Thursday, December 4, 2014

তাঁর রেনেসাঁস-সত্তা

আবুল মোমেন

সত্যিকারের বড় মানুষ সত্যিই দুর্লভ। কারণ বড় হওয়া মানেই খ্যাতিমান হওয়া, প্রতিষ্ঠিতজন হওয়া, পুরস্কার-স্বীকৃতি-সম্মাননায় অভিষিক্ত হওয়া। গণমাধ্যমের নজরে থাকা, তাতে প্রায়ই হাজিরা দেওয়া। এতে গৌরব বাড়ে, গর্বিত হওয়ার অধিকার জন্মায়। এই অধিকারবোধ প্রায় সবার অগোচরে সন্তর্পণে দূরত্ব আর আড়ালগুলো তৈরি করতে থাকে। বড় মানুষ কখন যে চূড়ার ছোট্ট পরিসরে আটকে যান হারিয়ে যান তা তিনিও টের পান না। ভাবি, এটা কি তাঁদের পরাজয়? কাইয়ুমভাই কিন্তু প্রাপ্তির আড়ম্বরে  হারিয়ে যান নি, তাতে আটকা পড়েন নি। না, খ্যাতি-প্রতিষ্ঠার কাছে তাঁর পরাজয় ঘটে নি।
তিনি সবসময় সবারই থাকলেন। পরিবারের, শিল্পী ও ছাত্রদের, সমাজের, দেশের এবং ইতিহাসের একজন হয়েই থাকলেন। কেবল থাকা নয়, সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে থাকা। বড় কথা, সে ভূমিকা বৃহত্তর অর্থে কল্যাণকর, গঠনমূলক, যথাযথ।
বয়স, অভিজ্ঞতা, অর্জন তাঁকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে নি, মৌলিক মানুষটিকে বদলে দিতে পারে নি। তিনি থাকলেন বরাবরের কাইয়ুম চৌধুরী - স্বামী, পিতা, চাচা, ফুফা, খালু, ভাই, বন্ধু, শিক্ষক। তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক বৃহৎ পরিবার ও ক্রমসম্প্রসারমান সমাজের অভিভাবক। এ তিনি বয়স বা সম্পর্কের জোরে কাকতলীয়ভাবে পান নি, যোগ্যতার সাথে দায়িত্বের ভারবহন করেই পেয়েছেন।
তাঁর কাছে সবাই চেয়েছেন, আর তাঁর মতো করেই তিনি দিয়ে গেছেন। পরিবারের বাইরে অধিকাংশের আবদার তো শিল্পীর কাছে - শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর কাছে। কিন্তু তাঁদের চাওয়া পেইন্টিং নয়, কেউ চান সংগঠনের লোগো, কারও দাবি সম্মেলনের পোস্টার, কেউ আর্জি জানান আমন্ত্রণপত্রের নক্সার, আর বেশিরভাগের প্রত্যাশা নিজের বইয়ের জন্যে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর স্বাক্ষরিত একটি প্রচ্ছদ-চিত্র। বেশির ভাগ দাবিই পূরণ করতেন তিনি। অচেনা ব্যক্তি কৌশলের আশ্রয় নেন কাইয়ুমভাইয়ের কোনো প্রিয়জনকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে সবসময় চাপে থাকতে হয়েছে তাঁকে।
কাইয়ুমভাই জীবনের প্রায় সবটা সময় চারুকলায় শিক্ষকতার বাইরে কোনো-না-কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থেকেছেন। অনেক পত্রিকা ও সাময়িকীর অঙ্গসৌষ্ঠবের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি, শেষ দিন পর্যন্ত করে গেছেন। সংবাদ, চিত্রালী, ইংরেজি এক্সপ্রেস, সচিত্র সন্ধানী, টাপুরটুপুর, অন্তরঙ্গ এমনি আরও অনেক। সাম্প্রতিককালে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন দৈনিক প্রথম আলো আর বেঙ্গল ফাউণ্ডেশনের সাথে। ফাঁকে ফাঁকে কবিতা লিখেছেন, ছোটদের জন্যে ছড়াও। চাপের মধ্যে থেকেও কখনও তাঁর প্রসন্নতা হারান নি, এমনকী প্রফুল্লতাও। কাজে চাপ কিংবা তাড়াহুড়ার ছাপ থাকত না তাঁর কোনো কাজে কিংবা আচরণে-ব্যবহারে। হয়ত সময় নিতেন তিনি, কিন্তু কাজের মানে আপস করতেন না, নিজের কাজটিই করতেন।
তাঁর আগ্রহের ক্ষেত্রও ছিল ছড়ানো  পেইন্টিং এবং গ্রাফিক্স, ড্রয়িং এবং স্কেচে সমান পারদর্শী; আগ্রহ ছিল সঙ্গীতে   উচ্চাঙ্গ, পুরোনো বাংলাগান, রবীন্দ্র-নজরুলসহ পঞ্চভাষ্কর, কি নয়; চলচ্চিত্রের প্রতি কেবল আগ্রহ নয় ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনে ছিলেন, ছিলেন আগ্রহী চলচ্চিত্র তৈরিতেও; সাহিত্য পাঠের অভ্যাস শৈশব থেকেই, এবং তা কখনও ছাড়েন নি; বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের প্রতিও কৌতূহলী ছিলেন। পছন্দের বই কেনা কখনও ছাড়েন নি। রেখে গেছেন ঈর্ষণীয় গানের সংগ্রহ। বইয়ের সংগ্রহে আছে দুর্লভ অনেক বই। ভালো চলচ্চিত্রের সংগ্রহও গড়ে উঠেছিল তাঁর।
কাইয়ুমভাইয়ের পক্ষে নিজের আঁকা প্রচ্ছদের বইগুলোর হদিশ নেওয়া বা দেখে শেষ করা সম্ভব ছিল না - তা সংখ্যায় এত বেশি। আমন্ত্রণপত্র, পোস্টার, মোড়ক-নক্সা, লোগোর ক্ষেত্রেও একথা খাটে। এমন বিপুল কাজের মান বজায় রাখা কঠিন কাজ। কাইয়ুম চৌধুরী অনায়াসেই তা ধরে রেখেছিলেন।
এর মধ্যে পেইন্টিং, ড্রয়িং কম করেন নি। তাতেও নিজের স্বাক্ষর রেখেছেন, উচ্চমান ধরে রেখেছেন। অন্য পরিচয়ের আড়ালে সমকালে তাঁর চিত্রকর পরিচয় তেমনভাবে আলোচিত হয় নি। এবার দিন যত গড়াবে ততই তা বাড়বে, কারণ চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরীকে উপেক্ষা করার উপায় নেই। তাঁর কবিতা কাব্যগুণ এবং বিশিষ্টতার কারণে পাঠকপ্রিয় হয়েছে, শিশুতোষ ছড়াও চমৎকার লিখেছেন। আজও অলঙ্করণে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তাঁর হাতের বর্ণবিন্যাসের অসাধারণত্ব হাতছাড়া হয়নি কখনও।
এতসব কেজো আর কালিক গণ্ডিতে বাঁধা শিল্পকর্মে ব্যস্ত থেকেও তিনি আশ্চর্যরকম দক্ষতায় কাজোত্তীর্ণ ও কালোত্তীর্ণ চিরকালের ছোঁয়া দিতে পেরেছেন তাঁর অধিকাংশ সৃষ্টিতে। তাই মানুষটার মধ্যে প্রয়োজন-অপ্রয়োজন, ক্ষণকাল-চিরকাল, কাজ-বিরাম, শ্রম-উপভোগ একাকার হয়ে গিয়েছিল। মানুষের মধ্যে থেকেও তিনি একা, আবার খ্যাতি-প্রতিষ্ঠার গণ্ডিতে থেকেও বিচ্ছিন্ন বা একা হন নি, থেকেছেন সবার।
বহুসত্তার এক রেনেসাঁসকালের মানুষ ছিলেন তিনি। জীবন কাটিয়েছেন জাতীয় ইতিহাসের নানা দুঃসময়ের ভাঙাগড়ার মধ্যে। কিন্তু তাতে তাঁর রেনেসাঁস-সত্তার বৈচিত্র ও বিশালতা ক্ষুণœ হয় নি। কাল কিংবা দুঃসময় তাঁকে হজম করতে পারে নি, পরাভূত করতে পারে নি। কাইয়ুম চৌধুরী খ্যাতি-প্রতিষ্ঠার কাছে যেমন নিজেকে সঁপে দেন নি, তেমনি ক্ষয়িষ্ণু কালের কাছেও হার মানেন নি। এমন আলোকিত জীবনের যবনিকা তো আলোকিত মঞ্চে নায়কের ভূমিকায় সহস্র মানুষকে সাক্ষী রেখেই পড়বার কথা। তার অন্যথা হয় নি।

***




   

Tuesday, October 21, 2014

দুর্নীতির কী হবে?

আবুল মোমেন

রাজনীতির মাধ্যমে জননেতা হওয়ার অর্থ হল তাদের অভিভাবক হওয়া। নির্বাচনের মাধ্যমে সাংসদ হওয়ার অর্থ হল জনগণের প্রতিনিধি হওয়া। আর এরপরে সরকারের মন্ত্রী হওয়ার অর্থ হল জনগণের সেবক হওয়া।
এই মানদণ্ডে যদি আমরা সদ্য-বিতাড়িত মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর ভূমিকা বিচার করি তাহলে তিন ক্ষেত্রের কোনোটিতেই তিনি পাশ মার্ক পান না।
তাঁর সম্পর্কে আগে থেকেই পত্রপত্রিকায় নানা বিরূপ খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাতে তাঁর এক বেপরোয়া বদমেজাজী অশালীন এবং দুর্নীতিগ্রস্ত চেহারাই ফুটে ওঠে। পত্রিকার এই সমালোচনা বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হত সবার। সাম্প্রতিক বিতর্কিত ভূমিকার পরে তাঁর বিরুদ্ধে খবরের জোয়ার বইছে এখন।
পত্রিকায় দেখলাম স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও সমালোচনায় কণ্ঠ মেলাচ্ছেন, এবং তিনি কেবল লতিফ সিদ্দিকীর নয় পুরো পরিবার সম্পর্কেই নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। শেখ হাসিনা বলেছেন, সিদ্দিকীরা পাগলের পরিবার। যে দু’জন সিদ্দিকী খ্যাতি (এবং কুখ্যাতি) লাভ করেছেন দু’জনের মতিভ্রম ঘটে মাঝে মাঝে, এলোমেলো কথাবার্তা বলতেও শোনা যায়। তবে আমরা সাধারণ মানুষ বিশেষজ্ঞীয় মতামত দিতে পারব না। যা হোক, প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ লতিফ সিদ্দিকী ইস্যুটি দক্ষতার সঙ্গেই নিয়ন্ত্রণ করেছেন। এক্ষেত্রে দূরদর্শিতা এবং পরিণত বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন তাঁরা।
এবার দেখার বিষয় হল এ ঘটনাটি থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কোনো শিক্ষা নেন কিনা। আমরা এ বিষয়ে একটু আলোকপাত করব।
আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে রাজনীতিকে অনেকেই ব্যক্তিগত বিত্তবৈভব অর্জনের ক্ষমতা হিসেবে ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। ক্ষমতাই দেবতা ক্ষমতাই মোক্ষ। ক্ষমতার আওতা এবং জৌলুস বাড়ানোর জন্যেই প্রয়োজন হয় নির্বাচনে দাঁড়িয়ে বিজয়ী হওয়া, এবং বিজয়ী হয়েই অফিসিয়ালি জননেতা হওয়ার সৌভাগ্য হয়। তারপর প্রতিযোগিতা শুরু হয় দলের মূল নেতার নেকনজরে আসার, অনুগ্রহভাজন হওয়ার। ভাগ্যে ভালো থাকলে মন্ত্রিত্বের শিকে ছিঁড়তে পারে।
এটি তাঁদের জন্য প্রথমত বিনিয়োগের ক্ষেত্র, দ্বিতীয়ত নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখা ও প্রভাব বাড়ানোর দূরূহ এক প্রতিযোগিতা যা তাঁরা জনসমর্থনের শক্তি ব্যবহার করে জিততে জানেন না, তাদের নির্ভর করতে হয় সশস্ত্র ক্যাডারদের ওপর। ফলে এ পর্যায়ে ক্যাডার পালন করতে হয়, তাদের অবৈধ, অনেক সময় অপরাধজনক কাজকে প্রশ্রয় দিয়ে নিজের অগ্রযাত্রা বজায় রাখার ধুরন্ধর কৌশলি লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। আর তৃতীয়ত, অপরাধ ও অবৈধ কাজের প্রতিষেধক হিসেবে নানান ‘সমাজসেবামূলক’ কাজে অর্থ সাহায্য দিয়ে নিজের জন্যে সভাপতি, প্রধান পৃষ্ঠপোষকের পদ ক্রয় করে নিতে হয়। এভাবে এ ধরনের বিতর্কিত নেতাদের প্রভাব বলয়ের মধ্যেই রাজনৈতিক দল আটকে পড়েছে আজ। কোনো বড় নেতাও কোনো দলকে এই গণ্ডি থেকে বের করে আনতে পারছেন না।
শুনেছি লতিফ সিদ্দিকীর ব্যক্তিগত পাঠাগার বেশ সমৃদ্ধ, তিনি পড়াশুনাও করেন, নিজে লেখালেখিও করেন, তাঁদের দু’ভাইয়ের লিখিত বইও আছে। সে বিচারে তিনি একজন সাহিত্যসেবী। তিনি ও তাঁর ভাই বড় মাপের মুক্তিযোদ্ধা, এ বিষয়ে কেউ বিতর্ক করে না। পঁচাত্তরের পরে একসময় লতিফ সিদ্দিকী দীর্ঘদিন কারাবন্দীও ছিলেন। অর্থাৎ সংগ্রাম এবং ত্যাগ  আদর্শবাদী রাজনীতির এই দুটি দীক্ষাই তাঁর রয়েছে। কিন্তু তারপরেও এ দশা কেন? কারণ, দেখা যাচ্ছে সত্যিই তিনি বেপরোয়া মানুষ, কাউকে মান্য করতে, সমীহ করতে, এমনকি সামান্য সৌজন্য ভদ্রতা রক্ষা করতেও অভ্যস্ত নন। এটি ব্যক্তিগত আচরণের একটি সমস্যা, সাংস্কৃতিক রুচির সংকটও বলা যায়। আর বর্তমান রাজনীতির ধারায় ধীরে ধীরে অতীতের অনেক রাজনীতিবিদ গা-ভাসিয়েছেন - দুর্নীতি তাঁদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
প্রশ্ন হল, তাঁর সম্পর্কে পত্রপত্রিকার খবর, কিংবা তাঁর ব্যক্তিগত আচরণগত সমস্যার কথা প্রধানমন্ত্রী কি জানতেন না? কথাটা কি বিশ্বাসযোগ্য? অনেকসময় দেখা গেছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লতিফ সিদ্দিকীকে তিনি সঙ্গে রেখেছেন। গুটিকয়েক মন্ত্রীকে নিয়ে যেসব অনুষ্ঠান তাতেও লতিফ সিদ্দিকী থেকেছেন। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের মন্ত্রীর তালিকায় তিনি রয়েছেন।
এই আস্থার এমন প্রতিদান সিদ্দিকী দিয়েছেন যে প্রধানমন্ত্রীকে এবারে ব্যবস্থা নিতেই হল। আবারও প্রশ্ন ওঠে - কেবল কি জনগণ ফুঁশে উঠলেই রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবেন? আইন বা শৃঙ্খলার কোনো নিজস্ব গতিপথ থাকবে না?
কিন্তু গুরুতর প্রশ্ন হল লতিফ সিদ্দিকীকে প্রধানমন্ত্রী, সরকার বা আওয়ামী লীগ যে শাস্তি দিল তা তো দুর্নীতির জন্যে নয়, ধর্মদ্রোহী কথার জন্য। এই একটি বিষয়ে সরকারের হাতপা বাঁধা, কেননা ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব পড়বে। অতএব ব্যবস্থা নিতেই হয়েছে। কিন্তু কেবল দুর্নীতি কিংবা অশালীন অভদ্র্র ও অগ্রহণযোগ্য আচরণের জন্যে শাস্তি আছে কিনা তা স্পষ্ট নয়।
দেশে ব্যাপকহারে দুর্নীতি হয় তা সকলেই জানেন, এও জানা বিষয় যে বড় আকারের দুর্নীতি ক্ষমতা ও ক্ষমতাবানদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং অনেক সময়, ইচ্ছাতেই হয়ে থাকে। সরকারের মন্ত্রী, সাংসদদের মধ্যে বা সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির খবর পাওয়া যায়। অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগগুলো বেশ প্রকট। কারও কারও আচরণগত সমস্যা সরকার ও সরকারি দলের ভাবমূর্তির সংকট তৈরি করছে। সাংসদদের মধ্যে দুর্নীতি, মাস্তানপোষণ এবং ব্যক্তিগতভাবে আচরণগত সমস্যার  প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা ও প্রতিপক্ষের লোকজনকে মারধরের ঘটনা বাড়ছে। সরকার নিশ্চেষ্ট থাকছেন, বা এত ধীরে এবং মৃদুভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্তি করছে, হালকা কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা নিচ্ছে যে তাতে এ রোগ মহামারীতে রূপ নেওয়া ঠেকবে না। এ অবস্থায় অচিরেই সরকারকে পুলিশ ও মাস্তানের ওপর নির্ভর করেই দেশ চালাতে হবে। কারণ এভাবে চললে জনসমর্থন কমতেই থাকবে।
আমরা আশা করব লতিফ সিদ্দিকী উপকাহিনীটি থেকে সরকার ও সরকারি দলের জন্যে কিছু শিক্ষা নেওয়ার আছে।
প্রথমত, জনগণ বেপরোয়া প্রকৃতির মানুষদের পছন্দ করে না, দ্বিতীয়ত, এ ধরনের আত্মম্ভরি মানুষ কখনও নির্ভরযোগ্য হতে পারে না, তৃতীয়ত, তাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত হবেনই এবং তাতে সরকারের জন্যে নেতিবাচক ভূমিকাই পালন করবেন। ক্ষমতার সব রকম অপব্যবহার বন্ধ হওয়া দরকার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ শুরু করা জরুরি। লতিফ সিদ্দিকী ইস্যু সম্পন্ন হওয়ার পর এ থেকেই শিক্ষা নিয়ে এ দুই কাজে সরকার বিশেষ জোর দিতে পারেন। এতে আখেরে তাঁরাই লাভবান হবেন।
তিনিই একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি, দূরদর্শী নেতা যিনি যে কোনো ঘটনা থেকে সঠিক শিক্ষাটি নিতে পারেন। সব ঘটনারই কার্যকরণ থাকে, এবং কোনো মানুষের ভূমিকা সীমা ছাড়ানোর পিছনে কারও না কারো প্রশ্রয়ও থাকে। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে নিজকে নিজে প্রশ্ন করতে পারেন তাঁর মন্ত্রী হয়ে লতিফ সিদ্দিকী লাগামছাড়া কথাবার্তা বলার এবং বেপরোয়া গা-জোয়ারি ভূমিকার সাহস পেলেন কোত্থেকে? এ ব্যাপারে তাঁর কি কোনো ব্যর্থতা কিংবা উদাসীনতা ছিল? অর্থাৎ আশকারা পাওয়ার ঘটনা কি ঘটে নি?


