Tuesday, April 1, 2014

জিয়াকে আরও বিতর্কিত করা কেন

আবুল মোমেন

বেগম খালেদা জিয়া পুত্রের পথ ধরে ঘোষণা দিলেন যে, তার স্বামী প্রয়াত জিয়াউর রহমানই দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। অন্তর্নিহিত কথাটা হল  বঙ্গবন্ধু নন, জেনারেল জিয়াই বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। কথাটা ঐতিহাসিক এবং সাধারণ আইনি ব্যাখ্যায় ধোপে টেকে না। কেন তা বোঝা দরকার। এতকাল তাদের ও বিএনপির দাবি জিয়া স্বাধীনতার প্রথম ঘোষক, এটুকুতে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন সেটার সঙ্গে যোগ হচ্ছে প্রথম রাষ্ট্রপতির দাবিটি। এতে ইতিহাসে কৃতিত্ব, গুরুত্ব, মহত্ত্ব বাড়ে কি না— আমি জানি না। কিন্তু এসবের পেছনে বঙ্গবন্ধুর কৃতিত্ব, গুরুত্ব, মহত্ত্ব লাঘবের প্রয়াস কাজ করে, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। বর্তমানকালে প্রচারণা জনমত গঠনে একটি বড় হাতিয়ার সন্দেহ নেই। কিন্তু তা বলে বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে জিয়াকে বড় করার কৌশল যে ধোপে টিকবে না, সেটা অন্তত বিচক্ষণ রাজনীতিবিদরা বুঝে থাকেন। সব জাতির ইতিহাসেই এমন কিছু নায়কের আবির্ভাব ঘটে যাদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বিতর্ক করার অবকাশ থাকে না। আর ইতিহাসে এমন কোনও কোনও চরিত্রের আবির্ভাব ঘটে থাকে, যাদের ভূমিকা হয় অস্বচ্ছ এবং বিতর্কিত। জিয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে তেমন একটি চরিত্র।
জিয়া স্বাধীনতার প্রথম ঘোষক বা রাষ্ট্রপতি এ দাবি ঐতিহাসিকভাবেই সত্য নয়। ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে পাকবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ার ও তাকে গ্রেপ্তার করার আগে বঙ্গবন্ধু তত্কালীন ইপিআর বা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে স্বাধীনতার একটি ঘোষণাবার্তা পাঠিয়েছিলেন। সেটি অন্তত চট্টগ্রামে যে কপি করে ও মাইকিং করে জনসাধারণের মধ্যে প্রচারিত-ঘোষিত হয়েছিল সে কথা আমি চট্টগ্রামবাসী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়ে বলতে পারব। সেই বার্তাটি যারা বেতারযন্ত্রে প্রচারের কাজ করেছিলেন তারা অনেকেই এখনও জীবিত আছেন এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় দিয়েছেন, বইয়েও ছাপা হয়েছে তা।
দ্বিতীয়ত, চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র যখন কিছু বেতারকর্মী দখল করে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র চালু করেন তখন ২৬ মার্চ ১৯৭১ দুপুরে সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের তত্কালীন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত এমএ হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার একটি ঘোষণা পাঠ করেন। এরও আগে সদ্য প্রয়াত বেলাল মোহাম্মদের নেতৃত্বে কর্মীরা অধিবেশন শুরু করে বেতারকেন্দ্রটির নামে যেমন স্বাধীনতার ছাপ রাখলেন তেমনি ঘোষণাতেও স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। তবে এসবই নেতা নয়, ঘোষকের বক্তব্য। বস্তুত নেতা বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চ রেসকোর্সের ময়দানেই স্বাধীনতা ও আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। এরপর থেকে দেশের শাসনভার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতেই চলে এসেছিল। বাংলাদেশ বস্তুত সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের দ্বারাই শাসিত হচ্ছিল, জনগণের এটাই ছিল আকাক্সক্ষা এবং এ ব্যবস্থা তাদের চাহিদা ছিল ও তারা এটা আনন্দে মেনে নিয়েছিল। ছাব্বিশে মার্চ যখন বোঝা গেল একদিকে পাকিস্তান সরকার আলোচনা ভেঙে দিয়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সামরিক অভিযান চালাতে শুরু করেছে এবং অন্যদিকে বিভিন্ন সেনানিবাস থেকে আক্রান্ত হয়ে বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকরা সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে তখন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সবারই