Monday, December 30, 2013

কঠিন বছর পেরিয়ে কঠিন বছরে পদার্পণ

আবুল মোমেন

সময় প্রবহমান, কাল নিরবধি। তারপরেও সুবিধার জন্যে সময়ের নানা বিভাজন করে নিয়েছে মানুষ। এইসব বিভাজনের সবকটিরই আলাদা গুরুত্ব আছে। তবে মূল্যায়নের জন্যে বছরের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। আমরা অবশ্য এমন একটা বছর শেষ করতে যাচ্ছি আজ যেটি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি নাটকীয় অধ্যায়ের মাঝখানে রয়েছে। আজ বছরের হিসেবে ২০১৩ সন শেষ হচ্ছে কিন্তু যে রাজনৈতিক হিংসাত্মক ঝোড়া হাওয়ার মধ্যে আছি তার সমাপ্তি আজ হবে না। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ দশম সংসদের নির্বাচনের মাধ্যমেও তা শেষ হবে বলে মনে হয় না। বরং যেভাবে সব চলছে তাতে সেদিন হয়ত হিংসার নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে।
২০১৩ সন শুরু হয়েছিল জানুয়ারি মাসে যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আযাদের - অনেক গণমাধ্যমে যে ব্যক্তি বাচ্চু রাজাকার নামে পরিচিত - ফাঁসির রায় ঘোষণার মাধ্যমে। এটি ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ও যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রথম রায়। অভিযুক্ত ব্যক্তি অবশ্য পলাতক এবং কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত না থাকায় এ রায় নিয়ে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় নি। কিন্তু ফেব্র“য়ারির ৫ তারিখ জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ায় একে গুরু অপরাধের লঘু শাস্তি গণ্য করে ঢাকায় তরুণসমাজ রায় প্রত্যাখ্যান করে রীতিমত বিপ্লবী কাণ্ড ঘটায়। এটি সর্বত্র গণজাগরণ মঞ্চ নামে অভিহিত হয়। কোনো রকম সাংগঠনিক ভিত্তি ছাড়া কেবলমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে এরকম বিশাল গণজাগরণ সৃষ্টি কেবল অবাক করে নি জনগণকে, একই সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও গণতান্ত্রিক মূল্যাবোধে বিশ্বাসী সকলকে আশাবাদী ও আশ্বস্ত করে তুলেছিল।
কিন্তু এরপরে ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মামলার রায়ে আসামীকে ফাঁসি দেওয়ায় তাঁর অঞ্চল পিরোজপুর এবং জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেক প্রাণহানী ঘটেছে, বিপুল সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগ সমর্থকরা বিশেষভাবে আক্রমণের শিকার হন।
ফেব্র“য়ারি মাসের এ দুটি ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশের দুটি শক্তিশালী মতাদর্শের বিপরীত অবস্থানটা স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। প্রতিক্রিয়ার এই প্রত্যাঘাতে তরুণরা পিছু হটেনি, বরং গণজাগরণ মঞ্চকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করেছে, তীব্র প্রতিকূলতার মুখেও মাঠ ছাড়ে নি, আন্দোলনকে রাজপথে সরব রেখেছে। অন্যদিকে জামায়াত হিংসাত্মক আক্রমণের রাস্তা বেছে নিয়েছে। তারা জোটের বড় শরিক ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে আন্দোলনের মাঠে সঙ্গে পেয়েছে, যদিও এ দলের জন্যে পরবর্তী নির্বাচন ও তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুটি মুখ্য।
বিএনপির দিক থেকেও অবশ্য এটিই ছিল চাহিদা অর্থাৎ জামায়াত হিংসাত্মক ভূমিকায় মাঠে থাকুক। ফলে বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোটের তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুর আন্দোলন জামায়াতের সহিংস প্রতিক্রিয়ার একটা ঢাল হিসেবে কাজ করেছে।
এর মধ্যেই আরও ঘটনায় পরিস্থিতি জটিল ও উত্তপ্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে জামায়াত সম্পর্কে যেসব পর্যবেক্ষণ এসেছে তাতে দলটি যুদ্ধাপরাধী ও হিংসাত্মক রাজনীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে। এক পর্যায়ে আদালতের রায়ে জামায়াতের ইসলামি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য ঘোষিত হয়। অন্যদিকে গণজাগরণ মঞ্চের চাপে সরকার সংসদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আদালত আইন সংশোধন করে সরকারের জন্যে উচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ তৈরি করে। আর পরবর্তী সময়ে আরও কয়েকটি রায় হয় যাতে জামায়াতের তাত্ত্বিক নেতা গোলাম আযম ও বিএনপি নেতা আবদুল আলীম বয়সের কারণে দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেও জামায়াতের নেতা আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসির আদেশ হয়। সরকারি আপিলে উচ্চ আদালতে পুনর্বিচারে কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ হয় এবং সবশেষে আপিল বিভাগে রায় বহাল থাকায় শেষ পর্যন্ত এই আদেশ কার্যকর হয়। এরপর আবারও জামায়াতের তীব্র সহিংস প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন এলাকায় বহু প্রাণহানি ও সম্পদহানি ঘটেছে। এসব ঘটনা অনেকের জন্যে একাত্তরের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে। তাছাড়া এ ঘটনায় পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াও দেশে প্রবল প্রতিবাদ সৃষ্টি করেছে। পাশাপাশি জমায়াতের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কে যে অটুট আছে তাও প্রমাণিত হয়। জামায়াতের এই সহিংস প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি ১৮ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে রাজপথে আন্দোলন চাঙ্গা রাখার চেষ্টা হয়েছে বরাবর। এর মধ্যে ৫মে কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক হেফাজতে ইসলাম সংগঠন ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে বিশাল সমাবেশ করে