Sunday, September 28, 2014

আরবদেশে মুক্তি কোন্ পথে?

আবুল মোমেন

কয়েকটি ছোট ছোট প্রশ্ন তোলা যাক।
সাদ্দাম হোসেনকে একনায়কত্বের পথে শক্তি জুগিয়েছে কে?
ইরানের বিরুদ্ধে সাদ্দামকে অস্ত্রসজ্জিত করে যুদ্ধে ঠেলেছে কে?
আফগানিস্তানের তালিবানদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সংগঠিত করেছে কে?
ওসামা বিন লাদেন ও আল-কায়েদার পৃষ্ঠপোষক ছিল কে?
পিএলও-র বিপক্ষে হিজবুল্লাহর উত্থানে মদত দিয়েছিল কে?
ইজরায়েলকে আরবদের বিরুদ্ধে একতরফা পক্ষপাতমূলক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে কে?
এ ছ’টি প্রশ্নের উত্তর একটিই - যুক্তরাষ্ট্র।
আজ এটা পরিস্কার এই সব মানুষ ও সংগঠনের উত্থান সেসব অঞ্চলের জন্যে কল্যাণকর হয় নি।
আরও কয়েকটি প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক বলেই উত্থাপন করা দরকার।
ইরাকে আক্রমণ চালানোর জন্যে গণ-ধ্বংসাত্মক অস্ত্র মওজুদের অজুহাত কি সত্য ছিল?
প্যালেস্টাইনি নেতা ইয়াসির আরাফাতকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়া কি সঠিক ছিল?
ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পরে ইরাকে কি শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে?
একতরফা ব্যবস্থার মাধ্যমে আফগানিস্তান সমস্যার কি যথাযথ সমাধান করা গেছে?
চারটি প্রশ্নেরই উত্তর একই - না।
আমরা দেখছি এ সব অঞ্চলে ভোগান্তি আরও বেড়েছে, প্রাণহানি অব্যাহত রয়েছে, রক্তপাত ও ধ্বংস চলছেই। শত্র“তারও অবসান হচ্ছে না।
উপরের প্রশ্নোত্তর পর্বের পটভূমিতে যদি মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বিভীষিকা আইএস বা ইসলামিক স্টেট দলের ভূমিকা বিচার করি তাহলে পশ্চিমা প্রচারণার ওপর-ভাষ্যে ভুলে গেলে বোধহয় চলবে না। তলিয়ে বিচার করা দরকার।
বহুকাল ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হচ্ছে অন্যান্য আরব দেশের মত সিরিয়াতেও বশংবদ সরকার কায়েম। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করে শিখণ্ডি সরকার বসিয়ে বিপুল তেলসম্পদের বখরা ভালোভাবে আদায় হয়েছে। এ অঞ্চলে এখন একমাত্র হাতছাড়া রয়েছে সিরিয়া। দীর্ঘদিন নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েও সার্থক হয় নি যুক্তরাষ্ট্র। পুরোনো সম্পর্কের জের ধরে মধ্যপ্রাচ্যে শেষ সমর্থক-রাষ্ট্রকে রক্ষায় রাশিয়া এখনও আন্তরিক। ইরানও রয়েছে পাশে। যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক কোনো যুদ্ধে আর জড়াতে চায় না। বিশেষত ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধে মার্কিন সৈনিকদের প্রাণহানি, পেশাগত নৈতিকতাচ্যুতি, এবং আহতদের মানসিক বৈকল্য ও বিপুল খরচের চাপ মার্কিন ভোটারদের একই ধরনের অভিজ্ঞতার প্রতি বিরূপ করে রেখেছে। কিন্তু সিরিয়াকে অমনি ছেড়ে দিতে রাজি নয় যুক্তরাষ্ট্র, হস্তক্ষেপের ফিকিরেই ছিল পরাশক্তিটি।
এমন সময়ে আকস্মিকভাবে ইরাক থেকে উত্থান ঘটল ভয়ঙ্কর মতাদর্শের আইএস। তারা একটি অঞ্চলে রাতারাতি ইসলামি খেলাফতই প্রতিষ্ঠা করে ফেলল! তারপর এমন জঙ্গি নিষ্ঠুর অমানবিক আচরণ শুরু করল যা কোনো ধরনের ইসলামি দল-উপদলের পক্ষেও সমর্থন করা সম্ভব নয়। লক্ষ্য করবার বিষয় আইএসকে সমর্থন করার মত কোনো স্বীকৃত মুসলিম সংগঠন নেই। আবার সকল বিরুদ্ধতাকে হেলায় অগ্রাহ্য করে আইএস তার মানবতাবিরোধী অপরাধ চালিয়েও যাচ্ছে। কোনো রাষ্ট্রশক্তি এবং কোনো বড় সাংগঠনিক শক্তির সমর্থন ছাড়াই আইএসের অমানবিকতার অগ্রাভিযান অব্যাহত রয়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে মানবিক বিপর্যয়ের মাত্রা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।
এবার যদি আমরা প্রশ্নটা তুলি - আইএসের আকস্মিক উত্থান এবং এত বাধার মুখেও অগ্রাভিযানের পিছনে কে?
উত্তরটা কী হতে পারে বলে আপনারা ভাবছেন? উত্তর কিন্তু একটিই Ñ আগের অঘটনগুলোর ধারাবাহিকতা এখানেও ক্ষুণœ হয় নি। বলা যায়, কলকাঠি যুক্তরাষ্ট্রই নাড়াচ্ছে, সঙ্গে যথারীতি মিত্ররাও রয়েছে। ফ্রান্স ও অষ্ট্রেলিয়া ইতোমধ্যে আইএসের ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে। পশ্চিমে যারা বসবাস করেন, তাদের মধ্যে যাদের চোখকান খোলা তারা পুঁজিবাদী বিশ্বের এসব চালাকি ভালোই ধরতে পারছে। তাদের মধ্যে যারা তরুণ, যাদের রক্ত গরম, তারা অনেক সময় এত অন্যায় দেখে নিজেদের ধরে রাখতে পারে না। তারা প্রতিকারের জন্যে আরেকটি ভুলের ফাঁদে পা দেয়, যেমন করে অতীতে তালিবান ও আল কায়েদায় ভুলে এভাবে শিক্ষিত ছেলেরা জেহাদী যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু পুঁজিবাদের হাতে সৃষ্ট এসব জঙ্গি সংগঠনের প্রাণভোমরা কখনও তারা হাতছাড়া করে নি। তারা মূলত পুঁজিবাদের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহৃত হওয়ার জন্যেই সৃষ্ট। প্রয়োজনে ফুরানোর পর যথারীতি তাদের ধ্বংস করেও দেওয়া হয়েছে। এখন তালিবান আল কায়েদার যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাদের বাগাড়ম্বরের ক্ষমতাটুকই আছে, সমান তালে লড়ে পুঁজিবাদী বিশ্বকে পরাস্থ করার কোনো ক্ষমতাই নেই।
আইএস ব্যাপক হৈচৈ বাধিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ভালোভাবে জায়গা করে দেওয়ার উপলক্ষ তৈরি করে দিয়েছে। তারাও আসরে নেমে পড়তে দেরি করে নি। প্রথমে বারাক ওবামা তাঁর ভোটারদের আশ্বস্ত করে বললেন, আমরা এবার আর স্থলবাহিনী পাঠাব না, কেবল বিমান আক্রমণ চালিয়েই কাজ সারব। সেভাবেই শুরু হল। এবারে তাঁদের সামরিক কৌশলবিদ আসরে নেমেছেন। তাঁদের কণ্ঠে একটু একটু শোনা যাচ্ছে যে শুধু বিমান আক্রমণ চালিয়ে সম্ভবত কাজ হবে না, এক পর্যায়ে স্থলবাহিনী পাঠাতেই হবে। এদিকে বিমান আক্রমণ এবং তাতে বেশ ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও আইএস তার নিষ্ঠুর জঙ্গি কার্যক্রম জোরদার করে চলেছে। ফলে পুঁজিবাদী মিত্রশক্তির মধ্যপ্রাচ্যে ঢুকে পড়ার উপলক্ষটা আরও ভালভাবে তৈরি হয়ে গেল।
আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি, যথাসময়ে আইএসের পরিণতিও তালিবান ও আলকায়েদার মতই হবে। কেবল দেখতে হবে পুঁজিবাদের তাদের কতটুকু এবং কতদিন লাগবে।
মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে মনে রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে রয়েছে সৌদিআরব, মিশর, কুয়েত, জর্ডান, প্রভৃতি আরববিশ্বের প্রভাবশালী ধনী মুসলিম দেশ।
আরব দেশগুলোতে আধুনিক শিক্ষা এখনও সাধারণের মধ্যে ছড়ায় নি। ফলে প্রথা এবং সংস্কৃতির প্রাচীন ধারার ঘোর থেকে জনগণ মুক্ত হয় নি। এসব দেশের শাসকদলের কাছে - তা রাজতন্ত্র স্বৈরতন্ত্র বা ছদ্মগণতন্ত্র, যা-ই হোক Ñ জনগণের এই পরিণতিই কাম্য। রাজা-প্রজার সম্পর্কের বাইরে এসব দেশে গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ এখনও সম্ভব নয়। নির্বাচনও এরকম সমাজে স্বৈরতন্ত্রী ও ধর্র্মান্ধদেরই ক্ষমতায় পাঠায়। গণতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতা, মানবাধিকার, নারীর সমানাধিকার, আইনের শাসন ইত্যাদির পক্ষে সমাজমানসকে তৈরি করার জন্যে কোনো সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন এসব দেশে এখনও হয় নি। ফলে বেশিরভাগ দেশে শরিয়ার নামে এমন সব রীতি চালু রয়েছে যা সমাজের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করছে। এতে ধনী দেশ হওয়া সত্ত্বের সাধারণ মানুষ শিক্ষা ও চেতনায় অগ্রসর হচ্ছে না। তাতে ইসলামের মূল শিক্ষা ও নবীর মূল চেতনার পরিপন্থী হয়ে পড়ছে সমাজগুলো। তাদের নেতৃত্বের পুঁজিবাদের তাঁবেদারির ফলে আজ ইসলাম ও মুসলিম জনগণ চরম প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ে গেছে। তাদের সাথে সরাসরি যোগ দিয়ে কিংবা এদের সৃষ্ট তথাকথিত ধর্মীয় সংগঠনে জুটে গিয়ে মুক্তির পথ মিলবে না। এর জন্যে প্রয়োজন সমাজ সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কার, এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লব। এটা জেহাদী জোশ দিয়ে অর্জিত হবে না, এটা সম্ভব হবে প্রত্যেক দেশে সচেতন মানুষ একাট্টা হয়ে নিজ নিজ দেশে সমাজ ও সরকার পরিবর্তনের কাজ করলে। তার ভিত্ তৈরি করে দেবে আধুনিক জনশিক্ষার প্রসার।
পশ্চিমের অস্ত্র কিনে, ভাড়াটে সৈন্য দিয়েও একাজ হবে না। নবীর দেখানো পথ জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে নিজেদের যোগ্যতা ও শক্তি বৃদ্ধি করে সমাজের নবায়নের মাধ্যমেই এটা অর্জন সম্ভব। পথটা সহজ বা সংক্ষিপ্ত নয়, দীর্ঘ ও বন্ধুর। সবাই জানি বড় কিছু অর্জন করতে হলে কঠিন পথে বিপুল ত্যাগেই তা মেলে। আর তার জন্যে যথাযথ হাতিয়ার প্রয়োজন। সেটি আপাতত একে ৪৭, রকেট লাঞ্চার, কামান-বাজুকা নয়। তার আগে দরকার জ্ঞানের আলোয় নির্মিত দূরদর্শী প্রজ্ঞাপূর্ণ নেতৃত্ব ও আলোকিত অনুসারীর দল। এই নেতৃত্বই নিজ দেশের জনগণকে জাগিয়ে তুলে ঐক্যবদ্ধ করবে। অর্থাৎ দূরদর্শী জ্ঞানী গণনায়কের প্রয়োজন আজ আরব দেশগুলোতে। এটাই তাদের মুক্তির একমাত্র পথ।

***

Tuesday, September 23, 2014

কী তৈরি করছি - শিক্ষার্থী নাকি পরীক্ষার্থী?

