Tuesday, June 24, 2014

এভাবে চললে দেশ কোথায় যাবে?

আবুল মোমেন

স্বাধীন বাংলাদেশে একটা বড় কাজ ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এটি আমাদের বকেয়া কাজ। অন্তত বেয়াল্লিশ বছর আগে স্বাধীনতা অর্জনের পরে এ কাজ শুরু হয়েছিল। তখন ভিতর-বাইরের চাপ ছিল এ বিচার কাজ না করার জন্যে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে পুনর্গঠন, পুনর্বাসন এবং নবযাত্রা সূচনার কাজগুলো ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিচারের কাজ একটু মন্থর হয়ে পড়ে এবং সরকার ও আদালতের দিক থেকে ঔদার্য প্রদর্শিত হয়। তবে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে সব পণ্ড করে দিয়েছিলেন। প্রায় চার দশক পরে বর্তমান সরকার সেই বকেয়া কাজ এখন সম্পন্ন করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
বকেয়া কাজ ছাড়াও সরকারের জন্যে দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার কিছু এজেণ্ডা রয়েছে। এর মুখ্যটি হল গণতন্ত্র। বস্তুত আমাদের গণতন্ত্রের আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল। এদেশের মানুষ ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর থেকেই গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্যে  আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করে। শেখ মুজিবকে সেই আন্দোলনই এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুতে উন্নীত করে এবং তাঁর বলিষ্ঠ দুঃসাহসী দূরদর্শী নেতৃত্ব সেই আন্দোলনকে স্বাধীনতার জন্যে মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত করে।
গণতন্ত্রের সাথে যুক্ত রয়েছে কিছু নীতি-আদর্শ এবং শাসনব্যবস্থার কিছু পদ্ধতি। দেশ ও সমাজকে হতে হবে সকল ধর্ম-বর্ণ বিত্ত-গোত্র-নির্বিশেষে সমতাভিত্তিক। একে এককথায় বলতে পারি অসাম্প্রদায়িক মানবিক আদর্শ। দ্বিতীয়ত, শাসন কাজে জনগণের প্রতিনিধিত্ব এবং অংশীদারিত্ব থাকতে হবে। একাজগুলোও বকেয়া পড়ে গেছে কেবল এটুকু বললে সবটা বলা হবে না। অসাম্প্রদয়িক মানবতার নীতি-আদর্শ এবং জনগণের প্রতিনিধিত্ব ও অংশীদারিত্বের নিশ্চয়তা বাহাত্তরের সংবিধানে লিপিবদ্ধ ছিল। কিন্তু কাগজে-কলমে স্বীকৃতি দান, কিংবা দলিলে লিপিবদ্ধ করেই যেন কাজ শেষ হয়েছে। এই ঘোষিত নীতিতে সমাজকে শিক্ষিত করা এবং পদ্ধতি চালু করার বাস্তব পদক্ষেপ গৃহীত হয় নি।
ক্ষমতা কুক্ষিগত করে জিয়া সংবিধান পরিবর্তন করে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি থেকে সরে এলেন। তিনি পছন্দ করলেন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে সেভাবে ব্যবহার করলেন। তাঁর নীতির পক্ষে শক্তি বাড়ানোর জন্যে একদিকে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে কোণঠাসা করলেন এবং অন্যদিকে ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোকে পুনর্বাসিত করলেন। এমনকী তাদের তাঁর সরকারের অংশও করে নিলেন। কেবল ধর্ম ইসলাম নয় সাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশের রাজনীতির বিষয় হয়ে উঠল, এবং পাকিস্তান আমলের মত সরকারের শাসনপদ্ধতির অবশ্য বিবেচ্য ও মান্য নীতি হয়ে উঠেছিল।