সরকার, গণজাগরণ মঞ্চ এবং প্রগতিশীল সমাজকে রীতিমত শংকাগ্রস্ত করে তোলে। বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং তাঁর দল বিএনপি এটিকে কাজে লাগানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চালান। ফলে খোদ রাজধানীতে বড় রকমের সংঘাতের আশংকা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত শেষরাতে পুলিশ ও র‌্যাব আধঘণ্টার অভিযান চালিয়ে সমাবেশ ভেঙে দিতে সক্ষম হয়। দেখা গেল যথার্থ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও অঙ্গীকার ছাড়া কেবল শ্লোগানের ওপর ভর করে কোনো দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন করা যায় না। সরকার হেফাজতকে পক্ষে রাখার এবং বিএনপি-জামায়াত থেকে দূরে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত কট্টরপন্থী এই গোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত বিবদমান কোনো পক্ষেরই নির্ভরযোগ্য সঙ্গী হতে পারে নি।
এদিকে সরকার, বরং বলা যায় ১৪ দলীয় জোটের প্রধান দল আওয়ামী লীগ, কৌশল হিসেবে গণজাগরণ মঞ্চকে দীর্ঘদিন রাজপথে রাখতে গিয়ে এর যে অরাজনৈতিক নির্দলীয় রূপ তাকে নষ্ট করে পুরো আন্দোলনের ক্ষতি করেছে। সেই থেকে মঞ্চ আর প্রথম দিককার ভূমিকায় ফিরতে পারে নি।
এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলে ও সরকারে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করায় তাঁর নিজের দল ও সরকার সম্পূর্ণ তাঁর মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে। এর ফলে ধর্মান্ধ শক্তির বিরুদ্ধে মাঠ পর্যায়ে রাজনৈতিক প্রতিরোধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগ কার্যত সংগঠন হিসেবে স্থবির হয়ে পড়েছে অথবা তারাও ভাড়াটে বাহিনী দিয়ে লাঠিয়ালের কাজ করাচ্ছে।
একদিকে আওয়ামী লীগের স্থবিরতা আর অন্যদিকে বিএনপির অক্ষমতা মিলে রাজনৈতিক অঙ্গন প্রায় সারা বছর একপক্ষে জামায়াতি ক্যাডার ও ভাড়াটে মাস্তান এবং অন্যপক্ষে সরকারি বিভিন্ন বাহিনীর দখলে থাকল।
এরই চূড়ান্ত মহড়া আমরা দেখতে পেয়েছি আঠার দলীয় জোটের পূর্বঘোষিত মার্চ ফর ডেমোক্রেসির দিন। খালেদা জিয়ার আহ্বানে এ কর্মসূচী পরের দিনও প্রলম্বিত হল। কিন্তু এ থেকে যে বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে তাহল জামায়াতের কার্যকর ভূমিকা ছাড়া বিএনপির পক্ষে রাজপথ দখলে রেখে সরকারি দমনপীড়নের বাধা ডিঙিয়ে কিছু করা প্রায় অসম্ভব। সরকারি বাহিনী মাঠে সক্রিয় থাকলে মাস্তানরাও পিছিয়ে যায়। আর সরকারের সাথে আগেই বিভিন্ন স্থানে রীতিমত সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত হয়ে জামায়াত-শিবিরের শক্তিও এর মধ্যে অনেকাংশেই হ্রাস পেয়েছে। ফলে আপাতত বেগম জিয়াকে মূলত গণমাধ্যমের ওপর নির্ভর করে আন্দোলন জারি রাখতে হবে।
সামাজিক সূচকে নানান অগ্রগতি হলেও বিগত বছরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেক দুর্বলতা উন্মোচিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের মত দেশের সবচেয়ে প্রাচীন গণতান্ত্রিক দলকেও রাজনৈতিক বিরোধিতা সামলাতে সংগঠন ও রাজনৈতিক কর্মসূচির পরিবর্তে সরকারি বাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারের মতই প্রবল হিংসাত্মক বিরোধিতা ঠেকাতে শেখ হাসিনাকেও পিতার মত একই রকম অ্যাকশনের পুনরাবৃত্তি করতে গিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, প্রমাণ হতে চলেছে বিএনপির মত দল অনেকটাই পরগাছার মত। ব্যাপক সমর্থন থাকলেও দলে ত্যাগী ও সংগ্রামী স্থানীয় নেতা-কর্মীর অভাব রয়েছে। তৃতীয়ত, বোঝা যাচ্ছে নাগরিকসমাজ তাদের ভূমিকা নির্ধারণ করতে পারছে না, তাদের ভূমিকায় পূর্বাপর সামঞ্জস্য থাকছে না।
হয়ত একটু আগাম হবে বলা, তবে আলামতে মনে হচ্ছে, আগেকার মত ইসলামের দোহাই দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর দিন বোধহয় ফুরিয়ে এসেছে। হেফাজতে ইসলামসহ বিএনপি-জামায়াত জোট এ ধারায় ব্যাপক প্রচারণা চালানো সত্ত্বেও মনে হয় এ সমালোচনার আর সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্যতা নেই। আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, বঙ্গবন্ধুর সরকার সামরিক বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তা বাহিনীর আশানুরূপ সহায়তা-সমর্থন পায় নি, কিন্তু শেখ হাসিনা মনে হচ্ছে এ জায়গায় অনেকখানি এগিয়েছেন। ফলে জবরদস্তিমূলক ভোটারহীন প্রার্থীবিহীন সাজানো নির্বাচনের ব্যবস্থা করে এবং গণমাধ্যম, সুশীলসমাজ ও আন্তর্জাতিক মহলের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েও বিরোধী জোটের আন্দোলনের মুখোমুখি হয়ে নিজ অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছেন। আমরা দেখেছি বরং বিএনপি সমঝোতার স্বার্থে  নিজ অবস্থান থেকে অনেকখানি সরে এসেছিল। বস্তুত শেখ হাসিনা নির্বাচন ও গণতন্ত্রকে এখন ততটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না, তার বিবেচনায় এর আগের কাজ হল দেশকে হারানো লক্ষ্যাদর্শের পথে ফিরিয়ে আনা। তাঁর সাথে নাগরিকসমাজের দূরত্ব বেড়েছে। তবে প্রায় একক জেদ এবং দলীয় ও সরকারি মদতে তিনি যদি টিকে যান, সফল হন তবে এ দূরত্ব কমে যাবে বলেই তাঁর বিশ্বাস। তিনি নিজেকে রণাঙ্গণে মনে করছেন Ñ বুদ্ধিজীবীরা অনেককাল তাঁর সঙ্গে থেকে এখন হয়ত রণেভঙ্গ দিয়েছেন।
সম্ভবত আগামী বছরটি হবে আরও কঠিন এবং হয়ত আরও সংঘাতময়। গত একটি বছর রাজনৈতিক অঙ্গনে বস্তুত একক খেলোয়াড় ছিলেন শেখ হাসিনা, আগামী বছরটি তাঁর জন্যে আরও বড় চ্যালেঞ্জ নিয়েই আসছে। এবার তাঁকে ঝড় সামলাতে এবং সমাজের ভাঙনগুলো জোড়া লাগাতে হবে। কাজটা নিশ্চিতভাবেই কঠিন, কিন্তু তিনি তো জেনেশুনেই কঠিন পথে পা দিয়েছেন।

