Tuesday, November 1, 2016

চরিত্রহীন সমাজের বিকৃতি

আবুল মোমেন


দিনাজপুরের নিতান্ত শিশু পাঁচ বছরের পূজার ওপর যে বর্বর অত্যাচার হয়েছে তা যে কোনো বিবেকবান মানুষকেই ঘা দিয়েছে। এক নিষ্পাপ শিশুর ওপর এমন মর্মান্তিক আঘাত এদেশে আরও অনেক হয়েছে। প্রতিবারই সচেতন মানুষ শিহরিত হয়েছেন, এবং দোষী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। তবে সময় সবকিছুকেই ভুলিয়ে দেয়, আর আমাদের মত সমস্যাসঙ্কুল সমাজে মানুষের স্মৃতি, বিবেক, দায়িত্ববোধ সবই সংকট ও সময়ের প্রহারে প্রখরতা হারিয়ে দ্রুত অসাড় হয়ে যায়। আবার কোনো বীভৎস ক্রুঢ়তা তাকে জাগিয়ে তোলে। বলা বাহুল্য সেও অল্প সময়ের জন্যে, কিংবা বলা যায় নতুনভাবে ঘুমিয়ে পড়াতেই এই জেগে ওঠার একমাত্র সার্থকতা।
শিশুটির ওপর বিকৃত যৌন আক্রমনের জন্যে অভিযুক্ত ব্যক্তি সাইফুল ইসলাম তাদের প্রতিবেশী, তিন সন্তানের জনক যাদের দুজন কন্যা সন্তান এবং তাকে অবোধ শিশুটি নিশ্চিন্তে বড় আব্বু বলে সম্বোধন করত। এ ঘটনায় নাড়া খেয়ে আমাদের দায়িত্ব সচেতনতা যদি কেবল দোষীদের পাকড়াও করার, কঠোর শাস্তি প্রদানের দাবি আর সাধারণভাবে মূল্যবোধের অবক্ষয়, তারুণ্যের দিশাহীনতা, সামাজিক অস্থিরতা ইত্যাদি লক্ষ্যহীন অসার বুলিতে শেষ হয় তবে সমাজের অবক্ষয় ও অসাড়তারই প্রমাণ মেলে।
এই অবস্থার জন্যে ঢালাওভাবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অবক্ষয়, শিক্ষা-সংস্কৃতির ব্যর্থতাকে দায়ী করা যায়। কিন্তু এতো শ্লোগান বিশেষ, যা সবাই বলছে, এবং শিখে নিয়ে সবাই বলতে সক্ষম। যে অপরাধকে পৃষ্ঠপোষকতা করে, যে স্বয়ং অপরাধকর্মে লিপ্ত হয় সকলেই এসব শ্লোগান রপ্ত করে নিয়ে এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য নষ্ট করে দেয়। এভাবে অসচেতন ও সংবেদনাহীন সমাজ মূল্য ও নৈতিকতা-নিরপেক্ষ তথা চরিত্রহীন হয়ে পড়ে।
একটা বীভৎস অপরাধের পরিচয় পেয়ে শিউরে উঠেও এ সংকটকে গভীরভাবে বুঝে নিতে হয়। সংকটটা এখানেই যে ব্যক্তির পতন ঠেকানোর জন্যে এখানে কোনো সামাজিক প্রতিরোধ নেই। যেসব প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে সামাজিক প্রতিরোধ দানা বাঁধতে পারত, যেমন প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, সংবাদপত্র, রাজনৈতিক সংগঠন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ইত্যাদি সকলই যে ভিতরে ভিতরে চরিত্রহীন হয়ে পড়েছে। সবার ওপরে কি থাকবে রাষ্ট্রযন্ত্রের গভীরে বাসা-বাঁধা দুর্নীতিগ্রস্ততা? কিন্তু কথা হল এই দূষিত বাস্তবতা আপনা আপনি আমাদের কল্পনার অভীষ্ট আদর্শ অবস্থায় তো আর পৌঁছাবে না, এর জন্যে সমস্যাকে অনুধাবন ও বিশ্লেষণ করাই প্রাথমিক দায়িত্ব। তবেই নিরাময়ের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব। সে কাজ ক্ষুদ্র পরিসরেও শুরু হতে পারে। কিন্তু শুরু হওয়াটা জরুরি।