আবুল মোমেন

শিক্ষামন্ত্রীর নিরহঙ্কার নেতৃত্বে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অগ্রযাত্রা আমাদের দেশে ব্যতিক্রমী ঘটনা। এর মধ্যে সাড়ে তিন কোটি ছাত্রকে বত্রিশ কোটি বই শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনেই পৌঁছে দেওয়ার মত বিস্ময় যেমন আছে তেমনি আছে সর্বমহলের কাছে গ্রহণযোগ্য শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে রীতিমত বাস্তবায়ন শুরু করার মত ঐতিহাসিক অর্জন। শিক্ষামন্ত্রীর সততা ও আন্তরিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। সে ভরসায় শিক্ষা নিয়ে যাঁরা ভাবেন তাঁদের বিবেকের ওপর চেপে বসতে থাকা একটি দুর্ভাবনা ও উদ্বেগ তুলে ধরার কথা ভাবছি।
একেবারে প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পুরো শিক্ষাকে যে আমরা পরীক্ষার মধ্যে -গণ্ডিবদ্ধ করে ফেললাম কাজটা কি ঠিক হল? প্রশ্নটা তোলা জরুরি কারণ এতে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য - জ্ঞানবান বিবেচক নাগরিক তৈরি - বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই ঘাটতি রেখে শিক্ষার অপর গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি কতটা হতে পারে তাও বিচার্য বিষয়। এ দুটি বিষয়ের পরিপূরকতা বাধাগ্রস্ত হলে কাজ হবে না, কারণ দক্ষকর্মী তৈরি হবে জ্ঞানবান বিবেচক নাগরিকের ভিত্তিভূমির ওপর।
পরীক্ষা হল শিক্ষার্থীর সিলেবাস ভিত্তিক অর্জিত শিক্ষার মান যাচাইয়ের একটি পদ্ধতি। আমাদের দেশে যে পদ্ধতিতে শ্রেণিকক্ষের পাঠ দেওয়া এবং তার ভিত্তিতে পরীক্ষা নেওয়া হয় তাতে বিভিন্ন স্তরের সম্পূর্ণ অর্জনলক্ষ্য পূরণ ও পরিমাপ কোনোটাই করা সম্ভব নয়। নিচের পর্যায় থেকে অসম্পূর্ণ শিক্ষা এবং তার আবার পরীক্ষাকেন্দ্রিকতার ফল কেমন তা আমাদের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষিতসমাজের গড় আচরণ ও ভূমিকা থেকেই বোঝা উচিত। একটি অসম্পূর্ণ শিক্ষার প্রভাবে নানা অসম্পূর্ণতা নিয়েই সমাজ গড়ে উঠছে। বরং এই নব্যশিক্ষিতদের দাপটে আমাদের সনাতন ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ ও নৈতিকতাও চ্যালেঞ্জের মুখে অকার্যকর হয়ে পড়ছে। সমাজ আজ নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শূন্যতায় বিপথগামী হয়ে পড়েছে।
কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থায় শিক্ষার নগদ-লক্ষ্য হচ্ছে পরীক্ষায় ভালো ফল এবং তা এত উগ্রভাবে প্রধান হয়ে উঠেছে যে বাকি লক্ষ্যগুলো বাকিই থেকে যাচ্ছে, আর তাতে প্রত্যেক ছাত্রের জীবনে মানবিক শিক্ষার বকেয়ার পাহাড় জমছে। ছাত্র যেমন তেমনি শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিচারও হয় একমাত্র পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে। পরীক্ষা সর্বগ্রাসী হয়ে রীতিমত স্কুল ও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেই অকেজো করে দিয়েছে। কারণ পরীক্ষায় ভালো করা আদতে এমন একটি দক্ষতা যার জন্যে স্কুলে ব্যয়িত সময়কে রীতিমত অপব্যয় বলে মনে হচ্ছে অনেকেরই, বিপরীতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে কোচিং সেন্টার ও টিউটরের পাঠ। লক্ষ্য যদি একমাত্র পরীক্ষাই হয় তবে সে বিচারে এটাই বেশি ফলপ্রসূ। ছাত্র-অভিভাবকদের চাহিদা এবং সরকারের চাপের মধ্যে পড়ে শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার্থীতে রূপান্তরের কাজ করছেন এবং স্কুল নয় বস্তুত পরীক্ষার্থী তৈরির কারখানায় খাটছেন (কোচিং সেন্টার সম্পর্কে একথা আরও বেশি খাটে)। তবে তারা খুশিমনেই খাটছেন কারণ এটি আর্থিকভাবে লাভজনক। শিক্ষার্থীকে নিছক পরীক্ষার্থীতে রূপান্তরের এ অন্যায় দীর্ঘদিন চলতে থাকায় বর্তমানে শিক্ষক-অভিভাবক সকলেই পরীক্ষাকেই ধ্যানজ্ঞান এবং শিক্ষা বলে ভুল - না, অন্যায় - করছেন। ফলে শিক্ষা প্রশাসন-শিক্ষকসমাজ-অভিভাবক এবং এর ভিকটিম ছাত্র মিলে বিপথগামিতার ও অধোগতির রমরমা চলছে অবাধে। সোনালি পাঁচ-তারকা শিক্ষার্থীদের, থুড়ি পরীক্ষার্থীদের, সহাস্য ছবির আড়ালে এ অবক্ষয় ঢাকা যাচ্ছে না।
মুশকিল হল, এ আনন্দ প্রায়ই দেখা যাচ্ছে স্বল্পস্থায়ী। কারণ প্রাপ্ত শিক্ষা যে টেকসই নয় তা প্রথমে পরবর্তী ধাপের ভর্তি পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়ে যায় তাতে অধিকাংশের ফলাফলের হাল দেখে। কিন্তু তার আরও স্থায়ী অর্থাৎ টেকসই কুফল দেখা যায় সমাজে - শিক্ষিত মানুষদের দক্ষতার মান এবং  দুর্নীতি-অনৈতিকতার নৈরাজ্য দেখে। এছাড়া একজন শিক্ষিত মানুষের ন্যূনতম অর্জনের চিত্রও ভয়াবহ। দু একটি নমুনা দেওয়া যাক।
প্রাথমিকের মোদ্দা কয়েকটি অর্জনলক্ষ্য হল পড়া-লেখা-বলা-শোনা (শুনে বোঝা) এবং গণিতে নির্দিষ্ট দক্ষতা অর্জন। গোটা ছাত্রজীবনেই এসব অর্জনের অগ্রগতি চলবে।
বাস্তবে কী ঘটছে? প্রাথমিক স্তর নিয়ে একটি নির্ভরযোগ্য জরীপে দেখা যাচ্ছে শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ শিশু উপরোল্লিখিত দক্ষতাগুলো নির্দিষ্ট মান অনুযায়ী অর্জনে ব্যর্থ থেকেই প্রাথমিক পর্যায় সমাপ্ত করে, যাদের অনেকেই জিপিএ ৫-ও পেয়ে থাকে। তাদের কথা ছেড়ে দিন, আপনি যদি বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের  ছাত্র বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিপ্রাপ্তদের সামনে শরৎচন্দ্র বা হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের পাতা খুলে পড়ে শোনাতে বলেন তাহলে অভিজ্ঞতাটা কেমন হবে? আমার অভিজ্ঞতা বলে, দুচারজন ছাড়া কেউই ভাব ও অর্থ ফুটিয়ে শুদ্ধ উচ্চারণে গড়গড় করে পড়তে পারে না। পদে পদে হোঁচট খায়, এবং পাঠ ও রস উভয়ই ব্যাহত হয়।
চার বছর (বা ৬ বছর) বয়স থেকে আঠার বছর (অনেক ক্ষেত্রে তা আরও প্রলম্বিত হচ্ছে) একটানা পড়াশুনার মধ্যে থাকা সত্ত্বেও প্রায় সবারই জ্ঞানভিত্তিক স্মৃতি অত্যন্ত দুর্বল। অর্থাৎ এত বছরে তারা যেসব বিষয় পড়েছে (বা তাদের পড়ার কথা) যেমন - বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজ, পদার্থ বিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের নানা শাখা, মানবিক ও অন্যান্য বিদ্যা - তার পুঞ্জিভূত যে সঞ্চয় তাদের থাকার কথা তা গড়ে উঠছে না। বেচারা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন কেবল সঞ্চয় থাকলেও হবে না, কারণ তা স্তূপাকার হয়ে জঞ্জালে পরিণত হবে যদি না এ দিয়ে ভাবনা, চিন্তা, দর্শনসহ মনন ও উপভোগের নানান রসদ তৈরির প্রক্রিয়া চালু থাকে। এ কথা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে কেবল নির্ধারিত কিছু পাঠ্যবই পড়িয়ে প্রকৃত শিক্ষিত জাতি তৈরি করা যায় না। আর আমাদের দেশে পরীক্ষার্থীতে রূপান্তরিত ছাত্র অযথা পুরো পাঠ্যবই বা কেন পড়বে? শিক্ষক-টিউটরের সহযোগিতায় তারা আসন্ন পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তরগুলোই শুধু শেখে, প্রায় ক্ষেত্রে মুখস্থ করে। এভাবে কোনো বিষয় পূর্ণাঙ্গভাবে জানা হয় না, যেটুকু জানা হয় তার কোনো মননশীল চর্চার সুযোগ নেই। এই কাটছাঁট করা শিক্ষার উপমা হতে পারে পাখা ছেঁটে দেওয়া পাখি, যে আর উড়তে পারে না।
এভাবে শিক্ষাটা অর্থাৎ জানা বোঝা ইত্যাদি হয় ভাসা-ভাসা। যা সে পড়ে বা তার পড়ার কথা, সেসব কখনও তার ভাবনার বিষয় হয় না, বস্তুত এভাবে কারও সমৃদ্ধ চিন্তাজগত তৈরি হয় না। এ কারণে আমরা দেখি সংসদে সুস্থ তর্ক হয় না অশ্লীল ঝগড়া হয়। জাতীয় জীবনে কোনো ইস্যুতে সারগর্ভ আলোচনা হয় না একতরফা গোঁয়ার্তুমির প্রকাশ ঘটে।
পরীক্ষার এই দোর্দ--প্রতাপে জ্ঞানার্জন ও সাংস্কৃতিক মানসম্পন্ন মানুষ হয়ে ওঠার রসদগুলো অধিকাংশের অনায়ত্ত থেকে যাচ্ছে। এর চরম দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় বাংলা সম্মানের পাঠ শেষ করে  রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি ভিন্ন কোনো বইয়ের নাম বলতে পারে না এমন তরুণ প্রচুর এবং মূল টেকস্ট না পড়ে ইংরেজিসাহিত্যে ডিগ্রি অর্জন এদেশেই সম্ভব। একথাও বলা যায়, উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার পরও অধিকাংশের সাহিত্যবোধ, সমাজচিন্তা, বিজ্ঞানমনষ্কতা ইত্যাদি অবিকশিত থেকে যায়। পরীক্ষার রিলে রেসে আবদ্ধ ছাত্রজীবন কাটিয়ে অধূনা অধিকাংশ শিক্ষিতজনের স্কুলজীবনে নাটকে, অভিনয়ে, গানে, আবৃত্তিতে, বিতর্কে কি স্কাউটিং, ক্যাম্পিং, ক্রীড়ার অভিজ্ঞতা থাকছে না; স্কুল, সহপাঠী, শিক্ষককে নিয়ে এমন বৈভবময় অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হচ্ছে না যা ভবিষ্যত জীবনে বারবার ফিরে ফিরে আসবে মধুর উদ্দীপক স্মৃতিচারণ হয়ে। সঞ্চয়হীন মানুষ জ্ঞানের দিক থেকে অবশ্যই দরিদ্র থাকবে, আর স্মৃতিহীন মানুষের মানবিক খুঁটিগুলো তৈরি হয় না। বেপরোয়া কাজে কি বখাটেপনায় লিপ্ত হতে তার অন্তর থেকে রুচির বাধা তৈরি হবে না। নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়া তাদের পক্ষে সম্ভব। এই রিক্ততার বড় খেসারত হচ্ছে আমাদের শিক্ষিতজনদের প্রকৃত দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম গড়ে উঠছে না - পেশা বা জীবিকার সত্তার বাইরে মনুষ্যসত্তার মান খুবই খারাপ হচ্ছে।
পরীক্ষাই সব হয়ে ওঠায় একে ঘিরে শিক্ষার প্রতিকূল, অবাঞ্ছিত, এমনকি বেআইনি কাজ ও দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। এটাই স্বাভাবিক পরিণতি হওয়ার কথা। অন্ধবিশ্বাস যেমন ধর্মকে ঘিরে অসাধু ব্যক্তিদের ব্যবসার সুযোগ করে দেয় এ শিক্ষাও তার উপজাত হিসেবে নোটবই, টেস্ট পেপার, মেডইজি, কোচিং সেন্টার, টিউশিন এবং অবশ্যই প্রশ্নপত্র ফাঁসে শিক্ষাকে জড়িয়ে রাখছে। বত্রিশ সেট প্রশ্ন তৈরি করেও এটা বন্ধ করা যাবে না। কারণ শিক্ষার একমাত্র আরাধ্য দেবতা যদি হয় পরীক্ষা তো তাঁকে তুষ্ট করার জন্যে পুণ্যলোভী - এক্ষেত্রে A+ লোভী - শিক্ষার্থী বা তার অভিভাবক, তেমন পুরোহিতই খুঁজবেন যিনি যে কোনো মূল্যে - অর্থাৎ অবৈধ পথে হলেও - মোক্ষ লাভে সহায় হবেন। শিক্ষকের মধ্যে তেমন যোগ্য সাহসী মানুষের অভাব ঘটাই স্বাভাবিক। তাতে কেউ দমবেন না। সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা, কেরানি, প্রেসকর্মী, দপ্তরি, মায় দারোয়ান ইত্যাদি যেকোনো স্তর থেকে কাক্সিক্ষত সাহসী যোগ্য পুরুষ এগিয়ে আসবেনই। হয়ত দর চড়বে, প্রণামী বাড়বে - এই যা।
২.
এটি আদতে শৈশবেই সশ্রম দ-প্রাপ্ত শিশুর বেড়ে ওঠার গল্প। ঘরের নামে ওদের খাঁচায় বন্দি রাখা হয়, শিক্ষা জীবন কাটে কারাগারে, পরীক্ষার দ- খাটতে খাটতে। আশ্চর্য ব্যাপার হল শিক্ষা নয় এই দ- ভোগেই সবাই যেন প্রলুব্ধ হয়, এমনকি এতে আনন্দ পেতে থাকে, তার জন্যে নানা প্রলোভনও মওজুদ থাকছে। ফলে মানবজীবনের প্রস্তুতিকাল, পুরো কৈশোর ও প্রথম তারুণ্য, পরীক্ষার শৃঙ্খলে বাঁধা থাকছে। তাদের মাঠের, মুক্ত হাওয়ার, আলোর, আকাশের, গাছের, মাটির, জলের, সমবয়সীর সঙ্গের, বড়দের  স্নেহমমতার এবং গল্পের, সুরের, রঙের, আঁকার, ভাঙার, গড়ার, চড়ার, লাফাবার, দৌড়োবার যে অপরিমেয় ক্ষুধা-চাহিদা তা কি পূরণ করেছি আমরা? তার প্রকৃত আনন্দ, তার মনের বিকাশ কিসে সেসব ভাবনা কি আমাদের শিক্ষার এজেণ্ডায় আর সমাজের ভাবনায় আছে?
কোন ব্যবস্থায় একজন নিউটন জীবনসায়াহ্নে বলতে পারেন আমি মাত্র জ্ঞানসমুদ্রের তীরে নুড়ি কুড়াচ্ছি তা আমরা ভাবি না। আর ভাবি না বলেই জীবনপ্রভাতেই শিক্ষার্থীর গায়ে পরীক্ষার্থীর যুদ্ধ চড়িয়ে দিচ্ছি।
আমরা কেন এভাবে একটি - আসলে কোটি কোটি - বিয়োগান্তক গল্প রচনা করে চলেছি? এটা আফসোসের কথা, কারণ এ পরিণাম ঠেকানো সম্ভব - সহজেই এর পরিণতি মিলনাত্মক করা যেত।

***



Monday, September 8, 2014

কোন্ পথে চলবে বিএনপি

আবুল মোমেন

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণত বিরোধী দলের মূল কাজ হল জনগণের পাশে থেকে দেশ ও জনস্বার্থে বিভিন্ন ইস্যুতে অবস্থান গ্রহণ। বক্তব্য প্রকাশ এবং নানা মাত্রার আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে তা করাই রেওয়াজ। এছাড়া জনগণের কোনো ভোগান্তির সময়ও তাদের পাশে দাঁড়ানো রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব।
বর্তমানে উত্তরবঙ্গে বন্যা হচ্ছে। বন্যা বেশ ভালো মতই হচ্ছে এবং বহু মানুষ জলবন্দি হয়ে পড়েছেন। পত্রপত্রিকার খবরে বোঝা যাচ্ছে ত্রাণ কাজ এখনও অপ্রতুল। তাছাড়া এসব অঞ্চলে বিপুল দরিদ্র মানুষ এমনিতেই যে কষ্টে থাকে তা জানা থাকলে এ সুযোগে তাদের ঘরবসতি ও জীবনমানের উন্নতির জন্যে কিছু মানবিক কাজ করে রাজনৈতিক দল লাভবান হতে পারে। এছাড়া গার্মেন্টস কারখানাকে ঘিরেও মানবিক তৎপরতা চালানোর সুযোগ রয়েছে।
সারাদেশে রাস্তাঘাটের বেহাল দশায় যোগাযোগ খাতে জনদুর্ভোগ চরম পর্যায়ে রয়েছে। কয়েকটি লঞ্চডুবি ও প্রচুর প্রাণহানিতে  এ খাতের ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি ধরা পড়েছে। এভাবে তালিকা দীর্ঘ করা সম্ভব।
বিএনপি এরকম কোনো ইস্যু নিয়েই আন্দোলনে নামছে না। সব সময় সব ইস্যুতে তাদের সুচিন্তিত বক্তব্য থাকে না। ভুক্তভোগী মানুষের পাশে দলটিকে দেখাও যাচ্ছে না। বলা যায়, প্রত্যক্ষভাবে মাঠ-পর্যায়ে জনসেবার রেওয়াজ যেন এ দলটির মধ্যেই নেই।
বিএনপি নেতা-কর্মীরা জানেন কোনো মতে সাধারণ নির্বাচনের সুযোগ তৈরি করা গেলে তাদের জয়লাভের সম্ভাবনাই বেশি। হয়ত তাদের মূল্যায়ন হচ্ছে পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপির জয় অবধারিত। ফলে দেখা যাচ্ছে তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য ও কর্মকা- মূলত সরকার পতন ও দ্রুত মধ্যবর্তী নির্বাচনকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে।  মনোভাবটা হয়ত এরকম, একবার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ফিরে পেলে সব কাজই করা সম্ভব, করা হবে।
এই মনোভোবের কারণে দলের রাজনীতির জন্যেই কতকগুলো সমস্যা তৈরি হচ্ছে। প্রথমত, বিএনপি যে সরকারের বাইরে থাকলেও প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের ভূমিকা পালনে অসচেতন ও অক্ষম এ সমালোচনা সমর্থিত হয়। দ্বিতীয়ত, বিএনপির রাজনীতি একমাত্র এই দাবিকে ঘিরে আবর্তিত হওয়ায় একে অগ্রাহ্য করা কিংবা এটি আদায়ে সম্ভাব্য আন্দোলন ঠেকানোর জন্যে আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে মাঠে না নেমে সরকারি নানা ব্যবস্থা ও বাহিনীর সহায়তার মাধ্যমেই কাজ সম্পন্ন করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এভাবে দেশের নানা অঞ্চলে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন গড়ে ওঠা ও দানা বাঁধানোর কোনো সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। তৃতীয়ত, সরকার পরিবর্তন ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জনকল্যাণের জন্যে যদি করাও হয়ে থাকে তা মূলত একটি আইন ও সাংবিধানিক বা বলা যায় আদর্শিক বিষয় কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে জনদুর্ভোগ ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় বলে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। তারা বোঝে এটা দলের নীতি-নির্ধারকদের এজে-া, এতে যুক্তি বা বক্তব্য হাজির করা তাদের এক্তিয়ারের বিষয় নয়। চতুর্থত, এভাবে চলতে থাকায় জেলা পর্যায়ের নেতা ও সারাদেশের কর্মীদের মধ্যে যথার্থ রাজনৈতিক কর্মসূচি ও আন্দোলন দাঁড় করাতে না পারার হতাশা ছড়াচ্ছে। ফলে দিনে দিনে দল ও দলীয় কাজকর্মে স্থবিরতা নামছে। সরকার শাসনদ- আরও শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণে রাখার ও চালানোর সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে।
নি:সন্দেহে এটি বিএনপির রাজনীতির জন্যে কঠিন সময়। এ সময় নেতৃত্বের দূরদর্শিতা, সৃজনশীলতা এবং অঙ্গীকার ও সাহসী ভূমিকা প্রয়োজন ছিল। মানতেই হবে নেতৃত্ব এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে। এ সূত্রে বলা দরকার বর্তমান সময়ে মুসলিম জাতীয়তাবাদের পুরোনো ধরণ ও ভাবনা নিয়ে রাজনীতিতে এগুনো যাবে না। সময়োপযোগী পরিবর্তনের তাগিদ বোঝার জন্যে নেতৃত্বে দূরদর্শিতা প্রয়োজন, আর তা সম্পাদন করার জন্যে প্রয়োজন সৃজনশীল হওয়ার ক্ষমতা। তারপর চাই কর্মীদের নিয়ে সরকারি দল ও বাহিনীর প্রতিবন্ধকতা ভেঙে মাঠে নামার সাহস। এ তিন ক্ষেত্রেই এখনও পর্যন্ত খালেদা জিয়া বা তারেক রহমান দলকে যথাযথ নেতৃত্ব দিতে পারেন নি।
বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতির বিবেচনায় আওয়ামী লীগের একটি বড় সাফল্য হল জামায়াতে ইসলামির গায়ে ভালোভাবে যুদ্ধাপরাধীর ছাপ মেরে দিতে পারা। তার ওপর, বর্তমান মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি এবং ইসলামি জঙ্গিবাদ উত্থানের সমস্যার আলোকে ওয়াহাবিপন্থাসহ সুন্নিধারা থেকে উদ্ভূত নানান কট্টরপন্থা সম্পর্কে মুসলমানদের মধ্যেও সচেতনতা ও সতর্কতা তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থায় জামায়াতে ইসলামকে রাজনৈতিক সঙ্গী রাখা এবং রাজনৈতিক কর্মকা-ে তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকা রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিচ্ছে বলে মনে হয়  না।
একটি খাঁটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপির উচিত ছিল ক্রমশ কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা বর্তমান সরকারের ভূমিকায় ধীরে ধীরে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হতে থাকা নাগরিকসমাজের বিভিন্ন ফোরামের সাথে সংযোগ বাড়ানো। এটি ফলপ্রসূ করতে হলে অবশ্য মুক্তিযুদ্ধ ও জামায়াত সম্পর্কে তাদের বক্তব্য পরিষ্কার করে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। অতি সম্প্রতি দলে ক্রমেই সবচেয়ে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে থাকা সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমান ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বললেও দলীয় অবস্থান ও ভূমিকায় তার প্রতিফলন দেখা না গেলে এ কেবল সাময়িক রাজনৈতিক চাল বলেই গণ্য হবে। জনমনে কোনো গুরুত্ব পাবে না।
মনে রাখা দরকার, রাজনৈতিক অঙ্গনে কঠিন সময় ও প্রতিকূল চ্যালেঞ্জ একটি রাজনৈতিক দলের সামনে দলীয় ভাবমূর্তি, দলের প্রভাব এবং দল ও নেতৃত্বের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর বিরাট সুযোগ তৈরি করে। বস্তুত এভাবেই ষাটের দশকে পাকিস্তানের কর্তৃত্ববাদী শাসকের দমনপীড়নের মুখেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাঙালির জনপ্রিয় সর্ববৃহৎ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। বিপরীতে ক্ষমতায় থেকে সামরিক এজেন্সির সহযোগিতায় বিভিন্ন দলমতের মানুষের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা দলের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক দুর্বলতা আজ প্রকট হয়ে ধরা পড়ছে। এতকাল বিএনপির নেতা-কর্মীরা দলের এই সংকটের সাথে পরিচিত হন নি, কারণ তেমন বাস্তবতা তৈরি ছিল  না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আজ তা প্রকাশ হওয়ার পরে দলের নেতৃত্বকে পরিবর্তন-সংশোধনের বিষয় উপলব্ধি করতে দেখা যাচ্ছে না। বরং সরকারের চাপের মুখে তাদের আচরণ ও ভূমিকা দিশাহীন শিক্ষানবীশ রাজনীতিকের মত মনে হচ্ছে। ফলে কর্মসূচিগুলো যে নামকাওয়াস্তে দায়সারাগোছের কাজ তা বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না। নিজেরাসহ কেউই এগুলোর ব্যাপারে এখনও সিরিয়াস নন। এভাবে চললে আগামী নির্বাচনে আপনা-আপনি বিজয় এসে ধরা দেবে বলে নিশ্চিত থাকার সুযোগ বিএনপির জন্যে আর থাকবে না। আর কর্মীদের ছাপিয়ে ততদিনে হতাশার ছোঁয়া জনমনেও পৌঁছাবে।
বিএনপির ভবিষ্যত বর্তমানে নিহিত রয়েছে। বলা যায় বর্তমান সময় বিএনপির জন্যে ক্রান্তিকাল হিসেবে এসেছে। দেখা যাক তারা কি আওয়ামী লীগের মত সকল প্রতিকূলতা পেরিয়ে টিকে থাকতে পারবে নাকি মুসলিম লীগের মত বড় ধরনের পরাজয়ের ধাক্কায় ধীরে ধীরে কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে।

