Monday, December 30, 2013

কঠিন বছর পেরিয়ে কঠিন বছরে পদার্পণ

আবুল মোমেন

সময় প্রবহমান, কাল নিরবধি। তারপরেও সুবিধার জন্যে সময়ের নানা বিভাজন করে নিয়েছে মানুষ। এইসব বিভাজনের সবকটিরই আলাদা গুরুত্ব আছে। তবে মূল্যায়নের জন্যে বছরের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। আমরা অবশ্য এমন একটা বছর শেষ করতে যাচ্ছি আজ যেটি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি নাটকীয় অধ্যায়ের মাঝখানে রয়েছে। আজ বছরের হিসেবে ২০১৩ সন শেষ হচ্ছে কিন্তু যে রাজনৈতিক হিংসাত্মক ঝোড়া হাওয়ার মধ্যে আছি তার সমাপ্তি আজ হবে না। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ দশম সংসদের নির্বাচনের মাধ্যমেও তা শেষ হবে বলে মনে হয় না। বরং যেভাবে সব চলছে তাতে সেদিন হয়ত হিংসার নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে।
২০১৩ সন শুরু হয়েছিল জানুয়ারি মাসে যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আযাদের - অনেক গণমাধ্যমে যে ব্যক্তি বাচ্চু রাজাকার নামে পরিচিত - ফাঁসির রায় ঘোষণার মাধ্যমে। এটি ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ও যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রথম রায়। অভিযুক্ত ব্যক্তি অবশ্য পলাতক এবং কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত না থাকায় এ রায় নিয়ে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় নি। কিন্তু ফেব্র“য়ারির ৫ তারিখ জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ায় একে গুরু অপরাধের লঘু শাস্তি গণ্য করে ঢাকায় তরুণসমাজ রায় প্রত্যাখ্যান করে রীতিমত বিপ্লবী কাণ্ড ঘটায়। এটি সর্বত্র গণজাগরণ মঞ্চ নামে অভিহিত হয়। কোনো রকম সাংগঠনিক ভিত্তি ছাড়া কেবলমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে এরকম বিশাল গণজাগরণ সৃষ্টি কেবল অবাক করে নি জনগণকে, একই সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও গণতান্ত্রিক মূল্যাবোধে বিশ্বাসী সকলকে আশাবাদী ও আশ্বস্ত করে তুলেছিল।
কিন্তু এরপরে ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মামলার রায়ে আসামীকে ফাঁসি দেওয়ায় তাঁর অঞ্চল পিরোজপুর এবং জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেক প্রাণহানী ঘটেছে, বিপুল সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগ সমর্থকরা বিশেষভাবে আক্রমণের শিকার হন।
ফেব্র“য়ারি মাসের এ দুটি ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশের দুটি শক্তিশালী মতাদর্শের বিপরীত অবস্থানটা স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। প্রতিক্রিয়ার এই প্রত্যাঘাতে তরুণরা পিছু হটেনি, বরং গণজাগরণ মঞ্চকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করেছে, তীব্র প্রতিকূলতার মুখেও মাঠ ছাড়ে নি, আন্দোলনকে রাজপথে সরব রেখেছে। অন্যদিকে জামায়াত হিংসাত্মক আক্রমণের রাস্তা বেছে নিয়েছে। তারা জোটের বড় শরিক ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে আন্দোলনের মাঠে সঙ্গে পেয়েছে, যদিও এ দলের জন্যে পরবর্তী নির্বাচন ও তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুটি মুখ্য।
বিএনপির দিক থেকেও অবশ্য এটিই ছিল চাহিদা অর্থাৎ জামায়াত হিংসাত্মক ভূমিকায় মাঠে থাকুক। ফলে বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোটের তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুর আন্দোলন জামায়াতের সহিংস প্রতিক্রিয়ার একটা ঢাল হিসেবে কাজ করেছে।
এর মধ্যেই আরও ঘটনায় পরিস্থিতি জটিল ও উত্তপ্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে জামায়াত সম্পর্কে যেসব পর্যবেক্ষণ এসেছে তাতে দলটি যুদ্ধাপরাধী ও হিংসাত্মক রাজনীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে। এক পর্যায়ে আদালতের রায়ে জামায়াতের ইসলামি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য ঘোষিত হয়। অন্যদিকে গণজাগরণ মঞ্চের চাপে সরকার সংসদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আদালত আইন সংশোধন করে সরকারের জন্যে উচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ তৈরি করে। আর পরবর্তী সময়ে আরও কয়েকটি রায় হয় যাতে জামায়াতের তাত্ত্বিক নেতা গোলাম আযম ও বিএনপি নেতা আবদুল আলীম বয়সের কারণে দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেও জামায়াতের নেতা আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসির আদেশ হয়। সরকারি আপিলে উচ্চ আদালতে পুনর্বিচারে কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ হয় এবং সবশেষে আপিল বিভাগে রায় বহাল থাকায় শেষ পর্যন্ত এই আদেশ কার্যকর হয়। এরপর আবারও জামায়াতের তীব্র সহিংস প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন এলাকায় বহু প্রাণহানি ও সম্পদহানি ঘটেছে। এসব ঘটনা অনেকের জন্যে একাত্তরের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে। তাছাড়া এ ঘটনায় পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াও দেশে প্রবল প্রতিবাদ সৃষ্টি করেছে। পাশাপাশি জমায়াতের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কে যে অটুট আছে তাও প্রমাণিত হয়। জামায়াতের এই সহিংস প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি ১৮ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে রাজপথে আন্দোলন চাঙ্গা রাখার চেষ্টা হয়েছে বরাবর। এর মধ্যে ৫মে কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক হেফাজতে ইসলাম সংগঠন ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে বিশাল সমাবেশ করে সরকার, গণজাগরণ মঞ্চ এবং প্রগতিশীল সমাজকে রীতিমত শংকাগ্রস্ত করে তোলে। বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং তাঁর দল বিএনপি এটিকে কাজে লাগানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চালান। ফলে খোদ রাজধানীতে বড় রকমের সংঘাতের আশংকা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত শেষরাতে পুলিশ ও র‌্যাব আধঘণ্টার অভিযান চালিয়ে সমাবেশ ভেঙে দিতে সক্ষম হয়। দেখা গেল যথার্থ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও অঙ্গীকার ছাড়া কেবল শ্লোগানের ওপর ভর করে কোনো দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন করা যায় না। সরকার হেফাজতকে পক্ষে রাখার এবং বিএনপি-জামায়াত থেকে দূরে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত কট্টরপন্থী এই গোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত বিবদমান কোনো পক্ষেরই নির্ভরযোগ্য সঙ্গী হতে পারে নি।
এদিকে সরকার, বরং বলা যায় ১৪ দলীয় জোটের প্রধান দল আওয়ামী লীগ, কৌশল হিসেবে গণজাগরণ মঞ্চকে দীর্ঘদিন রাজপথে রাখতে গিয়ে এর যে অরাজনৈতিক নির্দলীয় রূপ তাকে নষ্ট করে পুরো আন্দোলনের ক্ষতি করেছে। সেই থেকে মঞ্চ আর প্রথম দিককার ভূমিকায় ফিরতে পারে নি।
এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলে ও সরকারে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করায় তাঁর নিজের দল ও সরকার সম্পূর্ণ তাঁর মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে। এর ফলে ধর্মান্ধ শক্তির বিরুদ্ধে মাঠ পর্যায়ে রাজনৈতিক প্রতিরোধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগ কার্যত সংগঠন হিসেবে স্থবির হয়ে পড়েছে অথবা তারাও ভাড়াটে বাহিনী দিয়ে লাঠিয়ালের কাজ করাচ্ছে।
একদিকে আওয়ামী লীগের স্থবিরতা আর অন্যদিকে বিএনপির অক্ষমতা মিলে রাজনৈতিক অঙ্গন প্রায় সারা বছর একপক্ষে জামায়াতি ক্যাডার ও ভাড়াটে মাস্তান এবং অন্যপক্ষে সরকারি বিভিন্ন বাহিনীর দখলে থাকল।
এরই চূড়ান্ত মহড়া আমরা দেখতে পেয়েছি আঠার দলীয় জোটের পূর্বঘোষিত মার্চ ফর ডেমোক্রেসির দিন। খালেদা জিয়ার আহ্বানে এ কর্মসূচী পরের দিনও প্রলম্বিত হল। কিন্তু এ থেকে যে বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে তাহল জামায়াতের কার্যকর ভূমিকা ছাড়া বিএনপির পক্ষে রাজপথ দখলে রেখে সরকারি দমনপীড়নের বাধা ডিঙিয়ে কিছু করা প্রায় অসম্ভব। সরকারি বাহিনী মাঠে সক্রিয় থাকলে মাস্তানরাও পিছিয়ে যায়। আর সরকারের সাথে আগেই বিভিন্ন স্থানে রীতিমত সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত হয়ে জামায়াত-শিবিরের শক্তিও এর মধ্যে অনেকাংশেই হ্রাস পেয়েছে। ফলে আপাতত বেগম জিয়াকে মূলত গণমাধ্যমের ওপর নির্ভর করে আন্দোলন জারি রাখতে হবে।
সামাজিক সূচকে নানান অগ্রগতি হলেও বিগত বছরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেক দুর্বলতা উন্মোচিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের মত দেশের সবচেয়ে প্রাচীন গণতান্ত্রিক দলকেও রাজনৈতিক বিরোধিতা সামলাতে সংগঠন ও রাজনৈতিক কর্মসূচির পরিবর্তে সরকারি বাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারের মতই প্রবল হিংসাত্মক বিরোধিতা ঠেকাতে শেখ হাসিনাকেও পিতার মত একই রকম অ্যাকশনের পুনরাবৃত্তি করতে গিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, প্রমাণ হতে চলেছে বিএনপির মত দল অনেকটাই পরগাছার মত। ব্যাপক সমর্থন থাকলেও দলে ত্যাগী ও সংগ্রামী স্থানীয় নেতা-কর্মীর অভাব রয়েছে। তৃতীয়ত, বোঝা যাচ্ছে নাগরিকসমাজ তাদের ভূমিকা নির্ধারণ করতে পারছে না, তাদের ভূমিকায় পূর্বাপর সামঞ্জস্য থাকছে না।
হয়ত একটু আগাম হবে বলা, তবে আলামতে মনে হচ্ছে, আগেকার মত ইসলামের দোহাই দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর দিন বোধহয় ফুরিয়ে এসেছে। হেফাজতে ইসলামসহ বিএনপি-জামায়াত জোট এ ধারায় ব্যাপক প্রচারণা চালানো সত্ত্বেও মনে হয় এ সমালোচনার আর সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্যতা নেই। আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, বঙ্গবন্ধুর সরকার সামরিক বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তা বাহিনীর আশানুরূপ সহায়তা-সমর্থন পায় নি, কিন্তু শেখ হাসিনা মনে হচ্ছে এ জায়গায় অনেকখানি এগিয়েছেন। ফলে জবরদস্তিমূলক ভোটারহীন প্রার্থীবিহীন সাজানো নির্বাচনের ব্যবস্থা করে এবং গণমাধ্যম, সুশীলসমাজ ও আন্তর্জাতিক মহলের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েও বিরোধী জোটের আন্দোলনের মুখোমুখি হয়ে নিজ অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছেন। আমরা দেখেছি বরং বিএনপি সমঝোতার স্বার্থে  নিজ অবস্থান থেকে অনেকখানি সরে এসেছিল। বস্তুত শেখ হাসিনা নির্বাচন ও গণতন্ত্রকে এখন ততটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না, তার বিবেচনায় এর আগের কাজ হল দেশকে হারানো লক্ষ্যাদর্শের পথে ফিরিয়ে আনা। তাঁর সাথে নাগরিকসমাজের দূরত্ব বেড়েছে। তবে প্রায় একক জেদ এবং দলীয় ও সরকারি মদতে তিনি যদি টিকে যান, সফল হন তবে এ দূরত্ব কমে যাবে বলেই তাঁর বিশ্বাস। তিনি নিজেকে রণাঙ্গণে মনে করছেন Ñ বুদ্ধিজীবীরা অনেককাল তাঁর সঙ্গে থেকে এখন হয়ত রণেভঙ্গ দিয়েছেন।
সম্ভবত আগামী বছরটি হবে আরও কঠিন এবং হয়ত আরও সংঘাতময়। গত একটি বছর রাজনৈতিক অঙ্গনে বস্তুত একক খেলোয়াড় ছিলেন শেখ হাসিনা, আগামী বছরটি তাঁর জন্যে আরও বড় চ্যালেঞ্জ নিয়েই আসছে। এবার তাঁকে ঝড় সামলাতে এবং সমাজের ভাঙনগুলো জোড়া লাগাতে হবে। কাজটা নিশ্চিতভাবেই কঠিন, কিন্তু তিনি তো জেনেশুনেই কঠিন পথে পা দিয়েছেন।

