Saturday, July 26, 2014

মধ্যপ্রাচ্যের অভিজ্ঞতা আমাদের কী শিক্ষা দেয়

আবুল মোমেন

পশ্চিমের গণমাধ্যম মালয়েশিয়ান যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করার ট্রাজেডি যে গুরুত্ব পেয়েছে তা গাজায় ইজরায়েলের নরমেধযজ্ঞকে ছাপিয়ে গেছে। একইভাবে জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন ফোরামে ও অন্যান্য কূটনৈতিক তৎপরতাতেও এ ইস্যুটিাই এখন প্রাধান্য পাচ্ছে।
বিমান ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা অবশ্যই মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। আর বিমান ভূপাতিত করার ঘটনা একটি নিকৃষ্ট ধরনের অপরাধ। অবশ্যই এ ট্র্যাজেডির সুষ্ঠু স্বচ্ছ তদন্ত হওয়া উচিত এবং দোষী ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করে শাস্তি দেওয়া সবারই দাবি।
গাজায় ইজরায়েলের সর্বাত্মক আক্রমণ বস্তুত ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে গণহত্যার ঘটনা। শুধু নিহত ও আহতের সংখ্যা এবং ও সম্পদ ধ্বংসের দিক থেকে এ বর্বর আক্রমণ বিমান দুর্ঘটনার চেয়ে আকারে অনেক বড়। মৃতের সংখ্যা পাঁচশ ছাড়িয়ে গেছে, আহত দুই হাজারের ওপরে। সবচেয়ে বড় কথা মারা যাচ্ছে বেসামরিক মানুষ, যার অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু। এটি কোনো যুদ্ধ নয়, হামাসের রকেট হামলা বা সামান্য প্রতিরোধ বানের জলে খড়কুটোমাত্র। এটি একতরফা গণহত্যার ঘটনা। এ শতাব্দীর এযাবৎ সবচেয় বড় ট্র্যাজেডি ঘটে চলেছে বিশ্ববাসীর সামনে। নিহতদের সকলেই মুসলমান, এখন রমজান মাস চলছে, সামনে ঈদ।
মালয়েশিয়ার যাত্রীবাহী বিমান ট্র্যাজেডি নিয়ে পশ্চিমের এত গরজের মূল কারণ এ ঘটনায় তারা প্রতিপক্ষ রাশিয়ার দিকে আঙুল তাক করতে পারছে। ক্রিমিয়া দখলের অজুহাতে তারা একজোট হয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কিছু বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা চালাচ্ছে। তাতে অবশ্য পুতিনকে নরম করা যায় নি। এবারে ঘোলাটে পরিস্থিতির মধ্যে ইউক্রেনের বিদ্রোহী রুশপন্থীদের সমর্থন দানের অজুহাতে রাশিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি ঘোলাটে নয়। একেবারে কাঁচের মত স্বচ্ছ। ইজরায়েল কোনো রকম রাখঢাক করছে না, তারা ঘোষণা দিয়েই হামাস-দমনের নামে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রে হানা দিয়েছে, ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। খুনী কে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা চুপ।
