Monday, July 8, 2019

নয়নের জন্যে ক্রোধ, নয়নদের জন্যে শোক


আবুল মোমেন

বরগুনার নয়ন বণ্ড তার নায়ক জেমস বণ্ডের মত হতে পারে নি। আদতে একালের এ সমাজে বাস করে তার বয়েসি তরুণের পক্ষে জেমস বণ্ডকে জানা সম্ভব নয়। সেকালের বাঙালি বণ্ড দস্যু মোহন বা দুস্যু বাহরামকে চেনাও তার কপালে ছিল না। সে পাড়ার বা জেলা শহরের যেসব মাস্তানদের অনুকরণে বড় হচ্ছিল তাদের কারো পক্ষেই বণ্ড-বাহরাম হওয়া সম্ভব ছিল না। তারা বর্তমান দূষিত রাজনীতির পরগাছা। একসময় কাজে লাগে, কিন্তু প্রয়োজন ফুরোলেই উপড়ে ফেলতে হয়। কখনও প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বাড় বাড়লে ছেঁটে ফেলতে হয়। নয়নের পৃষ্ঠপোষকরা রিফাত খুন হওয়ার পর থেকেই তার পাশ থেকে সরে গিয়েছিলেন। এখন তো নয়ন বণ্ড পর্ব চুকে গেছে।
আলোচিত খুনি নয়ন ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে। রিফাত হত্যাকা- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়লে পুরো জাতি নয়ন ও তার দোসরদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ফুঁসে উঠেছিল। আমাদের দেশে সুবিচার প্রাপ্তি নিয়ে মানুষের মনে ঘোরতর সন্দেহ আছে। পুলিশের সততা ও দক্ষতা নিয়ে যে সংশয় তা বিচার বিভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত। আমার ধারণা দূরদর্শী বিবেকবান মুষ্টিমেয় মানুষ ছাড়া দেশের বাদবাকি সকল মানুষ এতে সন্তুষ্টই হয়েছেন। জনমতের এই গতিপ্রকৃতি পুলিশ ও জননেতারা ভালোই জানেন। ফলে বিচারবহির্ভুত ক্রসফায়ারে দীর্ঘসূত্রী বিচারের প্রতীক্ষা থেকে তাঁরা সকলকে মুক্তি দিতে চান। যেহেতু নকল বণ্ডের জন্যে কারও সহানুভূতি নেই তাই অল্পকিছু মানুষের উদ্বেগ নিয়ে মাথা ঘামানোরও কিছু নেই।
হয়ত মানুষ খুশিই হয়েছে। রাষ্ট্র প্রাণহীন সত্তা, অনুরাগ-বিরাগের উর্দ্ধে জনগণের ইচ্ছায় আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠান। জনগণের ইচ্ছা অবশ্য রাষ্ট্রের মত অনুরাগ-বিরাগের উর্দ্ধে আইন দ্বারা পরিচালিত হয় না। প্রায়স এবং প্রধানত এ ইচ্ছা আবেগ দ্বারা চালিত হয়, আর আবেগ সাধারণত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অনুরাগ-বিরাগের দ্বারাই প্রভাবিত হয়। আর এই জন্যেই রাষ্ট্রকে মানবিক অনুরাগ-বিরাগের উর্দ্ধে থেকে কঠোরভাবে আইনের দ্বারা পরিচালিত হতে হয়। আইনের পথ থেকে বিচ্যুত হলে বা সংসারের অনুরাগ-বিরাগের প্রভাবে চালিত হলে রাষ্ট্র নিজের চরিত্র হারাতে থাকে। এভাবে চলতে থাকলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক ও সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট হয়। চোখ বুঁজে বলে দেওয়া যায় বর্তমান বাংলাদেশে রাষ্ট্রের প্রশাসন যন্ত্র অন্য দুই অঙ্গের চেয়ে