Saturday, July 2, 2016

ক্ষমতা ও ভীতির রাজনীতির ফাঁদে গণতন্ত্র ও দেশ



আবুল মোমেন

গুপ্তহত্যা সমাজে সব ধর্মের সব স্তরের মানুষের মধ্যে একটা আতঙ্ক যে ছড়িয়ে দিয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু সমাধানের ক্ষেত্রে আর দশটা রাজনৈতিক ইস্যুর মত এ বিষয়েও গোটা সমাজ চেনা ফর্মুলার মধ্যে আটকে যাচ্ছে। ফর্মুলাটা সত্যিই সবার অতিচেনা - ইসলামি জঙ্গিবাদীরা এসব ঘটাচ্ছে আর তাদের মদত দিচ্ছে বিএনপি-জামায়াত জোট। না, এর ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর কিছু নেই, এতে সত্যতা অবশ্যই আছে।
কিন্তু মুশকিল হল এ ফর্মুলায় সত্যতা থাকলেও তা কোনো সমাধান দিতে পারে না। যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতকে কাঠগড়ায় তুলে কিছু অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া যাবে, এমনকী হয়ত জামায়াতকে নিষিদ্ধও করা যাবে। কিন্তু তাতে মুক্তিযুদ্ধের ও ইতিহাসের দায় চুকানো হবে, ধর্মীয় কট্টরপন্থার রাজনীতি শেষ হবে না। ক্রসফায়ারের মাধ্যমে কিছু অপরাধী জঙ্গিকে পাল্টা খুন করেও কি জঙ্গিবাদের যুক্তিকে পরাস্থ করা যাবে? তাদের ডাকে কিছু মানুষের সাড়া দেওয়ার বাস্তবতা পাল্টে যাবে? জামায়াত-বিএনপিকে শায়েস্তা করতে গিয়ে সরকার বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে হেফাজতের দিকে - অর্থাৎ একইরকম বা অধিকতর ধর্মীয় কট্টরপন্থার দিকে। তাবলীগ জামায়াত ধর্মীয় চরমপন্থা চর্চা না করলেও নিবিঘ্নে যা প্রচার করছে তা গোঁড়া ধর্মীয় মতাদর্শ এবং তাতে বর্তমান বাস্তবতায় ধর্মীয় চরমপন্থাই মদত পাবে।
ক্ষমতাবান ও ক্ষমতার প্রসাদভুক্তদের নিরাপত্তা কোনো ব্যবস্থার সাফল্য কি গৌরব কোনটাই প্রকাশ করে না। কারণ কেবল সেই ব্যবস্থাই কাম্য যেখানে ক্ষমতাহীনও নিরাপদ। সরকার বা কোনো পক্ষই আপাতত সেই ব্যবস্থার কথা ভাবছে না। নয়ত সকলকে নিরাপত্তা প্রদানে অপরাগতা প্রকাশ করত না সরকার।
আপাতদৃষ্টিতে এটা বিএনপির বেকুবি যে তারা মধ্যপন্থার রাজনীতির সুযোগ হাতছাড়া করে জামায়াত ও অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলের সাথে মৈত্রী গড়ে নিজেদের ঘাড়ে অন্যের অর্থাৎ কট্টরপন্থীদের অপরাধের দায় তুলে নিচ্ছে। কেন তারা এটা করছে? কারণ তারা দেখছে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে দোষী শাব্যস্ত করলেও হেফাজতের মত অন্য কট্টরপন্থীদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করছে। এমনকি সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে বিএনপিকে ছাপিয়ে অধিকতর ধার্মিক এবং ধর্মের বিষয়ে প্রায় গোঁড়া মতাদর্শীদের মতই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। নিজের পিঠে ধর্মনিরপেক্ষতার ছাপ নিতে আওয়ামী লীগ একবিন্দুও রাজি নয়। তাহলে তারা কী করে মুক্তচিন্তার পরিসর ও ব্যক্তিদের রক্ষা করবে? হ্যাঁ, বাংলাদেশের জনমানসের দ্বিপক্ষীয় যে বিভাজন তাতে সঙ্গতকারণেই মুক্তচিন্তা ও প্রগতিচেতনার মানুষজন জামায়াত-সংশ্লিষ্ট বিএনপির সাথে যেতে পারে না, তাদের থাকতে হবে আওয়ামী লীগের সাথেই। কিন্তু নিশ্চয় তারা উত্তরোত্তর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কিছু নেতার বাইরে সারাদেশে সর্বস্তরে এ দলের নেতা-কর্মীদের সংস্কৃতির মধ্যে রূপান্তর ঘটছে, বাঙালির চিরায়ত মানবিক সংস্কৃতির চর্চার ক্ষেত্রগুলোতে এরা যেন আগন্তুক, তাদের মনোযোগের ক্ষেত্র প্রধানত বিত্তার্জন এবং সেই সাথে ধর্মীয় সংস্কৃতির মূলস্রোতের গড্ডলিকায় গা ভাসিয়ে রাখা। এরা সমাজপরিবর্তন বা সমাজপ্রগতির পথে অন্তরায় হওয়াই স্বাভাবিক।