Monday, December 23, 2013

বেহাল দেশে হাল ধরতে হবে নাগরিকদেরই

আবুল মোমেন
 
বাংলাদেশের ইতিহাসে গভীরতম সংকটকাল শুরু হল মনে হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন গণহত্যা চলছিল তখনও মানুষ জানতো তার মূলধারা কোনটি এবং এও জানতো রাজনৈতিক অঙ্গনেও সেটি মূলধারা। স্বাধীনতার পর স্বৈরাচারের ও ধর্মান্ধতার নানা রূপ দেখেছে জাতি। কিন্তু বরাবর তার হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক মানবতার ধারা ও গণতন্ত্রের অভিযাত্রা মূলধারার রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করেছে। আজকে পরিস্থিতি ভিন্নরূপ নিয়েছে। গণতন্ত্র ও জাতির মানবিক বিকাশের পথে রাজনীতি থেকেই তিনটি বড় সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে হয়।
প্রথমত, বর্তমান নির্বাচন ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক আন্দোলনের ঠেলায় বিএনপি নিজের মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক দলের চেহারা ও অবস্থান হারিয়ে ফেলেছে। বরাবর দলটির একটি অংশের টান ছিল ধর্মান্ধ রাজনীতির প্রতি, সেই সূত্রে জামায়াত ও অন্যান্য পাকিস্তানপন্থী ও যুদ্ধাপরাধী দল এবং ব্যক্তির প্রতিও এ দলের সহমর্মিতা বোঝা যেত। ক্ষমতাসীন দল এবং নাগরিক সমাজের কিছু অংশ এবার বাগে পেয়ে বিএনপির ‘মুখোশ’ উন্মোচন করতে চেয়েছে এবং দলটি যে জামায়াতের দোসর তা প্রমাণের সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি। মুশকিল হল, সব জরিপ ও পূর্বাভাসে যে-কোনও পরিস্থিতিতে নির্বাচনে বিজয়ের প্রায় নিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও বিএনপি জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি পক্ষপাত ‘প্রমাণেই’ উৎসাহিত হল।
পরিস্থিতি আগে কখনও এমন হয়নি যে, বিএনপির ভিতরকার মধ্যপন্থি গণতান্ত্রিক শক্তি বিবদমান অবস্থার মধ্যে চরম কোন অবস্থানে না গিয়ে গণতন্ত্রের সমঝোতা সমন্বয়ের পথটি খোলা রাখার জন্য কাজ করবে না বা করতে চেষ্টা করতে পারবে না। সরকার এই ধাক্কায় বিএনপিকে ‘সাইজ’ করার কৌশল নিয়ে এ দলের মধ্যধারার নেতা-কর্মীদের প্রতিও চরমধারার ব্যক্তিদের মতোই আচরণ করেছে। এ অনেকটা একাত্তরের পাক-সরকারের মতো, দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে সব বাঙালিকে এককাতারে ফেলে দেওয়ার ত্রুটির পুনরাবৃত্তি ঘটল। মনে রাখতে হবে রাজনীতিতে জেদ-ক্ষোভের স্থান নেই, নীতি-আদর্শ-কর্মসূচি ছাড়া কৌশল-কূটকৌশলেরই মূল্য আছে। সময়োচিত কৌশলী পদক্ষেপ নিতে না পারলে ক্ষমতার রাজনীতিতে বড় বিয়োগান্তক পরিণতি ঠেকানো যায় না। এই হুঁশ সব পক্ষের থাকা দরকার।
দ্বিতীয় সংকটটি ঘটেছে আওয়ামী লীগকে ঘিরে। বাংলাদেশের রাজনীতির উত্থান-পতনের বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে এখন মাঠে সক্রিয় মূল দলগুলোর মধ্যে বিএনপি, জাপা বা জামায়াতের গায়ে বৈধ-অবৈধতার চিহ্ন এবং তাদের ঘিরে রাজনৈতিক বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। এদিক থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে একমাত্র ‘পরিচ্ছন্ন’ দল ছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু এবারে ২০১৪ সালের নির্বাচনটি করে স্বেচ্ছায় দলটি তার গায়ে কলঙ্ক মেখে নিতে যাচ্ছে। এ ঘটনা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি সংকট সৃষ্টি করবে বলে মনে হয়।
আমি কখনও সক্রিয় রাজনীতি না করলেও দেশের রাজনীতির একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে বরাবর মনে করে এসেছি যে, এদেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারাটি এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এ দলটি কেন্দ্রিয় ভূমিকা পালন করে এসেছে। সমাজে মুক্তচিন্তা ও মানবিক চেতনা লালনের যে ধারাগুলো আছে তা অনুশীলন ও বিকাশে এ দল কখনও প্রত্যক্ষ, কখনও পরোক্ষভাবে মূল ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু এবারে ‘বর্বর’ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে তার পঁচাত্তর পরবর্তী প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি ও জাপার অনুসরণে একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করল।
যে দলের মূল শক্তি ছিল সারা দেশে ছড়ানো তার স্থানীয় নেতা-কর্মীর সমন্বয়ে শক্তিশালী সক্রিয় সংগঠন; তা হয়ে পড়ল নেত্রীকেন্দ্রিক এ ক্ষমতাকেন্দ্রিক এক জড়ভরত প্রতিষ্ঠানে। ক্ষমতার ব্যবহার-অপব্যবহার ছাড়া নেতাকর্মীদের আর কিছু করণীয় থাকল না। যে সংগঠন আইয়ুব-ইয়াহিয়া এবং জিয়া-এরশাদ দুই আমলে দুই জোড়া সেনাশাসকের নির্যাতন-বঞ্চনা সামলে নিয়ে দল ও দেশকে এগিয়ে নিয়েছে মূলত দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা নেতাকর্মীদের সক্রিয়তা ও ত্যাগে সে সংগঠনে এখন এসবের কোনও দাম নেই, ভূমিকা নেই।
ফলে আওয়ামী লীগের সরকারও যে-কোনও স্বৈরাচারী সরকারের মতোই রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রতিপক্ষদের সামলানোর জন্যে সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে সরকারের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর। জানিনা সামরিক স্বৈরাচারদের মতো শেখ হাসিনাও আজ দলীয় নেতাকর্মী ও নীতিনির্ধারকদের সাক্ষীগোপাল বানিয়ে রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার জন্য গোয়েন্দাদের ওপরই নির্ভর করছেন কিনা।
তৃতীয় সংকট জামায়াত ও অন্যান্য ধর্মান্ধ দলগুলোকে নিয়ে তৈরি হয়েছে। মূলত মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার কারণে স্বাধীনতার পর সরকারি নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে এ দলগুলোকে রাজনীতির মাঠ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া এবং ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীদের ঠেকানোর লক্ষ্যে জিয়ার এদের উত্থান ও প্রতিষ্ঠায় সহায়তাদান, দুদিক থেকেই দূরদর্শী বিবেচনার প্রমাণ দেয়নি। কারণ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দমানো যায় কিন্তু নেতৃত্ব সচেতন না হলে এতে ধর্মান্ধতার (ধর্মবিশ্বাস নয়) বৃত্ত ভাঙার জন্য এ বিষয়ে সামাজিক আলোচনা ও সমঝোতার পথগুলো ব্যবহার করার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। ওই সময়ে নিষেধাজ্ঞার চেয়েও জরুরি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের শনাক্ত করা ও বিচারের আওতায় এনে বিষয়টি বকেয়া ফেলে না রেখে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা। আবার ক্ষমতার প্রশ্রয়ে এমন অন্ধ শক্তিকে একসময় বাড়তে দিলে পরে গণতন্ত্রের স্বার্থে তাকে সামলানোর পথও থাকে না।
ফলে জামায়াত এখন বিএনপির কাঁধে চেপেছে আর বিএনপির জামায়াতিকরণ সম্পন্ন করছে। তাছাড়া এদেশের সনাতন ইসলামি শিক্ষার যে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা ও স্থবিরতা চলছিল তার পরিণতি এবং তাদের মধ্যে অচলায়তন ও বিচ্ছিন্নতা থেকে বেরিয়ে আসার সচেতনতা ও তাগিদ সৃষ্টির বিষয়ে কোনও কাজ হয়নি। এর উপায় নিয়ে নিজেদের মধ্যেও কখনও ভাবনা-চিন্তা করা হয়নি। পাশাপাশি রয়েছে বৈশ্বিক পরিস্থিতির পরিবর্তন যা মুসলিম মৌলবাদ উত্থানের প্ররোচনা ও প্রণোদনা তৈরি করে চলেছে। এখানে সম্পদেরও সমাহার ঘটেছে, তাদের শক্তিবৃদ্ধিতে যা সহায়ক হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের মতো বিপুলভাবে মুসলিমপ্রধান একটি দেশে গণতন্ত্রের রাজনীতিকে কীভাবে চরমপন্থার চোরাবালিতে পথ হারাতে না দিয়ে, সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে না দিয়ে আগলে রাখা যায় সেটুকু ভাবার মতো দূরদর্শিতার খুবই প্রয়োজন ছিল। জামায়াত পাকিস্তানি যোগাযোগ ছিন্ন করে ও একাত্তরের ভুল স্বীকার করে বাংলাদেশের বাস্তবতানুযায়ী রাজনীতির রাজপথে আসার সুযোগ গ্রহণ করেনি- এর পেছনে বিএনপির একটা অংশের ভূমিকা থাকা অস্বাভাবিক নয়। এতে দলটির সংকট কাটেনি, যার প্রভাব পড়েছে দেশের রাজনীতিতে।
সংকট তিনটি ধারায় তৈরি হলেও যে-কোনও সংঘাত-সংঘর্ষের নিয়ামানুযায়ী তা রণাঙ্গনে আপাতত দ্বি-ধারায় বিভক্ত হয়েছে। উভয়পক্ষে চরম মতাবলম্বীরা এখনও ঘটনা প্রভাবিত করে চলেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সাধারণত লাগাম ক্রমেই হাতছাড়া হতে থাকে। এখানেও তাই ঘটছে। এ রকম পরিস্থিতি সাধারণ জনগণের জন্য দুটি বাস্তবতা তৈরি করে- একদিকে তাকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়, অন্যদিকে সে ক্রমেই তার জৈবিক তাড়নার বাইরে অন্যান্য আগ্রহ, বিশেষভাবে রাজনৈতিক উৎসাহ, হারিয়ে ফেলতে থাকে। তার ওপর দুই বড় দলের নেত্রীকেন্দ্রিক সংগঠনে হুকুমের রাজনীতির দাপটে জনগণের বিরাজনীতিকরণের ষোলোকলা পূর্ণ হতে চলেছে। জনগণ প্রচলিত রাজনীতিতে আস্থা ও উৎসাহ হারিয়ে ফেললে আমাদের পরিচিত তৃতীয় শক্তির আগমন সহজ হয়। অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, জনগণ প্রাথমিকভাবে অন্তত তাকে স্বাগতও জানাবে। কারণ তার এখন মোটামুটি ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা।
জনগণকে যখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব পথের দিশা দিতে পারে না, কোথাও মানুষের সৃজনশীল চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায় না তখন সম্ভবত সচেতন বিবেকবান ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নিজের ক্ষুদ্র অবস্থান থেকে হলেও শেষ রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যান। এরকমই একটি ডাক আমরা দেশের সব্যসাচী লেখক কবি সৈয়দ শামসুল হকের কাছ থেকে সম্প্রতি পেলাম। তিনি আকুতি জানিয়েছেন বিজয়ী বাংলাদেশকে রক্ষায় আমরা যেন এগিয়ে আসি। কবি সত্যদ্রষ্টা বটে, সমাজের আপামর মানুষের মধ্যেও এই কবিসত্তা বিরাজ করে। দুঃসময়ে নিজের সত্যবোধকে জাগ্রত করে সমাজের বিচ্ছিন্নতা ও বিবাদ ঘোচানো আজ তাই সবার জন্যে সবচেয়ে বড় কাজ। যারা বিবেকবান তারাই প্রকৃত ধার্মিক, তারাই সমাজে গণতান্ত্রিক আবহের শিখাটি সব ঝড়ঝাপ্টার মধ্যেও বাঁচিয়ে রাখেন। রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ- এরকমই একটি প্রয়াস। সমাজে নানা জায়গায় শুভবুদ্ধির মানুষ এরকম মুক্ত মানবিক মঞ্চ তৈরির কথা ভাবছেন, চেষ্টা করে চলেছেন। এবার যেন এই ফেনিল তরঙ্গ ঠেলে বাংলাদেশ-তরণীকে রক্ষা করা ও এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব সচেতন বিবেকবান মানুষকেই নিতে হবে। কারণ, যেসব লক্ষণ সমাজে ফুটে উঠছে তাতে বোঝা যায় প্রচলিত রাজনীতি আদতে অথৈ জলে হাল ধরতে পারছে না অথবা হাল ছেড়েই দিয়েছে। তাই দেশের এই বেহাল অবস্থা।
আসুন, মানবতার নামে, গণতন্ত্রের নামে, মুক্তিযুদ্ধের নামে আপনার মন্যুষ্যত্বের দায় থেকে ভূমিকা নিন, দেশপ্রেমের পরিচয় দিন, নাগরিক দায়িত্ব পালন করুন।

Saturday, December 14, 2013

ক্ষমতার বৃত্ত ভেঙে যাক, আদর্শ ও নীতির রাজনীতি মুক্তি পাক

আবুল মোমেন

বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা স্বাভাবিক নয় তা আমরা জানি। বর্তমানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও আমরা জানি সংকটের মূল উৎস রাজনীতি। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরেই এ অচলাবস্থা ও সংকট সৃষ্টি হলেও আমরা জানি বিরোধের মূলে একটি আদর্শিক-নৈতিক দ্বন্দ্ব রয়েছে।
অনেক দিন ধরেই দেশের নাগরিকসমাজ দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এক কাতারে রেখে দুটি ক্ষমতাপাগল দল হিসেবে চিহ্নিত করে যাচ্ছেন। বর্তমান সংকট ঘনীভূত হওয়ার পর এই বক্তব্য ও সমালোচনা আরও ব্যাপকভাবে ও তীব্রতার সঙ্গেই হচ্ছে। কিন্তু কথাটা অনেকাংশে সত্য হলেও দেখা যাচ্ছে দুই বড় দলের কেউই তাদের স্ব স্ব নীতি-আদর্শের জায়গা থেকে সরতে রাজি নয়। বস্তুত বর্তমানে আদর্শিক-নৈতিক অবস্থানে তাদের অটলতা আরও স্পষ্ট হচ্ছে।
আমরা জানি দুই দলের মধ্যে আদর্শিক ঝোঁক কার কোন দিকে। আদর্শিক অবস্থানের দৃঢ়তা এক ধরনের নৈতিক ভূমিকা ও অবস্থান তৈরি করে। আমাদের সময় সঠিকভাবেই মনে করছে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দলকে সমর্থন দিয়ে আজ বিএনপি নৈতিকভাবে পরাজিত হয়েছে। একটা বিষয় বাংলাদেশের কোনো নাগরিক অস্বীকার করতে পারবে না - তা হল মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমেই দেশ স্বাধীন হয়েছে, এটি হচ্ছে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এবং সর্বোপরি, বিষয়টিতে কোনো অতিরঞ্জন, বিকৃতি বা বিভ্রান্তির অবকাশ নেই। নিশ্চিত করেই বলা যায় তরুণ প্রজন্ম এই গৌরবের অংশীদার হতে চাইবে, চাইছে। এ কথাও মনে রাখতে হবে মুক্তিযুদ্ধকে কোনোভাবেই ইসলাম ধর্মের প্রতিপক্ষ হিসেবে খাড়া করা যাবে না। এ নিয়ে সাময়িক বিভ্রান্তি হতে পারে কারও, কেউ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সব ধর্ম-বর্ণ-জাতিকে গ্রহণ করার যে মানবিক ঔদার্যের প্রকাশ ঘটেছিল তাকে ইসলামের বিপরীতে দাঁড় করাতে চাইতে পারে। কিন্তু তাতে ইসলামের মূল শিক্ষা ও মহানুভবতার ঐতিহ্যকেই অস্বীকার করা হয়। যারা একাত্তরে ইসলাম ধর্মের নামে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তারা ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ ভুলে গিয়ে জালেমের আদর্শ নিয়েছিল ও তাদের সাথেই হাত মিলিয়েছিল।
আমরা বরং বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করব, যখন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকানো গেল না, যখন বাংলাদেশ একেবারেই বাস্তবতা, আর আজ বেয়াল্লিশ বছর পরেও সেই দেশ টিকে আছে ও সবাইকে বিস্মিত করে এগিয়ে চলেছে তখনও এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করা কি কোনো স্বাভাবিক, সৎ রাজনীতি হতে পারে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার রাজনীতি হওয়া তো দূরের কথা?
জামায়াতে ইসলামি পুনরুজ্জীবিত হয়েছে আজ তিন যুগ হতে চলল। ভাবা যায়, এতদিন ধরে তারা একইভাবে একাত্তর-পূর্ববর্তী ধারার রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে! পরিবর্তিত বাস্তবতায় একটি রাজনৈতিক দলকে যে তার কৌশল ও অবস্থান পরিবর্তন করতে হয় তা তাদের নেতৃত্ব কেন ভাবে নি সেটা সত্যিই বিস্ময়কর ব্যাপার। তারা বরাবর ইসলামি বিপ্লবের কথা বলে এসেছে, অথচ ইসলামের ইতিহাসে আমাদের নবী এবং পরবর্তী সফল খলিফাদের জীবনেই আমরা দেখি প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয়, যাতে কৌশল হিসেবে কখনও তাঁরা ইহুদিদের সাথে কখনও খ্রিস্টানদের সাথেও সখ্য করেছেন, তাদের সহায়তা নিয়েছেন, সহায়তা দিয়েছেন। কখন জেহাদি ভূমিকা নিতে হবে কখন সম্প্রীতির পথে চলতে হবে তা যে নেতৃত্ব উপলব্ধি করতে পারে না সে তো অন্ধ ও স্থবির নেতৃত্ব। নতুন কৌশল হিসেবে জামায়াত জোর দিয়েছে দল ও দলীয় ব্যক্তিবর্গের আর্থিক ভিত্তি দৃঢ় করার ওপর। তারা ব্যাংক-বীমা-এনজিও ও অন্যান্য আর্থিক কর্মসূচীর মাধ্যমে নির্ভরশীল সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি ও তার পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। যতদূর বোঝা যায় বরাবর ধর্ম বিপন্ন এই ধুয়া তুলে আর ধর্মীয় বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিয়ে তারা তরুণ ও সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছে। এ কাজে তারা সবসময় আওয়ামী লীগ এবং দেশের বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন, যারা অধিকাংশই ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান। এভাবে একদেশদর্শী ভূমিকা নেওয়ায় ইসলামের সাম্য ও উদার মানবতার নীতি ও বাণী তাদের হাতে বারবার দলিত উপেক্ষিত হয়েছে।
ফলে বাস্তবতা হল এই - জামায়াত একদিকে জাতির গৌরবময় ইতিহাসের ও অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিপক্ষে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করতে চাইছে। বলা যায়, জাতির ইতিহাস ও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তাদের প্রতিপক্ষ আজ। তাতে বিপ্লবের নামে বাস্তবে তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে ধ্বংসাত্মক নাশকতামূলক কাজকর্মের ওপর। এভাবে কোনো রাজনীতিকেই এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।
দেশে ও প্রতিবেশী দেশে এরকম ভ্রান্ত বিপ্লবী রাজনীতির করুণ পরিণতি আমরা দেখেছি। স্বাধীনতার পরপর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বিপ্লবী স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করে জাসদ দেশের তরুণ মেধাবী এক প্রজন্মের বিশাল ক্ষতি করেছে, সত্তরের দশকের গোড়ায় পশ্চিম বঙ্গের নকশাল আন্দোলনে একইভাবে মেধাবী তারুণ্যের বিপুল অপচয় ঘটেছে। জামায়াত-শিবির গত তিন দশকে অনেক মেধাবী তরুণকে একইভাবে ইসলামী বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিয়ে ভ্রান্ত রাজনীতির কুহকে বিপ্লবের কানাগলিতে রুদ্ধ করে ফেলেছে।
জামায়াতকে আজ নিজেদের রাজনীতি নিয়ে মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে আত্মসমালোচনার পথে যেতে হবে, অতীতের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। রক্তরঞ্জিত হাত নিয়ে গণতন্ত্রের রাজনীতি চলতে পারে না, ইসলামি রাজনীতিও নয়! জামায়াত ভুল পথে চলছে তাতো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। বিএনপি? যত দোষই সুশীলসমাজ দিক না কেন, শেখ হাসিনার জেদ বলুন, গোঁয়ার্তুমি বলুন তা কিন্তু তার দলকে নিছক ক্ষমতার বৃত্ত থেকে বর্তমানে এক আদর্শিক লড়াইয়ের ময়দানে হাজির করে নিয়ে এসেছে। অল্প কয়েকটি সমমনা প্রগতিশীল দল ব্যতীত অন্যরা তাঁকে একা ঠেলে দিয়েছে এই লড়াইয়ে। বঙ্গবন্ধু কন্যা তাতে দমেন নি, ভয় পান নি, হয়ত মাঝে মাঝে দুঃখকষ্ট রাগ সামলাতে পারেন নি, এ কঠিন সময়ে তাঁর পাশে যাদের থাকার কথা ছিল তাদের বিরুদ্ধতায় ক্ষুব্ধ-বিষোদ্গার করেছেন বটে, কিন্তু লড়াইটা জারি রেখে তিনি আদর্শকে নৈতিক অবস্থানে নিয়ে যেতে পেরেছেন। ফলে সম-আদর্শে বিশ্বাসী  যারা এ লড়াইয়ে দূরে থাকছেন তাঁরা কিন্তু ইতিহাসের কাছে নৈতিকভাবে দায়ি থাকবেন। এটাও মনে রাখতে হবে লড়াইয়ের মূল রণক্ষেত্র অর্থাৎ যেখানে মূল প্রতিপক্ষ রয়েছে তা বাদ দিয়ে আলাদা ফ্রন্টে থাকা বা ভিন্ন তৎপরতা কখনও সৌখিনতার মাত্রা ছাপিয়ে যেতে পারবে না। আর যাই হোক আজকে বামপন্থার কিংবা বুদ্ধিজীবীদের সৌখিনতার পরিণতি দেশ ও জাতির জন্যে মঙ্গলজনক হবে না। মঙ্গল হবে না বিএনপির নৈতিক পরাজয়ের অবস্থানে একগুঁয়েমি করে যাওয়াটা। তাতে মানুষের দুঃখকষ্ট শুধু বাড়বে। আমরা জানি মানুষের দুঃখকষ্ট সহ্য করার একটা মাত্রা থাকে। মাত্রা ছাড়া দুঃখকষ্ট জাতির ওপর চাপিয়ে দিতে পারলে অনেকসময় সমাজে যে প্রবল চাপ তৈরি হয় তাতে শুভশক্তিকেও পিছু হটতে হয়। কিন্তু সেটা কখনও জাতির জন্যে কল্যাণকর হয় না, কারণ তাতে ইতিহাসের পশ্চাদযাত্রা প্রায় অবধারিত হয়ে পড়ে।
জামায়াতের মতই বিএনপিকেও ভাবতে হবে, ভাবতে হবে তার প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের রাজনীতির থেকে স্বতন্ত্র, সম্ভব হলে আরও অগ্রসর, রাজনীতি তারা কী দিতে পারে জাতিকে। কিন্তু একাত্তর-পূর্ববর্তী রাজনৈতিক ধ্যানধারণা নিয়ে বেগম জিয়া দলকে জামায়াতের সহযোগীতেই পরিণত করবেন। নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক রাজনীতির ওপর নির্ভর করে বিএনপির কোনো তাৎক্ষণিক লাভ যদি হয়ও, সুদূরপ্রসারী ক্ষতি হবে অনেক বেশি। কারণ নৈতিক পরাজয়ের পর একটি দলের সৎ রাজনৈতিক কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা থাকে না। তখন তাদের ছাপিয়ে দলে ভাড়াটে মাস্তান ও কর্মীরা জায়গা দখল করে নেবে। সেটা আখেরে ক্ষতিকর হবে। দেশের সুশীলসমাজের কাছেও আবেদন প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়ানোর প্রয়োজন নেই তাঁদের। কিন্তু টকশো-কলাম-মানববন্ধনে তাঁরা যেন জাতির ভবিষ্যত মাথায় রেখে কথা বলেন, ইতিহাসের  প্রেক্ষাপট মনে রেখে সঙ্গতিপূর্ণ অবস্থান নেন এবং বর্তমান সংকটের আদর্শিক ও নৈতিক দিকটি বুঝেই নিজেদের ভূমিকা নির্ধারণ করেন।





