Thursday, January 26, 2017

ঘোরে থাকা ও অঘোরে খেসারত

আবুল মোমেন

গত দুই দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে সামাজিক সূচকগুলোতে বাংলাদেশের যে উন্নতি হয়েছে তা দেশ-বিদেশে সবার নজর কেড়েছে। বিষয়টি এ কলামেও অনেকবারই উল্লেখ করা হয়েছে। কৃষি উৎপাদনেও আমাদের সাফল্যের কথা নানাভাবে উঠে এসেছে। সেতু, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ কাঠামোগত উন্নয়নও দৃশ্যমান। দারিদ্র কমেছে, স্বাস্থ্যসম্মত লেট্রিন বেড়েছে, সুপেয় পানির আওতা বাড়ছে। শিক্ষা ও কর্মজগতে নারীর অংশগ্রহণ বিস্ময়করভাবে বেড়েছে। আরো নানা ক্ষেত্রে উন্নয়ন হচ্ছে।
এটা উন্নয়ন ও অগ্রগতির রঙিন চিত্র। কিন্তু সেইসাথে এর মান বাড়ানো এবং একে টেকসই করার কাজটাও জরুরি। এই কৃষিপ্রধান দেশে কৃষিখাত একটি যুগান্তকারী রূপান্তরের সম্মুখীন হয়েছে। তা ঘটেছে দুভাবে - একদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কৃষিকে সহজ করতে এবং উৎপাদন বহুগুণ বাড়াতে সাহায্য করেছে আর অন্যদিকে এখানে বড় বিনিয়োগ আসতে থাকায় পারিবারিক চাষের ধারা ভেঙে ঐতিহ্যবাহী ছোট চাষি আজ ক্ষেতমজুরে পরিণত হচ্ছে। তাদের মজুরি বাড়লেও কাজের সুযোগ কমেছে আবার নির্ভরযোগ্য নিজস্ব খেতখামার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ফলে আয় বাড়লেও বিষয়সম্পত্তি কমেছে। মোটকথা তাদের জীবন আগের তুলনায় ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
এই বাস্তবতায় গ্রামের তরুণদের ব্যক্তিগত ভবিষ্যতচিন্তা তীব্র আকার ধারণ করেছে। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রথম পছন্দ ভাগ্যান্বেষণে বিদেশে পাড়ি দেওয়া, বিকল্প হল রাজধানীসহ অন্যান্য মহানগরে ভাগ্যপরীক্ষায় নামা। তবে আজ শহরের মত গ্রামেরও অনেক পরিবার কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষা দিতে আগ্রহী। কিন্তু তাদের জন্যে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। দেশে এখন শিক্ষিত তরুণদের সংখ্যার তুলনায় চাকুরির বাজার যথেষ্ট সংকুচিত। পরিসংখ্যান বলছে বর্তমানে দেশে শিক্ষিত তরুণ বেকারের সংখ্যা প্রায় দু কোটি। এরা অবশ্যই হতাশাগ্রস্ত, দিনে দিনে তাদের হতাশা বাড়ছে। ভাবুন, দেশে দুই কোটি হতাশ তরুণ রয়েছে।
বর্তমান বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আরও গভীরভাবে সমাজের কথা বা সমাজের প্রকৃত উন্নয়নের কথা ভাবা দরকার। খুব সাদামাটাভাবেও যদি দেখি তাহলেও এত উন্নয়নের মধ্যেও ব্যক্তিগত ও সমাজের মধ্যে যেসব পরিবর্তন দেখা যায় তা উন্নতির পরিচয় দেয় না, চিন্তার স্থবিরতা ও পথভ্রান্তি এবং অবক্ষয়ের কথা বলে। মানুষের পরিচয় তো তার পোশাক-আহার্য-ব্যবহার্য-বসতের মানদণ্ডেই কেবল বিচার হবে না, তার প্রকৃত বিচার হবে চিন্তা ও কাজের গুণগত মানদণ্ডে। যদি বলি মানুষের মান মাপার সূচকগুলো হল - বিচক্ষণতা, ন্যায়নিষ্ঠা, সহানুভূতি, দেশপ্রেম, মানবতাবোধ, দূরদর্শিতার মত মানবিকগুণাবলী তাহলে আমাদের অবস্থানটা কেমন দাঁড়াবে? সেই মানদণ্ডে আমরা অধিকাংশই অকৃতকার্য কিংবা খুব নিম্ন মান পাচ্ছি। ষাট বা সত্তরের দশকের তুলনায় সমাজে ধর্মান্ধতা অনেক বেড়েছে, সাম্প্রদায়িক মনোভাব সংখ্যাগুরুর চেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে।
ওপরে ব্যক্ত দুই পর্যবেক্ষণের প্রমাণ হিসেবে দুটি দৃষ্টান্ত দেব। পাঠ্যপুস্তকে ভুলভ্রান্তির সমস্যার আড়ালে ঢাকা যাবে না ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তির চাপের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকারের সম্পূর্ণ নতিস্বীকারের ঘটনাটি। এটি বাঙালি সমাজের পশ্চাদাপসরণের এক অকাট্য দৃষ্টান্ত কেবল নয়, এ তো বস্তুত হেফাজতের জয়ভেরি। একে অত্যুক্তি বলা যাবে না, কারণ ওরা তাদের দাবি শতভাগ মেনে নেওয়ায় সরকাকে অভিনন্দন জানিয়েছে এবং প্রত্যাশিতভাবেই শিক্ষানীতি বাতিলসহ জাতির পশ্চাদযাত্রা নিশ্চিৎ করতে তাদের আদর্শিক মৌলিক দাবি নিয়ে হাজির হয়েছে এবার। দ্বিতীয় বক্তব্যটা ছিল সাম্প্রদায়িক মনোভাব রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাওয়ার  বিষয়ে। হ্যাঁ, এখন উচ্চবিত্ত স্কুলের প্রাক-প্রাথমিক বা প্রথম শ্রেণির শিশুদের মুখেও সাম্প্রদায়িক বক্তব্য শোনা যায়, আবার পোশাকেও এর প্রকাশ ঘটছে। বলা বাহুল্য সব ক্ষেত্রে এর প্ররোচণা আসে সংখ্যাগুরুর দিক থেকে।
যদি সমাজের সবচেয়ে আলোকিত ও অগ্রসর অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রদের দিকে তাকানো যায় তাহলেও মান, মনোভাব, চেতনার বিচারে হতাশ হতে হয়। ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল এবং শিক্ষক নিয়োগে আর্থিক দুর্নীতির প্রেক্ষাপটটা বাদ দেওয়া যাবে না। তবে মূল কথা হল পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষার ভিতর দিয়ে আসার ফলে ছাত্ররা উচ্চশিক্ষার চাহিদা পূরণে অক্ষম। তাদের জ্ঞানচর্চার আকাক্সক্ষা কিংবা সক্ষমতা কোনোটাই তৈরি হয় না। ক্ষমা করবেন, এদের কি শিক্ষাপ্রতিবন্ধী বলা যাবে না? বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালগুলো আপনাকে হতাশ করবে। আর ছাত্ররা কী করছে? পরীক্ষা দিচ্ছে, সে বৈতরণী ভালোভাবে পার হওয়ার মোক্ষম পদ্ধতি তারা তো স্কুলজীবনেই শিখেছে - সম্ভাব্য প্রশ্ন জেনে তার উত্তর মুখস্থ করা। ফলে চকচকে ডিগ্রিও এসে যায় যথাসময়ে। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের দায়িত্বশীল কর্মীদের কাছ থেকে জেনেছি ছাত্র এবং শিক্ষক উভয়েরই বই ব্যবহারের হার লজ্জাজনকভাবে কম। রবীন্দ্রনাথের লাইব্রেরি শিক্ষক রচনার প্রথম পংক্তির বক্তব্যটি আমরা সুচারুভাবে সত্য করে তুলছি - বহুকালের জ্ঞান এখানে স্তব্ধ হয়ে আছে।
