Sunday, August 23, 2015

ছাত্রসংগঠনের হাজারিবাগ শাখা কেন?

আবুল মোমেন

শেষ পর্যন্ত সরকার হার্ড লাইনেই গেল। দু’দিনে ছাত্রলীগ-যুবলীগের তিনজন ‘ক্রসফায়ারে’ মারা গেল।
বিচারবহির্ভূত হত্যা বা মৃত্যু সুস্থ মস্তিষ্কে সমর্থন করা যায় না। বোঝা যায় সরকারও আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার ওপর আস্থা রাখতে পারে নি। আশু সমাধানের বেআইনি মর্মান্তিক পথটিই গ্রহণ করল।
দেশে দু’ধরনের সংকটে এমন এক বিষচক্র তৈরি হয়েছে যা ভাঙা সম্ভব হচ্ছে না। পুলিশের দিক থেকে তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশিট দেওয়া পর্যন্ত একদিকে চলে দুর্নীতি আর অন্যদিকে দুর্নীতি ও অদক্ষতার যোগফল হিসেবে মামলা হয় দুর্বল। দ্বিতীয় সংকট হল, প্রথম সংকটটি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকায় অপরাধীরা মামলা বা আইনি প্রক্রিয়ায় কোনো না কোনো স্তরে প্রভাবিত করার সুযোগ তৈরি করে তা কাজে লাগায়। রাজনীতির অপরাধ-সংশ্লিষ্টতার সংস্কৃতি জোরদার হওয়ার পর থেকে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রছায়ায় সংঘটিত কয়টি খুনের সুবিচার নিশ্চিত ও সম্পন্ন হয়েছে? খুনের সংখ্যা তো শয়ের ঘর ছাপিয়ে হাজারের কোঠায় পৌঁছেছে। এই বিচারহীনতার পুঞ্জিভূত পরিণতি নিয়ে আমরা কখনো গভীরভাবে ভাবি নি। বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে এমনটা হতে দিয়েছি। অবস্থা এমন হয়েছে যে সর্বোচ্চ আদালত থেকেও বলা হচ্ছে নিচের স্তরে যোগ্য বিচারকের অভাব রয়েছে, সুষ্ঠুভাবে রায় লেখার মত মানুষও কমে যাচ্ছেন। তেমনি দক্ষ আইনজীবীও সেভাবে তৈরি হচ্ছে না। সবটা মিলে সর্বত্র একটা ফাঁপা চাকচিক্যের আড়ালে আমরা আসল বিষয় হারিয়ে ফেলছি। দালানকোঠার বহর বাড়ছে, প্রযুক্তির আড়ম্বর ঘটছে, গাড়ি এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ের বৈভবও বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদে চলেছে।
বিচারহীনতা থেকে বিচারবহির্ভূত ‘বিচারের’ ফাঁদ খুব দূরের কিছু নয়। যারা ক্রসফায়ারের শিকার হচ্ছে তারা এতটাই ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিল যে তার সীমা সম্পর্কে ধারণা হারিয়ে ফেলেছিল। ওদের এই ধারণাটা আপনা-আপনি হয় নি, তারা তো আস্কারা পেয়েই এভাবে চলে এসেছে অর্থাৎ তাদের এভাবে চলতে দেওয়া হয়েছে।  তাদের এই ভাবনাটাকে ভিত্তিহীন বলাও মুশকিল। কারণ সত্যিই তো বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং সেইসূত্রে ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিচারের আওতামুক্ত থাকার চক্রটি বহুদিন ধরেই কার্যকর রয়েছে। হঠাৎ যে সরকার তাদের ইনফর্মাল বাহুবল নিয়ে বিব্রতবোধ করবে বা সমালোচনা থেকে বাঁচার জন্যে এমন বেপরোয়া নির্মমভাবে তাদের শায়েস্তা করা হবে সেটা তারা ভাবতেই পারে নি।
সরকার তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বরং কিছুটা বাহবা নিতে চাইবে - দ্যাখ, আমরা কতটা ন্যায়নিষ্ঠ, নিজের দলের কেউ আইন ভাঙলে তাকেও ছাড়ি না। তবে ক্রসফায়ারে না দিয়েও অনেককে দল থেকে বহিষ্কার করে মামলায় গ্রেপ্তার করে, দীর্ঘমেয়াদে জেলে রেখে সরকারের বারতাটা পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু ক্ষমতা আর লোভ সত্যিই তো অন্ধ - এ হল অন্ধশক্তি। 