বাঙালির যে সমাজ একদিন ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে অসাম্প্রদায়িক উদার মানবিক সংস্কৃতি ও রাজনীতির পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল তার এই দশা কীভাবে হল? আমাদের  চোখের সামনেই তো এটা ঘটল। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখার জন্যে পাকিস্তানি ধারার রাজনীতি ও আনুষঙ্গিক সংস্কৃতি ফিরিয়ে এনেছিল। তাদের নিজস্ব কোনো রাজনৈতিক দর্শন ছিল না - এ ছিল আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তির হাতে ক্ষমতা সংহত করার কৌশল।
স্বভাবতই মাঠে আওয়ামী লীগ বিরোধী সবচেয়ে সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি জামায়াতকে তারা মিত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ অর্থনীতির যোগসাজশে আশির দশক থেকে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো দ্রুত সমাজে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ক্ষমতার বিচারে এটি আওয়ামী লীগের দু:সময়, কিন্তু তখন সমাজ থেকে প্রগতিপন্থী সকল সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং বামদলগুলো বিএনপি-জাপার স্বৈরশাসন বিরোধী ব্যাপক আন্দোলন চালিয়ে গেছে। এ সময় এদের সাথে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। ফলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে থাকলেও সমাজে তাদের রাজনীতি এবং অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতির ধারাটিই ছিল মূলধারা, তাই শক্তিশালী। ওরা ক্ষমতা আঁকড়ে ছিল নিছক স্বৈরাচারী জবরদস্তির মাধ্যমে। ঐ সময় একাধিক নির্বাচনেও এটা পরিস্কার বোঝা গেছে ক্ষমতাসীনদের কারসাজিতে জনপ্রিয় ধারার পরাজয় ঘটছে।
দুর্ভাগ্যের বিষয় নব্বইয়ের গণআন্দোলনের বড় দুর্বলতা ছিল এর মাধ্যমে বিএনপি গণতান্ত্রিক দলের মর্যাদা পেয়ে যায় আর আওয়ামী লীগ ভোটের রাজনীতির জন্যে দলের নীতিতে রূপান্তর ঘটাতে শুরু করে। তবে তখনও সমাজে আওয়ামী লীগ ও অসাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহের ভূমিকা ও জোরই ছিল বেশি। কিন্তু ঠিক পরীক্ষামুখী শিক্ষার মতই ভোটকেন্দ্রিক রাজনীতি ক্রমে সংস্কৃতি থেকে বিযুক্ত হতে থাকল। দেখা গেল গণতান্ত্রিক আমলেই রাজনীতিতে পরিবর্তনের ধারাটা একতরফা ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে - জনগণ ক্রমেই উপেক্ষিত হয়েছে এবং হচ্ছে। কারণ দ্বিদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির সুস্থ ধারা তৈরির ঝুঁকি নিতে বড় দুই দলের কোনোটিই সাহস করল না। ফলে দিনে দিনে আমরা ক্ষমতাকে ঘিরে এক ভীতির রাজনীতির ফাঁদে আটকে যাচ্ছি।