বিএনপি দেশের বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে সরকারের বাইরে থেকেও এই নীতি-পদ্ধতির পক্ষে জনমতের একটা বড় অংশ ধরে রাখতে সক্ষম হয়। বরং তাদের প্রশ্রয়ে-পৃষ্ঠপোষকতায় এবং কিছুটা যুগের হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে এই ধারার ভয়ঙ্কর জঙ্গি মৌলবাদী শক্তির উত্থান ঘটেছে আজ।
ফলে ক্ষমতায় আসার পরে আওয়ামী লীগের ওপর বকেয়া ও চলমান যেসব দায়িত্ব পড়েছে তার মধ্যে এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ। এই অপশক্তির সাথে লড়তে গিয়ে খোদ আওয়ামী লীগের মধ্যে দুটি বড় পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করছি।  প্রথমত, সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী রাজনীতির দিক থেকে আওয়ামী লীগের সম্পর্কে ইসলামবিরোধী বলে যে সন্দেহ জনমনে ঢুকিয়ে দিয়ে নির্বাচন জয়ের কাজ হাসিল করা হয় তাকে অকার্যকর করা জরুরি হয়ে পড়ে। দেশের সাধারণ মানুষ যে-অর্থে ধর্মভীরু তাদের প্রতিনিধিত্বকারী সবচেয়ে বড় দলের অধিকাংশ কর্মী-সমর্থক, এমনকী নেতারাও সে অর্থে ধর্মবিশ্বাসী মুসলমান। কিন্তু তারা কেউই সাম্প্রদায়িক নন। কিন্তু জনগণের সন্দেহ-সংশয় দূর করার জন্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কৌশল হিসেবে নিজেদের ধর্মীয় তথা মুসলিম পরিচয়কে বিশেষভাবে জাহির করার নীতি গ্রহণ করে। এটি তো বিশ্বাস এবং জীবনচর্যার সাথে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট বিষয়। খুব সচেতন না হলে যে কোন কৌশল তার প্রাথমিক লক্ষ্য পূরণ করে আরও বাড়তি লক্ষ্য পূরণেও সমর্থ হতে থাকে। আওয়ামী লীগেও বাস্তব রাজনীতির সাথে ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কৃতির যোগ গভীর হয়ে পড়েছে। এখন এ দলে একজন জামায়াতি এমনকী জঙ্গি মানুষের আশ্রয় গ্রহণ অসম্ভব নয়। তার দৃষ্টান্ত আমরা বর্তমানে কিছু কিছু দেখছি। আর বিএনপির সাথে দলীয় ইতিহাস ও প্রধান নেতা নিয়ে বিবাদ ব্যতীত শ্রেণি অবস্থান, চিন্তাচেতনা  মানসিকতা এবং জীবনচর্যায় আওয়ামী লীগের বাস্তব কোনো ফারাক নেই। ফলে দুই দলে ক্ষমতা বদল হলে ইতিহাস পাল্টায়, সংস্কৃতির অঙ্গনে পরিবর্তন ঘটে কিন্তু শাসনব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আসে না।
দেশের প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী (ধর্মহীন নন) সমাজের সামনে এখনও মোটা দাগের বিবেচনায় আওয়ামী লীগ ছাড়া সমর্থন দেওয়ার মত অন্য কোন দল নেই। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এই সমর্থনকে স্বত:সিদ্ধ হিসেবে ধরে নিয়ে এদের সমালোচনা বা পরামর্শের প্রতি বিন্দুমাত্র কর্ণপাতও করে না। বরং দেশের দুটি বিবদমান পক্ষের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক মানবিক পক্ষ অবলম্বনকারীদের দোহাই দিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার কৌশল নিয়ে চলছে।