মনে হল এ পরিস্থিতিতে একজন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তার মুখ থেকে কোনও ঘোষণা এলে জনগণের মনোবল বাড়বে, তারা প্রতিরোধ যুদ্ধের দিকনির্দেশনাও পাবে। এর আগে বেতারের উত্সাহী বেসামরিক কর্মীরা আক্রমণকারী শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর আহ্বান জানিয়ে যেসব ঘোষণা দিয়েছেন তাতে প্রতিরোধের জন্যও মরিচের গুঁড়োসহ নানা দেশি পদ্ধতি ব্যবহারের কথাও বলা হয়েছে। সশস্ত্র সম্মুখযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলতেও তারা ভোলেননি। কিন্তু তবুও ঘটমান বাস্তবতায় বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের ভূমিকা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চেয়েছে মানুষ, চেয়েছে তারা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পাশে থেকে সামরিক যুদ্ধে অংশ নিক ও নেতৃত্ব দিক।
এ রকম একটি পটভূমিতে স্বাধীন বাংলা বেতারের মূল সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা মিলে পটিয়া থেকে তত্কালীন মেজর জিয়াকে কালুরঘাটে সম্প্রচার কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। তারা তার কাছে হানাদারদের আসন্ন আক্রমণ থেকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা চান এবং বেতারে একটি ঘোষণা দেওয়ার প্রস্তাব দেন। জিয়া দুটি প্রস্তাবই গ্রহণ করেন। এ বিষয়ে ঘটনার কারিগর বেলাল মোহাম্মদ তার বইয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। অনেক গবেষকও এ নিয়ে কাজ করেছেন। এসবই ২৭ মার্চের ঘটনা। জিয়া নিজেই ঘোষণার একটি খসড়া করলেন ইংরেজিতে। সম্ভবত অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন সেটির বাংলা অনুবাদ করেন। এই ঘোষণাটি জিয়াউর রহমান পাঠ করেছিলেন। তাতে তিনি নিজেকে অস্থায়ী সরকারের প্রধান হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। এই ভাষ্যটি বেতারে প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামের অভিভাবকস্থানীয় কিছু নাগরিক, যেমন শিল্পপতি একে খান, শিক্ষাবিদ আবুল ফজল, সাহিত্যিক সাংবাদিক মাহবুব উল আলম চৌধুরীসহ অনেকেই বললেন একজন মেজর যদি নিজের নামে এ রকম ঘোষণা দেয় তবে তা হবে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, স্বাধীনতার ঘোষণা হবে না। এটি একমাত্র বঙ্গবন্ধুই দিতে পারেন, নির্বাচনে বিজয়ী দলের প্রধান হিসেবে। সেদিনের শ্রোতারা সাক্ষী আছেন একবারই স্বনামে ঘোষণাটি প্রচারিত হওয়ার পর তা সংশোধিত হয় এবং মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে এ কটি কথা যোগ করতে হয়।
এ থেকে দুটি বিষয় মনে রাখা দরকার। প্রথমত, একজন সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে একটি ঘোষণা পাঠ করার জন্য মেজর জিয়াকে সেদিন স্বাধীনতাকামী রাজনীতিক ও তরুণরা বেতারকেন্দ্রে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি বিদ্রোহ করলেন কোন পরিস্থিতিতে, শেষ মুহূর্তে বিদ্রোহ করেছিলেন সেসব বর্ণনাও বিভিন্ন বইতে রয়েছে খনও সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হননি। তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার সৈন্যদল ও স্থানীয় তরুণদের নিয়ে প্রতিরোধ সংগঠিত করেননি যা দেশের অন্যান্য অঞ্চলে হয়েছে। তিনি নিজে বেতার ঘোষণার প্রয়োজন অনুভব করেননি। তবে প্রাপ্ত সুযোগ কাজে লাগিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, স্বনামে ঘোষণাটির পর বোঝা গেল তার নামে স্বাধীনতার ঘোষণা কার্যকর হয় না, বঙ্গবন্ধুর নামেই তা হতে পারে। ফলে তার এ ভ্রান্তি দ্রুত সংশোধন করতে হয়েছে। তাছাড়া সেদিন জনগণের কাছে জিয়া একজন অপরিচিত ব্যক্তি, মানুষ সামরিক পদবিটিকেই গুরুত্ব দিয়েছে। এ তো স্বাভাবিক ব্যাপার, একজন সামরিক কর্মকর্তাকে মানুষ কীভাবে চিনবে? অর্থাত্ সেদিন একজন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তার প্রয়োজন ছিল আমাদের, তার পদবিটিই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পদবির পরে যে-কোনও নামের একজন বাঙালি হলেই আমাদের চলছিল। আর তখন সবার অন্তরে যেমন জয় বাংলা ধ্বনি তেমনি মন্ত্রও একটিই এক নেতা এক দেশ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ। তাহলে দ্বিতীয় বিষয়টি হল যে ব্যক্তির অসংখ্য বা যে-কোনও সংখ্যক বিকল্প হতে পারে আর যার কোনও বিকল্প হতে পারে না তাদের কী করে এক কাতারে আনা যাবে? এ রকম প্রচেষ্টা সাধু-কর্ম হতে পারে না। বরং এ নিয়ে জেদ করলে যে ভ্রান্তি জিয়া সেদিন আপন হাতে ও কণ্ঠে সংশোধিত করেছিলেন সেটি ফিরিয়ে এনে তাকে অযথা ইতিহাসের আদালতে অভিযুক্ত করা হয়।