Monday, December 9, 2013

আর কত অশ্বডিম্ব চাইব

আবুল মোমেন

একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষে জাতিসঙ্ঘের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো এখনও ঢাকায় অবস্থান করছেন। প্রতিদিন দফায় দফায় তিনি নানা জনের সাথে বসছেন। তাঁর মিশনের লক্ষ্য একটিই - বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান। ধরে নেওয়া হচ্ছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যোগ না দিলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। কথাটা বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষও বিশ্বাস করেন বলে মনে হয়। কথাটা অসত্য নয় যে দেশের একটি প্রধান দলকে বাদ দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
কিন্তু এখানে আরও দুটি কথা থেকে যায় - প্রথমত, বিএনপি একা নেই আর, যে ১৮ দল নিয়ে বিএনপি জোট করেছে তার প্রধান শরিক দল হল জামায়াতে ইসলামি, যারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত। এযাবৎ বিএনপি স্পষ্ট করে নি তারা নির্বাচনে জামায়াতকে বাদ দিয়ে নতুনভাবে জোট সাজাবে কিনা। জামায়াত অবশ্য দল হিসেবে নিষিদ্ধ না হলেও নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। আর এর মধ্যে চূড়ান্ত রায় হয়ে যাচ্ছে তাদের অনেক নেতার। এ বাস্তবতায় জামায়াত মাঠপর্যায়ে সহিংসতা ছড়িয়ে দিলে বিএনপি কি তা মেনে নেবে? তাছাড়া বিএনপিরও দুই নেতা এ অপরাধের মামলায় শাস্তি পেয়েছেন। তাঁদের ব্যাপারে দলের অবস্থান পরিষ্কার নয়। দ্বিতীয় যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হল বর্তমানে দুই বড় জোটের পক্ষে একমত হয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন আর সম্ভব নয়। এর মধ্যে তাদের পারস্পরিক অনাস্থা ও বিদ্বেষ সর্বকালের সর্বোচ্চ অবস্থায় আছে এখন। দু’দল যেভাবে স্ব স্ব অবস্থানে অনড় রয়েছেন তাতে এ বিষয়েও তাঁরা চুল পরিমাণ সরবেন এমন ভরসা আমরা পাচ্ছি না।
এর পরেও কথা থেকে যায়, ১৯৯১ থেকে এ পর্যন্ত অন্তত তিনটি নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা তেমন হয় নি। ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০৮-এর নির্বাচন। কিন্তু সেসব নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হওয়া সত্ত্বেও কি ঐ তিন মেয়াদে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে সচল ছিল? আমরা বরাবর দেখে আসছি দুই দলের মধ্যে যখন যে দল পরাজিত হয়ে সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসেছেন তাঁরা সরকারি দলের কাছে থেকে যথাযথ সম্মান ও ভূমিকা পালনের সুযোগ পান নি। বিজয়ের দখলে সব - এই হচ্ছে আমাদের নীতি। এর ফলে বিরোধী দলের কাজ ছিল যে কোন মূল্যে সরকারকে অকার্যকর করা। সংসদ বর্জন, সংসদকে অপ্রয়োজনীয় কিন্তু অশালীন বিতর্কে জড়ানো। আর রাজপথে চলেছে আন্দোলনের নামে নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ড যা নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে চলতে ক্রমান্বয়ে সহিংস হয়ে উঠেছে। এভাবে উভয় পক্ষে রাজনীতি থেকে নীতিবাদী ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষরা বাদ পড়েছেন আর গুরুত্ব পেয়েছেন কালোটাকার মালিক ও সহিংসতা-নাশকতায় দক্ষ নেতা-কর্মী এবং ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা। এভাবে রাজনীতির সাথে দিনে দিনে নানামাত্রায় সহিংসতার যোগ ঘটে গেছে।
ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই যদি আমরা একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশের নিশ্চয়তা পেতাম তাহলেই এই দরকষাকষি ও দেনদরবার সত্যিকারভাবে সফল হতে পারত। নিরপেক্ষ মানুষ বরং বলতে চাইবে গত প্রায় বাইশ বছরের গণতান্ত্রিক আমলের রাজনীতি বেশি হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক হয়ে পড়েছে।
আমাদের রাজনীতি যেসব ব্যাধিতে ভুগছে তার নিদান তো নির্বাচনে নেই। নির্বাচন এর একটি ঔষধ হতে পারে, কিন্তু এটি ধন্বন্তরি নয় যে এক ওষুধে রোগ সারবে। রোগ সম্পূর্ণ নিরাময়ের জন্যে আরও ঔষধ লাগবে।
আসল রোগ তো বাংলাদেশের রাজনীতির আদর্শিক ভিত্তি কী হবে বা কোন কোন বিষয় সবার জন্যে একই থাকবে তা ঠিক করা। একাজ আরব্ধ রেখে ঘুরপথে ক্ষমতা দখল করা যায় কিন্তু পদে পদে পা হড়কাবেই। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে আমাদের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক নীতি-আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রতিফলন থাকতে হবে। সাংসদদের ভূমিকাও ঠিক করতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, জনপ্রশাসনকে চাকুরিবিধির আওতায় দক্ষতার মূল্যায়নে পরিচালনা এবং স্থানীয় সরকার, দুর্নীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতায়ন  ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হলে কেবল সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে হবে না। এ সময়ে বরং নাগরিক সমাজের উচিত হবে আমরা যেমন দেশ চাই তার একটি চার্টার তৈরি করে দুই দলের সাথে আলোচনা শুরু করা। দু’দলকেই সংশোধনের জন্যে ও করণীয় সম্পর্কে বলার কথা অনেক আছে। সেই প্রক্রিয়াই বরং তাদের উভয়ের জন্যে একটি সমতার ভূমি তৈরি করবে। প্রয়োজনীয় সকল আইন ও বিধি সংস্কার সম্পর্কে আইনের সুপারিশ তৈরি করা দরকার।
যেসব বাধার কারণে আমাদের সংসদ ও গণতন্ত্র অচল হয়ে পড়ে, আমাদের রাজনীতি দুর্নীতিগ্রস্ত ও হিংসাত্মক হয়ে ওঠে, আমাদের দুর্নীতি দমন ও নির্বাচন কমিশন দুর্বল হয়ে যায়, স্থানীয় সরকার ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে যায় তা দূর করতে হবে।
বড় দুই দল নির্বাচন নিয়ে পরস্পর বিরোধী অনড় অবস্থানে থাকলেও কিন্তু ওপরের বিষয়গুলোতে অনড়ভাবে এক থাকেন। তাঁদের এই অনড় সহাবস্থান দেশের জনগণ, গণতন্ত্র, রাজনীতি সব কিছুর জন্যই ক্ষতিকর। যদি নাগরিক সমাজ সত্যিই দেশের জন্যে দীর্ঘমেয়াদী টেকসই কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থান সন্ধান করেন তো তাঁদের সকল প্রয়াস কেবল সুষ্ঠু নির্বাচনে সীমাবদ্ধ রাখা ঠিক হবে না। তাতে সমস্যার একটি যেনতেন সমাধানমাত্র হতে পারে। তাতে আমাদের খুব বেশি উপকার হবে না। লাভ হতে পারে বড় দুই দলের কোনো একটির, যারা জয়ী হবে। হাতে সময় কম। এবারের নির্বাচন না হয় যেনতেন প্রকারের সুষ্ঠু নির্বাচনের অশ্বডিম্ব হোক। হয়ে যাক এবার। কিন্তু এবার দুই বড় দল যখন চাপে আছে, এবং আন্তর্জাতিক মহলও সক্রিয় তখনই মূল বিষয়ে আলোচনা শুরু করা দরকার। কেননা আর কত অশ্বডিম্ব প্রসব করবে ‘সুষ্ঠু নির্বাচন’। আমরা ফলপ্রসূ তাৎপর্যপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা চাই। সেটার জন্যে জনগণকে সজাগ এবং সক্রিয় করতে হবে।