Monday, December 23, 2013

বেহাল দেশে হাল ধরতে হবে নাগরিকদেরই

আবুল মোমেন
 
বাংলাদেশের ইতিহাসে গভীরতম সংকটকাল শুরু হল মনে হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন গণহত্যা চলছিল তখনও মানুষ জানতো তার মূলধারা কোনটি এবং এও জানতো রাজনৈতিক অঙ্গনেও সেটি মূলধারা। স্বাধীনতার পর স্বৈরাচারের ও ধর্মান্ধতার নানা রূপ দেখেছে জাতি। কিন্তু বরাবর তার হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক মানবতার ধারা ও গণতন্ত্রের অভিযাত্রা মূলধারার রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করেছে। আজকে পরিস্থিতি ভিন্নরূপ নিয়েছে। গণতন্ত্র ও জাতির মানবিক বিকাশের পথে রাজনীতি থেকেই তিনটি বড় সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে হয়।
প্রথমত, বর্তমান নির্বাচন ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক আন্দোলনের ঠেলায় বিএনপি নিজের মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক দলের চেহারা ও অবস্থান হারিয়ে ফেলেছে। বরাবর দলটির একটি অংশের টান ছিল ধর্মান্ধ রাজনীতির প্রতি, সেই সূত্রে জামায়াত ও অন্যান্য পাকিস্তানপন্থী ও যুদ্ধাপরাধী দল এবং ব্যক্তির প্রতিও এ দলের সহমর্মিতা বোঝা যেত। ক্ষমতাসীন দল এবং নাগরিক সমাজের কিছু অংশ এবার বাগে পেয়ে বিএনপির ‘মুখোশ’ উন্মোচন করতে চেয়েছে এবং দলটি যে জামায়াতের দোসর তা প্রমাণের সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি। মুশকিল হল, সব জরিপ ও পূর্বাভাসে যে-কোনও পরিস্থিতিতে নির্বাচনে বিজয়ের প্রায় নিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও বিএনপি জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি পক্ষপাত ‘প্রমাণেই’ উৎসাহিত হল।
পরিস্থিতি আগে কখনও এমন হয়নি যে, বিএনপির ভিতরকার মধ্যপন্থি গণতান্ত্রিক শক্তি বিবদমান অবস্থার মধ্যে চরম কোন অবস্থানে না গিয়ে গণতন্ত্রের সমঝোতা সমন্বয়ের পথটি খোলা রাখার জন্য কাজ করবে না বা করতে চেষ্টা করতে পারবে না। সরকার এই ধাক্কায় বিএনপিকে ‘সাইজ’ করার কৌশল নিয়ে এ দলের মধ্যধারার নেতা-কর্মীদের প্রতিও চরমধারার ব্যক্তিদের মতোই আচরণ করেছে। এ অনেকটা একাত্তরের পাক-সরকারের মতো, দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে সব বাঙালিকে এককাতারে ফেলে দেওয়ার ত্রুটির পুনরাবৃত্তি ঘটল। মনে রাখতে হবে রাজনীতিতে জেদ-ক্ষোভের স্থান নেই, নীতি-আদর্শ-কর্মসূচি ছাড়া কৌশল-কূটকৌশলেরই মূল্য আছে। সময়োচিত কৌশলী পদক্ষেপ নিতে না পারলে ক্ষমতার রাজনীতিতে বড় বিয়োগান্তক পরিণতি ঠেকানো যায় না। এই হুঁশ সব পক্ষের থাকা দরকার।
দ্বিতীয় সংকটটি ঘটেছে আওয়ামী লীগকে ঘিরে। বাংলাদেশের রাজনীতির উত্থান-পতনের বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে এখন মাঠে সক্রিয় মূল দলগুলোর মধ্যে বিএনপি, জাপা বা জামায়াতের গায়ে বৈধ-অবৈধতার চিহ্ন এবং তাদের ঘিরে রাজনৈতিক বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। এদিক থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে একমাত্র ‘পরিচ্ছন্ন’ দল ছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু এবারে ২০১৪ সালের নির্বাচনটি করে স্বেচ্ছায় দলটি তার গায়ে কলঙ্ক মেখে নিতে যাচ্ছে। এ ঘটনা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি সংকট সৃষ্টি করবে বলে মনে হয়।
আমি কখনও সক্রিয় রাজনীতি না করলেও দেশের রাজনীতির একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে বরাবর মনে করে এসেছি যে, এদেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারাটি এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এ দলটি কেন্দ্রিয় ভূমিকা পালন করে এসেছে। সমাজে মুক্তচিন্তা ও মানবিক চেতনা লালনের যে ধারাগুলো আছে তা অনুশীলন ও বিকাশে এ দল কখনও প্রত্যক্ষ, কখনও পরোক্ষভাবে মূল ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু এবারে ‘বর্বর’ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে তার পঁচাত্তর পরবর্তী প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি ও জাপার অনুসরণে একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করল।
যে দলের মূল শক্তি ছিল সারা দেশে ছড়ানো তার স্থানীয় নেতা-কর্মীর সমন্বয়ে শক্তিশালী সক্রিয় সংগঠন; তা হয়ে পড়ল নেত্রীকেন্দ্রিক এ ক্ষমতাকেন্দ্রিক এক জড়ভরত প্রতিষ্ঠানে। ক্ষমতার ব্যবহার-অপব্যবহার ছাড়া নেতাকর্মীদের আর কিছু করণীয় থাকল না। যে সংগঠন আইয়ুব-ইয়াহিয়া এবং জিয়া-এরশাদ দুই আমলে দুই জোড়া সেনাশাসকের নির্যাতন-বঞ্চনা সামলে নিয়ে দল ও দেশকে এগিয়ে নিয়েছে মূলত দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা নেতাকর্মীদের সক্রিয়তা ও ত্যাগে সে সংগঠনে এখন এসবের কোনও দাম নেই, ভূমিকা নেই।
ফলে আওয়ামী লীগের সরকারও যে-কোনও স্বৈরাচারী সরকারের মতোই রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রতিপক্ষদের সামলানোর জন্যে সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে সরকারের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর। জানিনা সামরিক স্বৈরাচারদের মতো শেখ হাসিনাও আজ দলীয় নেতাকর্মী ও নীতিনির্ধারকদের সাক্ষীগোপাল বানিয়ে রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার জন্য গোয়েন্দাদের ওপরই নির্ভর করছেন কিনা।
