Wednesday, June 19, 2013

আমরা যেন উদ্বাস্তুতে রূপান্তরিত হয়ে চলেছি


আবুল মোমেন

বর্ষার দু’এক পশলা ঝরতেই গ্রামবাংলার নিসর্গের লাবণ্য চোখ ও মনকে সজীব করে তোলে। চারিদিকে সবুজের সমারোহ- ঘন স্বচ্ছ সজীব প্রাণবন্ত এই শ্যামলিমার মজ্জাগত শক্তি আশাবাদ আর ইতিবাচকতা। এ কথা লিখেই চমকে ভাবতে হয় কোথায় আশাবাদ, কোথায়বা ইতিবাচকতা? এসবই মরীচিকার মত অধরা নয় কি? বাংলাদেশের মানুষের মনে হতাশার বীজ মহীরুহ হয়ে উঠেছে - নয় কি? সেই সাথে বিদ্বেষ হিংসা আর লোভের মহীরুহের পরিচয়ও পাচ্ছি। প্রকৃতিতে প্রাণের এমন উজ্জ্বল জৌলুষ ব্যক্তির প্রাণে ব্যর্থ হয়ে ফিরছে।
এর কারণটা কি?
বোধহয় কারণ এই যে আমরা প্রায় আমাদেরই অজান্তে মানসিক উদ্বাস্তুতে রূপান্তরিত হচ্ছি। আমরা দেশকে মনেপ্রাণে পেয়েছিলাম একাত্তরে, তাই প্রায় গণহারে উদ্বাস্তু হলেও তা ছিল বাহ্য তখন, হৃদয়ে জাগ্রত ছিল বাংলাদেশ। আজ সে সলতে নির্বাপিত। তাই যত পরিবর্তন, যত আয়োজন, যত অর্থলগ্নী হোক তা আমাদের অন্তরের দারিদ্র্য দূর করতে পারে না। আমাদের উন্মূলতা তথা উদ্বাস্তুপ্রবণতার আগুনে এসবই আরও ঘৃতাহুতি দেয়। কারণ উদ্বাস্তুর জীবনে ব্যক্তিগত ক্ষুধাই সব, সবই তার ভোজে লাগে।
কীভাবে আমরা উদ্বাস্তুতে রূপান্তরিত হলাম এবং হয়ে চলেছি, তার খোঁজ করা কি দরকার নয়? স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের ভুল হচ্ছিল, ব্যর্থতার শেষ ছিল না, কিন্তু সম্ভাবনার পথও তৈরি হচ্ছিল, রুদ্ধ তো হয়ই নি। কারণ তখনও হৃদয়েমনে বাংলাদেশ স্বপ্ন হয়ে, আশা হয়ে বেঁচে ছিল। বাংলাদেশ তো উত্থানপতনে জীবন্ত ইতিহাস, ঐতিহ্যসমৃদ্ধ চলমান সংস্কৃতি। এই ইতিহাস ও সংস্কৃতির রূপকার ও ফসল এক জনগোষ্ঠীর নাম বাঙালি। ইতিহাস তার মনোভূমির বীজতলা আর সংস্কৃতি তাতে জন্ম নেওয়া চারাগাছ। সবটাই প্রাণ আর প্রত্যাশা, স্বপ্ন আর সম্ভাবনার বিষয়। এই যায়গায় বিপর্যয় ঘটলে বা আকাল দেখা দিলে মানুষের দেউলিয়াত্বের সূচনা হয়, যার পরিণতি মানসিক উদ্বাস্তুতে রূপান্তর।
উদ্বাস্তু কেবল বর্তমান নিয়ে বাঁচে, স্বার্থটাই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে ওঠে তার, খাওয়া-পরা ও বাঁচার জন্যে লোভ তার প্রধান রিপু। লোভের পিছু পিছু আসে প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ, ক্রোধ এবং ক্রমে প্রয়োজনে আরও পাশববৃত্তির জাগরণ ঘটে - যুক্তিবিবেচনা লোপ পেয়ে পেশী শক্তির প্রয়োগের প্রবণতা বাড়তে থাকে। এই রিপুর মুক্ততাড়নায় চাহিদার কোনো সীমা টানা যায় না। যার মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে সে প্রাসাদ চায়, চাকুরি থাকলে উপরি চায়, একটা বাহন থাকলে একাধিক বা নতুন মডেলের চায়, অভ্যাসবশত অকারণে বাজার করবে, এক নারী নিয়ে সংসার বেঁধে আরও নারী চায়। এ পথের শেষ কোথায়? - শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে?