Wednesday, November 27, 2013

পুঁজিবাদী এজেণ্ডা সম্পর্কে সাবধানতা চাই

আবুল মোমেন


আমাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবশ্যই ভালো নয়। একদিকে অনিশ্চয়তা আর অন্যদিকে চরম সংঘাতের সম্ভাবনা। জনগণের উদ্বেগ ও আতঙ্কের পারদ কেবল চড়ছে। কিন্তু এর মধ্যেও দুটি কথা ভুললে চলবে না।
প্রথমত, বাংলাদেশে আর্থিক ও সামাজিক পরিবর্তন থেমে নেই - মানুষের প্রাপ্তির বিচারে সূচকগুলো এর মধ্যেও ঊর্ধগামী। একে উপেক্ষা বা নষ্ট করা ঠিক হবে না। দ্বিতীয়ত, দেশের এই সংকটজনক অবস্থার মধ্যেও পশ্চিমের মুরুব্বিয়ানার নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে সজাগ থাকা দরকার। ইদানীং ওদের ওপর অর্থনীতির নির্ভরশীলতা কমে এলেও আমাদের এবং ওদের মনস্তাত্ত্বিক অভ্যাসের কারণে এই নির্ভরশীলতা বা মুখাপেক্ষিতা বেশ জোরদারভাবেই উপস্থিত।
এটি বারবার এবং দেশের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে পশ্চিম অনুসৃত পুঁজিবাদী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যই হল সারা বিশ্ব থেকে যেকোনোভাবে মুনাফা অর্জন (আদতে লুণ্ঠন)। এই এজেণ্ডা বাস্তবায়নে তারা পথের সব বাধা দূর করবেই - প্রয়োজনে এর রক্ষক রাষ্ট্রগুলো একজোট হয়ে সর্বোচ্চ হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক পথের আশ্রয় নিতে একটুও কার্পণ্য করে না। তারা অবলীলায় একই বিষয়ে ডবল স্ট্যাণ্ডার্ড চালিয়ে যায়। ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের জন্যে যদি এক মানদণ্ড হয় তো সৌদি আরবের জন্যে অন্য মানদণ্ড। তারা এক মানদণ্ডে বিচার করে নি লিবিয়া ও কুয়েতকে। তার কারণ একটাই সাদ্দাম আরব বিশ্বে স্বাধীন অবস্থান তৈরি করেছিলেন, যদিও ইসলামি বিপ্লবোত্তর ইরানকে ঠেকানোর জন্যে তারাই এক সময় সাদ্দামকে তৈরি করেছিল। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে কীভাবে ব্যবহৃত তুচ্ছ আবর্জনার মত ফেলে দেয় তা বারবার তারা দেখিয়েছে। তারাই তালেবানদের অস্ত্রসজ্জিত করে জঙ্গিতে রূপান্তর করে যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছিল। তাদের জন্যে ইসলামের আবরণ তৈরি করে যুদ্ধের সহযোগী হয়ে ধন্য হয়েছে সৌদি আরবের বশংবদ বাদশাহরা। তারাই আলকায়দা ও বিন লাদেনের স্রষ্টা। তারাই তাদের ভক্ষক হয়েছে পরে সর্বোচ্চ নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতার মাধ্যমে।
পশ্চিমের রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি উদার মানবিক রূপও আছে, যদিও তা আসলে মূল রাষ্ট্রযন্ত্রেরই যন্ত্রাংশ মাত্র। এটি সারা বিশ্বে মানবাধিকার ও আইনের শাসনের শান্তিজল ছিটানোর দায়িত্ব নিয়ে শান্তির অবতারের ভূমিকায় সোচ্চার ও সক্রিয় ভূমিকা নেয়। পুঁজিবাদের এই যন্ত্রাংশটি বস্তুত দ্বিমুখী ধারালো ছুরির মত কার্যকর - একদিকে রাজনীতিবিদ ও উচ্চাভিলাষী ধনিকদের মধ্যে যেমন কার্যকর তেমনি অন্যদিকে নাগরিকসমাজের সংবেদনশীল মানুষদের মধ্যেও ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারে।
কিন্তু খুব খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এভাবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের ন্যায্য মানবিক ছাতাটি খুলে ধরে তারা আদতে আমাদের গ্রাম্য মেয়েদের মত আড়াল তৈরি করে নিজেদের স্বার্থের অনুকূল অর্থনৈতিক ও প্রভুত্ব রক্ষার এজেণ্ডাগুলো ঠিকই পালন ও পূরণ করে যাচ্ছে। সাদ্দাম-উত্তর ইরাকে চলমান ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত তাদের মানবাধিকার ও আইনের শাসনের চেতনাকে বিচলিত করে না। এ পরিণতির দায় কার এ নিয়ে ভাববার কোনো প্রয়োজন তারা বোধ করে না। মনে করুন, ইরাকের দখল সম্পন্ন হওয়ার পরপর তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন তাঁর দেশের মন্দা অর্থনীতিতে চিন্তিত ব্যবসায়ীদের বলেছিলেন ব্যাগ গুছিয়ে জলদি ইরাকে যাও, ওখানে এখন পুর্ননির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হবে। আর তার মানে প্রচুর ব্যবসা, প্রচুর মুনাফা।
পশ্চিম থেকেই গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসনের অনুকূলে নানা এজেণ্ডা বিশ্বময় প্রচার করা হয়। এমনকি প্রতি বছর তারাই শান্তির নোবেল লরিয়েট তৈরি করে বিশ্বশান্তির নতুন নতুন বার্তাবাহক প্রস্তুত করে থাকে। এর বিপরীতে দুটি ছোট্ট সরল প্রশ্ন কি তাদেরকে করার সময় আজও আসেনি? এ দুটি প্রশ্ন তোলা কি বিশ্বশান্তি, গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যেই তোলা অত্যন্ত ন্যায্য নয়?
প্রথম প্রশ্ন : যদি এতই তারা বোঝেন যুদ্ধ, সংঘাত হানাহানি ওপরে বর্ণিত তাদেরই প্রদত্ত অত্যন্ত ইতিবাচক এজেণ্ডাগুলো বাস্তবায়নে পথের বাধা তবে তারা কেন এ পরিস্থিতি তৈরির রসদটা জোগান দিয়ে যাচ্ছে? আমরা বলছি পুঁজিবাদী অর্থনীতির আজকের মেরুদণ্ড অস্ত্র তৈরি ও অস্ত্র ব্যবসার কথা। আমরা জানি তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় নিরস্ত্রিকরণের জন্যে, পারমানবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ করার জন্যে চমৎকার সব সংগঠন ও সংলাপের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু নিত্য যেসব সংঘাত-হানাহানিতে পৃথিবী ডুবে আছে, যেসব ‘ছোটখাট’ যুদ্ধ-সংঘাতে মহাযুদ্ধের চেয়েও বেশি প্রাণহানি ও বেশি অঙ্গহানি ঘটেছ ও ঘটে চলেছে তাতে পারমাণবিক নয় মারাত্মক সব প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ব্যবসার সবটাই তাদের হাতে, তারাই সরবরাহকারী, তারাই প্রয়োজনে, অর্থাৎ ব্যবসার মন্দা দেখা দিলে, যুদ্ধবাজ নেতা তৈরি করে নেয় - তাদের কেউ ক্ষমতার গদি আঁকড়ে থাকতে কেউ তা দখল করার সংগ্রামে এসব ব্যবহার করে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের মধ্যে এ মনোভাব তৈরি করার জন্যেও পুঁজিবাদের এজেন্টরা অনেক আগে থেকেই কাজ করে গেছে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য হল রুয়াণ্ডার হুটু ও তুৎসিরা মিলেমিশে বসবাস করে এসেছে চিরকাল। শ্বেতাঙ্গ দখলদাররা এসে হুটুদের বলল তোমাদের নাক খাড়া তাই তোমরা উচ্চ জাতি, থ্যাবড়া নাকের তুৎসিরা তুলনায় তুচ্ছ। শক্তিমানের প্রশয় কে না গ্রহণ করে? ওদের মধ্যে উচ্চমন্যতা বোধ করার মানুষ তৈরি হল, বিরোধের বীজ রোপিত হল, চারা গজাল ও তাতে হাওয়া দেওয়া চলল, ধীরে ধীরে বিষবৃক্ষ হয়ে তা বড় হয়েছে। তারপর ওদের অস্ত্র সজ্জিতও করা হয়েছে। শক্তিক্ষয় হয়ে যাওয়ার পরে তারাই আবার পুনর্গঠনের কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে। তাদের তৈরি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে শোরগোল তুলতে কসুর করবে না।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি আরও সরল। প্রশ্নটা পশ্চিমের পালের গোদা যুক্তরাষ্ট্রকে প্রথম করতে হবে, যদিও তাতে পুরো ইউরোপ যুক্ত, কারণ তারাই তো এলডোরাডোর সন্ধানে দলে দলে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে দেশটি ‘তৈরি’ করে নিয়েছে। প্রশ্নটা হল - আজ যে দেশটি তোমাদের বলছ, তার আদিবাসিন্দারা কোথায়? তাদের ঠাণ্ডামাথায় ঝাড়ে-বংশে খুন করে ‘নতুন দেশ’ পত্তন করেছ, তারপর এই বিশাল ভূখণ্ড জুড়ে কৃষির বিস্তার ঘটাতে ফাঁদ-পাতলে আফ্রিকায়, বর্বরতম ও নিষ্ঠুরতম পথে তাদের ধরে এনে দাসত্বের শৃঙ্খল পরিয়েছে, আজও, হ্যাঁ আজও, তাদের গ্লানির জীবনের অবসান হয় নি। হতে দাও নি তোমাদের মানসিকতার কারণে। এসব প্রশ্ন কি ন্যায্য নয়?
বাংলা প্রবচন বলে - আপনি আচরি পরেরে শিখাও। যার নিজের ইতিহাস জঘন্য অমানবিকতায় ভরা, যাদের বর্তমান মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে শত প্রশ্নে বিদ্ধ করা যায় তাদের উপদেশ দেওয়া আমাদের সাজে, তাদের নয় আমাদের। কেননা আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি ঢের পুরোনো, এর রয়েছে ধারাবাহিকতা, এবং মৌলিকভাবে এটি অনেক বেশি মানবিক। সমস্যা তৈরি করেছে ঔপনিবেশিক শক্তি - সেটা যেন না ভুলি।
আমি এর মধ্যেও কিন্তু ভুলে যাই নি কী আনন্দে আমি এখনও শেক্সপিয়র পড়ি, রাসেল পড়ে বরাবর চিন্তার খোরাক পাই, রেনেসাঁস ও আলোকনের ইতিহাসে প্রেরণা পাই, বিজ্ঞান আর আবিষ্কারের ঘটনাগুলোয় রোমাঞ্চিত শিহরিত হই। পশ্চিমাসভ্যতা আমার অনেক অনেক নায়কের আধার। এমনকি সেসব দেশে নাগরিকজীবনের সৌন্দর্য-সার্থকতায় আরাম বোধ করি, ঈর্ষা করি। তারপরেও আমাকে তো খুঁজে নিতে হবে আমার দেশের বিকাশের সঠিক পথটি। এই পথের যে কোন বাধাকেই সরাতে হবে। ভুললে কি চলবে দেশের স্বাধীনতা কীভাবে এসেছে? তার অন্তর্নিহিত আকাক্সক্ষাকে অস্বীকার করার অর্থ তো স্বাধীনতাকেই অস্বীকার করা। এটি ধর্মভিত্তিক-জাতীয়তার বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তার ধারণাকে সামনে নিয়ে এসেছিল - এটি যেহেতু সম্প্রদায় নিরপেক্ষ (ক্ষুদ্র জাতিকেও নিতে সক্ষম) তাই অধিকতর গণতান্ত্রিক, তাই এরই পক্ষে সম্ভব একটি আধুনিক রাষ্ট্র নির্মাণ। এটিকে আমাদেরই এজেণ্ডা হিসেবে জানতে হবে।
আমরা জানি বেলায় বেলায় কেবল নদীখাতেই অনেক পানি ও পলি প্রবাহিত হয় নি, রাজনৈতিক অঙ্গনেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে। দেশের পশ্চাৎগামী রাজনীতির প্রবল জোয়ারে প্রগতির রাজনীতি স্তিমিত হয়েছে। এর সাথে তাল মেলাতে গিয়ে মধ্যপন্থী রাজনীতি সবচেয়ে বেশি পিছু হটে গেছে। আওয়ামী লীগ আগের অবস্থানে নেই, তার ওপর টেণ্ডারবাজী দখলদারিতে মেতেছে ক্যাডাররা, ক্ষমতার ভাগ কায়েম রাখতে কালোটাকার ব্যবসায়ীরা দলের দখল নিয়ে নিচ্ছে। আর বিএনপি? ধর্মান্ধ রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা কি ছেড়েছে? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলমান অবস্থায়ও কি জামায়াতকে ছেড়েছে? তারা কি তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ সম্পর্কে অবস্থান পরিষ্কার করেছে?
আমাদের তো নিজেদের বাস্তবতার মধ্যেই পথ তৈরি করতে হবে। সে কাজে যদি রুচি না হয়, অনীহা তৈরি হয় তবে মনে রাখতে হবে পুঁজিবাদের কোনকিছুতেই অরুচি নেই, তারা যা পরে বমি করে বের করে দেবে তা প্রয়োজনে সময়মত হাসিমুখে গলাধকরণ করবে। বুশ ও বিন লাদেনের গলায় গলায় ভাবের ছবি পশ্চিমেরই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সাদ্দামের অস্ত্র ভাণ্ডার তাদেরই তৈরি, ফলে পরে যে অজুহাত খাড়া করে তারা ইরাকে আক্রমণ করছিল তা যে মিথ্যা সেটা তাদের চেয়ে আর কেউ ভালো জানত না। তারা প্রয়োজনে মিথ্যাকে সত্যের চমৎকার আবরণে সাজাতে জানে।
আমাদের বাস্তবতা হল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় আপাতত হাতে নেই। কী চমৎকার হত যদি এই দুটি দল কতকগুলো জাতীয় বিষয়ে সহমত থাকত, তাদের বিরোধ থাকত যদি উন্নয়নের নীতি-কৌশলে, পরিকল্পনা প্রণয়নে ও বাস্তবায়নে দক্ষতা নিয়ে। কিন্তু বিরোধ আরও মৌলিক  - মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, সংবিধান, গণতন্ত্র নিয়ে।
ফলে এই অবস্থায় নাগরিকসমাজ একটি অবস্থান নিতে পারেন। তাঁরা বিএনপির ওপর চাপ তৈরি করতে পারেন যাতে তারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে, আইন ও ইতিহাস, স্বাধীনতা ও জাতির কাছে অপরাধী সেই দলের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেন, ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদী যে কোনো দলের আনুকূল্য লাভের চেষ্টায় বিরত হয়ে নিজেদের স্বাধীন অবস্থানেই জোট নিয়ে নির্বাচনে আসে। আওয়ামী লীগের ওপর চাপ সৃষ্টি  করা হোক যাতে তারা ক্ষমতার মোহে একক নির্বাচনের কৌশল বাদ দেয় এবং কালোটাকা ও অবৈধ ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিদের সংসদে না পাঠায়, টেণ্ডারবাজ-দখলদারদের খপ্পর থেকে দলকে মুক্ত করে। আর দুই জোটের বাইরে প্রগতিশীল দলগুলোকে বড় দুই দলের ওপর একইভাবে চাপ সৃষ্টির জন্যে অনুরোধ করব। তাঁদের স্বাধীন অবস্থান বজায় রাখা জরুরি, কিন্তু তাদের ভূমিকা আরও সক্রিয় ও কার্যকর করে তুলতে হবে। রাজনৈতিক অঙ্গনে যুদ্ধাপরাধী, ধর্মান্ধ শক্তি, লুটেরা গোষ্ঠী এবং বেপরোয়া ক্ষমতার দাপটকারী শক্তি যাতে দুর্বল হয় সেই দায় নাগরিক সমাজকেও নিতে হবে।
জানি, হাতে সময় কম, নাগরিকসমাজও দুর্বল, ফলে দুই বড় দলের কৌশলি যুদ্ধ আসন্ন নির্বাচনের আগে থামিয়ে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের গ্রন্থি মোচন করা কতটুকু সম্ভব তা বেশ অনিশ্চিত। পরিস্থিতি যদি সেই অনাকাক্সিক্ষত সংঘাতের দিকেই যায় তবে তুলনামূলক ভাবে কম মন্দকে বাছাই করা ছাড়া বিকল্প পথ কি থাকবে?

Sunday, November 10, 2013

দুই নেত্রীর ফোনালাপ কি অচলাবস্থাই বাড়াল?

আবুল মোমেন

কথা ছিল প্রধানমন্ত্রী ফোনে বিরোধী নেত্রীকে সংলাপের আমন্ত্রণ জানাবেন। এর আগে ঢাকায় ১৮ দলীয় জোটের জনসভায় খালেদা জিয়া ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সংলাপের জন্যে যোগাযোগের সময় বেধে দিয়ে ২৭-২৮-২৯ অক্টোবর ৬০ ঘণ্টার হরতালের ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন। স্বভাবতই মানুষ প্রধানমন্ত্রীর ফোন এবং তার ফলাফল নিয়ে উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তা থেকে বেরুবার আশায় বসেছিল।
শেখ হাসিনা সময় পেরুনোর আগেই ২৬ তারিখ সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ ফোন করেছিলেন। দুই নেত্রীর ফোনালাপ চলেছে ৩৭ মিনিট ধরে!
বুঝতে অসুবিধা নেই, এ আলাপ আমন্ত্রণ এবং তা গ্রহণ বা প্রত্যখ্যানের মধ্যে শেষ হতে পারে নি। দেশের দুই শীর্ষ নেত্রীর ফোনালাপ সেদিন রাতেই নেটে ছড়িয়ে পড়ে। পরের দিন কিছু কিছু বৈদ্যুতিন টিভি চ্যানেল সম্পূর্ণটা প্রচার করে। আর ২৮ তারিখ প্রায় সব পত্রিকাতেই আলাপের পুরোটাই ছাপিয়ে দেওয়া হয়।
শুনে-পড়ে বলতে হয়, আলাপ তো নয় বাদানুবাদ হয়েছে। তাতে বিএনপির কিছু সিনিয়র নেতা প্রথমে বিব্রত বোধ করেছিলেন মনে হয়, কারণ দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব কাজটাকে শিষ্টাচার বহির্ভূত আখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের আপত্তিটা বুঝতে অসুবিধা হয় না, কারণ বিবাদে জড়িয়ে তাঁর নেত্রী প্রতিপক্ষকে অভিযোগের বাণে লাগাতার চাপে রাখতে গিয়ে শিষ্টাচার লঙ্ঘনে অনেক এগিয়ে ছিলেন। শব্দালঙ্কার নিয়ে যারা কাজ করেন তারা এ বাদানুবাদের মধ্যে ব্যঙ্গ, বিদ্রƒপ, শ্লেষ, পরিহাস, টিপ্পনি ইত্যাদির ভিয়েন খুঁজে পাবেন, তবে সব ছাপিয়ে বোঝা যাচ্ছিল খালেদার উষ্মা, মেজাজ তাঁর একেবারে তেতে ছিল। হাসিনা এই তপ্ত বর্ষণের ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু বলার সুযোগ পেয়েছেন তা প্রতিপক্ষকে শান্ত বা আশ্বস্ত করার কাজ করে নি - আগুনে জ্বালানিই পড়েছে।
বিবাদে জড়িয়ে গেলে সময় কোন দিকে বয়ে যায় তা খেয়াল থাকে না। ফোনে তো দু’মাথায় দু’জন মানুষই কথা বলছেন, তা-ও দুই দলের এমন দুই শীর্ষ নেতা যাঁদের ওপর কিছু বলার রেওয়াজ বা অধিকার কোনো দলে কারুরই নেই। ফলে মধ্যস্ততার কোনো সুযোগই ছিল না। শেষে ক্লান্ত প্রধানমন্ত্রী জরুরি সভার কথা টেনে বহু প্রতিক্ষিত সংলাপের ইতি টানেন। ফোন-রঙ্গ শেষে বা ফোন-রণাঙ্গণ থেকে ফিরে বিরোধী নেত্রী প্রতীক্ষারত সহকর্মীদের কাছে মেয়েলি উদযাপন করে হয়ত বলতে পারেন - কষে উচিত কথা শুনিয়ে দিয়েছি! হতে পারে, কারণ দু’দিন পরে সেই সিনিয়র নেতারা বলছেন বাগযুদ্ধে তাদের নেত্রীর কাছে প্রধানমন্ত্রী পাত্তা পান নি।
কিন্তু জনগণের কি এ আলাপকে যথোচিত মনে হয়েছে? বড় অংশ হতাশ হয়েছে, কেবল সংলাপের দ্বার খুলল না বলেই নয়, এর বিষয় ও ধরণটাও হতাশার কারণ। একজন বিশ্লেষকের এ বিষয়ে লেখার শিরোনাম তাই ‘এ সংলাপ না হলেই ভালো ছিল’ ; এক টিভি চ্যানেলের টক-শোর নাম রাখা হল ‘সম্ভাবনা না সম্ভব না?’
কিন্তু জীবন তো থেমে থাকতে পারে না, অচলাবস্থাও আসলে থেমে থাকে না। প্রতিদিনই অচলাবস্থার ধরনের কিছু না কিছু পরিবর্তন ঘটে চলেছে।
যেদেশে গণমাধ্যম-বাতিক সংক্রামকভাবে বর্ধিষ্ণু আর টিভি চ্যানেলে বিস্ময়করভাবে গান-নাটকের চেয়ে খবর ও টক-শো বেশি জনপ্রিয় সেখানে এ ধরনের ঘটনা তো মহার্ঘ সওদা। টক-শো, কলাম এবং খবরে মতামত দিতে দিতে দেশের বিশিষ্টজনরা ব্যস্ত দিন এবং রাত কাটাচ্ছেন। রাতও কাটাতে হয় কারণ সবচেয়ে জনপ্রিয় টক-শোগুলো নাকি অধিক রাতেই জমে। বিশুদ্ধ নিরপেক্ষতা এক্ষেত্রে একেবারে নিরামিষ ব্যাপার, তর্ক জমে আলোচকরা পক্ষ নিয়ে ভাগ হয়ে গেলে।
বার বার মুখ পুড়লেও আশায় বুক বাঁধতে বাংলাদেশের মানুষের জুড়ি নেই। মনে হয় বিএনপি এখন দু’ভাবে সংলাপের দরজা খোলার কথা ভাবছে - একদিকে রাজপথের  আন্দোলনকে আরও জোরদার করবে তারা আর অন্যদিকে বিদেশি কূটনীতিকদের দূতিয়ালিতে লাগাবে। আওয়ামী লীগের চিন্তা আপাতত একটিই - গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখা।
ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনের মাধ্যমে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসার ঘটনা বাংলাদেশে আগে ঘটে নি। প্রথমবার ক্ষমতার মেয়াদ পূরণ করে আত্মবিশ্বাসী হাসিনা সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনে নেমেছিলেন। এই একবার ছাড়া গণতান্ত্রিক আমলেও কখনওই শান্তিপূর্ণভাবে এক সরকার থেকে পরবর্তী সরকারে ক্ষমতা হস্তান্তর হয় নি। বিস্তর জলঘোলা করে ধ্বংসাত্মক রাজনীতির পথ বেয়েই নির্বাচন হয়েছে। ২০০১ এর অভিজ্ঞতা এবং গত ৬ মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বেশ বড় ব্যবধানে হারার কারণে এবারে হাসিনা স্বভাবতই খুব সতর্ক হয়ে পা ফেলছেন।
আমাদের অনেকেরই ধারণা ছিল সাম্প্রতিক এই বিজয়গুলোকে আগামী নির্বাচনেও বিজয়ের ইঙ্গিত হিসেবে ধরে নিয়ে বিএনপি মোটামুটি একটা মুখ বাঁচানো সংলাপ সেরে দ্রুত নির্বাচনেই যেতে চাইবে। এখন মনে হচ্ছে বেগম জিয়ার আরও কিছু হিসেব আছে। হতে পারে পুত্রদের মামলামুক্ত হয়ে দেশে ফেরার ব্যবস্থা, হতে পারে জোটের গুরুত্বপূর্ণ শরিক জামায়াতের অনুকূলে কিছু ছাড় আদায় বা হতে পারে নির্বাচনে যাওয়ার আগে তিনি রাজপথের আন্দোলন থেকে সুস্পষ্ট বিজয় পেতে চান। সম্ভবত তারই প্রভাব পড়েছে তাঁর ফোনালাপে - তিনি কথার লড়াইয়ে জিততে চেয়েছেন।
এসবের মধ্যেও আসল কথা হল, বাংলাদেশ এবার সত্যিই কঠিন রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যেই পড়েছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছেন ইতিহাসের বেশ কিছু বকেয়া দায় মেটানোর প্রতিশ্র“তি দিয়ে। তার প্রধান হল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের আলোকে স্কুলের পাঠ্যবই পরিমার্জন, গণমাধ্যমসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমন ইত্যাদিও এ দায়ের অংশ। সেই সাথে একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নও দেখিয়েছিলেন তিনি। তাতে অন্তত দুই দশক পরে নবপ্রজন্মের তরুণদের ভোট টানতে পেরেছিল আওয়ামী লীগ। লীগের বড় জয়ের পিছনে এটাই ছিল মুখ্য। শেষের বিষয়টি ছাড়া বাকি সব বিষয়ে জামায়াত ও ধর্মান্ধ দলগুলো সরাসরি বিপক্ষে, বিএনপি তাদের অভিভাবক হিসেবে কথার মারপ্যাঁচ চালিয়ে শেষ পর্যন্ত একই অবস্থান ধরে রাখছে।
এখানে বাংলাদেশের রাজনীতির একটা বিষয় বুঝে নেওয়া দরকার। একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, যে-দুটি মূলধারায় রাজনীতি চলছে দেশে তার বিপরীতমুখিতার ভিত্তি হল আওয়ামী লীগ ও এন্টি আওয়ামী লীগ রাজনীতি। পঁচাত্তরের পর থেকেই এটিই বাস্তবতা। এর মধ্যে ১৯৯০ পর্যন্ত সামরিক ও ছদ্ম সামরিক-গণতন্ত্রের মধ্যে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফেরার সুযোগ ছিল না। ১৯৯৬-এ প্রথমবার ক্ষমতায় এসে হাসিনা বিরোধীদে সাথে মোটামুটি আপস-সমঝেতা করেই চলেছেন। কিন্তু এবারে ক্ষমতায় এসে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, পাঠ্যবই পরিমার্জনসহ ইতিহাসের বকেয়া দায় মেটানো ও ইতিহাস-শুদ্ধিকরণের কাজে হাত দিয়েছেন। পাশাপাশি জঙ্গি দমনেও আন্তরিক ছিলেন। এর ফলে দেশে প্রায় একাত্তরের অবস্থা তৈরি হয়েছে। কারণ দুটি ক্ষেত্রেই জামায়াত-বিএনপি অভিযুক্ত হয়েছে। ফলে যা ১৯৯০ থেকে এযাবৎ কেবল দুটি ক্ষমতালিপ্সু দলের মধ্যেকার সেয়ানে সেয়ানে মোকাবিলার বাইরে যায় নি তা আকস্মিকভাবে দু’পক্ষের ইতিহাস ও আদর্শের ভিন্নতা খুলে ধরেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এলে এবং বিএনপি জামায়াত ও ধর্মান্ধদের না ছাড়লে তাদের অবস্থা খুব সঙ্গীন হবে।
তাই এক দলকে এই ধারা ধরে রাখতে এবং অন্য দলকে এর থেকে বেরুতে হলে ক্ষমতায় যেতে হবে। এ কারণেই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে কোনো পক্ষই এতটুকু ছাড় দিতে চাইছে না। বরং বলা যায় স্ব স্ব  অবস্থানে থেকে দুই দলই পরাজয়ে অপারগ এবং তাই ছাড় দিতে অক্ষম।
বিএনপির জন্যে সমীকরণ আরও জটিল কারণ ক্ষমতায় বসে ক্ষমতার জন্য তৈরি দলকে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে সচল রাখা মুশকিল। অতীতে মুসলিম লীগের পরিণতি আমরা দেখেছি। অবশ্য তা বলে বিএনপি দুর্বল হয়ে গেলেও এন্টি আওয়ামী লীগ রাজনীতির অবসান হবে না। জামায়াত রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকলেও তারা এবং নানান ধারার ধর্মীয় গোষ্ঠী সমাজে উত্তরোত্তর শক্তিশালী হয়েছে। তারা সমাজে সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাজনীতির জোরালো প্রতিপক্ষ দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। মুসলিম সমাজে আলোকন-নবায়নের কাজ খুব ফলপ্রসূভাবে না হওয়া পর্যন্ত অবস্থার উন্নতি হবে বলে মনে হয় না।
মুশকিল হল নানা কারণে আমজনগণ ও ছাত্রতরুণরা প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আর আগ্রহী নয়। জ্বলন্ত চুলা আর তপ্ত কড়াইয়ের এই ফাঁড়া থেকে তারা বেরুতে চায়। দুই পক্ষের কারও ওপর তাদের আস্থা নেই, কেউই তাদের দলে টানতে পারছে না। তাতে অবশ্য মন্দের ভালো হিসেবে হয়ত গৃহযুদ্ধের আশংকা দূর হয়। কিন্তু আপাতত রাজনৈতিক অঙ্গনের ঈশানে থমথমে মেঘের আনাগোনা বাড়তে থাকবে বলেই মনে হয়।