ক্ষমতাবানই ভীতির রাজনীতির সূচনা করে থাকে এবং এদেশে তা শুরু হয়েছে জিয়ার মাধ্যমে। জিয়া ক্ষমতায় এসেছেন জেল হত্যার অব্যবহিত পরে এবং দেখা গেল তিনি এই হত্যাকারীদের - যারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুরও হত্যাকারী - সাথে দরকষাকষিতে অংশ নিয়েছেন এবং রফা হিসেবে তাদের রাষ্ট্রীয় চাকুরি দিয়েছেন তথা পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। ফলে তাঁর জন্যে ক্ষমতার বাইরে থেকে স্বাভাবিক রাজনীতি করার উপায় অন্তত মুক্তিযুদ্ধের ফসল এই বাংলাদেশে থাকল না। তাঁকে যুগপৎ নির্বাচন দিয়ে এবং ফলাফল সপক্ষে রেখে নিজের ক্ষমতা ও নিরাপত্তা সংহত করতে হয়েছে। একদল মাথা গরম সেনা কর্মকর্তার অবিমৃষ্যকারিতার শিকার হয়ে জিয়া নিহত (তথা ক্ষমতাচ্যুত) হওয়ায় শহীদের মর্যাদায়, অন্তত সমাজের একটা অংশের কাছে, আদৃত হতে থাকলেন। নতুবা তাঁর পক্ষেও স্বৈরাচারী শাসনের দায়ে বিচার এড়ানো সম্ভব হত না। উত্তরাধিকারের রাজনীতিতে বেগম জিয়া এই নেতিবাচক ভীতির রাজনীতিকে টেনে এনেছেন। সুস্থ প্রতিপক্ষতার গণতান্ত্রিক রাজনীতির কথা তিনি বা তাঁর সঙ্গীরা কেউ ভাবেন নি। আর পঁচাত্তর-পরবর্তী ঘটনাগুলোর নির্যাস তো আওয়ামী লীগের জন্যে ছিল গরল। তা হজম করাকে দলের নতুন নেতৃত্ব নিজেদের অক্ষমতা তথা দুর্বলতার প্রকাশ গণ্য করেছে। তারা সর্বাত্মক প্রতিপক্ষতার পথ ধরেছেন। কিন্তু সেটি যে আদতে ভীতির মনস্তত্ত্বকেই প্রকাশ করে সেটা তারা মোটেও বিবেচনায় নেন নি।
বঙ্গবন্ধুসহ প্রথম প্রজন্মের আওয়ামী লীগ নেতাদের অধিকাংশ এসেছেন মুসলিম লীগ থেকে। তাঁরা ধর্মচর্চা করবেন এ তো স্বাভাবিক। তবে গণতান্ত্রিক রাজনীতি যে সেক্যুলার, ধর্মনিরপেক্ষ (ধর্মহীন নয়) সেটা তাঁরা জানতেন এবং মানতেন। কিন্তু ক্ষমতা হারানোর ভয়ে এখন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা প্রথমত ধর্মচর্চার বিষয়টিকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তুলেছেন এবং ওলামালীগ গঠন, হেফাজতকে প্রশ্রয় দেয়া, মুক্তচিন্তার সমালোচনা, মাদ্রাসাসহ শিক্ষার যুগোপযোগী আধুনিকায়নে অনীহার মাধ্যমে কট্টরপন্থা এবং ধর্মব্যবসায়ীদের সাথে কার্যকর কোনো ব্যবধান রাখছে না। তদুপরি গণতন্ত্র যে আদর্শিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার শর্তাধীন সেটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে যাচ্ছে। রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হলে সমাজ কোনোভাবেই ধর্মহীন হয় না, কারণ আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনজীবনে রাষ্ট্রের ভূমিকা থাকে ক্ষুদ্র পরিসরে, বৃহত্তর অংশে সমাজই দাপটের সাথে ভূমিকা পালন করে। মুশকিল হল, আমাদের রাজনৈতিকদলগুলো সরকার গঠন করে সমাজকেও রাষ্ট্রের অধীনস্থ করে সকল ক্ষমতা হস্তগত করতে চায়। সর্বাত্মক ক্ষমতার ভোগ-দখল ঠিক রাখার জন্যে জবাবদিহিতার পথ বন্ধ করতে হয় এবং তাতে খুলে যায় দুর্নীতির হাজারও পথ। তাই এদেশে গণতান্ত্রিক সরকার দ্রুত দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং সরকার প্রধানের একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
