আবুল মোমেন
বাংলাদেশে বেগম
রোকেয়ার ভাবমূর্তি এখন উজ্জ্বল। হয়ত বলা যায় বাঙালি মুসলিম সমাজের তিনিই শীর্ষ নারী
ব্যক্তিত্ব। তাঁর নামে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় আছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রিনিবাস
হয়েছে, রাজধানীতে সড়কের নামকরণ হয়েছে তাঁর নামে। জনজীবনে বেগম রোকেয়া এভাবে প্রতিষ্ঠিত
আজ।
বেগম রোকেয়ার
সাহিত্যের বড় ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে আছে নারীর অবরোধমুক্তি। পর্দাপ্রথার আতিশয্যকে
তিনি কষাঘাত করেছেন সাহিত্যে - বিশেষত অবরোধবাসিনীর পত্রে। দ্বিতীয় বিষয় ছিল ধর্মের
নামে নারীর স্বাধীনতা ও অধিকার ক্ষুণ্ন করার বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ।
তবে বাংলাদেশে
তাঁর জীবনের মূল ব্রত নারী শিক্ষার প্রসার আজ ঘটে চলেছে - এই ভেবে আত্মপ্রসাদ পাওয়া
যেতে পারে। তবে এটি ঘটছে যুগের নিয়মে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কার্যক্রমের সাথে তাল মিলিয়ে।
কিন্তু এ প্রশ্নটা না ভুললেই নয় - নারী, এবং ছেলেরাও, বর্তমান বাংলাদেশে যে শিক্ষা
পাচ্ছে এবং শিক্ষা পেয়ে যেভাবে বড় হচ্ছে বেগম রোকেয়া কি তার কথাই ভেবেছিলেন?
আজ বাংলাদেশের
সমাজমৃত্তিকায় জঙ্গিবাদ বীজ বপন করেছে, ধর্মান্ধতা শক্তিশালী হয়েছে এবং সাম্প্রদায়িকতা
বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। রোকেয়া এসবের বিরুদ্ধেই লিখেছেন, বলেছেন এবং কাজ করে গেছেন।
তিনি ব্যক্তিগত জীবনে স্বামীর কাছ থেকে প্রেরণা ও সহযোগিতা উভয়ই পেয়েছিলেন। সম্ভবত
তাই নারী-পুরুষের সমতা ও অংশগ্রহণে সমাজের কল্যাণ তিনি দেখেছেন।
বাংলাদেশ নানামুখী
পথে চলছে। তবে মুসলিম সমাজের বড় একটি অংশ নারীকে অবরোধবাসিনীই দেখতে চাইছে। যদিও একদিক
থেকে প্রায় রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্নের রাজ্যের মতই আজকের বাংলাদেশ যেখানে প্রধানমন্ত্রী,
প্রধান বিরোধী নেত্রী, সংসদের বিরোধী নেত্রী, সংসদের উপনেতা, স্পিকার, বেশ কয়েকজন মন্ত্রী,
উচ্চ আদালতের একাধিক বিচারপতি মহিলা তবুও আমরা জানি এটি রোকেয়া কল্পিত ও কথিত নারীস্তান
নয়। রীতিমত পুরুষস্তান। রোকেয়া পুরুষতন্ত্রকে সমালোচনার হুল ফোটানোর জন্যেই এক নারীস্তানের
কল্পলোক সৃষ্টি করেছিলেন - অবরুদ্ধ নারীর আর্তনাদ ও ফরিয়াদ যেন তাঁর জোরালো লেখায় অন্যভাবে প্রকাশ পেয়েছিল।
আজ রাষ্ট্রের
গুরুত্বপূর্ণ পদে এত এত নারী, শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেয়েদের প্রাধান্য সত্ত্বেও বলতে
হবে, সাধারণের সমাজে নারীর অবস্থান রোকেয়ার ভাবনাকে উপহাসই করছে। নারী নির্যাতন বাড়ছেই
কেবল। নারীর নিরাপত্তা আজ সবচেয়ে ভঙ্গুর অবস্থায় আছে।
তাঁর স্বপ্নের
পথ থেকে অপসৃয়মান এ সমাজে তবুও রোকেয়া স্মরণীয় ব্যক্তি, শ্রদ্ধেয় নাম, ইতিহাসের বরেণ্য
চরিত্র। ব্যস এটুকুই। অর্থাৎ বাহ্য স্বীকৃতি দিয়েই আমরা খালাস। সমাজবাস্তবতা তো তাই
বলে। তাঁর শিক্ষা গ্রহণ করছি না আমরা, তাঁর লক্ষ্য ও আদর্শ বাস্তবায়নে আমরা অপারগ।
রোকেয়ার সৃষ্ট
সাহিত্য পাঠেই তাঁকে পাওয়া যাবে, রোকেয়ার জীবনেই মিলবে তাঁর জীবনাদর্শের শিক্ষা। কিন্তু
এ সমাজে একালে যেন নাম নেওয়াই যথেষ্ট, আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপনেই দায়িত্ব শেষ হয়।
বেগম রোকেয়ার
ভাবমূর্তি নতুন প্রজন্মের কাছে - যারা তাঁর নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয় পড়ে, ছাত্রী নিবাসে
থাকে - কীভাবে পৌঁছায়, নির্মিত হয়? হয় কি? এ সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। যেটুকু
ধারণা হয় তা হবে রোকেয়াকে লজ্জা দেওয়ার সামিল।
রোকেয়ার নি:স্বীকরণের
মাধ্যমে এক নামসর্বস্ব রোকেয়াকে তৈরি করে নেওয়া হল কি? নামসর্বস্ব রোকেয়ার নামে জয়ধ্বনি
দেওয়া সহজ। তাঁর বইয়ের পাতা খুললে, তা পড়লে, চিন্তার সাথে পরিচিত হলেই বিপদ। তাহলে
নিশ্চিন্তে গা ভাসানো যাবে না। আমরা কি গা ভাসিয়েই চলব নাকি রোকেয়ার তুল্য না হলেও
তাঁর অনুসারী হয়ে গা লাগিয়ে কাজ করে তাঁর ঋণ স্বীকার ও শোধ করব।
***