Sunday, September 29, 2013

শঙ্কা শুধু দানাই বাঁধছে, ভাঙবে কে

আবুল মোমেন


দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিদিনই অনিশ্চয়তা এবং চাপা উদ্বেগ-উত্তেজনার পারদ বাড়ছে। এরকম পরিস্থিতি একেবারে নতুন নয় দেশবাসীর জন্য, এ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আগেও আমরা গেছি। তবে সবসময় পরিণতি ভালো হয়নি বলে সব মানুষই যেন ভেতরে-ভেতরে অস্থির হয়ে আছে। নাগরিক সমাজ এ নিয়ে ব্যাপকভাবে কথাবার্তা বললেও রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ বা উদেযাগ আসছে না। তাতে মানুষের হতাশা তো বাড়ছেই, একটু আতঙ্কগ্রস্তও হয়ে পড়ছে সবাই।  দেশে দুটি বড় পক্ষ তৈরি হয়েছে সক্রিয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে। সমস্যাটা বড় হয়ে উঠেছে এ কারণে যে-কোনও পক্ষই নিজ-নিজ অবস্থানের অনুকূলে জনগণকে টানতে পারছে না। এত দিনের ক্ষমতার রাজনীতির অভ্যস্ততায় দুই বড় দলেই নেতাকর্মীদের মধ্যে অর্থবিত্তের সঞ্চয় ও মোহ উভয়ই বেড়েছে। ফলে নিজ-নিজ দলীয় কর্মসূচি ও দাবি নিয়ে রাজপথে যথার্থ গণ-আন্দোলন তৈরি করার সামর্থ্য তাদের নেই বললেই চলে। বিকল্প হচ্ছে রাজপথে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে জনমনে আতঙ্ক বাড়ানো। আপাতত বিরোধী দল সে কাজই করছে। সরকারি দল হিসেবে এ পর্যায়ে আওয়ামী লীগের এ ধরনের ভূমিকায় নামার প্রয়োজন পড়ছে না। কিন্তু বিরোধী পক্ষকে মোকাবিলা করার জন্যে তারাও কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচি মাঠে আনতে পারছে না। রাজনীতির নামে প্রকাশ্যে যা ঘটতে দেখছে মানুষ তা হল ক্ষমতাপাগল কিছু ব্যক্তির দিশাহীন অপকর্মের নমুনা। তাতে মানুষ হতাশ এবং বিরক্ত। রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল বা নেতাদের ওপর মানুষের আস্থা তলানিতে ঠেকেছে। অথচ শেখ হাসিনা এ মেয়াদের শুরুতেই একেবারে রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা নিয়ে বিডিআর বিদ্রোহ-পরবর্তী পরিস্থিতি সামলেছেন। আবার মেয়াদের শেষে এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রেও তিনিই রাষ্ট্রনায়কসুলভ দৃঢ়তা দেখাচ্ছেন ও দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিচ্ছেন। দুই ক্ষেত্রেই তিনি ঝুঁকি নিয়েছেন, সাহসী ভূমিকা পালন করে চলেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হয়নি, সবটা এ মেয়াদে শেষ হবে না। এটি আসলে একটি চলমান প্রক্রিয়া। মাত্র গত মাসে হাঙ্গেরিতে ধরা পড়েছে এক নািসদোসর, যার বয়স এখন ৯৬। কিন্তু তা বলে বিচার থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছেন না তিনি। কাঠগড়ায় তোলা হবে তাকে অচিরেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশের জন্যে ইতিহাসেরই একটি উপজাত কর্তব্য, যেমন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ নািস যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দায়িত্ব তৈরি করেছে। যুদ্ধ নানা মাত্রার অপরাধ সৃষ্টি করে এবং তা নিরসনের ধরনও নানান রকম হতে পারে। তবে ব্যক্তি-অপরাধীকে সাধারণত দায় নিয়ে বিচার ও শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। কোন জাতি হয়তো সামষ্টিক অপরাধের জন্যে ক্ষমা চাইতে পারে ক্ষতিগ্রস্ত জাতির কাছে। জাপানকে কোরিয়া ও চীনের কাছে বারবার ক্ষমা চাইতে দেখছি আমরা। কিছুকাল আগে রুশ প্রেসিডেন্ট পোলিশদের বিরুদ্ধে কৃত অপরাধের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এ সবই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের জের। এ প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত আছে। আমরাও এ জন্যে আশা করেছি পাকিস্তান সরকারিভাবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের জন্যে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চাইবে।