আবুল মোমেন
প্রথম আলোয়
প্রকাশিত অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হকের কলাম (বাংলাভাষা ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, ২১
মার্চ ২০১৮) অনেক বিষয়ে ভাবনার পথ করে দেয়। তাঁর ভাষা বিষয়ক বক্তব্যের সূত্র ধরে কয়েকটি
জরুরি বিষয় আলোচনায় আনা যায়।
তিনি বলেছেন
দেশে বাংলাভাষী ভিন্ন অন্যান্য ভাষাভাষি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১
ভাগের মত হবে এবং তাদের উন্নতি ও অগ্রগতির জন্যে বাংলা শেখার বিকল্প নেই। বহুকাল আগে
আদিবাসীদের ভাষাবিষয়ক এক গোলটেবিল আলোচনায় যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। রাঙামাটিতে
অনুষ্ঠিত সে আলোচনায় এবং এর পরে আরো নানা বৈঠকে ও নিজের লেখায় বলেছি যে কোনো ভাষার
জন্যে শিক্ষার মাধ্যম বা ব্যবহারিক যোগ্যতা অর্জনে সে ভাষায় উন্নত গদ্যশৈলীর বিকাশ
প্রয়োজন। বাংলা গদ্যের বিকাশের সূচনাতেই প্রতিভাশালী লেখকগণ তাতে সমৃদ্ধ সাহিত্য রচনা
করেন। ছড়া, কবিতা, কথা সাহিত্য ও চিন্তাশীল গদ্য রচনায় দ্রুত বিকাশ বাংলাভাষাকে শক্তি
দিয়েছে। ভাষার জগতে আমরা দেখি কৃত্রিমভাবে তৈরি ভাষা উর্দু উন্নত সাহিত্যের বাহন হয়ে
বহু আঞ্চলিক ভাষার সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করেছে। পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান বা পাখতুনখাওয়ার
মানুষ যে তাদের স্ব স্ব মাতৃভাষা থাকা সত্ত্বেও উর্দুকে শিক্ষার মাধ্যম ও রাষ্ট্রভাষা
হিসেবে মেনে নিল তা যেমন ব্রিটিশ ও পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্তের ফল তেমনি নিজেদের
শক্তিশালী ভাষা-সাহিত্যের অভাবও একটি কারণ। আবার একই কারণে অর্থাৎ সমৃদ্ধ ভাষা ও সাহিত্যের
জোরেই সেদিন বাঙালি রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলন করে কেবল সফল হয়নি, সে আন্দোলনকে শেষ
পর্যন্ত বাঙালির স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের লড়াই পর্যন্ত টেনে নিতে পেরেছিল।
আমাদের দেশে
৪৫টির মত যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে তাঁদের স্বতন্ত্র ভাষা ও সাংস্কৃতিক
বৈচিত্র রক্ষা করা উচিত এবং তা চর্চার মাধ্যমেই হবে। তবে এসব ভাষায় সমৃদ্ধ সাহিত্যের
অভাব রাতারাতি পূরণ হবে না, অথচ শিশুদের শিক্ষা তো বন্ধ রাখা যাবে না। মনে হয় এ পর্যায়ে
একদিকে এসব ভাষার বিকাশের জন্যে গবেষণামূলক কাজের পাশাপাশি শিশুশিক্ষার দৃষ্টান্তমূলক
কিছু গ্রন্থরচনা হতে পারে। কিন্তু শিক্ষায় ছাত্রের অনুভূতি ও ভাবনার স্ফূরণ ঘটানোর
জন্যে যে বিপুল সাহিত্যিক ও শিক্ষণীয় লেখার প্রয়োজন হয় তা আরো বহুদিন পূরণ হবে বাংলাভাষার
মাধ্যমে। চাকমা, গারো, সাঁওতালি ভাষায় এ অভাব পূরণ হবে কিনা, তার জন্যে বাংলাভাষার
আধিপত্য কতটা আর নিজেদের দুর্বলতা কতটা দায়ি তা বাস্তবতার আলোকেই বিচার করতে হবে।
মানুষের সাংস্কৃতিক
জীবনে ভাষাই মুখ্য তাই তাতে বহুমুখী উন্নত উপাদানের প্রয়োজন হয়। আমরা দেখি বর্তমানে
বাঙালিদের মতই আদিবাসী শিশু হয়ত সুকুমার রায়ের ছড়াতেই মুগ্ধ হয়, তরুণ-তরুণীরা শরৎচন্দ্র