আশা করি কেউ ইন্টারনেটে বইয়ের সন্ধান পাওয়ার দোহাই দিয়ে এই বাস্তবচিত্রে ফুটে-ওঠা ব্যাধির গভীরতাকে খাটো করছেন না। এও আশা করছি যে, কেউই নিশ্চয় বিশ্বাস করবেন  না কেবলমাত্র প্রশ্নের উত্তর শিখে (আমাকে শিক্ষকরা জানিয়েছেন, এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেও জানি, অধূনা কেউই এত বোকা নয় যে মূল পাঠ্যবই পড়বে।) শিক্ষিত জাতি তৈরি হতে পারে। আর একে নিশ্চয় জ্ঞানচর্চা বলে সন্তুষ্টিতে ভুগব না আমরা।
শিক্ষায়তনে সংস্কৃতিচর্চা নেই। অনেক বলাবলি লেখালেখির ফলে কিছু ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা চালু হয়েছে। সবাই জানি স্কুল বা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক প্রতিযোগিতায় কেবল সেরারাই অংশ নিতে পারে, আমছাত্ররা এর বাইরে থাকে। এটা অবশ্য স্পেশালাইজেশন বা বিশেষায়নের কাল - অর্থাৎ যে খেলে বা পারে সেই খেলবে, গান নাচ নাটকেও ব্যবস্থা তাই। অথচ শৈশব তো কাটার কথা অংশগ্রহণের আনন্দে - সে সুযোগ থেকে সিংহভাগকে বঞ্চিত রেখে ক্রীড়া বা সংস্কৃতিচর্চা হবে কীভাবে? এককালে ছোটবড় সব গ্রামশহরেই, এবং গ্রামশহরের ছোটবড় সব স্কুলেই খেলাপাগল, নাটকপাগল, গানপাগল মানুষজন ছিলেন, তাঁরা ও তাঁদের সঙ্গিরা মিলে এক একটি জনপদকে প্রাণবন্ত করে রাখতেন। বছরে একটা দুটো নাটক, যাত্রা বিচিত্রা শীতকালে গ্রামের মানুষ নিজেরাই করত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বছরে কয়দিন উৎসবমুখর হয়ে থাকত। এখন সেসব বিগতকালের স্মৃতি। একই কথা বলা যাবে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো নিয়ে। ব্যাণ্ডসঙ্গীতের কাট-কাটানো শব্দদূষণ, টেলিভিশনের রঙীন নাটক-টকশো, পত্রিকার পাতায় তারকাদের বিচিত্র সাফল্যের জৌলুস দেখে যেন সমাজের বাস্তব চিত্র সম্পর্কে ভুল ধারণায় না ভুগি।
আমাদের সমাজ সাংস্কৃতিকভাবে মরতে বসেছে যদিও সংস্কৃতিই মানুষ ও সমাজের প্রাণ। কৃষকের গলায় গান নেই, জেলের কণ্ঠে ভাটিয়ালি নেই যেমন সত্য তেমনি ছাত্রের হাতে বই নেই, কণ্ঠে গান নেই, নাটকের মহড়ায় তাদের ব্যস্ততা নেই, একুশের সংকলন প্রকাশের তাড়া নেই, লেখার ভূত মাথায় নেই। আজ পরীক্ষাই ভূত ভবিষ্যত ও বর্তমান, তার পুরো ছাত্রজীবন জুড়ে একমাত্র সত্য হয়ে বিরাজমান। সংস্কৃতিহীন একালে জঙ্গিবাদ, গ্যাংস্টারিজম, মাদকের নেশায় আকৃষ্ট হচ্ছে কিশোর ও তরুণরা। আমাদের অজ্ঞাতসারে কলিকাল শুরু হয়ে যায় নি তো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজ রাষ্ট্রীয়ক্ষমতা হাতে পেয়ে শাসনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বটে, যা ভাবা যায় নি তেমন কাজ - যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিও - দিয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র শক্ত হাতে আগলে রাখতে গিয়ে সমাজ যে হাতছাড়া হয়ে গেল! সমাজের যে জামায়াতিকরণ হয়ে যাচ্ছে, যার থাবার বাইরে নেই আওয়ামী লীগও! না, কেবল যে ভোল পাল্টে জামায়াতিরা লীগে যোগ দিচ্ছে তা নয়, বা লীগের ওপর হেফাজত সওয়ার হয়েছে তাও নয়, খোদ আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যেও ধর্মান্ধতা-সাম্প্রদায়িকতা, চিন্তার পশ্চাৎপদতা ভর করেছে।
একটি জাতির শিক্ষা এবং রাজনীতি যদি আদর্শ ও সংস্কৃতিচ্যুত হয়ে যায় তাহলে তার উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার তাল কেটে যায়। নাসিরনগর, হলিআর্টিজান চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় তাল কিভাবে কাটছে। ফাঁক অর্থাৎ দুর্বলতা অনেক সময় বোঝা যায় না। প্রধানমন্ত্রীর হাস্যোজ্জ্বল আত্মবিশ্বাসী উপস্থিতি সত্যিই আশ্বস্ত হওয়ার মত দৃশ্য। একইভাবে শিক্ষামন্ত্রী যখন বছরের প্রথমদিনে ৩৬ কোটি বই নিয়ে কলকাকলিমুখর শিশুদের মাঝে উপস্থিত হন বা লক্ষ লক্ষ জিপিএ-৫ প্রাপ্তের ফলাফল নিয়ে হাসি মুখে হাসিখুশি প্রধানমন্ত্রীর হাতে অর্পণ করেন তখন সবার মনে সুখানুভূতি হয়। কিন্তু বাস্তব তো সবসময় ছবির মতো নয়। এর যেমন লোকভোলানোর ক্ষমতা আছে তেমনি যারা নিত্য এসব কথা বলছেন, এমন সাফল্য উদযাপনে ব্যস্ত থাকছেন তাঁরাও বাস্তবতা ভুলে যেতে পারেন। কিন্তু অভিজ্ঞ চোখে আর বিশ্লেষণী চেতনায় ফাঁক ও দুর্বলতা ধরা পড়বেই।
নাহ্, সরকারকে হেফাজতের ধন্যবাদ এবং তাদের আরো উচ্চাভিলাষী দাবিকে কি খাটো করে দেখব? দেখা সম্ভব? কারণ তাদের দাবি মানতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অসাম্প্রদায়িকতা, বাঙালির শাশ্বত উদার মানবিকতার বাণী যে বিসর্জন দিতে হল! সেটা কীভাবে মানা যাবে।
সমাজে যখন চিন্তার জড়তা নামে তখন কথার ফুলঝুড়িও বাড়ে। চিন্তাহীনের মনে কথা ঘোর তৈরি করতে পারে। আর তখনই মানুষ অঘোরে মারা পড়ে। পরিস্থিতি অনুধাবন করতে না পেরে এমন অঘোরে মৃত্যুর বিপুল খেসারত এ জাতি অতীতে দিয়েছে। প্রশ্ন হল, ন্যাড়া বেলতলায় কবার যায়? বারবার স্বেচ্ছায় যায় এ কেমন ন্যাড়া!


