Saturday, March 4, 2017

স্বাধীন কণ্ঠস্বরগুলো একত্রিত হওয়া দরকার

আবুল মোমেন

ফেব্রুয়ারি মাস গিয়ে মার্চ মাস শুরু হয়েছে। এই দুই মাস আমরা জাতীয় জীবনের অনেক অর্জনের ইতিহাস নিয়ে গর্ব করতে পারি। তবে এর মূল কথা একটি - বাঙালির অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনায় জাগরণ ও ঐক্য গঠন এবং পরিশেষে এই ধারার বিজয় অর্জন।
কিন্তু ২০১৭ সনে এসে দেখছি এ তো ইতিহাস! আমাদের বর্তমান সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন, গণতান্ত্রিক চেতনাও ক্ষয়িষ্ণু, নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এ কথা ঠিক বাংলাদেশের রাজনীতির পশ্চাদাপসরণ শুরু হয়েছে দুই সামরিক শাসকের আমলে। ১৯৯১ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করতে শুরু করে। কিন্তু সেবারে তারা পরাজিত হয়েছিল মূলত অতিআত্মবিশ্বাস ও প্রতিপক্ষকে খাটো করে দেখার কারণে। এর পর থেকে ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সহাবস্থান যে সম্ভব তা প্রমাণ করাই ছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের  একটি মিশন। তাতে সফল হয়েই তারা ২০০৮ এর সুষ্ঠু নির্বাচনে বিপুল বিজয় অর্জন করেছিল। এটুকু বাস্তবসম্মত এবং যথেষ্ট বলে বিবেচিত হতে পারত।
কিন্তু ২০১৮ এর নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ কেন হেফাজতে ইসলামের মত একটি সংগঠনের সাথে প্রকাশ্যে আপস করছে? এতকাল ইসলামি সমাজের মধ্যেও হেফাজতে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা বিশেষ ছিল না, এরা ছিল কওমি মাদ্রাসার আপন বলয়ে সীমাবদ্ধ গোষ্ঠী। মওলানা ফরিদউদ্দিন মাসুদের মত উদারপন্থী জ্ঞানী আলেমসমাজ কখনো তাদের কট্টরপন্থাকে গ্রহণ করেন নি। কিন্তু কোন পর্যায়ের আপস হলে মূলধারার পাঠ্যবইয়ে তাদেরই প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সংস্কার করা হয়, যার সবটাই সাম্প্রদায়িক কিংবা কট্টরপন্থার বিবেচনা থেকেই  করা?
সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে প্রকারান্তরে জামায়াতে ইসলামিকে কোণঠাসা করলেন। বাস্তবতার বিচারে হয়ত এর মূূল্য হিসেবে মুসলিম ভোটারদের এমন বারতা দেওয়া প্রয়োজন ছিল যে তাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দিয়েছেন, তবে ইসলামপন্থীদের নয়। কিন্তু সেটা জানানোর তরিকা কি এই, যে সরকার সাম্প্রদায়িকতা ও কট্টরপন্থাকে প্রশ্রয় দেবেন? ইসলাম কি কট্টর সাম্প্রদায়িক ধর্ম, যেমনটা হেফাজতের নেতারা ভাবেন? ইসলামের উদার মানবিক রূপটি হারিয়ে গেলে বাঙালির ঐতিহ্য এবং ইসলাম ধর্ম দুটিই নানা বিভ্রান্তির শিকার হবে।