তারা কেন চুপ সে ইতিহাস অবিদিত নয়। কেন কৃত্রিমভাবে মধ্যপ্রাচ্যে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হল, কারা করল তা সবার জানা আছে। ১৯২২ সনে বেলফুর ঘোষণার মাধ্যমে এই নবযাত্রা শুরু। ১৯৪৬ সনে প্যালেস্টাইন থেকে আরব মুসলমানদের উৎখাত করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিজয়ী ব্রিটেন-ফ্রান্স-যুক্তরাষ্ট্র যেন যুদ্ধে নাৎসি অনাচার-অবিচারের ক্ষতিপূরণ হিসেবে এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দিল। আদতে ইহুদিবাদীদের এ পৃথক ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বহু পুরোনো। ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখন হ্রাস পাচ্ছিল তখন তারা সর্বত্র কৌশলগত সুবিধা কায়েমের প্রয়াস চালিয়েছে। উপমহাদেশে পাকিস্তান সৃষ্টি ও কাশ্মীর সমস্যা তৈরি যেমন তেমনি প্রত্যক্ষভাবে শাসকের হাত গুটানোর আগে মধ্যপ্রাচ্যে তৈরি করল ইজরায়েল রাষ্ট্র। রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ সারা বিশ্ব থেকে ইহুদিরা এসে বসতি করেছে এই জবরদস্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে। ১৯৪৮ সালের আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ থেকে নিয়ে আজকের দিন পর্যন্ত ইতিহাস বিচার করলে দেখা যাবে প্রতিবারের যুদ্ধে ইজরায়েল তার ভূসীমানা বাড়িয়েছে। ইহুদি বসতি বাড়িয়ে যাওয়াই তার লক্ষ্য। এবারে যুদ্ধ শেষ হলে হয়ত পশ্চিম তীরে কিছু জমি দখলে রাখবে তারা।
ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্ররা যখন মানবাধিকার বা আইনের শাসনের কথা বলে, যখন আমাদের এ বিষয়ে নানা উপদেশ দিতে চায় তখন এর ভণ্ডামির দিকটাও যেন আমরা খেয়াল রাখি। এসব যে নিতান্ত ফাঁকা বুলি, তাদের দ্বৈতনীতি ও দ্বৈত মানদণ্ডের প্রমাণ তা-ও আমাদের বুঝতে হবে। আমরা নিশ্চয় দেশে সবার মানবাধিকারের সুরক্ষা চাইব, আমরা অবশ্যই দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকুক এমনটাই চাই। কিন্তু তা নিজেদের তাগিদে, নিজেদের বিবেক বোধ থেকেই চাইব। কারও শেখানো বুলি হিসেবে নয়, তাদের মুখপাত্র হয়ে নয়। বিশেষ ভাবে আমরা অবশ্যই পশ্চিমা দেশ বা তাদের সংস্থাগুলোকে সাক্ষী মেনে নিজের দেশের সমস্যা সমাধান করতে যাব না। তাদের ভণ্ডামি, মিথ্যাচার, দ্বিবাচার আজ আর গোপন কিছু নয়।
কথা হল, মুসলিম দেশগুলোর সাথে পশ্চিমা বিশ্ব এভাবে মুরুব্বিয়ানা করে চলেছে কীভাবে কেনই বা তারা বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ একাজ অপ্রতিহতভাবে করতে পারছে? না, এটা কোনো মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন নয়। এর উত্তরও সবার জানা।
মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে মুসলিম বিশ্বের মুরুব্বী দেশ সৌদি আরব। আর সৌদি আরবের নেতৃত্বে সেখানকার সকল তেলসমৃদ্ধ দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের কাছে আত্মবিক্রিত হয়ে আছে। ওআইসি বা আরব লীগের শক্তিশালী সদস্য হচ্ছে সৌদি আরব। এসব আরবদেশের শাসক সম্প্রদায় তেলের সম্পদে অচিন্ত্যনীয় বিলাসী জীবন যাপনে অভ্যস্ত। আর ওদের সকল তেলখনি মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক কোম্পানির অধীনে পরিচালিত। তাদের উপার্জিত অর্থ বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বে