****

Monday, January 16, 2017

কথায় না হয়ে কাজে বড় হওয়ার শিক্ষা কতদূর?

আবুল মোমেন

২০১৭ সনের পাঠ্য বইয়ে বেশ কিছু ভুল পাওয়া গেছে, এ নিয়ে দৈনিক পত্রিকা, বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোরগোল উঠেছে। এ থেকে ভাবা যেতে পারে যে, জাতি শিক্ষা নিয়ে বেশ সচেতন হয়ে উঠেছে। তবে সমালোচনার ঝড় এমনভাবে বইছে যে, এতে সাম্প্রতিককালে সাধারণভাবে পাঠ্যবইয়ের আধেয় এবং মুদ্রণের মান যে বেড়েছে এবং তার কৃতিত্ব যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেই তথ্য চাপা পড়ে যাচ্ছে। সবাই মিলে গেল-গেল রব তুলে দায়িত্বরত কর্তৃপক্ষকে নার্ভাস করে দিলে ত্রুুটি সংশোধনের সহজ স্বাভাবিক পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তখন আমাদের দেশে সাধারণত নামিদামিদের নিয়ে বড়সড় কমিটি গড়ে তার আড়াল নেওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয় নি, ভারি নামের দুদুটি কমিটি গঠন করে আপাতত গণ-অসন্তোষ ও গণমাধ্যমকে শান্ত করার চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে এনসিটিবির দুজনকে ওএসডিও করা হয়েছে, একজন চিত্রকরের ওপর কোপ পড়েছে। তবে আমরা তো জানি এ ধরনের কমিটি কর্তৃপক্ষকে সাময়িক সুরক্ষা দিতে পারে বটে, কিন্তু পাঠ্য পুস্তক রচনা বা সংশোধন তাঁদের সভা ও সিদ্ধান্তে সুসম্পন্ন হওয়ার নয়। এর একটি স্থায়ী সুদক্ষ ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার, যার অভাব রয়েছে বলে মনে হয়।
যেসব ভুল নিয়ে হৈ চৈ উঠেছে তার সবই এক মাত্রার নয়। মানসিক আঘাত বোঝাতে যঁৎঃ-এর স্থলে যবধৎঃ শব্দের প্রয়োগ নেহায়েৎ লেখার (স্লিপ অব পেন) বা প্রুফের প্রমাদ, যে কোনো স্কুলের শিক্ষকই যা দেখামাত্র শুদ্ধ করে দেবেন। এমন ঘটনা ৬০-৫৫ বছর আগে আমাদের কালেও দেখেছি। বোর্ডও নিজস্ব ব্যবস্থায় এ নিয়ে স্কুলে নির্দেশনা পাঠাতে পারে।
পত্রপত্রিকার মাধ্যমে যেসব ভুল সম্পর্কে জানতে পারলাম তাতে মনে হয় ভুলের উৎস বা কারণ মূলত তিনটি - ১. শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনে বিপুল বই প্রস্তুত করে বিতরণের চাপ, ২. লেখক ও বিশেষজ্ঞদের সময়-সংকট এবং তাঁদের মধ্যে অনেকের দক্ষতা ও আন্তরিকতার অভাব এবং ৩. সমাজমানসে পুঞ্জিভূত সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মীয় রাজনীতির চাপ ও কৌশলী পদক্ষেপ ।
এবারে আমরা সমস্যাগুলোর সমাধানে কিছু পরামর্শ দিতে পারি কিনা দেখি, যদিও তা শোনার সম্ভাবনা কম।
১. ফি-বছর স্কুল ছাত্র বৃদ্ধির সাথে সাথে বইয়ের কপির সংখ্যাও বাড়তে থাকবে। গত কয়েক বছরের ধরণ দেখে মনে হয় বছরে গড়ে ২ কোটি করে কপির সংখ্যা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে আমার দুটি বিনীত নিবেদন আছে - প্রথমত, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরকে দুই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সার্বিকভাবেই ভাগ করে দেওয়া উচিত। সেভাবে এনসিটিবিরও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই ভাগ হওয়া বাঞ্ছনীয়। দ্বিতীয়ত, আমাদের মত দরিদ্র দেশে কেন সক্ষম ও অক্ষম উভয় ধরনের পরিবারকে বিনামূল্যে বই দেওয়া অপরিহার্য ভাবছে সরকার? এটা আমার বোধগম্য নয়। শুধুমাত্র সরকারি প্রাথমিক স্কুলে ঢালাওভাবে বিনামূল্যে বই দেওয়া যায়, অন্যত্র তার প্রয়োজন নেই। স্কুল কর্তৃপক্ষ মেধাবী ও দরিদ্র ছাত্রের বৃত্তির যোগ্যতা যেভাবে নির্ধারণ করেন এক্ষেত্রেও সেভাবেই বিনামূল্যে বই পাওয়ার উপযুক্ত ছাত্রদের নির্বাচন করবেন। তারপরেও এতে যেটুকু সমস্যা হবে তা নীতিগত নয়, ব্যবস্থাপনার। আমার ধারণা এ কাজে দক্ষ ব্যবস্থাপনার বুদ্ধি যোগ্য ব্যক্তিরা দিতে পারবেন। কিন্তু এভাবে যে বিপুল অর্থ সাশ্রয় ও আয় হবে তা স্কুলশিক্ষায় ব্যয় করা হলে শিক্ষার মান বাড়ানোর জন্যে অনেক কাজ করা যাবে। শিক্ষক সংকট, পাঠাগার ও গ্রন্থাগারিকের অভাব, বিজ্ঞান গবেষণাগার ও সহায়ক কর্মীর সংকট, খেলাধূলার অভাব ইত্যাদি স্কুল শিক্ষার বহু জরুরি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংযোজন করা যাবে।