আমাদের সমাজে দুর্বল স্থান অনেক। দারিদ্র বা অশিক্ষা হয়ত কমবে। কিন্তু সাংস্কৃতিকভাবে প্রধান তিনটি দুর্বলতা সহজে কাটবে বলে মনে হয় না। প্রথমত এ সমাজ নৈতিকভাবে দুর্বল ও আপসপ্রবণ, দ্বিতীয়ত এ সমাজ আইন ও নিয়মের প্রতি কেবল উদাসীন নয় তা অমান্য করার মধ্যে গৌরব বোধ করে এবং তৃতীয়ত এ সমাজে সুস্থ স্বাভাবিক যৌন চেতনা, রুচি ও জীবনের চর্চা হয় নি। সে অর্থে সমাজ ভিতরে ভিতরে চরিত্রহীন হয়ে পড়েছে।
এই চরিত্র-খোয়ানো সমাজ স্বাভবতই দিনকে দিন অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে - অপরাধীকে লালন করে এবং অপরাধ দমন ও নির্মূলের সকল উদ্যাগকে অকেজো করে দিয়ে। এই অবস্থায় পুরুষশাসিত সমাজে অপ্রতিহত হয়েছে পুরুষের প্রাধান্য, কোণঠাসা হয়েছে নারী। সংখ্যালঘু নারী আর কন্যাশিশু এ সমাজে খুবই দুর্বল। তাহলে সংখ্যালঘু সমাজের কন্যাশিশুর অবস্থান সমাজে সবচেয়ে দুর্বল। ইসলামে নারীর সমানাধিকার স্বীকৃত এ নিয়ে বাদানুবাদে না গিয়েও সহজেই দেখিয়ে দেখা যায় এ সমাজে কীভাবে ধর্মের নামে এবং ঐতিহাসিক প্রথার দোহাই দিয়ে পুরুষই সমাজের একচ্ছত্র কর্তা হয়ে বসেছে। আইনের বিধানকে কাজে লাগিয়ে লড়াই করার সুযোগও কম, কারণ পুরুষতন্ত্র নারীকে দমনে সর্বশক্তি কাজে লাগাবে। তার হাতে ধর্ষণ ছাড়াও আরও অত্যাচারের শক্তি মওজুদ আছে।
কিন্তু দিনাজপুরের বড় আব্বুর কীর্তি কোনো ব্যাখ্যাতেই মেলানো যায় না। পাঁচ বছরের শিশুকে ধর্ষণ - কোন পর্যায়ের অপরাধ তা এ সমাজকেই বুঝতে হবে। কিন্তু এমন ঘটনা নতুনও  তো নয়। শিশুদের ধর্ষণ ও তারপরে হত্যার ঘটনা বহু বহু ঘটেছে এদেশে। এটা বিকৃতি, চরম বিকৃতি এবং মানুষের নৃশংস পশু হয়ে ওঠার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
মানতেই হবে এ সমাজমানস গভীরভাবে রোগাক্রান্ত, এটি অসুস্থ সমাজ। যে সমাজে অবোধ কন্যাশিশুও নিরাপদ নয় সেটি কীভাবে মানুষের সমাজ বলে দাবি করবে? এটি নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং এ ঘটনা এ সমাজের পুরুষতন্ত্রের বিকৃত যৌনক্ষুধার গভীরতাকেই তুলে ধরে। এমন সমাজের বৈষয়িক উন্নতি হলেও মানবিক অধ:পতন ঠেকানো মুশকিল হবে।
আমরা আবারো বলব, সঠিক শিক্ষা চাই, সামাজিক শিষ্টাচারসহ সুস্থ সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও পরিবেশ চাই। মানবিক সমাজের সুস্থ সংস্কৃতির ধারায় শিশু পরম আদরের পাত্রী। তার অবমাননা, নিষ্ঠুর পীড়ন আমাদের সকল উচ্চাভিলাষী কথা আর উন্নয়নের বুলিকে উপহাস করে। অহঙ্কারী আহাম্মক সমাজকে চপেটাঘাত বসিয়ে দেয়। বোধোদয় হবে কি আমাদের?

***