Thursday, February 19, 2015

চট্টগ্রাম মাতৃভাষা সংগ্রামেও পিছিয়ে ছিল না

আবুল মোমেন

ভাষা আন্দোলনের মাসে ভাষার কথায় আসা যাক। এ প্রজন্মের তরুণদের জানা প্রয়োজন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রামের ভূমিকা অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল। ঢাকার পাশাপাশি একই সময়ে চট্টগ্রামেও গঠিত হয়েছিল ভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এ পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন তখনকার তরুণ বামপন্থী কবি ও সংস্কৃতিকর্মী মাহবুবউল আলম চৌধুরী। যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন যুবলীগের সংগঠক ও পরবর্তীকালে বিখ্যাত শ্রমিক নেতা  চৌধুরী হারুনর রশিদ। এ সময় এ আন্দোলনে বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন যুবলীগের তরুণ কর্মীরা।
এই সাথে মনে রাখতে হবে সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের দাবি নিয়ে ভাষা আন্দোলনে শরিক হয়েছিল তমদ্দুন মজলিশও। এর দুই শীর্ষনেতা, পরবর্তীকালে বাংলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ আবুল কাশেম এবং তরুণছাত্র ও পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ১৯৬৬ সনে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় অকালপ্রয়াত ড. মাহফুজুল হকও ছিলেন চট্টগ্রামের মানুষ।
বায়ান্নর একুশে ফেব্র“য়ারি ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ ও অসংখ্য ছাত্র হতাহত হওয়ার খবর শুনে চট্টগ্রাম বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। পরের দিন বাইশে ফেব্র“য়ারি লালদিঘির মাঠে সভা ডাকে ভাষা সংগ্রাম পরিষদ। সেদিন রাতেই কবি মাহবুবউল আলম চৌধুরী প্রচণ্ড জ্বরের ঘোরের মধ্যে রচনা করেন একুশের প্রথম কবিতা - ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। জ্বরের প্রচণ্ডতায় তিনি নিজের হাতে লিখতে পারেন নি। মুখে মুখে বলে গেছেন আর সঙ্গী চৌধুরী হারুন তা লিখে নিয়েছিলেন। কবিতাটি দীর্ঘ, বক্তব্যপ্রধান, আবেগপ্রবণ, আবার সেই সাথে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় লক্ষ্যপূরণের দৃঢ়সংকল্পে মানুষকে উদ্দীপ্ত করতে সক্ষম। মুসলিম লীগ সরকার প্রেস থেকেই এটির মুদ্রিত কপি বাজেয়াপ্ত করে, কবিতাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং মুদ্রাকর ও প্রকাশককে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু তখন তো ভাষা আন্দোলনের আবেগ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কবিতাটি যেন ছাইচাপা আগুন। আজ এটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক সম্পদ আমাদের।
চট্টগ্রামে ধীরে ধীরে সর্বস্তরের মানুষ ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। কেবল শহরে নয় বিভিন্ন মহকুমা ও থানা শহরে স্কুল-কলেজকে কেন্দ্র করে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল আন্দোলন। সাহিত্যিক আবুল ফজল, কবিয়াল রমেশ শীল, তরুণ লেখক সুচরিত চৌধুরীসহ সর্বস্তরে এ আন্দোলনের পক্ষে মানুষ অবস্থান নিয়েছিল। অন্তত আমার জানা মতে আজও চট্টগ্রাম শহরে দু’জন ভাষা সৈনিক জীবনসায়াহ্নে উপনীত হয়ে দিনযাপন করছেন - এঁদের একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী এ কে এম এমদাদুল ইসলাম এবং অন্যজন বিশিষ্ট সমাজসেবক কৃষ্ণগোপাল সেন।
বাংলাভাষার চর্চা ও প্রসার নিয়ে চট্টগ্রামের গর্ব করার মত আরও বিষয় রয়েছে। মধ্যযুগে যখন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা স্তিমিত তখন দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ আরাকান রাজসভায় রীতিমত বাংলাসাহিত্যের রাজসিক দরবার চলছে। আলাওল, সৈয়দ সুলতান, মাগন ঠাকুর প্রমুখ তাঁদের সাহিত্য রচনা করে যাচ্ছিলেন যেগুলো আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে পড়া হয়।
শুধু সাহিত্যচর্চা নয়, ভাষার অধিকার রক্ষার জন্যে সুদূর সপ্তদশ শতাব্দীতে চট্টগ্রামের অন্তর্গত সন্দ্বীপ থেকে এক কবি বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রতিবাদী আওয়াজ তুলেছিলেন। সন্দ্বীপের সেই কবি আবদুল হাকিম রীতিমত তিরস্কার করে লিখেছিলেন - ‘ যেসব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি/ দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়/ নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়।’
তাঁর কবিতায় মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা কী তীব্র, আর এর অবহেলাকারীদের প্রতি কী কঠোর ধিক্কার না প্রকাশ পেয়েছে।
এই উত্তরাধিকার মনে রেখে আমরা যেন বর্তমানকে একবার দেখি এবং ভবিষ্যতে মাতৃভাষা সুরক্ষার জন্যে নিজেদের করণীয় ঠিক করি।