Saturday, July 26, 2014

মধ্যপ্রাচ্যের অভিজ্ঞতা আমাদের কী শিক্ষা দেয়

আবুল মোমেন

পশ্চিমের গণমাধ্যম মালয়েশিয়ান যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করার ট্রাজেডি যে গুরুত্ব পেয়েছে তা গাজায় ইজরায়েলের নরমেধযজ্ঞকে ছাপিয়ে গেছে। একইভাবে জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন ফোরামে ও অন্যান্য কূটনৈতিক তৎপরতাতেও এ ইস্যুটিাই এখন প্রাধান্য পাচ্ছে।
বিমান ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা অবশ্যই মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। আর বিমান ভূপাতিত করার ঘটনা একটি নিকৃষ্ট ধরনের অপরাধ। অবশ্যই এ ট্র্যাজেডির সুষ্ঠু স্বচ্ছ তদন্ত হওয়া উচিত এবং দোষী ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করে শাস্তি দেওয়া সবারই দাবি।
গাজায় ইজরায়েলের সর্বাত্মক আক্রমণ বস্তুত ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে গণহত্যার ঘটনা। শুধু নিহত ও আহতের সংখ্যা এবং ও সম্পদ ধ্বংসের দিক থেকে এ বর্বর আক্রমণ বিমান দুর্ঘটনার চেয়ে আকারে অনেক বড়। মৃতের সংখ্যা পাঁচশ ছাড়িয়ে গেছে, আহত দুই হাজারের ওপরে। সবচেয়ে বড় কথা মারা যাচ্ছে বেসামরিক মানুষ, যার অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু। এটি কোনো যুদ্ধ নয়, হামাসের রকেট হামলা বা সামান্য প্রতিরোধ বানের জলে খড়কুটোমাত্র। এটি একতরফা গণহত্যার ঘটনা। এ শতাব্দীর এযাবৎ সবচেয় বড় ট্র্যাজেডি ঘটে চলেছে বিশ্ববাসীর সামনে। নিহতদের সকলেই মুসলমান, এখন রমজান মাস চলছে, সামনে ঈদ।
মালয়েশিয়ার যাত্রীবাহী বিমান ট্র্যাজেডি নিয়ে পশ্চিমের এত গরজের মূল কারণ এ ঘটনায় তারা প্রতিপক্ষ রাশিয়ার দিকে আঙুল তাক করতে পারছে। ক্রিমিয়া দখলের অজুহাতে তারা একজোট হয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কিছু বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা চালাচ্ছে। তাতে অবশ্য পুতিনকে নরম করা যায় নি। এবারে ঘোলাটে পরিস্থিতির মধ্যে ইউক্রেনের বিদ্রোহী রুশপন্থীদের সমর্থন দানের অজুহাতে রাশিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি ঘোলাটে নয়। একেবারে কাঁচের মত স্বচ্ছ। ইজরায়েল কোনো রকম রাখঢাক করছে না, তারা ঘোষণা দিয়েই হামাস-দমনের নামে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রে হানা দিয়েছে, ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। খুনী কে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা চুপ।
তারা কেন চুপ সে ইতিহাস অবিদিত নয়। কেন কৃত্রিমভাবে মধ্যপ্রাচ্যে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হল, কারা করল তা সবার জানা আছে। ১৯২২ সনে বেলফুর ঘোষণার মাধ্যমে এই নবযাত্রা শুরু। ১৯৪৬ সনে প্যালেস্টাইন থেকে আরব মুসলমানদের উৎখাত করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিজয়ী ব্রিটেন-ফ্রান্স-যুক্তরাষ্ট্র যেন যুদ্ধে নাৎসি অনাচার-অবিচারের ক্ষতিপূরণ হিসেবে এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দিল। আদতে ইহুদিবাদীদের এ পৃথক ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বহু পুরোনো। ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখন হ্রাস পাচ্ছিল তখন তারা সর্বত্র কৌশলগত সুবিধা কায়েমের প্রয়াস চালিয়েছে। উপমহাদেশে পাকিস্তান সৃষ্টি ও কাশ্মীর সমস্যা তৈরি যেমন তেমনি প্রত্যক্ষভাবে শাসকের হাত গুটানোর আগে মধ্যপ্রাচ্যে তৈরি করল ইজরায়েল রাষ্ট্র। রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ সারা বিশ্ব থেকে ইহুদিরা এসে বসতি করেছে এই জবরদস্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে। ১৯৪৮ সালের আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ থেকে নিয়ে আজকের দিন পর্যন্ত ইতিহাস বিচার করলে দেখা যাবে প্রতিবারের যুদ্ধে ইজরায়েল তার ভূসীমানা বাড়িয়েছে। ইহুদি বসতি বাড়িয়ে যাওয়াই তার লক্ষ্য। এবারে যুদ্ধ শেষ হলে হয়ত পশ্চিম তীরে কিছু জমি দখলে রাখবে তারা।
ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্ররা যখন মানবাধিকার বা আইনের শাসনের কথা বলে, যখন আমাদের এ বিষয়ে নানা উপদেশ দিতে চায় তখন এর ভণ্ডামির দিকটাও যেন আমরা খেয়াল রাখি। এসব যে নিতান্ত ফাঁকা বুলি, তাদের দ্বৈতনীতি ও দ্বৈত মানদণ্ডের প্রমাণ তা-ও আমাদের বুঝতে হবে। আমরা নিশ্চয় দেশে সবার মানবাধিকারের সুরক্ষা চাইব, আমরা অবশ্যই দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকুক এমনটাই চাই। কিন্তু তা নিজেদের তাগিদে, নিজেদের বিবেক বোধ থেকেই চাইব। কারও শেখানো বুলি হিসেবে নয়, তাদের মুখপাত্র হয়ে নয়। বিশেষ ভাবে আমরা অবশ্যই পশ্চিমা দেশ বা তাদের সংস্থাগুলোকে সাক্ষী মেনে নিজের দেশের সমস্যা সমাধান করতে যাব না। তাদের ভণ্ডামি, মিথ্যাচার, দ্বিবাচার আজ আর গোপন কিছু নয়।
কথা হল, মুসলিম দেশগুলোর সাথে পশ্চিমা বিশ্ব এভাবে মুরুব্বিয়ানা করে চলেছে কীভাবে কেনই বা তারা বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ একাজ অপ্রতিহতভাবে করতে পারছে? না, এটা কোনো মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন নয়। এর উত্তরও সবার জানা।
মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে মুসলিম বিশ্বের মুরুব্বী দেশ সৌদি আরব। আর সৌদি আরবের নেতৃত্বে সেখানকার সকল তেলসমৃদ্ধ দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের কাছে আত্মবিক্রিত হয়ে আছে। ওআইসি বা আরব লীগের শক্তিশালী সদস্য হচ্ছে সৌদি আরব। এসব আরবদেশের শাসক সম্প্রদায় তেলের সম্পদে অচিন্ত্যনীয় বিলাসী জীবন যাপনে অভ্যস্ত। আর ওদের সকল তেলখনি মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক কোম্পানির অধীনে পরিচালিত। তাদের উপার্জিত অর্থ বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বে লগ্নি খাটার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। অর্থাৎ একদিকে তেলের উৎস দেশগুলোকে কমিশন দিয়ে বিপুল উপার্জন করছে তারা আর অন্যদিকে উৎস দেশসমূহের অর্জিত কমিশনের টাকার সিংহভাগ থাকছে তাদের মালিকানাধীন ব্যাংকে বা খাটছে তাদের দেশসমূহে অন্যান্য ব্যবসায়িক খাতে। এই মহালাভের স্বর্গসুখ কোনো বোকাও সহজে ছাড়তে যাবে না। আর এখনও পর্যন্ত গোত্রবিভক্ত অনাধুনিক আম আরব জনগণ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মাথা তুলতে পারে নি। তাদের ওপর স্বৈরাচারী বাদশাহী শাসন চলছে, ইসলামের নামে সকল রকম গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকার হরণ করা হয়েছে সেসব দেশে। শাসককুলকে বিভোর করে রাখা হয়েছে ভোগবিলাসের আনন্দে, যেমন একসময় সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন চীনাদের বুঁদ করে রেখেছিল আফিমের নেশায়।
কেন পশ্চিমারা ইরাকের শাসক সাদ্দাম হোসেনের ওপর এত খাপপা ছিল, এত খড়্গ হস্ত হল? তাও অবশ্য কারো অজানা থাকার কথা নয়। আরব অঞ্চলে সাদ্দাম ছিলেন অন্যান্য শাসকদের থেকে পৃথক। তিনিও স্বৈরাচারী ছিলেন, কিন্তু ছিলেন জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তি, তিনি তাঁর দেশের তেলখনির ওপর অধিকার বাড়াচ্ছিলেন, তেল ব্যবসা স্বাধীনভাবে চালাচ্ছিলেন। ফলে তাঁকে নিয়ে মুরুব্বীদের সমস্যা। আরেক সমস্যা হল ভূতাত্ত্বিক জরীপে দেখা যাচ্ছে ইরাকে আরও প্রচুর তেল ও গ্যাস মওজুদ রয়েছে। এরকম একটি ‘সোনার’ খনি এরকম একজন ‘বেয়াড়া’ লোকের হাতে ছেড়ে দিতে চায় নি পশ্চিমের কার্পোরেট মুরুব্বীরা। তাদের হয়েই দেশ শাসন করেন ওবামা-বুশরা, ব্লেয়ার-ক্যামেরুনরা। ফলে তাদের চাপ এবং নিজেদের গরজ কাজ করেছে একযোগে। মনে করুন ১৯৫৩ সনে ইরানের ঘটনা। সেদেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ড. মোসাদ্দেক সরকার যে-ই তেলখনি জাতীয়করণ করল অমনি একটা অজুহাত খাড়া করে আক্রমণ চালাল ব্রিটেন। সরকারের পতন ঘটাল এবং দ্রুত শাহের মাধ্যমে পশ্চিমের শিখণ্ডি সরকার বসানো হয়েছিল।
তাই মনে রাখতে হবে পুঁজিবাদী বিশ্বের আলাদা কোনো রাজনীতি নেই। অর্থনৈতিক স্বার্থের দ্বারাই তাদের রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। এমনকী গণতন্ত্র, আইনের শাসন বা মানবাধিকারের মত ইস্যুগুলো নিছক রাজনৈতিক ছলমাত্র। নতুবা তারা কেন গণতন্ত্রহীনতা, আইনের শাসনের অভাব বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ইরাকে আক্রমণ চালাল আর গণতন্ত্রের সামান্যতম নমুনাও যেসব দেশে নেই সেই সৌদি আরবের সরকারকে চাপে রাখে না, হুঁশিয়ার করে না? তারা যে অজুহাতে ইরাকে আক্রমণ চালিয়েছে, কার্যত ইরাক ধ্বংস করেছে, সেই সব অজুহাত অনেক বেশি খাটে সৌদি আরব, কুয়েত, আবুধাবির মত দেশের ক্ষেত্রে।
ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ইজরায়েলের ভূমিকা কেমন তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ধর্মের জঙ্গিরূপ ধারণ কীরকম আত্মঘাতী ফলাফল আনে তা-ও দেখছি হামাসের ভূমিকা ও তার পরিণাম দেখে। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার কী ধরনের পরিণতি সৃষ্টি করে তাও দেখছি সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কট্টর ইসলামি দেশগুলোর ভূমিকায়। আমাদের দেশেও ধর্মান্ধদের হাতে মানবতার লাঞ্ছনা যেমন দেখেছি তেমনি দেখেছি প্রকারান্তরে তা কীভাবে ধর্মের বাণী ও শিক্ষার পরিপন্থী ভূমিকা রাখে। আমরা দেখছি ধর্মীয় ও সম্প্রদায়ভিত্তিক সংস্থা ওআইসি বা আরব লীগও চরম সংকটের সময়ও কেমন অকার্যকর হয়ে থাকে।
এ অবস্থায় প্রয়োজন অতীতের জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনের মত মূলত তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের মহাজোট। ষাট-সত্তরের দশকে এ জোট যখন সক্রিয় ছিল তখন বিশ্বের রাজনৈতিক হালচাল তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল, তখনই এশিয়া-আফ্রিকা থেকে সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শাসনের চূড়ান্ত অবসান হয়েছে, গণমানুষের মুক্তির লক্ষ্যে কাজ হয়েছে। তখনই যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে জোরালো এবং কার্যকর প্রতিবাদ হয়েছে - সে কিউবা সংকট হোক আর আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ হোক। সেদিন প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্ব নয় বিশ্ব রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের নায়ক ছিলেন নেহেরু-নাসের-নক্রুমা-টিটোর মত তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রনায়করা। আজ আবার সেই রকমের বিশ্ব ফোরাম দরকার। সেই ফোরাম তার নেতাও তৈরি করে নেবে। তবেই তথাকথিত মুক্তবিশ্বের অন্যদের অবরুদ্ধ করার অন্যায়ের, ছলনার, ধাপ্পাবাজির রাজনীতিকে অকার্যকর করা যাবে। ইজরায়েলের মত  ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের ধৃষ্টতাও বন্ধ করা সম্ভব হবে।