তৃতীয় সংকট জামায়াত ও অন্যান্য ধর্মান্ধ দলগুলোকে নিয়ে তৈরি হয়েছে। মূলত মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার কারণে স্বাধীনতার পর সরকারি নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে এ দলগুলোকে রাজনীতির মাঠ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া এবং ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীদের ঠেকানোর লক্ষ্যে জিয়ার এদের উত্থান ও প্রতিষ্ঠায় সহায়তাদান, দুদিক থেকেই দূরদর্শী বিবেচনার প্রমাণ দেয়নি। কারণ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দমানো যায় কিন্তু নেতৃত্ব সচেতন না হলে এতে ধর্মান্ধতার (ধর্মবিশ্বাস নয়) বৃত্ত ভাঙার জন্য এ বিষয়ে সামাজিক আলোচনা ও সমঝোতার পথগুলো ব্যবহার করার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। ওই সময়ে নিষেধাজ্ঞার চেয়েও জরুরি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের শনাক্ত করা ও বিচারের আওতায় এনে বিষয়টি বকেয়া ফেলে না রেখে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা। আবার ক্ষমতার প্রশ্রয়ে এমন অন্ধ শক্তিকে একসময় বাড়তে দিলে পরে গণতন্ত্রের স্বার্থে তাকে সামলানোর পথও থাকে না।
ফলে জামায়াত এখন বিএনপির কাঁধে চেপেছে আর বিএনপির জামায়াতিকরণ সম্পন্ন করছে। তাছাড়া এদেশের সনাতন ইসলামি শিক্ষার যে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা ও স্থবিরতা চলছিল তার পরিণতি এবং তাদের মধ্যে অচলায়তন ও বিচ্ছিন্নতা থেকে বেরিয়ে আসার সচেতনতা ও তাগিদ সৃষ্টির বিষয়ে কোনও কাজ হয়নি। এর উপায় নিয়ে নিজেদের মধ্যেও কখনও ভাবনা-চিন্তা করা হয়নি। পাশাপাশি রয়েছে বৈশ্বিক পরিস্থিতির পরিবর্তন যা মুসলিম মৌলবাদ উত্থানের প্ররোচনা ও প্রণোদনা তৈরি করে চলেছে। এখানে সম্পদেরও সমাহার ঘটেছে, তাদের শক্তিবৃদ্ধিতে যা সহায়ক হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের মতো বিপুলভাবে মুসলিমপ্রধান একটি দেশে গণতন্ত্রের রাজনীতিকে কীভাবে চরমপন্থার চোরাবালিতে পথ হারাতে না দিয়ে, সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে না দিয়ে আগলে রাখা যায় সেটুকু ভাবার মতো দূরদর্শিতার খুবই প্রয়োজন ছিল। জামায়াত পাকিস্তানি যোগাযোগ ছিন্ন করে ও একাত্তরের ভুল স্বীকার করে বাংলাদেশের বাস্তবতানুযায়ী রাজনীতির রাজপথে আসার সুযোগ গ্রহণ করেনি- এর পেছনে বিএনপির একটা অংশের ভূমিকা থাকা অস্বাভাবিক নয়। এতে দলটির সংকট কাটেনি, যার প্রভাব পড়েছে দেশের রাজনীতিতে।
সংকট তিনটি ধারায় তৈরি হলেও যে-কোনও সংঘাত-সংঘর্ষের নিয়ামানুযায়ী তা রণাঙ্গনে আপাতত দ্বি-ধারায় বিভক্ত হয়েছে। উভয়পক্ষে চরম মতাবলম্বীরা এখনও ঘটনা প্রভাবিত করে চলেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সাধারণত লাগাম ক্রমেই হাতছাড়া হতে থাকে। এখানেও তাই ঘটছে। এ রকম পরিস্থিতি সাধারণ জনগণের জন্য দুটি বাস্তবতা তৈরি করে- একদিকে তাকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়, অন্যদিকে সে ক্রমেই তার জৈবিক তাড়নার বাইরে অন্যান্য আগ্রহ, বিশেষভাবে রাজনৈতিক উৎসাহ, হারিয়ে ফেলতে থাকে। তার ওপর দুই বড় দলের নেত্রীকেন্দ্রিক সংগঠনে হুকুমের রাজনীতির দাপটে জনগণের বিরাজনীতিকরণের ষোলোকলা পূর্ণ হতে চলেছে। জনগণ প্রচলিত রাজনীতিতে আস্থা ও উৎসাহ হারিয়ে ফেললে আমাদের পরিচিত তৃতীয় শক্তির আগমন সহজ হয়। অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, জনগণ প্রাথমিকভাবে অন্তত তাকে স্বাগতও জানাবে। কারণ তার এখন মোটামুটি ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা।
জনগণকে যখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব পথের দিশা দিতে পারে না, কোথাও মানুষের সৃজনশীল চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায় না তখন সম্ভবত সচেতন বিবেকবান ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নিজের ক্ষুদ্র অবস্থান থেকে হলেও শেষ রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যান। এরকমই একটি ডাক আমরা দেশের সব্যসাচী লেখক কবি সৈয়দ শামসুল হকের কাছ থেকে সম্প্রতি পেলাম। তিনি আকুতি জানিয়েছেন বিজয়ী বাংলাদেশকে রক্ষায় আমরা যেন এগিয়ে আসি। কবি সত্যদ্রষ্টা বটে, সমাজের আপামর মানুষের মধ্যেও এই কবিসত্তা বিরাজ করে। দুঃসময়ে নিজের সত্যবোধকে জাগ্রত করে সমাজের বিচ্ছিন্নতা ও বিবাদ ঘোচানো আজ তাই সবার জন্যে সবচেয়ে বড় কাজ। যারা বিবেকবান তারাই প্রকৃত ধার্মিক, তারাই সমাজে গণতান্ত্রিক আবহের শিখাটি সব ঝড়ঝাপ্টার মধ্যেও বাঁচিয়ে রাখেন। রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ- এরকমই একটি প্রয়াস। সমাজে নানা জায়গায় শুভবুদ্ধির মানুষ এরকম মুক্ত মানবিক মঞ্চ তৈরির কথা ভাবছেন, চেষ্টা করে চলেছেন। এবার যেন এই ফেনিল তরঙ্গ ঠেলে বাংলাদেশ-তরণীকে রক্ষা করা ও এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব সচেতন বিবেকবান মানুষকেই নিতে হবে। কারণ, যেসব লক্ষণ সমাজে ফুটে উঠছে তাতে বোঝা যায় প্রচলিত রাজনীতি আদতে অথৈ জলে হাল ধরতে পারছে না অথবা হাল ছেড়েই দিয়েছে। তাই দেশের এই বেহাল অবস্থা।
আসুন, মানবতার নামে, গণতন্ত্রের নামে, মুক্তিযুদ্ধের নামে আপনার মন্যুষ্যত্বের দায় থেকে ভূমিকা নিন, দেশপ্রেমের পরিচয় দিন, নাগরিক দায়িত্ব পালন করুন।