ক্রসফায়ারে নিহত ছাত্রলীগ নেতা আরজুর পরিচয় জেনে প্রথমেই প্রশ্ন করতে হয় - হাজারিবাগ থানা ছাত্রলীগ কমিটি থাকবে কেন? ছাত্রলীগ একটি ছাত্রসংগঠন, এর শাখা তো থাকবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক। মূলত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ভিত্তিক হবে ছাত্র সংগঠনের শাখা। একটি কেন্দ্রীয় কমিটি থাকবে, তার অধীনে জেলা কমিটি এবং মহানগর কমিটি থাকবে। কিন্তু এলাকাভিত্তিক কমিটি কেন? এরকম কর্মক্ষেত্রের সাথে সংশ্লিষ্টতাহীন কমিটি হলে তাদের কাজ কী হবে? নির্দিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব না থাকায় এসব শাখায় ভাগ্যান্বেষী অছাত্র তরুণরা এসে ভীড় করবে। ক্ষমতাসীন দলের ক্ষেত্রে তো তাদের ভীড় ঠেকানো যাবে না। ছাত্র সংগঠনের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হলে এগুলোকে অবশ্যই শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যায়ল ও কলেজ-কেন্দ্রিক সংগঠন হতে হবে। তাতে নেতাদের ছাত্রত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সহজ হবে।
আমাদের দুর্ভাগ্য, দেশে গণতান্ত্রিকব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের নির্বাচনগুলো বন্ধ হয়ে আছে। নির্বাচনহীনতার অর্থ গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি আর এর পরিণতি হল অসহিষ্ণুতা এবং ভিন্ন পথে নেতাদের ক্ষমতাবান হওয়ার ঝোঁক বাড়া। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংগঠনের দখলদারি এবং কায়েমি স্বার্থ প্রতিষ্ঠার কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। ছাত্র রাজনীতি - প্রধান দলগুলোর ক্ষেত্রে - মূলত ভর্তি বাণিজ্য, টেণ্ডারবাজি, নিরীহ ছাত্রদের শোষণ এবং একছত্র কায়েমি ক্ষমতার অন্যান্য অনুষঙ্গ অপতৎপরতার দূষণ ও বিকার সমাজদেহে ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। ছাত্র রাজনীতি থেকে আপাতত জাতি কিছুই পায় না।
লক্ষ্যহীন, আদর্শহীন, উদ্দেশ্যহীন এবং সৎকর্মহীন নেতৃত্ব এবং রাজনীতি নানা ধরনের উৎপাত তৈরি করে। দোকানপাটে চাঁদাবাজি, তোলাবাজি, ছিনতাই রাহাজানি, অপহরণ ও মুক্তিপণ ইত্যাদি বলপ্রয়োগের ক্ষমতার চর্চা অপ্রতিহতভাবে চলছে। মানুষ এসব উৎপাতে এতটা অতিষ্ঠ হয়েছে যে ছাত্র-তরুণদের সম্পর্কে সমাজে নেতিবাচক মনোভাব প্রবল। এমনকি ক্রসফায়ার নিয়ে মানুষ বিচলিত নয়। সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগী পরিবার ব্যতীত কেউ মাথাই ঘামায় না। এই অবক্ষয় থেকে বেরুতে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এলাকার দখলদারি বন্ধ করার পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্তমান ধারার নেতৃত্ব ও কাঠামো থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে।
এ জন্যে আমি প্রস্তাব করব - অন্তত এক বছরের জন্যে - ছাত্রসংগঠনগুলোর কার্যক্রম বন্ধ রাখা হোক, সকল কমিটিও ভেঙে দেওয়া হোক। ছাত্রদের রাজনৈতিক অধিকার ও রাজনীতি করার অধিকার বন্ধ হবে না। কিন্তু সংগঠন থাকবে না। এই এক বছরের মধ্যে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান - বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ - স্ব স্ব ছাত্রসংসদের নির্বাচন করবেন। এ নির্বাচনে ছাত্ররা সরাসরি অংশ নেবে, তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে প্যানেল তৈরি করতে পারবে। কিন্তু কেবলমাত্র নিয়মিত ছাত্ররাই এতে অংশ নিতে পারবে। একবার এম. এ. পাশ করে আবার অন্য বিষয়ে ভর্তি হলেও তারা নির্বাচনের যোগ্য হবে না। এভাবে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান প্রচারণা, প্রার্থী নির্বাচন, ভোট, নির্বাচন পদ্ধতি ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে নিয়মাবলী নির্ধারণ করে নেবেন।
