Saturday, December 14, 2013

ক্ষমতার বৃত্ত ভেঙে যাক, আদর্শ ও নীতির রাজনীতি মুক্তি পাক

আবুল মোমেন

বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা স্বাভাবিক নয় তা আমরা জানি। বর্তমানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও আমরা জানি সংকটের মূল উৎস রাজনীতি। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরেই এ অচলাবস্থা ও সংকট সৃষ্টি হলেও আমরা জানি বিরোধের মূলে একটি আদর্শিক-নৈতিক দ্বন্দ্ব রয়েছে।
অনেক দিন ধরেই দেশের নাগরিকসমাজ দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এক কাতারে রেখে দুটি ক্ষমতাপাগল দল হিসেবে চিহ্নিত করে যাচ্ছেন। বর্তমান সংকট ঘনীভূত হওয়ার পর এই বক্তব্য ও সমালোচনা আরও ব্যাপকভাবে ও তীব্রতার সঙ্গেই হচ্ছে। কিন্তু কথাটা অনেকাংশে সত্য হলেও দেখা যাচ্ছে দুই বড় দলের কেউই তাদের স্ব স্ব নীতি-আদর্শের জায়গা থেকে সরতে রাজি নয়। বস্তুত বর্তমানে আদর্শিক-নৈতিক অবস্থানে তাদের অটলতা আরও স্পষ্ট হচ্ছে।
আমরা জানি দুই দলের মধ্যে আদর্শিক ঝোঁক কার কোন দিকে। আদর্শিক অবস্থানের দৃঢ়তা এক ধরনের নৈতিক ভূমিকা ও অবস্থান তৈরি করে। আমাদের সময় সঠিকভাবেই মনে করছে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দলকে সমর্থন দিয়ে আজ বিএনপি নৈতিকভাবে পরাজিত হয়েছে। একটা বিষয় বাংলাদেশের কোনো নাগরিক অস্বীকার করতে পারবে না - তা হল মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমেই দেশ স্বাধীন হয়েছে, এটি হচ্ছে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এবং সর্বোপরি, বিষয়টিতে কোনো অতিরঞ্জন, বিকৃতি বা বিভ্রান্তির অবকাশ নেই। নিশ্চিত করেই বলা যায় তরুণ প্রজন্ম এই গৌরবের অংশীদার হতে চাইবে, চাইছে। এ কথাও মনে রাখতে হবে মুক্তিযুদ্ধকে কোনোভাবেই ইসলাম ধর্মের প্রতিপক্ষ হিসেবে খাড়া করা যাবে না। এ নিয়ে সাময়িক বিভ্রান্তি হতে পারে কারও, কেউ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সব ধর্ম-বর্ণ-জাতিকে গ্রহণ করার যে মানবিক ঔদার্যের প্রকাশ ঘটেছিল তাকে ইসলামের বিপরীতে দাঁড় করাতে চাইতে পারে। কিন্তু তাতে ইসলামের মূল শিক্ষা ও মহানুভবতার ঐতিহ্যকেই অস্বীকার করা হয়। যারা একাত্তরে ইসলাম ধর্মের নামে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তারা ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ ভুলে গিয়ে জালেমের আদর্শ নিয়েছিল ও তাদের সাথেই হাত মিলিয়েছিল।
আমরা বরং বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করব, যখন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকানো গেল না, যখন বাংলাদেশ একেবারেই বাস্তবতা, আর আজ বেয়াল্লিশ বছর পরেও সেই দেশ টিকে আছে ও সবাইকে বিস্মিত করে এগিয়ে চলেছে তখনও এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করা কি কোনো স্বাভাবিক, সৎ রাজনীতি হতে পারে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার রাজনীতি হওয়া তো দূরের কথা?