এ কোন্ পথে চলেছে ওরা?

আবুল মোমেন

নিরীহ মানুষকে হাত বেঁধে চোখ বেঁধে ছুরি দিয়ে জবাই করা কি ইসলামের শিক্ষা হতে পারে? তারা অন্য ধর্মাবলম্বী হলেও? কোনো বন্দি মুসলমানকে পুড়িয়ে হত্যা করা কি ইসলাম? শিয়াপন্থী মুসলমানের মসজিদে বোমা হামলা চালিয়ে নির্বিচারে তাদের হত্যা করা কি ধর্মসম্মত কাজ হতে পারে?
ইসলামের শিক্ষা এটা নয়। নবীজীর শিক্ষাও এটা নয়। যে প্রাচীন গোত্রভিত্তিক হানাহানি বন্ধ করার জন্যে হযরত মোহাম্মদ (স:) ইসলাম ধর্ম প্রবর্তন করেছেন এরা ঠিক সেই কাজই করছে। অর্থাৎ এক শ্রেণীর মুসলমানকে ফিরিয়ে নিচ্ছে আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে। তারা বর্বর যুগ ফিরিয়ে আনতে চাইছে। এবং তা চাইছে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে। ওরা যে কাজ করছে তা জেহাদ নয়, ধর্মযুদ্ধ নয়, শ্রেফ বর্বরতা।
বরং এদের অবিমৃষ্যকারিতার জন্যে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার আরব মুসলিম বিশ্বে হস্তক্ষেপের সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার অভাবে আজ সারা পৃথিবীর - একটি-দুটি ব্যতিক্রম ব্যতীত - মুসলিম দেশে দেশে অস্থিরতা, হানাহানি, দুর্যোগ চলছে।
এর মধ্যে ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ ছিল ব্যতিক্রম। এখানে বরাবর মানবিক ঔদার্য প্রাধান্য পেয়েছে। সুফী ও সাধকদের ধর্মীয় সহনশীলতা ও মানবপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে আমাদের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে। সে কারণে আরব বিশ্বের তুলনায় আমাদের দেশে শিক্ষা বিস্তার ঘটছে দ্রুত, স্বাস্থ্য খাতে চমকপ্রদ উন্নয়ন ঘটেছে, মানুষের গড় আয় এবং আয়ু উভয়ই বেড়েছে। আমাদের রয়েছে মুক্ত গণমাধ্যম, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার। এদেশের ভূমিজ সন্তান যারা তাদের ধর্ম যা-ই হোক সকলে বরাবর শোষণ-বঞ্চনা-দু:শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। তারই ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ, এবং এ কারণেই আমাদের অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু এদেশেও কিছু মানুষ ধর্মান্ধতার পশ্চাৎপদ চিন্তা জোর করে চাপিয়ে দিতে চায়। তারা দু:শাসক পাকিস্তানের দোসর হিসেবে হত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠনে অংশ নিয়েছে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। আর আজও নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করতে চায় বাংলাদেশের অগ্রগতি।