সরকারবিরোধী রাজনীতির প্রধান শক্তি বিএনপির রাজনীতির অন্তর্নিহত দুর্বলতার বিষয়টি আমরা বারবার উল্লেখ করেছি। তাদের রাজনীতির প্রকৃত রূপ হচ্ছে আওয়ামী বিরোধিতা। এ কাজ করতে গিয়ে তারা জামায়াত এবং কট্টর ইসলামি দলগুলোর সাথে জোট গঠন করেছে। এরা আবার স্বাধীনতার বিরোধিতা, যুদ্ধাপরাধ এবং জঙ্গিবাদের জন্যে অভিযুক্ত, যা যে কোনো বিবেচনায় বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতি হতে পারে না। তদুপরি দেশের তরুণ সমাজ, যারা ভোটারদের প্রায় অর্ধেক, এ ধারাকে গ্রহণ করে না। ফলে তাদের রাজনীতি দলীয় কর্মীদের  নীতি-আদর্শের ভিত্তি যেমন দিতে পারছে না তেমনি পারছে না দেশের তরুণদের দলে টানতে। এ ধরনের ভাবাবেগ চালিত তরুণ কর্মীরাই কিন্তু দীর্ঘদিনের নিপীড়ন-শোষণের বিরুদ্ধে মাঠে থেকে সংগ্রাম চালিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে ধরে রেখেছে, এগিয়ে নিয়েছে। এই দুর্জয় মনোবলের নিবেদিত কর্মীর অভাবেই বিএনপি আজ ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।
তবে সব বাস্তবতার নিজস্ব কিছু উপজাত ফল আছে। আওয়ামী লীগ নেত্রী দেশকে মৌলবাদ জঙ্গিবাদ মুক্ত রাখার ব্রত পালন করতে গিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্যে দুর্বল বিএনপিকে একেবারে স্থায়ীভাবে কোণঠাসা করে রাখার এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাচ্ছেন না। তাতে তাঁর সরকার, দল এবং তাঁর নিজের হাতে ক্ষমতা একচেটিয়াভাবে কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে। কথায় বলে চরম ক্ষমতা চরম দুর্নীতির জন্ম দেয়। শেখ হাসিনার এবারের শাসনকালে দুর্নীতি কেবল সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে নি, এরই অনুষঙ্গ হিসেবে আইন-আদালত অমান্য করে দখলদারি, হত্যা-গুম, চাঁদাবাজিসহ ভয়ঙ্কর সব অপরাধ বাড়ছে এবং বলাবাহুল্য এসবে সরকারি দলের লোকজনের ভূমিকাই মুখ্য।
কেবল দুর্নীতি ও অন্যান্য অপরাধ নয় অন্য দিকেও অবক্ষয় ঘটছে। আওয়ামী লীগ ও তাঁর অঙ্গ সংগঠনে অপরাধীর সংখ্যা বাড়ছে, দল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলছে। এমনকি আজ যেটি সংসদে বিরোধী দল সেটিও প্রকৃত বিরোধী দল নয়। ফলে গণতন্ত্র নামসর্বস্ত ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে।
আজ দেশে যিনি রাজনীতিবিদ তিনি আসলে জননেতা নন, এক জাতের গড়ফাদার, যিনি দলীয় অনুসারীদের নানা অপরাধ-বাড়াবাড়ির রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেন। মন্ত্রী-আমলা এমপিরা জনগণের সেবক নন, রাষ্ট্রীয় শোষণযন্ত্রের অংশ হয়ে পড়েছেন, যেটি নির্বাচন সেটি প্রহসন মাত্র, বিচারবিভাগের স্বাধীনতা কথার কথা আজ, ক্ষমতাসীন দলেরও অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্রের নীতি কথার কথা মাত্র।
এভাবে বলা যাবে সমাজে সর্বত্র ফাঁপা মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব ঘটছে। যিনি শিক্ষক তিনি প্রকৃত শিক্ষক নন, যিনি সাংবাদিক তিনিও প্রকৃত সাংবাদিক নন। এভাবে রাজনীতিবিদ, বিচারক, প্রশাসক, বিশ্ববিদ্যালয়, আদালত, রাজনৈতিক দল কেউ বা কোনোটিই আদতে সেজন ও সেটি নয়। শেখ হাসিনার এই গণতান্ত্রিক শাসনে দেশের এই যে অবক্ষয় ঘটছে এর খেসারত কে দেবে? জাতিকেই দিতে হবে। কিন্তু তার সামনে রাজনৈতিক বিকল্প শক্তি এখন নেই। সম্ভবত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সুধীজনকে এগিয়ে এসে একাট্টা হয়ে সামাজিক জাগরণ ঘটাতে হবে। সেই সাথে স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ওপর গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্যে চাপ সৃষ্টি করতে হবে।