Saturday, December 14, 2013

ক্ষমতার বৃত্ত ভেঙে যাক, আদর্শ ও নীতির রাজনীতি মুক্তি পাক

আবুল মোমেন

বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা স্বাভাবিক নয় তা আমরা জানি। বর্তমানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও আমরা জানি সংকটের মূল উৎস রাজনীতি। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরেই এ অচলাবস্থা ও সংকট সৃষ্টি হলেও আমরা জানি বিরোধের মূলে একটি আদর্শিক-নৈতিক দ্বন্দ্ব রয়েছে।
অনেক দিন ধরেই দেশের নাগরিকসমাজ দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এক কাতারে রেখে দুটি ক্ষমতাপাগল দল হিসেবে চিহ্নিত করে যাচ্ছেন। বর্তমান সংকট ঘনীভূত হওয়ার পর এই বক্তব্য ও সমালোচনা আরও ব্যাপকভাবে ও তীব্রতার সঙ্গেই হচ্ছে। কিন্তু কথাটা অনেকাংশে সত্য হলেও দেখা যাচ্ছে দুই বড় দলের কেউই তাদের স্ব স্ব নীতি-আদর্শের জায়গা থেকে সরতে রাজি নয়। বস্তুত বর্তমানে আদর্শিক-নৈতিক অবস্থানে তাদের অটলতা আরও স্পষ্ট হচ্ছে।
আমরা জানি দুই দলের মধ্যে আদর্শিক ঝোঁক কার কোন দিকে। আদর্শিক অবস্থানের দৃঢ়তা এক ধরনের নৈতিক ভূমিকা ও অবস্থান তৈরি করে। আমাদের সময় সঠিকভাবেই মনে করছে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দলকে সমর্থন দিয়ে আজ বিএনপি নৈতিকভাবে পরাজিত হয়েছে। একটা বিষয় বাংলাদেশের কোনো নাগরিক অস্বীকার করতে পারবে না - তা হল মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমেই দেশ স্বাধীন হয়েছে, এটি হচ্ছে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এবং সর্বোপরি, বিষয়টিতে কোনো অতিরঞ্জন, বিকৃতি বা বিভ্রান্তির অবকাশ নেই। নিশ্চিত করেই বলা যায় তরুণ প্রজন্ম এই গৌরবের অংশীদার হতে চাইবে, চাইছে। এ কথাও মনে রাখতে হবে মুক্তিযুদ্ধকে কোনোভাবেই ইসলাম ধর্মের প্রতিপক্ষ হিসেবে খাড়া করা যাবে না। এ নিয়ে সাময়িক বিভ্রান্তি হতে পারে কারও, কেউ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সব ধর্ম-বর্ণ-জাতিকে গ্রহণ করার যে মানবিক ঔদার্যের প্রকাশ ঘটেছিল তাকে ইসলামের বিপরীতে দাঁড় করাতে চাইতে পারে। কিন্তু তাতে ইসলামের মূল শিক্ষা ও মহানুভবতার ঐতিহ্যকেই অস্বীকার করা হয়। যারা একাত্তরে ইসলাম ধর্মের নামে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তারা ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ ভুলে গিয়ে জালেমের আদর্শ নিয়েছিল ও তাদের সাথেই হাত মিলিয়েছিল।
আমরা বরং বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করব, যখন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকানো গেল না, যখন বাংলাদেশ একেবারেই বাস্তবতা, আর আজ বেয়াল্লিশ বছর পরেও সেই দেশ টিকে আছে ও সবাইকে বিস্মিত করে এগিয়ে চলেছে তখনও এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করা কি কোনো স্বাভাবিক, সৎ রাজনীতি হতে পারে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার রাজনীতি হওয়া তো দূরের কথা?
জামায়াতে ইসলামি পুনরুজ্জীবিত হয়েছে আজ তিন যুগ হতে চলল। ভাবা যায়, এতদিন ধরে তারা একইভাবে একাত্তর-পূর্ববর্তী ধারার রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে! পরিবর্তিত বাস্তবতায় একটি রাজনৈতিক দলকে যে তার কৌশল ও অবস্থান পরিবর্তন করতে হয় তা তাদের নেতৃত্ব কেন ভাবে নি সেটা সত্যিই বিস্ময়কর ব্যাপার। তারা বরাবর ইসলামি বিপ্লবের কথা বলে এসেছে, অথচ ইসলামের ইতিহাসে আমাদের নবী এবং পরবর্তী সফল খলিফাদের জীবনেই আমরা দেখি প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয়, যাতে কৌশল হিসেবে কখনও তাঁরা ইহুদিদের সাথে কখনও খ্রিস্টানদের সাথেও সখ্য করেছেন, তাদের সহায়তা নিয়েছেন, সহায়তা দিয়েছেন। কখন জেহাদি ভূমিকা নিতে হবে কখন সম্প্রীতির পথে চলতে হবে তা যে নেতৃত্ব উপলব্ধি করতে পারে না সে তো অন্ধ ও স্থবির নেতৃত্ব। নতুন কৌশল হিসেবে জামায়াত জোর দিয়েছে দল ও দলীয় ব্যক্তিবর্গের আর্থিক ভিত্তি দৃঢ় করার ওপর। তারা ব্যাংক-বীমা-এনজিও ও অন্যান্য আর্থিক কর্মসূচীর মাধ্যমে নির্ভরশীল সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি ও তার পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। যতদূর বোঝা যায় বরাবর ধর্ম বিপন্ন এই ধুয়া তুলে আর ধর্মীয় বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিয়ে তারা তরুণ ও সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছে। এ কাজে তারা সবসময় আওয়ামী লীগ এবং দেশের বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন, যারা অধিকাংশই ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান। এভাবে একদেশদর্শী ভূমিকা নেওয়ায় ইসলামের সাম্য ও উদার মানবতার নীতি ও বাণী তাদের হাতে বারবার দলিত উপেক্ষিত হয়েছে।