আর সেই আক্রান্ত জাতির সামনে নেতার বক্তব্য ও নির্দেশনাই ছিল কাম্য, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কোনও অবকাশ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব মেনে সেদিন সেনা সদস্য ও সাধারণ জনগণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অস্থায়ী সরকার গঠনের মূল কারিগর তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্য নেতৃবৃন্দ তখন নিরাপদ আশ্রয় খুঁজেছেন, যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজেছেন এবং ছড়িয়ে পড়া এমপি ও সহায়ক ব্যক্তিবর্গকে একত্র করার দুরূহ কাজে লিপ্ত ছিলেন। একটি সরকার ঘোষণার আগে ভারত সরকারের সমর্থনও আদায় করতে হয়েছে। এভাবে সবদিক গুছিয়ে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে অস্থায়ী সরকার গঠন করতে করতে ১৭ মে পর্যন্ত লেগে যায়। সেদিন কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের আম্রকাননে, আজ যা মুজিবনগর নামে পরিচিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহণ করে। আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করা হয়। অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন স্বভাবতই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর তার অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব লাভ করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
একথা মানতে হবে ১৯৭১ সালের বাস্তবতায় মেজর জিয়ার কণ্ঠস্বর স্বাধীনতাকামী মানুষের মনে ব্যাপক উত্সাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল। ফলে সেই থেকে জনমনে জিয়ার একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়। ১৯৭৫-এর রক্তাক্ত ঘটনাবলি, ক্ষমতায় এসে তার অনুসৃত রাজনীতি ও বিভিন্ন কার্যক্রম তাকে ক্রমেই বিতর্কিত করেছে। বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যার ঘাতকদের প্রতি তার পৃষ্ঠপোষকতামূলক আচরণ যেমন নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়, তেমনি ক্ষমতায় এসে পাকিস্তানি ধারার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রচলন, স্বাধীনতাবিরোধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দান এসব বিতর্ককে স্থায়ী করে তুলেছে। তার দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর পর বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সেই ধারাটি বহাল রেখে জিয়াউর রহমানকে বিতর্কিত রেখে দেওয়ার ব্যবস্থাই করেছেন। আর বর্তমানে জিয়াকে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দাঁড় করাতে গিয়ে বিষয়টিকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যে প্রাথমিক ভ্রান্তি জিয়া নিজের হাতে সংশোধন করেছিলেন তাকে সেই ভুলের দায় বহন করতে বাধ্য করার মধ্যে ফায়দা কী হতে পারে বোঝা যাচ্ছে না।
এসবই তারেক জিয়ার মস্তিষ্ক থেকেই উদ্ভূত বলে মনে হচ্ছে। পুত্রকে অন্ধভাবে অনুসরণ করছেন বেগম জিয়া। দলে এমন কেউ নেই যারা তাদের উপেক্ষা করে বা সহমতে এনে সঠিক পথটি দেখাতে পারেন। তারেকের প্রত্যক্ষ ও নেপথ্য উভয় প্রকার নেতৃত্বেই বিএনপি রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের ওপর মানুষ নানা কারণে অসন্তুষ্ট, সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষও কম নয়। ফলে নির্বাচনে বিএনপির জন্য জয়ের সুবিধা ভালোভাবেই আছে। অযথা অস্থির ও মরিয়া হয়ে আবোলতাবোল কথা বললে দলের ক্ষতিই হবে, ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কম।