লগ্নি খাটার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। অর্থাৎ একদিকে তেলের উৎস দেশগুলোকে কমিশন দিয়ে বিপুল উপার্জন করছে তারা আর অন্যদিকে উৎস দেশসমূহের অর্জিত কমিশনের টাকার সিংহভাগ থাকছে তাদের মালিকানাধীন ব্যাংকে বা খাটছে তাদের দেশসমূহে অন্যান্য ব্যবসায়িক খাতে। এই মহালাভের স্বর্গসুখ কোনো বোকাও সহজে ছাড়তে যাবে না। আর এখনও পর্যন্ত গোত্রবিভক্ত অনাধুনিক আম আরব জনগণ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মাথা তুলতে পারে নি। তাদের ওপর স্বৈরাচারী বাদশাহী শাসন চলছে, ইসলামের নামে সকল রকম গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকার হরণ করা হয়েছে সেসব দেশে। শাসককুলকে বিভোর করে রাখা হয়েছে ভোগবিলাসের আনন্দে, যেমন একসময় সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন চীনাদের বুঁদ করে রেখেছিল আফিমের নেশায়।
কেন পশ্চিমারা ইরাকের শাসক সাদ্দাম হোসেনের ওপর এত খাপপা ছিল, এত খড়্গ হস্ত হল? তাও অবশ্য কারো অজানা থাকার কথা নয়। আরব অঞ্চলে সাদ্দাম ছিলেন অন্যান্য শাসকদের থেকে পৃথক। তিনিও স্বৈরাচারী ছিলেন, কিন্তু ছিলেন জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তি, তিনি তাঁর দেশের তেলখনির ওপর অধিকার বাড়াচ্ছিলেন, তেল ব্যবসা স্বাধীনভাবে চালাচ্ছিলেন। ফলে তাঁকে নিয়ে মুরুব্বীদের সমস্যা। আরেক সমস্যা হল ভূতাত্ত্বিক জরীপে দেখা যাচ্ছে ইরাকে আরও প্রচুর তেল ও গ্যাস মওজুদ রয়েছে। এরকম একটি ‘সোনার’ খনি এরকম একজন ‘বেয়াড়া’ লোকের হাতে ছেড়ে দিতে চায় নি পশ্চিমের কার্পোরেট মুরুব্বীরা। তাদের হয়েই দেশ শাসন করেন ওবামা-বুশরা, ব্লেয়ার-ক্যামেরুনরা। ফলে তাদের চাপ এবং নিজেদের গরজ কাজ করেছে একযোগে। মনে করুন ১৯৫৩ সনে ইরানের ঘটনা। সেদেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ড. মোসাদ্দেক সরকার যে-ই তেলখনি জাতীয়করণ করল অমনি একটা অজুহাত খাড়া করে আক্রমণ চালাল ব্রিটেন। সরকারের পতন ঘটাল এবং দ্রুত শাহের মাধ্যমে পশ্চিমের শিখণ্ডি সরকার বসানো হয়েছিল।
তাই মনে রাখতে হবে পুঁজিবাদী বিশ্বের আলাদা কোনো রাজনীতি নেই। অর্থনৈতিক স্বার্থের দ্বারাই তাদের রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। এমনকী গণতন্ত্র, আইনের শাসন বা মানবাধিকারের মত ইস্যুগুলো নিছক রাজনৈতিক ছলমাত্র। নতুবা তারা কেন গণতন্ত্রহীনতা, আইনের শাসনের অভাব বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ইরাকে আক্রমণ চালাল আর গণতন্ত্রের সামান্যতম নমুনাও যেসব দেশে নেই সেই সৌদি আরবের সরকারকে চাপে রাখে না, হুঁশিয়ার করে না? তারা যে অজুহাতে ইরাকে আক্রমণ চালিয়েছে, কার্যত ইরাক ধ্বংস করেছে, সেই সব অজুহাত অনেক বেশি খাটে সৌদি আরব, কুয়েত, আবুধাবির মত দেশের ক্ষেত্রে।
ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ইজরায়েলের ভূমিকা কেমন তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ধর্মের জঙ্গিরূপ ধারণ কীরকম আত্মঘাতী ফলাফল আনে তা-ও দেখছি হামাসের ভূমিকা ও তার পরিণাম দেখে। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার কী ধরনের পরিণতি সৃষ্টি করে তাও দেখছি সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কট্টর ইসলামি দেশগুলোর ভূমিকায়। আমাদের দেশেও ধর্মান্ধদের হাতে মানবতার লাঞ্ছনা যেমন দেখেছি তেমনি দেখেছি প্রকারান্তরে তা কীভাবে ধর্মের বাণী ও শিক্ষার পরিপন্থী ভূমিকা রাখে। আমরা দেখছি ধর্মীয় ও সম্প্রদায়ভিত্তিক সংস্থা ওআইসি বা আরব লীগও চরম সংকটের সময়ও কেমন অকার্যকর হয়ে থাকে।
এ অবস্থায় প্রয়োজন অতীতের জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনের মত মূলত তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের মহাজোট। ষাট-সত্তরের দশকে এ জোট যখন সক্রিয় ছিল তখন বিশ্বের রাজনৈতিক হালচাল তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল, তখনই এশিয়া-আফ্রিকা থেকে সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শাসনের চূড়ান্ত অবসান হয়েছে, গণমানুষের মুক্তির লক্ষ্যে কাজ হয়েছে। তখনই যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে জোরালো এবং কার্যকর প্রতিবাদ হয়েছে - সে কিউবা সংকট হোক আর আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ হোক। সেদিন প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্ব নয় বিশ্ব রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের নায়ক ছিলেন নেহেরু-নাসের-নক্রুমা-টিটোর মত তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রনায়করা। আজ আবার সেই রকমের বিশ্ব ফোরাম দরকার। সেই ফোরাম তার নেতাও তৈরি করে নেবে। তবেই তথাকথিত মুক্তবিশ্বের অন্যদের অবরুদ্ধ করার অন্যায়ের, ছলনার, ধাপ্পাবাজির রাজনীতিকে অকার্যকর করা যাবে। ইজরায়েলের মত  ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের ধৃষ্টতাও বন্ধ করা সম্ভব হবে।



Wednesday, July 9, 2014

পার্বত্য চট্টগ্রাম: শান্তির সন্ধানে

আবুল মোমেন

ব্রিটিশ শাসকরা ১৮৬১ সনে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ এলাকা ঘোষণা করেছিল। বিশেষ এলাকা দুটি কারণে -১. এর বৈচিত্রপূর্ণ প্রকৃতি যেখানে পাহাড় আর অরণ্য রয়েছে জীববৈচিত্রের ভাণ্ডার হিসেবে এবং ২. জনবৈচিত্র যা ১১টি উপজাতির স্ব-স্ব সাংস্কৃতিক বৈচিত্র নিয়ে বিশিষ্ট। এই জনগণ মূলত অরণ্যচারী এবং মূলধারার নাগরিক সংস্কৃতির বাইরে নিজ নিজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বহন করে নিভৃত জীবনে অভ্যস্ত। এদের জীবনাচার ও সংস্কৃতি সমভূমির কৃষিসমাজের পূর্ববর্তী কালের। সে অর্থে তুলনামূলকভাবে প্রাচীন কিংবা আদিম। এর মধ্যে আকস্মিকভাবে এবং গুণগতভাবে যদি ভিন্ন জীবনাচারে অভ্যস্ত মানুষজনের ব্যাপক আনাগোনা ও বসবাস শুরু হয় তাহলে দুই কালিক সংস্কৃতি, যা প্রায় মৌলিকভাবেই বিপরীত, তার মধ্যে সংঘাত দেখা দেবে।