উদ্বাস্তু-মানুষের সমাজ থাকে না, ওরা তো বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি - নিজ নিজ স্বার্থের দায় মেটাচ্ছে, কামনা চরিতার্থ করছে, যে কোনো সুযোগের সর্বোচ্চ (সর্বোত্তম নয়) ব্যবহার করে নিচ্ছে। এ সময়ে মানুষ আর পশুতে তফাৎ বিশেষ থাকে না। আজ বাংলাদেশে মানুষ মতভিন্নতা জানে না, কেবল বোঝে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, তা থেকে সহজেই প্রতিপক্ষ তৈরি হয়। প্রতিপক্ষের প্রতি অন্ধ ঘৃণা আর ক্রোধে রিপু-ই সক্রিয় হয়ে ওঠে। মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে ধিকি ধিকি সবসময়। তাই মানুষ গুম হয়, খুন হয়, আঠারো টুকরায় খণ্ডিত হয়। সংখ্যালঘু চরম নির্যাতনের শিকার হয়, নারী ধর্ষিতা হয়। পাশাপাশি সেবক প্রভু হয়, বিচারকও ঘুষ খায়। আপন স্বার্থ ও রিপুর তাড়নায় আস্তে আস্তে সমাজ ভেঙে যেতে থাকে। একাত্তরে যখন আমরা কোটি মানুষ দেশছাড়া হয়ে সর্বার্থে উদ্বাস্তু, আরও কোটি মানুষ নিজ দেশে পরবাসী উদ্বাস্তু তখন কিন্তু আমরা অমানুষ হই নি। মানবেতর জীবন কাটিয়ে, ঝুপড়িতে, পাইপের মধ্যে বাস করে, একবেলা খেয়ে সামান্য পেয়ে, অনেকেই সর্বস্ব হারিয়ে সর্বক্ষণ মৃত্যুর থাবার নিচে থেকে, বর্বর অত্যাচারের শিকার হয়েও অমানুষ হই নি। আমরা তখন ত্যাগের জন্যে মরিয়া, আমাদের কণ্ঠে গান ছিল, হৃদয়ে ভালোবাসা, দেশের জন্যে প্রাণপাত করার পণ। ওই উদ্বাস্তু জীবনে আমাদের মধ্যে প্রতিবেশীর সহৃদয়তা, সহযাত্রীর সহমর্মিতাসহ কী মানবিক সম্পর্ক সব গড়ে উঠেছিল! সেই উদ্বাস্তু শিবিরে উদ্বাস্তুজীবনে আমরা মানুষ ছিলাম, সমাজ গড়ে তুলেছিলাম, এমনকি দক্ষতা ও সততার সাথে সরকার ও প্রশাসন চালিয়েছি, সবচেয়ে বড় কথা আমরা মুক্তির জন্যে যুদ্ধ করেছিলাম, আমরা স্বাধীনতা এনেছিলাম।
আজ স্বাধীন দেশে আমরা অমানুষ হয়ে পড়ছি, সততার আকাল চলছে, দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে, দক্ষতাও    অন্তর্হিত। আমরা পারছি না এখন।
তখন পেরেছিলাম আর এখন পারছি না - কারণ তখন দেশছাড়া হয়েও আমরা মানসিকভাবে উদ্বাস্তু হই নি, আমাদের হৃদয়ে ছিল জাগ্রত বাংলাদেশ। আর আজ দেশজুড়ে আমরা আধিপত্য করছি, কারণ হৃদয়ের বাংলাদেশের সলতে নিভেছে। আমরা মানসিক উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছি। মানসিক উদ্বাস্তু কেবল ব্যক্তিস্বার্থই চরিতার্থ করে, সে দখল করতে জানে, ভোগ করে, ভাগ করে নিতে ও পেতে জানে না। ফিলিস্তিনের জনগণ উদ্বাস্তু  শিবিরে থেকেও মানবিক ও সামাজিক জীবন যাপন করছে, প্রতিটি মৃত্যুতে (ইজরায়েলিদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড) তারা মাতম করে সাড়া দেয়। প্রতিটি জীবন তারা দেশের জন্যে স্বাধীনতার জন্যে উৎসর্গ করতে পারে। কারণ ওরা উদ্বাস্তু শিবিরে থেকেও উদ্বাস্তু নয়, দেশপ্রেমিক মানুষ। যেমনটা আমরা ছিলাম একাত্তরে।