২. পাঠ্যবইয়ের রচয়িতা ও সম্পাদক নির্বাচনের মাপকাঠি সম্পর্কে আমি জানি না। তবে স্কুলশিক্ষার সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থেকে জানি আমাদের পাঠ্যবইয়ের ভাষা বড্ড গতানুগতিক, প্রাণহীন, শিশুমনকে উদ্দীপ্ত করার মত সমৃদ্ধ নয়। যাও বা সাহিত্যের বইগুলো থেকে শিশুরা উদ্দীপনা পেতে পারত তাতেও বাদ সেধেছে দিনে দিনে এমন সৃজনশীল লেখার সংখ্যা কমতে থাকায়। আমাদের বিবেচনায় থাকা দরকার কোন ভাষা প্রাণবন্ত কোনটি নিষ্প্রাণ, কার ভাষা সরস কারটি নীরস, কোনটিতে আছে কল্পনাকে মুক্তি দেওয়ার রসদ কোনটি বদ্ধ ভাষা ইত্যাদি। কারো কারো ভাষা বন্ধ্যা, আড়ষ্ট, তাই শিশুর কল্পনা ও ভাবনাকে জাগাতে পারে না। ভাষাবোধের এই সংবেদনশীলতা ছাড়া কীভাবে শিশুদের জন্যে যথার্থ শৈলীর লেখা নির্বাচন বা প্রণয়ন করা যাবে?
যে কোনো শিক্ষার্থীর বিদ্যাচর্চায় অগ্রগতি অনেকাংশে নির্ভর করে তার গদ্যের ওপর - তা প্রাঞ্জল গতিশীল হওয়া জরুরি। এমন গদ্য লেখার যোগ্যতা অর্জন শিক্ষার একটি বড় কাজ। প্রমিত ভাষায় নিজের ভাব-বক্তব্য প্রকাশের দুর্বলতা যে কোনো জাতিকে মেধাচর্চায় পিছিয়ে দেবে - এটা মনে রাখা উচিত।
এটুকু বাড়তি কথার পরে বলতে চাই যে, লেখক ও সম্পাদক নির্বাচনে আরো মনোযোগী হতে হবে। আর বছরের শুরুতেই পরবর্তী বছরের বই রচনা (যদি প্রয়োজন থাকে), পরিমার্জন, সম্পাদনার কাজ শুরু করে দেওয়া উচিত। যাঁরা বাইরে থেকে যুক্ত হবেন তাঁদের অবশ্যই অন্তত ৬ মাসের ছুটি নিয়ে সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েই কাজ করতে হবে। তাঁদের মূল চাকুরি ও আর্থিক সুবিধাদির বিষয় সরকারকে দেখতে হবে।
৩. আমরা সকলেই জানি দ্বিজাতিতত্ত্বের ভূত মুক্তিযুদ্ধও জাতির মনস্তত্ত্ব থেকে সম্পূর্ণ ছাড়াতে পারে নি, বরং সাম্প্রতিক কালে ইসলামি জঙ্গিবাদের প্রভাব বাড়ায় এ সংকট বেড়েছে। তাই কীভাবে শিক্ষায় সাম্প্রদায়িক মনোভাব ও ধর্মান্ধতা ছড়ায় তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানা উচিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। তারপর সে অনুযায়ী শিক্ষা থেকে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা নির্মূলের কৌশল ও ব্যবস্থাপত্র নির্ধারণ করা সম্ভব হবে। সেই সচেতনতার অভাব যে প্রকট তা বোঝা যায় যখন হেফাজতের দাবি মেনে পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত রচনা ও লেখকের রদবদল হয়। এই মনস্তত্ত্বের যে দীর্ঘ ইতিহাস আছে তা-ও জানা দরকার। ১৯৬৭ সন থেকে ফাংশনাল ইংরেজির অত্যন্ত চালু একটি বই হল অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কলিমদাদ খানের অ ইড়ড়শ ড়ভ এৎধসসধৎ, ঞৎধহংষধঃরড়হ ্ ঈড়সঢ়ড়ংরঃরড়হ। এর ১১০ পৃষ্ঠায় ট্রান্সলেশনে পরপর কয়েকটি বাক্য এরকম - বাংলাদেশীরা সাহসী, ইংরেজরা পরিশ্রমী, মুসলমানরা সত্যবাদী, হিন্দুরা মূর্তি পূজক। এতে সাহস, শ্রমশীলতা, সত্যবাদিতার মত গুণবাচক বিশেষণগুলো যেভাবে বসানো হয়েছে তাতে একদিকে শিশুদের বুঝতে কষ্ট হবে যে কেউ কেউ যুগপৎ কয়েকটিগুণের অধিকারী হতে পারে। আবার অন্যদিকে হিন্দুর বেলায় যে পরিচিতি দেওয়া হয়েছে তা কোনো গুণ প্রকাশ করে না। এতে সামাজিকভাবে তাদের অবনমন ঘটে যা পরিস্কার সাম্প্রদায়িক কাজ।
শিক্ষামন্ত্রী এ বিষয়ে অবগত ও সচেতন বলেই জানি। কিন্তু এ মানসিকতা তো কেবল প্রশাসনিক ও বিভাগীয়ভাবে মোকাবিলা করা যাবে না। রাজনীতি ও সমাজের পশ্চাদাপসরণ ও ব্যর্থতার দায় কেবল পাঠ্যবই প্রণেতা ও আমলার কাঁধে চাপালে চলবে কেন? তবে এ বিষয়ে তাদের অসচেতন থাকলেও চলবে না, আর বর্ণচোরা অনুপ্রবেশকারীদের না চিনলেও হবে না।