বা হুমায়ুন আহমেদ পড়ে আনন্দ পায়, ভালোবাসে রবীন্দ্র-নজরুলের গান, দ্যাখে হয়ত সৈয়দ হকের
নাটক, পড়ে জীবনানন্দের কবিতা ইত্যাদি। এসবের বিকল্প সমমানের কিছু সে তো নিজের ভাষায়
পায় না। ভাষা-সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য ও বিকাশের সুযোগ নিয়ে দাবি তোলা যায়, আন্দোলনে
নামা যাবে কিন্তু তা করার নিশ্চিত কার্যকর উপায় হল ভাষার নিজস্ব শক্তি, যা দেবে সমৃদ্ধ
সাহিত্য ও বৈচিত্রময় গদ্যশৈলী। আমরা বলব, ভাষাগুলো রক্ষার পথ খোলা থাকুক আবার ক্ষুদ্র
জাতির বিকাশের পথও উন্মুক্ত থাকুক। আমরা দেখেছি জনসংখ্যার জোরে বালুচ, দারি, গুরুমুখী,
পাঞ্জাবি, সিন্ধি ইত্যাদি ভাষা বিলুপ্ত হয়নি আবার খানিকটা সুযোগের এবং অনেকটা সমৃদ্ধ
সাহিত্যের অভাবে ভাষাগুলো ততটা বিকশিতও হয়নি। মনে পড়ছে উচ্চশিক্ষিত পাঞ্জাবি অভিনেতা
বলরাজ সাহনি স্মৃতিকথায় লিখেছেন তিনি মাতৃভাষা গুরুমুখীতে সাহিত্য রচনা ছেড়ে হিন্দি
ও ইংরেজিতে লিখেছেন উন্নত সাহিত্যের অংশীদার হওয়া ও বেশি পাঠক পাওয়ার জন্যে।
এখন প্রশ্ন
উঠতে পারে একটি সমৃদ্ধ ভাষা হওয়ার কারণে বাংলা তার প্রতিবেশী ক্ষুদ্র জাতিদের উন্নতি-অগ্রগতির
বাহন হওয়া সত্ত্বেও তার প্রতি আমরা বাঙালিরা কেন ঔদাসীন্য দেখাচ্ছি, তাকে অযত্ন করছি?
এ প্রসঙ্গেও আবুল কাশেম ফজলুল হক ইঙ্গিত দিয়েছেন। এর গোড়ায় রয়েছে শিক্ষার লক্ষ্য ও
উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের বিভ্রান্তিকর ধারণা। সরকার একদিকে বলেন জ্ঞানভিত্তিক সমাজ
প্রতিষ্ঠা করবেন আবার বলা হয় কর্মমুখী শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। এ দুটি লক্ষ্য
পরস্পর বিরোধী নয় ঠিক, কিন্তু এর প্রস্তুতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে কোন কোন্ ক্ষেত্রগুলো
বিশেষ গুরুত্ব পেতে পারে, এ নিয়ে কোনো স্বচ্ছ ধারণার পরিচয় মেলে না আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়।
প্রাথমিক পর্বে ভাষা শেখার পাশাপাশি শিশুর অনুভূতি ও ভাব-ভাবনার ক্ষমতার উন্মোচন ঘটাতে
হবে। তাই এ সময় কর্মমুখী দক্ষতার ওপর জোর না দিয়ে অনুভূতি, ভাবুকতা ও চিন্তা বিকাশের
ভিৎ তৈরিই জরুরি। এ পর্যায়ে সে সামাজিকতায় অভ্যস্ত হওয়ার পাশাপাশি নানা ব্যক্তিগত দক্ষতা
ও উপভোগের বিভিন্ন পথের সাথে পরিচিত হয়, এসবের চর্চা করে। এরপরে হয়ত এসব দক্ষতা সম্প্রসারণের
পাশাপাশি জ্ঞানের নানা শাখার সাথে পরিচয় ঘটবে, ভালো লাগার সম্পর্ক তৈরি হবে। কৃষি,
বাগান, রান্না, সেলাই ইত্যাদি পাঠের চেয়ে হাতে-কলমে চর্চার বিষয়, কিন্তু বাস্তবতা হল
দেশের কয়টি স্কুলে তেমন জায়গা বা সুযোগ আছে? আর পরীক্ষার চাপে পিষ্ট ছাত্র-শিক্ষক কখনই
বা এতসব কর্মমুখী বিষয়ে সময় দেবে? তারা তো
খেলারও সময় পাচ্ছে না।
শৈশবে শিশুর
মধ্যে ভাষার দক্ষতা এবং বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হয়। শিশুকে মৌলিক ভাবনার সাহস জোগাতে
হয়, তার জন্যে প্রয়োজন প্রশ্ন করার সাহস দেওয়া, আবার প্রশ্ন উদ্রেক হওয়ার জন্যে চাই
তাদের কৌতূহল ও অনুসন্ধিৎসাকে জাগিয়ে তোলা। এত সবের ফুরসৎ কি আমাদের শিক্ষায় মেলে?