এই মৌলিক বৈপরীত্য সম্পর্কে দুটি কথা বলা যায়। সমভূমির মানুষের কৃষিসমাজ গড়ে উঠেছে বন কেটে আবাদ করার নীতির ভিত্তিতে। কেবল বন কাটা নয়, কৃষিসমাজের মানুষের লক্ষ্য থাকে যে কোনা জমিকে -তা বন হোক, নতুন জাগা চর হোক কি এবড়োথেবড়ো পতিত জমি হোক সেগুলোকে আবাদযোগ্য করে তোলা। বিপরীতে পাহাড়ী অরণ্যে বসবাসকারী ক্ষুদ্রজাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা প্রকৃতির সাথে সহবাসে অভ্যস্ত, একে মৌলিকভাবে পাল্টাতে তারা নারাজ। ফলে এদের হাতে বন-সম্পদ যুগ যুগ ধরে রক্ষা পেয়ে এসেছে। অনেকেই মনে করেন জুম চাষে পাহাড়ে যে আগুন দেওয়া হয় তাতে বনসম্পদ নষ্ট হয়। আসলে অরণ্যাচারী জনগোষ্ঠী বরাবরই প্রাকৃতিক সম্পদের তুলনায় সংখ্যায় অল্প থাকে, ফলে তাদের এ ঐতিহ্যবাহী চাষপদ্ধতি প্রয়োজনীয় ফসল ফলানোর পাশাপাশি বনভূমিকে উর্বর করার পদ্ধতিও বটে। তাই শত বছরের ইতিহাস থেকে দেখা যায় এ অঞ্চলে কৃষিসমাজের বাঙালির ব্যাপক আবাসনের আগে বনভূমি বিনষ্ট হওয়ার রেকর্ড নেই। বন ও প্রাকৃতিক সম্পদ বাঁচিয়ে জীবনধারনের এ তাদের সহজাত শিক্ষা। কিন্তু কৃষিজীবী মানুষ বনকে আপদ মনে করে আর সবধরনের পশুকেই হিং¯্র ও বিপজ্জনক ভাবে। ফলে দুটিরই বিনাস তার সহজাত অভ্যাস।
দ্বিতীয় বৈপরীত্যের বিষয়টিও মৌলিক। অরণ্যবাসীর জীবনে ও মননে প্রকৃতিই সবকিছুর আধার ও নিয়ন্তা। ফলে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি তার মনোভাব ভক্ত বিশ্বাসীর এবং এর পূজা করেই সে শান্তি পায়। তৌহিদি ধর্মের মানুষের মানস এর বিপরীত। ফলে বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক উভয় সংস্কারেই বৈপরীত্য বিদ্যমান।
এই বৈপরীত্যের কারণে প্রাকৃতিক সম্পদের গুরুত্ব এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্ব বিবেচনায় নিলে কেবল পার্বত্য জেলা নয় অন্যান্য সমভূমির বনাঞ্চল বা স্বকীয় প্রাকৃতিক পরিবেশে অভ্যস্ত সকল ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবনব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ ঘটানোর মত যেকোনো কাজের আগে দশবার ভাবা দরকার। এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল নিয়ে ভাবতে হবে বিশেষভাবে।
২.
আমরা কিছুতেই অস্বীকার করতে পারব না যে বাংলাদেশ কেবল একটি জনবহুল দেশই নয়, এখানে ভূমির তুলনায় জনসংখ্যার চাপ অনেক বেশি। সে কারণেই কৃষিভিত্তিক দেশ হিসেবে এদেশে খাদ্যাভাব ও দারিদ্র লেগেই ছিল। আধুনিক প্রযুক্তি ও  উপকরণের ব্যবহার বাড়িয়ে খাদ্যাভাব দূর করা গেছে, কিন্তু দারিদ্র্য এখনও আমাদের বড় সমস্যা। অর্থনীতি ও মানুষের পেশায় পরিবর্তন ঘটছে। শ্রমজীবী মানুষ বিদেশে যাচ্ছে, প্রান্তিক নারীরা দলে দলে তৈরি পোশাক শিল্পসহ নানা কাজে যুক্ত হচ্ছেন। শিক্ষার হার বাড়ছে,স্বাস্থ্য সচেতনতা ও সুযোগসুবিধা বাড়ায় গড় আয়ু ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে, দারিদ্র কমছে। কিন্তু জমি বনাম জনসংখ্যার সংকট কমানোর উপায় নেই - কারণ জমি স্থিতিশীল আর জনসংখ্যা বর্ধিষ্ণু।  