আমাদের দেশে একাত্তরে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিসংগ্রাম করলেও তারই ধারাবাহিকতায় ইতিহাসকে এগিয়ে নিতে পারেনি। যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে সদ্যস্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে অগ্রাধিকার দেওয়া সম্ভব হয়নি। তখন সরকারের সামনে প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ ছিল চারটি— ১. শত্রুর দখলমুক্ত সদ্যস্বাধীন দেশে প্রশাসনিক কাঠামো ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ২. সংবিধান প্রণয়ন ও তার আওতায় সরকারের আইনগত বৈধতা প্রতিষ্ঠা ৩. যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন এবং ৪. এক কোটি শরণার্থীকে ফেরত আনা ও পুনর্বাসন। বঙ্গবন্ধু দ্রুত এ চারটি দায়িত্ব পালনে হাত দিয়েছিলেন এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু বিজয় বা স্বাধীনতা রাজনৈতিক কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যেও যে আরও অনেক বেশি দায়িত্ব নিয়ে আসে সেটা যেন তার সহকর্মীদের বোঝাতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধপরিস্থিতি এক ধরনের উচ্চাভিলাষী মানুষ তৈরি করে যাদের সামলানোর কৌশল প্রয়োগ করতে পারেননি তিনি। তৃতীয়ত, দল ও দলনিরপেক্ষভাবে তখন যারা নিঃস্বার্থভাবে দেশ গঠনে কাজ করতে চেয়েছিলেন তাদের জন্যও কাজের সুযোগ তৈরি করতে পারেননি। চতুর্থত, যুদ্ধপরবর্তী ভাবাবেগপূর্ণ পরিস্থিতিতে চরমপন্থা ও চক্রান্তের পথও সুগম হয় যা তার নেতৃত্ব বা প্রশাসন যথাযথভাবে সামলাতে পারেনি। আর তার মৃত্যুতে এবং তার আগে থেকে দূরদর্শী নেতা তাজউদ্দিন নিষ্ক্রিয় ও পরে নিহত হওয়ায় চলমান রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ।তখন দেশে প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, সিপিবি ও অন্যান্য সমমনা দল বাকশালের অংশীদার হয়ে কিছুটা জনবিচ্ছিন্ন, জাসদ গোলকধাঁধার ভ্রান্তি-চক্রান্তে পড়ে হীনবল। ফলে আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করে এবং সরকারি দমনপীড়নের চাপে রেখেই জিয়াউর রহমান ভস্ম থেকে পাকিস্তানকে পুনরুদ্ধার করার রাজনীতি শুরু করেছিলেন। তারই উপজাত এরশাদ, পুনরুজ্জীবিত জামায়াত আর বিভিন্ন ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দল। জিয়া এরও চেয়ে ভয়ঙ্কর যে-কাজটি করতে সক্ষম হয়েছেন, তা হল মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, বাঙালির চিরায়ত মানবতার সংস্কৃতি, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতি ইত্যাদি বাংলাদেশের অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক উপদানগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কাজে অনেক বুদ্ধিজীবী পেশাজীবীকে সংঘবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। সেই থেকে বাংলাদেশ চলছে দুই রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে। দেশের বুদ্ধিজীবী ও নাগরিকসমাজ সঠিক ভূমিকা নিতে না-পারায় এই বিভাজন ঐতিহাসিক সত্যে পরিণত হয়েছে।তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ ফাটল বন্ধ করার ঔষধ নয়। এ হল সন্তর্পণে ফাটল পেরুনোর নির্বাচনি বৈতরণী বিশেষ। কিন্তু ফাটল বাড়ছে। এবং তাতে কিছু নতুন বাস্তবতাও তৈরি হয়েছে।