আমাদের মনে হয় বাংলাদেশের সচেতন মানুষের কয়েকটি বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে। প্রথমত বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু, এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মে মুসলমান এবং সাধারণজন যে কোনো মানদণ্ডে ভালো মুসলমান। তারা দেশের অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষের সাথে সহাবস্থানে     অভ্যস্ত। দ্বিতীয়ত, এদেশের মানুষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চায়, তাতে একাধিক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবে, কোনো দলের আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতা (তবে ধর্মহীনতা নয়) হলে কোনো দলের আদর্শে ধর্মীয় চেতনা (তবে ধর্মান্ধতা নয়) স্থান পেতে পারে। কিন্তু সবার লক্ষ্য হতে হবে দেশের উন্নয়ন, দেশের ভবিষ্যত। দেশের মানুষের ইচ্ছা এবং সে ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে তারা যে ইতিহাস রচনা করেছে সেটাকেও মর্যাদা দিতে হবে সবার।
তৃতীয়ত, বর্তমান বিশ্বের মুক্তবাজার বা বিশ্বায়নের চাপ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে একা থাকা যাবে না। তাহলে পিছিয়ে পড়তে হবে। আমাদের বহির্বিশ্বে বন্ধুরাষ্ট্র থাকবে, তবে লক্ষ্য রাখতে হবে দেশের সার্বভৌমত্ব যেন ক্ষুণœ না হয়। মর্যাদার হানী না হয় এবং দেশের স্বার্থও যেন বজায় থাকে। অর্থাৎ দেশ পরিচালনায় সরকারকে যেমন প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে তেমনি জনগণকেও একইভাবে পরিণত বুদ্ধির প্রমাণ দিতে হবে। সেই সাথে স্মরণ করিয়ে দেব, পশ্চিমের পুঁজিবাদী বিশ্ব সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিয়ে থাকে তাদের আর্থিক স্বার্থের ওপর। তারা ইরাক ও লিবিয়ায় আক্রমণ চালিয়েছে শুধুমাত্র নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে। সেদেশের জনগণকে চারম ভোগান্তি ও অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিতে এতটুকু কার্পণ্য তারা করে নি। একই ঘটনা ঘটছে প্যালেস্টাইন নিয়ে, আফগানিস্তান নিয়ে।
বাস্তবতা অত্যন্ত কঠিন। বস্তুত মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্যে এখন কঠিন একটি সময় যখন তাদের চরম ধৈর্য, গভীর প্রজ্ঞা এবং যথার্থ দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে। মানুষ পুড়িয়ে, অবরোধ-হরতাল করে, র‌্যাব-পুলিশ ব্যবহার করে, জেল-জুলুম অত্যাচার চালিয়ে, বিবৃতি আর মানববন্ধন করে দায় সারার চেষ্টা করলে হবে না। সমস্যাটা বুঝতে হবে দেশের এবং বৈশ্বিক পটভূমিতে, দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের নিরিখে, দেশীয় সামাজিক পটভূমিতে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতির ভিত্তিতে। এই দু:সময়ে মাথা গরম করার সুযোগ নেই, ঠাণ্ডা মাথায় সঠিক কৌশল ঠিক করেই সামনে এগুতে হবে।
আমার মনে হয় এ সময় প্রকৃত আলেম-ওলেমাদের এগিয়ে এসে ইসলামের সঠিক পথের কথা বলতে হবে। রাজনীতির ক্ষেত্রে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের পথ খুঁজে বের করতে হবে।

