Saturday, August 15, 2015

শূন্যতায় তুমি শোকসভা

আবুল মোমেন


আজকের দিনটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে বিশেষভাবে স্মরণ করার দিন। ১৯৭৫ সালের এইদিনে ঘাতকদল তাঁকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। তারপর থেকে বাংলাদেশ যেন এক অভিভাবকহীন পরিবার - ছন্নছাড়া, দিগভ্রান্ত।
একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালালে বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়। সে রাতেই বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে, কিন্তু তাঁরই নেতৃত্বে, মুক্তিযুদ্ধ চলেছিল। পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুদণ্ডের হুমকির মধ্যে তিনি প্রিয় দেশ ও দেশবাসীর কাছ থেকে শারীরিকভাবে অনেক দূরে ছিলেন।
সেদিন বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তাঁর সহকর্মীদের যোগ্য নেতৃত্ব ও ভারতের সহায়ক সরকারের সহযোগিতায় আমরা অত্যন্ত কঠিন সেই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম গৌরবের সঙ্গে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে যা সম্ভব হয়েছিল পঁচাত্তরে তাঁর মৃত্যুর পরে তা সম্ভব হয়নি। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, কেন? একাত্তরে তাকে ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল, সেটাই কি কারণ? একাত্তরে তাঁর পক্ষে যোগ্য নেতৃত্ব দেওয়ার মতো মানুষ ছিলেন, যেমন তাজউদ্দিন আহমদসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ, সেটাই কি কারণ? এ দুটি কারণই সত্য বলে মনে হয়।
কিন্তু তারও চেয়ে সত্য তৃতীয় একটি কারণ। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড কেবল বঙ্গবন্ধু বা তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে সংঘটিত একটি অপরাধ ছিল না; এ ছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অংশ; খন্দকার মুশতাক এই ষড়যন্ত্রের একজন অংশীদার, বাংলাদেশের ইতিহাসের দ্বিতীয় মীর জাফর।
পটপরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে বায়ান্নো থেকে বিপুল ত্যাগ ও দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে জাতির অর্জিত আদর্শ ও মূলনীতিগুলো বিসর্জন এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্ন তছনছ করে দিয়ে প্রত্যাখ্যাত পাকিস্তানি ধারার ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা ও ধর্মান্ধ  চিন্তাচেতনা ও সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করে। কেবল তা-ই নয়, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সংস্কৃতিকর্মীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ নির্যাতনও  চালায়। এরই ধারাবাহিকতায় জেনারেল জিয়া সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে মুসলিম ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার প্রাধান্য দিতে শুরু করেন। এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী এবং ধর্মান্ধ দলসমূহকে রাজনৈতিকভাবে পুনরুজ্জীবিত ও সেসব দলের নেতৃবৃন্দকে সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত করেন। জিয়ার পরে এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আর সংবিধানে ধর্মীয় পরিচয় লাগিয়ে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক চেহারা পাল্টে দিলেন। নব্বইয়ের পরে ক্ষমতায় এসে বেগম জিয়া একই ধারাই অব্যাহত রাখেন।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত দীর্ঘ দু-দশক ধরে বঙ্গবন্ধুর নাম গণমাধ্যমে, পাঠ্যবই ও অন্যান্য প্রচারণা থেকে মুছে দেওয়া হয়, তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ নিষিদ্ধ থাকে। অন্যান্য জাতীয় নেতাদের কথাও অনুচ্চারিত থেকে যায়। ফলে এ সময়ে দেশে নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়, যারা এ দেশের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারেনি। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দিন বা মুক্তিযোদ্ধাদের যে ভূমিকা তা ঠিকভাবে জানতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধে ও স্বাধীনতা অর্জনে কারা ছিল বন্ধুরাষ্ট্র, এ সময় ভারত-সোভিয়েতের ভূমিকা ইত্যাদিও জানা হয়নি তাদের। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয়, ভূমিকা এবং বিপরীতে রাজাকার-আলবদর ও অন্যান্য দালালদের কী ভূমিকা তা-ও ঠিকভাবে জানানো হয়নি। চীন, সৌদি আরব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতিবাচক ভূমিকার কথাও তারা জানতে পারেনি।