উন্নয়ন এখন দৃশ্যগোচর, তার জন্যে সরকারকে কৃতিত্বও দেওয়া যাবে, কিন্তু শিক্ষার মান উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে গেছে, রাজনৈতিক চেতনার ধার ধারছে না কেউ। ফলে সমাজে বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছে। মানুষ বহু ধারায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে না শুধু, তার ভোক্ত সত্তাটাই সব ছাপিয়ে উঠছে। ফলে সমাজে দ্বন্দ্বের সম্পর্ক বাড়ছে, সংঘাত, অপরাধ, দুর্নীতি বেড়েই চলেছে। গভীর উদ্বেগ ও কষ্ট থেকেই বলতে হবে যে চকমিলানো উন্নয়ন ও ঝকঝকে আলোর মধ্যেও মানুষের চেতনার জগতে অন্ধকারের ছায়া বেড়ে চলেছে। এ যেন মানুষের প্রতি তার নিয়তির এক নিষ্ঠুর পরিহাস। সে বোধ অবশ্য কাজ করছে না, এ নিয়ে রাজনীতিবিদরা একদমই ভাবছেন না, বুদ্ধিজীবীরা অসহায় দর্শকে পরিণত হয়েছেন, মানুষের শুভবোধ অকার্যকর হয়ে পড়ছে।
মানবসমাজ ভারসাম্যের ওপরই চলে, তাই কোনো নেশাই তার জন্যে কল্যাণকর নয়, না, উন্নয়নের নেশাও নয়। কারণ তাতে ভারসাম্যহীনতা অর্থাৎ বৈষম্য বাড়ার আশংকা তৈরি হয়। শুধু তা নয়, তখন অকারণেই মানুষের ভোগের আকাঙ্ক্ষা বাড়তে থাকে, সে তৃপ্তি বা সন্তুষ্টির সংকটে ভুগতে থাকে। তখন আবার ধর্মব্যবসায়ী, এমনকি ধ্যানব্যবসায়ী কাজে নেমে পড়েন, এবং তাদের দেখেদেখি আরো নানা রকম ব্যবসায়িক ধান্ধা বাড়তে থাকে। তাতে ভারসাম্যের আরো গোলমাল দেখা দেয়। এসব আলামত আমরা সমাজে প্রকট রূপেই দেখতে পাচ্ছি।
রাজনীতি যদি কেবলমাত্র ক্ষমতায় গিয়ে জনগণকে কিছু সেবা দিতে পারে, ক্ষমতার বাইরে থেকে জনগণের পাশে থাকতে বা জনগণকে নিয়ে অন্যায় বা ভ্রান্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অক্ষম হয় তাহলে এ কারণে রাজনীতি ঘিরে অনুদারতা ও অমানবিক বিকারের জন্ম ঠেকানো মুশকিল। বিএনপি ক্ষমতার বাইরে গিয়ে এই ফাঁদে পড়েছে আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে ভবিষ্যতের জন্যে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে গিয়ে একই ফাঁদে পা দিচ্ছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে আজ ক্ষমতা ও এর সুবিধার বাইরে আওয়ামী লীগেরও কোনো রাজনীতি নেই। আওয়ামী লীগকে তো শিক্ষার হেফাজতিকরণের পক্ষেই সাফাই গাইতে হবে, সুন্দরবন ও রামপালের সহাবস্থানের পক্ষেই বলতে হবে। বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলির দূষণ নিয়েও বলতে পারবে না। কারণ কোন বিষয় কীভাবে সরকারকে বিব্রত করবে তার ঠিক নেই। অতএব রাজনৈতিক কণ্ঠটি কেবল বিএনপির বিরুদ্ধেই বাজানো যাবে - সেটাই ইতিহাসের বিষয়। এভাবে আওয়ামী লীগও তামাদি রাজনীতির খপ্পরে পড়ে যাচ্ছে না তো। যদিও এতে খুব ক্ষতি হবে দেশের। কারণ আওয়ামী লীগের চেয়ে রাজনৈতিক চিন্তাচেতনায় এগিয়ে থাকা দলগুলোও তো ছত্রভঙ্গ, দিশাহীন, দুর্বল আজ। তবে বুদ্ধিমানের কাজ হল যত ক্ষীণ হোক, সঠিক সৎ বক্তব্যে কান পাতা, এ থেকেও শেখারটুকু নেওয়া যায়। অবশ্য ক্ষমতার বদহজম হলে এই রুচিও নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
