Monday, December 30, 2013

কঠিন বছর পেরিয়ে কঠিন বছরে পদার্পণ

আবুল মোমেন

সময় প্রবহমান, কাল নিরবধি। তারপরেও সুবিধার জন্যে সময়ের নানা বিভাজন করে নিয়েছে মানুষ। এইসব বিভাজনের সবকটিরই আলাদা গুরুত্ব আছে। তবে মূল্যায়নের জন্যে বছরের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। আমরা অবশ্য এমন একটা বছর শেষ করতে যাচ্ছি আজ যেটি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি নাটকীয় অধ্যায়ের মাঝখানে রয়েছে। আজ বছরের হিসেবে ২০১৩ সন শেষ হচ্ছে কিন্তু যে রাজনৈতিক হিংসাত্মক ঝোড়া হাওয়ার মধ্যে আছি তার সমাপ্তি আজ হবে না। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ দশম সংসদের নির্বাচনের মাধ্যমেও তা শেষ হবে বলে মনে হয় না। বরং যেভাবে সব চলছে তাতে সেদিন হয়ত হিংসার নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে।
২০১৩ সন শুরু হয়েছিল জানুয়ারি মাসে যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আযাদের - অনেক গণমাধ্যমে যে ব্যক্তি বাচ্চু রাজাকার নামে পরিচিত - ফাঁসির রায় ঘোষণার মাধ্যমে। এটি ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ও যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রথম রায়। অভিযুক্ত ব্যক্তি অবশ্য পলাতক এবং কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত না থাকায় এ রায় নিয়ে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় নি। কিন্তু ফেব্র“য়ারির ৫ তারিখ জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ায় একে গুরু অপরাধের লঘু শাস্তি গণ্য করে ঢাকায় তরুণসমাজ রায় প্রত্যাখ্যান করে রীতিমত বিপ্লবী কাণ্ড ঘটায়। এটি সর্বত্র গণজাগরণ মঞ্চ নামে অভিহিত হয়। কোনো রকম সাংগঠনিক ভিত্তি ছাড়া কেবলমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে এরকম বিশাল গণজাগরণ সৃষ্টি কেবল অবাক করে নি জনগণকে, একই সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও গণতান্ত্রিক মূল্যাবোধে বিশ্বাসী সকলকে আশাবাদী ও আশ্বস্ত করে তুলেছিল।
কিন্তু এরপরে ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মামলার রায়ে আসামীকে ফাঁসি দেওয়ায় তাঁর অঞ্চল পিরোজপুর এবং জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেক প্রাণহানী ঘটেছে, বিপুল সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগ সমর্থকরা বিশেষভাবে আক্রমণের শিকার হন।
ফেব্র“য়ারি মাসের এ দুটি ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশের দুটি শক্তিশালী মতাদর্শের বিপরীত অবস্থানটা স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। প্রতিক্রিয়ার এই প্রত্যাঘাতে তরুণরা পিছু হটেনি, বরং গণজাগরণ মঞ্চকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করেছে, তীব্র প্রতিকূলতার মুখেও মাঠ ছাড়ে নি, আন্দোলনকে রাজপথে সরব রেখেছে। অন্যদিকে জামায়াত হিংসাত্মক আক্রমণের রাস্তা বেছে নিয়েছে। তারা জোটের বড় শরিক ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে আন্দোলনের মাঠে সঙ্গে পেয়েছে, যদিও এ দলের জন্যে পরবর্তী নির্বাচন ও তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুটি মুখ্য।
বিএনপির দিক থেকেও অবশ্য এটিই ছিল চাহিদা অর্থাৎ জামায়াত হিংসাত্মক ভূমিকায় মাঠে থাকুক। ফলে বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোটের তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুর আন্দোলন জামায়াতের সহিংস প্রতিক্রিয়ার একটা ঢাল হিসেবে কাজ করেছে।