শক্তিশালী, প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে। বিগত জাতীয় নির্বাচনে প্রভাবক ভূমিকা পালনের মাধ্যমে তাঁরা জনপ্রতিনিধিদের চেয়েও প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠেছেন। আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক হতে পারে কিনা সেটি তাত্ত্বিক তর্কের বিষয়। তবে রাষ্ট্রে আইনের শাসন যে লাঘব হয়েছে বা হয়ে চলেছে সে বিষয়ে সংশয় নেই।
আইনের শাসনের অভাব বা দুর্বলতার ফাঁক গলে সমাজে নানা অনাচার তৈরি হতে থাকে। রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের সম্পর্কে ভারসাম্যের সমস্যা তৈরির মত আইনের ফাঁক গলে যেমন ক্রসফায়ারের সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে ঠিক তেমনি ক্রসফায়ারে যারা নিকেশ হচ্ছে তারাও তৈরি হচ্ছে। হয়ত একদল আইনের আশ্রয়ে থেকে এ সংস্কৃতিতে অংশ নিচ্ছে আরেক দল আইন প্রণেতাদের প্রশ্রয়ে থেকে আইন ভাঙছে। কে বেশি দায়ি, কে আগে কে পরে - এই ইঁদুর-বিড়াল বা টম অ্যা- জেরি গেইমে সময় ব্যয় না করে কাজের কথায় আসা যাক।
জার্মান মহাকবি গ্যয়টে একটি কবিতার লিখেছেন - ‘আত্মনিয়ন্ত্রণই শুধু মহত্ত্বের নিশ্চয়তা দিতে পারে।/সীমা মানতে পারার মধ্যে প্রজ্ঞার পরিচয় মেলে,/এবং অন্য কিছুু নয় শুধুই আইনই পারে আমাদের স্বাধীনতা দিতে।’
ঈশপের গল্পেও জানা যায় খরগোশ খুব তৎপর চৌকস হলেও আখেরে বিজয়ী হয় ধীরস্থির কচ্ছপ। কচ্ছপের আয়ুও খরগোশের দশগুণ হবে। আমরা কথায় কথায় রাষ্ট্রের দীর্ঘজীবন কামনা করে থাকি। বলি - বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক। তাহলে কিন্তু খরগোশের মত অতি দৌড়ঝাঁপ বা লম্ফঝম্ফ বাদ দিয়ে খানিকটা কচ্ছপের মতই ধীরস্থির - একটু ভাষা দিয়ে বলি - দূরদর্শী প্রজ্ঞার সাথে পথ চলতে হবে। সেটা অবশ্য আইনের শাসনে চলার পথ, যেমনটা ঈশপের কচ্ছপ চলেছিল।
আইনের শাসনে আসতে হলে নয়ন বণ্ড তৈরি হওয়ার যে সামাজিক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে সেদিকে নজর দিতে হবে। নয়ন যদি রোগবাহী জীবাণু হয়ে থাকে তাহলে তার বাহক বাতাস বা জল হল দেশের বর্তমান রাজনীতি। আমি বহুবার লিখেছি, নতুন যুগ এসেছে, কালান্তর ঘটেছে, তার সাথে খাপ খাইয়ে পরিবর্তন আনতে হবে রাজনীতিতে। প্রযুক্তি ও জ্ঞাননির্ভর একালে আগ্নেয়াস্ত্র বা বাহুবলে কাজ হবে না। সাময়িক লাভ হলেও আখেরে খেসারত অনেক বেশি গুণতে হবে। একালে বাহু নয় মস্তিষ্কই খাটাতে হবে। এমনকি একালের যুদ্ধেও বাহুবল গৌণ, মুখ্য হল মেধার দৌড়। মেধা-বুদ্ধি-প্রজ্ঞা লাগবে, ঘৃণা-প্রতিহিংসা লোভে কাজ হবে না। কিন্তু যেখানে মানুষগুলো তৈরি হচ্ছে সেই পরিবার, স্কুল কিংবা সমাজ গঠন-পুনর্গঠনে যত কথা হচ্ছে তত কি কাজের কাজ কিছু হচ্ছে?
