈরি হয় যার ফলে এক প্রান্তে চীনপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন ও অন্যপ্রান্তে সরকারদলীয় জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের একটি অংশও এতে যুক্ত হয়েছিল। আদতে মুষ্টিমেয় ধর্মান্ধ ও চরম-পন্থী দল ব্যতীত গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল সেদিন।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তখনও দুই মেরু বিশ্বব্যবস্থাই চলমান, সোভিয়েত ইউনিয়ন তখনো যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি। তখন মাত্রই সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সহযোগিতায় তৎকালীন তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম শেষ হয়ে দেশগুলো স্বাধীন হয়েছে। বিশ্বব্যাপী তরুণ, শ্রমজীবী, বুদ্ধিজীবী ও শিল্পসাহিত্যেকদের মধ্যে সমাজতন্ত্রের পক্ষে জোরালো স্রোত বইছে তখন। তখনকার তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে রাজনীতিতে সমাজতন্ত্রের আদর্শ ও স্বপ্নই সবচেয়ে শক্তিশালী অনুষঙ্গ। যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সামরিক জোট ন্যাটোর প্রতিদ্বন্দ্বী ওয়ারশ চুক্তি কার্যকর ভূমিকায় ছিল। তাছাড়া তথাকথিত প্রথম বিশ্বের রাজনৈতিক নেতৃত্বের তুলনায় তৃতীয় বিশ্বের  নেতৃবৃন্দের ক্যারিসমা ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল অনেক বেশি। এটি তৈরি হয়েছিল পঞ্চাশ ও ষাটের দশক জুড়ে মূলত নেহেরু, নক্রুমা, শোয়েকর্ন, নাসের, টিটোর মত নেতাদের কারণে। আর একাত্তরে খুবই বড় বিষয় ছিল বাংলাদেশকে ঘিরে যে প্রতিবেশী দেশ ভারত তার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নেহেরু-কন্যা ইন্দিরা গান্ধি।
১৯৭১ সনে বছর জুড়ে ইন্দিরা গান্ধির ভূমিকা একবার মনে করুন। জটিল পরিস্থিতিটি তিনি সে সময়ের বাস্তবতার  আলোকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সুকৌশলে সমাধানের পথে পরিচালনা করেছিলেন। ভারতের জোট নিরপেক্ষ দেশের ভাবমূর্তি ধরে রেখেই তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে নিরাপত্তা চুক্তি করে মার্কিন তৎপরতার সম্ভাবনা বন্ধ করেছিলেন এবং প্রয়োজনের সময় জাতিসঙ্ঘে সোভিয়েত সমর্থন আদায় করে নিয়েছিলেন। চীন ব্যতীত মোটামুটি সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সমর্থন নিয়েই তিনি এগিয়েছেন।
এ কথাও স্মরণ করা প্রয়োজন তখন তাজউদ্দিন আহমেদ দলীয় ও দল-বহির্ভূত অভ্যন্তরীণ সকল কোন্দল, টানাপোড়েন দক্ষতার সঙ্গে সামলেছেন। এক লক্ষ্য স্বাধীনতা থেকে বিচ্যুত হতে দেন নি এত মানুষের এত ত্যাগকে। তাছাড়া কিছু নেতার মধ্যে বিভ্রান্তি ও দূরভসন্ধি থাকলেও জনগণ কিন্তু অসাম্প্রদায়িক সমাজতান্ত্রিক একটি দেশের স্বপ্নেই উজ্জীবিত ছিল।