এর মধ্যেই আরও ঘটনায় পরিস্থিতি জটিল ও উত্তপ্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে জামায়াত সম্পর্কে যেসব পর্যবেক্ষণ এসেছে তাতে দলটি যুদ্ধাপরাধী ও হিংসাত্মক রাজনীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে। এক পর্যায়ে আদালতের রায়ে জামায়াতের ইসলামি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য ঘোষিত হয়। অন্যদিকে গণজাগরণ মঞ্চের চাপে সরকার সংসদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আদালত আইন সংশোধন করে সরকারের জন্যে উচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ তৈরি করে। আর পরবর্তী সময়ে আরও কয়েকটি রায় হয় যাতে জামায়াতের তাত্ত্বিক নেতা গোলাম আযম ও বিএনপি নেতা আবদুল আলীম বয়সের কারণে দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেও জামায়াতের নেতা আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসির আদেশ হয়। সরকারি আপিলে উচ্চ আদালতে পুনর্বিচারে কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ হয় এবং সবশেষে আপিল বিভাগে রায় বহাল থাকায় শেষ পর্যন্ত এই আদেশ কার্যকর হয়। এরপর আবারও জামায়াতের তীব্র সহিংস প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন এলাকায় বহু প্রাণহানি ও সম্পদহানি ঘটেছে। এসব ঘটনা অনেকের জন্যে একাত্তরের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে। তাছাড়া এ ঘটনায় পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াও দেশে প্রবল প্রতিবাদ সৃষ্টি করেছে। পাশাপাশি জমায়াতের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কে যে অটুট আছে তাও প্রমাণিত হয়। জামায়াতের এই সহিংস প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি ১৮ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে রাজপথে আন্দোলন চাঙ্গা রাখার চেষ্টা হয়েছে বরাবর। এর মধ্যে ৫মে কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক হেফাজতে ইসলাম সংগঠন ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে বিশাল সমাবেশ করে সরকার, গণজাগরণ মঞ্চ এবং প্রগতিশীল সমাজকে রীতিমত শংকাগ্রস্ত করে তোলে। বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং তাঁর দল বিএনপি এটিকে কাজে লাগানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চালান। ফলে খোদ রাজধানীতে বড় রকমের সংঘাতের আশংকা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত শেষরাতে পুলিশ ও র‌্যাব আধঘণ্টার অভিযান চালিয়ে সমাবেশ ভেঙে দিতে সক্ষম হয়। দেখা গেল যথার্থ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও অঙ্গীকার ছাড়া কেবল শ্লোগানের ওপর ভর করে কোনো দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন করা যায় না। সরকার হেফাজতকে পক্ষে রাখার এবং বিএনপি-জামায়াত থেকে দূরে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত কট্টরপন্থী এই গোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত বিবদমান কোনো পক্ষেরই নির্ভরযোগ্য সঙ্গী হতে পারে নি।
এদিকে সরকার, বরং বলা যায় ১৪ দলীয় জোটের প্রধান দল আওয়ামী লীগ, কৌশল হিসেবে গণজাগরণ মঞ্চকে দীর্ঘদিন রাজপথে রাখতে গিয়ে এর যে অরাজনৈতিক নির্দলীয় রূপ তাকে নষ্ট করে পুরো আন্দোলনের ক্ষতি করেছে। সেই থেকে মঞ্চ আর প্রথম দিককার ভূমিকায় ফিরতে পারে নি।
এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলে ও সরকারে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করায় তাঁর নিজের দল ও সরকার সম্পূর্ণ তাঁর মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে। এর ফলে ধর্মান্ধ শক্তির বিরুদ্ধে মাঠ পর্যায়ে রাজনৈতিক প্রতিরোধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগ কার্যত সংগঠন হিসেবে স্থবির হয়ে পড়েছে অথবা তারাও ভাড়াটে বাহিনী দিয়ে লাঠিয়ালের কাজ করাচ্ছে।