আদতে ভীতির রাজনীতি নিজস্ব তাগিদেই দলে একক ক্ষমতাধর ব্যক্তি তৈরি করে। এখানে সব ধরনের স্বাধীন মতামতের প্রতি ভীতি ও সন্দেহ কাজ করে। জঙ্গিবাদীদের হামলায় এবং সরকারের স্পষ্ট ঔদাসীন্যে এ সমাজে এ সময়টা মুক্তচিন্তা, প্রগতিচিন্তা ও উদারমানবতাবাদের জন্যে সবচেয়ে কঠিন দুঃসময়। এদিকে খোলামেলা মতামতের প্রতি ভীতি এতটা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দুই বড় দলের কোনোটিই মায় তাদের ছাত্র সংগঠনের কমিটি গঠনের দায়ও কাউন্সিলরদের হাতে দিতে সাহস পায় না। তাও ন্যস্ত হয় মূল দলপ্রধানের হাতে। সম্ভবত এগুলোর শাখা সংগঠনও নেত্রী বা তাঁর বিশ্বাসভাজনদের দ্বারাই গঠিত হয়। এভাবে ছাত্রকর্মীরা স্ব স্ব গ্রুপের লাঠিয়ালে পরিণত হয়। ভীতির সংস্কৃতিতে ক্ষমতা হারানোর ভয় জাঁকিয়ে বসে এবং ক্ষমতার জন্যে যে কোনো আপসই কাম্য হয়ে ওঠে। বড় দুই দলের ক্ষমতা হারানোর পারস্পরিক ভীতির মনস্তত্ত্বের মধ্যে যে ভূমিটি উর্বর হয়েছে তাহল ধর্মীয় মৌলবাদ। কারণ এই পুরো সময়টায় আন্তজার্তিকভাবে - অনেকটাই পশ্চিমের ভ্রান্ত নীতি ও স্বার্থান্ধ ভূমিকার কারণে - ইসলামি মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ পরিপুষ্ট হয়েছে। কিন্তু আমাদের তো আন্তর্জাতিক মদতের দোহাই দিয়ে পার পাওয়ার উপায় নেই। সমস্যা আমাদের সমাধানও আমাদেরই খুঁজে বার করতে হবে।
এর জন্যে বড় দুই দলকেই একে অপরের কাছ থেকে ক্ষমতা হারিয়েও স্বাভাবিক রাজনীতি চর্চার ভরসা পেতে হবে। তারা সে ভরসার জায়গা তৈরি করতে না পারলে গণতন্ত্রের বিকৃতি এবং ক্ষমতার (আদতে ভীতির) বিকার ঠেকানো যাবে না।

***



ইইউ নিয়ে গণভোটের পূর্বাপর



আবুল মোমেন

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মূল কুশীলব এবং মূল রঙ্গমঞ্চ ছিল ইউরোপ। যুদ্ধের পুরো ধকল গেছে তাদের ওপর দিয়ে - ল-ন-বার্লিন-লেনিনগ্রাদের (বর্তমানে পুনরায় সেন্ট পিটার্সবার্গ) মত শহরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। ইউরোপে লোকক্ষয় হয়েছিল ছয় কোটি, শুধু তাদের বিপ্লবের সূতিকাগার লেনিনগ্রাদ রক্ষা করতেই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের এক কোটি মানুষ প্রাণ দিয়েছিল।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে প্রায় ধ্বংসস্তূপ থেকেই ইউরোপ আবার জেগে উঠেছে যদিও যুদ্ধে জয়ী মিত্রশক্তির চার দেশের তিনটি, ব্রিটেন-ফ্রান্স-রাশিয়া ইউরোপেই অবস্থিত। কিন্তু বিজয়ী হলেও তাদেরও ক্ষয়ক্ষতি পরাজিত অক্ষশক্তির প্রধান দুই দেশ জার্মেনি ও ইতালির চেয়ে কম হয় নি। ফলে যুদ্ধোত্তর ইউরোপ জুড়ে ভবিষ্যতে যে কোনো যুদ্ধকে এড়ানোর এবং শান্তিকালকে দীর্ঘায়িত, এমনকি স্থায়ী করার মনোভাব জোরদার হয়ে উঠেছিল। তবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে মিত্রশক্তির সবচেয়ে ধনবান এবং যুদ্ধে প্রায় অক্ষত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন নেতৃত্ব দিচ্ছিল সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব-বিরোধী ¯œায়ুযুদ্ধের। গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশক ছিল মূলত  স্নায়ুযুদ্ধের কাল। এ সময় মার্কিন-সোভিয়েত পরস্পর রণসজ্জা যেমন বেড়েছে তেমনি লোক দেখানো দাঁতাত বা সমরাস্ত্র সম্বরণের আলোচনা ও চুক্তিও হয়েছে একাধিক।