যেভাবে জেনারেল জিয়া ভস্ম থেকে পাকিস্তানের বীজ তুলে এনেছিলেন তেমনি এবারে শেখ হাসিনা প্রায় নির্বাপিত ভস্ম থেকে বাংলাদেশের প্রাণবীজের স্ফুলিঙ্গ তুলে আনার চেষ্টা করছেন। তিনি কেবল বঙ্গবন্ধুর খুনি বা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারেই নামেননি, আইএসআইয়ের ঘাঁটি বন্ধ করেছেন, পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস শুদ্ধির প্রয়াস নিয়েছেন, সমাজে অসাম্প্রদায়িক মানবতার বাতাবরণ তৈরির চেষ্টা করছেন। এ কাজ দীর্ঘমেয়াদি, সময়সাপেক্ষ। কিন্তু এদিকে দেখতে দেখতে নির্বাচনের সময় এসে হাজির। শেখ হাসিনা এবং তার অনুসারীরা ত্রিশংকু অবস্থায় পড়েছেন।নির্বাচনে সব দলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে হবে। তাতে বিদ্যমান বাস্তবতায় যুদ্ধাপরাধী বা একুশে আগস্টের হামলাকারীদের ঠেকানো গেলেও তার পেছনের রাজনৈতিক শক্তিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া, এমনকী জনগণ চাইলে জয়ী হওয়া থেকেও, ঠেকানো যাবে না। বিকল্প পথ ছিল একাত্তরের চেতনায় জাতিকে, বিশেষত তরুণ সমাজকে, ঐক্যবদ্ধ করে গণজোয়ার, গণআন্দোলন সৃষ্টি করে তার পটভূমিতে নির্বাচনে যাওয়া— অনেকটা ১৯৭০ এর মতো। তবে ক্ষমতায় থেকে এবং দলীয় ক্যাডারবাহিনীকে লাগামছাড়া ভোগদখলের সুযোগ দিয়ে তা সম্ভব কিনা সে প্রশ্ন ওঠা সঙ্গত।এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের যে-দুর্বলতাটি প্রকাশ পাচ্ছে তা হল, বাংলাদেশকে পুনরুদ্ধারের কঠিন সংগ্রামে তিনি নিজের দলকে সঙ্গে নিতে পারেননি। আওয়ামী লীগের শক্তি তার সাংগঠনিক ভিত, এই দফায় শেখ হাসিনা তার প্রশ্রয় ও প্রসাদ বিতরণে ব্যক্তিগত খেয়ালের ওপর এতটাই নির্ভর করেছেন যে তাতে দলের সাংগঠনিক কাঠামো ও শক্তি উভয়ই ক্ষয় পেয়েছে, দুর্বল হয়েছে। তার জন্যে এটুকু আশ্বাস হয়তো দেওয়া যায় যে, এতদ্সত্ত্বেও তুলনায় বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি এখনও দুর্বল।কিন্তু এত কথার পরে যে-কথাটা বলা দরকার তা হল, দেশের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক সমাজ তলে-তলে দুটি যুযুধান শিবিরে বিভক্ত, কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠান। তার পক্ষে নানা উপদলে-কোন্দলে বিভক্ত সন্ত্রাস-সংহারে মত্তপ্রায় দুটি শিবিরের ক্ষমতার লড়াইকে  নেহায়েত নির্বাচনি কর্মকাণ্ডে সীমিত রাখা সম্ভব হবে কি? মানুষ এসব নিয়েও ভাবিত, শঙ্কিত এবং সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে হতাশ ও আতঙ্কিত। 

Tuesday, September 3, 2013

দুই নেত্রীর সামনে ইতিহাস সৃষ্টির সুযোগ

আবুল মোমেন
কঠিন সময় মানেই দুঃসময় এমন ভাবা ঠিক নয়। কঠিন সময়ই নেতৃত্বগুণের পরিচয় দেওয়ার উপলক্ষ তৈরি করে দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রায় আজীবন কঠিন সময়েই জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এভাবেই তিনি একজন দলীয় কর্মী থেকে জাতির জনক, শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধুতে উন্নীত হয়েছিলেন।
নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন আমাদের দুই নেত্রীকে দেশের রাজনীতির রঙ্গমঞ্চের দুই প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছিল। তারা সেদিন নেতৃত্বগুণের পরিচয় দিয়েছিলেন নাগরিক সমাজ ও জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে তিন জোটের রূপরেখা গ্রহণ করে। এর ফলে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে ও দেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে।
