Wednesday, July 9, 2014

পার্বত্য চট্টগ্রাম: শান্তির সন্ধানে

আবুল মোমেন

ব্রিটিশ শাসকরা ১৮৬১ সনে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ এলাকা ঘোষণা করেছিল। বিশেষ এলাকা দুটি কারণে -১. এর বৈচিত্রপূর্ণ প্রকৃতি যেখানে পাহাড় আর অরণ্য রয়েছে জীববৈচিত্রের ভাণ্ডার হিসেবে এবং ২. জনবৈচিত্র যা ১১টি উপজাতির স্ব-স্ব সাংস্কৃতিক বৈচিত্র নিয়ে বিশিষ্ট। এই জনগণ মূলত অরণ্যচারী এবং মূলধারার নাগরিক সংস্কৃতির বাইরে নিজ নিজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বহন করে নিভৃত জীবনে অভ্যস্ত। এদের জীবনাচার ও সংস্কৃতি সমভূমির কৃষিসমাজের পূর্ববর্তী কালের। সে অর্থে তুলনামূলকভাবে প্রাচীন কিংবা আদিম। এর মধ্যে আকস্মিকভাবে এবং গুণগতভাবে যদি ভিন্ন জীবনাচারে অভ্যস্ত মানুষজনের ব্যাপক আনাগোনা ও বসবাস শুরু হয় তাহলে দুই কালিক সংস্কৃতি, যা প্রায় মৌলিকভাবেই বিপরীত, তার মধ্যে সংঘাত দেখা দেবে।
এই মৌলিক বৈপরীত্য সম্পর্কে দুটি কথা বলা যায়। সমভূমির মানুষের কৃষিসমাজ গড়ে উঠেছে বন কেটে আবাদ করার নীতির ভিত্তিতে। কেবল বন কাটা নয়, কৃষিসমাজের মানুষের লক্ষ্য থাকে যে কোনা জমিকে -তা বন হোক, নতুন জাগা চর হোক কি এবড়োথেবড়ো পতিত জমি হোক সেগুলোকে আবাদযোগ্য করে তোলা। বিপরীতে পাহাড়ী অরণ্যে বসবাসকারী ক্ষুদ্রজাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা প্রকৃতির সাথে সহবাসে অভ্যস্ত, একে মৌলিকভাবে পাল্টাতে তারা নারাজ। ফলে এদের হাতে বন-সম্পদ যুগ যুগ ধরে রক্ষা পেয়ে এসেছে। অনেকেই মনে করেন জুম চাষে পাহাড়ে যে আগুন দেওয়া হয় তাতে বনসম্পদ নষ্ট হয়। আসলে অরণ্যাচারী জনগোষ্ঠী বরাবরই প্রাকৃতিক সম্পদের তুলনায় সংখ্যায় অল্প থাকে, ফলে তাদের এ ঐতিহ্যবাহী চাষপদ্ধতি প্রয়োজনীয় ফসল ফলানোর পাশাপাশি বনভূমিকে উর্বর করার পদ্ধতিও বটে। তাই শত বছরের ইতিহাস থেকে দেখা যায় এ অঞ্চলে কৃষিসমাজের বাঙালির ব্যাপক আবাসনের আগে বনভূমি বিনষ্ট হওয়ার রেকর্ড নেই। বন ও প্রাকৃতিক সম্পদ বাঁচিয়ে জীবনধারনের এ তাদের সহজাত শিক্ষা। কিন্তু কৃষিজীবী মানুষ বনকে আপদ মনে করে আর সবধরনের পশুকেই হিং¯্র ও বিপজ্জনক ভাবে। ফলে দুটিরই বিনাস তার সহজাত অভ্যাস।
দ্বিতীয় বৈপরীত্যের বিষয়টিও মৌলিক। অরণ্যবাসীর জীবনে ও মননে প্রকৃতিই সবকিছুর আধার ও নিয়ন্তা। ফলে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি তার মনোভাব ভক্ত বিশ্বাসীর এবং এর পূজা করেই সে শান্তি পায়। তৌহিদি ধর্মের মানুষের মানস এর বিপরীত। ফলে বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক উভয় সংস্কারেই বৈপরীত্য বিদ্যমান।
এই বৈপরীত্যের কারণে প্রাকৃতিক সম্পদের গুরুত্ব এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্ব বিবেচনায় নিলে কেবল পার্বত্য জেলা নয় অন্যান্য সমভূমির বনাঞ্চল বা স্বকীয় প্রাকৃতিক পরিবেশে অভ্যস্ত সকল ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবনব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ ঘটানোর মত যেকোনো কাজের আগে দশবার ভাবা দরকার। এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল নিয়ে ভাবতে হবে বিশেষভাবে।
২.