Sunday, February 8, 2015

জনগণের পাশে থাকলেই রাজনীতি লাভবান হবে

আবুল মোমেন

গতকাল একদিনেই পেট্রোল বোমায় পুড়ে মারা গেছেন ১০ জন। এর মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে। বিরোধী দলের ৩৪ দিনের আন্দোলনে পুড়ে ও গুলিতে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা দাঁড়াল ৮৬ জনে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিচ্ছেন অগ্নিদগ্ধ আরও ৬৬ জন। রংপুর ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে আছেন ৩২ জন দগ্ধ মানুষ।
আমি অনেককেই জানি যারা টেলিভিশনে এই বীভৎস বর্বরতার করুণ পরিণতি দেখে দেখে নিজেরা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমরা চিকিৎসকদের কাছে শুনেছি অগ্নিদগ্ধ যারা সুস্থও হচ্ছেন তাদের শারীরিক ও মানসিক পুনবার্সন এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তাদের জন্যে মানসিক চিকিৎসা সেবা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেটা আমাদের অধিকাংশ মানুষ জানেন না। এরকম রোগীর সংখ্যাও ২০০ ছাড়িয়ে গেছে।
এযাবৎ যারাই পেট্রোল বোমার শিকার হয়েছেন তারা সকলেই সমাজের নিম্নবর্গের খেটে খাওয়া মানুষ। এদের ওপর দিয়েই ‘আন্দোলনের’ মূল ঝড়টা বয়ে যাচ্ছে। এমন রাজনীতি এ দেশ আগে কখনও দেখে নি যার শিকার হবেন সাধারণ মানুষ।
দেশের অর্থনীতিও চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। স্বয়ং অর্থমন্ত্রী এবার স্বীকার করেছেন চলতি অর্থ বছরের প্রথমার্ধ ভালো কাটলেও দ্বিতীয়ার্ধে রাজনৈতিক দুর্যোগের ফলে বিপর্যয়ে পড়েছে। সব খাতের ক্ষতি যোগ করলে গত এক মাসে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এ ক্ষতির দায় ব্যাংক, বীমা, সরকার, বিনিয়োগকারীদের সাথে সাথে প্রান্তিক কৃষক ও দিনমজুরকেও বহন করতে হচ্ছে। প্রান্তিক মানুষের দিন চলছে না। পেট্রোল বোমার শিকার অনেকেই বলেছেন বাড়িতে খাবারদাবারের অভাব দেখা দেওয়ায় বাধ্য হয়ে কেউ ট্রাক নিয়ে বেরিয়েছেন, কেউবা মালবোঝাই ট্রাকে উঠেছেন, কেউ বাসের যাত্রী হয়েছেন।
অবরোধ-হরতালের নামে যা চলছে তাকে কেউ রাজনীতি বলবেন না। আবার সরকার এই কথা বলে মানুষের চরম দুর্ভোগ থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখলেও তো চলবে না। তাতে কি হতভাগ্য সাধারণ মানুষ আর দেশের নিরাপরাধ অর্থনীতি দুই অবোধ গোঁয়ার রাজনীতির শিকার হচ্ছে না? একদিকে তারা আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে আর অন্যদিকে বিরোধীদের অপরাধী কর্মকাণ্ডের বলী হওয়ায় সরকার এ বর্বরতার উশকানিদাতাদের সাথে বসতে রাজি নয়।
সরকারের বক্তব্য ভুল নয়, কিন্তু ১৯৯০-এর পরবর্তী ৪টি গ্রহণযোগ্য সাধারণ নির্বাচনের প্রাপ্ত ভোটের হিসেবে দেখা যাচ্ছে প্রধান দুই দলের সমর্থকদের সংখ্যা খুবই কাছাকাছি। ফলে অপরাধীদের পুলিশি ব্যবস্থায় শায়েস্তা করার পথে চললেও ৩টি কারণে সরকারকে আলোচনার কথা ভাবতে হবে - ১. সাধারণ মানুষকে আর আগুনে পুড়তে দেওয়া যায় না, ২. দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস হতেও দেওয়া যায় না, এবং ৩. জনগণের বড় একটি অংশকে উপেক্ষা করাও ঠিক নয়। পরবর্তী নির্বাচনে প্রথম ২টি অপকর্মের খেসারত দেবে বিরোধী দল এবং এসবের ও শেষোক্ত কাজের সুফল পাবে সরকারি দল।
মানুষ তার পাশে যাকে পায় তাকেই পছন্দ করে, ভোট দেয়। বিরোধী দল ভুল করছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার দোহাই দিয়ে সরকারও ভুল পথে হাঁটলে জনগণ কোথায় দাঁড়াবে?