এখানেই বলে রাখব আমাদের বড় এক দুর্বলতার কথা - বইয়ের অলঙ্করণ। আমাদের চারুকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অলঙ্করণ, বৈজ্ঞানিক ড্রয়িং-স্কেচ, অক্ষরবিন্যাস ইত্যাদি উচ্চমানে শেখানো হয় না। বিদেশি বইয়ের তুলনায় এক্ষেত্রে আমরা অত্যন্ত দুর্বল, বিপুলভাবে পিছিয়ে আছি। কিন্তু শিশুদের বইয়ে ভালো মানের ছবি থাকা আবশ্যক। যেহেতু এটি একটি সাংবাৎসরিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাই যোগ্য লোকবল তৈরির জন্যে আগ্রহী চারুশিল্পীর অন্তত ১০ জনের একটি দলকে দক্ষতা অর্জনের জন্যে বিদেশে পাঠানো হোক। পরে তাঁরাই দেশে প্রশিক্ষণ দিতে পারবেন।
মূল তিনটি পর্যবেক্ষণের বাইরে আর দু’একটি সাধারণ কথা বলতে চাই। আমাদের শিক্ষায় বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চা, উপভোগ, সৃজন, মৌলিক চিন্তা ও বিশ্লেষণের অবকাশ নেই বললেই চলে, পরীক্ষার চাপে ও আধিক্যে শিক্ষার আসল লক্ষ্য অনর্জিত থেকে যাচ্ছে। আমরা এমন উচ্চডিগ্রিধারীদের পাচ্ছি যারা চিন্তা করতে, গুছিয়ে কোনো বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে, শুদ্ধভাবে লিখে বক্তব্য প্রকাশ করতে পারে না। তাই দেশে নয় বিদেশে গিয়েই আমাদের মেধাবীরা নিজ নিজ মেধার প্রকাশ ঘটাতে পারছে। এদেশের অদম্য মেধাবীরা কেবল জিপিএ-৫ পেতে পারে। সমাজে জ্ঞানের সত্যিকারের চাহিদাই তৈরি হয় নি - এটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মস্ত দুর্বলতা।
এই দুর্বলতার সূত্র ধরে এ ব্যবস্থায় পাঠ্যবই (এবং জ্ঞানার্জন ও নির্মল আনন্দের জন্যে বই পড়া) এবং শ্রেণিকক্ষের পঠনপাঠন, এবং সেই সূত্রে স্কুল ক্রমেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে প্রশ্ন ও উত্তর সম্বলিত গাইডবই, পরীক্ষায় দক্ষ হয়ে ওঠার কোচিং সেন্টার এবং মুখস্থবিদ্যা।
আরেকটা কথা বলতে চাই, আমাদের দেশে নাকি ছাত্রের ওপর বইয়ের বোঝা বেশি। কথাটা সত্য হলেও বাস্তবে পঠনপাঠন কম, আজকালকার ছাত্ররা লুকিয়ে নভেল-নাটক পড়ে না, স্কুলে লাইব্রেরির চলও উঠে গেছে। তাহলে? বোঝা বাড়ল কীভাবে? না, এ হল পরীক্ষার বোঝা, পাঠ্যবইয়ের চেয়ে গাইডবই ভারি, এক ছাত্রের একটি স্কুল হলেও এক ছাত্রের কোচিং সেন্টার হয় একাধিক, পড়া-শুনার চেয়ে পরীক্ষার জন্যে খাতার বোঝা অনেক বেশি। ছাত্ররা সেগুলো টানে।
উন্নত বিশ্বে স্কুল পর্যায়েই কিন্তু স্ব স্ব ভাষার ধ্রুপদী সাহিত্যের সাথে ছাত্ররা পরিচিত হয়। প্রচুর বই পড়ে তারা। দশ বারো বছর স্কুলে পড়ে আমাদের ছাত্ররা বাংলাসাহিত্যের কটা বই পড়ে? বঙ্কিম তো বহু আগেই তামাদি হয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র-নজরুলরাও বাসি হয়ে পড়েছেন। সম্প্রতি পাঠ্যবই বহির্ভূত সাহিত্য পাঠের জন্যে সরকার বিদেশি সাহায্য নিয়ে বড় কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। কিন্তু পরীক্ষাময় শিক্ষায় তা সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারবে বলে বিশ্বাস হয় না।
সব শেষে বলতেই হবে, আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে, এবং তাই শিক্ষা জীবনেও, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি তাদের প্রভাব এখনও বহাল রেখেছে, বরং দিনে দিনে আরো জোরালোভাবে তা ছড়াচ্ছে। হেফাজতে ইসলাম পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তনের জন্যে যেমন সরকারকে ধন্যবাদ দিয়েছে তেমনি আবার ভবিষ্যতে আরো দাবি তোলার হুঁশিয়ারিও জানাচ্ছে। হায় স্বাধীন বাংলাদেশে, শেখ হাসিনার বাংলাদেশে, শেষ পর্যন্ত মূলধারার শিক্ষা কওমি মাদ্রাসার আদর্শেই বুঝি ঢেলে সাজানোর কাল আসছে।
লক্ষ লক্ষ জিপিএ-৫ তারকার মরীচিকার আলোয় আমরা বুঝি আসল ক্ষেত্রে পথ হারাতে বসেছি। একদিকে পরীক্ষার ফল নিয়ে উৎসবে মেতে উঠছে জাতি আর অন্যদিকে শিক্ষার যাত্রাপথ ভুলভ্রান্তি ও ধর্মান্ধতার আঁধিতে ঢেকে যাচ্ছে। এভাবে চললে আমাদের দেশে কবে সেই ছেলে হবে (এবং অবশ্যই মেয়ে), যে কথায় বড় না হয়ে কাজে বড় হবে?