জামায়াতে ইসলামি পুনরুজ্জীবিত হয়েছে আজ তিন যুগ হতে চলল। ভাবা যায়, এতদিন ধরে তারা একইভাবে একাত্তর-পূর্ববর্তী ধারার রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে! পরিবর্তিত বাস্তবতায় একটি রাজনৈতিক দলকে যে তার কৌশল ও অবস্থান পরিবর্তন করতে হয় তা তাদের নেতৃত্ব কেন ভাবে নি সেটা সত্যিই বিস্ময়কর ব্যাপার। তারা বরাবর ইসলামি বিপ্লবের কথা বলে এসেছে, অথচ ইসলামের ইতিহাসে আমাদের নবী এবং পরবর্তী সফল খলিফাদের জীবনেই আমরা দেখি প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয়, যাতে কৌশল হিসেবে কখনও তাঁরা ইহুদিদের সাথে কখনও খ্রিস্টানদের সাথেও সখ্য করেছেন, তাদের সহায়তা নিয়েছেন, সহায়তা দিয়েছেন। কখন জেহাদি ভূমিকা নিতে হবে কখন সম্প্রীতির পথে চলতে হবে তা যে নেতৃত্ব উপলব্ধি করতে পারে না সে তো অন্ধ ও স্থবির নেতৃত্ব। নতুন কৌশল হিসেবে জামায়াত জোর দিয়েছে দল ও দলীয় ব্যক্তিবর্গের আর্থিক ভিত্তি দৃঢ় করার ওপর। তারা ব্যাংক-বীমা-এনজিও ও অন্যান্য আর্থিক কর্মসূচীর মাধ্যমে নির্ভরশীল সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি ও তার পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। যতদূর বোঝা যায় বরাবর ধর্ম বিপন্ন এই ধুয়া তুলে আর ধর্মীয় বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিয়ে তারা তরুণ ও সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছে। এ কাজে তারা সবসময় আওয়ামী লীগ এবং দেশের বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন, যারা অধিকাংশই ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান। এভাবে একদেশদর্শী ভূমিকা নেওয়ায় ইসলামের সাম্য ও উদার মানবতার নীতি ও বাণী তাদের হাতে বারবার দলিত উপেক্ষিত হয়েছে।
ফলে বাস্তবতা হল এই - জামায়াত একদিকে জাতির গৌরবময় ইতিহাসের ও অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিপক্ষে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করতে চাইছে। বলা যায়, জাতির ইতিহাস ও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তাদের প্রতিপক্ষ আজ। তাতে বিপ্লবের নামে বাস্তবে তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে ধ্বংসাত্মক নাশকতামূলক কাজকর্মের ওপর। এভাবে কোনো রাজনীতিকেই এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।
দেশে ও প্রতিবেশী দেশে এরকম ভ্রান্ত বিপ্লবী রাজনীতির করুণ পরিণতি আমরা দেখেছি। স্বাধীনতার পরপর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বিপ্লবী স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করে জাসদ দেশের তরুণ মেধাবী এক প্রজন্মের বিশাল ক্ষতি করেছে, সত্তরের দশকের গোড়ায় পশ্চিম বঙ্গের নকশাল আন্দোলনে একইভাবে মেধাবী তারুণ্যের বিপুল অপচয় ঘটেছে। জামায়াত-শিবির গত তিন দশকে অনেক মেধাবী তরুণকে একইভাবে ইসলামী বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিয়ে ভ্রান্ত রাজনীতির কুহকে বিপ্লবের কানাগলিতে রুদ্ধ করে ফেলেছে।