আমার ধারণা একবার ছাত্রসংসদের নির্বাচন চালু হলে, প্রথম দু’একবার যদি কিছু কিছু সমস্যা হয়ও, আখেরে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। ভালো ছাত্র, যোগ্য প্রার্থীদের সামনে আনতে চাইবে সাধারণ ছাত্ররা। অছাত্র, চাঁদাবাজ, দখলদার, অস্ত্রবাজ, মাস্তান, ধর্ষকদের হাত থেকে শিক্ষা, রাজনীতি, ছাত্রসমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জনগণ এবং দেশ ও সমাজকে রক্ষা করার এটাই পথ। সাধারণ ছাত্ররা তাদের মনোবল ফিরে পাবে, নিজেদের সংঘবদ্ধ শক্তির চমকপ্রদ প্রকাশ দেখে উৎসাহিত হবে। পাশাপাশি বিতর্কিত ব্যক্তিরা দখলদার হিসেবে বিতাড়িত হবে।
রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে সংলাপে বসতে পারেন। তার আগে জাতীয় সংলাপও হতে পারে । সংসদেও বিষয়টি আলোচিত হওয়া সম্ভব। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই যা চলছে তা আর চলতে দেওয়া উচিত নয়। কে কোন স্বার্থে কোন এলাকায় নিজে নিজে ক্ষমতাসীন দলের কোনো অঙ্গ সংগঠনের শাখা খুলে নিজেই সভাপতি পদ গ্রহণ করে নিজের কোন স্বার্থ হাসিল করবে তা না পারবে বুঝতে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, না তাদের সরকার। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেছেন, ছাত্রলীগে শিবির এবং আওয়ামী লীগে জামায়াতের লোকজন ঢুকে পড়ছে। ঢুকে পড়বেই তো। যদি সংঠনের নাম এবং গণতন্ত্র ও আদর্শ উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কোনো কাজ না থাকে তাহলে নেতাদের একমাত্র কাজ তো হবে নিজের অর্থবিত্ত, ক্ষমতাবৃদ্ধি আর সে ক্ষমতার রোয়াব দেখিয়ে আশেপাশের সবাইকে দাবিয়ে রাখা। 
এখন একাজই তো করছে অঙ্গ সংগঠনগুলো। তার মধ্যে ছাত্রলীগ-যুবলীগ তাদের তারুণ্যের কারণে রাখঢাক করে কাজটা সারতে পারছে না। খোদ সরকারের জন্যে কেউ কেউ আপদ-বালাই হয়ে উঠছে। কিন্তু সে বালাই ক্রসফায়ারে দূর করার ব্যবস্থাটি সুবুদ্ধির বা দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করছে না।  এটিকে বলব, সকল বিকল্পের মধ্যে নিকৃষ্ট বিকল্প। কারণ বিচারহীনতার পুঞ্জিভূত সংস্কৃতি আজ আমাদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে সংস্কৃতিতে নিয়ে আসছে। এরপরের স্তরটি হল জায়গায় জায়গায় মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেবে, যেমনটা সেদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নরসিংদিতে ডাকাত সন্দেহে মোট ছয়জনকে পিটিয়ে খুন করা হল। 
তার পরের ধাপটি হল কাউকে প্রতিপক্ষ মনে হলেই ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে সন্দেহভাজন বানিয়ে গণপিটুনির ব্যবস্থা করা। আমরা বিচারহীনতা ও বিচার বহির্ভূত ক্ষমতার বহুমুখী কুফলও এ সমাজে দেখছি। দুর্নীতি সাথে এই অপরাধপ্রবণতা পাল্লা দিয়ে চলতে থাকলে কোথায় গিয়ে থামব আমরা? তাই আশু পরিবর্তন চাই। প্রথমে ছাত্র সংগঠন থেকেই শুরু হোক। এখানে শৃঙ্খলা ফেরোনো হলে অন্য সব অঙ্গ সংগঠনেও ফেরানো সহজ হবে। বিষয়টা ভাবতে হবে। 
শেষে আবারও বলব, ছাত্রসংগঠনের আবার হাজারিবাগ শাখা কেন?

***