Wednesday, July 9, 2014

পার্বত্য চট্টগ্রাম: শান্তির সন্ধানে

আবুল মোমেন

ব্রিটিশ শাসকরা ১৮৬১ সনে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ এলাকা ঘোষণা করেছিল। বিশেষ এলাকা দুটি কারণে -১. এর বৈচিত্রপূর্ণ প্রকৃতি যেখানে পাহাড় আর অরণ্য রয়েছে জীববৈচিত্রের ভাণ্ডার হিসেবে এবং ২. জনবৈচিত্র যা ১১টি উপজাতির স্ব-স্ব সাংস্কৃতিক বৈচিত্র নিয়ে বিশিষ্ট। এই জনগণ মূলত অরণ্যচারী এবং মূলধারার নাগরিক সংস্কৃতির বাইরে নিজ নিজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বহন করে নিভৃত জীবনে অভ্যস্ত। এদের জীবনাচার ও সংস্কৃতি সমভূমির কৃষিসমাজের পূর্ববর্তী কালের। সে অর্থে তুলনামূলকভাবে প্রাচীন কিংবা আদিম। এর মধ্যে আকস্মিকভাবে এবং গুণগতভাবে যদি ভিন্ন জীবনাচারে অভ্যস্ত মানুষজনের ব্যাপক আনাগোনা ও বসবাস শুরু হয় তাহলে দুই কালিক সংস্কৃতি, যা প্রায় মৌলিকভাবেই বিপরীত, তার মধ্যে সংঘাত দেখা দেবে।
এই মৌলিক বৈপরীত্য সম্পর্কে দুটি কথা বলা যায়। সমভূমির মানুষের কৃষিসমাজ গড়ে উঠেছে বন কেটে আবাদ করার নীতির ভিত্তিতে। কেবল বন কাটা নয়, কৃষিসমাজের মানুষের লক্ষ্য থাকে যে কোনা জমিকে -তা বন হোক, নতুন জাগা চর হোক কি এবড়োথেবড়ো পতিত জমি হোক সেগুলোকে আবাদযোগ্য করে তোলা। বিপরীতে পাহাড়ী অরণ্যে বসবাসকারী ক্ষুদ্রজাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা প্রকৃতির সাথে সহবাসে অভ্যস্ত, একে মৌলিকভাবে পাল্টাতে তারা নারাজ। ফলে এদের হাতে বন-সম্পদ যুগ যুগ ধরে রক্ষা পেয়ে এসেছে। অনেকেই মনে করেন জুম চাষে পাহাড়ে যে আগুন দেওয়া হয় তাতে বনসম্পদ নষ্ট হয়। আসলে অরণ্যাচারী জনগোষ্ঠী বরাবরই প্রাকৃতিক সম্পদের তুলনায় সংখ্যায় অল্প থাকে, ফলে তাদের এ ঐতিহ্যবাহী চাষপদ্ধতি প্রয়োজনীয় ফসল ফলানোর পাশাপাশি বনভূমিকে উর্বর করার পদ্ধতিও বটে। তাই শত বছরের ইতিহাস থেকে দেখা যায় এ অঞ্চলে কৃষিসমাজের বাঙালির ব্যাপক আবাসনের আগে বনভূমি বিনষ্ট হওয়ার রেকর্ড নেই। বন ও প্রাকৃতিক সম্পদ বাঁচিয়ে জীবনধারনের এ তাদের সহজাত শিক্ষা। কিন্তু কৃষিজীবী মানুষ বনকে আপদ মনে করে আর সবধরনের পশুকেই হিং¯্র ও বিপজ্জনক ভাবে। ফলে দুটিরই বিনাস তার সহজাত অভ্যাস।
দ্বিতীয় বৈপরীত্যের বিষয়টিও মৌলিক। অরণ্যবাসীর জীবনে ও মননে প্রকৃতিই সবকিছুর আধার ও নিয়ন্তা। ফলে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি তার মনোভাব ভক্ত বিশ্বাসীর এবং এর পূজা করেই সে শান্তি পায়। তৌহিদি ধর্মের মানুষের মানস এর বিপরীত। ফলে বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক উভয় সংস্কারেই বৈপরীত্য বিদ্যমান।
এই বৈপরীত্যের কারণে প্রাকৃতিক সম্পদের গুরুত্ব এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্ব বিবেচনায় নিলে কেবল পার্বত্য জেলা নয় অন্যান্য সমভূমির বনাঞ্চল বা স্বকীয় প্রাকৃতিক পরিবেশে অভ্যস্ত সকল ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবনব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ ঘটানোর মত যেকোনো কাজের আগে দশবার ভাবা দরকার। এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল নিয়ে ভাবতে হবে বিশেষভাবে।
২.
আমরা কিছুতেই অস্বীকার করতে পারব না যে বাংলাদেশ কেবল একটি জনবহুল দেশই নয়, এখানে ভূমির তুলনায় জনসংখ্যার চাপ অনেক বেশি। সে কারণেই কৃষিভিত্তিক দেশ হিসেবে এদেশে খাদ্যাভাব ও দারিদ্র লেগেই ছিল। আধুনিক প্রযুক্তি ও  উপকরণের ব্যবহার বাড়িয়ে খাদ্যাভাব দূর করা গেছে, কিন্তু দারিদ্র্য এখনও আমাদের বড় সমস্যা। অর্থনীতি ও মানুষের পেশায় পরিবর্তন ঘটছে। শ্রমজীবী মানুষ বিদেশে যাচ্ছে, প্রান্তিক নারীরা দলে দলে তৈরি পোশাক শিল্পসহ নানা কাজে যুক্ত হচ্ছেন। শিক্ষার হার বাড়ছে,স্বাস্থ্য সচেতনতা ও সুযোগসুবিধা বাড়ায় গড় আয়ু ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে, দারিদ্র কমছে। কিন্তু জমি বনাম জনসংখ্যার সংকট কমানোর উপায় নেই - কারণ জমি স্থিতিশীল আর জনসংখ্যা বর্ধিষ্ণু।  তিনটি মূল কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বাস্তচ্যুত হচ্ছে - ১. প্রাকৃতিক কারণ, যেমন নদী ভাঙন বা সিডরের মত দুর্যোগ, ২. দারিদ্র, যে কোনো পারিবারিক দুর্যোগ বা উৎসবে তাদের সহায় সম্বল বিক্রি করতে বাধ্য হয় প্রান্তিক মানুষ এবং ৩. আকস্মিকভাবে বিত্তবান হয়ে ওঠা মানুষ ও নতুন গজিয়ে ওঠা আবাসন শিল্পের উদ্যোক্তাদের প্রলোভন ও চাপে দরিদ্র মানুষ জমি হারাচ্ছে। ফলে মাথা গুঁজবার ঠাঁই খুঁজতে গ্রামের বাস্তচ্যুত এবং স্বল্পায়ী ও বেকার মানুষ বিপদ আপদ ভবিষ্যত কিছু নিয়েই ভাববার অবকাশ পায় না। তার কাছে বর্তমান এক নির্মম ও কঠিন বাস্তবতা। এর ফল হিসেবে আমরা দেখি যে-চর মাত্রই সমুদ্র থেকে জাগছে, যেখানে এখনও জোয়ার ভাটার খেলা চলে, যে জমি দিনে দু’বার জোয়ারে সম্পূর্ণ তলিয়ে যায় সেখানেও মানুষ মাচাঘর তুলে বসবাস শুরু করে দিচ্ছে। সুন্দরবনের বাঘ-কুমীর-সাপের সঙ্গে লড়ে বসতি করছে, নোনা পানির মধ্যে ঘর তুলছে, চট্টগ্রাম শহরে পাহাড়ের পাদদেশে ধসের ঝুঁকির মধ্যে সংসার পাতছে। আর শহরের ফুটপাথে, রেললাইনের ধারে, যেকোনো পতিত জমিতে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে শোয়ার জায়গা করে সপরিবারে দিন গুজরান করছে। যেদেশে প্রায় চল্লিশ ভাগ মানুষ এরকম বসতি সঙ্কটে আছে তাদের জন্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ছয় হাজার বর্গমাইলের বিস্তীর্ণ তিনটি জেলা একটা আকর্ষণীয় জায়গা হিসেবে বিবেচিত হওয়া স্বাভাবিক। নতুন-জাগা চর, পাহাড়ের পাদদেশ বা বাঘ-কুমীর অধ্যুষিত অরণ্য বা মহানগরের ফুটপাত, রেললাইনের ধারের চেয়ে এ অঞ্চল তাদের বেশি পছন্দের জায়গা হওয়াই স্বাভাবিক।
মানুষের মৌলিক পাঁচটি চাহিদার মধ্যে বাসস্থানের অধিকার অন্যতম। সরকার এ অধিকার পূরণের দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না। তাদের মাথায় বিপন্ন মানুষের পুনর্বাসনের জন্যে নানা বিকল্পের মধ্যে নিশ্চয় পার্বত্য অঞ্চলের কথাও এসেছে এবং সেভাবে কাজ হয়েছে।
তবে পার্বত্য অঞ্চলে প্রথম ব্যাপক হারে সরকারি উদ্যোগে বাঙালি বসতিস্থাপনের পেছনে অন্য উদ্দেশ্য ছিল। ১৯৭৯-৮০-৮১’র দিকে জেনারেল জিয়া এ কাজ শুরু করেছিলেন মূলত শান্তিবাহিনীর তৎপরতা বন্ধের দীর্ঘমেয়াদী প্রতিকার হিসেবে। উদ্দেশ্য ছিল পাহাড়ে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীকে ছাপিয়ে বাঙালি জনসংখ্যা বাড়ানো। তাঁর অনুসৃত নীতি পরবর্তী পনের বছর ধরে  জেনারেল এরশাদ ও বেগম জিয়ার সরকার পালন করে গেছে। এর ফলে সত্যি সত্যিই পাহাড়ে জনসংখ্যার ভারসাম্য পাহাড়ীদের প্রতিকূলে চলে গেছে। বর্তমানে মোট জনসংখ্যা সম্ভবত পাহাড়ী-বাঙালি ৪৮:৫২ হয়ে গেছে, যা স্থানীয় অধিবাসী হিসেবে পাহাড়ীদের পক্ষে মানা কঠিন।
৩.
এবারে আমাদের বুঝতে হবে এর ফলাফলটা কী হল। মনে রাখতে হবে ১৯৭৯-৮০’র আগে দীর্ঘদিনে স্বাভাবিক নিয়মে পাহাড়ে সমভূমি বাঙালিদের যে বসতি গড়ে উঠছিল তাতে কোনো সংকট হয়নি। তারা পরস্পর মিলে মিশে বসবাস করেছে। কিন্তু এবারে দুটি কারণে সংকট তীব্র হল। প্রথমত, পাহাড়ে বাঙালি অভিবাসনের সরকারি নীতির পিছনে এমন একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল যাকে স্বাধিকারের জন্যে সংগ্রামরত জনগোষ্ঠীর কাছে সরকারের একটি হীন চক্রান্ত বলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক। বাস্তবে তাই হয়েছে এবং এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঠেকানো যায় নি। দ্বিতীয়ত, অল্পসময়ে যে ব্যাপক বাঙালিকে পরিকল্পিতভাবে সেখানে বসতির ব্যবস্থা করা হয়েছে তাদের অধিকাংশের পেশাগত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র ছিল কৃষি। প্রথম অধ্যায়ে কৃষিসমাজের যেসব বৈশিষ্ট্য-প্রবণতার কথা বলা হয়েছে তা এখানে ঘটেছে। পাশাপাশি কৃষি শিল্পের বিকাশের জন্যে সরকার বাঙালিদের নির্বিচারে জমি বরাদ্দ দিয়ে সংকট ঘনীভূত করেছে। এতে একেবারে এই বাস্তব ভূমি-সংকটের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণ একটা গভীর বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক সংঘাতের সম্মুখীন হল। প্রকৃতিভিত্তিক সরল এবং আদিম। জীবনসংস্কৃতিতে অভ্যস্ত জনগোষ্ঠী প্রকৃতি-উদাসীন বা প্রকৃতি শাসনে অভ্যস্ত সাকার পূজা বিরোধী জটিল প্রবল সংস্কৃতির চাপের মধ্যে পড়ে যায়। তাদের ঐতিহ্যবাহী জীবনব্যবস্থা, খাদ্যোৎপাদন পদ্ধতি, নিভৃত জীবনযাপন, স্বাধীন মুক্ত জীবনের অভ্যাস আকস্মাৎ ভেঙে পড়েছে। তারা ভূমি হারিয়েছে, খাদ্য সংকটে পড়েছে এবং সবচেয়ে বড় কথা নিভৃতের মুক্ত জীবনের অধিকার খুইয়েছে। সবটা মিলে এটি তাদের জন্য বড় রকমের আঘাত।
৪.
আমাদের মনে হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে জনসংখ্যা ভারাক্রান্ত সমভূমির ভূমিহীন মানুষের কিছু অভিবাসন হওয়া অযৌক্তিক নয়। কিন্তু তা হতে হবে পার্বত্য অঞ্চলের স্থানীয় অধিবাসীদের নেতৃবৃন্দের বা নির্ভরযোগ্য জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটির মতামত নিয়ে। এ ব্যবস্থাটি  সামগ্রিকভাবে দেশের জন্যে প্রয়োজনীয় বনাঞ্চল সংরক্ষণের পাশাপাশি মূল্যবান জীববৈচিত্র্য, পরিবেশের ভারসাম্য ও জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় সহায়ক হবে। অর্থাৎ পার্বত্য অঞ্চলে সমভূমির বাঙালি অভিবাসন হবে, কিন্তু তা হতে হবে পরিকল্পিতভাবে স্থানীয় মানুষের সম্মতিতে এবং প্রকৃতি, পরিবেশ ও স্থানীয় মানুষের কৃষ্টি-ঐতিহ্য রক্ষার জন্যে কিছু শর্তের ভিত্তিতে। একমাত্র এভাবেই এ অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে হয়।

Tuesday, June 24, 2014

এভাবে চললে দেশ কোথায় যাবে?

আবুল মোমেন

স্বাধীন বাংলাদেশে একটা বড় কাজ ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এটি আমাদের বকেয়া কাজ। অন্তত বেয়াল্লিশ বছর আগে স্বাধীনতা অর্জনের পরে এ কাজ শুরু হয়েছিল। তখন ভিতর-বাইরের চাপ ছিল এ বিচার কাজ না করার জন্যে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে পুনর্গঠন, পুনর্বাসন এবং নবযাত্রা সূচনার কাজগুলো ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিচারের কাজ একটু মন্থর হয়ে পড়ে এবং সরকার ও আদালতের দিক থেকে ঔদার্য প্রদর্শিত হয়। তবে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে সব পণ্ড করে দিয়েছিলেন। প্রায় চার দশক পরে বর্তমান সরকার সেই বকেয়া কাজ এখন সম্পন্ন করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
বকেয়া কাজ ছাড়াও সরকারের জন্যে দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার কিছু এজেণ্ডা রয়েছে। এর মুখ্যটি হল গণতন্ত্র। বস্তুত আমাদের গণতন্ত্রের আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল। এদেশের মানুষ ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর থেকেই গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্যে  আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করে। শেখ মুজিবকে সেই আন্দোলনই এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুতে উন্নীত করে এবং তাঁর বলিষ্ঠ দুঃসাহসী দূরদর্শী নেতৃত্ব সেই আন্দোলনকে স্বাধীনতার জন্যে মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত করে।
গণতন্ত্রের সাথে যুক্ত রয়েছে কিছু নীতি-আদর্শ এবং শাসনব্যবস্থার কিছু পদ্ধতি। দেশ ও সমাজকে হতে হবে সকল ধর্ম-বর্ণ বিত্ত-গোত্র-নির্বিশেষে সমতাভিত্তিক। একে এককথায় বলতে পারি অসাম্প্রদায়িক মানবিক আদর্শ। দ্বিতীয়ত, শাসন কাজে জনগণের প্রতিনিধিত্ব এবং অংশীদারিত্ব থাকতে হবে। একাজগুলোও বকেয়া পড়ে গেছে কেবল এটুকু বললে সবটা বলা হবে না। অসাম্প্রদয়িক মানবতার নীতি-আদর্শ এবং জনগণের প্রতিনিধিত্ব ও অংশীদারিত্বের নিশ্চয়তা বাহাত্তরের সংবিধানে লিপিবদ্ধ ছিল। কিন্তু কাগজে-কলমে স্বীকৃতি দান, কিংবা দলিলে লিপিবদ্ধ করেই যেন কাজ শেষ হয়েছে। এই ঘোষিত নীতিতে সমাজকে শিক্ষিত করা এবং পদ্ধতি চালু করার বাস্তব পদক্ষেপ গৃহীত হয় নি।
ক্ষমতা কুক্ষিগত করে জিয়া সংবিধান পরিবর্তন করে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি থেকে সরে এলেন। তিনি পছন্দ করলেন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে সেভাবে ব্যবহার করলেন। তাঁর নীতির পক্ষে শক্তি বাড়ানোর জন্যে একদিকে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে কোণঠাসা করলেন এবং অন্যদিকে ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোকে পুনর্বাসিত করলেন। এমনকী তাদের তাঁর সরকারের অংশও করে নিলেন। কেবল ধর্ম ইসলাম নয় সাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশের রাজনীতির বিষয় হয়ে উঠল, এবং পাকিস্তান আমলের মত সরকারের শাসনপদ্ধতির অবশ্য বিবেচ্য ও মান্য নীতি হয়ে উঠেছিল।
বিএনপি দেশের বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে সরকারের বাইরে থেকেও এই নীতি-পদ্ধতির পক্ষে জনমতের একটা বড় অংশ ধরে রাখতে সক্ষম হয়। বরং তাদের প্রশ্রয়ে-পৃষ্ঠপোষকতায় এবং কিছুটা যুগের হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে এই ধারার ভয়ঙ্কর জঙ্গি মৌলবাদী শক্তির উত্থান ঘটেছে আজ।
ফলে ক্ষমতায় আসার পরে আওয়ামী লীগের ওপর বকেয়া ও চলমান যেসব দায়িত্ব পড়েছে তার মধ্যে এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ। এই অপশক্তির সাথে লড়তে গিয়ে খোদ আওয়ামী লীগের মধ্যে দুটি বড় পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করছি।  প্রথমত, সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী রাজনীতির দিক থেকে আওয়ামী লীগের সম্পর্কে ইসলামবিরোধী বলে যে সন্দেহ জনমনে ঢুকিয়ে দিয়ে নির্বাচন জয়ের কাজ হাসিল করা হয় তাকে অকার্যকর করা জরুরি হয়ে পড়ে। দেশের সাধারণ মানুষ যে-অর্থে ধর্মভীরু তাদের প্রতিনিধিত্বকারী সবচেয়ে বড় দলের অধিকাংশ কর্মী-সমর্থক, এমনকী নেতারাও সে অর্থে ধর্মবিশ্বাসী মুসলমান। কিন্তু তারা কেউই সাম্প্রদায়িক নন। কিন্তু জনগণের সন্দেহ-সংশয় দূর করার জন্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কৌশল হিসেবে নিজেদের ধর্মীয় তথা মুসলিম পরিচয়কে বিশেষভাবে জাহির করার নীতি গ্রহণ করে। এটি তো বিশ্বাস এবং জীবনচর্যার সাথে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট বিষয়। খুব সচেতন না হলে যে কোন কৌশল তার প্রাথমিক লক্ষ্য পূরণ করে আরও বাড়তি লক্ষ্য পূরণেও সমর্থ হতে থাকে। আওয়ামী লীগেও বাস্তব রাজনীতির সাথে ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কৃতির যোগ গভীর হয়ে পড়েছে। এখন এ দলে একজন জামায়াতি এমনকী জঙ্গি মানুষের আশ্রয় গ্রহণ অসম্ভব নয়। তার দৃষ্টান্ত আমরা বর্তমানে কিছু কিছু দেখছি। আর বিএনপির সাথে দলীয় ইতিহাস ও প্রধান নেতা নিয়ে বিবাদ ব্যতীত শ্রেণি অবস্থান, চিন্তাচেতনা  মানসিকতা এবং জীবনচর্যায় আওয়ামী লীগের বাস্তব কোনো ফারাক নেই। ফলে দুই দলে ক্ষমতা বদল হলে ইতিহাস পাল্টায়, সংস্কৃতির অঙ্গনে পরিবর্তন ঘটে কিন্তু শাসনব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আসে না।
দেশের প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী (ধর্মহীন নন) সমাজের সামনে এখনও মোটা দাগের বিবেচনায় আওয়ামী লীগ ছাড়া সমর্থন দেওয়ার মত অন্য কোন দল নেই। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এই সমর্থনকে স্বত:সিদ্ধ হিসেবে ধরে নিয়ে এদের সমালোচনা বা পরামর্শের প্রতি বিন্দুমাত্র কর্ণপাতও করে না। বরং দেশের দুটি বিবদমান পক্ষের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক মানবিক পক্ষ অবলম্বনকারীদের দোহাই দিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার কৌশল নিয়ে চলছে।
সরকারবিরোধী রাজনীতির প্রধান শক্তি বিএনপির রাজনীতির অন্তর্নিহত দুর্বলতার বিষয়টি আমরা বারবার উল্লেখ করেছি। তাদের রাজনীতির প্রকৃত রূপ হচ্ছে আওয়ামী বিরোধিতা। এ কাজ করতে গিয়ে তারা জামায়াত এবং কট্টর ইসলামি দলগুলোর সাথে জোট গঠন করেছে। এরা আবার স্বাধীনতার বিরোধিতা, যুদ্ধাপরাধ এবং জঙ্গিবাদের জন্যে অভিযুক্ত, যা যে কোনো বিবেচনায় বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতি হতে পারে না। তদুপরি দেশের তরুণ সমাজ, যারা ভোটারদের প্রায় অর্ধেক, এ ধারাকে গ্রহণ করে না। ফলে তাদের রাজনীতি দলীয় কর্মীদের  নীতি-আদর্শের ভিত্তি যেমন দিতে পারছে না তেমনি পারছে না দেশের তরুণদের দলে টানতে। এ ধরনের ভাবাবেগ চালিত তরুণ কর্মীরাই কিন্তু দীর্ঘদিনের নিপীড়ন-শোষণের বিরুদ্ধে মাঠে থেকে সংগ্রাম চালিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে ধরে রেখেছে, এগিয়ে নিয়েছে। এই দুর্জয় মনোবলের নিবেদিত কর্মীর অভাবেই বিএনপি আজ ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।
তবে সব বাস্তবতার নিজস্ব কিছু উপজাত ফল আছে। আওয়ামী লীগ নেত্রী দেশকে মৌলবাদ জঙ্গিবাদ মুক্ত রাখার ব্রত পালন করতে গিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্যে দুর্বল বিএনপিকে একেবারে স্থায়ীভাবে কোণঠাসা করে রাখার এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাচ্ছেন না। তাতে তাঁর সরকার, দল এবং তাঁর নিজের হাতে ক্ষমতা একচেটিয়াভাবে কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে। কথায় বলে চরম ক্ষমতা চরম দুর্নীতির জন্ম দেয়। শেখ হাসিনার এবারের শাসনকালে দুর্নীতি কেবল সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে নি, এরই অনুষঙ্গ হিসেবে আইন-আদালত অমান্য করে দখলদারি, হত্যা-গুম, চাঁদাবাজিসহ ভয়ঙ্কর সব অপরাধ বাড়ছে এবং বলাবাহুল্য এসবে সরকারি দলের লোকজনের ভূমিকাই মুখ্য।
কেবল দুর্নীতি ও অন্যান্য অপরাধ নয় অন্য দিকেও অবক্ষয় ঘটছে। আওয়ামী লীগ ও তাঁর অঙ্গ সংগঠনে অপরাধীর সংখ্যা বাড়ছে, দল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলছে। এমনকি আজ যেটি সংসদে বিরোধী দল সেটিও প্রকৃত বিরোধী দল নয়। ফলে গণতন্ত্র নামসর্বস্ত ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে।
আজ দেশে যিনি রাজনীতিবিদ তিনি আসলে জননেতা নন, এক জাতের গড়ফাদার, যিনি দলীয় অনুসারীদের নানা অপরাধ-বাড়াবাড়ির রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেন। মন্ত্রী-আমলা এমপিরা জনগণের সেবক নন, রাষ্ট্রীয় শোষণযন্ত্রের অংশ হয়ে পড়েছেন, যেটি নির্বাচন সেটি প্রহসন মাত্র, বিচারবিভাগের স্বাধীনতা কথার কথা আজ, ক্ষমতাসীন দলেরও অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্রের নীতি কথার কথা মাত্র।
এভাবে বলা যাবে সমাজে সর্বত্র ফাঁপা মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব ঘটছে। যিনি শিক্ষক তিনি প্রকৃত শিক্ষক নন, যিনি সাংবাদিক তিনিও প্রকৃত সাংবাদিক নন। এভাবে রাজনীতিবিদ, বিচারক, প্রশাসক, বিশ্ববিদ্যালয়, আদালত, রাজনৈতিক দল কেউ বা কোনোটিই আদতে সেজন ও সেটি নয়। শেখ হাসিনার এই গণতান্ত্রিক শাসনে দেশের এই যে অবক্ষয় ঘটছে এর খেসারত কে দেবে? জাতিকেই দিতে হবে। কিন্তু তার সামনে রাজনৈতিক বিকল্প শক্তি এখন নেই। সম্ভবত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সুধীজনকে এগিয়ে এসে একাট্টা হয়ে সামাজিক জাগরণ ঘটাতে হবে। সেই সাথে স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ওপর গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্যে চাপ সৃষ্টি করতে হবে।

