Tuesday, June 14, 2016

সংখ্যালঘুর ঘুরে দাঁড়ানো, শুভ বাংলাদেশের এগুনো

আবুল মোমেন

নাটোরের মুদি দোকানদার সুনীল গোমেজ, টাঙ্গাইলের দর্জি নিখিলচন্দ্র, বান্দরবানের পুরোহিত বৌদ্ধ ভিক্ষু মংশৈউ চাক, ঝিনাইদহের পুরোহিত আনন্দ গোপাল কিংবা পাবনার সেবায়েত নিত্যরঞ্জন পাণ্ডেকে মেরে খুনিরা কি ইসলামি হুকুমত কায়েমের পথের কাঁটা সরাচ্ছে? নাকি সংখ্যালঘুদের মনে ভয় ধরিয়ে তাদের দেশছাড়া করতে চায়?
সংখ্যালঘুদের মনে দেশছাড়ার চিন্তা মাথাচাড়া দেবে সন্দেহ নেই, কারণ পৈত্রিক জান সকলেই বাঁচাতে চান। কিন্তু তাতে ইসলামি হুকুমতের অনুকূলে কী ঘটবে জানি না, তবে বিএনপি ভোটের রাজনীতিতে সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হয়। তা থেকে সরল সিদ্ধান্ত টানা যায় যে এসবের পেছনে বিএনপি-জামায়াতের হাত আছে, যেমনটা বিশ্বাস করেন প্রধানমন্ত্রী এবং বলে থাকেন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। আমরা অবশ্য এত সরল সমীকরণে সত্যের সবটা জানা যাবে তেমন ভাবনায় আস্থা পাই না।
গুপ্তহত্যাগুলোর প্রতিক্রিয়া ভিন্নভাবে হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের জন্যে বংশের ভিটেমাটি ছেড়ে দেশান্তরি উদ্বাস্তু হওয়া এত সহজ নয়। এর মধ্যে বিরাট ঝুঁকি ও চরম অনিশ্চয়তা রয়েছে। পূর্ববর্তীদের এসব ভোগান্তির কাহিনি তাদের অজানা নয়। ফলে, এখন ভাবার সময় এসেছে এভাবে পরে পরে মার খাওয়ার সময় এটা নয়, তার ভবিতব্য জান নিয়ে পলায়ন নয়, বরং জানমাল রক্ষার জন্যে মুখোমুখি লড়াই করা। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আত্মরক্ষার চূড়ান্ত লড়াই চালাতে হয়, যা আক্রমণাত্মক হয়ে পড়তে বাধ্য। হয়ত সেদিকে উশকানি দেওয়া হচ্ছে যাতে দেশে সাম্প্রদায়িকতা ইন্ধন পায়।
সংখ্যালঘুদের নেতৃবৃন্দ এটা বোঝেন। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত ১৪ দলীয় জোটের সাথে বৈঠকে যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন তাতে এটা বোঝা যায়। স্বভাবতই সন্ত্রাসী ঘাতকদের রুখে দাঁড়াতে হলে তাঁদের পাশে কাদের পাচ্ছেন সেটা প্রথম বিবেচ্য বিষয় হবে। এটাও স্বাভাবিক যে এক্ষেত্রে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তাঁরা আওয়ামী লীগকেই পাশে প্রত্যাশা করেন।
একাত্তরে গোটা হিন্দু সম্প্রদায় হানাদারদের লক্ষ্যস্থল হয়েছিল আওয়ামী লীগকে একচেটিয়া ভোট দেওয়ার কথিত অপরাধের কারণে। স্বাধীনতার পরেও দেশ যেভাবে চলছে তাতে এখনও জামায়াত ও অন্যান্য কিছু ধর্মান্ধ দলের সাথে জোটবদ্ধ বিএনপিকে সংখ্যালঘুদের ভোট দেওয়ার স্বাভাবিক কোনো কারণ নেই। গয়েশ্বরচন্দ্র বা নিতাই চৌধুরীদের নিয়মের ব্যতিক্রম ধরা হয়, যদি নিপাতনে সিদ্ধও হন তবুও। ফলে জনধারণাটা এরকমই থেকে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে নির্বাচনকেন্দ্রিক হাঙ্গামার শিকার হয়ে মার খেতে খেতে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হতে হতে হিন্দু সম্প্রদায় বিশেষভাবে এবং সাধারণভাবে সংখ্যালঘুমাত্রই নির্বাচনের প্রতি বিমুখ হয়ে পড়ছে। হয়ত এই বাস্তবতা দেখে কবরের মধ্যে পিতাপুত্র ফজলুল কাদের চৌধুরী ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী নড়েচড়ে উঠবেন। কারণ বাস্তব জীবনে নির্বাচনে এমন বাস্তবতাই তো তাঁদের কাম্য ছিল।
তবে সংখ্যালঘু ঘুরে দাঁড়ালে ভোট দিয়েই ঘুরে দাঁড়াবে। মর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করেই বাঁচতে চাইবে। ঐক্য পরিষদ নেতারা ন্যায্যতই আওয়ামী লীগ, ১৪ দলীয় জোট এবং দেশের প্রগতিশীল সকল শক্তির কাছে এই সহযোগিতা কামনা করে যে তারা আক্রান্ত হলে এঁদের পাশে পাবে এবং রুখে দাঁড়ানোর ও ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামে সহশক্তি হিসেবে পাশে থাকবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এ বাবদ তাদের অভিজ্ঞতা খুব ভালো নয়। এ পক্ষের একক বৃহৎ দল আওয়ামী লীগ আর আগের উদার মানবিক রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী মানুষের দল নেই - যদিও নেত্রীসহ উপরের দিকে এখনও কিছু নেতা এই ধারার ঐতিহ্য বহন করেন। এখন যারা সারা দেশে দলটিকে প্রতিনিধিত্ব করে তারা নব্য ধনী, উচ্চাভিলাষী ক্ষমতা লোভী, স্থানীয়ভাবে আধিপত্য বিস্তারে ব্যস্ত এবং বৈধ-অবৈধ পথে অর্থোপার্জনে