Wednesday, May 17, 2017

কোন্ চেতনায় দেশের প্রকৃত উন্নয়ন ঘটবে?

আবুল মোমেন

জেনারেল এরশাদ কি বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারবেন? তাঁর বয়সের কথা - সম্ভবত এখন ৮৫-৮৬ চলছে - একেবারে বাদ দেওয়া যাবে না। তাছাড়া দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মামলাগুলো থেকে তাঁর নিস্কৃতির ব্যবস্থা হলেও এরশাদ কি স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ফিরে পাবেন? বাংলাদেশের ইতিহাসে দুই সামরিক শাসকের মধ্যে এরশাদের জন্যেই এ কাজটা কঠিন বেশি। এর বাইরে থাকল সাম্প্রতিক রাজনীতিতে তাঁর সুবিধাবাদ ও অস্থিরমতিত্বের নানা কা-। জনমনে এরও প্রভাব রয়েছে এবং তাঁকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে কোনো মহলই নিতে চাইবে না, যেমন চায় নি ও নেয় নি খোদ আওয়ামী লীগও। তাঁকে তারা ব্যবহার করেছে, করছে।
আদতে ক্ষমতাসীন দলের মতির ওপরই এরশাদের ভাগ্য নির্ভর করে। ফলে তাঁর জোট গঠন এবং সরকারের কাছ থেকে দূরে সরে স্বাধীন অবস্থান গ্রহণের প্রক্রিয়াকে মানুষ - অন্তত অনেকেই  - পাতানো খেলা হিসেবেই নেবে। এরশাদ নিজেও ক্ষমতাসীন অবস্থায় আ স ম  আবদুর রবকে দিয়ে বহুদলীয় জোট গঠন করিয়ে তাঁর নির্ভরযোগ্য বিরোধী দল বানাতে চেয়েছিলেন। লোকে এ জোটকে গৃহপালিত বিরোধী দল বলত এবং এই প্রক্রিয়ার সাথেই আ স ম রবের রাজনৈতিক জীবনের কার্যকারিতারও ইতি ঘটে।
এরশাদের রাজনৈতিক জীবন টিকে আছে বস্তুত ক্ষমতার প্রসাদেই। উত্তরবঙ্গে তাঁর যে নিজস্ব ভোটবলয় ছিল তা অস্তায়মান। তাঁর ও তাঁদের পরিবারের প্রতি সেখানকার মানুষের মায়া থাকলেও তাতে এমন জোয়ার থাকবে না যে তাঁরা ছাড়াও দলের অন্য প্রার্থীরাও বিজয়ী হবেন।
এরশাদ ও তাঁর জোট বস্তুত ফুটো বেলুন, তালি দিয়ে তা খুব বেশি দূর ওড়ানো যাবে না। এরশাদ যেমন আবদুর রবকে খাড়া করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে বাদ দিয়ে ভোটের গণতন্ত্র চালু রাখতে চেয়েছিলেন সম্ভবত আওয়ামী লীগ এবার তাঁকে সামনে এনে একই পন্থায় বিএনপিকে মাইনাস অথবা সাইজ করতে চাইছে। এটা ক্ষমতাসীনদের একটি পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ নিশ্চয় - কদ্দুর কাজে লাগে তা দেখতে চাইছেন তাঁরা। এর মধ্যে আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্যে মুখিয়ে থাকা বিএনপিকে বিরক্ত করা হবে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের লাভালাভ নিয়ে চরম সংশয়ে তথা সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যেও রাখা হবে। এতে নির্বাচনে অংশ নিলেও বিএনপির পক্ষে সর্বশক্তি ও সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হবে না। প্রধান প্রতিপক্ষকে অপ্রস্তুত বা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে রেখে নির্বাচনে আনতে পারলে তা আওয়ামী লীগের মন:পুত হবে।