Saturday, February 7, 2015

দূতিয়ালির উদ্যোগ নিতে হবে দ্রুত

আবুল মোমেন

বিবদমান দুই রাজনৈতিক দলের শীঘ্র সংলাপে বসার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। প্রধান বিরোধী জোটের ডাকা টানা অবরোধ ও দীর্ঘ হরতালের কবলে পড়ে জনজীবনে স্বাভাবিকতা নেই। আজ ৩৪ দিন ধরে এই অবস্থা চলছে। অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হয়েছে ৮৬ জন, আর আহত হয়ে মরণযন্ত্রণায় আছে তিনশতাধিক। রেল-বাস-টেম্পো-রিকসা পুড়ছে। একদিকে সাধারণ মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে অন্যদিকে এই অনাচার ও অচলাবস্থা তাদের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এ অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। এবং তা হওয়া প্রয়োজন শীঘ্র।
কিন্তু তা কীভাবে হবে? দুই প্রধান দল তো দুই বিপরীত প্রান্তে অনড় অবস্থান নিয়ে গোঁ ধরে আছে। আমি বলব এ অবস্থায় নাগরিকসমাজকে মাঠে নামতে হবে। এ অভিজ্ঞতা আমাদের জন্যে নতুন নয়। নব্বইয়ের গণঅভ্যূত্থানের চূড়ান্ত পর্যায়ে স্বৈরাশাসকের ক্ষমতা-ত্যাগ, ক্ষমতা হস্তান্তর এবং অন্তর্বতী সরকার নিয়ে দুই প্রধান জোটের ঐকমত্য তৈরির কাজটি তো নাগরিকসমাজই করেছে। তাঁদের মধ্যে প্রবীণ কয়েকজন, যেমন সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ, ব্যারিষ্টার ইশতিয়াক আহমেদ এবং আরও কয়েকজন, দুই পক্ষের সাথে আলোচনা করে উত্তরণের রূপরেখা তৈরিতে দূতিয়ালি করেছিলেন। এভাবেই সেদিন তিনজোটের ঐতিহাসিক রূপরেখা তৈরি হয়েছিল।
এ ধরনের কাজ প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে হয় না। যেসব বুদ্ধিজীবী টক-শো বা অন্যান্য মিডিয়ায় নিজেদের বক্তব্য ও অবস্থান তুলে ধরেছেন তাঁরা আর একাজের জন্যে উপযুক্ত হবেন না। এ কথা ঠিক যে টক-শো ও মিডিয়ার মোহে এদেশের বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীদের সিংহভাগ মজেছেন। তবুও মনে করি এখনও কিছু বর্ষীয়ান পেশাজীবী-বুদ্ধিজীবী আছেন যাঁরা নিজেদের বিবেকের নির্দেশনায়ই পথ চলেন। বিশেষভাবে এমন মানুষ চাই যাঁদের নিয়ে বিতর্ক নেই, যাঁদের সততা-দক্ষতায় মানুষের আস্থা থাকবে। যাঁরা অন্ধ দলবাজ তাঁরা এমন মানুষকে অপছন্দ করেন আমরা জানি। কিন্তু এখন আম জনগণের আস্থাভাজন হওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অন্ধ দলবাজরা বরাবরই সংখ্যায় অল্প। তাদের গলার আওয়াজ বড় হলেও জনসমর্থন খুবই কম।
আমাদের মনে আছে ষাটের দশকে আইয়ুব আমলে রাজনৈতিক সংকটকালে গণতন্ত্রের বাতাবরণ উন্মোচনের ক্ষেত্রে নয় নেতার বিবৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। নব্বইয়ের অভিজ্ঞতার কথা তো আগেই বলেছি।
আমরা আশা করব এবং আহ্বান জানাব, বর্ষীয়ান বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীদের কয়েকজন মিলে সমস্যা সমাধানের এক বা একাধিক ফর্মূলা নিয়ে এগিয়ে আসবেন। দেরি করা উচিত হবে না। প্রতিদিনই জনভোগান্তি বাড়ছে এবং হিংসা ও বিদ্বেষের আগুন বেড়ে চলেছে।