ফলে কুড়ি বছরের বিভ্রান্তিকর অপপ্রচারের মাধ্যমে দেশের ইতিহাস সম্পর্কে মানুষের মনে বিভ্রান্তি এবং বিতর্কের জন্ম দেওয়া সম্ভব হয়েছে। আজও আমরা এই বিভ্রান্তি ও বিতর্কের জের টানছি, এবং তার খেসারত দিয়ে যাচ্ছি। এ যেন সত্যিকারের অভিভাবকহীন এক ছন্নছাড়া পরিবারের দিগভ্রান্ত পদচারণা চলছে।
পরিস্থিতি আজ এ রকম যে, একজন দেশদ্রোহী ও যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গে সরকার পরিচালনার ব্যর্থতাকে গুলিয়ে ফেলছি আমরা। অপরাধের সঙ্গে অপারগতাকে এক করে ফেলছি। চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতাকে এক কাতারে রাখছি।
আমরা জানি, স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন, এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, নবগঠিত অনভিজ্ঞ সরকার ও প্রশাসন পরিচালনার মতো দুরূহ কাজ করতে হয়েছে। সেই সঙ্গে একদিকে দেশের অভ্যন্তরে ওঁত পেতে থাকা পরাজিত শক্তির এদেশীয় দোসরদের চক্রান্ত এবং অন্যদিকে অতি-উৎসাহী উচ্চাভিলাষী মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতাও মোকাবিলা করতে হয়েছে। আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরাজিত পাকিস্তান, তার বন্ধুরাষ্ট্র চীন ও সমর্থক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশসমূহ মিলে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল বাংলাদেশকে বিপদগ্রস্ত করার  চেষ্টা করে গেছে। এদেরই অপতৎপরতার ফলে ১৯৭৪-এ দুর্ভিক্ষ হয়েছে, গোলাম আজমগং প্রশ্রয় পেয়েছে ও জামায়াতসহ অসংখ্য ধর্মান্ধ দল শক্তি সঞ্চয় করেছে। এভাবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনে অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা এবং ক্রমে চরম মনোভাবের এক বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। আজকের দিনে বাংলাদেশের এই অস্থির বর্তমান ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে আমরা যে অভাব প্রতিদিন অনুভব করি তা হল একজন যোগ্য নেতার, একজন যথার্থ অভিভাবকের। আর তখন স্বভাবতই মনে পড়ে যায় বঙ্গবন্ধুর কথা। মনে পড়ে যায় কীভাবে ইতিহাসের উজান বেয়ে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এ দেশের মানুষের নয়নমণি, একমাত্র নেতা, পরম নির্ভর অভিভাবক।
তাই বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েই তার আরব্ধ কাজ সম্পন্ন করতে হবে। মৃত্যুদিবসে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করব জাতির এই চরম সংকটকালে তাঁর কন্যা একজন যোগ্য উত্তরসূরি রাজনৈতিক নেতাই ও রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠেন সেই প্রার্থনা জানিয়ে।
২০০৯ সনে জাতীয় সংসদে বিপুল আসনে বিজয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। আমরা লক্ষ করছি শেখ হাসিনা এবারে ক্ষমতায় এসে দেশকে পঁচাত্তর-পরবর্তী পিছুটান থেকে উদ্ধারের ব্রত নিয়েছেন। সত্যি বলতে কি এখন কাজটা বঙ্গবন্ধুর আমলের চেয়েও কঠিন। তখন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানের কাল, বাঙালির ঐক্য গঠনের কাল। আজ বিশ্বায়ন আর বাজার অর্থনীতির চাপ একদিকে আর অন্যদিকে ধর্মান্ধ জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। কঠিন এই পথ থেকে অবশ্য সরতে রাজি নন বঙ্গবন্ধু-কন্যা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া, এসডিজি পূরণ করে এমডিজি পূরণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা তিনি বজায় রেখেছেন। তবুও বর্তমান আওয়ামী লীগের পক্ষে আগের মত একাট্টা হয়ে আদর্শ ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে আন্তরিক থাকা সম্ভব হচ্ছে না। দলের ভিতর থেকেই নানা সংকট তৈরি হচ্ছে, বাইরের সংকট তো আছেই।
তবুও মনে হয় পঁচাত্তরের পিছুটান কাটানোর এটাই শেষ সুযোগ। ফলে শেখ হাসিনাকে সফল হতেই হবে। আর সে পথে বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে সবচেয়ে বড় যে শিক্ষা নিতে পারেন তা হল জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা। আজকে দেশে তরুণের সংখ্যা জনসংখ্যার অর্ধেক তারা কোনো দল করে না, আর অর্ধেক যে নারী তারাও অধিকাংশ দলভুক্ত নয়। ফলে ঐক্যের সঠিক বাতাবরণ তৈরি হলে যারা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী রাজনীতি করছে তারা আবারও একাত্তরের মত জনবিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্রগোষ্ঠীতে পরিণত হবে।

***