ফলে বাস্তবতা হল এই - জামায়াত একদিকে জাতির গৌরবময় ইতিহাসের ও অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিপক্ষে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করতে চাইছে। বলা যায়, জাতির ইতিহাস ও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তাদের প্রতিপক্ষ আজ। তাতে বিপ্লবের নামে বাস্তবে তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে ধ্বংসাত্মক নাশকতামূলক কাজকর্মের ওপর। এভাবে কোনো রাজনীতিকেই এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।
দেশে ও প্রতিবেশী দেশে এরকম ভ্রান্ত বিপ্লবী রাজনীতির করুণ পরিণতি আমরা দেখেছি। স্বাধীনতার পরপর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বিপ্লবী স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করে জাসদ দেশের তরুণ মেধাবী এক প্রজন্মের বিশাল ক্ষতি করেছে, সত্তরের দশকের গোড়ায় পশ্চিম বঙ্গের নকশাল আন্দোলনে একইভাবে মেধাবী তারুণ্যের বিপুল অপচয় ঘটেছে। জামায়াত-শিবির গত তিন দশকে অনেক মেধাবী তরুণকে একইভাবে ইসলামী বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিয়ে ভ্রান্ত রাজনীতির কুহকে বিপ্লবের কানাগলিতে রুদ্ধ করে ফেলেছে।
জামায়াতকে আজ নিজেদের রাজনীতি নিয়ে মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে আত্মসমালোচনার পথে যেতে হবে, অতীতের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। রক্তরঞ্জিত হাত নিয়ে গণতন্ত্রের রাজনীতি চলতে পারে না, ইসলামি রাজনীতিও নয়! জামায়াত ভুল পথে চলছে তাতো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। বিএনপি? যত দোষই সুশীলসমাজ দিক না কেন, শেখ হাসিনার জেদ বলুন, গোঁয়ার্তুমি বলুন তা কিন্তু তার দলকে নিছক ক্ষমতার বৃত্ত থেকে বর্তমানে এক আদর্শিক লড়াইয়ের ময়দানে হাজির করে নিয়ে এসেছে। অল্প কয়েকটি সমমনা প্রগতিশীল দল ব্যতীত অন্যরা তাঁকে একা ঠেলে দিয়েছে এই লড়াইয়ে। বঙ্গবন্ধু কন্যা তাতে দমেন নি, ভয় পান নি, হয়ত মাঝে মাঝে দুঃখকষ্ট রাগ সামলাতে পারেন নি, এ কঠিন সময়ে তাঁর পাশে যাদের থাকার কথা ছিল তাদের বিরুদ্ধতায় ক্ষুব্ধ-বিষোদ্গার করেছেন বটে, কিন্তু লড়াইটা জারি রেখে তিনি আদর্শকে নৈতিক অবস্থানে নিয়ে যেতে পেরেছেন। ফলে সম-আদর্শে বিশ্বাসী  যারা এ লড়াইয়ে দূরে থাকছেন তাঁরা কিন্তু ইতিহাসের কাছে নৈতিকভাবে দায়ি থাকবেন। এটাও মনে রাখতে হবে লড়াইয়ের মূল রণক্ষেত্র অর্থাৎ যেখানে মূল প্রতিপক্ষ রয়েছে তা বাদ দিয়ে আলাদা ফ্রন্টে থাকা বা ভিন্ন তৎপরতা কখনও সৌখিনতার মাত্রা ছাপিয়ে যেতে পারবে না। আর যাই হোক আজকে বামপন্থার কিংবা বুদ্ধিজীবীদের সৌখিনতার পরিণতি দেশ ও জাতির জন্যে মঙ্গলজনক হবে না। মঙ্গল হবে না বিএনপির নৈতিক পরাজয়ের অবস্থানে একগুঁয়েমি করে যাওয়াটা। তাতে মানুষের দুঃখকষ্ট শুধু বাড়বে। আমরা জানি মানুষের দুঃখকষ্ট সহ্য করার একটা মাত্রা থাকে। মাত্রা ছাড়া দুঃখকষ্ট জাতির ওপর চাপিয়ে দিতে পারলে অনেকসময় সমাজে যে প্রবল চাপ তৈরি হয় তাতে শুভশক্তিকেও পিছু হটতে হয়। কিন্তু সেটা কখনও জাতির জন্যে কল্যাণকর হয় না, কারণ তাতে ইতিহাসের পশ্চাদযাত্রা প্রায় অবধারিত হয়ে পড়ে।
জামায়াতের মতই বিএনপিকেও ভাবতে হবে, ভাবতে হবে তার প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের রাজনীতির থেকে স্বতন্ত্র, সম্ভব হলে আরও অগ্রসর, রাজনীতি তারা কী দিতে পারে জাতিকে। কিন্তু একাত্তর-পূর্ববর্তী রাজনৈতিক ধ্যানধারণা নিয়ে বেগম জিয়া দলকে জামায়াতের সহযোগীতেই পরিণত করবেন। নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক রাজনীতির ওপর নির্ভর করে বিএনপির কোনো তাৎক্ষণিক লাভ যদি হয়ও, সুদূরপ্রসারী ক্ষতি হবে অনেক বেশি। কারণ নৈতিক পরাজয়ের পর একটি দলের সৎ রাজনৈতিক কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা থাকে না। তখন তাদের ছাপিয়ে দলে ভাড়াটে মাস্তান ও কর্মীরা জায়গা দখল করে নেবে। সেটা আখেরে ক্ষতিকর হবে। দেশের সুশীলসমাজের কাছেও আবেদন প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়ানোর প্রয়োজন নেই তাঁদের। কিন্তু টকশো-কলাম-মানববন্ধনে তাঁরা যেন জাতির ভবিষ্যত মাথায় রেখে কথা বলেন, ইতিহাসের  প্রেক্ষাপট মনে রেখে সঙ্গতিপূর্ণ অবস্থান নেন এবং বর্তমান সংকটের আদর্শিক ও নৈতিক দিকটি বুঝেই নিজেদের ভূমিকা নির্ধারণ করেন।