Friday, February 6, 2015

শাঁখের করাতে কাটা পড়ছে জনগণ

আবুল মোমেন

দুই বড় দল ক্ষমতার রাজনীতিই করে এমনটাই আমরা জানি। কিন্তু বর্তমানে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে তার পেছনে রাজনৈতিক মতাদর্শের ভূমিকা আছে বলে মনে হয়।  কেউই বিশ্বাস করবেন না যে বিএনপি-আওয়ামী লীগ আদর্শের জন্য লড়ছে। না তারা ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যেই মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এর সাথে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব মিশে গেছে। ক্ষমতার লড়াই চালিয়ে যেতে যেতে উভয় দলই এরকম ঝুঁকিপূর্ণ বাস্তবতা তৈরি করেছে। ফলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার যেমন ক্ষমতা ছাড়া বা হারানোর ঝুঁকি নিতে চায় না তেমনি বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় ফেরার মরণকামড় ছাড়তে চাইছে না।
দুই দলের এই চাপান-উতোড়ে মানুষের ভোগান্তি অবর্ণনীয় জায়গায় পৌঁছেছে - কাজকর্ম স্থবির, আয়-উপার্জনে টান, বাজার ঊর্দ্ধমুখী, আমদানি-রপ্তানি দুইই কমছে, কৃষি উৎপাদকদের সর্বনাশ হচ্ছে। সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠছে পেট্রোল বোমার ভয়াবহতা। এই নিষ্ঠুর বীভৎস দৃশ্য তাকিয়ে দেখা যায় না, সহ্যাতীত, বেদনা ও কষ্টে মোহ্যমান করে দেয়।
শিশুদের হাল্কা মারামারি কখনও বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেলে বড়রা এসে থামিয়ে দেন। সমস্যা হল বড় দুই দলকে তো নয় তাদের কাণ্ডকারখানাকেও শিশুতোষ বলা যাবে না। অনেকেই বলছেন তারা পরস্পর যুদ্ধাবস্থা চালিয়ে রাজনীতিতে অপরাধ-দুর্নীতি টেনে এনেছেন। চট করে বলা যায় দুর্নীতিযুক্ত  অপরাধপ্রবণ রাজনীতির পরিণতি এটা।
তা না হয় বলা গেল। কিন্তু মুক্তির পথ কি? বিএনপি-জামাতের এ নাশকতাময় রাজনীতির ডাকে জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়ে দাবি আদায় করে দেবেন এমনটা নিশ্চয় খোদ দলগুলোও আশা করে না। অতিষ্ঠ জনগণ সরকারের পক্ষে স্বতস্ফূর্তভাবে নামবে না। সম্ভবত বিএনপির আশা অতীতের মত সামরিক বাহিনির হস্তক্ষেপে তারা আন্দোলন সম্মানজনকভাবে থামাতে পারবে ও অচিরেই একটি অবাধ মুক্ত নির্বাচনের সুযোগ পাবে। সরকার মনে করছে পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি-আনসারসহ হাতে মওজুদ বাহিনির সাহায্যে নাশকতা দমাতে পারবে এবং এবারও সংকট উৎরানো যাবে।
জনগণের ধারণা সামরিক বাহিনি সহজে হস্তক্ষেপ করবে না, আবার জনমনে ভয় বিভিন্ন বাহিনির সাহায্যে সারাদেশে নাশকতা বন্ধ করা কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ হবে। ততদিনে জনদুর্ভোগ যে পর্যায়ে পৌঁছাবে তাতে পরিস্থিতির অবনতির আশংকা জনগণ তাড়াতে পারে না।