তিনটি মূল কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বাস্তচ্যুত হচ্ছে - ১. প্রাকৃতিক কারণ, যেমন নদী ভাঙন বা সিডরের মত দুর্যোগ, ২. দারিদ্র, যে কোনো পারিবারিক দুর্যোগ বা উৎসবে তাদের সহায় সম্বল বিক্রি করতে বাধ্য হয় প্রান্তিক মানুষ এবং ৩. আকস্মিকভাবে বিত্তবান হয়ে ওঠা মানুষ ও নতুন গজিয়ে ওঠা আবাসন শিল্পের উদ্যোক্তাদের প্রলোভন ও চাপে দরিদ্র মানুষ জমি হারাচ্ছে। ফলে মাথা গুঁজবার ঠাঁই খুঁজতে গ্রামের বাস্তচ্যুত এবং স্বল্পায়ী ও বেকার মানুষ বিপদ আপদ ভবিষ্যত কিছু নিয়েই ভাববার অবকাশ পায় না। তার কাছে বর্তমান এক নির্মম ও কঠিন বাস্তবতা। এর ফল হিসেবে আমরা দেখি যে-চর মাত্রই সমুদ্র থেকে জাগছে, যেখানে এখনও জোয়ার ভাটার খেলা চলে, যে জমি দিনে দু’বার জোয়ারে সম্পূর্ণ তলিয়ে যায় সেখানেও মানুষ মাচাঘর তুলে বসবাস শুরু করে দিচ্ছে। সুন্দরবনের বাঘ-কুমীর-সাপের সঙ্গে লড়ে বসতি করছে, নোনা পানির মধ্যে ঘর তুলছে, চট্টগ্রাম শহরে পাহাড়ের পাদদেশে ধসের ঝুঁকির মধ্যে সংসার পাতছে। আর শহরের ফুটপাথে, রেললাইনের ধারে, যেকোনো পতিত জমিতে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে শোয়ার জায়গা করে সপরিবারে দিন গুজরান করছে। যেদেশে প্রায় চল্লিশ ভাগ মানুষ এরকম বসতি সঙ্কটে আছে তাদের জন্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ছয় হাজার বর্গমাইলের বিস্তীর্ণ তিনটি জেলা একটা আকর্ষণীয় জায়গা হিসেবে বিবেচিত হওয়া স্বাভাবিক। নতুন-জাগা চর, পাহাড়ের পাদদেশ বা বাঘ-কুমীর অধ্যুষিত অরণ্য বা মহানগরের ফুটপাত, রেললাইনের ধারের চেয়ে এ অঞ্চল তাদের বেশি পছন্দের জায়গা হওয়াই স্বাভাবিক।
মানুষের মৌলিক পাঁচটি চাহিদার মধ্যে বাসস্থানের অধিকার অন্যতম। সরকার এ অধিকার পূরণের দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না। তাদের মাথায় বিপন্ন মানুষের পুনর্বাসনের জন্যে নানা বিকল্পের মধ্যে নিশ্চয় পার্বত্য অঞ্চলের কথাও এসেছে এবং সেভাবে কাজ হয়েছে।
তবে পার্বত্য অঞ্চলে প্রথম ব্যাপক হারে সরকারি উদ্যোগে বাঙালি বসতিস্থাপনের পেছনে অন্য উদ্দেশ্য ছিল। ১৯৭৯-৮০-৮১’র দিকে জেনারেল জিয়া এ কাজ শুরু করেছিলেন মূলত শান্তিবাহিনীর তৎপরতা বন্ধের দীর্ঘমেয়াদী প্রতিকার হিসেবে। উদ্দেশ্য ছিল পাহাড়ে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীকে ছাপিয়ে বাঙালি জনসংখ্যা বাড়ানো। তাঁর অনুসৃত নীতি পরবর্তী পনের বছর ধরে  জেনারেল এরশাদ ও বেগম জিয়ার সরকার পালন করে গেছে। এর ফলে সত্যি সত্যিই পাহাড়ে জনসংখ্যার ভারসাম্য পাহাড়ীদের প্রতিকূলে চলে গেছে। বর্তমানে মোট জনসংখ্যা সম্ভবত পাহাড়ী-বাঙালি ৪৮:৫২ হয়ে গেছে, যা স্থানীয় অধিবাসী হিসেবে পাহাড়ীদের পক্ষে মানা কঠিন।
৩.