****

Monday, January 9, 2017

পথিকৃৎ সাহিত্যিককে শতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি

আবুল মোমেন

বাংলা গদ্যের সূচনা হয়েছিল খ্রিস্টান পাদ্রি আর হিন্দু পণ্ডিতদের হাতে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায়। বাঙালি মুসলমান সুলতানি আমলে পদাবলী করেছে, কিছু পরে আরাকান রাজসভায় কাব্যচর্চা করেছে। পুথিসাহিত্যের ইতিহাসও কম পুরোনো নয়, যাতে মুসলিম লেখকদের অবদানই বেশি।  তবে গদ্য রচনায় তাঁদের অংশগ্রহণ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক  থেকেই ভালভাবে শুরু হয়।
কথাসাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের গুরুত্বপূর্ণ অবদান শুরু হয় আরও পরে। এ ক্ষেত্রে মীর মোশারফ হোসেনের নাম সবার আগে আসবে - মূলত বিষাদসিন্ধুর কারণে। ইসমাইল হোসেন সিরাজী সাহিত্যের সব শাখায় বিচরণ করলেও সৃজনশীল রচনা হিসেবে এসবের মান ততটা উচ্চস্তরের নয়। উপন্যাস হিসেবে কাজী ইমদাদুল হকের আবদুল্লাহ এবং নজিবর রহমান সাহিত্যরত্বের আনোয়ারা প্রথম পাঠক ও সমালোচকদের নজর কাড়ে। বেগম রোকেয়া, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী নজরুল ইসলামের মত গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম লেখক উপন্যাস রচনা করলেও তাঁদের এসব সৃষ্টির সাহিত্যমূল্য এবং তাঁদের মূল অবদানের প্রেক্ষাপটে ততটা বেশি নয়। এদিক থেকে মাহবুব উল আলমের গল্প ও উপন্যাসের মান বাংলাসাহিত্যের বিচারে যথেষ্ট উন্নত। একটিমাত্র উপন্যাস লিখে কথাসাহিত্যের পথ-রচনায় সহায়তা করেছেন মনীষী হুমায়ুন কবীরের মত প্রতিভাবান বুদ্ধিজীবী। এর আগে আবুল মনসুর আহমদ ব্যাঙ্গাত্মক সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজে বিরাজমান অসংগতি ও কুসংস্কারের তীব্র সমালোচনা করেছেন। আবুল ফজল তাঁর সমাজ সংস্কারক ও প্রগতিচেতনার ধারায় মানবতাবাদী আদর্শভিত্তিক উপন্যাস রচনা করেছেন।
আবু রুশদ-এর প্রয়াসেও কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল - নাগরিক আভিজাত্যের গণ্ডির বাঁধন ভেঙে জীবনের বৃহত্তর পরিসরে তিনি আসতে পারেন নি। গ্রামবাংলার সাধারণ কৃষিসমাজের যে জীবন এবং তার আধুনিক জীবন গঠনের প্রয়াস, রাজনীতির নানান বাঁক, সমাজের অগ্রগতি ও পিছুটান, জাতি ও রাষ্ট্রগঠনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার বয়ান লেখার দায় পালনে এগিয়ে এলেন শওকত ওসমান, আবু জাফর শামসুদ্দীন, সরদার জয়েনউদ্দিন আর আবু ইসহাক প্রমুখ। এঁদের বলা যায় বাঙালি মুসলিম  কথাসাহিত্যের দ্বিতীয় প্রজন্ম। এঁদের প্রায় একদশকের কনিষ্ঠ সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ পূর্ববঙ্গের মুসলিম গ্রামসমাজের বয়ানই লিখলেন, কিন্তু তাঁর মৌলিকত্ব ও স্বাতন্ত্র্যে বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট হয়ে থাকলেন।
শওকত ওসমান, আবু জাফর শামসুদ্দীন ও সরদার জয়োনউদ্দিন রাজনীতি সচেতন লেখক এবং বাঙালি জাতির অগ্রযাত্রার বিষয়ে এক ধরনের অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন। এঁরা মাদ্রাসায় শিক্ষিত, গ্রামেই বড়  হয়েছেন এবং বাঙালি মুসলিমসমাজকে ভালোভাবেই জানেন। শেষোক্ত দুজন প্রথম জীবনে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তবে  তিনজনই চিন্তাচেতনায় ছিলেন প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক এবং সমাজতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল। তবুও তুলনায় শওকত ওসমান প্রধানত সাহিত্যিশিল্পী - রাজনীতি তাঁর মানসের প্রধান প্রণোদনা হলেও জীবনের অন্যান্য বিষয়ও তাঁকে ভাবিয়েছে, লেখায় সেসব তুলে আনতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