আবার এসবের মধ্যেই শান্তির পক্ষে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক কাজও হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সমর্থনে গড়ে উঠেছিল বিশ্বশান্তি পরিষদ, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনেও তাদের জোর সমর্থন ছিল। অন্যদিকে ক্রমে জার্মেনি-ফ্রান্সে সমাজতন্ত্রীরা শক্তি সঞ্চয় করেছে, জার্মেনিতে গ্রিন পার্টি জোরদার হয়ে শান্তির পক্ষে বাস্তব কাজে হাত লাগানো শুরু করে। যুদ্ধপরবর্তীকালে স্ক্যাণ্ডিনেভীয় দেশগুলোতে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা জোরদার হতে থাকে এবং ইউরোপে শান্তি স্থাপনে তা সহায়ক হয়।
১৯৫৭ সনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের গোড়াপত্তন হয় ইউরোপীয় ঐক্যের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মূলত ফ্রান্স-জর্মন উদ্যোগের ভিত্তিতে। এই ছোট পদক্ষেপে প্রাথমিকভাবে পশ্চিম ইউরোপের ছয়দেশ ফ্রান্স, জার্মেনি, ইটালি, হল্যা-, লুক্সেমবার্গ ও বেলজিয়াম  মিলে  ইউরোপীয় অর্থনৈতিক বাজার (ই ই এম) চালু করে ১৯৭৩ সনে। এটি পরে ইউরোপীয় সাধারণ বাজার বা ইউরোপিয়ান কমন মার্কেট (ইসিএম) নামে পরিচিত হয়। এর পরিসর বাড়ানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে ইউরোপের অন্যতম বড় অর্থনীতি ও শক্তিধর দেশ ব্রিটেনকে এর অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে উদ্যোক্তাদের দিক থেকে জোর প্রয়াস চলতে থাকে। ব্রিটেনের যোগদান সহজ হয় নি, তাদের কিছু নেতার বহু বছরের প্রয়াসের ফল এটি। শেষ পর্যন্ত ব্রিটেনসহ ইইউর সংখ্যা হয়েছিল ২৮। ব্রিটেনের গণভোটের পরে একটি কমে তা       হবে ২৭।
ব্রিটেনবাসী এবং সে দেশের বড় দুই দল টোরি ও লেবার পার্টি প্রথম থেকেই এ বিষয়ে ছিল দ্বিধান্বিত। ১৯৭৩ সনে, আজকের মতই, রক্ষণশীল টোরি দলের উদারপন্থী প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ গণভোটের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইইসিতে যোগ দেন। পরের বছর ক্ষমতায় এসে লেবার দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন পূর্বসুরীর প্রতিশ্রতি রক্ষা করতে গণভোটের ঝুঁকি নিয়েছিলেন এবং ফলাফল অর্থাৎ রায় এসেছিল ইসিএমে যোগ দেওয়ার পক্ষে, তাও পক্ষে ভোট পড়েছিল ৬৭ শতাংশ। বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়ায় লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসনের পক্ষে গণভোটের রায় বাস্তবায়ন কঠিন হয় নি।
তবে ব্রিটেনবাসী এবং তাদের রাজনৈতিক দলগুলো কখনো এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে একপক্ষে আসতে পারে নি। দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিলই। এর বড় কারণ ব্রিটেনবাসী ঐতিহ্যগতভাবে নিজেদের ইউরোপের মূল ভূখ-ের অংশ ভাবে নি। সপ্তদশ শতাব্দীতে ওয়েস্টফালিয়ার চুক্তি হওয়ার পরে ইউরোপীয় দেশগুলোর নৌবাণিজ্যের অধিকার পারস্পরিক সমঝোতায় যখন প্রসারিত হল তখন ব্রিটেন শ্রেয়তর নৌশক্তির জোরে নিজের অগ্রবর্তিতা ধরে রেখেছিল। নৌশক্তি ও সামরিক শক্তির জোরে  তাদের বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলো বিশ্বের নানা প্রান্তে বাণিজ্যের পাশাপাশি নিজস্ব উপনিবেশ স্থাপনে ও উপনিবেশ থেকে লুণ্ঠনে ইউরোপের অন্য দেশগুলোকে পিছনে ফেলে দিয়েছিল। ফলে দেখা যায় রেনেসাঁস ও এনলাইটেনমেন্ট মূলত পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপ জুড়ে হলেও ইউরোপে প্রথম শিল্প বিপ্লব হয়েছে ইংল্যাণ্ড। কারণ এর জন্যে প্রয়োজন পুঁজি, কাঁচামাল এবং শস্তা শ্রমিকের প্রাচুর্য ও অব্যাহত সরবরাহ। তা তারা পেয়েছিল নতুন উপনিবেশগুলো থেকে এবং অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী ইউরোপীয় দেশের চেয়ে যা ছিল পরিমাণে বিপুল ।