এরশাদ বিএনপির বিকল্প শক্তি হিসেবে জনগণের আস্থা পাবেন না। অর্থাৎ চলমান এই প্রক্রিয়ার সুফল সরাসরি আসার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু পরোক্ষ ফল যে আওয়ামী লীগ পাবে না তা নয়। বিএনপির মূল অনুপ্রেরণা - বেগম জিয়া ও তারেক জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যত ও ভূমিকাকে চাপে রাখার অস্ত্র হাতে রেখেছে ক্ষমতাসীন দল। তাঁদের মামলার গতিপ্রকৃতি থেকে মানুষ এটা বুঝতে পারে। এর চরম পদক্ষেপ হতে পারে তাঁরা দুজনই মামলায় শাস্তি পেয়ে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষিত হতে পারেন। বর্তমান বাস্তবতায় দলে এর ফল হতে পারে সেনাপতির অনুপস্থিতিতে হতোদ্যম সৈন্য বাহিনির মত।
এইখানে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এরকম অবস্থায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কখনো মাঠ ছাড়ে নি, বরং আন্দোলনকে প্রায় নৈরাজ্যের পথে নিয়ে দাবি আদায়ে সক্ষমতা দেখিয়েছে। কিন্তু যে দল ক্ষমতার প্রসাদ পাওয়ার জন্যে ভীড় করে আসা নানা মত-পথের মানুষের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে তার পক্ষে জিয়ার উত্তরসুরী ব্যতীত অন্য কারো নেতৃত্বে দলে ঐক্য রক্ষা ও সে দলকে নিয়ে জানবাজী রেখে লড়াই চালানো সম্ভব নয়। এটা গত দশ বছরে ভালোভাবে প্রমাণিত হয়েছে যদিও নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও মাঠের লড়াইয়ে মূল ভূমিকা পালন করেছিল আওয়ামী লীগই। বিএনপি তাতে শরিক থেকে লাভবান হয়েছিল।
বিএনপর এই অন্তর্নিহিত দুর্বলতা আওয়ামী লীগ ভালোভাবেই জানে। আর মামলা-মোকদ্দমা ও পুলিশি অ্যাকশানে তাদের কাবু করে রেখে এর প্রমাণও তারা পেয়েছে।
বর্তমান বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ আরো কিছু বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে। আঞ্চলিক রাজনীতি, বিশেষত ভারতের সমর্থন এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতায় দুই প্রধান দলের মধ্যে আওয়ামী লীগই সবার অপেক্ষাকৃত পছন্দের দল। এমনকি হেফাজতের প্রতি সরকারের সাম্প্রতিক পক্ষপাতমূলক ভূমিকা এই সমর্থনকে আরো জোরদার করবে। এর বিরুদ্ধে দেশে যে প্রগতিচেতনার রাজনীতি ও সমাজভাবনা আছে তাকে বিএনপি প্রতিনিধিত্ব করে না, এবং করবেও না। এ অবস্থায় তারা চাইবে ধর্মীয় কার্ডটি আরো ভালোভাবে খেলে ও খেলিয়ে ভোটারদের পক্ষে টানতে। অর্থাৎ আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে ইসলামি রাজনীতি ও ইসলামি দলগুলোর পোয়াবারো হবে। এরশাদের জোটের ৫৮ দলের মধ্যে পঞ্চাশের অধিক হল নামসর্বস্ব ইসলামি দল, বিএনপি জোটেও তারাই সংখ্যায় বেশি। আওয়ামী লীগও এধারার বাইরে থাকল না, তারা খোদ হেফাজতের সাথে মৈত্রী করে নিয়েছে।
রাজনীতির এই সাম্প্রতিক গতিধারায় আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষমতায় থাকা সহজ হবে মনে হলেও এর মূল্য গুণতে হবে অনেক। আওয়ামী লীগই এতকাল এদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, তাই তার সাথেই চলেছে এদেশের প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি-সংস্কৃতিধারা। কিন্তু ক্রমে প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর জন্য আওয়ামী লীগের দরজা খুলে যাওয়ায়  সে