Thursday, October 10, 2013

পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র : কাছ থেকে দেখা সালমান খুরশীদের সাথে সাক্ষাৎ


১৭ তারিখে দুপুরে হোটেল তাজমহলে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেছিলেন বিদেশ মন্ত্রকের যুগ্মসচিব। এতে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশে ভারতের তিনজন সাবেক হাই কমিশনার ও একজন ডেপুটি হাই কমিশনার। এঁরা হলেন দেব মুখার্জি, রজিত মিত্তির, পিনাক চক্রবর্তী এবং অমিতাভ ত্রিপাঠী। আর ছিলেন দিল্লিতে কর্মরত বেশ কয়েকজন সিনিয়র বাঙালি সাংবাদিক, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রমুখ।
যেমনটা হয় প্রথমে ছোট ছোট জটলায় পরিচয়, আলাপ, পুরোনো পরিচয়ের সূত্রে টুকটাক কথাবার্তা চলল। দেব মুখার্জি মনে রেখেছেন আমাকে, নতুন বই কী লিখেছি জিজ্ঞেস করলেন, ভুললেন না পারিবারিক কুশলাদি জানতে। সাংবাদিক সৃঞ্জয় চৌধুরীর সাথে আলাপ করে বুঝলাম তিনি অভিনেতা বসন্ত চৌধুরীর ছেলে। তাঁকে জানালাম একজন মুদ্রা সংগ্রাহক ও মুদ্রা বিশারদ হিসেবে একাধিকবার চট্টগ্রাম সফরকালে তাঁর বাবার সাথে আমাদের বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল।
চারদিক ঘিরে টেবিল। প্রথমে আলোচনার সূত্রপাত করেন দেব মুখার্জী। এক্ষেত্রে যা হয় দু’ দেশের ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক-সামাজিক সম্পর্কের কথা দিয়েই আলোচনা শুরু হয়। তবে তাঁর এবং ভারতীয় পক্ষের অন্যান্যদের আলোচনায় বোঝা গেল ভারত ইদানীং বাংলাদেশকে বিশেষ গুরুত্বের সাথেই গ্রহণ করে। বিশেষত বর্তমান সরকার পূর্ব ভারতের বিদ্রোহীদের ঘাঁটি ও আইএসআইয়ের প্রশিক্ষণকেন্দ্র বন্ধ করায় তাঁরা এর ধারাবাহিকতা রক্ষায় আগ্রহী। প্রায় প্রত্যেকেই স্থল সীমান্ত চুক্তি ও তিস্তা চুক্তি সম্পাদিত হয়েও কার্যকর না হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করতে শোনা যায়। ফেলানি হত্যাসহ সীমান্তের হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার ব্যাপারে কার্যকর কিছু হওয়া উচিত বলেই সবাই মত দিয়েছেন। আমাদের দিক থেকে দলের বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ডেইলি স্টারের সহযোগী সম্পাদক শাহ হোসেইন ইমাম কথা শুরু করেছিলেন। সীমান্ত চুক্তি, তিস্তা চুক্তি ও সীমান্তে বিএসএফের ভূমিকা নিয়ে আমাদের উদ্বেগের কথা তো ছিলই, সেই সাথে সদ্য সমাপ্ত লোকসভা অধিবেশনে স্থল সীমান্ত চুক্তি না ওঠায় হতাশা ব্যক্ত করতেও তিনি ভোলেন নি।
আমাদের দলের যারা কথা বলেছেন সবাই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই তিনটি বিষয় যে প্রভাব ফেলেছে তা বলতে ভোলেন নি। কেউ কেউ আরেকটু অগ্রসর হয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে সরকার পরিবর্তনের আভাস রয়েছে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের মনোভাব কি একই থাকবে? তার সাথে কেউ বলেছেন ভারতেও আগামী বছর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির উত্থানের সম্ভাবনা আছে, তাতে কী ভারতের বাংলাদেশ নীতিতে পরিবর্তন ঘটবে?
বাংলাদেশের নির্বাচনকে কূটনীতিকরা অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবেই দেখতে চান, এবং আশা করেন সরকারে পরিবর্তন ঘটলেও বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। বোঝা যায় এটা একটা অফিসিয়াল প্রতিক্রিয়া এবং নিয়মরক্ষার আশাবাদ। আর সেদেশে বিজেপি ক্ষমতায় আসবেই এমনটা এখনই তাঁরা কেউ ভাবছেন না। তবে কেন্দ্রে যে সরকারই আসুক ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি খুবই পাল্টাবে বলে মনে করেন না কেউ।
অমিতাভ ত্রিপাঠী আলোচনায় একটু ঝাঁঝ আনলেন এই বলে যে, তিস্তার পানি বাংলাদেশের কতটুকু অঞ্চলকে প্রভাবিত করে? তাছাড়া চুক্তি হোক বা না হোক নদী দিয়ে পানি তো প্রবাহিত হচ্ছে, এবং বাংলাদেশ পানি কম পাচ্ছে না। তাঁর সাথে আরও একটু যোগ করলেন সাবেক হাই কমিশনার ও বর্তমানে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সচিব পিনাক চক্রবর্তী। তিনি বলতে চাইলেন, সীমান্তে বিএসএফের তৎপরতা চলে অবৈধ অনুপ্রবেশের কারণে, সেটা ঠেকানোর জন্যে বাংলাদেশ সরকার কী করছেন? দ্রুত মাইক নিয়ে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সোহরাব হাসান দু’দেশের সম্পর্কের প্রেক্ষাপটেই বিষয়টিকে দেখতে বললেন। সীমান্ত পারাপার ও সীমান্ত হাটে যাতায়াত বহুকালের বিষয় ফলে এখানে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালানোর আগে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সকলেই অবশ্য গুলি চালানোর মত পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকার পক্ষেই ছিলেন। সবার মত ছিল বাংলাদেশ সীমান্তে যারা দায়িত্ব পালন করবেন তাদের ভালোভাবে ব্রিফিং হওয়া দরকার।
আমি বলেছিলাম, দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক হয় বহুমাত্রিক এবং তার নানা স্তর থাকে। কখনও কখনও এতে টানাপোড়েন তৈরি হয়, কখনও অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু এর ভিতর দিয়ে সম্পর্ক ফলপ্রসূভাবে এগুচ্ছে কিনা সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে আমাদের দলগত মূল্যায়ন মনে হয় এই যে, গত পাঁচ বছরে এ সম্পর্কে ফলপ্রসূ অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের যতটুকু অবদান ভারতের দিক থেকে, তিস্তা চুক্তি ও স্থলসীমান্ত চুক্তি লোকসভায় অনুমোদন বিলম্বিত হওয়ায় তার প্রত্যাশিত প্রতিদান মিলছে না। ভারতের বন্ধুরা স্বভাবতই ২৫টি ব্যতীত সকল পণ্য শুল্ক বাধা উঠিয়ে দেওয়া, এক বিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্যের প্রসঙ্গ তুলেছেন। কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দিক থেকে আমাদের মনে হয় রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে ওঠা বিষয় দুটি দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া জরুরি।
ফলে সেদিনই বিকেলে সাউথ ব্লকে আমরা যখন সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হয়েছি ভারতের বিদেশমন্ত্রী সালমান খুরশীদের সাথে তখন আবারও এই প্রসঙ্গগুলো তুলেছি আমরা। তার আগে একটু বলে নিই সালমান খুরশীদ হলেন ভারতের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. জাকির হোসেনের দৌহিত্র। তাঁর বাবাও শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। আর তিনি নিজে আইনজীবী, লেখক, রাজনীতিবিদ। তাঁর একটি বই অ্যাট হোম ইন ইণ্ডিয়া আমার আগেই পড়া ছিল। সম্মেলন কক্ষে আমাদের অপেক্ষা যখন একটু দীর্ঘতর হচ্ছিল, আমরা একটু অধৈর্য হয়ে পড়ছিলাম, তখনই সুদর্শন মানুষটা ঘরে ঢুকে হাসিমুখে সম্ভাষণ জানাতেই বেশ উষ্ণ আন্তরিক পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল।
চেয়ারে বসতে বসতে রবীন্দ্রনাথের যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে এবং নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা স্মরণ করে বেশ কাছের মানুষটি হয়ে কথা শুরু করেছিলেন। বললেন তাঁর নানার ছোট ভাই ড. মাহমুদ হোসেনের কথা, যিনি পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে একসময় (১৯৬০-৬৩) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। বললেন, আমাদের মধ্যে মিল যত বেশি পার্থক্য তার চেয়ে অনেক কম। স্মরণ করলেন ছাত্রজীবনে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনি ও তার স্বামীর সাথে পরিচয়ের কথা।
তা সত্ত্বেও ভারতের সাথে জ্বলন্ত ইস্যুগুলো উঠে এলো। সালমান খুরশীদ ফেলানির হত্যাকাণ্ডে গভীর শোক প্রকাশ করলেন এবং বললেন সীমান্তে মৃত্যু বন্ধ করার উপায় বের করতেই হবে। এই প্রসঙ্গে বললেন, তাঁর স্বপ্ন হল, একদিন সীমান্ত থাকবে না, দু’দেশের মানুষ অনায়াসে চলাচল করতে পারবেন। তাঁর বিশ্বাস লোকসভার আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনে স্থল সীমান্ত চুক্তি উত্থাপিত হবে। এটি পাশ করতে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতি প্রয়োজন হয় যা বর্তমান ইউপিএ সরকারের নেই। তাই সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে, বিজেপির সমর্থনের ব্যাপারেও তিনি আশাবাদী বলে জানালেন।
তিনিও তিস্তা চুক্তি না হলেও পানি প্রবাহ ঠিক আছে বলে জানান। সাথে এ প্রতিশ্রুতি দেন যে, পানি যেন কোনভাবে প্রত্যাহৃত না হয় সেটা দেখা হবে। ভবিষ্যতে উজানে কোন বাঁধ বা প্রকল্প করতে হলে বাংলাদেশকে সাথে নিয়েই তা করা হবে।
সালমান খুরশীদ জোর দিলেন যৌথ উদ্যোগের আরও নানান ক্ষেত্র খুঁজে নেওয়ার উপর- তা সরকারি এবং বেসরকারি উভয় খাতেই হতে পারে। বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য সেবা খাতের প্রসঙ্গ এসেছে এই সূত্রে।
তবে যৌথ উদ্যোগে যে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হতে যাচ্ছে রামপালে তা বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবনের বিপুল ক্ষতি করবে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এ কেন্দ্র থেকে ভারতে বিদ্যুৎ যাবে, ফলে এর মধ্যে ভারতের স্বার্থ এবং বাংলাদেশের সমস্যার দিকটি ফুটে উঠলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে অসমতা ও ক্ষেত্র বিশেষে অন্যায্যতার অভিযোগ প্রকট হয়ে ওঠে। বড় প্রতিবেশীকে এসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। এটাও আমরা বুঝছি না শেখ হাসিনা কেন তড়িঘড়ি করে বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে এটি বাস্তবায়নে এগিয়ে গেলেন যেখানে ভারত সব পক্ষকে সাথে না নিয়ে সীমান্ত চুক্তি বা তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নে অগ্রসর হচ্ছে না? সেদিনই সাউথ ব্লকে আরেকটু অপেক্ষা করে আমরা মিলিত হয়েছিলাম ভারতের বিদেশ সচিব শ্রীমতী সুজাতা সিংয়ের সাথে। সৌজন্য ও প্রীতি বিনিময় এবং কূটনৈতিক শিষ্টাচারের সুন্দর অভিব্যক্তিসহ দিনের কর্মসূচি শেষ হয়েছিল।