যদি একজন নয়ন শৈশবে এমন একটা বাড়ি পেত যেখানে সে শান্তভাবের গান শুনতে পেত, চমৎকার ছবিওয়ালা বই পেত, মজাদার গল্প শুনতে পেত; যদি ছোটবেলায় এমন একটি পাড়া পেত যেখানে অনেক সমবয়সি খেলার সাথী হত তার, থাকত মাঠ ও তাতে দৌড়ানো ও খেলার স্বাধীনতা; যদি এমন একটি স্কুল পেত যেখানে পড়া মুখস্থের পরিবর্তে সে খেলত, গাইত, আবৃত্তি করত, গল্প শুনত ও বলত, অনেক বড় মাপের মনীষীর জীবনকথা শুনত, নিজ হাতে এটা-ওটা বানাত; যদি বালকবেলায় (নয়না হলে বালিকাবেলা) সে কোনো সংগঠন পেত যেখানে নানা কাজে, প্রতিযোগিতায়, অনুষ্ঠানে অংশ নিতে নিতে সে নিজের অনেক গুণের খবর পেত, তৃপ্ত হত নিজেকে ছাপিয়ে তার বড় হওয়ার সাধ, পেত হাততালি, বাহবা আর দু’একটা পুরস্কার; আর সেই বয়সে সে যদি এমন দু’চারজন বড় ভাই-আপুর সান্নিধ্য পেত যারা তার শৈশব-কৈশোরে পাশে থেকে কখনও আনন্দ দিয়ে, কখনও আশ্বস্ত করে, কখনও চমক দিয়ে, কখনও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে তার বড় হওয়ার পথকে সুগম করে দিত!
আমি নিশ্চিত নয়ন এমন শৈশব এমন কৈশোর পায় নি। শিশুরা সবচেয়ে বেশি দেখে শেখে, অনুকরণ ভালোবাসে তারা। তার দেখা জীবন থেকেই নয়ন শিক্ষা নিয়েছিল। সেই শিক্ষা তাকে কেবল বাঁচতে দেয় নি তা নয়, জীবনে এবং মরণে তার কপালে ধিক্কারই এনে দিয়েছে। এটি আদতে মানবতার পরাজয়ের কাহিনী। এই পরাজয় বস্তুত এই সমাজের এই রাষ্ট্রের। এটি বাংলাদেশের দীর্ঘজীবিতার পথ নয়, হোঁচট আর হুমড়ি খেলে পতনই ঘটে, অপঘাত মৃত্যুর শংকা বাড়ে।
তাই বলব এভাবেই যদি আমরা চলতে থাকি, নয়নদের ‘বড়’ হতে দেই তবে পরিণতি এরকমই ঘটবে। এ কেমন বাস্তবতা - দেশের উন্নয়ন ঘটছে মহাসমারোহে আর মানুষের ঘটছে অবনতি! মন্যুষ্যত্বের ঘটছে পরাভব! সমাজের উন্নয়ন ছাড়া বস্তুগত বা বহিরঙ্গের উপরিকাঠামোর উন্নয়ন টেকসই হতে পারে না। নজর দিতে হবে মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকে। পদ্মাসেতুর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল স্কুলশিক্ষার মানোন্নয়ন, শিশু-কিশোর ছেলেমেয়েদের জন্যে আনন্দময় জীবন নিশ্চিত করার কাজ। ভাবুন তো স্কুলগুলোর কথা - মাঠ, মিলনায়তন, মঞ্চ ছাড়া; গান-আবৃত্তি-চারুকলা-নাটক ছাড়া; খেলাধূলা-সাঁতার কাটা-গাছে চড়া ছাড়া; অফুরন্ত অবসর, গল্প শোনার আসর, নানান অভিযান ছাড়া; নিজস্ব সকাল-জ্যোৎস্না-সুনীল আকাশ ছাড়া; একজন প্রিয় আপু, প্রিয় দাদা-ভাইয়া ছাড়া কীভাবে কতটি প্রজন্ম কেবল পড়া-পরীক্ষার চাপে এবং অযত্ন-বেখায়ালে বেড়ে উঠেছে এদেশে।
নয়নের প্রতি ক্রোধ ছিল, ক্রোধ নিয়ে লিখতে লিখতে ওর মতদের জন্যে বড্ডা মন খারাপ হয়ে গেল। উদ্বেগ বাড়ল দেশের ভবিষ্যত নিয়ে।

***