এবারে আমাদের বুঝতে হবে এর ফলাফলটা কী হল। মনে রাখতে হবে ১৯৭৯-৮০’র আগে দীর্ঘদিনে স্বাভাবিক নিয়মে পাহাড়ে সমভূমি বাঙালিদের যে বসতি গড়ে উঠছিল তাতে কোনো সংকট হয়নি। তারা পরস্পর মিলে মিশে বসবাস করেছে। কিন্তু এবারে দুটি কারণে সংকট তীব্র হল। প্রথমত, পাহাড়ে বাঙালি অভিবাসনের সরকারি নীতির পিছনে এমন একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল যাকে স্বাধিকারের জন্যে সংগ্রামরত জনগোষ্ঠীর কাছে সরকারের একটি হীন চক্রান্ত বলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক। বাস্তবে তাই হয়েছে এবং এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঠেকানো যায় নি। দ্বিতীয়ত, অল্পসময়ে যে ব্যাপক বাঙালিকে পরিকল্পিতভাবে সেখানে বসতির ব্যবস্থা করা হয়েছে তাদের অধিকাংশের পেশাগত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র ছিল কৃষি। প্রথম অধ্যায়ে কৃষিসমাজের যেসব বৈশিষ্ট্য-প্রবণতার কথা বলা হয়েছে তা এখানে ঘটেছে। পাশাপাশি কৃষি শিল্পের বিকাশের জন্যে সরকার বাঙালিদের নির্বিচারে জমি বরাদ্দ দিয়ে সংকট ঘনীভূত করেছে। এতে একেবারে এই বাস্তব ভূমি-সংকটের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণ একটা গভীর বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক সংঘাতের সম্মুখীন হল। প্রকৃতিভিত্তিক সরল এবং আদিম। জীবনসংস্কৃতিতে অভ্যস্ত জনগোষ্ঠী প্রকৃতি-উদাসীন বা প্রকৃতি শাসনে অভ্যস্ত সাকার পূজা বিরোধী জটিল প্রবল সংস্কৃতির চাপের মধ্যে পড়ে যায়। তাদের ঐতিহ্যবাহী জীবনব্যবস্থা, খাদ্যোৎপাদন পদ্ধতি, নিভৃত জীবনযাপন, স্বাধীন মুক্ত জীবনের অভ্যাস আকস্মাৎ ভেঙে পড়েছে। তারা ভূমি হারিয়েছে, খাদ্য সংকটে পড়েছে এবং সবচেয়ে বড় কথা নিভৃতের মুক্ত জীবনের অধিকার খুইয়েছে। সবটা মিলে এটি তাদের জন্য বড় রকমের আঘাত।
৪.
আমাদের মনে হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে জনসংখ্যা ভারাক্রান্ত সমভূমির ভূমিহীন মানুষের কিছু অভিবাসন হওয়া অযৌক্তিক নয়। কিন্তু তা হতে হবে পার্বত্য অঞ্চলের স্থানীয় অধিবাসীদের নেতৃবৃন্দের বা নির্ভরযোগ্য জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটির মতামত নিয়ে। এ ব্যবস্থাটি  সামগ্রিকভাবে দেশের জন্যে প্রয়োজনীয় বনাঞ্চল সংরক্ষণের পাশাপাশি মূল্যবান জীববৈচিত্র্য, পরিবেশের ভারসাম্য ও জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় সহায়ক হবে। অর্থাৎ পার্বত্য অঞ্চলে সমভূমির বাঙালি অভিবাসন হবে, কিন্তু তা হতে হবে পরিকল্পিতভাবে স্থানীয় মানুষের সম্মতিতে এবং প্রকৃতি, পরিবেশ ও স্থানীয় মানুষের কৃষ্টি-ঐতিহ্য রক্ষার জন্যে কিছু শর্তের ভিত্তিতে। একমাত্র এভাবেই এ অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে হয়।