Sunday, September 29, 2013

শঙ্কা শুধু দানাই বাঁধছে, ভাঙবে কে

আবুল মোমেন


দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিদিনই অনিশ্চয়তা এবং চাপা উদ্বেগ-উত্তেজনার পারদ বাড়ছে। এরকম পরিস্থিতি একেবারে নতুন নয় দেশবাসীর জন্য, এ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আগেও আমরা গেছি। তবে সবসময় পরিণতি ভালো হয়নি বলে সব মানুষই যেন ভেতরে-ভেতরে অস্থির হয়ে আছে। নাগরিক সমাজ এ নিয়ে ব্যাপকভাবে কথাবার্তা বললেও রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ বা উদেযাগ আসছে না। তাতে মানুষের হতাশা তো বাড়ছেই, একটু আতঙ্কগ্রস্তও হয়ে পড়ছে সবাই।  দেশে দুটি বড় পক্ষ তৈরি হয়েছে সক্রিয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে। সমস্যাটা বড় হয়ে উঠেছে এ কারণে যে-কোনও পক্ষই নিজ-নিজ অবস্থানের অনুকূলে জনগণকে টানতে পারছে না। এত দিনের ক্ষমতার রাজনীতির অভ্যস্ততায় দুই বড় দলেই নেতাকর্মীদের মধ্যে অর্থবিত্তের সঞ্চয় ও মোহ উভয়ই বেড়েছে। ফলে নিজ-নিজ দলীয় কর্মসূচি ও দাবি নিয়ে রাজপথে যথার্থ গণ-আন্দোলন তৈরি করার সামর্থ্য তাদের নেই বললেই চলে। বিকল্প হচ্ছে রাজপথে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে জনমনে আতঙ্ক বাড়ানো। আপাতত বিরোধী দল সে কাজই করছে। সরকারি দল হিসেবে এ পর্যায়ে আওয়ামী লীগের এ ধরনের ভূমিকায় নামার প্রয়োজন পড়ছে না। কিন্তু বিরোধী পক্ষকে মোকাবিলা করার জন্যে তারাও কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচি মাঠে আনতে পারছে না। রাজনীতির নামে প্রকাশ্যে যা ঘটতে দেখছে মানুষ তা হল ক্ষমতাপাগল কিছু ব্যক্তির দিশাহীন অপকর্মের নমুনা। তাতে মানুষ হতাশ এবং বিরক্ত। রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল বা নেতাদের ওপর মানুষের আস্থা তলানিতে ঠেকেছে। অথচ শেখ হাসিনা এ মেয়াদের শুরুতেই একেবারে রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা নিয়ে বিডিআর বিদ্রোহ-পরবর্তী পরিস্থিতি সামলেছেন। আবার মেয়াদের শেষে এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রেও তিনিই রাষ্ট্রনায়কসুলভ দৃঢ়তা দেখাচ্ছেন ও দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিচ্ছেন। দুই ক্ষেত্রেই তিনি ঝুঁকি নিয়েছেন, সাহসী ভূমিকা পালন করে চলেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হয়নি, সবটা এ মেয়াদে শেষ হবে না। এটি আসলে একটি চলমান প্রক্রিয়া। মাত্র গত মাসে হাঙ্গেরিতে ধরা পড়েছে এক নািসদোসর, যার বয়স এখন ৯৬। কিন্তু তা বলে বিচার থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছেন না তিনি। কাঠগড়ায় তোলা হবে তাকে অচিরেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশের জন্যে ইতিহাসেরই একটি উপজাত কর্তব্য, যেমন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ নািস যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দায়িত্ব তৈরি করেছে। যুদ্ধ নানা মাত্রার অপরাধ সৃষ্টি করে এবং তা নিরসনের ধরনও নানান রকম হতে পারে। তবে ব্যক্তি-অপরাধীকে সাধারণত দায় নিয়ে বিচার ও শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। কোন জাতি হয়তো সামষ্টিক অপরাধের জন্যে ক্ষমা চাইতে পারে ক্ষতিগ্রস্ত জাতির কাছে। জাপানকে কোরিয়া ও চীনের কাছে বারবার ক্ষমা চাইতে দেখছি আমরা। কিছুকাল আগে রুশ প্রেসিডেন্ট পোলিশদের বিরুদ্ধে কৃত অপরাধের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এ সবই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের জের। এ প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত আছে। আমরাও এ জন্যে আশা করেছি পাকিস্তান সরকারিভাবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের জন্যে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চাইবে।আমাদের দেশে একাত্তরে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিসংগ্রাম করলেও তারই ধারাবাহিকতায় ইতিহাসকে এগিয়ে নিতে পারেনি। যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে সদ্যস্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে অগ্রাধিকার দেওয়া সম্ভব হয়নি। তখন সরকারের সামনে প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ ছিল চারটি— ১. শত্রুর দখলমুক্ত সদ্যস্বাধীন দেশে প্রশাসনিক কাঠামো ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ২. সংবিধান প্রণয়ন ও তার আওতায় সরকারের আইনগত বৈধতা প্রতিষ্ঠা ৩. যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন এবং ৪. এক কোটি শরণার্থীকে ফেরত আনা ও পুনর্বাসন। বঙ্গবন্ধু দ্রুত এ চারটি দায়িত্ব পালনে হাত দিয়েছিলেন এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু বিজয় বা স্বাধীনতা রাজনৈতিক কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যেও যে আরও অনেক বেশি দায়িত্ব নিয়ে আসে সেটা যেন তার সহকর্মীদের বোঝাতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধপরিস্থিতি এক ধরনের উচ্চাভিলাষী মানুষ তৈরি করে যাদের সামলানোর কৌশল প্রয়োগ করতে পারেননি তিনি। তৃতীয়ত, দল ও দলনিরপেক্ষভাবে তখন যারা নিঃস্বার্থভাবে দেশ গঠনে কাজ করতে চেয়েছিলেন তাদের জন্যও কাজের সুযোগ তৈরি করতে পারেননি। চতুর্থত, যুদ্ধপরবর্তী ভাবাবেগপূর্ণ পরিস্থিতিতে চরমপন্থা ও চক্রান্তের পথও সুগম হয় যা তার নেতৃত্ব বা প্রশাসন যথাযথভাবে সামলাতে পারেনি। আর তার মৃত্যুতে এবং তার আগে থেকে দূরদর্শী নেতা তাজউদ্দিন নিষ্ক্রিয় ও পরে নিহত হওয়ায় চলমান রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ।তখন দেশে প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, সিপিবি ও অন্যান্য সমমনা দল বাকশালের অংশীদার হয়ে কিছুটা জনবিচ্ছিন্ন, জাসদ গোলকধাঁধার ভ্রান্তি-চক্রান্তে পড়ে হীনবল। ফলে আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করে এবং সরকারি দমনপীড়নের চাপে রেখেই জিয়াউর রহমান ভস্ম থেকে পাকিস্তানকে পুনরুদ্ধার করার রাজনীতি শুরু করেছিলেন। তারই উপজাত এরশাদ, পুনরুজ্জীবিত জামায়াত আর বিভিন্ন ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দল। জিয়া এরও চেয়ে ভয়ঙ্কর যে-কাজটি করতে সক্ষম হয়েছেন, তা হল মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, বাঙালির চিরায়ত মানবতার সংস্কৃতি, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতি ইত্যাদি বাংলাদেশের অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক উপদানগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কাজে অনেক বুদ্ধিজীবী পেশাজীবীকে সংঘবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। সেই থেকে বাংলাদেশ চলছে দুই রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে। দেশের বুদ্ধিজীবী ও নাগরিকসমাজ সঠিক ভূমিকা নিতে না-পারায় এই বিভাজন ঐতিহাসিক সত্যে পরিণত হয়েছে।তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ ফাটল বন্ধ করার ঔষধ নয়। এ হল সন্তর্পণে ফাটল পেরুনোর নির্বাচনি বৈতরণী বিশেষ। কিন্তু ফাটল বাড়ছে। এবং তাতে কিছু নতুন বাস্তবতাও তৈরি হয়েছে।যেভাবে জেনারেল জিয়া ভস্ম থেকে পাকিস্তানের বীজ তুলে এনেছিলেন তেমনি এবারে শেখ হাসিনা প্রায় নির্বাপিত ভস্ম থেকে বাংলাদেশের প্রাণবীজের স্ফুলিঙ্গ তুলে আনার চেষ্টা করছেন। তিনি কেবল বঙ্গবন্ধুর খুনি বা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারেই নামেননি, আইএসআইয়ের ঘাঁটি বন্ধ করেছেন, পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস শুদ্ধির প্রয়াস নিয়েছেন, সমাজে অসাম্প্রদায়িক মানবতার বাতাবরণ তৈরির চেষ্টা করছেন। এ কাজ দীর্ঘমেয়াদি, সময়সাপেক্ষ। কিন্তু এদিকে দেখতে দেখতে নির্বাচনের সময় এসে হাজির। শেখ হাসিনা এবং তার অনুসারীরা ত্রিশংকু অবস্থায় পড়েছেন।নির্বাচনে সব দলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে হবে। তাতে বিদ্যমান বাস্তবতায় যুদ্ধাপরাধী বা একুশে আগস্টের হামলাকারীদের ঠেকানো গেলেও তার পেছনের রাজনৈতিক শক্তিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া, এমনকী জনগণ চাইলে জয়ী হওয়া থেকেও, ঠেকানো যাবে না। বিকল্প পথ ছিল একাত্তরের চেতনায় জাতিকে, বিশেষত তরুণ সমাজকে, ঐক্যবদ্ধ করে গণজোয়ার, গণআন্দোলন সৃষ্টি করে তার পটভূমিতে নির্বাচনে যাওয়া— অনেকটা ১৯৭০ এর মতো। তবে ক্ষমতায় থেকে এবং দলীয় ক্যাডারবাহিনীকে লাগামছাড়া ভোগদখলের সুযোগ দিয়ে তা সম্ভব কিনা সে প্রশ্ন ওঠা সঙ্গত।এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের যে-দুর্বলতাটি প্রকাশ পাচ্ছে তা হল, বাংলাদেশকে পুনরুদ্ধারের কঠিন সংগ্রামে তিনি নিজের দলকে সঙ্গে নিতে পারেননি। আওয়ামী লীগের শক্তি তার সাংগঠনিক ভিত, এই দফায় শেখ হাসিনা তার প্রশ্রয় ও প্রসাদ বিতরণে ব্যক্তিগত খেয়ালের ওপর এতটাই নির্ভর করেছেন যে তাতে দলের সাংগঠনিক কাঠামো ও শক্তি উভয়ই ক্ষয় পেয়েছে, দুর্বল হয়েছে। তার জন্যে এটুকু আশ্বাস হয়তো দেওয়া যায় যে, এতদ্সত্ত্বেও তুলনায় বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি এখনও দুর্বল।কিন্তু এত কথার পরে যে-কথাটা বলা দরকার তা হল, দেশের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক সমাজ তলে-তলে দুটি যুযুধান শিবিরে বিভক্ত, কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠান। তার পক্ষে নানা উপদলে-কোন্দলে বিভক্ত সন্ত্রাস-সংহারে মত্তপ্রায় দুটি শিবিরের ক্ষমতার লড়াইকে  নেহায়েত নির্বাচনি কর্মকাণ্ডে সীমিত রাখা সম্ভব হবে কি? মানুষ এসব নিয়েও ভাবিত, শঙ্কিত এবং সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে হতাশ ও আতঙ্কিত। 

Tuesday, September 3, 2013

দুই নেত্রীর সামনে ইতিহাস সৃষ্টির সুযোগ

আবুল মোমেন
কঠিন সময় মানেই দুঃসময় এমন ভাবা ঠিক নয়। কঠিন সময়ই নেতৃত্বগুণের পরিচয় দেওয়ার উপলক্ষ তৈরি করে দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রায় আজীবন কঠিন সময়েই জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এভাবেই তিনি একজন দলীয় কর্মী থেকে জাতির জনক, শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধুতে উন্নীত হয়েছিলেন।
নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন আমাদের দুই নেত্রীকে দেশের রাজনীতির রঙ্গমঞ্চের দুই প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছিল। তারা সেদিন নেতৃত্বগুণের পরিচয় দিয়েছিলেন নাগরিক সমাজ ও জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে তিন জোটের রূপরেখা গ্রহণ করে। এর ফলে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে ও দেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে।
একানব্বই থেকে গণতন্ত্রের পথে আমাদের যাত্রা শুরু হলেও রাজনৈতিক সংকট আমাদের পিছু ছাড়ে নি। মুক্তিযুদ্ধ যে-রাজনীতির সমাধি রচনা করেছে বলে ভাবা হয়েছিল তার পুনরুজ্জীবন ঘটে পঁচাত্তরের পরে। তার অনুঘটকের কাজ করেছেন জেনারেল জিয়া। তবে কাজটা সম্ভব হওয়ার কারণ রাষ্ট্রের উত্তরণ ঘটলেও সমাজের রূপান্তর ঘটাতে পারি নি আমরা। আজ দুই নেত্রী জনগণের প্রধান দুই মতাদর্শের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যা জাতীয় জীবনে ও নাগরিক সমাজে বিবদমান প্রতিপক্ষতা লালন করছে। একটু পরিষ্কার করে যদি বলি, তো বলা যায় আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাঙালি জাতীয়তার ভাবাদর্শের নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং বিএনপি মুসলিম ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের নেতৃত্বে রয়েছে। এর সরল ব্যাখ্যা এ-ও হবে, আওয়ামী লীগ বায়ান্ন থেকে একাত্তরের তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতি করছে আর বিএনপি পাকিস্তানি ভাবধারার রাজনীতির নেতৃত্ব দিচ্ছে। উভয় মতাদর্শের পিছনে থেকে দেশের সচেতন মানুষ, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিক, নারী-ছাত্র সকলেই এই বিভাজনে শরিক হয়ে পড়ছেন। এই বিবদমান রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে হিসেবে চিহ্নিত হয়ে পড়ায় দুই দল বা তাদের নেতৃত্বাধীন দুই জোটের পক্ষে সমঝোতায় আসা কঠিন।
আবার ভাবাদর্শিক পার্থক্য ছাড়াও যুদ্ধাপরাধ ও তাদের বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি, বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যা এবং হত্যাকারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং সর্বশেষ ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মত ঘটনা দুই দলে সমঝোতা, এমনকি দুই নেত্রীর মধ্যে বৈঠকও অসম্ভব করে তুলেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে প্রায় সমশক্তির দুটি পক্ষের নেত্রী তাঁরা।
দুই নেত্রী রাজনীতিতে রয়েছেন তিরিশ বছর। এর মধ্যে তাঁরা কখনও দেশ বা জাতীয় কোন ইস্যু নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসেন নি। দিনে  দিনে পারস্পরিক দূরত্ব বেড়েছে এবং তা কমার সম্ভাবনা আপাতত নেই। তারও চেয়ে বড় কথা হল, তাঁরা দু’জন বসলেও তা থেকে গ্রহণযোগ্য কোন ফলাফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ইতিহাস আমাদের জন্যে এরকম এক কঠিন সময় তৈরি করেছে। 
যেসব জাতি ও দেশ উন্নত হয়ে আজকের বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং শাসনব্যবস্থা ও নাগরিক জীবনে ধর্মের ভূমিকার বিষয়ে সকল তর্ক-বিতর্ক, এমনকি হানাহানির অবসান ঘটিয়েছে বহুকাল আগে। এ বিষয়ে নিষ্পত্তি করেই তারা রেনেসাঁস থেকে শিল্প বিপ্লবের ফসল কাজে লাগিয়ে উন্নত জীবনের সূচনা করেছে। এটি ধর্মবিরোধী পথ নয়, রাষ্ট্র ও নাগরিক জীবনকে ধর্মনিরপেক্ষ রেখে সব সম্প্রদায়ের জন্যে সমতার ভিত্তি তৈরির পথ।
আমাদের ধারণা হয় যে শেখ হাসিনা এই পথ ধরেই এগুতে চাইছেন, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষার সাথে মেলে। কিন্তু দেশে এমন মানুষও কম নেই যারা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার রাজনীতি এগিয়ে নিতে চান। তাছাড়া সাম্প্রতিককালে ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান, সম্প্রতি লিবিয়া এবং বহুকাল ধরে প্যালেস্টাইনে উন্নত পশ্চিমা বিশ্ব যে ভূমিকা পালন করেছে বা করছে তাতে সমগ্র বিশ্বের মুসলমান সমাজে একটা নতুন ধর্মীয় জাতীয়তার উন্মেষ দেখা যাচ্ছে। দেশে দেশে বহু জঙ্গি ইসলামি দলও মাথাচাড়া দিচ্ছে। এতে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার এজেণ্ডা শক্তিশালী হয়ে উঠছে এবং বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের যাত্রাপথ কঠিনতর হয়ে পড়ছে।
এর পাশাপাশি মনে রাখতে হবে সব মানুষ রাজনৈতিক দলের বিচারের ক্ষেত্রে ভাবাদর্শের মাপকাঠিকেই একমাত্র বা মুখ্য করে ধরে না। তারা দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, দলীয় আধিপত্য ও সংকীর্ণতা এবং অবশ্যই সুশাসনের অভাবের মত বিষয়কেই বিচারের মাপকাঠি হিসেবে ধরতে চায়। সেদিক থেকে তারা দুই বড় দলের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য দেখে না।
এদিকে সমাজ সংস্কার ও সমাজ পরিবর্তনের কাজ যেহেতু সেভাবে হয় নি তাই স্থবির সমাজকে অবক্ষয়ের ঘূণে ধরেছে। আজকের রাজনীতিতে অস্ত্র, কালোটাকা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার বেড়েছে। এতে বিরাজনীতিকরণ যেমন হয়েছে তেমনি রাজনীতিতে দূষণও ঘটেছে। কালোটাকার মালিকরা রাজনীতিতে জাঁকিয়ে বসেছে। আর তাতে দলীয় কোন্দল, ক্যাডারভিত্তিক দখলদারী, অবৈধ পথে বিত্ত ও ক্ষমতা অর্জনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। দীর্ঘকাল এরকম অবস্থা চলতে থাকার ফলে আমাদের সামাজিক ও ব্যক্তিক নৈতিকতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার মান অত্যন্ত নিচে নেমে গেছে। এরকম বাস্তবতায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠুভাবে চালানো কঠিন। ফলে একদিকে সংবিধান যখনতখন রদবদল করা হয়েছে আর অন্যদিকে দিনে দিনে সরকার কর্তৃত্বপরায়ন হয়ে উঠেছে।
রাজনীতিতে নীতি-আদর্শের জায়গা কমে যাওয়ায় আস্থার সংকটও বেড়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য রাখার জন্যে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল।
এতে নির্বাচন বৈতরণী পার হওয়া গেছে বটে কিন্তু কি সংসদ কি সরকার কোনটিই ঠিক মতো চলে নি। প্রতিবারই পরাজিত দল নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং বিজয়ী দল সম্পূর্ণ ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে। বিরোধী দল সংসদ বর্জন থেকে সব রকম অসহযোগিতা চালিয়ে গেছে। গণতান্ত্রিক আমলে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা বেশি হয়েছে, আদিবাসী সংখ্যালঘুদের ভোগান্তি বেড়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নির্বাচনসহ অচলাবস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রমিক, কৃষকসহ মেহনতি মানুষের পক্ষে কথা বলার সংগঠন ও নেতা কমেছে। ছাত্র সংগঠনের অবক্ষয় সর্বনিু পর্যায়ে নেমে গেছে।
কিন্তু তারপরও গণতন্ত্রই ভরসা। প্রথমত, অন্য কোন ভালো বিকল্প নেই; দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্রে সংশোধন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতায়নের সুযোগ থাকে।
সামনে নির্বাচন, গণতন্ত্রকে সচল রাখতে হলে সেটি সুসম্পন্ন করতে হবে। এ নিয়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, সংকট গভীর হচ্ছে। ফলে প্রথম কথায় ফিরে গিয়ে বলতে হবে - এখনই সময় নেতৃত্বগুণের পরিচয় দেওয়ার। কিন্তু আপাতত দুই নেত্রী নিজ নিজ অবস্থানে অটল, ছাড় দিতে নারাজ। অথচ ইতিহাস তাঁদের সামনে ইতিহাস সৃষ্টির সুযোগ এনে দিয়েছে।
আমার ধারণা, বর্তমান অচল অবস্থায় যিনি তা নিরসনে প্রথম চালটি দেবেন তিনিই জনগণের চোখে নেতৃত্বগুণের বিচারে এক ধাপ এগিয়ে থাকবেন। কারণ পরিস্থিতি কিছু পাল্টেছে। অধিক হারে মানুষ শিক্ষার আওতায় এসেছে, উপার্জনক্ষম নারীর সংখ্যা বেড়েছে এবং হতদরিদ্র পরিবারের সংখ্যা কমেছে, মঙ্গা-দুর্ভিক্ষাবস্থা নেই বললেই চলে। এর ফলে নিজের সংসার-পরিবার-সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করার মত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তারা শান্তি ও স্থিতিশীলতা চাইবে এটাই স্বাভাবিক। ফলে সেই নেতৃত্বকে মানুষ সাধুবাদ জানাবে যিনি শান্তি-স্থিতির অনুকূলে কাজ করবেন। তাই বলব, প্রথমত, সমাজে সমঝোতা ও সৃষ্টিশীলতার পক্ষে জোরালো জনমত রয়েছে এবং দ্বিতীয়ত, সমঝোতার পথে যিনি প্রথমে পা বাড়াবেন তিনি একটু হলেও এগিয়ে থাকবেন। আমরা বিশ্বাস করি দুই নেত্রীই বিষয়টি বোঝেন।
