একানব্বই থেকে গণতন্ত্রের পথে আমাদের যাত্রা শুরু হলেও রাজনৈতিক সংকট আমাদের পিছু ছাড়ে নি। মুক্তিযুদ্ধ যে-রাজনীতির সমাধি রচনা করেছে বলে ভাবা হয়েছিল তার পুনরুজ্জীবন ঘটে পঁচাত্তরের পরে। তার অনুঘটকের কাজ করেছেন জেনারেল জিয়া। তবে কাজটা সম্ভব হওয়ার কারণ রাষ্ট্রের উত্তরণ ঘটলেও সমাজের রূপান্তর ঘটাতে পারি নি আমরা। আজ দুই নেত্রী জনগণের প্রধান দুই মতাদর্শের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যা জাতীয় জীবনে ও নাগরিক সমাজে বিবদমান প্রতিপক্ষতা লালন করছে। একটু পরিষ্কার করে যদি বলি, তো বলা যায় আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাঙালি জাতীয়তার ভাবাদর্শের নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং বিএনপি মুসলিম ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের নেতৃত্বে রয়েছে। এর সরল ব্যাখ্যা এ-ও হবে, আওয়ামী লীগ বায়ান্ন থেকে একাত্তরের তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতি করছে আর বিএনপি পাকিস্তানি ভাবধারার রাজনীতির নেতৃত্ব দিচ্ছে। উভয় মতাদর্শের পিছনে থেকে দেশের সচেতন মানুষ, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিক, নারী-ছাত্র সকলেই এই বিভাজনে শরিক হয়ে পড়ছেন। এই বিবদমান রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে হিসেবে চিহ্নিত হয়ে পড়ায় দুই দল বা তাদের নেতৃত্বাধীন দুই জোটের পক্ষে সমঝোতায় আসা কঠিন।
আবার ভাবাদর্শিক পার্থক্য ছাড়াও যুদ্ধাপরাধ ও তাদের বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি, বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যা এবং হত্যাকারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং সর্বশেষ ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মত ঘটনা দুই দলে সমঝোতা, এমনকি দুই নেত্রীর মধ্যে বৈঠকও অসম্ভব করে তুলেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে প্রায় সমশক্তির দুটি পক্ষের নেত্রী তাঁরা।
দুই নেত্রী রাজনীতিতে রয়েছেন তিরিশ বছর। এর মধ্যে তাঁরা কখনও দেশ বা জাতীয় কোন ইস্যু নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসেন নি। দিনে  দিনে পারস্পরিক দূরত্ব বেড়েছে এবং তা কমার সম্ভাবনা আপাতত নেই। তারও চেয়ে বড় কথা হল, তাঁরা দু’জন বসলেও তা থেকে গ্রহণযোগ্য কোন ফলাফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ইতিহাস আমাদের জন্যে এরকম এক কঠিন সময় তৈরি করেছে। 
যেসব জাতি ও দেশ উন্নত হয়ে আজকের বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং শাসনব্যবস্থা ও নাগরিক জীবনে ধর্মের ভূমিকার বিষয়ে সকল তর্ক-বিতর্ক, এমনকি হানাহানির অবসান ঘটিয়েছে বহুকাল আগে। এ বিষয়ে নিষ্পত্তি করেই তারা রেনেসাঁস থেকে শিল্প বিপ্লবের ফসল কাজে লাগিয়ে উন্নত জীবনের সূচনা করেছে। এটি ধর্মবিরোধী পথ নয়, রাষ্ট্র ও নাগরিক জীবনকে ধর্মনিরপেক্ষ রেখে সব সম্প্রদায়ের জন্যে সমতার ভিত্তি তৈরির পথ।
আমাদের ধারণা হয় যে শেখ হাসিনা এই পথ ধরেই এগুতে চাইছেন, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষার সাথে মেলে। কিন্তু দেশে এমন মানুষও কম নেই যারা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার রাজনীতি এগিয়ে নিতে চান। তাছাড়া সাম্প্রতিককালে ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান, সম্প্রতি লিবিয়া এবং বহুকাল ধরে প্যালেস্টাইনে উন্নত পশ্চিমা বিশ্ব যে ভূমিকা পালন করেছে বা করছে তাতে সমগ্র বিশ্বের মুসলমান সমাজে একটা নতুন ধর্মীয় জাতীয়তার উন্মেষ দেখা যাচ্ছে। দেশে দেশে বহু জঙ্গি ইসলামি দলও মাথাচাড়া দিচ্ছে। এতে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার এজেণ্ডা শক্তিশালী হয়ে উঠছে এবং বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের যাত্রাপথ কঠিনতর হয়ে পড়ছে।
এর পাশাপাশি মনে রাখতে হবে সব মানুষ রাজনৈতিক দলের বিচারের ক্ষেত্রে ভাবাদর্শের মাপকাঠিকেই একমাত্র বা মুখ্য করে ধরে না। তারা দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, দলীয় আধিপত্য ও সংকীর্ণতা এবং অবশ্যই সুশাসনের অভাবের মত বিষয়কেই বিচারের মাপকাঠি হিসেবে ধরতে চায়। সেদিক থেকে তারা দুই বড় দলের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য দেখে না।