এ একেবারে শাঁখের করাত। দু দিকেই কাটছে। কাটছে কারণ স্বাধীনতার আগে, বিশেষত ষাটের দশকে, জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শের যে ঐক্য এবং নেতৃত্ব ও দলের প্রতি আস্থা সৃষ্টি হয়েছিল স্বাধীনতার পরে তা দিনে দিনে ক্ষয় পেয়েছে। এখন জনগণ রাজনৈতিকভাবে বেশ বিভ্রান্ত, নেতৃত্ব ও দল সম্পর্কে তাদের আস্থায় ভাঁটা চলছে। বিভ্রান্তি ও অনাস্থা জনগণের মধ্যে এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা ও ঔদাসীন্য তৈরি করে। বাংলাদেশ এই বাস্তবতার শিকার হয়েছে - রাজনীতিবিদরাই এ জন্যে দায়ি, আওয়ামী লীগ বিশেষভাবে। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলের তো নিরংঙ্কুশ জনপ্রিয়তা ভোগ করে যাওয়ার কথা অন্তত কুড়ি বছর। ষড়যন্ত্র হয়েছে সত্য, কিন্তু নেতৃত্ব ও দলও জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারে নি - সেটাও বুঝতে হবে।
ভ্রম সংশোধনের একটি চেষ্টা হয়েছিল বাকশাল গঠনের মাধ্যমে, কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে, তার আগেই জাতি বিভক্ত হয়ে পড়েছে, ফলে এই উদ্যোগের সমালোচনা আজ অবধি চলছে। ২০০৮ সনে ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা আরেকবার পুরোনো ভ্রান্তি থেকে তাঁর দল ও দেশকে বের করে আনার কথা ভেবেছেন। কিন্তু মনে হচ্ছে ষাটের দশকের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগাচ্ছেন না তিনি। তখনও নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ থাকলেও অন্যান্য সমমনা দল, গোষ্ঠী, নাগরিকসমাজের ভূমিকা ছিল স্বাধীন, স্বতস্ফূর্ত এবং রাজনীতির পরিপূরক। এখন যেন নেতৃত্ব এবং দলীয় প্রাধান্য প্রকট, সর্বত্র দলীয়করণের ছাপ পড়ে গেছে। এভাবে নাগরিকসমাজের স্বাধীনতা, স্বতস্ফূর্ততা এবং সর্বোপরি মর্যাদা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাজনৈতিক দল যেমন মানুষের আস্থা হারিয়েছে তেমনি আস্থা ও মর্যাদা হারিয়েছে নাগরিকসমাজও। একই অবস্থা পেশাজীবী গোষ্ঠীসমূহের। এই পরিণতি ঘটেছে রাজনৈতিক দল ও নাগরিকসমাজের যোগসাজশেই। কিন্তু এতে কেউই লাভবান হয় নি, কিন্তু ব্যক্তির নানা পদ-পদবী পুরস্কার-স্বীকৃতি লাভ হয়েছে হয়ত। বিপরীতে সংকটকালে দেশকে রক্ষা করার মত কোনো মানুষ থাকল না দেশে। একটি জাতি ও দেশের জন্যে এ হল চরম সর্বনাশা পরিণতি। জনগণের জন্যে এ যেন ভোঁতা ছুরিতে জবাই হওয়ার প্রাণান্তকর অভিজ্ঞতা। ফলে এ তো দীর্ঘমেয়াদী হওয়াই স্বাভাবিক।