Thursday, August 29, 2013

যুক্তি তর্ক গল্প

আবুল মোমেন

আঠার বছর আগে চট্টগ্রামের পত্রিকায় সর্বশেষ কলাম লিখেছিলাম। তখন কাজ করতাম দৈনিক পূর্বকোণে। ১৯৯৫ সনের মাঝামাঝি দৈনিক পূর্বকোণ ছেড়ে আসি। তারপর তিন বছর ভোরের কাগজে লিখেছি। এরপর টানা পনের বছর দৈনিক প্রথম আলোয় কলাম লিখেছি। সাপ্তাহিক কলাম লেখার রেওয়াজ থাকলেও শেষ কয়েক বছর প্রতি পক্ষে একবার লিখেছি। সে হিসেবে নিয়মিত কলাম লেখার অভ্যাস চলেছে ১৯৮৬-র ফেব্র“য়ারি থেকে। সে প্রায় সাতাশ বছর হতে চলল। বলা যায় সহস্রাধিক কলাম লিখেছি এ পর্যন্ত।
তবে এরও আগে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সনে ভাষা সৈনিক ও একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসি নি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’র রচয়িতা মাহবুব উল আলম চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত দৈনিক স্বাধীনতায় সহকারি সম্পাদক হিসেবে সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় দুই-ই লিখেছি। এ ছিল সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে - হয়ত তিন মাস। কারণ তখনও এম. এ. পাশ করা হয় নি। ১৯৭৮ সনে ওয়াহিদভাই - বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সঙ্গীতগুণী ওয়াহিদুল হক - চট্টগ্রামে এসে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি লাইফ প্রকাশ করলে আমি পড়া শেষ করে ও মাস্টারি ছেড়ে তাতেও সহকারি সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হই। তখনও সাপ্তাহিক কলাম লিখেছি, ইংরেজিতে। তবে সে-ও ছিল স্বল্পকালীন মেয়াদের সাংবাদিকতা - আট মাস স্থায়ী হয়েছিল। তারপর ১৯৮৬ থেকে টানা সাংবাদিকতায় আছি।
যখন থেকে নিয়মিত কলাম লিখছি, অর্থাৎ ১৯৮৬ সনের ফেব্র“য়ারিতে দৈনিক পূর্বকোণে লেখার মাধ্যমে যার সূচনা, তখন থেকেই আমার কলামের নাম যুক্তি তর্ক গল্প। মূলত সমকালীন রাজনীতি নিয়ে লিখি, কখনও সামাজিক ইস্যুও কলামের বিষয় হয়। ক্বচিৎ লিখি আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে।
সবসময় সমাজের অগ্রগতি না হলেও কিংবা অগ্রগতি আশানুরূপ গতিতে না হলেও, সমাজ কখনও থেমে থাকে না। ইতিহাসও তেমনি। অর্থাৎ সমাজ ও ইতিহাস উভয়ই গতিময়, পরিবর্তনশীল, এবং দুয়ের অগ্রগতিই কাম্য। এ নিয়ে রক্ষণশীলদের বাধার মুখে সমাজে টানাপোড়েন চলে, ইতিহাস কখনও শান্ত প্রায়স সংকুল হয়ে ওঠে। সমকালীন মানুষের পক্ষে তার সঠিক ব্যাখ্যা করা সবসময় সম্ভব হয় না। তাতে অনেক গল্পকথা, অতিকথা এবং নানা কথা চালু হয়। এ সবই মানুষের মুখে মুখে রচিত ও চালু হয়। তাতে দ্বিমত হওয়াই স্বাভাবিক, তর্ক জমে ওঠা খুবই সঙ্গত। সমাজ, ইতিহাস, রাজনীতি, এমনকি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সাহিত্য ইত্যাদি নিয়েও তর্ক কত প্রকার ও কি কি তা সাম্প্রতিক কালের বাংলাদেশের মানুষ খুব ভালো করেই জানে। তর্কের কোনো শেষ নেই। শুনেছি টেলিভিশনের কোনো কোনো টক-শোই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। টক-শো জনপ্রিয় হচ্ছে মূলত দুই বা তার অধিক কথকের তর্কাতর্কির কারণে।
তর্কের খাতিরে তর্ক অবশ্য উপকারে আসে না। তাতে সমাজের অপকারই হয়। তাই তর্কের মূল ভিত্তি হওয়া দরকার যুক্তি। যুক্তি দিয়ে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করা জরুরি। সেক্ষেত্রে দেখা যাবে তর্ক আমাদের মীমাংসা বা সমাধানের পথেই নিয়ে যাবে। এটা হবে অগ্রগতি।
এরকই একটি ইচ্ছা থেকে আমি কলাম লিখি। আর তাই কলামের নামকরণ করেছি - যুক্তি তর্ক গল্প। নামটি একেবারে মৌলিক নয়। বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্রকার ঋত্ত্বিক ঘটকের শেষ ছবিটির নাম যুক্তি তক্ক গপ্পো। নামটা সেখান থেকেই পাওয়া, কেবল পশ্চিমবঙ্গীয় আঞ্চলিক শব্দ তক্ক ও গপ্পোর পরিবর্তে প্রমিত বাংলা তর্ক ও গল্প শব্দ দুটি পছন্দ করেছি। তবে এই নামকরণ সম্পর্কে একান্ত নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে আমার। সেটাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। 
সমাজে অনেক বিষয়ে তর্ক চলছে, নতুন নতুন ইস্যু যুক্ত হচ্ছে তাতে। এটা একটি প্রাণবন্ত সমাজের জন্যে স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু আমাদের জন্যে দুর্ভাগ্যের বিষয় হল এখানে তর্কে যুক্তির চেয়ে গল্পকথা টেনে আনা হচ্ছে বেশি। তাতে কোনো তর্কই সুষ্ঠুভাবে মীমাংসিত হয় না। আমরা বহুকালের পুরোনো ধারণা, চিন্তা, বিশ্বাস, সংস্কার আজও বয়ে বেড়াচ্ছি। এমনকি বিপুল ত্যাগ ও রীতিমত মুক্তিযুদ্ধ করে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেও পুরোনো তর্কের নিষ্পত্তি ঘটাতে পারছি না। কথাটা ব্যাখ্যা করে বলি।
মানুষের ব্যবহারিক জীবনের পরিবর্তন ঠেকানো যায় না। এক জীবনে আমরা পায়ে-হেঁটে-চলা মানুষ আজ গাড়ি চড়ছি, বিমানে চড়ছি; পুকুরে জাল দিয়ে মাছ ধরে খেতে অভ্যস্ত মানুষ ফ্রিজ-ডিপফ্রিজ ব্যবহার করছি; হাতপাখার মানুষ বৈদ্যুতিক ফ্যান ছেড়ে এখন শীতাতপ যন্ত্রে আরাম করছি; পান্তাভাতের স্বাদ ভুলে চিনে খাবারে মজেছি, এমনি আরও অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে। ব্যবহারিক জীবনে যেসব পরিবর্তনে আমরা অভ্যস্ত হয়েছি তার পেছনে প্রযুক্তির ভূমিকার কথা আমরা জানি। কিন্তু নিত্যনতুন এসব প্রযুক্তি আসছে কোত্থেকে? তার পেছনে কাজ করছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানই মানুষের জানার পরিধি ও জ্ঞানের জগৎ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। তার ফলে যুক্তিসঙ্গতভাবেই অনেক ধারণা ও বিশ্বাস সেকেলে হয়ে খারিজ হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীদের অনেক তত্ত্বের সাথে তৎকালীন ধর্মীয় নেতাদের সংঘাত বেধেছিল, সে আমরা জানি। গেওর্দানো ব্র“নোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, গ্যালিলিও গেলিলেইকে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু জ্ঞান হচ্ছে আলো, আর যুক্তি সেই আলোর রশ্মি - একে চূড়ান্তভাবে থামানো, চাপা দেওয়া সম্ভব নয়।
মানুষের ব্যবহারিক জীবনের পরিবর্তনের পিছনে যে বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তির দর্শন আছে তাকে বুঝতে না পারলে এবং বুঝে ধারণা না করলে সেই সমাজের মানস পুরোনো ও তামাদি হয়ে যাবে। সে সবসময় পিছনে থাকবে, অগ্রসর উন্নত সমাজের অনুকরণ করে একটি দ্বিতীয় মানের জীবনে ঘুরপাক খেতে থাকবে।
দীর্ঘদিন এ বিষয়ে যতœ না নেওয়ায় আমাদের উচ্চতর জ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠানে, এমনকি বিদ্বৎসমাজের অবক্ষয় ও পিছিয়ে থাকা চোখে পড়ার মত। আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় - যা একসময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ছিল - বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিঙে একশতের মধ্যেও আসে না। আমাদের মেডিক্যাল বলুন, প্রকৌশল বিদ্যাচর্চা বলুন সব ক্ষেত্রেই এই অবস্থা। বাস্তবটা আরও বোঝা যাবে এই তথ্য থেকে - গত শতকের ষাট সত্তর দশকে মালয়েশিয়া থেকে ছাত্ররা উচ্চ শিক্ষার জন্যে আমাদের দেশে আসত, আর আজ পরিস্থিতি ঠিক উল্টো। আমাদের ছাত্ররা সেখানে উচ্চশিক্ষার জন্যে যাচ্ছে।
আমাদের সমাজমানস তামাদি হয়ে পড়েছে। আমরা রাষ্ট্র পাল্টেছি, কিন্তু সমাজ বদলাতে পারি নি, অভ্যাসে-ব্যবহারে হয়ত বদলেছি, কিন্তু চিন্তায় ভাবনায় বদলাই নি। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিকরা কিন্তু সমাজবদলের কথাই বলেছিলেন।
এখানে একথাটাও বলা দরকার। মানুষের জীবনে যুক্তির পাশাপাশি বিশ্বাসেরও জায়গা আছে। বিশ্বাসের ভিত্তিতে বন্ধন তৈরি হয়, মানুষ শিকড়বদ্ধ হয়, আর যুক্তি তাকে বিকশিত ও প্রস্ফুটিত হওয়ার পাথেয় দেয়। মানুষের বিশ্বাসকে ঘিরে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক ভালোবাসার, বৈরাগ্য ও আধ্যাত্মিকতার, গভীর ধর্ম বোধের বীজ বিবর্তিত বিকশিত হয়।
আজকে আমাদের সমাজে সত্যিকার অর্থে বিশ্বাসের সংকট চলছে। কপটতা, মিথ্যাচার এবং মোনাফেকিতে মানুষ ব্যাপক হারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। এ সমাজ মানবধর্ম পালন করছে না। তাই বলা যায়, সঠিক পথে সামষ্টিকভাবে কোন ধর্মই পালিত হচ্ছে না। ধর্মান্ধতা, ধর্মব্যবসায় আর যাই হোক ধর্ম পালন হয়।
বিজ্ঞানেও নেই ধর্মেও সংকট - ফলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের দিকে এগুচ্ছে সমাজ। এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সবাই ভুক্তভোগী, সবাই এ নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু কেবল নিজেকে শোধরাচ্ছি না।
মানুষ হিসেবে বড় হয়ে তবে জাতি হিসেবে সার্থক হতে পারব। নিজের বিশ্বাসকে জীবনের ইতিবাচক অবলম্বন হিসেবে পেতে হলে যুক্তির পথে চলতে হবে, আমি নিজের জন্যে এবং পাঠকদের জন্যে সেই পথেরই সন্ধান করি।
এই অনুসন্ধানী পথে সহযাত্রী হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে আজকের ও আগামী দিনের সকল সহযাত্রীকে জানাই আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা, এবং তাদের মাধ্যম দেশবাসীকে - সুপ্রভাত, সুপ্রভাত বাংলাদেশ।