এদিকে সমাজ সংস্কার ও সমাজ পরিবর্তনের কাজ যেহেতু সেভাবে হয় নি তাই স্থবির সমাজকে অবক্ষয়ের ঘূণে ধরেছে। আজকের রাজনীতিতে অস্ত্র, কালোটাকা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার বেড়েছে। এতে বিরাজনীতিকরণ যেমন হয়েছে তেমনি রাজনীতিতে দূষণও ঘটেছে। কালোটাকার মালিকরা রাজনীতিতে জাঁকিয়ে বসেছে। আর তাতে দলীয় কোন্দল, ক্যাডারভিত্তিক দখলদারী, অবৈধ পথে বিত্ত ও ক্ষমতা অর্জনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। দীর্ঘকাল এরকম অবস্থা চলতে থাকার ফলে আমাদের সামাজিক ও ব্যক্তিক নৈতিকতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার মান অত্যন্ত নিচে নেমে গেছে। এরকম বাস্তবতায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠুভাবে চালানো কঠিন। ফলে একদিকে সংবিধান যখনতখন রদবদল করা হয়েছে আর অন্যদিকে দিনে দিনে সরকার কর্তৃত্বপরায়ন হয়ে উঠেছে।
রাজনীতিতে নীতি-আদর্শের জায়গা কমে যাওয়ায় আস্থার সংকটও বেড়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য রাখার জন্যে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল।
এতে নির্বাচন বৈতরণী পার হওয়া গেছে বটে কিন্তু কি সংসদ কি সরকার কোনটিই ঠিক মতো চলে নি। প্রতিবারই পরাজিত দল নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং বিজয়ী দল সম্পূর্ণ ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে। বিরোধী দল সংসদ বর্জন থেকে সব রকম অসহযোগিতা চালিয়ে গেছে। গণতান্ত্রিক আমলে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা বেশি হয়েছে, আদিবাসী সংখ্যালঘুদের ভোগান্তি বেড়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নির্বাচনসহ অচলাবস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রমিক, কৃষকসহ মেহনতি মানুষের পক্ষে কথা বলার সংগঠন ও নেতা কমেছে। ছাত্র সংগঠনের অবক্ষয় সর্বনিু পর্যায়ে নেমে গেছে।
কিন্তু তারপরও গণতন্ত্রই ভরসা। প্রথমত, অন্য কোন ভালো বিকল্প নেই; দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্রে সংশোধন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতায়নের সুযোগ থাকে।
সামনে নির্বাচন, গণতন্ত্রকে সচল রাখতে হলে সেটি সুসম্পন্ন করতে হবে। এ নিয়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, সংকট গভীর হচ্ছে। ফলে প্রথম কথায় ফিরে গিয়ে বলতে হবে - এখনই সময় নেতৃত্বগুণের পরিচয় দেওয়ার। কিন্তু আপাতত দুই নেত্রী নিজ নিজ অবস্থানে অটল, ছাড় দিতে নারাজ। অথচ ইতিহাস তাঁদের সামনে ইতিহাস সৃষ্টির সুযোগ এনে দিয়েছে।
আমার ধারণা, বর্তমান অচল অবস্থায় যিনি তা নিরসনে প্রথম চালটি দেবেন তিনিই জনগণের চোখে নেতৃত্বগুণের বিচারে এক ধাপ এগিয়ে থাকবেন। কারণ পরিস্থিতি কিছু পাল্টেছে। অধিক হারে মানুষ শিক্ষার আওতায় এসেছে, উপার্জনক্ষম নারীর সংখ্যা বেড়েছে এবং হতদরিদ্র পরিবারের সংখ্যা কমেছে, মঙ্গা-দুর্ভিক্ষাবস্থা নেই বললেই চলে। এর ফলে নিজের সংসার-পরিবার-সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করার মত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তারা শান্তি ও স্থিতিশীলতা চাইবে এটাই স্বাভাবিক। ফলে সেই নেতৃত্বকে মানুষ সাধুবাদ জানাবে যিনি শান্তি-স্থিতির অনুকূলে কাজ করবেন। তাই বলব, প্রথমত, সমাজে সমঝোতা ও সৃষ্টিশীলতার পক্ষে জোরালো জনমত রয়েছে এবং দ্বিতীয়ত, সমঝোতার পথে যিনি প্রথমে পা বাড়াবেন তিনি একটু হলেও এগিয়ে থাকবেন। আমরা বিশ্বাস করি দুই নেত্রীই বিষয়টি বোঝেন।