Monday, July 8, 2013

প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে সঠিক ক্রিয়ার পথ খোলা

আবুল মোমেন

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল আগের চারটির ধারাতেই হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লাহ খান আগে কখনও নির্বাচনে পরাজিত হন নি, আর গাজীপুরও আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল।
একই দিনে অনুষ্ঠিত দেশের অন্যান্য জায়গায় তিনটি মেয়র নির্বাচনের একটিতে বিএনপি প্রার্থী ও অন্য দুটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। এই ধারাটি শুরু হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচন থেকে।
তবুও সবটা মেলালে বলা যাবে না যে দেশে বিএনপির পক্ষে হাওয়া উঠেছে। কিন্তু এটা নিশ্চিত, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমেছে ভোটারদের মনে। তারই প্রতিফলন ঘটছে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে, আর তাতে আওয়ামী লীগ হারছে, বিএনপি জয়ী হচ্ছে।
যদি তুলনামূলক আলোচনা করা যায় তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যাবে বর্তমান সরকার তার পূর্ববর্তী সরকারের চেয়ে অনেক বেশি ও ভালো কাজ করেছে। এমনকি বিএনপি মনোভাবাপন্ন অনেক ভোটারও ব্যক্তিগত আলাপে বলেছেন চার সিটি মেয়রের মধ্যে অন্তত দু’জন স্ব স্ব শহরের উন্নয়নে কাজ করেছেন বলে তাঁরাও ভিন্ন মতের এসব প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু তারপরেও তাঁদের পরাজয় ঠেকানো যায় নি।
দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগের ইতিবাচক অর্জনকে নেতিবাচক ‘অর্জন’ চাপা দিয়ে দিয়েছে। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে সরকার প্রধান ও তাঁর দলের আক্রোশমূলক ভূমিকা জনগণ পছন্দ করে নি। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হল সুযোগ থাকলে যে কোন গৌরবের ভাগীদার হওয়া। সরকার এ জনমনস্তত্ত্বের বিপরীতে চলেছে। পদ্মা সেতু হোক এটাই জনগণ কামনা করেছিল, তাই এটি দীর্ঘায়িত ও অনিশ্চিত হওয়ায় মানুষ সরকারের ওপর বিরক্ত হয়েছে। হলমার্ক কেলেংকারিসহ ডেস্টিনি, ইউনিপে বা স্টক মার্কেটের বিপর্যয়ে সরকার বুদ্ধিমত্তার সাথে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান দিতে পারে নি। ইসলাম ও আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলেম ও অ্যাকাডেমিক পরিমণ্ডলে অনেক বিতর্ক হয়, কিন্তু এসব বিষয় আম জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ এরকম একটি নাজুক বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ থেকে জনগণকে খেপিয়ে তোলার রসদ পেয়ে গেছে ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতিকরা। সব মিলে মানুষের প্রতিক্রিয়াকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চালিত করার মত রসদ ও জ্বালানি ধীরে ধীরে সঞ্চিত হয়েছে সাধারণের মধ্যে।
ফলে বলা যায়, সাম্প্রতিক স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে এই প্রতিক্রিয়ার বহি:প্রকাশ আমরা দেখছি। ঘুরে দাঁড়াতে হলে আওয়ামী লীগকে নির্ভর করতে হবে মানুষের শুভবুদ্ধিজাত ক্রিয়ার ওপর। প্রতিক্রিয়ার প্রতিবিধানে সঠিক ক্রিয়াই ঔষধ।

- কী হতে পারে সঠিক ক্রিয়া?
প্রথম কাজ শত্র“ কমানো, এবং দ্বিতীয় কাজ বন্ধু বাড়ানো। যাদেরকে দূরে ঠেলা হয়েছে, পর বানানো হয়েছে তাদের সাথে সংযোগ ও আস্থার সম্পর্ক তৈরির কাজ শুরু করতে হবে। যারা বন্ধু ছিল তাদেরকেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দূরে ঠেলেছে। এরশাদ বা জোটের অন্যান্য শরিকদের যথার্থ মর্যাদা ও গুরুত্ব দেওয়া হয় নি, দলের মধ্যে যাদের কণ্ঠস্বরে স্বাধীন সত্তার পরিচয় মেলে তারা উপেক্ষিত হয়েছেন, এমনকি যেসব বুদ্ধিজীবী-সংস্কৃতিকর্মীর ভূমিকা বরাবর আওয়ামী লীগের অনুকূলে তাঁদের সামান্য সমালোচনা সইতে না পেরে ঢালাওভাবে তাঁদেরও দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
তার ওপর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডহীন আওয়ামী লীগের নামে দৃশ্যমান কাজ হচ্ছে ছাত্র-যুবলীগের টেণ্ডারবাজী-দখলদারির প্রতেযোগিতা - যা জনসমাজকে শংকিত, বিচলিত করে চলেছে। সব মিলে সুশাসন ব্যাহত হয়েছে।
জনগণের আবেগ ও মনস্তত্ত্বকে বুঝতে পারাই হল রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রথম কাজ। পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে তারা ক্ষমতাসীন সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট। সে অসন্তুষ্টির প্রকাশ ঘটাচ্ছে ভোটের মাধ্যমে। এই নেতিবাচক কাজটি বিএনপির জন্যে ইতিবাচক হয়ে আসছে। জনগণ ব্যাপক হারে বিএনপিপন্থী হয়ে গেছে তা নয়, মূলত এটা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রত্যাখ্যানের ভোট। বিএনপির জন্যে এটাকে কাজে লাগানো সহজ, তবে তা টেকসই ও সুদূরপ্রসারী কোনো ফল দেবে না। টেকসই ও সুদূরপ্রসারী যে ভালো ফল মিলছে তাহল সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশনের সামর্থ্য। আমরা বোধহয় ভোট জালিয়াতির পর্ব পেরিয়ে এসেছি।
মুশকিল হল রাজনীতিতে প্রতিক্রিয়ার তীব্র বহি:প্রকাশ ঘটার কারণে আমাদের দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সহজে আসবে না। যে দল জনগণকে ইতিবাচকভাবে সক্রিয় করে রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশীদার করতে পারবে তারাই শেষ পর্যন্ত দেশ ও গণতন্ত্রের উপকার করতে পারবে। তাই রাজনীতিতে জনগণের ভাবাবেগকে পুঁজি করার দিনকে পিছনে ফেলে তাদের ভাবনাচিন্তা ও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের পথ তৈরি করতে হবে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে যত রকম পাব্লিক ফোরাম আছে সেগুলো সক্রিয় থাকা, তাদের ভালোকথা ও কাজকে গ্রহণ করার ব্যবস্থা থাকলে সে রাজনীতি অবশ্যই এগিয়ে যাবে। ক্ষমতান্ধ রাজনীতি তো আবদ্ধতা তৈরি করে যা জনবিচ্ছিন্নতা ঘটায়। এর পরিণতি কারও জন্যেই শুভ হতে পারে না।