Monday, December 9, 2013

আর কত অশ্বডিম্ব চাইব

আবুল মোমেন

একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষে জাতিসঙ্ঘের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো এখনও ঢাকায় অবস্থান করছেন। প্রতিদিন দফায় দফায় তিনি নানা জনের সাথে বসছেন। তাঁর মিশনের লক্ষ্য একটিই - বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান। ধরে নেওয়া হচ্ছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যোগ না দিলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। কথাটা বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষও বিশ্বাস করেন বলে মনে হয়। কথাটা অসত্য নয় যে দেশের একটি প্রধান দলকে বাদ দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
কিন্তু এখানে আরও দুটি কথা থেকে যায় - প্রথমত, বিএনপি একা নেই আর, যে ১৮ দল নিয়ে বিএনপি জোট করেছে তার প্রধান শরিক দল হল জামায়াতে ইসলামি, যারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত। এযাবৎ বিএনপি স্পষ্ট করে নি তারা নির্বাচনে জামায়াতকে বাদ দিয়ে নতুনভাবে জোট সাজাবে কিনা। জামায়াত অবশ্য দল হিসেবে নিষিদ্ধ না হলেও নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। আর এর মধ্যে চূড়ান্ত রায় হয়ে যাচ্ছে তাদের অনেক নেতার। এ বাস্তবতায় জামায়াত মাঠপর্যায়ে সহিংসতা ছড়িয়ে দিলে বিএনপি কি তা মেনে নেবে? তাছাড়া বিএনপিরও দুই নেতা এ অপরাধের মামলায় শাস্তি পেয়েছেন। তাঁদের ব্যাপারে দলের অবস্থান পরিষ্কার নয়। দ্বিতীয় যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হল বর্তমানে দুই বড় জোটের পক্ষে একমত হয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন আর সম্ভব নয়। এর মধ্যে তাদের পারস্পরিক অনাস্থা ও বিদ্বেষ সর্বকালের সর্বোচ্চ অবস্থায় আছে এখন। দু’দল যেভাবে স্ব স্ব অবস্থানে অনড় রয়েছেন তাতে এ বিষয়েও তাঁরা চুল পরিমাণ সরবেন এমন ভরসা আমরা পাচ্ছি না।
এর পরেও কথা থেকে যায়, ১৯৯১ থেকে এ পর্যন্ত অন্তত তিনটি নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা তেমন হয় নি। ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০৮-এর নির্বাচন। কিন্তু সেসব নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হওয়া সত্ত্বেও কি ঐ তিন মেয়াদে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে সচল ছিল? আমরা বরাবর দেখে আসছি দুই দলের মধ্যে যখন যে দল পরাজিত হয়ে সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসেছেন তাঁরা সরকারি দলের কাছে থেকে যথাযথ সম্মান ও ভূমিকা পালনের সুযোগ পান নি। বিজয়ের দখলে সব - এই হচ্ছে আমাদের নীতি। এর ফলে বিরোধী দলের কাজ ছিল যে কোন মূল্যে সরকারকে অকার্যকর করা। সংসদ বর্জন, সংসদকে অপ্রয়োজনীয় কিন্তু অশালীন বিতর্কে জড়ানো। আর রাজপথে চলেছে আন্দোলনের নামে নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ড যা নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে চলতে ক্রমান্বয়ে সহিংস হয়ে উঠেছে। এভাবে উভয় পক্ষে রাজনীতি থেকে নীতিবাদী ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষরা বাদ পড়েছেন আর গুরুত্ব পেয়েছেন কালোটাকার মালিক ও সহিংসতা-নাশকতায় দক্ষ নেতা-কর্মী এবং ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা। এভাবে রাজনীতির সাথে দিনে দিনে নানামাত্রায় সহিংসতার যোগ ঘটে গেছে।
ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই যদি আমরা একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশের নিশ্চয়তা পেতাম তাহলেই এই দরকষাকষি ও দেনদরবার সত্যিকারভাবে সফল হতে পারত। নিরপেক্ষ মানুষ বরং বলতে চাইবে গত প্রায় বাইশ বছরের গণতান্ত্রিক আমলের রাজনীতি বেশি হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক হয়ে পড়েছে।
আমাদের রাজনীতি যেসব ব্যাধিতে ভুগছে তার নিদান তো নির্বাচনে নেই। নির্বাচন এর একটি ঔষধ হতে পারে, কিন্তু এটি ধন্বন্তরি নয় যে এক ওষুধে রোগ সারবে। রোগ সম্পূর্ণ নিরাময়ের জন্যে আরও ঔষধ লাগবে।
আসল রোগ তো বাংলাদেশের রাজনীতির আদর্শিক ভিত্তি কী হবে বা কোন কোন বিষয় সবার জন্যে একই থাকবে তা ঠিক করা। একাজ আরব্ধ রেখে ঘুরপথে ক্ষমতা দখল করা যায় কিন্তু পদে পদে পা হড়কাবেই। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে আমাদের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক নীতি-আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রতিফলন থাকতে হবে। সাংসদদের ভূমিকাও ঠিক করতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, জনপ্রশাসনকে চাকুরিবিধির আওতায় দক্ষতার মূল্যায়নে পরিচালনা এবং স্থানীয় সরকার, দুর্নীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতায়ন  ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হলে কেবল সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে হবে না। এ সময়ে বরং নাগরিক সমাজের উচিত হবে আমরা যেমন দেশ চাই তার একটি চার্টার তৈরি করে দুই দলের সাথে আলোচনা শুরু করা। দু’দলকেই সংশোধনের জন্যে ও করণীয় সম্পর্কে বলার কথা অনেক আছে। সেই প্রক্রিয়াই বরং তাদের উভয়ের জন্যে একটি সমতার ভূমি তৈরি করবে। প্রয়োজনীয় সকল আইন ও বিধি সংস্কার সম্পর্কে আইনের সুপারিশ তৈরি করা দরকার।
যেসব বাধার কারণে আমাদের সংসদ ও গণতন্ত্র অচল হয়ে পড়ে, আমাদের রাজনীতি দুর্নীতিগ্রস্ত ও হিংসাত্মক হয়ে ওঠে, আমাদের দুর্নীতি দমন ও নির্বাচন কমিশন দুর্বল হয়ে যায়, স্থানীয় সরকার ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে যায় তা দূর করতে হবে।
বড় দুই দল নির্বাচন নিয়ে পরস্পর বিরোধী অনড় অবস্থানে থাকলেও কিন্তু ওপরের বিষয়গুলোতে অনড়ভাবে এক থাকেন। তাঁদের এই অনড় সহাবস্থান দেশের জনগণ, গণতন্ত্র, রাজনীতি সব কিছুর জন্যই ক্ষতিকর। যদি নাগরিক সমাজ সত্যিই দেশের জন্যে দীর্ঘমেয়াদী টেকসই কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থান সন্ধান করেন তো তাঁদের সকল প্রয়াস কেবল সুষ্ঠু নির্বাচনে সীমাবদ্ধ রাখা ঠিক হবে না। তাতে সমস্যার একটি যেনতেন সমাধানমাত্র হতে পারে। তাতে আমাদের খুব বেশি উপকার হবে না। লাভ হতে পারে বড় দুই দলের কোনো একটির, যারা জয়ী হবে। হাতে সময় কম। এবারের নির্বাচন না হয় যেনতেন প্রকারের সুষ্ঠু নির্বাচনের অশ্বডিম্ব হোক। হয়ে যাক এবার। কিন্তু এবার দুই বড় দল যখন চাপে আছে, এবং আন্তর্জাতিক মহলও সক্রিয় তখনই মূল বিষয়ে আলোচনা শুরু করা দরকার। কেননা আর কত অশ্বডিম্ব প্রসব করবে ‘সুষ্ঠু নির্বাচন’। আমরা ফলপ্রসূ তাৎপর্যপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা চাই। সেটার জন্যে জনগণকে সজাগ এবং সক্রিয় করতে হবে।