দেশ জিনিসটা তো কথার কথা নয়, বক্তৃতায় মুখে ফেনা তুলবার বিষয়মাত্র নয়। এতো জানা-বোঝা এবং চর্চার বিষয়, তারপর দেশচেতনা ও ভালোবাসার কথা উঠবে। স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনীতি দিনে দিনে সেই চর্চার ও ভালোবাসার দেশটাকে ঝাপসা করে দিলো।
আমাদের প্রকৃতিই আবার আশাবাদী হতে শোখায়। আমরা দাবি করে বলতে পারি, সভ্যতার বিচারে আমাদের ঐতিহ্য সত্যিই চমকপ্রদ, গৌরবময়। আমাদের রয়েছে পালযুগের চিত্রকলা, বৈষ্ণব পদাবলী, বাউল গান, সুফিধারার মরমি সঙ্গীত, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন এবং এভাবে মানবকৃষ্টির অসংখ্য শ্রেষ্ঠ কৃতী। না, সভ্যতার নিরিখে পিছিয়ে পড়িনি আমরা এখনও। তবে উদ্বাস্তু জীবন আরও কিছুকাল চলতে থাকলে সত্যিই পিছিয়ে পড়ব। কারণ মানুষ তার প্রাণের কণ্ঠ শুনতে পেলে তবেই জেগে ওঠে, সৃষ্টিশীলতাও তখন শুরু হয়। ফলে আমরা অনেক পথ পাড়ি দিয়ে বিস্তর অর্জন সত্ত্বেও আজ মুখ থুবড়ে পড়েছি। তার কারণ আমাদের প্রাণভোমরায় হাত পড়েছে। রূপকথার গল্পে দৈত্যের প্রাণ থাকত কৌটোতে রাখা পতঙ্গের মধ্যে। সেটা মারলে দৈত্যও মরে। মানবের প্রাণভোমরা তার সংস্কৃতি। সেখানে হাত পড়েছে, সেটা না সরিয়ে হাজার টাকা পয়সা ঢেলে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জিত হবে না। এই প্রাণ বাঁচে ইতিহাসে-সংস্কৃতিতে। আজকাল উন্নয়নপন্থীদের উগ্রতা এমন পর্যায়ে গেছে যে তারা ইতিহাস আর সংস্কৃতির কথা বললে রাগ করেন। রাগ করে বলেন কেবল পিছনে টানা, পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটা, কেবল বিবাদ টেনে আনা! অথচ সংস্কৃতির ভাণ্ডার থেকেই তার জীবনদর্শন নীতিনৈতিকতার মানদণ্ড তৈরি হবে। ফলে সংস্কৃতি গেলে মনুষ্যত্বও যাবে।
কিন্তু যে মানুষ  ইতিহাস চেতনাহীন তার কোনো সংস্কৃতির বাতাবরণ তৈরি হয় না, স্বার্থ ও বর্তমানের ভোগের চিন্তা ছাড়া। এই হল প্রকৃত উদ্বাস্তু, ব্যক্তিস্বার্থের জোয়ালে বাঁধা, যে পারে চুরি করতে, ঘুষ খেতে আর দখল করতে। এ সবের পিছু পিছু আসে সন্ত্রাস, হানাহানি, খুন-জখম, দুনিয়ার অমানবিকতা। বাংলাদেশে এসবই চলছে। উদ্বাস্তুর দেশে এর বেশি আর কী হবে।
কথা হল, আমরা কি উদ্বাস্তু হয়েই থাকব? উদ্বাস্তু হতেই থাকব? নাকি সেই একাত্তরের সোনালি উদ্বাস্তুজীবনের স্মৃতি হাতড়ে আরেকবার হৃদয়ে বাংলাদেশকে ধারণ করে গৌরবের অধ্যায়কে ফিরিয়ে আনব? এছাড়া এদেশের বেঁচে ওঠার আর কোনো পথ নেই। বিকল্প যে পথটিতে এখন আমরা হাঁটছি তার নিদর্শন আঠারো টুকরোর লাশ, সাভার ট্র্যাজেডি, খুন-গুম-ধর্ষণ, হলমার্ক-ডেস্টিনি কেলেংকারি, সহিংসতা ও সন্ত্রাস, রামুর ধ্বংসযজ্ঞ, আশুলিয়ার দখল, সংসদের অচলতা, ক্ষমতাবানদের নির্লজ্জ ভোগবিলাসের ব্যসন, ঋণখেলাপী সংস্কৃতি... এভাবে লুটপাট দখলভোগ, খুনজখম ধ্বংস-বিপর্যয়, অন্ধকার তমশা অমানিশা এবং জীবনানন্দের সেই অদ্ভুত আঁধার... যারা অন্ধ তারা চোখে দেখে বেশি... যারা রাজাকার তারাই দেশপ্রেমিক, মুক্তিযোদ্ধা তাদের তোষামোদকারী... বলি, ধ্বংস ও চূড়ান্ত বিপর্যয় আর কতদূর?