আমরা যেন পরিস্থিতির নাজুক ও বিপদের দিকটি দেখতে ভুল না করি। কৃষি উৎপাদনে চমকপ্রদ অর্জন, সড়ক সেতু-স্থাপনার উন্নয়নের নিচে যেন এ সত্য ঢাকা না পড়ে যে এদেশে তার শাশ্বত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের বিপরীতে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে, সাম্প্রদায়িকতার থাবা শক্তিশালী হয়েছে এবং বিএনপি জামায়াতকে এবং আওয়ামী লীগ হেফাজতকে লালন করছে। সরকার বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন আপডেট করতে গিয়ে ১৯২৯ এর ঔপনিবেশিক আইনের চেয়ে একধাপ পিছিয়ে গেল। বাস্তবতা হল, আওয়ামীলীগ দৃশ্যপট থেকে সরে গেলে জামায়াত-হেফাজত কট্টরপন্থা স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করবে ও ধর্মের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের পশ্চাদযাত্রা সম্পন্ন করবে।
এটাকে রূপকথাসুলভ বাস্তবতাও বলা যাবে না - সমাজকে খুবলে রক্তাক্ত করার মত ধ্বংসের শক্তির পদধ্বনি শোনা গেলেও উদ্ধারের রাজপুত্র ও তার সঙ্গিসাথী মন্ত্রিপুত্র, সওদাগরপুত্র-কোটালিপুত্ররা কৈ? তাদের দেখা নেই।
দ্রুত বিকল্প স্বাধীন কণ্ঠস্বরগুলো একত্রিত হওয়া দরকার। নিদেনপক্ষে স্বাধীন অবস্থান ধরে রেখে অনবরত বলে যাওয়া দরকার, যেমন পশ্চিমে চমস্কি একক লড়াই চােিয় যাচ্ছেন। এর মূল্য আছে, কারণ শেষ পর্যন্ত মানুষ, বিশেষত সাধারণ মানুষ ও তরুণসমাজ, সত্যকথা ভালোবাসে, সত্যের সৌন্দর্যের কদর করতে জানে। তারা তাদের মত করে কাজ করবে।
এই শক্তি - যা জায়মান বলে ভাবি - ক্ষমতায় যাবে না, কিন্তু ক্ষমতাসীনদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চাপ দেওয়ার জন্যে আওয়ামী লীগ এখনো বিএনপির চেয়ে শ্রেয়তর বিকল্প। তবে কি বিএনপিকেও এই বারতা দিতে হবে যে দেশে একটি মধ্য বা মধ্যডানপন্থী আধুনিক গণতান্ত্রিক দলের চাহিদা রয়েছে, তারা জামায়াতকে ছেড়ে সে জায়গা নিতে পারে। ক্ষমতার জন্যে আওয়ামী লীগ কি তার মধ্যবাম অবস্থা ছেড়ে যাবে? আওয়ামী লীগের শক্তি ছিল তার সংগঠন, সংগঠন সচল থাকে রাজনীতির জোরে, ক্ষমতা বা বিত্তের জোরে নয়। নিচের থেকে রাজনৈতিক চাপ তৈরি হলে দলের জন্যে ভালো হবে, কারণ স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে ক্ষুদ্র দল ও ব্যক্তির ভূমিকা পালনের সুযোগ তৈরি হয় এবং তার চাপে মূল রাজনীতি ও সংগঠন ক্রমে জনমুখী হওয়ার প্রণোদনাও পায়। টেণ্ডর ও দখল নিয়ে কোন্দলে জড়িত জর্জরিত দল গা-ঝাড়া দিয়ে সক্রিয় হতে পারবে কি? কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কি তেমন আলামতকে বিদ্রোহ ভেবে অংকুরেই থামিয়ে দেবে?
এসবও জরুরিভিত্তিতে ভাবার বিষয়