আবু জাফর শামসুদ্দীনে পদ্মা মেঘনা যমুনা, সরদার জয়েনউদ্দিনের অনেক সূর্যের আশা বাংলার মুসলিম সমাজের রাজনৈতিক অভিযাত্রাকে তুলে ধরার ব্রত থেকেই যেন লেখা। উপন্যাসের কুশীলবরা সেই ইতিহাসের ধারা ও বাঁক, অগ্রগতি ও পিছুটান, সম্ভাবনা ও ব্যর্থতার বয়ান নির্মাণে ভূমিকা পালন করেছে, শওকত ওসমান জননী উপন্যাসে গ্রামীণসমাজ এবং তার এক বিশিষ্ট নারী-চরিত্রকে ঘিরে অনেক চরিত্রই তুলে আনেন - মুসলিম রাজনীতির প্রেক্ষাপট ছাপিয়ে মানব-জীবনের পরিসরেই তাঁদের ফুটিয়ে তুলতে চান।
যখন শওকত ওসমান রাজনীতির অঙ্গনে পদচারণা করেন তখন রূপকের আশ্রয় নিয়ে তীব্র ব্যঙ্গের কষাঘাতে একেবারে লক্ষ্যভেদী হতে চেয়েছেন তাঁর ক্রীতদাসের হাসি পাকিস্তান আমলে রচিত হয় সামরিক স্বৈরাচারকে ব্যঙ্গ ও আক্রমণের বিষয়বস্তু করে। আমাদের সাহিত্যে এটি একটি ব্যতিক্রমী সাহসী সংযোজন। এ তাঁর আদর্শিক লড়াই বটে, কিন্তু সাহিত্যেরই ফর্মের মধ্যে থেকে তা চালালেন। তাঁর গল্পে এবং অন্যান্য উপন্যাসেও আমরা দেখি রাজনীতি বা রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে কিংবা চৌহদ্দিতে তিনি আটকে থাকেন নি। জীবনেরই গল্প বলার চেষ্টা করে গেছেন।
শওকত ওসমান পশ্চিমবঙ্গ থেকে দেশভাগের পরে এদেশে এসেছেন, মাদ্রাসা শিক্ষার পরে উচ্চতর পর্যায়ে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশের গ্রামের সাথে তাঁর প্রত্যক্ষ পরিচয় নেই, তা গড়ে উঠেছে নাগরিক সমাজের সাথে।
কিন্তু এদেশটি, বিশেষত এর সচেতন শিক্ষিত নাগরিক সমাজের জীবনের বড় অংশ জুড়েই আছে রাজনীতিÑ সেই ৪৭-এর দেশভাগের পর থেকেই। শওকত ওসমান বেশিদিন আগন্তুক হয়ে থাকেন নি। জাতির মূলধারা কেবল চিনে নেননি তা বিনির্মাণে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন, ভাবনা-চিন্তা দিয়ে তার রূপায়নে ভূমিকা পালন করেছেন। সেই থেকে শওকত ওসমান পূর্ব বাংলার সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের অগ্রসেনাদের একজন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সে অবস্থান আরো পাকাপোক্ত হয়েছে। পঁচাত্তরের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পরে তিনি দেশান্তরী হয়ে নিজের পক্ষপাত ও অবস্থান স্পষ্ট করলেন। এটি কেবল বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুগত্য বা তাঁর দলের প্রতি পক্ষপাত প্রকাশ করে না, বরং এ থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রতি তাঁর অবিচল সামূহিক অঙ্গীকারই প্রকাশ পায়। যিনি রণাঙ্গনের যোদ্ধা নন, যাঁর লড়াইয়ে মূল অস্ত্র কেবল কলম ও লেখা তাঁর জন্যে দেশত্যাগীর উদ্বাস্তুজীবন কেবল অনিশ্চিতিতে ভরা নয়, দারুণ কষ্টকর ও হতাশাময় হতে পারে। শেষ পর্যন্ত তা হয়েও ছিল। তবে বাংলাদেশের লড়াকু ছাত্রজনতা কখনো হাল ছাড়েনি বলে তাঁর জন্যে স্বদেশ প্রত্যার্তনের মত বাস্তবতা তৈরি করতে পেরেছিল। দেশে ফিরে শওকত ওসমান তাঁর লড়াইকে আরো শাণিতই করলেন। এ পর্যায়ে বাংলাদেশকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম জীবনের মুখ্য বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল অন্য অনেকের মতই।
বাংলাদেশ, বহু বছর পরে, বঙ্গবন্ধু-কন্যার নেতৃত্বে তার প্রতিষ্ঠিত পথে ফিরে এসেছে। এর পেছনে শওকত ওসমানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে বাংলাদেশের এই সঠিক বাংলাদেশ হয়ে ওঠার ফিরতিযাত্রা বা অভিযাত্রা এখনো শেষ হয় নি। তাই শতবর্ষে তাঁকে স্মরণ ও শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে গিয়েও বলতে হবে যে তাঁর অভাববোধ এখনও শেষ হয় নি। শওকত ওসমান পরিণত বয়সেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন বটে, কিন্তু বাংলাদেশ যে এখনো রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত হয়ে উঠতে পারে নি! তাই শওকত ওসমানের মত মানুষের অভাব এখনো ভীষণভাবে অনুভূত হচ্ছে দেশে। তবে লেখকের শরীরী মৃত্যু ঘটলেও লেখার মাধ্যমে তাঁরা তো অমর।

