Friday, July 5, 2013

কীভাবে গণতন্ত্রের পথ খোলা রাখা যায়?

আবুল মোমেন


দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা সামনে আরও বাড়বে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের ইতিহাস বলে এর সাথে পাল্লা দিয়ে সংঘাত-সহিংসতাও বাড়বে। এর ভিতর দিয়েও নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কি সচল থাকবে - শুধু এ প্রশ্নেই নাগরিকদের উদ্বেগ ও শংকা ঘুরপাক খাচ্ছে না। নাগরিকদের এমনকি ভাবতে হচ্ছে নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ফল কি হতে পারে? ইউরোপে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক পথেই হিটলারের নাৎসি দল ক্ষমতায় এসেছিল। বাস্তবতা বলছে এদেশে সেরকম একটি আশংকা তৈরি হয়েছে। জামায়াতে ইসলামি কি নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক দল? গণতান্ত্রিক নীতি-আদর্শ কি তারা মানে? হেফাজতে ইসলাম বা এরকম ধর্মভিত্তিক আরও সংগঠন আছে যারা সাধারণভাবে গণতান্ত্রিক নীতি-আদর্শে বিশ্বাসী নয়, আর দেশের সংবিধানে ঘোষিত মূল নীতি-আদর্শের প্রতিও আস্থা পোষণ করে না। তারা সকলেই এখন আওয়ামী বিরোধী অবস্থান থেকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটে ভিড়ে গেছে।
সমস্যা আরও গভীর হয়েছে, কারণ আওয়ামী লীগ সরকারে থেকে যেভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে, ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা দেখিয়ে যাচ্ছে তাতে এ দলের মধ্যে ফ্যাসিবাদী মনোভাবের প্রকাশ দেখতে পান অনেকেই। অনেকের আশংকা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী আচরণ আরও প্রকট হবে।
এ অবস্থায় দেশপ্রেমিক সচেতন মানুষমাত্রই দেশের ভবিষ্যত নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে উঠছে - দেশ দুটি রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তাই যেমন জেনারেল এরশাদ ও জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা বিএনপির ছাতার নিচে সমবেত হচ্ছে তেমনি এতকালের জামায়াত বিরোধী হিসেবে পরিচিত হেফাজতসহ ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলো নিজেদের মধ্যেকার মৌলিক ধর্মীয় বিভেদ ও বিবাদ চাপা দিয়ে দেশীয় রাজনীতির বিভেদ-বিবাদকে প্রাধান্য দিয়ে বিএনপির ছাতার নিচে সমবেত হচ্ছে।
বিপরীতে দেশের বাম ও মধ্যপন্থী অনেক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সাথে জোটবদ্ধ হয়েছে। দেশের রাজনীতির এই দ্বিমুখী বিভাজন সাধারণভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়। কিন্তু দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রমাণ করেছে তাদের কাছে মূল বিবেচ্য বিষয় ক্ষমতা। ক্ষমতার জন্যে আদর্শ ও নীতি বিসর্জন দিতে তারা কুণ্ঠিত হয় না। এই প্রেক্ষাপটে নির্দলীয় সচেতন মানুষের একটা বড় অংশ দুই বড় দলকে একই কাতারে রাখতে চান, বা বলতে চান, তারা মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। আরেক দল জামায়াত ও ধর্মান্ধ দলগুলোর মুক্তিযুদ্ধসহ জাতীয় বিকাশের অন্যান্য ক্ষেত্রে ভূমিকা বিবেচনায় নিয়ে তাদের মদদদাতা হিসেবে বিএনপি ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সম্পর্কে সতর্ক থাকতে চান।
মানতেই হবে স্বাধীনতার পরে রাজনীতির অবক্ষয় হয়েছে - দুই বড় দল যুগপৎ এর শরিক ও শিকার। এর পরিণতি হিসেবে দেশের রাজনীতিতে কালো টাকা, অবৈধ অস্ত্র, বেপরোয়া কর্মকাণ্ড আর চরম সুবিধাবাদের নানা নজির দেখতে দেখতে মানুষ হতাশ এবং আতঙ্কিত।
এর প্রতিবিধান হিসেবে বিয়োগ-দুই তত্ত্বে কাজ হবে বলে মনে করি না। সেটাও একটা জবরদস্তির পথ। এও বুঝি, একটি নির্বাচিত সরকারের মেয়াদের উপান্তে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন যখন আসন্ন তখন দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের কথা বলেও লাভ নেই।
সমস্যার আশু সমাধানের দুটিমাত্র পথ খোলা আছে - দুই বড় দল আলোচনায় বসে সমাধানের ফর্মুলা বের করা অথবা দুই বড় দলের নেতৃত্বে জাতির বিভক্তি, যার পরিণতি সম্পর্কে আগাম কোনো পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়। শুধু এটুকু বলতে পারি, সমাধানের জন্যে যে দল প্রথম উদ্যোগ নেবে, কিছু ছাড় দেবে, প্রয়োজনে উদারতা দেখাবে তারাই লাভবান হবে। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ পরিণতি হবে গৃহযুদ্ধ।
এই সর্বনাশা পরিণতি এড়ানোর জন্যে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে গণতান্ত্রিক নীতি-আদর্শ সমুন্নত ও এ প্রক্রিয়া সচল রাখার জন্যে ধারাবাহিক ফলপ্রসূ কাজ হওয়া দরকার। আলোচনার পরিবেশই পারে বিবাদ ও বিভেদের নিম্নচাপ দূর করতে। সেটাই গণতন্ত্রের পথ। তাই কীভাবে গণতন্ত্রের পথ খোলা রাখা যায় সকল পক্ষকে আজ সে কথাই ভাবতে হবে।