আমরা কিছুতেই অস্বীকার করতে পারব না যে বাংলাদেশ কেবল একটি জনবহুল দেশই নয়, এখানে ভূমির তুলনায় জনসংখ্যার চাপ অনেক বেশি। সে কারণেই কৃষিভিত্তিক দেশ হিসেবে এদেশে খাদ্যাভাব ও দারিদ্র লেগেই ছিল। আধুনিক প্রযুক্তি ও  উপকরণের ব্যবহার বাড়িয়ে খাদ্যাভাব দূর করা গেছে, কিন্তু দারিদ্র্য এখনও আমাদের বড় সমস্যা। অর্থনীতি ও মানুষের পেশায় পরিবর্তন ঘটছে। শ্রমজীবী মানুষ বিদেশে যাচ্ছে, প্রান্তিক নারীরা দলে দলে তৈরি পোশাক শিল্পসহ নানা কাজে যুক্ত হচ্ছেন। শিক্ষার হার বাড়ছে,স্বাস্থ্য সচেতনতা ও সুযোগসুবিধা বাড়ায় গড় আয়ু ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে, দারিদ্র কমছে। কিন্তু জমি বনাম জনসংখ্যার সংকট কমানোর উপায় নেই - কারণ জমি স্থিতিশীল আর জনসংখ্যা বর্ধিষ্ণু।  তিনটি মূল কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বাস্তচ্যুত হচ্ছে - ১. প্রাকৃতিক কারণ, যেমন নদী ভাঙন বা সিডরের মত দুর্যোগ, ২. দারিদ্র, যে কোনো পারিবারিক দুর্যোগ বা উৎসবে তাদের সহায় সম্বল বিক্রি করতে বাধ্য হয় প্রান্তিক মানুষ এবং ৩. আকস্মিকভাবে বিত্তবান হয়ে ওঠা মানুষ ও নতুন গজিয়ে ওঠা আবাসন শিল্পের উদ্যোক্তাদের প্রলোভন ও চাপে দরিদ্র মানুষ জমি হারাচ্ছে। ফলে মাথা গুঁজবার ঠাঁই খুঁজতে গ্রামের বাস্তচ্যুত এবং স্বল্পায়ী ও বেকার মানুষ বিপদ আপদ ভবিষ্যত কিছু নিয়েই ভাববার অবকাশ পায় না। তার কাছে বর্তমান এক নির্মম ও কঠিন বাস্তবতা। এর ফল হিসেবে আমরা দেখি যে-চর মাত্রই সমুদ্র থেকে জাগছে, যেখানে এখনও জোয়ার ভাটার খেলা চলে, যে জমি দিনে দু’বার জোয়ারে সম্পূর্ণ তলিয়ে যায় সেখানেও মানুষ মাচাঘর তুলে বসবাস শুরু করে দিচ্ছে। সুন্দরবনের বাঘ-কুমীর-সাপের সঙ্গে লড়ে বসতি করছে, নোনা পানির মধ্যে ঘর তুলছে, চট্টগ্রাম শহরে পাহাড়ের পাদদেশে ধসের ঝুঁকির মধ্যে সংসার পাতছে। আর শহরের ফুটপাথে, রেললাইনের ধারে, যেকোনো পতিত জমিতে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে শোয়ার জায়গা করে সপরিবারে দিন গুজরান করছে। যেদেশে প্রায় চল্লিশ ভাগ মানুষ এরকম বসতি সঙ্কটে আছে তাদের জন্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ছয় হাজার বর্গমাইলের বিস্তীর্ণ তিনটি জেলা একটা আকর্ষণীয় জায়গা হিসেবে বিবেচিত হওয়া স্বাভাবিক। নতুন-জাগা চর, পাহাড়ের পাদদেশ বা বাঘ-কুমীর অধ্যুষিত অরণ্য বা মহানগরের ফুটপাত, রেললাইনের ধারের চেয়ে এ অঞ্চল তাদের বেশি পছন্দের জায়গা হওয়াই স্বাভাবিক।
মানুষের মৌলিক পাঁচটি চাহিদার মধ্যে বাসস্থানের অধিকার অন্যতম। সরকার এ অধিকার পূরণের দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না। তাদের মাথায় বিপন্ন মানুষের পুনর্বাসনের জন্যে নানা বিকল্পের মধ্যে নিশ্চয় পার্বত্য অঞ্চলের কথাও এসেছে এবং সেভাবে কাজ হয়েছে।
তবে পার্বত্য অঞ্চলে প্রথম ব্যাপক হারে সরকারি উদ্যোগে বাঙালি বসতিস্থাপনের পেছনে অন্য উদ্দেশ্য ছিল। ১৯৭৯-৮০-৮১’র দিকে জেনারেল জিয়া এ কাজ শুরু করেছিলেন মূলত শান্তিবাহিনীর তৎপরতা বন্ধের দীর্ঘমেয়াদী প্রতিকার হিসেবে। উদ্দেশ্য ছিল পাহাড়ে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীকে ছাপিয়ে বাঙালি জনসংখ্যা বাড়ানো। তাঁর অনুসৃত নীতি পরবর্তী পনের বছর ধরে  জেনারেল এরশাদ ও বেগম জিয়ার সরকার পালন করে গেছে। এর ফলে সত্যি সত্যিই পাহাড়ে জনসংখ্যার ভারসাম্য পাহাড়ীদের প্রতিকূলে চলে গেছে। বর্তমানে মোট জনসংখ্যা সম্ভবত পাহাড়ী-বাঙালি ৪৮:৫২ হয়ে গেছে, যা স্থানীয় অধিবাসী হিসেবে পাহাড়ীদের পক্ষে মানা কঠিন।
৩.