Tuesday, June 3, 2014

গণতন্ত্র না স্বৈরশাসন

আবুল মোমেন

নির্বাচন ও ভোট যদি গণতন্ত্র চর্চার মুখ্য উপাদান হয়ে থাকে তাহলে বাঙালির সে অভিজ্ঞতা শত বছর পেরিয়ে গেছে। এদেশে ব্রিটিশরা ইউনিয়ন বোর্ড গঠন করেছিল নির্বাচনের মাধ্যমে। তারপর থেকে স্থানীয় পর্যায়ে এ নির্বাচন অব্যাহত ছিল। তবে ঔপনিবেশিক আমলে বয়স্ক ভোটাধিকার বা অ্যাডাল্ট ফ্রেঞ্চাইজ শুরু হয়েছে আরও অনেক পরে, সম্ভবত ত্রিশের দশকে প্রাদেশিক সরকার গঠনের সময় থেকে। এর আগে জমিদার ও বিভিন্ন ক্যাটাগরির করদাতাদের ভোটে স্ব স্ব গ্র“পের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন।  যেভাবেই হোক নির্বাচন ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সাথে বাঙালির পরিচয় তাই অনেক কালের।
পাকিস্তান আমলে কেন্দ্রে যখন বারবারই নির্বাচিত সরকার গঠন বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল তখন বাঙালি-অধ্যুষিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গণতন্ত্রের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন হয়েছে। তবে অগণতান্ত্রিক, এমনকী সামরিক স্বৈরশাসনের আমলেও স্থানীয় সরকারের নির্বাচন বন্ধ হয় নি এবং ততদিনে বয়স্ক ভোটাধিকারও পাকাপোক্ত হয়েছে। তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে কেন্দ্রে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার প্রতিষ্ঠার দাবির প্রতি বরাবর জনসাধারণকে আকৃষ্ট করা গেছে। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সব আন্দোলন-সংগ্রামের মূল দাবি ছিল গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসক নির্বাচনের অধিকার। ১৯৫৪ ও ১৯৭০ সনের নির্বাচনে মত প্রকাশের সুযোগ পেয়ে রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে গণতন্ত্রের দাবিটি জোরালোভাবে প্রকাশ করেছিল দেশের জনসাধারণ। বহু বাধাবিপত্তি এবং যুদ্ধ-সংগ্রামের পরে হলেও এই জনদাবি পূরণের সুযোগগুলো এসেছিল।
স্বাধীনতার পরে ১৯৭২, ১৯৯১ এবং পরে ২০০৯-এ বলা যায় জনগণের গণতন্ত্রের স্বপ্ন পূরণের সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল। সে সুযোগে কাজে লাগে নি, লাগানো যায় নি। এর কারণটা খুব দুর্বোধ্য নয়। নির্বাচন ও ভোট হল পদ্ধতি -এ নিয়ে বিস্তর কথা বলা যায়, নানান পরীক্ষানিরীক্ষা করাও সম্ভব। তাতে হয়ত অনিয়ম, অপরাধ কমানো এবং সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। তার প্রমাণ আমরা রেখেছি। কিন্তু পদ্ধতির এই সাফল্য তার লক্ষ্য অর্থাৎ আমাদের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে সফল করে নি। প্রতিবারেই নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা বিকেন্দ্রিকরণের পরিবর্তে অধিক হারে কেন্দ্রীভূত করেছে। ক্ষমতা বাড়তে বাড়তে বর্তমানে প্রায় সকল ক্ষমতাই এক ব্যক্তি অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর হাতে পুঞ্জিভূত হয়েছে। জনগণ ক্ষমতা হারিয়েছে, এমনকী দলের সিনিয়র নেতারাও এখন ক্ষমতাহীন। কেবল সরকার নয় দলও চলছে তাঁর একক সিদ্ধান্তে। তাতে তাঁকে ঘিরে পছন্দের মানুষের খাস বলয় তৈরি  হচ্ছে, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ও সিস্টেম ভেঙে এই বৃত্তের দাপট বাড়াই স্বাভাবিক। তাঁদের ঘিরে ছড়াতে থাকে ক্ষমতার বিকার, অর্থাৎ দুর্নীতি, ব্যাপক দুর্নীতি। তাতে সরকারের কাজের গতি হয় মন্থর, অপচয় বাড়ে, জনদুর্ভোগও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। এর ব্যত্যয় হওয়া সম্ভব নয়। আর সমাজ থেকে  জোরালো বাধা না এলে এই বৃত্ত ভাঙা অসম্ভব।
জনসংখ্যায় দেশটা বড়, মানুষ ভাগ্য পরিবর্তনে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা যে কোনো সুযোগ কাজে লাগাতে চায়। তাদের এই দুর্বলতার সুযোগ নেয় ক্ষমতার প্রসাদ পাওয়া স্থানীয় বেপরোয়া ভাগ্যান্বেষীরা। সারা দেশে এরকম অসংখ্য ক্ষমতাধর মধ্যবর্তী নেতার আবির্ভাব ঘটেছে। তাদেরও হায়ারার্কি আছে, এবং সেভাবে অবৈধ উপার্জনের তৎপরতা চলে, ভাগ বন্টন হয়। আর তার সূত্রে নানা মাত্রার অপরাধও সংঘটিত হতে থাকে। অপরাধ যত ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে তাতে সচেতন মানুষ দলীয় দাসত্বের গ্লানি বইতে অক্ষম হয়ে পড়ছে। কেবল বিএনপি নয় আওয়ামী লীগের ভিতর থেকেই শামীম-জয়নালদের মত বিতর্কিতদের রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জোরদার হবে। সমাজের গ্লানিমোচনের সমবেত উদ্যোগ এভাবে তৈরি হতে পারে।
অপরাধ ও অপরাধীর পরিচয় ক্রমেই ফাঁস হয়ে যাবে। কেউ আড়ালে থাকবে না, ভালোমানুষের চেহারা বানিয়ে সাধু সেজে পার পাবে না। আইনের বিচারালয় না পারলে জনমতের আদালত তার হৃতসাহস ও চরিত্র ফিরে পেতে থাকবে। অপরাধের বিপরীতে এ-ও মানুষেরই সহজাত প্রবৃত্তি। ভালো থাকার সুযোগ যেমন সে নেয় তেমনি ভালো হওয়ার সুযোগও সে হাতছাড়া করবে না।
লক্ষ্য করার বিষয় অনেকভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা সত্ত্বেও দেশের নানা খাতের দুর্নীতি তথা পারফর্মেন্স-চিত্র তুলে ধরার ক্ষত্রে টিআইবির ধারাবাহিক প্রয়াস মানুষের চোখে গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। পত্রপত্রিকার দুর্নীতিবিরোধী খবর নিয়ে নানা মাত্রার সমালোচনা থাকলেও ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির খবরগুলোকে মানুষ বিশ্বাস করছে। এসব অপতৎপরতার চিত্রই আমরা প্রতিদিনের সংবাদপত্রে পাচ্ছি। অপহরণ, গুম, খুন এই অপরাধেরই অনুষঙ্গ। বিত্ত ও ক্ষমতার কাছে আপাতত গণতন্ত্রসহ মানবাধিকার ও আইনের শাসনের স্বপ্ন বন্দি হয়ে আছে। এই  বাস্তবতা দুই নেত্রীর জন্যেই ভালো সুযোগ তৈরি করেছে জনগণের আস্থা ফিরে পাওয়ার। ভালো কিছু করার এই সুযোগ তাঁরাও হারাবেন না এমনটাই মানুষ চাইছে।
তাই বলব এ একেবারে সম্পূর্ণ হতাশাজনক চিত্র নয়। হতাশাজনক অবশ্যই, কিন্তু কোনো মানবগোষ্ঠীর চূড়ান্ত পরিণতি এটি নয়। খোদ অপরাধীও মনে করে না অপরাধেই তার ভাগ্য বাঁধা আছে। সে-ও, তার বিবেচনায়, ভালো কিছুর পথের কাঁটা সরাতেই এমন কাজে অর্থাৎ অপরাধে ‘বাধ্য’ হচ্ছে। নূর হোসেনের বিধিলিপি এখন পলাতক জীবন, নয়ত আইনের আওতায় এসে শাস্তি ভোগ। শামীম ওসমানের জন্যে জনধিক্কার, জয়নাল হাজারীর জন্যে রাজনৈতিক নির্বাসনই শেষ পরিণতি কিনা দেখার বিষয়। আবিদ হাকিমের কাছে একরাম খুনের দায় স্বীকার করে নিজের শাস্তি চেয়ে আত্মোপলদ্ধি ও অনুশোচনার পথে পা বাড়াচ্ছে কি?
লক্ষ্য করার বিষয় হল অপরাধের মাত্রা ও ধরনের নিষ্ঠুরতা অনেক বেড়েছে। অনেক সময় অপরাধী কর্তৃক অপরাধীর অর্থাৎ সমগোত্রের বিরুদ্ধে অ্যাকশানে অপরাধের গণ্ডি ছাপিয়ে নিরীহ মানুষেরও প্রাণ যাচ্ছে। যেমন মেধাবী বালক ত্বকী, নিরীহ আইনজীবী চন্দন সরকার। তবে এসব অনাকাক্সিক্ষত অমানবিক জঘন্য অপরাধ সাধারণের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে। ত্বকীর মৃত্যুতে শিহরিত এবং আত্মধিক্কারের ফলে তৎপর হতে চায়নি এমন মানুষ কম ছিল। অ্যাডভোকেট চন্দন সরকারের নির্মম হত্যাকাণ্ড এখনও পর্যন্ত দেশের আইনজীবীদের রাজপথে রেখেছে।
বেপরোয়া ভাগ্যান্বেষীদের অপরাধের মাত্রা এবং নেতিবাচক প্রভাব এত বেড়েছে যে পেশাজীবী ও সচেতন মানুষ মাত্রই এদের কোনরকম প্রশ্রয় দিতে নারাজ। রাজনীতি ছাপিয়ে এখন নিতান্ত মানবিক মূল্যবোধ ও সাধারণ নৈতিকতার প্রশ্ন বড় হয়ে উঠছে। আমার বিবেচনায় এই পরিবর্তিত বাস্তবতার সুযোগ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার তুলনায় শেখ হাসিনার কিছুটা বাড়তি সুবিধা থাকবে। কারণ যে কোনো অবস্থাতেও বাস্তবতাতেই খালেদাকে জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীর বিষয়ে স্পষ্ট সিদ্ধান্তে আসতে হবে। একথা একশভাগ সত্য ধর্মবাদী বা ধর্মনিরপেক্ষ যে বিশ্বাসেরই হোক দেশের তরুণ সমাজের বড় অংশই মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের অংশীদার হতে আগ্রহী। আর তার পাশাপাশি আজকে রাজনৈতিক দলের কাছে তাদেরসহ সবার প্রত্যাশা হল সুশাসন। এটি না হলে সেই সরকার ব্যর্থ বলে গণ্য হবে।
সেদিক থেকে ৫ জানুয়ারি-উত্তর বর্তমান সরকার যে ব্যর্থতার বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। সামাজিক  সূচকের অগ্রগতি বস্তুত বহুকালের ধারাবাহিক কাজের ফসল - এতে সব সরকারেরই ভূমিকা আছে, তারচেয়ে বেশি আছে গণমানুষের, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের, আর আছে আন্তর্জাতিক দাতামহলের। কৃষি খাতের অগ্রগতিতেও সরকার-নির্বিশেষে ধারাবাহিকতা আছে, বর্তমান কৃষিমন্ত্রী ও বর্তমান সরকারের কিছু বাড়তি কৃতিত্ব তো আছেই। শিক্ষা খাতের অগ্রগতি এ সরকারের বিশেষ কৃতিত্ব, তবে সংখ্যাগত অগ্রগতির সাথে শিক্ষার গুণগত মানের সামঞ্জস্য থাকছে কিনা সেটা এখনও প্রশ্নসাপেক্ষ।
সামগ্রিকভাবে এখন মানুষ মনে করতে শুরু করেছে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকার ব্যর্থ হতে চলেছে। এমন ভাবার কারণ, তাদের বিগত আমলের ভূমিকা এবং সাম্প্রতিক চাঞ্চল্যকর সব অপরাধের ঘটনাতেও সরকার প্রধানের দিক থেকে সুবিচার ও সুশাসনের সদিচ্ছার প্রমাণ না আসা। এবার প্রধানমন্ত্রীর প্রমাণ দিতে হবে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তিনি আন্তরিক। তাহলেই গণতন্ত্রের পথের বাধা দূর হবে, কারণ এর মাধ্যমেই ক্ষমতাসীন দল জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার জন্য জনসমর্থন ও প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবে। নয়ত, দুর্ভাগ্যের বিষয় ও দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তাঁকে উত্তরোত্তর কঠোর ও কর্তৃত্ববাদী হয়ে স্বৈরশাসনের পথেই এগুতে হবে।