ধারায় বিশ্বাসী লোকজন লীগে ঢুকে পড়ছে। আবার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা, এবং আগামীতেও ক্ষমতায় থাকার সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলে ক্ষমতার প্রসাদলোভী সুবিধাবাদী রাজনীতিকরাও এ দলে ভীড় করছে। দলের ক্ষমতায় টিকে থাকার এজেণ্ডাটির অগ্রাধিকার বরাবর এদের জন্যে প্রশ্রয় হিসেবে থাকবে এবং দিনে দিনে দলের অভ্যন্তরে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল চেতনার অংশ কোণঠাসা ও দুর্বল হতে থাকবে। এতে আওয়ামী লীগের রাজনীতির যে রূপান্তর ঘটছে তা বাংলাদেশকে তার গৌরবময় সহনশীল মানবিক সমাজের ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারে। বস্তুত এই বিচ্যুতি শুরু হয়ে গেছে। তার জোরালো আলামত সমাজে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় উগ্রতা ও তা পালনের বাহ্য আড়ম্বর সমাজজীবনে সংখ্যালঘুদের অবস্থানকে অনিশ্চিত, অনিরাপদ করছে ও তাদের দৈনন্দিন জীবনে অস্বস্তি সৃষ্টি করছে। সংখ্যালঘুদের অব্যাহত দেশত্যাগে এটা বোঝা যায়। এ অবস্থায় সমাজে মুক্তচিন্তাই যে কেবল চাপে পড়ছে তা নয় প্রকৃত জ্ঞানচর্চার পরিবেশও বিনষ্ট হচ্ছে। সমাজে অন্ধবিশ্বাস, সংস্কার ও মূঢ়তা এবং ক্ষমতা, অর্থ ও পেশিশক্তির দাপট বাড়ছে। এসবের আলামতও অস্পষ্ট নয়।
এখন প্রশ্ন হল, স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতক পরে দেশের এই পরিণতিই কি কাম্য ছিল, কাম্য হতে পারে? মুশকিল হল, এসব নিয়ে আওয়ামী লীগের ভাবনা কি তা জানারও উপায় নেই, কারণ সেখানে একক সিদ্ধান্তেই সব চলছে। শেখ হাসিনা আপাতত বুদ্ধিজীবী, শিল্পীসাহিত্যিক, নাগরিকসমাজকে দূরে ঠেলে রেখেছেন। হতে পারে আমলাদের হাতে ক্ষমতা বেশি, ধর্মীয় নেতাদের পিছনে সমর্থক বেশি, কিন্তু সমাজকে এগিয়ে নিতে ক্ষমতাবান ও অন্ধ সমর্থকের চেয়ে বেশি প্রয়োজন চিন্তাশীল সৃজনশীল মানুষের ভূমিকা। তাদের মধ্যেও সুবিধাবাদী তোষামুদে প্রকৃতির লোক থাকতে পারে, আছেও, কিন্তু ছদ্মাবরণ ভেদ করে খাঁটি মানুষদের খুঁজে নেওয়া ও তাদের পরামর্শ নেওয়াই তো নেতৃত্বের বড় কাজ। অতীতের দিকে তাকালে বাংলাদেশের গড়ে ওঠার কালে গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীদের এ ধরনের সংযোগ এবং তার ফলাফল জাতি দেখেছে, তাতে উপকৃত হয়েছে।
বাংলাদেশের জন্যে বর্তমান সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্ন হল - দেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগুবে নাকি মুসলিম জাতীয়তার কট্টরপন্থার সাথে আপসের রাজনীতির খেসারত দেবে? অর্থনৈতিক ও বৈষয়িক উন্নতির মধ্যেও একটি দেশ ও তার জনগণ চেতনায় পিছিয়ে যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের ধনী উন্নত দেশগুলো মানবসভ্যতায় কোনো অবদান রাখতে পারছে না। বাংলাদেশ আজ সেই রকম এক অন্ত:সারহীন উন্নয়ন বা শুভঙ্করের ফাঁকির সামনে পড়ছে। এই ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে এখন থেকেই দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ ও সচেতন নাগরিকদের ভাবা উচিত।
***