লিপ্ত। অভিযোগ আছে শত্রু সম্পত্তি, এমনকি হিন্দুদের ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি দখল করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা, সমর্থকরাই এগিয়ে আছে। ইদানীং ক্ষমতাসীন দলে নানা মতপথের সুবিধাবাদী মানুষ ভিড়ে যাচ্ছে যারা উদার মানবতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাস তো করেই না অনেকেই মতাদর্শের দিক থেকে বিএনপি-জামায়াত শিবিরেরই মানুষ। ফলে আজ কারো আওয়ামী লীগ পরিচয় পেলেই আশ্বস্ত হতে পারে না কেউ। আর মাঠ পর্যায়ে ঘটনা ঘটার সময় তাদের ভূমিকা সত্যিই হতাশাজনক। রামুর বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা, সিলেটে দেবোত্তর সম্পত্তি দখলপ্রয়াসসহ সারা দেশে এরকম সংখ্যালঘু নির্যাতনের ও সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখলের ঘটনায় বারবার আঙুল উঠেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের দিকে। ফলে অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত যখন আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতাসীন জোটকে  পাশে না দাঁড়ানোর অনুযোগ করেন তখন সেটা কেবল হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আদিবাসীদের মনের কথা নয়, শুভ বাংলাদেশে বিশ্বাসী সকল মানুষেরই অন্তরের কথা।
একথা ঠিক, এদেশে এযাবৎ যত ইতিবাচক প্রগতিশীল আন্দোলন হয়েছে তা শেষ পর্যন্ত যৌক্তিক পরিণতি পেয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বা দায় গ্রহণ করার পরে। ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকের গণতন্ত্রের আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, পুনরায় স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন ইত্যাদি সবই বরাবর শুরু করেছে বামপন্থী দল ও সামাজিক শক্তি আর তার পরিণতি দেওয়া থেকে সমাপ্তি টানার কাজ হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। ফলে আজকের সংকটকালে একজন সংখ্যালঘু মানবাধিকার কর্মীর মুখে আওয়ামী লীগের প্রতি অভিযাগ ওঠা স্বাভাবিক। তাঁর অন্তরের কথাটি এদেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন অধিকাংশ মানুষের মনের কথা। আজ দেশ যে এত উন্নয়নের মধ্যেও রাজনৈতিকভাবে পথ হারাতে বসেছে তার কারণ আওয়ামী লীগ নিজেই রাজনৈতিক আদর্শের পথ হারিয়ে ফেলেছে। তার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের ধর্মহীনতার মিথ্যা প্রচারণা ঠেকাতে গিয়ে ক্রমেই নিজেরাই রাজনীতিতে ইসলামের ব্যবহার বাড়িয়েছে, পথ খুলে দিয়েছে ধর্মান্ধ মানুষদের নির্বিবাদে দলে অনুপ্রবেশের জন্যেও। তারাই আজ জেলা ও স্থানীয় পর্যায়ে দেশের বৃহত্তম উদার মানবিক গণতান্ত্রিক দলটির প্রতিনিধিত্ব করছে। দেশজুড়ে তাদের যে ভূমিকা তাতে বলতেই হয় আওয়ামী লীগ আজ সর্বাংশে না হলেও বহুলাংশে পথ হারিয়েছে। আর সে কারণেই বাংলাদেশে ধর্মান্ধ ও ধর্মব্যবসায়ীদের রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠার পথ সুগম হয়েছে।
আমরা মনে করি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার মত ঐতিহাসিক কাজ সম্পন্ন করার পাশাপাশি আজ দেশের স্বার্থে ও জনকল্যাণে আরও একটি ঐতিহাসিক দায় মেটানোর দায় এসে পড়েছে আওয়ামী লীগের ওপরই। দীর্ঘদিন ধরে একতরফা অবাধে কাজ চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে ধর্মান্ধ জঙ্গি শক্তি সমাজে নিজেদের জন্যে সামাজিক নিরাপত্তা-বাতাবরণ তৈরি করে নিতে পেরেছে। আর তাই তারা এত সহজে টার্গেট-হত্যা সম্পন্ন করে নিরাপদে সরে যেতে পারছে। সামাজিক আশ্রয় প্রশ্রয় ছাড়া এটা সম্ভব হত না।
ফলে এ ব্যাধি থেকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিকে রক্ষা করে সকল ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষকে নিয়ে গণতান্ত্রিক পথে দেশ পরিচালনার জন্যে সামাজিক শক্তিগুলো থেকে আন্দোলনমুখী কাজ শুরু হওয়া দরকার। যার জন্যে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয়  জোটসহ সকল প্রগতিশীল ও বামদলের সক্রিয় অংশগ্রহণ আজ সময়ের দাবি। আমরা আশা করি আওয়ামী লীগ একদিকে এই সামাজিক উদ্যোগগুলোকে স্বত:স্ফূর্তভাবে গড়ে উঠতে দেবে এবং অন্যদিকে যথাযথভাবে ও যথাসময়ে তাতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে সংকট মুক্ত করবে।
***