সেই থেকে ব্রিটেনবাসীর দীর্ঘদিনের লালিত আভিজাত্যের গরিমা বা উচ্চম্মন্যতার রেশ বয়োজ্যেষ্ঠদের মন থেকে এখনও কাটে নি। এক ইউরোপের ধারণায় তাদের সেই ভাবাবেগে চোট লেগেছিল। তা পরিষ্কার বোঝা যায় গণভোটের ফলাফলে - যেখানে তরুণদের ৭৫ শতাংশ ইইউতে থাকার পক্ষে রায় দিয়েছে সেখানে ৬৫ বছরের উর্দ্ধে মানুষের ভোট পক্ষে পড়েছে মাত্র ৩৮ ভাগ।
এদিকে সত্তরের দশক থেকে ইউরোপে শক্তিশালী অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হতে থাকে জার্মেনি। সেই সূত্রে ইউরোপের ভরকেন্দ্র ল-ন ছেড়ে ক্রমে বন ও বর্তমানে বার্লিনে থিতু হয়েছে। বর্তমান ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের প্রধান নেতা নিশ্চিতভাবেই জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল। এটা ব্রিটেনের প্রবীণ নাগরিকদের জন্যে স্বস্তির বিষয় ছিল না। তারাই এক্ষেত্রে দক্ষিণপন্থার ফাঁদে পা দিয়েছেন এবং ২৩ জুনকে স্বাধীনতা দিবস ঘোষণায় আগ্রহী হয়েছেন। তবে এটাও মনে রাখতে হবে ১৯৯০ এ সমাজতন্ত্রের পতনের পর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর অর্থনৈতিক বিপর্যয় এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে এ সময় এসব দেশের বহু মানুষ উন্নত পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাতে থাকে, যাদের একটি বড় অংশ আশ্রয় নিয়েছে ব্রিটেনে। এই শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের নিয়েও ব্রিটেনবাসী দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তাদের অর্থনীতি এমনিতেই চাপে আছে, এতে আরও চাপ তৈরি হচ্ছে, নাগরিকদের ওপর করের বোঝা ক্রমেই বাড়ছে, দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাপনের ব্যয়ও বাড়তির দিকে। সবচেয়ে বড় কথা স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতের অনেক ভর্তুকি কমে যাচ্ছিল অথবা উঠিয়ে নেয়া হচ্ছিল। এসবকে কাজে লাগিয়েছে ব্রেক্সিট বা ব্রিটেনের ইইউ থেকে এক্সিট বা বেরিয়ে আসার পক্ষপাতীরা। তারা নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে অত্যন্ত বাড়াবাড়ি রকমের উগ্র জাতীয়তাবাদের আশ্রয় নিয়েছে, পরিস্থিতির ওপর রঙ চড়িয়ে ইইউর নেতিকরণ করেছে। তাতে এর সম্ভাব্য পরিণাম নিয়ে ভাবার কোনো সময় পায় নি অনেক মানুষ। বিপরীতে ইইউর পক্ষের বা ব্রেক্সিট বিরোধীরাও প্রতিপক্ষের সাথে পাল্লা দিয়ে এর পরিণতি কতটা ভয়ানক হতে পারে তার ওপর জোর দিয়েছে। যেন উভয় পক্ষ বিপরীত দিক থেকে মানুষকে ভয় দেখানোর পথ ধরেছিল। মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনার ওপর আস্থা রেখে একটু বড় পরিসরে দীর্ঘমেয়াদী ভাবনার পথ খুলতে পারে নি কোনো পক্ষই। তাতে মানুষ বুঝে-শুনে ভেবে-চিন্তে যেন ভোট দিতে পারে নি। মানুষের এই দোদুল্যমান মনের অবস্থা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে ভোটের পরেই। এর মধ্যে পুনরায় গণভোটের আয়োজনের পক্ষে স্বাক্ষরকারীর সংখ্যা ৩০ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে, যেখানে এক লক্ষ মানুষের মতামত পেলেই তা মানার ঐতিহ্য রয়েছে ব্রিটেনের। অনেকেই ব্রেক্সিট-পরবর্তী তাৎক্ষণিক বাস্তব প্রতিক্রিয়ার ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব দেখে এখন আফসোস করছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন সম্ভবত তাঁর দুই মহান পূর্বসুরী হিথ ও উইলসনের মত বিজয়ী হয়ে ইতিহাসে অমর হওয়ার সুযোগ হারিয়ে নিজের পরাজয়কেই মহিমান্বিত করতে চাইছেন। গণতন্ত্রের পতাকা ঊর্ধে তুলে ধরে তিনি পরাজয়ের দায় কাঁদে নিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন এবং দ্বিতীয়ত, গণভোটের রায় মেনে নেওয়ার জন্যে সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এবারের গণভোটের ফলাফল ১৯৭৩ এর মত হয় নি। জাতি স্পষ্ট রায় দেয় নি - ৫২ ও ৪৮ শতাংশের ব্যবধান জাতির বিভক্তিকেই প্রকাশ করে যা ১৯৭৫ এ ছিল ৬৭ ও ৩৩ শতাংশ। এবারের ফলাফলে ল-ন ও ইংল্যা-ের জনমতের সাথে যুক্তরাজ্যভুক্ত ওয়েলসের জনমতের মিল থাকলেও স্কটল্যা- ও উত্তর আয়ারল্যা-বাসীর মতামতের মিল ঘটে নি। এ দুটি রাজ্যেই শক্তিশালী গ্রুপ এবং জনমত রয়েছে যথাক্রমে স্বাধীনতা ও মূল আয়ারল্যাণ্ডের সাথে একীভূত হওয়ার পক্ষে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন দুই অঞ্চলেই সেই প্রবণতা এখন বাড়বে। স্কটিশ প্রথম মন্ত্রী স্টারজিয়ন তো বলেই দিয়েছেন স্কটল্যাণ্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে আরেকটি গণভোটের দাবি উত্থাপিত হয়েই থাকল। উত্তর আয়ারল্যণ্ডও স্বাধীনতা ও অন্তর্ভুক্তির কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। এমনকি এই গণভোটের রেশ ধরে ইউরোপের অন্যান্য দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের শক্তি বৃদ্ধি পাবে যা পরিণামে ইইউ থেকে আরও কিছু দেশের বেরিয়ে যাওয়ার বাস্তবতা তৈরি করবে। ইউরোপ জুড়ে অভিবাসীদের জন্যে বিরূপ বাস্তবতাও তৈরি হবে ভবিষ্যতে।
তবে তারও চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে উঠছে যদি সত্যিই যুক্তরাজ্যের পরিণতি অঙ্গহানির দিকে গড়ায় তাহলে ব্রিটেনের কি জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য পদ থাকবে বা থাকা উচিৎ? বিশ্বের ধনী দেশের ক্লাব জি-৭ এর সদস্য পদেও কী কোনো পরিবর্তন হবে? এসব কিছুই হয়ত এক্ষুণি ঘটবে না, কিন্তু ব্রিটেনের অর্থনৈতিক শক্তি, ভূরাজনৈতিক প্রভাব ইউরোপে এবং এর ফলাফল হিসেবে বিশ্বে কমতে পারে। ব্রিটিশ অর্থনীতি এই ধাক্কা সামলে উঠতে যত সময় নেবে ততই নেতিবাচক ফলাফলগুলো ত্বরান্বিত হবে। ব্রিটেনের বড় দুই দলের অভ্যন্তরেই ঝড় বইছে, যা প্রবলভাবে অনুভূত হচ্ছে বিরোধী লেবার পার্টিতে।
এর মধ্যে লেবার দলের এমপি টিউলিপ সিদ্দিকি ঠিকই বলেছেন, এখন গণভোটকে কেন্দ্র করে জাতির মধ্যে সৃষ্ট বিভাজন ও তিক্ততা সারানোর কাজেই ব্রিটেনবাসীকে মন দিতে হবে। কারণ ব্রিটেনের নিজের স্বার্থ ছাড়াও বিশ্ব অর্থনীতি ও বিশ্বব্যবস্থার স্বার্থে ব্রিটেনকে প্রভাবশালী অবস্থান ও ভূমিকা বজায় রাখতে হবে।
***