এত হতাশার মধ্যেও একটা আশার কথা বলতে চাই। মানবসমাজে কখনও সব সম্ভবনা শেষ হয়ে যায় না। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার, এমনকি উত্তরণের প্রয়াসে কত সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটে। গত সিকি শতাব্দীর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা-অস্থিরতার মধ্যেও দেশের মানুষ উৎপাদন বাড়িয়েছে বিস্ময়কর গতিতে, বিভিন্ন সামাজিক সূচকে চমকপ্রদ সাফল্য এনেছে, এমনকি এর মধ্যেই প্রবৃদ্ধিও ছয় শতাংশের কাছাকাছি ধরে রেখেছে। ফলে এই মানুষের ওপর আস্থা রাখা যায়।
সাধারণ মানুষ কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী, তারা অনবরত কাজ করেই চলে বলে এত হরতাল-অবরোধ-নাশকতার মধ্যেও দেশ এবং জীবন একভাবে চলে যাচ্ছে। এত অনিশ্চয়তা-অস্থিরতার মধ্যেও বৈদেশিক মুদ্রার মওজুদ বেড়েছে, প্রবৃদ্ধির মাত্রাও ঠিক আছে। কাজে বিশ্বাস করার অর্থ হল ফলে বিশ্বাস করা  - অর্থাৎ ফলপ্রসূ কাজ হওয়া চাই। রাজনীতিবিদরা প্রচুর কথা বলেন, সে তুলনায় কাজ কম করেন। ফলপ্রসূ কাজ আরও কম। নিস্ফলা বাগাড়ম্বরে জনগণের আস্থা নেই। এভাবে অনেক দিন ধরেই চলতে থাকায় জনগণ রাজনীতি ও রাজনীতিবিদে আস্থা হারিয়েছে। কথামালার রাজনীতি নাগরিকসমাজকেও গিলে ফেলেছে - তাঁরা এখন গণমাধ্যমে কথায় মশগুল। এতে জনগণ বেশ বিরক্ত।
দুই দলের দুই রাজনীতির মধ্যে, আমার ধারণা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতির প্রতি নবপ্রজন্মসহ অধিকাংশ মানুষের আকর্ষণ আছে। কিন্তু এ রাজনীতির প্রতিভূ হয়ে বিরাজমান আওয়ামী লীগ তাদের সেভাবে আকৃষ্ট করতে পারে না, পারছে না তাদের আস্থা অর্জন করতে। অপরপক্ষের দুর্দশা আরেকটু বেশি - তাদের সমর্থক ও ভোটার আছে, কিন্তু সংগঠন ও কর্মী নেই। ফলে তাদের আন্দোলন ভাড়াটে নাশকতাকারীদের হাতে চলে গেছে। এ কারণেই সরকার মনে করতে পারছে যে সরকারি বাহিনি দিয়েই এই অপকর্মভিত্তিক রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ করা সম্ভব হবে।
হয়ত হবে। কিন্তু তাতে এই ধারার রাজনীতি বন্ধ হবে না। মুসলিম লীগের ভরাডুবি, এমনকি বিলুপ্তির পরে বিএনপির উত্থান সম্ভব হয়েছে। এমনকি জামাতের সমর্থকও দেশে রয়েছে। ফলে জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলা এবং নাগরিকসমাজকেও স্বাধীনভাবে ভূমিকা পালনের সুযোগ দেওয়া জরুরি। সেভাবে যে রাজনৈতিক জাগরণ সম্ভব, জাগ্রত জনতার যে ঐক্য সম্ভব তা জাতিকে উত্তরণের পুষ্টি দেবে, প্রেরণা দেবে।
বাংলাদেশের জন্য শর্টকাট পথে সমাধান নেই, দীর্ঘমেয়াদী কাজের প্রস্তুতি নিতে হবে। নিষ্ক্রিয়তার জড়তা কাটিয়ে নাগরিকদের সরব সক্রিয় হতে হবে।