Tuesday, September 3, 2013

দুই নেত্রীর সামনে ইতিহাস সৃষ্টির সুযোগ

আবুল মোমেন
কঠিন সময় মানেই দুঃসময় এমন ভাবা ঠিক নয়। কঠিন সময়ই নেতৃত্বগুণের পরিচয় দেওয়ার উপলক্ষ তৈরি করে দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রায় আজীবন কঠিন সময়েই জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এভাবেই তিনি একজন দলীয় কর্মী থেকে জাতির জনক, শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধুতে উন্নীত হয়েছিলেন।
নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন আমাদের দুই নেত্রীকে দেশের রাজনীতির রঙ্গমঞ্চের দুই প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছিল। তারা সেদিন নেতৃত্বগুণের পরিচয় দিয়েছিলেন নাগরিক সমাজ ও জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে তিন জোটের রূপরেখা গ্রহণ করে। এর ফলে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে ও দেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে।
একানব্বই থেকে গণতন্ত্রের পথে আমাদের যাত্রা শুরু হলেও রাজনৈতিক সংকট আমাদের পিছু ছাড়ে নি। মুক্তিযুদ্ধ যে-রাজনীতির সমাধি রচনা করেছে বলে ভাবা হয়েছিল তার পুনরুজ্জীবন ঘটে পঁচাত্তরের পরে। তার অনুঘটকের কাজ করেছেন জেনারেল জিয়া। তবে কাজটা সম্ভব হওয়ার কারণ রাষ্ট্রের উত্তরণ ঘটলেও সমাজের রূপান্তর ঘটাতে পারি নি আমরা। আজ দুই নেত্রী জনগণের প্রধান দুই মতাদর্শের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যা জাতীয় জীবনে ও নাগরিক সমাজে বিবদমান প্রতিপক্ষতা লালন করছে। একটু পরিষ্কার করে যদি বলি, তো বলা যায় আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাঙালি জাতীয়তার ভাবাদর্শের নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং বিএনপি মুসলিম ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের নেতৃত্বে রয়েছে। এর সরল ব্যাখ্যা এ-ও হবে, আওয়ামী লীগ বায়ান্ন থেকে একাত্তরের তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতি করছে আর বিএনপি পাকিস্তানি ভাবধারার রাজনীতির নেতৃত্ব দিচ্ছে। উভয় মতাদর্শের পিছনে থেকে দেশের সচেতন মানুষ, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিক, নারী-ছাত্র সকলেই এই বিভাজনে শরিক হয়ে পড়ছেন। এই বিবদমান রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে হিসেবে চিহ্নিত হয়ে পড়ায় দুই দল বা তাদের নেতৃত্বাধীন দুই জোটের পক্ষে সমঝোতায় আসা কঠিন।
আবার ভাবাদর্শিক পার্থক্য ছাড়াও যুদ্ধাপরাধ ও তাদের বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি, বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যা এবং হত্যাকারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং সর্বশেষ ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মত ঘটনা দুই দলে সমঝোতা, এমনকি দুই নেত্রীর মধ্যে বৈঠকও অসম্ভব করে তুলেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে প্রায় সমশক্তির দুটি পক্ষের নেত্রী তাঁরা।
দুই নেত্রী রাজনীতিতে রয়েছেন তিরিশ বছর। এর মধ্যে তাঁরা কখনও দেশ বা জাতীয় কোন ইস্যু নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসেন নি। দিনে  দিনে পারস্পরিক দূরত্ব বেড়েছে এবং তা কমার সম্ভাবনা আপাতত নেই। তারও চেয়ে বড় কথা হল, তাঁরা দু’জন বসলেও তা থেকে গ্রহণযোগ্য কোন ফলাফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ইতিহাস আমাদের জন্যে এরকম এক কঠিন সময় তৈরি করেছে। 
যেসব জাতি ও দেশ উন্নত হয়ে আজকের বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং শাসনব্যবস্থা ও নাগরিক জীবনে ধর্মের ভূমিকার বিষয়ে সকল তর্ক-বিতর্ক, এমনকি হানাহানির অবসান ঘটিয়েছে বহুকাল আগে। এ বিষয়ে নিষ্পত্তি করেই তারা রেনেসাঁস থেকে শিল্প বিপ্লবের ফসল কাজে লাগিয়ে উন্নত জীবনের সূচনা করেছে। এটি ধর্মবিরোধী পথ নয়, রাষ্ট্র ও নাগরিক জীবনকে ধর্মনিরপেক্ষ রেখে সব সম্প্রদায়ের জন্যে সমতার ভিত্তি তৈরির পথ।