একদিকে আওয়ামী লীগের স্থবিরতা আর অন্যদিকে বিএনপির অক্ষমতা মিলে রাজনৈতিক অঙ্গন প্রায় সারা বছর একপক্ষে জামায়াতি ক্যাডার ও ভাড়াটে মাস্তান এবং অন্যপক্ষে সরকারি বিভিন্ন বাহিনীর দখলে থাকল।
এরই চূড়ান্ত মহড়া আমরা দেখতে পেয়েছি আঠার দলীয় জোটের পূর্বঘোষিত মার্চ ফর ডেমোক্রেসির দিন। খালেদা জিয়ার আহ্বানে এ কর্মসূচী পরের দিনও প্রলম্বিত হল। কিন্তু এ থেকে যে বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে তাহল জামায়াতের কার্যকর ভূমিকা ছাড়া বিএনপির পক্ষে রাজপথ দখলে রেখে সরকারি দমনপীড়নের বাধা ডিঙিয়ে কিছু করা প্রায় অসম্ভব। সরকারি বাহিনী মাঠে সক্রিয় থাকলে মাস্তানরাও পিছিয়ে যায়। আর সরকারের সাথে আগেই বিভিন্ন স্থানে রীতিমত সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত হয়ে জামায়াত-শিবিরের শক্তিও এর মধ্যে অনেকাংশেই হ্রাস পেয়েছে। ফলে আপাতত বেগম জিয়াকে মূলত গণমাধ্যমের ওপর নির্ভর করে আন্দোলন জারি রাখতে হবে।
সামাজিক সূচকে নানান অগ্রগতি হলেও বিগত বছরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেক দুর্বলতা উন্মোচিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের মত দেশের সবচেয়ে প্রাচীন গণতান্ত্রিক দলকেও রাজনৈতিক বিরোধিতা সামলাতে সংগঠন ও রাজনৈতিক কর্মসূচির পরিবর্তে সরকারি বাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারের মতই প্রবল হিংসাত্মক বিরোধিতা ঠেকাতে শেখ হাসিনাকেও পিতার মত একই রকম অ্যাকশনের পুনরাবৃত্তি করতে গিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, প্রমাণ হতে চলেছে বিএনপির মত দল অনেকটাই পরগাছার মত। ব্যাপক সমর্থন থাকলেও দলে ত্যাগী ও সংগ্রামী স্থানীয় নেতা-কর্মীর অভাব রয়েছে। তৃতীয়ত, বোঝা যাচ্ছে নাগরিকসমাজ তাদের ভূমিকা নির্ধারণ করতে পারছে না, তাদের ভূমিকায় পূর্বাপর সামঞ্জস্য থাকছে না।
হয়ত একটু আগাম হবে বলা, তবে আলামতে মনে হচ্ছে, আগেকার মত ইসলামের দোহাই দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর দিন বোধহয় ফুরিয়ে এসেছে। হেফাজতে ইসলামসহ বিএনপি-জামায়াত জোট এ ধারায় ব্যাপক প্রচারণা চালানো সত্ত্বেও মনে হয় এ সমালোচনার আর সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্যতা নেই। আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, বঙ্গবন্ধুর সরকার সামরিক বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তা বাহিনীর আশানুরূপ সহায়তা-সমর্থন পায় নি, কিন্তু শেখ হাসিনা মনে হচ্ছে এ জায়গায় অনেকখানি এগিয়েছেন। ফলে জবরদস্তিমূলক ভোটারহীন প্রার্থীবিহীন সাজানো নির্বাচনের ব্যবস্থা করে এবং গণমাধ্যম, সুশীলসমাজ ও আন্তর্জাতিক মহলের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েও বিরোধী জোটের আন্দোলনের মুখোমুখি হয়ে নিজ অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছেন। আমরা দেখেছি বরং বিএনপি সমঝোতার স্বার্থে  নিজ অবস্থান থেকে অনেকখানি সরে এসেছিল। বস্তুত শেখ হাসিনা নির্বাচন ও গণতন্ত্রকে এখন ততটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না, তার বিবেচনায় এর আগের কাজ হল দেশকে হারানো লক্ষ্যাদর্শের পথে ফিরিয়ে আনা। তাঁর সাথে নাগরিকসমাজের দূরত্ব বেড়েছে। তবে প্রায় একক জেদ এবং দলীয় ও সরকারি মদতে তিনি যদি টিকে যান, সফল হন তবে এ দূরত্ব কমে যাবে বলেই তাঁর বিশ্বাস। তিনি নিজেকে রণাঙ্গণে মনে করছেন Ñ বুদ্ধিজীবীরা অনেককাল তাঁর সঙ্গে থেকে এখন হয়ত রণেভঙ্গ দিয়েছেন।
সম্ভবত আগামী বছরটি হবে আরও কঠিন এবং হয়ত আরও সংঘাতময়। গত একটি বছর রাজনৈতিক অঙ্গনে বস্তুত একক খেলোয়াড় ছিলেন শেখ হাসিনা, আগামী বছরটি তাঁর জন্যে আরও বড় চ্যালেঞ্জ নিয়েই আসছে। এবার তাঁকে ঝড় সামলাতে এবং সমাজের ভাঙনগুলো জোড়া লাগাতে হবে। কাজটা নিশ্চিতভাবেই কঠিন, কিন্তু তিনি তো জেনেশুনেই কঠিন পথে পা দিয়েছেন।