Thursday, May 15, 2014

সুড়ঙ্গের শেষে আলোর রেখা

আবুল মোমেন

জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। পুলিশ ও র‌্যাব হয়ত নানান পরিসংখ্যান দিয়ে পরিস্থিতির অপেক্ষাকৃত ভালো চিত্র তুলে ধরবে। কিন্তু বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর গুম ও অপহরণের ঘটনা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ভয় ভীতি বেড়ে যাওয়ার কারণ এ ধরনের কোনো ঘটনারই সুষ্ঠু তদন্ত হয়ে অপরাধী ধরা পড়ছে না। ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পরে দু’বছর  অতিবাহিত হল। ঘটনার রহস্য উদঘাটন এবং দোষী শনাক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। বিচার তো পরের কথা। মেধাবী ছাত্র ত্বকীর মৃতদেহ পাওয়া গেল, নিহতের পরিবার এবং নারায়ণগঞ্জের সুধিজনের দিক থেকে অভিযুক্তের নাম সাঙ্গ-পাঙ্গসহ বারবার উঠল। কিন্তু কোনো অগ্রগতি নেই। বেলার সম্পাদিকা পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানার স্বামী ব্যবসায়ী সিদ্দিক অপহৃত হয়েও সৌভাগ্যক্রমে ফিরে এলেন। কিন্তু সে মামলারও তেমন কোনো অগ্রগতি হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে না।
সমাজে নানা কারণে খুন-অপহরণের মত অপরাধ সংঘটিত হয়। তিনটি কারণে তা জনমনে আতঙ্ক ছড়াতে থাকে। এক. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্বাভাবিক তৎপরতা ব্যাহত-বিঘিœত হলে এবং পরিণতিতে ঘটনার রহস্য ভেদ না হয়ে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা না হলে; দুই. সরকারি সংস্থা, সরকারি দলের এ ধরনের  অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে; তিন. কিশোর ত্বকী বা উকিল মাধবচন্দ্রের মত নিরীহ  মানুষের প্রাণহানী বাড়তে থাকলে। পারস্পরিক দ্বন্দ্বের জের ধরে সংঘটিত অপরাধ বা ঐশীর মত বিপথগামী সন্তানের অপরাধের পরিণতি মানুষকে মর্মাহত, বিচলিত, দু:খিত করে, কিন্তু ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত করে না। আজকের দিনে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার কারণ গুম-খুনের মত অপরাধের ধারাবাহিকতা, কোনো মামলার অগ্রগতি না হওয়া এবং সবটা মিলিয়ে বিভিন্ন শহরে ও জনপদে থমথমে অবস্থার সৃষ্টি হওয়া। এসব ব্যাপারে সরকারের নিরপেক্ষতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আন্তরিকতা ও দক্ষতা এবং ন্যায় বিচার প্রাপ্তির সম্ভাবনা সম্পর্কে অনিশ্চয়তায় ভুগছে মানুষ।
জনজীবনে সৃষ্ট নিরাপত্তাহীনতা কাটানোর জন্যে সরকার মানুষকে আশ্বস্ত করার মত কোনো উদ্যোগ নিতে পারছে না। অন্তত এখনও পর্যন্ত নেওয়া হয় নি। ইলিয়াস আলীর ভাগ্যে কী ঘটেছে তা এতদিনে তাঁর নিকটজন, তাঁর দলের নেতা-কর্মী ও সাধারণ জনগণকে জানাতে সরকারের সক্ষম হওয়া উচিত ছিল। নয়ত ঘটনার দুই বছর পরে এটাকে ব্যর্থতা বলেই মনে করবে মানুষ, এবং এর দায় নিতে হবে সরকারকেই। ইলিয়াস আলীর নিভের্জাল দলীয় পরিচয় এবং নানা কারণে ভাবমূর্তি বিতর্কিত হলেও ঘটনাটি পুলিশ-র‌্যাব-সরকারের ব্যর্থতার সাক্ষ্যই দিতে থাকবে। বিএনপি নেতার ক্ষেত্রে যদি জনমতের ধারা এরকম হয় তাহলে ত্বকী বা মাধবচন্দ্রের ক্ষেত্রে এ ধারণা কতটা একতরফা এবং তীব্র হবে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
বৃহত্তর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর ইঙ্গিত  হল ক্ষমতাসীন দল বা এ দলের নেতৃত্ব মনে করছে তাদের জন্যে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে স্থায়ীভাবে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে হটিয়ে দেওয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। সরকার সম্ভবত মনে করছে সামরিক বাহিনী, জনপ্রশাসন এবং নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশের সমর্থন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। এর জোরে শক্ত হাতে শাসনযন্ত্র চালিয়ে জনগণের সামনে থেকে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিটি নিশ্চিহ্ন কিংবা অকার্যকর পর্যায়ে দুর্বল করে দেওয়া যায়। যদি ক্ষমতাকেন্দ্রিক এই আঁতাত সম্পর্কে সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিশ্চিত থাকে তাহলে তারা একই সাথে বিএনপি ও জামায়াতকে অকেজো করে দেওয়ার চেষ্টা চালাবে। সম্ভবত সে কারণেই জামায়াতবিরোধী অরাজনৈতিক ইসলামি সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সাথে সখ্য গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার।
তালি অবশ্য এক হাতে বাজে না, আর পরিস্থিতি সাধারণত একক চেষ্টাতেও অনুকূল হয়ে ওঠে না। অনেকের ভূমিকা ও অবদানে তা গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের নাগরিকসমাজের প্রভাবশালী অংশ মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ক্ষুণœ করতে রাজি নয়, আর এর বাইরের নতুন প্রজন্ম এ বিষয়ে গভীর আবেগপূর্ণ স্পর্শকাতরতা লালন করে থাকে। এরা উভয়েই এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের ভূমিকায় শতভাগ সন্তুষ্ট নয়, কিন্তু বিপরীতে বিএনপির ভূমিকা তাদের হতাশ করেছে। জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধ, পাকিস্তানের প্রতি দুর্বল এবং যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট দলের প্রতি এদের পক্ষে সমর্থন জানানো সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ এই পরিস্থিতির সুবিধা পাচ্ছে।
দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র থাকুক, তার মধ্যে ধর্মীয় চেতনাকে প্রাধান্য দিয়ে পরিচালিত দলও থাকতে পারে, কিন্তু সবার নীতি-আদর্শে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন ঘটকু এই প্রত্যাশাটাই স্বাভাবিক। মনে হয় দেশের সচেতন মানুষ এটাই আশা করে। আওয়ামী লীগ কুড়ি বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে ইসলাম ধর্মীয় চেতনার মিশ্রণ বা সহাবস্থান গড়ে তোলার দুরূহ কাজটি করতে পেরেছে। ফলে সেদিক থেকে সে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মূল অস্ত্র অনেকটাই ভোঁতা করে দিতে সক্ষম হয়েছে। এখন আওয়ামী নেতৃত্ব চাইছে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের কালিমায় জামায়াতে ইসলামি দলের পরিচয়টি বিতর্কিত করে হেফাজতের মত ধর্মভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠনের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে সাধারণ ভোটারের ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট রক্ষা ও প্রতিদ্বন্দ্বী জোটকে রাজনৈতিকভাবে আরও দুর্বল করে দেওয়া।
ক্ষমতার এই খেলাটায় সম্ভবত নাগরিকসমাজ ও তরুণদের অনেকেরই সায় আছে। এ কাজ হয়ত ক্ষমতার জোরে অনেক দূর করাও সম্ভত, কিন্তু এর পরিণতিগুলো সামলানো বেশ কঠিন। এ প্রক্রিয়ায় সরকারকে অতিমাত্রায় বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর - যার মধ্যে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাও অন্তর্ভুক্ত থাকবে - ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হয়। আর এসবের সদস্যরা যখন এটা বুঝতে পারবে তখন তাদের ক্ষমতার পরিধির বিস্তার অনেক সদস্যকেই-যারা একটু উচ্চাভিলাষী, একটু বেপরোয়া-পরিস্থিতির সুযোগ নিতে প্রলুব্ধ করবে। বেসামরিক জনশাসনের ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। আর ক্ষমতাসীন দল ও জোটের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও ক্ষমতাবান (যুগপৎ বিত্তবানও) হয়ে ওঠার এই দৌড়ে শামিল হওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকবে। বাংলাদেশে বর্তমানে এ ঘটনাই ঘটছে।
 বাস্তবতা হল দেশের অধিকাংশ মানুষ মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের বিচার চায়, এর চেয়ে সংখ্যায় কিছু কম কিন্তু তা-ও অনেকেই, একাত্তরের ভূমিকার জন্যে জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে বিবেচনা করে, এর চেয়ে কিছু কম তা-ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি অংশ, বিএনপির জামায়াত-সংশ্লিষ্টতা পছন্দ করে না। সেই সাথে এ-ও বাস্তব তাদের এই মনোভাবের পাশাপাশি মাথাচাড়া দিচ্ছে ভয় ও আতঙ্কের বোধ। কেননা অপহরণ-গুম-খুনের ঘটনাগুলো সরাসরি ব্যক্তির জীবনের নিরাপত্তাকেই হুমকিতে ফেলে দিচ্ছে। বর্তমানের বাস্তব, যা অপহরণ-খুন, তদন্ত ও বিচার ব্যর্থতায় জনজীবনকে অনিশ্চিত, অসহায় অবস্থা ও অন্যায় সয়ে নেওয়ার যে শাস্তি দিচ্ছে তা আপাতত তার জন্যে ইতিহাসের ঘটনার চেয়ে জরুরি ভিত্তিতে নিষ্পন্ন হওয়ার বিষয়। এই অসহায় ক্ষোভ ও ক্রোধ থেকে সৃষ্টি হবেÑহয়ত হচ্ছে ওÑক্ষমতাসীনদের সাথে তার ব্যাপক সমর্থক গোষ্ঠীর দূরত্ব, এমনকী বিরোধ।
এমন পরিস্থিতি এড়ানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে সুশাসন নিশ্চিত করা। কিন্তু সরকার তো সুশাসনকে তাদের অগ্রাধিকারে রাখছে না, রাজনৈতিক ফায়দাকেই যে গুরুত্ব দিচ্ছে সেটা মোটামুটি পরিস্কার। এই বক্তব্যের পক্ষে দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় নির্বাচন কমিশন ও দুদকের ওপর সরকারের ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব। আর সাম্প্রতিক অপরাধগুলোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর নিস্ক্রিয়তা, মন্থরগতি, উদাসীনতার প্রমাণও হাজির করা যায়।
কিন্তু এই বাস্তবতায় আতঙ্কিত এবং হতাশ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে এবং সরকারের ওপর তাদের আস্থাও কমে যাচ্ছে। এমন চলতে থাকলে নির্বাচন বৈতরণী সফলভাবে পার হওয়া সরকারি জোটের জন্যে কঠিন হবে। তার অর্থ হবে ইতোমধ্যে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠা ক্ষমতার আঁতাত স্বচ্ছ নিরপেক্ষ নির্বাচনের দিকে যাবে না। দুদককেও স্বাধীন ও শক্তিশালী করবে না। বরং বিচার ব্যবস্থাসহ সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্রের ওপর প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে চাইবে।
এ অবস্থাটা মানুষ চায় না। কিন্তু মানুষ কি জামায়াতের দোসর বিএনপিকে ক্ষমতায় ফেরানোর জন্যে কঠিন আন্দোলনে নামার ঝুঁকি নেবে? আমার মনে হয় নেবে না। ফলে জনগণ সত্যি সত্যি শাঁখের করাতে কাটা পড়ছে। তাকে পরিত্রাণ দেওয়ার পথ বিএনপি দেখাতে পারছে না, সম্ভবত তারেক ও খালেদা জিয়ার তা জানা নেই।
তাহলে কি জনগণের জন্যে এ ত্রাহি অবস্থা থেকে পরিত্রাণের কোনো পথই নেই? আমার মনে হয় আছে। নাগরিকসমাজকেই অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে এ কাজে নামতে হবে। মনে রাখা দরকার, পথ যদি সরকার পরিবর্তনে না মেলে তাহলে ক্ষমতাসীন সরকারের নীতি ও কর্মসূচি পরিবর্তনে নাগরিকসমাজকে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে নাগরিকসমাজেরও অনেক সাফল্য আছে। নীতির ক্ষেত্রে যেমন তেমনি অনেক ইস্যুতেও তা এসেছে। শিশু ও নারীর অধিকার  রক্ষায় নীতি প্রণয়ন এবং সে অনুযায়ী আইন প্রণয়ন ও ব্যবস্থা গ্রহণের দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তি আদায় নাগরিক সমাজেরই অর্জন। কথা হল, কাজ অনেক বাকি আছে। দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ, স্থানীয় সরকারকে কার্যকর করা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা, লিঙ্গ-ধর্ম-জাতিগত বৈষম্য দূর করা ইত্যাদি অনেক কাজ আছে যেখানে অগ্রগতি হলে গণতন্ত্র চর্চায়ও তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আসবে। নাগরিকসমাজ যদি সরকার  ও শিক্ষকদের উদ্বুদ্ধ করে প্রতিষ্ঠান এবং পেশার মর্যাদা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ ভূমিকা পালনে উদ্বুদ্ধ ও বাধ্য করতে পারতেন তাহলেও আমাদের গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় নতুন গতি সঞ্চার হত।
আমি হতাশার কারণ দেখি না। সত্যি যে আমরা কঠিন দু:সময় পার করছি, যাকে মাঝে মাঝেই বন্ধ্যাকাল এবং অবনতিশীল পরিস্থিতির চূড়ান্ত পরিণতি বলে মনে হয়। কিন্তু আমাদের তরুণ সমাজ, যাতে বড় সংখ্যায় তরুণ নারী সমাজও অন্তর্ভুক্ত, বেশ প্রাণবন্ত, উদ্যমী, এবং সর্বোপরি নি:স্বার্থ ভালো কাজ করার জন্যে উদগ্রীব। আমরা কেন তাদেরই দেশের ভবিষ্যত জেনে তাদেরকে সাথে নিয়ে নাগরিকের দায়িত্বগুলো পালনে সক্রিয় হই না! আমি খুবই আশাবাদী যে সেখানেই সুড়ঙ্গের শেষের আলোর রেখা ফুঠে উঠছে।

Thursday, April 10, 2014

কোথায় আছে অমৃত?

আবুল মোমেন

রাষ্ট্রের গতিপথ কখনও মসৃণ নয়, উত্থানপতন ও বাঁকবদল এত বড় আকারে হয়ে থাকে যে বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, প্রতি পঞ্চাশ বছরে একবার মহাদেশের মানচিত্রে পরিবর্তন ঘটে। ইউরোপের দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টা সহজে বোঝা যাবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পর ইউরোপের মানচিত্রে কিছু পরিবর্তন ঘটেছিল। তারপর ১৯৮৯-এর পরে জার্মেনি, চেকেশ্লোভাকিয়া (এখন বিলুপ্ত), যুগোশ্লাভিয়া (এখন পাঁচটি ভাগে বিভক্ত) এবং পূর্বেকার সোভিয়েত ইউনিয়নে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এই অস্থিরতা যে এখনও কাটেনি তা সাম্প্রতিক ক্রাইমিয়া ক্রাইসিসে ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে। এশিয়া ও আফ্রিকাতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ঔপনিবেশিক কাল শেষ হয়ে স্বাধীনতার পর্ব শুরু হওয়ায় তখনই রদবদল ঘটেছে। তাতে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর ও মধ্য আফ্রিকার মানচিত্র নির্মাণ ঠিক ছিল কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। অনেক বিশেষজ্ঞের অভিমত এতে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের বিষয়টিই অগ্রাধিকার পেয়েছে। তারই জের ধরে  প্যালেস্টাইন সমস্যা ষাট বছর ধরে চলছে বা ইরাক আকষ্মিকভাবে কুয়েত দখল করে নিতে চেয়েছিল। বাংলাদেশের আবির্ভাব প্রমাণ করে উপমহাদেশে ১৯৪৭-এর সাম্রাজ্যবাদী দেশভাগ সঠিক ছিল না। এসব দৃষ্টান্ত থেকে রাষ্ট্রের অস্থিরতা আমরা বুঝতে পারি।
এর ওপরে আছে রাষ্ট্রশাসনেও নানা উত্থানপতন। ভিন্ন মতাবলম্বী নিয়েই গণতন্ত্র, কিন্তু সেই গণতন্ত্রই অনেক সময় চরম ফ্যাসিবাদের উত্থানে সহায়ক হয়ে থাকে, যেমন হয়েছিল ১৯৩৬ সালে জার্মেনিতে নির্বাচনে হিটলারের বিজয়ের মাধ্যমে।
এখন প্রতিবেশী এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের  দেশ ভারতবর্ষে সাধারণ নির্বাচন শুরু হয়েছে। সব জরিপ ও জল্পনায় বলা হচ্ছে এবারের নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন জোট ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়ান্স (এনডিএ) বিজয়ী হবে এবং ২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গার জন্যে অভিযুক্ত নরেন্দ্র মোদীই হবেন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। সবার আশংকা বিজেপির অতীতের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ির তুলনায় মোদী শক্ত হাতে তাঁর নিজস্ব ও দলীয় এজেণ্ডা বাস্তবায়ন করতে চাইবেন। তাতে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সমাজজীবনে পরিবর্তনের হাওয়া লাগার সম্ভাবনা রয়েছে। একটি মুসলিম সমাজের তুলনায় বলা যায় হিন্দু সমাজের উপরিকাঠামোর পোশাকি সংস্কৃতি দৃশ্যত অনেক উদার হলেও তার হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক সামাজিক এজেন্ডা বস্তুত অনেক রক্ষণশীল ও কট্টরভাবে অনুদার। ফলে এরকম শাসনামলে অহিন্দু সম্প্রদায়গুলো, বিশেষত বৃহত্তম সংখ্যালঘু মুসলিমসমাজ, বৈষম্যের শিকার হতে পারে। এর প্রতিক্রিয়া উপমহাদেশের মুসলিমপ্রধান দেশেও যে পড়বে তাতে সন্দেহ নেই।
এবারের নির্বাচনে বিজেপি হিন্দুত্ববাদী দলের ভূমিকা নেওয়ার বিষয়ে যথেষ্ট সংযত ছিল। ইশতেহারের ঘোষণায় এমন ইঙ্গিত থাকলেও নির্বাচনী প্রচারণায় তারা ভারতবর্ষের ঐক্য ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির ওপর জোর দিচ্ছে। তাতে ভারতীয় শক্তিশালী বণিকসম্প্রদায় মোদীকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া দারিদ্র, বৈষম্য, শোষণ-পীড়িত সমাজের সাধারণ মানুষ বরাবর স্থিতিশীল সরকার ও শক্তপোক্ত শাসকের পক্ষে। একারণেই ভারতের সাধারণ মানুষ আম আদমি পার্টির নীতি বাগিশ অবস্থানকে দুর্বলতা বলে গণ্য করেছে এবং ক্ষমতা প্রয়োগ না করে ত্যাগ করার নীতিকে সমর্থন জানায় নি। দলের নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ওপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ঝাড়ার কারণ সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় যাকে পাঠিয়েছিল তার এভাবে নীতির দোহাই দিয়ে দুম করে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়াকে তারা দুর্বলের আচরণ ও প্রতারণার শামিল মনে করেছে। এর চেয়ে অল্পসল্প দুর্নীতি করে শক্ত হাতে ক্ষমতা প্রয়োগ করলে তাকে নেতা মানতে তারা স্বস্তি বোধ করত। এই মনস্তত্ত্ব আমাদের সমাজেও প্রবল।
রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রশাসনে এরকম উত্থান পতন ও বাঁকবদল অবশ্যম্ভাবী বলেই সমাজকে পরিণত, স্থিতিশীল ও পোক্ত হতে হয়। তা না হলে অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে রাজনীতি ও সংস্কৃতির অঙ্গনে নানা রকম ঢেউ আছড়ে পড়তে থাকলে সমাজ তা নিজ শক্তি ও প্রজ্ঞায় সামলাতে পারবে না। সমাজ বকাটা ঘুড়ির মত দিগ্ভ্রান্ত হয়ে নানান স্রোতের মধ্যে যে ঢেউটি প্রবল হবে তাতেই সওয়ার হবে। অভীষ্ট পথে না গিয়ে ভুল পথেও চলে যেতে পারে। সে কারণে সমাজে কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হয় যেগুলো বিভ্রান্তিকর অবস্থার মধ্যেও পথ দেখাতে পারে। তেমনি থাকতে হয় অভিভাবকতুল্য জ্যেষ্ঠ নাগরিক, যাঁরা সংকটের সময় নির্দিষ্টভাবে পথের দিশা দিয়ে থাকেন।
আমরা যদি দেশের ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখব  গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অনেক রকম ঢেউ উঠেছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা পথ হারাইনি। ভাষা-সাহিত্য-শিল্প নিয়ে চরম বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা হয়েছে, অর্থনৈতিক বৈষম্যও চরম ছিল, ছিল ধর্মীয় মৌলবাদ ও সামাজিক কুসংস্কারের দৌরাত্ম্য, রাজনীতিতে ভ্রান্ত পথের মোহও ছড়ানো হয়েছিল। এই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ জাতির অভিভাবক ও পথ প্রদর্শকের ভূমিকা এবং ছাত্ররা অগ্রপথিকের ভূমিকা পালন করেছিল। একেবারে আলাদাভাবে বলা যায় ভাষা আন্দোলনের সময় বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও পুথি গবেষক মুন্সী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ একেবারে বয়োজ্যেষ্ঠ অভিভাবকের ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাঁরা যুগান্তকরী বক্তব্য রেখেছেন এ সময়ে। আর তাঁদের সাথে সে সময়ের প্রবীণ-নবীন অধিকাংশ লেখক ও শিক্ষাবিদ এককাতারে শামিল হয়েছিলেন। ষাটের দশকের রাজনৈতিক আন্দোলনের সময় কথাসাহিত্যিক শিক্ষাবিদ আবুল ফজল ও কবি ও নারীনেত্রী বেগম সুফিয়া কামাল বলিষ্ঠভাবে অভিভাবকত্ব দিয়েছেন। তখনকার অস্থির সময়ে লেখক-শিল্পীদের পাশাপাশি অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীসহ বুদ্ধিজীবীরা সরব ও সক্রিয়া ভূমিকা পালন করেছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রাজনীতিবিদরা সেই সময়ে এদের  প্রদর্শিত পথেই হেঁটেছেন। তাতে জাতীয় ঐক্য যেমন হয়েছে, তেমিন সকল বাধা জয় করে সামনে এগুনোও সম্ভব হয়েছে। সেই সময় সংবাদপত্র, যেমন দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, অবজার্ভার ও পূর্বদেশের ভূমিকা স্মরণ করুন। নিশ্চয় মনে পড়বে মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, আবদুস সালাম-এর মত সম্পাদক-সাংবাদিকদের কথা। আজকে এই সমাজে সাহসী প্রজ্ঞাবান নি:স্বার্থ অভিভাবকের অভাব প্রকট। বিশ্ববিদ্যালয়ও অভিভাবকহীন। বিদ্যা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মূল্য এখানেও হতাশাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার পাদপীঠ থেকে ডিগ্রি ও সনদ বিক্রয়ের কারখানায় পরিণত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হল সেই প্রতিষ্ঠান যেখানে বিদ্যা উৎপন্ন হয়। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, এখানে দেশবিদেশের জ্ঞানীগুণীরা নিজেদের কাজ করবেন আর ছাত্ররা তাঁদের সঙ্গে থেকে জ্ঞানচর্চার জোগালি হিসেবে কাজ করে পরিণতি লাভ করবে। অতীতের নালন্দা বা তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশবিদেশের জ্ঞানীগুণীদের আগমনের কথা আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি। একইভাবে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, চৌষট্টির দাঙ্গা বিরোধী ভূমিকা, ছেষট্টির ছয়দফার আন্দোলন, আটষট্টির স্বাধিকার আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ভূমিকার কথা ভাবুন। এখন কোথায় সংবাদপত্রের সেই ভূমিকা, কোথায়ইবা সেইসব মানবের সম্পাদক ও সাংবাদিক?
এখন বিশ্বায়নের এই কালে বাস করেও আমরা কূপমণ্ডুকতার চর্চা করছি। এর প্রভাব পড়ছে সর্বত্র, আমাদের জীবনের কোথাও মননশীলতার ছাপ নেই, এর প্রয়োজনও নেই। তাই চিন্তার দৈন্য, রুচির বিকার, অনুকরণসর্বস্বতা চলছে সর্বত্র। স্বার্থচিন্তা, ভোগের উদগ্র লালসার আগুনে পুড়ে যাচ্ছে ন্যায়-অন্যায় বোধ, জ্বলে যাচ্ছে সুশাসন ও আইনের শাসনের ধারণা, মিথ্যাচার, কপটতা, তোষামোদী, ক্ষমতার ও বিত্তের দম্ভ, ফাঁপা ও ফাঁকা গরিমায় প্রায় অসহ্য হয়ে উঠছে সমাজ জীবন। এ অবস্থার মধ্যেও পুরস্কার-স্বীকৃতি-সম্মাননার হিড়িক চলছে। তার কোনটা ঠিক কোনটা ছলনা বোঝা দায়। এভাবে মুড়ি-মুড়কি একদর হয়ে গেছে। খনার বচনে আছে যে দেশে ঘি ও তেলের দাম সমান সেই দেশে বাস করবে না। এদেশে অনেক আগেই মুজিব-জিয়াকে এক পাল্লায় তোলার কৌশল কাজ দিয়েছে। এবার কি তারেক জিয়া সেরকম একটা ভূমিকায় পৌঁছে যাবে? তাঁর সর্বশেষ কথার চালটা অনুসারীরা এদেশেও  চালু করে পাল তোলার মত বাতাস সৃষ্টির চেষ্টা চালাবেন সন্দেহ নেই। কথা হল তাতে কি উঠে পড়বেন তাঁদের সমর্থক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অধ্যাপকরাও? ভবী কি ভুলবে এসব কথায়? বিশ্বাস করা যায় না এমন তরল অস্থির সমাজের মনমানসিকতা।
কিন্তু এই বাস্তবতা এবং এর পরিণতি নিয়ে কেউ যেন মাথা ঘামাতে রাজি নন। সবাই গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। ফলে ক্ষমতা ও বিত্তই সমাজে প্রভাব ও প্রতিপত্তি নির্ধারণ করছে আর দুর্বল অংশ তোষামোদ ও কপটতার আশ্রয় নিয়ে গা ভাসাচ্ছে। এ যেন অমেরুদণ্ডী প্রাণীর সমাজ। সমাজে এ ধরনের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠার সময়ে আজ থেকে শিকি শতাব্দী আগে কবিতায় লিখেছিলাম -
এখন উচু হওয়ার সময়/ কুঁজো হওয়ার/’
এবং ‘... প্রবল অনুরাগে/নিচু হয়ে সবাই
এ ওর/‘শিরদাঁড়া ভেঙে বেছে দেয় কাঁটা-/ যা কিনা
বিশ্রি/অপ্রয়োজনীয়/এবং/কাঁটার আপদ ঘুচিয়ে/
সরীসৃপ শৈথিল্যে মেতে ওঠে/তারপর।’
আমরা শিরদাঁড়াহীন প্রাণীতে পরিণত হচ্ছি, সরীসৃপ শৈথিল্যে
মেতে উঠছি। বিষ নিয়ে খেলছি-অমৃত কোথায় জানি না।