এবারে আমাদের বুঝতে হবে এর ফলাফলটা কী হল। মনে রাখতে হবে ১৯৭৯-৮০’র আগে দীর্ঘদিনে স্বাভাবিক নিয়মে পাহাড়ে সমভূমি বাঙালিদের যে বসতি গড়ে উঠছিল তাতে কোনো সংকট হয়নি। তারা পরস্পর মিলে মিশে বসবাস করেছে। কিন্তু এবারে দুটি কারণে সংকট তীব্র হল। প্রথমত, পাহাড়ে বাঙালি অভিবাসনের সরকারি নীতির পিছনে এমন একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল যাকে স্বাধিকারের জন্যে সংগ্রামরত জনগোষ্ঠীর কাছে সরকারের একটি হীন চক্রান্ত বলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক। বাস্তবে তাই হয়েছে এবং এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঠেকানো যায় নি। দ্বিতীয়ত, অল্পসময়ে যে ব্যাপক বাঙালিকে পরিকল্পিতভাবে সেখানে বসতির ব্যবস্থা করা হয়েছে তাদের অধিকাংশের পেশাগত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র ছিল কৃষি। প্রথম অধ্যায়ে কৃষিসমাজের যেসব বৈশিষ্ট্য-প্রবণতার কথা বলা হয়েছে তা এখানে ঘটেছে। পাশাপাশি কৃষি শিল্পের বিকাশের জন্যে সরকার বাঙালিদের নির্বিচারে জমি বরাদ্দ দিয়ে সংকট ঘনীভূত করেছে। এতে একেবারে এই বাস্তব ভূমি-সংকটের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণ একটা গভীর বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক সংঘাতের সম্মুখীন হল। প্রকৃতিভিত্তিক সরল এবং আদিম। জীবনসংস্কৃতিতে অভ্যস্ত জনগোষ্ঠী প্রকৃতি-উদাসীন বা প্রকৃতি শাসনে অভ্যস্ত সাকার পূজা বিরোধী জটিল প্রবল সংস্কৃতির চাপের মধ্যে পড়ে যায়। তাদের ঐতিহ্যবাহী জীবনব্যবস্থা, খাদ্যোৎপাদন পদ্ধতি, নিভৃত জীবনযাপন, স্বাধীন মুক্ত জীবনের অভ্যাস আকস্মাৎ ভেঙে পড়েছে। তারা ভূমি হারিয়েছে, খাদ্য সংকটে পড়েছে এবং সবচেয়ে বড় কথা নিভৃতের মুক্ত জীবনের অধিকার খুইয়েছে। সবটা মিলে এটি তাদের জন্য বড় রকমের আঘাত।
৪.
আমাদের মনে হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে জনসংখ্যা ভারাক্রান্ত সমভূমির ভূমিহীন মানুষের কিছু অভিবাসন হওয়া অযৌক্তিক নয়। কিন্তু তা হতে হবে পার্বত্য অঞ্চলের স্থানীয় অধিবাসীদের নেতৃবৃন্দের বা নির্ভরযোগ্য জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটির মতামত নিয়ে। এ ব্যবস্থাটি  সামগ্রিকভাবে দেশের জন্যে প্রয়োজনীয় বনাঞ্চল সংরক্ষণের পাশাপাশি মূল্যবান জীববৈচিত্র্য, পরিবেশের ভারসাম্য ও জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় সহায়ক হবে। অর্থাৎ পার্বত্য অঞ্চলে সমভূমির বাঙালি অভিবাসন হবে, কিন্তু তা হতে হবে পরিকল্পিতভাবে স্থানীয় মানুষের সম্মতিতে এবং প্রকৃতি, পরিবেশ ও স্থানীয় মানুষের কৃষ্টি-ঐতিহ্য রক্ষার জন্যে কিছু শর্তের ভিত্তিতে। একমাত্র এভাবেই এ অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে হয়।