সমাজতন্ত্র, সেই আদর্শের ভিত্তিতে গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজব্যবস্থাই ছিল মানুষের লক্ষ্য। ঐক্যবদ্ধ জাগ্রত জনগণ যখন যুদ্ধে জড়িয়ে যায় তাদের জন্যে সেটি হল মুক্তির যুদ্ধ, ন্যায় যুদ্ধ, জনযুদ্ধ। একাত্তরে বাংলাদেশে আমরা তেমন এক যুদ্ধেই লিপ্ত ছিলাম। এরকম যুদ্ধে কেউ পরাজিত হয় না, বিজয়ীই হয়। আমাদের পরে ভিয়েতনামেও একইভাবে জনগণ বিজয়ী হয়েছিল, তারা তো সরাসরি পরাশক্তি মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এ বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল।
সেই সব দিনে সমাজতন্ত্রের আদর্শ স্বাধীনতাকামী মানুষকে এগিয়ে চলার, যুদ্ধ জয়ের মন্ত্র দিয়েছিল।
আজ কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আগেই সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের পতন হয়েছে, এক মেরু বিশ্বের একক মোড়ালে পরিণত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটোর পরিসর ও শক্তি বৃদ্ধি পেলেও ভারসাম্য রক্ষার মত ওয়ারশ চুক্তি আর কার্যকর নেই। তারও চেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় হল রাশিয়া ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের শাসনব্যবস্থা ও অর্থনীতির নানা দুর্বলতা, ব্যর্থতা, জনসমক্ষে যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে তাতে দেশে দেশে এই স্বপ্ন প্রবল ঘা খেয়েছে। এর বিপরীতে পুঁজিবাদী বিশ্ব এ সময়ে মুক্তবাজার অর্থনীতি চাপিয়ে দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক আগ্রাসন ও আধিপত্য বজায় রাখার সব কৌশল অবলম্বন করেছে। আবার তখন উন্নয়নশীল দেশের শক্তিশালী হাতিয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে আদর্শবাদের অবক্ষয় ঘটেছে। এই শূন্যতা পূরণের বিকল্প হিসেবে সর্বত্র ধর্মাশ্রয়ী চিন্তার প্রসার ঘটেছে। এটাও বলতে হবে, এ সময়ে জাতিসঙ্ঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য এবং একে ঘিরে আরো নানান সংস্থা ও  দেশীয় এনজিওদের ভূমিকায় বাংলাদেশসহ নানা দেশে সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটেছে যা এসব সূচকে প্রতিফলিত হয়। কিন্তু রাজনীতির, অবক্ষয় ঠেকানো যায় নি।
এই রাজনীতি ক্ষমতা দখলে এবং তার মাধ্যমে সর্বত্র আধিপত্য ও প্রভাব সৃষ্টির প্রয়াস চালায়। গণতন্ত্র এতে সংকুচিত হয়। ধর্মান্ধতা যা জঙ্গিবাদ পর্যন্ত এগুতে পারে, সাম্প্রদায়িকতা যা দাঙ্গা পর্যন্ত গড়াতে পারে, ঘৃণা ও বিদ্বেষ যা সন্ত্রাসের জন্ম দেয়, মিথ্যা ও প্রতারণা যা ইতিহাসকে বিভ্রান্তির কুহকে ঢেকে দেয় ইত্যাদির প্রসার ঘটেছে এ সময়। এসবের পিছু নেয় জবাবদিহিতার অভাব ও অদক্ষতা, ক্ষমতা ও সিদ্ধান্তের কেন্দ্রীভবন। দুর্নীতি ও অপরাধের যুগলবন্দি ভূমিকা গণতন্ত্রের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। পৃথিবীতে আজ ট্রাম্পের উত্থান, মোদীর আশ্চর্যরকম জনপ্রিয়তা এবং সাফল্য, পুতিনের কায়েমি রাজত্বই হল বাস্তবতা। পৃথিবীতে আবার ধর্মান্ধতা ও জাতিগত বৈরিতা প্রবল হয়ে উঠেছে, অন্যায় অমানবিক যুদ্ধ চলছেই এবং অকারণ মৃত্যুর মিছিল থামছে না।