Tuesday, April 1, 2014

জিয়াকে আরও বিতর্কিত করা কেন

আবুল মোমেন

বেগম খালেদা জিয়া পুত্রের পথ ধরে ঘোষণা দিলেন যে, তার স্বামী প্রয়াত জিয়াউর রহমানই দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। অন্তর্নিহিত কথাটা হল  বঙ্গবন্ধু নন, জেনারেল জিয়াই বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। কথাটা ঐতিহাসিক এবং সাধারণ আইনি ব্যাখ্যায় ধোপে টেকে না। কেন তা বোঝা দরকার। এতকাল তাদের ও বিএনপির দাবি জিয়া স্বাধীনতার প্রথম ঘোষক, এটুকুতে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন সেটার সঙ্গে যোগ হচ্ছে প্রথম রাষ্ট্রপতির দাবিটি। এতে ইতিহাসে কৃতিত্ব, গুরুত্ব, মহত্ত্ব বাড়ে কি না— আমি জানি না। কিন্তু এসবের পেছনে বঙ্গবন্ধুর কৃতিত্ব, গুরুত্ব, মহত্ত্ব লাঘবের প্রয়াস কাজ করে, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। বর্তমানকালে প্রচারণা জনমত গঠনে একটি বড় হাতিয়ার সন্দেহ নেই। কিন্তু তা বলে বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে জিয়াকে বড় করার কৌশল যে ধোপে টিকবে না, সেটা অন্তত বিচক্ষণ রাজনীতিবিদরা বুঝে থাকেন। সব জাতির ইতিহাসেই এমন কিছু নায়কের আবির্ভাব ঘটে যাদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বিতর্ক করার অবকাশ থাকে না। আর ইতিহাসে এমন কোনও কোনও চরিত্রের আবির্ভাব ঘটে থাকে, যাদের ভূমিকা হয় অস্বচ্ছ এবং বিতর্কিত। জিয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে তেমন একটি চরিত্র।
জিয়া স্বাধীনতার প্রথম ঘোষক বা রাষ্ট্রপতি এ দাবি ঐতিহাসিকভাবেই সত্য নয়। ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে পাকবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ার ও তাকে গ্রেপ্তার করার আগে বঙ্গবন্ধু তত্কালীন ইপিআর বা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে স্বাধীনতার একটি ঘোষণাবার্তা পাঠিয়েছিলেন। সেটি অন্তত চট্টগ্রামে যে কপি করে ও মাইকিং করে জনসাধারণের মধ্যে প্রচারিত-ঘোষিত হয়েছিল সে কথা আমি চট্টগ্রামবাসী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়ে বলতে পারব। সেই বার্তাটি যারা বেতারযন্ত্রে প্রচারের কাজ করেছিলেন তারা অনেকেই এখনও জীবিত আছেন এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় দিয়েছেন, বইয়েও ছাপা হয়েছে তা।
দ্বিতীয়ত, চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র যখন কিছু বেতারকর্মী দখল করে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র চালু করেন তখন ২৬ মার্চ ১৯৭১ দুপুরে সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের তত্কালীন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত এমএ হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার একটি ঘোষণা পাঠ করেন। এরও আগে সদ্য প্রয়াত বেলাল মোহাম্মদের নেতৃত্বে কর্মীরা অধিবেশন শুরু করে বেতারকেন্দ্রটির নামে যেমন স্বাধীনতার ছাপ রাখলেন তেমনি ঘোষণাতেও স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। তবে এসবই নেতা নয়, ঘোষকের বক্তব্য। বস্তুত নেতা বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চ রেসকোর্সের ময়দানেই স্বাধীনতা ও আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। এরপর থেকে দেশের শাসনভার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতেই চলে এসেছিল। বাংলাদেশ বস্তুত সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের দ্বারাই শাসিত হচ্ছিল, জনগণের এটাই ছিল আকাক্সক্ষা এবং এ ব্যবস্থা তাদের চাহিদা ছিল ও তারা এটা আনন্দে মেনে নিয়েছিল। ছাব্বিশে মার্চ যখন বোঝা গেল একদিকে পাকিস্তান সরকার আলোচনা ভেঙে দিয়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সামরিক অভিযান চালাতে শুরু করেছে এবং অন্যদিকে বিভিন্ন সেনানিবাস থেকে আক্রান্ত হয়ে বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকরা সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে তখন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সবারই মনে হল এ পরিস্থিতিতে একজন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তার মুখ থেকে কোনও ঘোষণা এলে জনগণের মনোবল বাড়বে, তারা প্রতিরোধ যুদ্ধের দিকনির্দেশনাও পাবে। এর আগে বেতারের উত্সাহী বেসামরিক কর্মীরা আক্রমণকারী শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর আহ্বান জানিয়ে যেসব ঘোষণা দিয়েছেন তাতে প্রতিরোধের জন্যও মরিচের গুঁড়োসহ নানা দেশি পদ্ধতি ব্যবহারের কথাও বলা হয়েছে। সশস্ত্র সম্মুখযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলতেও তারা ভোলেননি। কিন্তু তবুও ঘটমান বাস্তবতায় বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের ভূমিকা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চেয়েছে মানুষ, চেয়েছে তারা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পাশে থেকে সামরিক যুদ্ধে অংশ নিক ও নেতৃত্ব দিক।
এ রকম একটি পটভূমিতে স্বাধীন বাংলা বেতারের মূল সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা মিলে পটিয়া থেকে তত্কালীন মেজর জিয়াকে কালুরঘাটে সম্প্রচার কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। তারা তার কাছে হানাদারদের আসন্ন আক্রমণ থেকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা চান এবং বেতারে একটি ঘোষণা দেওয়ার প্রস্তাব দেন। জিয়া দুটি প্রস্তাবই গ্রহণ করেন। এ বিষয়ে ঘটনার কারিগর বেলাল মোহাম্মদ তার বইয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। অনেক গবেষকও এ নিয়ে কাজ করেছেন। এসবই ২৭ মার্চের ঘটনা। জিয়া নিজেই ঘোষণার একটি খসড়া করলেন ইংরেজিতে। সম্ভবত অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন সেটির বাংলা অনুবাদ করেন। এই ঘোষণাটি জিয়াউর রহমান পাঠ করেছিলেন। তাতে তিনি নিজেকে অস্থায়ী সরকারের প্রধান হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। এই ভাষ্যটি বেতারে প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামের অভিভাবকস্থানীয় কিছু নাগরিক, যেমন শিল্পপতি একে খান, শিক্ষাবিদ আবুল ফজল, সাহিত্যিক সাংবাদিক মাহবুব উল আলম চৌধুরীসহ অনেকেই বললেন একজন মেজর যদি নিজের নামে এ রকম ঘোষণা দেয় তবে তা হবে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, স্বাধীনতার ঘোষণা হবে না। এটি একমাত্র বঙ্গবন্ধুই দিতে পারেন, নির্বাচনে বিজয়ী দলের প্রধান হিসেবে। সেদিনের শ্রোতারা সাক্ষী আছেন একবারই স্বনামে ঘোষণাটি প্রচারিত হওয়ার পর তা সংশোধিত হয় এবং মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে এ কটি কথা যোগ করতে হয়।
এ থেকে দুটি বিষয় মনে রাখা দরকার। প্রথমত, একজন সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে একটি ঘোষণা পাঠ করার জন্য মেজর জিয়াকে সেদিন স্বাধীনতাকামী রাজনীতিক ও তরুণরা বেতারকেন্দ্রে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি বিদ্রোহ করলেন কোন পরিস্থিতিতে, শেষ মুহূর্তে বিদ্রোহ করেছিলেন সেসব বর্ণনাও বিভিন্ন বইতে রয়েছে খনও সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হননি। তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার সৈন্যদল ও স্থানীয় তরুণদের নিয়ে প্রতিরোধ সংগঠিত করেননি যা দেশের অন্যান্য অঞ্চলে হয়েছে। তিনি নিজে বেতার ঘোষণার প্রয়োজন অনুভব করেননি। তবে প্রাপ্ত সুযোগ কাজে লাগিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, স্বনামে ঘোষণাটির পর বোঝা গেল তার নামে স্বাধীনতার ঘোষণা কার্যকর হয় না, বঙ্গবন্ধুর নামেই তা হতে পারে। ফলে তার এ ভ্রান্তি দ্রুত সংশোধন করতে হয়েছে। তাছাড়া সেদিন জনগণের কাছে জিয়া একজন অপরিচিত ব্যক্তি, মানুষ সামরিক পদবিটিকেই গুরুত্ব দিয়েছে। এ তো স্বাভাবিক ব্যাপার, একজন সামরিক কর্মকর্তাকে মানুষ কীভাবে চিনবে? অর্থাত্ সেদিন একজন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তার প্রয়োজন ছিল আমাদের, তার পদবিটিই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পদবির পরে যে-কোনও নামের একজন বাঙালি হলেই আমাদের চলছিল। আর তখন সবার অন্তরে যেমন জয় বাংলা ধ্বনি তেমনি মন্ত্রও একটিই এক নেতা এক দেশ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ। তাহলে দ্বিতীয় বিষয়টি হল যে ব্যক্তির অসংখ্য বা যে-কোনও সংখ্যক বিকল্প হতে পারে আর যার কোনও বিকল্প হতে পারে না তাদের কী করে এক কাতারে আনা যাবে? এ রকম প্রচেষ্টা সাধু-কর্ম হতে পারে না। বরং এ নিয়ে জেদ করলে যে ভ্রান্তি জিয়া সেদিন আপন হাতে ও কণ্ঠে সংশোধিত করেছিলেন সেটি ফিরিয়ে এনে তাকে অযথা ইতিহাসের আদালতে অভিযুক্ত করা হয়।
আর সেই আক্রান্ত জাতির সামনে নেতার বক্তব্য ও নির্দেশনাই ছিল কাম্য, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কোনও অবকাশ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব মেনে সেদিন সেনা সদস্য ও সাধারণ জনগণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অস্থায়ী সরকার গঠনের মূল কারিগর তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্য নেতৃবৃন্দ তখন নিরাপদ আশ্রয় খুঁজেছেন, যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজেছেন এবং ছড়িয়ে পড়া এমপি ও সহায়ক ব্যক্তিবর্গকে একত্র করার দুরূহ কাজে লিপ্ত ছিলেন। একটি সরকার ঘোষণার আগে ভারত সরকারের সমর্থনও আদায় করতে হয়েছে। এভাবে সবদিক গুছিয়ে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে অস্থায়ী সরকার গঠন করতে করতে ১৭ মে পর্যন্ত লেগে যায়। সেদিন কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের আম্রকাননে, আজ যা মুজিবনগর নামে পরিচিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহণ করে। আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করা হয়। অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন স্বভাবতই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর তার অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব লাভ করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
একথা মানতে হবে ১৯৭১ সালের বাস্তবতায় মেজর জিয়ার কণ্ঠস্বর স্বাধীনতাকামী মানুষের মনে ব্যাপক উত্সাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল। ফলে সেই থেকে জনমনে জিয়ার একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়। ১৯৭৫-এর রক্তাক্ত ঘটনাবলি, ক্ষমতায় এসে তার অনুসৃত রাজনীতি ও বিভিন্ন কার্যক্রম তাকে ক্রমেই বিতর্কিত করেছে। বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যার ঘাতকদের প্রতি তার পৃষ্ঠপোষকতামূলক আচরণ যেমন নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়, তেমনি ক্ষমতায় এসে পাকিস্তানি ধারার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রচলন, স্বাধীনতাবিরোধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দান এসব বিতর্ককে স্থায়ী করে তুলেছে। তার দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর পর বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সেই ধারাটি বহাল রেখে জিয়াউর রহমানকে বিতর্কিত রেখে দেওয়ার ব্যবস্থাই করেছেন। আর বর্তমানে জিয়াকে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দাঁড় করাতে গিয়ে বিষয়টিকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যে প্রাথমিক ভ্রান্তি জিয়া নিজের হাতে সংশোধন করেছিলেন তাকে সেই ভুলের দায় বহন করতে বাধ্য করার মধ্যে ফায়দা কী হতে পারে বোঝা যাচ্ছে না।
এসবই তারেক জিয়ার মস্তিষ্ক থেকেই উদ্ভূত বলে মনে হচ্ছে। পুত্রকে অন্ধভাবে অনুসরণ করছেন বেগম জিয়া। দলে এমন কেউ নেই যারা তাদের উপেক্ষা করে বা সহমতে এনে সঠিক পথটি দেখাতে পারেন। তারেকের প্রত্যক্ষ ও নেপথ্য উভয় প্রকার নেতৃত্বেই বিএনপি রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের ওপর মানুষ নানা কারণে অসন্তুষ্ট, সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষও কম নয়। ফলে নির্বাচনে বিএনপির জন্য জয়ের সুবিধা ভালোভাবেই আছে। অযথা অস্থির ও মরিয়া হয়ে আবোলতাবোল কথা বললে দলের ক্ষতিই হবে, ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কম।