শওকত ওসমান এদেশের অমর পথিকৃৎদের একজন। শতবর্ষে তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

Monday, January 2, 2017

২০১৬-২০১৭ : বিদায়-স্বাগত

আবুল মোমেন

যে বছরটি অতিবাহিত হল তাতে সবচেয়ে বড় অর্জন বোধহয় জঙ্গিবাদের মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাফল্য। হলি আর্টিজানের বড় হামলা ও প্রাণহানীর ঘটনা সত্ত্বেও মানতেই হবে যে তাতে সরকার মোটেও ঘাবড়ায়নি। সঠিক পথেই জঙ্গিদের মোকাবিলা করেছে। এরপর তাদের গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ নেতা হয় ধরা পড়েছে নয়ত মারা পড়েছে। এর চেয়েও বড় কথা জঙ্গিবাদের পরবর্তী আক্রমণ পরিকল্পনা সবই এ পর্যন্ত বানচাল করা সম্ভব হয়েছে।
এখনও বাংলাদেশ জঙ্গিবাদী আক্রমণ ও তাদের উত্থানের আশংকা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নয়। জামায়াত ও বিভিন্ন ধর্মান্ধ দল ছাড়াও বিএনপির একটি অংশ এদের মদত দিয়েছে। কওমিসহ সব মাদ্রাসার শিক্ষায় ইসলামের কট্টরপন্থার কথাই বেশি আলোচিত হয়ে এসেছে। এখনও বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে বিভিন্ন ব্যাখ্যায় জিহাদের ডাক দেওয়া হয়, অন্য ধর্ম সম্পর্কে নিন্দা প্রচার করা হয়, আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়া হয়, নারীর অধিকার ও স্বাধীনতা সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দেওয়া হয়। এতে আমজনতার ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা তৈরি হয় না, আবার জঙ্গিবাদ সম্পর্কে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। তবুও এদেশে আপামর মানুষের অধিকাংশই ধর্মের নামে হানাহানি ও রক্তপাত পছন্দ করে না। ধর্মের শান্তি ও সাম্যের কথাকেই তারা বিশেষ মূল্য দিয়ে থাকে। সে কারণে আমাদের মনে হয় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু তরুণ হয়ত বিভ্রান্ত হয়ে বিপথগামী হতে পারে কিন্তু বৃহত্তর জনসমাজ কখনো এ পথে পা দেবে না। এ অঞ্চলের মুসলমান সৌহার্দ্য সহযোগিতার শান্তিপূর্ণ পথেই জীবনযাপনে অভ্যস্ত।
রাজনৈতিকভাবে এ বছরটা শান্তিপূর্ণ কেটেছে, এদিক থেকে কোনো বড় আন্দোলন বা নাশকতা হয় নি। বিএনপি এখনো পথের সন্ধানেই আছে, সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে নি। রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন আমাদের গণতান্ত্রিক যাত্রাপথে একটি বড় ঘটনা হয়ে থাকবে। মনে হচ্ছে দেশ পুনরায় সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচনের ধারায় ফিরে এলো। এ নির্বাচনে সৎ ও দক্ষ প্রার্থীর বিজয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যত সম্পর্কে মানুষকে আশাবাদী করে তুলেছে। আশা করা যায় সরকারও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর ভরসা রাখতে পারবে। যদি তা হয় তাহলে এটি হবে ২০১৬ সনের বড় একটি অর্জন।
২০১৬-সনের সালতামামিতে পদ্মা সেতুর কথা আনতে হয়। ২০১৩ তে যখন এটি নিয়ে জল অনেক ঘোলা হয়েছে, বিশ্বব্যাংক আমাদের ওপর এক হাত নিলো তখন সাধারণভাবে জনগণ হতচকিত ও হতাশ হয়ে পড়েছিল। বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদগণও তেমন কোনো আশাব্যঞ্জক পথ দেখাতে পারেন নি। কিন্তু তখনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর নেতৃত্বের দূরদর্শিতা, আত্মবিশ্বাস, সাহস ও দক্ষতা প্রদর্শন করলেন। তাঁকে সে সময় যথাযথ সহায়তা ও পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান। ড. রহমান প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থের সংস্থান করবে এবং সেতু নির্মাণে সমস্যা হবে না। ২০১৬ সনে এসে সেতুর অবকাঠামোর সিংহভাগ নির্মাণ হওয়ার পরে আমরা আজ নি:সন্দেহ হতে পারি এ সেতু সম্পর্কে, গর্ব করতে পারি বাংলাদেশের সামর্থ্য নিয়ে। এভাবে বিশ্বব্যাংকের খবরদারির প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে  প্রধানমন্ত্রী জাতিকে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করলেন। প্রধানমন্ত্রীর এই সাহসী নেতৃত্বের ফলে আজ পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। এখন বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, আইএমএফ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের সাথে কাজ করার জন্যে তৎপর হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ মর্যাদার সাথে তাদের ঋণ নিয়ে দেনদরবার করতে পারছে। এটিও একটি বড় রকমের অগ্রগতি দেশের।
এর মধ্যে দারিদ্রের হার আরো হ্রাস পেয়েছে। মানুষের গড় আয়ু এবং মাথাপিছু আয় তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় উন্নয়নের গতিতে বাংলাদেশ আজ সবার চেয়ে এগিয়ে। কৃষি উৎপাদনে সবক্ষেত্রে - শস্য, সবজি, ফল - বাংলাদেশের অগ্রগতি সারাবিশ্বের মানদণ্ডেই বিস্ময়কর। বাংলাদেশের মানুষ নানাভাবে উৎপাদনমুখী কাজে নিজেদের নিয়োজিত করছে। যারা দেশে পারছে না তারা বিদেশে গিয়ে আয় করছে। অনেক বছর পরে ২০১৬ সনে বিদেশে শ্রমশক্তির রপ্তানিও বাড়তে শুরু করেছে।
এমন অগ্রগতির কথা আরো বলা যাবে। কিন্তু এ সময়ে একটি দুর্ভাবনার কথা বলে নেওয়া উচিত। এখনও আওয়ামী লীগের কিছু স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মী, যুবলীগ-ছাত্রলীগের প্রায় সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা নানামুখী অন্তর্কোন্দলে জড়িয়ে পড়েছে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর পেছনে মূল কারণ হল টাকা পয়সার ভাগ। তারা টেণ্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জায়গা দখলে জড়িয়ে যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে এসব কাজে অস্ত্রসহ ভাড়া খাটছে। এ আমলে ছাত্রলীগ-যুবলীগের অনেক নেতা-কর্মী এভাবে প্রাণ হারিয়েছে। এটা সরকারের ভাবমূর্তিই কেবল ক্ষুণ্ন করছে না, আগামী দিনের নির্বাচনকে অবাধ ও হস্তক্ষেপমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে সরকারকে বেকায়দায় রাখবে বলে মনে হচ্ছে। এটা দল, দেশ এবং গণতন্ত্রের জন্যে ক্ষতিকর হচ্ছে।
এদিকে যতই বোঝা যাচ্ছে বর্তমান সরকার তার পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় তো থাকবেই এমনকি হয়ত ভবিষ্যতেও ক্ষমতায় আসবে তখন বিভিন্ন মত-পথের মানুষজন সরকারি সুবিধা পাওয়ার আসায় আওয়ামী লীগে যোগ দিতেও শুরু করেছ। তাদের মধ্যে নিছক সুবিধা প্রত্যাশী উচ্চাভিলাষীরা যেমন আছে তেমনি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্যে বিপরীত রাজনৈতিক আদর্শের মানুষজনও থাকছে। পত্রিকার খবরেও দেখা যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামি  ও অন্যান্য ধর্মান্ধ দলের অনেকেই ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে। যতজন প্রকাশ্যে সরবে যোগ দিয়েছেন তারচেয়ে অনেক বেশি মানুষ নীরবে গোপনে ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনে মিশে যাচ্ছে। এতে আওয়ামী লীগকে বিপদে পড়তে হতে পারে। দেশেরও বিপদ বাড়বে।
আমরা বলব ২০১৭ সনে সরকারের উচিত হবে মাঠে সুস্থ ধারার রাজনীতি জোরদার করার জন্যে কাজ করা। সংলাপ চালিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনায় বিশ্বাসী আরো রাজনৈতিক দলকে সক্রিয় করা দরকার। এই প্রসঙ্গে বলব প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এ দলে যারা জামায়াতবিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী তাদের সক্রিয় হতে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। এরকম শক্তি মাঠে কার্যকর থাকলে গণতন্ত্রের চর্চা সুসংহত হবে। নয়ত দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে গেলেও তা সুসংহত হবে না রাজনৈতিক অঙ্গনের অস্থিরতার কারণে।
বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার বড় দুর্বলতা হল দেশটি এখনো রাজনৈতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে পরিচালিত দলের অংশগ্রহণে গণতন্ত্র চর্চা করতে পারছে না। আর এর অভাবে - অর্থাৎ যথাযথ প্রতিদ্বন্দ্বী দলের অভাবে - আওয়ামী লীগ মাঠে সক্রিয় একক দলে পরিণত হচ্ছে, যা একনায়কি শাসন তথা ফ্যাসিবাদী তৎপরতার ঝোঁক বাড়াবে। জঙ্গিবাদী উত্থান ও আক্রমণের আশংকা সরকারের এই প্রবণতাকে কেবল জোরদারই করবে। বাংলাদেশে অবস্থার গতিকে আজ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা বিভাগ, সামরিক বাহিনীর ভূমিকার অনেক বড় ও জোরালো হয়েছে। এমন বাস্তবতায় গণতন্ত্র দুর্বল হতে বাধ্য। এই দুর্বলতা ও সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে আওয়ামী লীগ, নাগরিক সমাজ ও সচেতন নাগরিকদের বিশেষভাবে সচেতন সোচ্চার হতে হবে।
আশা করব ২০১৭ তে আমরা গণতন্ত্রের তথা রাজনীতির এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব।



***