বাংলাদেশের উন্নতি হচ্ছে, মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। কিন্তু একথা ভুললে চলবে না, মৌলিক চাহিদার একমাত্র অবস্তুগত এবং শেষ বিচারে মানুষের জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান শিক্ষায় সংখ্যাগত উন্নয়নকে মানের বেহাল অবস্থা বিদ্রƒপ করছে। শিক্ষার মান মূলধারার সর্বস্তরে এমন নেমেছে যে এ সত্য অস্বীকার করার চেষ্টা চললে আমাদের ভবিষ্যতও সংকটাপন্ন হবে। একালে ধর্মাচার বাড়লেও নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সংকট আরো বেড়েছে কারণ মুক্ত জ্ঞানচর্চা ব্যতীত ধর্মান্ধতা  ঠেকানো যায় না, গণতন্ত্রের বিকাশও রুদ্ধ হয়ে যায়, সমাজমানসে যে স্থবিরতা নামে তা নানা বিকার  ও অপরাধকেই প্রশ্রয় দেয়।
আজ বিশ্বের মূলধারা ভোগবাদিতার জয়গান গাইছে, ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার মধ্যেও বাণিজ্য ও লাভের চিন্তাই প্রবল, সেবা ও দানও আজ বিনিয়োগের খাত। মানুষের জন্ম  থেকে মৃত্যু - সবটা জুড়ে ব্যবসা ও মুনাফার চিন্তা জড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষ কখনো ক্রেতা কখনো বিক্রেতা, কখনো নিজেই পণ্য কখনো ভোক্তা। এর কোনোটিই মানবের মূল সত্তা নয়। তার মূল্য তো নিহিত আছে মনুষ্যত্বের মধ্যে যা অনেক নীতি ও মূল্যবোধের সমন্বয়ে গঠিত হয়।
আজ সে জায়গায় আপস চলছে। একাত্তর কারো কোনো বিনিয়োগ ছিল না, এ থেকে ব্যক্তিগত মুনাফার ভাবনা কারো মধ্যে ছিল না, কেউ একা ছিল না। আমরা ছিলাম সকলে, ব্যক্তি ও তার চিন্তার জগৎ আলাদা হলেও, সামষ্টিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মহত্ত্ব সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন।
বিশ্ব জুড়ে মানুষ যেমন আদর্শ হারিয়েছে তেমনি তার হারিয়েছে মহত্ত্ব। তাই মানুষের জীবন স্থূল ভোগবিলাস ও আচার ধর্মের সহজ লক্ষ্যে বাঁধা পড়ছে।
কথায় কথায় বলা হয়, একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার। মনে রাখতে হবে একাত্তরের মূল হাতিয়ার কিন্তু অস্ত্র নয়, আগ্নেয়াস্ত্র গজরাতে থাকলে খুনোখুনি ও প্রতিহিংসার মহড়াই চলবে, সমাজ রক্তাক্ত হবে, অপরাধ ও দুর্নীতি হাত ধরাধরি করে চলবে।
না, একাত্তরের মূল হাতিয়ার ছিল সেদিনের রাজনীতি - যাতে নীতি ছিল, আদর্শ ছিল, যা মানুষের মুক্তির কথা ভেবেছিল। হ্যাঁ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি প্রধান একটি বিষয়, কিন্তু এটি যেন খোদ মানুষটির বিনিময়ে না আসে।
অথচ আজ সারা বিশ্বে মানুষের পরাজয় ঘটছে - সুউচ্চ দালান আর সুদৃশ্য স্থাপনা সে বারতাকে ঢাকতে পারবে না। যে বিশ্ব ট্রাম্প, পুতিন, মোদী, এরদেয়ানদের সামনে তুলে আনে, দীর্ঘদিন সহ্য করে যায় তার যে নৈতিক শক্তির আকাল চলছে সেটা বুঝতে তো অসুবিধা হয় না।

স্বাধীনতার ছেচল্লিশ বছর পরেও যদি ধর্মান্ধতা ও পশ্চাৎপদ চিন্তার সাথে আপস চলে তাহলে আমাদের রাজনীতি কোন পথে চলেছে সে প্রশ্ন উঠবেই। না, আজ একাত্তরের তুলনায় এক প্রতিকূল বিশ্ব ও প্রতিকূল সময়ে আমরা বাস করছি।