জামায়াতকে আজ নিজেদের রাজনীতি নিয়ে মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে আত্মসমালোচনার পথে যেতে হবে, অতীতের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। রক্তরঞ্জিত হাত নিয়ে গণতন্ত্রের রাজনীতি চলতে পারে না, ইসলামি রাজনীতিও নয়! জামায়াত ভুল পথে চলছে তাতো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। বিএনপি? যত দোষই সুশীলসমাজ দিক না কেন, শেখ হাসিনার জেদ বলুন, গোঁয়ার্তুমি বলুন তা কিন্তু তার দলকে নিছক ক্ষমতার বৃত্ত থেকে বর্তমানে এক আদর্শিক লড়াইয়ের ময়দানে হাজির করে নিয়ে এসেছে। অল্প কয়েকটি সমমনা প্রগতিশীল দল ব্যতীত অন্যরা তাঁকে একা ঠেলে দিয়েছে এই লড়াইয়ে। বঙ্গবন্ধু কন্যা তাতে দমেন নি, ভয় পান নি, হয়ত মাঝে মাঝে দুঃখকষ্ট রাগ সামলাতে পারেন নি, এ কঠিন সময়ে তাঁর পাশে যাদের থাকার কথা ছিল তাদের বিরুদ্ধতায় ক্ষুব্ধ-বিষোদ্গার করেছেন বটে, কিন্তু লড়াইটা জারি রেখে তিনি আদর্শকে নৈতিক অবস্থানে নিয়ে যেতে পেরেছেন। ফলে সম-আদর্শে বিশ্বাসী  যারা এ লড়াইয়ে দূরে থাকছেন তাঁরা কিন্তু ইতিহাসের কাছে নৈতিকভাবে দায়ি থাকবেন। এটাও মনে রাখতে হবে লড়াইয়ের মূল রণক্ষেত্র অর্থাৎ যেখানে মূল প্রতিপক্ষ রয়েছে তা বাদ দিয়ে আলাদা ফ্রন্টে থাকা বা ভিন্ন তৎপরতা কখনও সৌখিনতার মাত্রা ছাপিয়ে যেতে পারবে না। আর যাই হোক আজকে বামপন্থার কিংবা বুদ্ধিজীবীদের সৌখিনতার পরিণতি দেশ ও জাতির জন্যে মঙ্গলজনক হবে না। মঙ্গল হবে না বিএনপির নৈতিক পরাজয়ের অবস্থানে একগুঁয়েমি করে যাওয়াটা। তাতে মানুষের দুঃখকষ্ট শুধু বাড়বে। আমরা জানি মানুষের দুঃখকষ্ট সহ্য করার একটা মাত্রা থাকে। মাত্রা ছাড়া দুঃখকষ্ট জাতির ওপর চাপিয়ে দিতে পারলে অনেকসময় সমাজে যে প্রবল চাপ তৈরি হয় তাতে শুভশক্তিকেও পিছু হটতে হয়। কিন্তু সেটা কখনও জাতির জন্যে কল্যাণকর হয় না, কারণ তাতে ইতিহাসের পশ্চাদযাত্রা প্রায় অবধারিত হয়ে পড়ে।
জামায়াতের মতই বিএনপিকেও ভাবতে হবে, ভাবতে হবে তার প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের রাজনীতির থেকে স্বতন্ত্র, সম্ভব হলে আরও অগ্রসর, রাজনীতি তারা কী দিতে পারে জাতিকে। কিন্তু একাত্তর-পূর্ববর্তী রাজনৈতিক ধ্যানধারণা নিয়ে বেগম জিয়া দলকে জামায়াতের সহযোগীতেই পরিণত করবেন। নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক রাজনীতির ওপর নির্ভর করে বিএনপির কোনো তাৎক্ষণিক লাভ যদি হয়ও, সুদূরপ্রসারী ক্ষতি হবে অনেক বেশি। কারণ নৈতিক পরাজয়ের পর একটি দলের সৎ রাজনৈতিক কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা থাকে না। তখন তাদের ছাপিয়ে দলে ভাড়াটে মাস্তান ও কর্মীরা জায়গা দখল করে নেবে। সেটা আখেরে ক্ষতিকর হবে। দেশের সুশীলসমাজের কাছেও আবেদন প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়ানোর প্রয়োজন নেই তাঁদের। কিন্তু টকশো-কলাম-মানববন্ধনে তাঁরা যেন জাতির ভবিষ্যত মাথায় রেখে কথা বলেন, ইতিহাসের  প্রেক্ষাপট মনে রেখে সঙ্গতিপূর্ণ অবস্থান নেন এবং বর্তমান সংকটের আদর্শিক ও নৈতিক দিকটি বুঝেই নিজেদের ভূমিকা নির্ধারণ করেন।