শিশুর চিন্তাশক্তি ও তা প্রকাশের ক্ষমতা বরং এ শিক্ষা কেড়ে নেয়। ফলে আজ এমন শিক্ষিত
মানুষ পাচ্ছি যারা নিজেরা চিন্তাও করে না তা প্রকাশের প্রশ্নও ওঠে না। তারা কেবল চর্বিত
চর্বণ করে, অন্যের কথা ও শেখানো বুলি আওড়াতে পারে। বুদ্ধির আড়ষ্টতা বা জড়তা যে কোনো
জাতির জন্যে সর্বনাশের কারণ হতে পারে।
আমরা যদি বাংলাদেশের
উন্নয়নের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখব তা মূলত ঘটেছে শিক্ষাবঞ্চিত বা স্বল্পশিক্ষিত
মানুষের শ্রম, উদ্যম ও সৃজনশীলতায়। কৃষি, তৈরি-পোশাক ও অভিবাসী খাতেই মূল আয় আমাদের
আর এ তিন খাতেই খাটেন শিক্ষাবঞ্চিত এবং ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর দল। ডিগ্রিধারী যারা উদ্যোক্তা
বা সফল তাদের সে সাফল্যের পেছনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অবদান ন্যূনতম, অধিকাংশই কাজে
নেমে ঠেকে ঠেকে শিখেছেন। আর সাম্প্রতিক কালে সমাজে একদল উচ্চাভিলাষী ভাগ্যান্বেষী চতুর
মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে যারা যে কোনো মূল্যে ভাগ্য ফেরাতে বদ্ধ পরিকর, তারা বোঝে ক্ষমতা
ও রাজনীতি তাদের সহায় হবে। ফলে তার আশ্রয়ে আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে ধূর্তবুদ্ধির
প্রয়োগে একটি লুটেরা শ্রেণি সমাজকে জিম্মি করে রাখছে। এসব আলামত জ্ঞানভিত্তিক তো নয়,
ন্যূনতম শিক্ষিত সমাজের লক্ষণ নয়, অথচ উন্নয়নে বুঁদ আমরা এই স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছি।
সমাজে ধান্ধাবাজের সংখ্যা বেড়ে চললে মানুষ তার মনুষ্যধর্ম হারিয়ে ফেলে, যদিও প্রাতিষ্ঠানিক
ধর্মের আড়ম্বর বাড়ে।
উন্নয়ন হচ্ছে
ঠিকই, আয়, আয়ু বাড়ছে, সামাজিক খাতের নেতিবাচক সূচকগুলো কমতির দিকে, যোগাযোগ, জ্বালানি,
বিদ্যুতে ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে, উন্নয়নের অনেক প্রকল্প দৃশ্যমান। কিন্তু মানুষ - কবি
আল মাহমুদের ভাষায় - কতদূর এগুলো মানুষ? নাকি মানুষ হিসেবে পিছিয়ে পড়ছি আমরা? মানবিক গুণাবলির
ঘাটতি বাড়ছে না? এর জন্যে শিক্ষা - প্রধানত শিক্ষাকেই দায় নিতে হবে না?
বহুধা বিভক্ত
শিক্ষা পদ্ধতি জাতীয় ঐক্য বা সমদর্শিতার অন্তরায়, পরীক্ষার ফলাফলকেন্দ্রিক শিক্ষা সত্যিকারের
জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে বাধা, আর এরকম অপরিকল্পিত ব্যবস্থা সমাজের প্রান্তিক
ও দুর্বল অংশের জন্যে সহায়ক হতে পারে না। বিষয়গুলো নিয়ে ভাবনা, গভীর ভাবনা প্রয়োজন।
কিন্তু এ কাজে আমাদের উৎসাহ ও দক্ষতায় বরাবর ঘাটতি ছিল, আর এখন পরীক্ষায় সাফল্যের জোয়ারে
এসব বিবেচনা একেবারেই ভেস্তে যাচ্ছে।
***