আমাদের ধারণা হয় যে শেখ হাসিনা এই পথ ধরেই এগুতে চাইছেন, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষার সাথে মেলে। কিন্তু দেশে এমন মানুষও কম নেই যারা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার রাজনীতি এগিয়ে নিতে চান। তাছাড়া সাম্প্রতিককালে ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান, সম্প্রতি লিবিয়া এবং বহুকাল ধরে প্যালেস্টাইনে উন্নত পশ্চিমা বিশ্ব যে ভূমিকা পালন করেছে বা করছে তাতে সমগ্র বিশ্বের মুসলমান সমাজে একটা নতুন ধর্মীয় জাতীয়তার উন্মেষ দেখা যাচ্ছে। দেশে দেশে বহু জঙ্গি ইসলামি দলও মাথাচাড়া দিচ্ছে। এতে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার এজেণ্ডা শক্তিশালী হয়ে উঠছে এবং বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের যাত্রাপথ কঠিনতর হয়ে পড়ছে।
এর পাশাপাশি মনে রাখতে হবে সব মানুষ রাজনৈতিক দলের বিচারের ক্ষেত্রে ভাবাদর্শের মাপকাঠিকেই একমাত্র বা মুখ্য করে ধরে না। তারা দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, দলীয় আধিপত্য ও সংকীর্ণতা এবং অবশ্যই সুশাসনের অভাবের মত বিষয়কেই বিচারের মাপকাঠি হিসেবে ধরতে চায়। সেদিক থেকে তারা দুই বড় দলের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য দেখে না।
এদিকে সমাজ সংস্কার ও সমাজ পরিবর্তনের কাজ যেহেতু সেভাবে হয় নি তাই স্থবির সমাজকে অবক্ষয়ের ঘূণে ধরেছে। আজকের রাজনীতিতে অস্ত্র, কালোটাকা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার বেড়েছে। এতে বিরাজনীতিকরণ যেমন হয়েছে তেমনি রাজনীতিতে দূষণও ঘটেছে। কালোটাকার মালিকরা রাজনীতিতে জাঁকিয়ে বসেছে। আর তাতে দলীয় কোন্দল, ক্যাডারভিত্তিক দখলদারী, অবৈধ পথে বিত্ত ও ক্ষমতা অর্জনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। দীর্ঘকাল এরকম অবস্থা চলতে থাকার ফলে আমাদের সামাজিক ও ব্যক্তিক নৈতিকতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার মান অত্যন্ত নিচে নেমে গেছে। এরকম বাস্তবতায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠুভাবে চালানো কঠিন। ফলে একদিকে সংবিধান যখনতখন রদবদল করা হয়েছে আর অন্যদিকে দিনে দিনে সরকার কর্তৃত্বপরায়ন হয়ে উঠেছে।
রাজনীতিতে নীতি-আদর্শের জায়গা কমে যাওয়ায় আস্থার সংকটও বেড়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য রাখার জন্যে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল।
এতে নির্বাচন বৈতরণী পার হওয়া গেছে বটে কিন্তু কি সংসদ কি সরকার কোনটিই ঠিক মতো চলে নি। প্রতিবারই পরাজিত দল নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং বিজয়ী দল সম্পূর্ণ ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে। বিরোধী দল সংসদ বর্জন থেকে সব রকম অসহযোগিতা চালিয়ে গেছে। গণতান্ত্রিক আমলে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা বেশি হয়েছে, আদিবাসী সংখ্যালঘুদের ভোগান্তি বেড়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নির্বাচনসহ অচলাবস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রমিক, কৃষকসহ মেহনতি মানুষের পক্ষে কথা বলার সংগঠন ও নেতা কমেছে। ছাত্র সংগঠনের অবক্ষয় সর্বনিু পর্যায়ে নেমে গেছে।
কিন্তু তারপরও গণতন্ত্রই ভরসা। প্রথমত, অন্য কোন ভালো বিকল্প নেই; দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্রে সংশোধন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতায়নের সুযোগ থাকে।
সামনে নির্বাচন, গণতন্ত্রকে সচল রাখতে হলে সেটি সুসম্পন্ন করতে হবে। এ নিয়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, সংকট গভীর হচ্ছে। ফলে প্রথম কথায় ফিরে গিয়ে বলতে হবে - এখনই সময় নেতৃত্বগুণের পরিচয় দেওয়ার। কিন্তু আপাতত দুই নেত্রী নিজ নিজ অবস্থানে অটল, ছাড় দিতে নারাজ। অথচ ইতিহাস তাঁদের সামনে ইতিহাস সৃষ্টির সুযোগ এনে দিয়েছে।
আমার ধারণা, বর্তমান অচল অবস্থায় যিনি তা নিরসনে প্রথম চালটি দেবেন তিনিই জনগণের চোখে নেতৃত্বগুণের বিচারে এক ধাপ এগিয়ে থাকবেন। কারণ পরিস্থিতি কিছু পাল্টেছে। অধিক হারে মানুষ শিক্ষার আওতায় এসেছে, উপার্জনক্ষম নারীর সংখ্যা বেড়েছে এবং হতদরিদ্র পরিবারের সংখ্যা কমেছে, মঙ্গা-দুর্ভিক্ষাবস্থা নেই বললেই চলে। এর ফলে নিজের সংসার-পরিবার-সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করার মত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তারা শান্তি ও স্থিতিশীলতা চাইবে এটাই স্বাভাবিক। ফলে সেই নেতৃত্বকে মানুষ সাধুবাদ জানাবে যিনি শান্তি-স্থিতির অনুকূলে কাজ করবেন। তাই বলব, প্রথমত, সমাজে সমঝোতা ও সৃষ্টিশীলতার পক্ষে জোরালো জনমত রয়েছে এবং দ্বিতীয়ত, সমঝোতার পথে যিনি প্রথমে পা বাড়াবেন তিনি একটু হলেও এগিয়ে থাকবেন। আমরা বিশ্বাস করি দুই নেত্রীই বিষয়টি বোঝেন।