Monday, December 9, 2013

আর কত অশ্বডিম্ব চাইব

আবুল মোমেন

একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষে জাতিসঙ্ঘের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো এখনও ঢাকায় অবস্থান করছেন। প্রতিদিন দফায় দফায় তিনি নানা জনের সাথে বসছেন। তাঁর মিশনের লক্ষ্য একটিই - বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান। ধরে নেওয়া হচ্ছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যোগ না দিলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। কথাটা বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষও বিশ্বাস করেন বলে মনে হয়। কথাটা অসত্য নয় যে দেশের একটি প্রধান দলকে বাদ দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
কিন্তু এখানে আরও দুটি কথা থেকে যায় - প্রথমত, বিএনপি একা নেই আর, যে ১৮ দল নিয়ে বিএনপি জোট করেছে তার প্রধান শরিক দল হল জামায়াতে ইসলামি, যারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত। এযাবৎ বিএনপি স্পষ্ট করে নি তারা নির্বাচনে জামায়াতকে বাদ দিয়ে নতুনভাবে জোট সাজাবে কিনা। জামায়াত অবশ্য দল হিসেবে নিষিদ্ধ না হলেও নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। আর এর মধ্যে চূড়ান্ত রায় হয়ে যাচ্ছে তাদের অনেক নেতার। এ বাস্তবতায় জামায়াত মাঠপর্যায়ে সহিংসতা ছড়িয়ে দিলে বিএনপি কি তা মেনে নেবে? তাছাড়া বিএনপিরও দুই নেতা এ অপরাধের মামলায় শাস্তি পেয়েছেন। তাঁদের ব্যাপারে দলের অবস্থান পরিষ্কার নয়। দ্বিতীয় যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হল বর্তমানে দুই বড় জোটের পক্ষে একমত হয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন আর সম্ভব নয়। এর মধ্যে তাদের পারস্পরিক অনাস্থা ও বিদ্বেষ সর্বকালের সর্বোচ্চ অবস্থায় আছে এখন। দু’দল যেভাবে স্ব স্ব অবস্থানে অনড় রয়েছেন তাতে এ বিষয়েও তাঁরা চুল পরিমাণ সরবেন এমন ভরসা আমরা পাচ্ছি না।
এর পরেও কথা থেকে যায়, ১৯৯১ থেকে এ পর্যন্ত অন্তত তিনটি নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা তেমন হয় নি। ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০৮-এর নির্বাচন। কিন্তু সেসব নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হওয়া সত্ত্বেও কি ঐ তিন মেয়াদে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে সচল ছিল? আমরা বরাবর দেখে আসছি দুই দলের মধ্যে যখন যে দল পরাজিত হয়ে সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসেছেন তাঁরা সরকারি দলের কাছে থেকে যথাযথ সম্মান ও ভূমিকা পালনের সুযোগ পান নি। বিজয়ের দখলে সব - এই হচ্ছে আমাদের নীতি। এর ফলে বিরোধী দলের কাজ ছিল যে কোন মূল্যে সরকারকে অকার্যকর করা। সংসদ বর্জন, সংসদকে অপ্রয়োজনীয় কিন্তু অশালীন বিতর্কে জড়ানো। আর রাজপথে চলেছে আন্দোলনের নামে নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ড যা নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে চলতে ক্রমান্বয়ে সহিংস হয়ে উঠেছে। এভাবে উভয় পক্ষে রাজনীতি থেকে নীতিবাদী ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষরা বাদ পড়েছেন আর গুরুত্ব পেয়েছেন কালোটাকার মালিক ও সহিংসতা-নাশকতায় দক্ষ নেতা-কর্মী এবং ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা। এভাবে রাজনীতির সাথে দিনে দিনে নানামাত্রায় সহিংসতার যোগ ঘটে গেছে।
ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই যদি আমরা একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশের নিশ্চয়তা পেতাম তাহলেই এই দরকষাকষি ও দেনদরবার সত্যিকারভাবে সফল হতে পারত। নিরপেক্ষ মানুষ বরং বলতে চাইবে গত প্রায় বাইশ বছরের গণতান্ত্রিক আমলের রাজনীতি বেশি হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক হয়ে পড়েছে।
আমাদের রাজনীতি যেসব ব্যাধিতে ভুগছে তার নিদান তো নির্বাচনে নেই। নির্বাচন এর একটি ঔষধ হতে পারে, কিন্তু এটি ধন্বন্তরি নয় যে এক ওষুধে রোগ সারবে। রোগ সম্পূর্ণ নিরাময়ের জন্যে আরও ঔষধ লাগবে।
আসল রোগ তো বাংলাদেশের রাজনীতির আদর্শিক ভিত্তি কী হবে বা কোন কোন বিষয় সবার জন্যে একই থাকবে তা ঠিক করা। একাজ আরব্ধ রেখে ঘুরপথে ক্ষমতা দখল করা যায় কিন্তু পদে পদে পা হড়কাবেই। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে আমাদের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক নীতি-আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রতিফলন থাকতে হবে। সাংসদদের ভূমিকাও ঠিক করতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, জনপ্রশাসনকে চাকুরিবিধির আওতায় দক্ষতার মূল্যায়নে পরিচালনা এবং স্থানীয় সরকার, দুর্নীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতায়ন  ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হলে কেবল সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে হবে না। এ সময়ে বরং নাগরিক সমাজের উচিত হবে আমরা যেমন দেশ চাই তার একটি চার্টার তৈরি করে দুই দলের সাথে আলোচনা শুরু করা। দু’দলকেই সংশোধনের জন্যে ও করণীয় সম্পর্কে বলার কথা অনেক আছে। সেই প্রক্রিয়াই বরং তাদের উভয়ের জন্যে একটি সমতার ভূমি তৈরি করবে। প্রয়োজনীয় সকল আইন ও বিধি সংস্কার সম্পর্কে আইনের সুপারিশ তৈরি করা দরকার।
যেসব বাধার কারণে আমাদের সংসদ ও গণতন্ত্র অচল হয়ে পড়ে, আমাদের রাজনীতি দুর্নীতিগ্রস্ত ও হিংসাত্মক হয়ে ওঠে, আমাদের দুর্নীতি দমন ও নির্বাচন কমিশন দুর্বল হয়ে যায়, স্থানীয় সরকার ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে যায় তা দূর করতে হবে।
বড় দুই দল নির্বাচন নিয়ে পরস্পর বিরোধী অনড় অবস্থানে থাকলেও কিন্তু ওপরের বিষয়গুলোতে অনড়ভাবে এক থাকেন। তাঁদের এই অনড় সহাবস্থান দেশের জনগণ, গণতন্ত্র, রাজনীতি সব কিছুর জন্যই ক্ষতিকর। যদি নাগরিক সমাজ সত্যিই দেশের জন্যে দীর্ঘমেয়াদী টেকসই কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থান সন্ধান করেন তো তাঁদের সকল প্রয়াস কেবল সুষ্ঠু নির্বাচনে সীমাবদ্ধ রাখা ঠিক হবে না। তাতে সমস্যার একটি যেনতেন সমাধানমাত্র হতে পারে। তাতে আমাদের খুব বেশি উপকার হবে না। লাভ হতে পারে বড় দুই দলের কোনো একটির, যারা জয়ী হবে। হাতে সময় কম। এবারের নির্বাচন না হয় যেনতেন প্রকারের সুষ্ঠু নির্বাচনের অশ্বডিম্ব হোক। হয়ে যাক এবার। কিন্তু এবার দুই বড় দল যখন চাপে আছে, এবং আন্তর্জাতিক মহলও সক্রিয় তখনই মূল বিষয়ে আলোচনা শুরু করা দরকার। কেননা আর কত অশ্বডিম্ব প্রসব করবে ‘সুষ্ঠু নির্বাচন’। আমরা ফলপ্রসূ তাৎপর্যপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা চাই। সেটার জন্যে জনগণকে সজাগ এবং সক্রিয় করতে হবে।