Wednesday, August 21, 2013

নাগরিক সমাজ দায়িত্ব এড়াতে পারে না

আবুল মোমেন

দু বছরের অস্বাভাবিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং দুটি স্বল্প মেয়াদের সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দিলে গত তেইশ বছরের মধ্যে কুড়ি বছর দেশ দুই নেত্রীর অধীনে শাসিত হয়ে আসছে।
দেশ শাসন করলেও কখনও তাঁরা দু’জন দেশ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন নি, বা করতে পারেন নি কিংবা করতে চান নি। জনসভার ভাষণে অবশ্য তাঁরা একে অপরের সমালোচনার জবাব দিয়েছেন। কখনও একের মন্তব্যের সমালোচনা করেছেন অন্যে। জনসভার এই চর্চায় অবশ্য দূরত্বই বাড়ে, আলোচনার সম্ভাবনা যায় কমে। দুই নেত্রীর কাছে সুশীল সমাজের এটি একটি প্রধান চাওয়া। বিগত তেইশ বছরে দুই নেত্রীর মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ যে হয় নি তা নয়, কিন্তু সেসব সাধারণ সৌজন্য বিনিময়ের বেশি আলোচনা পর্যন্ত গড়ায় নি।
শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দু’জনেই প্রায় একই সময়ে রাজনীতিতে এসেছেন। এসেছেন তাঁরা নিজ নিজ বিপর্যস্ত দলের হাল ধরবার জন্যে। ফলে দু’জনেই দলীয় সভানেত্রীর ভূমিকা নিয়ে প্রত্যক্ষ দলীয় রাজনীতি শুরু করেছেন। তবে এখানে বলতে হবে, শেখ হাসিনা এক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে আছেন। বঙ্গবন্ধু-কন্যা হিসেবে তিনি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেই বড় হয়েছেন এবং ছাত্রজীবনে সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতি করেছেন। উপমহাদেশের রাজনৈতিক ধারা থেকে বলা যায়, কোনো একসময় তাঁর জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার সম্ভাব্যতা বরাবরই ছিল।
খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন। স্বয়ং জিয়াউর রহমান প্রথমে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বিশেষ পরিস্থিতিতে জাতীয় পরিচিতি পান এবং পরে বিশেষ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন ও তারপরে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। একজন সামরিক কর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আসার বিষয়টি একেবারেই আকস্মিক। তাঁর স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুর পর তাঁকে বিএনপি নেতৃবৃন্দ জিয়ার শূন্যতা পূরণ ও দলীয় ঐক্য ধরে রাখার জন্যে সভানেত্রীর পদ দিয়ে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। আর পঁচাত্তরের পরে আওয়ামী লীগে উপদলীয় কোন্দল মাথাচাড়া দিচ্ছিল। জিয়া-এরশাদের নির্যাতনে দলে সংকট বাড়ছিল, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গতিশীল নেতৃত্বে ফিরে আসার জন্যে তৎকালীন নেতৃবৃন্দ শেখ হাসিনাকেই দলীয় প্রধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনা ধীরে ধীরে দলে তাঁর একক ও একচ্ছত্র নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিপরীতে বেগম জিয়ার নেতৃত্বের বিষয়টি খুব স্পষ্ট নয়, তিনি সহযোগীদের পরামর্শ কতটা নেন, কতটা পুত্র তারেকের ওপর নির্ভর করেন তা বোঝা যায় না। তবে বিএনপির গঠনতন্ত্রের এবং তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার কারণেই তিনিও একক ও একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করেন।
দুই নেত্রী যেভাবে একক ও একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তা নিয়ে আপাতত বলার কিছু নেই। কিন্তু যে দু’জন মানুষের ওপর দেশ ও দেশবাসীর ভাগ্য নির্ভর করছে তাঁরা যে দেশ নিয়ে পরস্পর কোনো আলোচনাই করতে পারছেন না তাতে দেশের ক্ষতি হচ্ছে। কারণ যে কোন দেশের শাসনব্যবস্থায় ধারাবাহিকতা দরকার। গণতন্ত্রে এটি আরও অপরিহার্য। আলাপ-আলোচনা ছাড়া এ কাজ তো সম্ভব নয়। এর ফলেই আমাদের রাজনীতিতে বিদেশি কূটনীতিকদের বারবার নাক গলাতে দেখি, আবার আমাদের রাজনীতিকদেরও বিদেশিদের কাছে গিয়ে নালিশ জানাতে দেখি, এবং মাঝে মাঝে সেনা-সমর্থিত অসাংবিধানিক সরকারের আবির্ভাবও ঘটে যাচ্ছে।
কিন্তু কুড়ি বছরেও দুই নেত্রীর বৈঠক সম্ভব না হওয়ায় এখন বোধহয় সময় এসেছে এর কারণ খুঁজে বের করে বিকল্প কোনো পথ খুঁজে দেখা।
সচেতন নাগরিকের চোখে দুই দলের মধ্যেকার আস্থার সংকট ধরা পড়বেই। বোঝা কঠিন নয় আওয়ামী লীগের পক্ষে জেনারেল জিয়ার কিছু ভূমিকা মেনে নেওয়া কঠিন। প্রথমত, বঙ্গবন্ধুর স্ব-স্বীকৃত খুনীদের বিচার না করে বরং প্রজাতন্ত্রের মূল্যবান চাকুরি দিয়ে পুরস্কৃত করা। দ্বিতীয়ত, ১৫ আগস্টের হত্যার বিচার থেকে তাদের অব্যাহতি দিয়ে জারিকৃত ইণ্ডেমনিটি আইন বহাল রাখা। তৃতীয়ত, নিষিদ্ধ ঘোষিত যুদ্ধাপরধীদের দল জামায়াতকে বৈধতা দান ও পুনর্বাসিত করা। চতুর্থত, মুক্তিযুদ্ধের দালালদের পুনর্বাসিত করা ও দালাল আইন সম্পূর্ণ রহিত করা। পঞ্চমত, মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণের পথ থেকে সরে এসে পাকিস্তানি ধারার ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার রাজনীতির প্রচলন।
এর সাথে যদি বেগম জিয়ার বিগত আমলের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা এবং দশ ট্রাক অস্ত্র মামলাকে বিবেচনায় নিই তাহলেও কয়েকটি গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। একুশে আগস্ট হামলার মূল টার্গেট ছিলেন বেগম জিয়ার প্রতিপক্ষ শেখ হাসিনা। সেদিন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমানসহ বাইশজন আওয়ামী লীগ-কর্মী নিহত হয়েছিলেন। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এই হামলার সাথে কেবল নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির লোক জড়িত ছিল না, এদের অনেকের জামায়াত কানেকশন ছিল এবং বিএনপির এমন কোনো কোনো নেতার পৃষ্ঠপোষকতা ছিল যাঁদের যোগাযোগ ছিল হাওয়া ভবনের সাথে। আর দশ ট্রাক অস্ত্রের ঘটনায় বিএনপি ও জামায়াতের একাধিক মন্ত্রী-নেতার যোগাসাজশের বিষয় তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।
এখন জাতীয় পর্যায়ে আরও প্রশ্ন উঠে আসছে। যে কোনো বিবেচনায় জামায়াতে ইসলামি যুদ্ধাপরাধীদের দল, এ দল একাত্তরের ভূমিকার ভুল স্বীকার করে নি। বরং ধর্মকে ব্যবহার করে বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে দেশে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানো এবং দেশে নাশকতা, উত্তেজনা ও হানাহানি সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিএনপি জামায়াতে ইসলামিকে নিয়ে জোট গঠন করেছে। এই বাস্তবতায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় গেলে জামায়াত-নেতারা মন্ত্রীও হবেন। তারা হেফাজতে ইসলামের মত একটি ধর্মান্ধ ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে অরাজকতা সৃষ্টিতে উৎসাহ দিতে কুণ্ঠিত হয় নি।
এসব প্রশ্নের সদুত্তর সুশীল সমাজ যদি নাও চায়, একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে যদি আওয়ামী লীগ চায় তাহলে তাকে তো দোষ দেওয়া যাবে না।
আমরা জানি দখলদারি, টেণ্ডারবাজি বা ক্ষমতার জন্যে দলীয় কোন্দল ও হানাহানি দু’দলে  একইভাবেই চলে। এতে জনগণের ভোগান্তি হয় তাও সবাই স্বীকার করবেন। কিন্তু এর বাইরে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড, ইতিহাস বিকৃতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী ভূমিকা, যুদ্ধাপরাধীদের মদত দেওয়ার মত ঘটনার কি বিহিত হবে?
মনে হচ্ছে শেখ হাসিনা এখন নির্বাচনে পরাজিত হলেও তাঁর অবস্থান থেকে নড়তে চাইছেন না, কারণ তিনি মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় যে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছেন তা নিয়ে আপোস করতে চান না। কথা হল, তাহলে কী হবে? 
আমার মনে হয়, নির্বাচনের আগে অত্যন্ত জরুরি হল - বিএনপির দাবি নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনা এবং তার বিপরীতে আওয়ামী লীগের দাবি হওয়া উচিত জামায়াত ও ধর্মান্ধ শক্তি সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করা। কেননা, গণতন্ত্র তো কেবল নির্বাচন আর পাঁচ বছর পরপর সরকার পরিবর্তন নয়। গণতন্ত্রের অন্যতম বিষয় হল ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমানাধিকার নিশ্চিত করা, একটি অসাম্প্রদায়িক নাগরিক সমাজ গঠন, আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করা ইত্যাদি। এ বিষয়ে সুরাহা না হলে হয়ত নির্বাচন হবে, নতুন সরকার আসবে, কিন্তু অবিশ্বাস ও অনাস্থা, সংঘাত ও হানাহানি, অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা চলতেই থাকবে।
দেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান চাইলে এ বিষয়ে নাগরিকসমাজকে কথা বলতে হবে ও উদ্যোগ নিতে হবে।

Monday, August 19, 2013

শূন্যতায় তুমি শোকসভা

আবুল মোমেন

আজকের দিনটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে বিশেষভাবে স্মরণ করার দিন। ১৯৭৫ সালের এইদিনে ঘাতকরা তাকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। তারপর থেকে বাংলাদেশ যেন এক অভিভাবকহীন পরিবার - ছন্নছাড়া, দিগভ্রান্ত। 
একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালালে বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়। সে রাতেই বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে, কিন্তু তারই নেতৃত্বে, মুক্তিযুদ্ধ চলেছিল। পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুদণ্ডের হুমকির মধ্যে তিনি প্রিয় দেশ ও দেশবাসীর কাছ থেকে শারীরিকভাবে অনেক দূরে ছিলেন।
সেদিন বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তার সহকর্মীদের যোগ্য নেতৃত্ব ও ভারতের সহায়ক সরকারের সহযোগিতায় আমরা অত্যন্ত কঠিন সেই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম গৌরবের সঙ্গে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে যা সম্ভব হয়েছিল পঁচাত্তরে তার মৃত্যুর পরে তা সম্ভব হয়নি। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, কেন? একাত্তরে তাকে ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল, সেটাই কি কারণ? একাত্তরে তার পক্ষে যোগ্য নেতৃত্ব দেওয়ার মতো মানুষ ছিলেন, যেমন তাজউদ্দিন আহমদসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ, সেটাই কি কারণ? এ দুটি কারণই সত্য বলে মনে হয়। 
কিন্তু তারও চেয়ে সত্য তৃতীয় একটি কারণ। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড কেবল বঙ্গবন্ধু বা তার পরিবারের বিরুদ্ধে সংঘটিত একটি অপরাধ ছিল না; এ ছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অংশ; খন্দকার মুশতাক এই ষড়যন্ত্রের একজন অংশীদার, বাংলাদেশের ইতিহাসের দ্বিতীয় মীর জাফর। 
পটপরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে বায়ান্নো থেকে বিপুল ত্যাগ ও দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে জাতির অর্জিত আদর্শ ও মূলনীতিগুলো বিসর্জন এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্ন তছনছ করে দিয়ে প্রত্যাখ্যাত পাকিস্তানি ধারার ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা ও ধর্মান্ধ       চিন্তাচেতনা ও সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করে। কেবল তা-ই নয়, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সংস্কৃতিকর্মীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ নির্যাতনও  চালায়। এরই ধারাবাহিকতায় জেনারেল জিয়া সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে মুসলিম ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার প্রাধান্য দিতে শুরু করেন। এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী এবং ধর্মান্ধ দলসমূহকে রাজনৈতিকভাবে পুনরুজ্জীবিত ও সেসব দলের নেতৃবৃন্দকে সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত করেন। জিয়ার পরে এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আর সংবিধানে ধর্মীয় পরিচয় লাগিয়ে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক চেহারা পাল্টে দিলেন। নব্বইয়ের পরে ক্ষমতায় এসে বেগম জিয়া একই ধারাই অব্যাহত রাখেন।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত দীর্ঘ দু-দশক ধরে বঙ্গবন্ধুর নাম গণমাধ্যমে, পাঠ্যবই ও অন্যান্য প্রচারণা থেকে মুছে দেওয়া হয়, তার ৭ মার্চের ভাষণ নিষিদ্ধ থাকে। অন্যান্য জাতীয় নেতাদের কথাও অনুচ্চারিত থেকে যায়। ফলে এ সময়ে দেশে নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়, যারা এ দেশের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারেনি। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দিন বা মুক্তিযোদ্ধাদের যে ভূমিকা তা ঠিকভাবে জানতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধে ও স্বাধীনতা অর্জনে কারা ছিল বন্ধুরাষ্ট্র, এ সময় ভারত-সোভিয়েতের ভূমিকা ইত্যাদিও জানা হয়নি তাদের। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয়, ভূমিকা এবং বিপরীতে রাজাকার-আলবদর ও অন্যান্য দালালদের কী ভূমিকা তা-ও ঠিকভাবে জানানো হয়নি। চীন, সৌদি আরব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতিবাচক ভূমিকার কথাও তারা জানতে পারেনি।
ফলে কুড়ি বছরের বিভ্রান্তিকর অপপ্রচারের মাধ্যমে দেশের ইতিহাস সম্পর্কে মানুষের মনে বিভ্রান্তি এবং বিতর্কের জন্ম দেওয়া সম্ভব হয়েছে। আজও আমরা এই বিভ্রান্তি ও বিতর্কের জের টানছি, এবং তার খেসারত দিয়ে যাচ্ছি। এ যেন সত্যিকারের অভিভাবকহীন এক ছন্নছাড়া পরিবারের দিগভ্রান্ত পদচারণা চলছে।
পরিস্থিতি আজ এ রকম যে, একজন দেশদ্রোহী ও যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গে সরকার পরিচালনার ব্যর্থতাকে গুলিয়ে ফেলছি আমরা। অপরাধের সঙ্গে অপারগতাকে এক করে ফেলছি। চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতাকে এক কাতারে রাখছি। 
আমরা জানি, স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন, এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, নবগঠিত অনভিজ্ঞ সরকার ও প্রশাসন পরিচালনার মতো দুরূহ কাজ করতে হয়েছে। সেই সঙ্গে একদিকে দেশের অভ্যন্তরে ওঁত পেতে থাকা পরাজিত শক্তির এদেশীয় দোসরদের চক্রান্ত এবং অন্যদিকে অতি-উৎসাহী উচ্চাভিলাষী মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতাও মোকাবিলা করতে হয়েছে। আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরাজিত পাকিস্তান, তার বন্ধুরাষ্ট্র চীন ও সমর্থক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশসমূহ মিলে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল বাংলাদেশকে বিপদগ্রস্ত করার  চেষ্টা করে গেছে। এদেরই অপতৎপরতার ফলে ১৯৭৪-এ দুর্ভিক্ষ হয়েছে, গোলাম আজমগং প্রশ্রয় পেয়েছে ও জামায়াতসহ অসংখ্য ধর্মান্ধ দল শক্তি সঞ্চয় করেছে। এভাবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনে অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা এবং ক্রমে চরম মনোভাবের এক বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। আজকের দিনে বাংলাদেশের এই অস্থির বর্তমান ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে আমরা যে অভাব প্রতিদিন অনুভব করি তা হল একজন যোগ্য নেতার, একজন যথার্থ অভিভাবকের। আর তখন স্বভাবতই মনে পড়ে যায় বঙ্গবন্ধুর কথা। মনে পড়ে যায় কীভাবে ইতিহাসের উজান বেয়ে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এ দেশের মানুষের নয়নমণি, একমাত্র নেতা, পরম নির্ভর অভিভাবক। 
তার জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েই তার আরব্ধ কাজ সম্পন্ন করতে হবে। মৃত্যুদিবসে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করব জাতির এই চরম সংকটকালে তার একজন যোগ্য উত্তরসূরি রাজনৈতিক নেতার জন্য প্রার্থনা জানিয়ে।


Monday, August 5, 2013

গণতান্ত্রিক রাজনীতি কি সন্ত্রাসের কাছে হার মানবে?

আবুল মোমেন 

বড় রাজনৈতিক দলের ছাত্র-যুবনেতাদের পারস্পরিক খুনোখুনির ঘটনা নতুন নয়। দেশের নানান অঞ্চল থেকে এমন খবর প্রায়ই আসে। ঢাকায় মিল্কি হত্যার ঘটনাটি সংলগ্ন মার্কেটের সিসিটিভির ক্যামেরার কল্যাণে বাড়তি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। গণমাধ্যমের ভাষায় ফিল্মি কায়দায় মাত্র ১৪ সেকেণ্ডে ঘটা হত্যাকাণ্ড! গুলি করে মানুষ মারতে হয়ত এক সেকেণ্ডই যথেষ্ট।
বিপরীতে মিল্কির কথিত হত্যাকারী তারেকের হত্যাকাণ্ডটি লোকচক্ষুর আড়ালে হওয়ায় এটি হয়ে থাকল কেবল একটি তথ্য।
কিন্তু মিল্কি বা তারেকের হত্যাকাণ্ড নয়, ফিরে যাব প্রথম কথাটিতে। যে দুটি দল এদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যায় সে দুই দলেই ছাত্র-যুব নেতাদের অন্তর্দলীয় কোন্দল এখন চরম আকার নিয়েছে। কখনও কখনও দ্বিদলীয় সংঘর্ষে তারা জড়িয়ে পড়ে। তবে উপদলীয় কোন্দলের ঘটনাই বেশি ঘটছে।
এই প্রাণঘাতি কোন্দলের পিছনে কাজ করে ক্ষমতার ভাগ, দলে ও এলাকায় আধিপত্য, অবৈধ উপার্জনের বখরা নিয়ে দ্বন্দ্ব। এ পর্যায়ে প্রথমত রাজনীতির সাথে সন্ত্রাসের সংযোগ ঘটে, দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক কর্মী ও অপরাধীর মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়। এক সময় রাজনীতিকরা ক্ষমতা ও বিত্তের আধিপত্য বজায় রাখার জন্যে কর্মীদের মাধ্যমে পেশাদার সন্ত্রাসী জোগাড় করতেন। এখন সন্ত্রাসীরা আর ভাড়া খাটে না - একদিকে তারা রাজনৈতিক দলে ঢুকে পড়েছে আর অন্যদিকে দলীয় কর্মীদের অনেকেই এদের সংস্পর্শে এসে সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়েছে।
সোমালিয়া-আফগানিস্তানে ওয়ারলর্ডদের কথা শুনেছি। তারা দেশ ধর্ম জাতি স্বাধীনতা এইসব বড় বড় লক্ষ্যের কথা বলে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। আমাদের দেশে ছোটমাপের ওয়ারলর্ড তৈরি হয়েছে, যাদের লক্ষ্যও ছোট - নিজের জন্যে দলে ভালো পদ, একটু ক্ষমতার ভাগ, অর্থবিত্তের নিত্য যোগান। ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তার এই মানুষগুলোর কিছু অনুসারীও থাকে যারা তাদের অবৈধ উপার্জনের সহায়ক শক্তি এবং সে উপার্জনের উচ্ছিষ্টের ওপর জীবন ধারণ করে। হয়ত গোপনে লক্ষ্য থাকে একদিন নিজেও তার বসের মত ক্ষমতা অর্জন করবে, রোয়াব দেখাবে।
কখন থেকে রাজনীতিতে এই পেশিশক্তি ও কালোটাকা-নির্ভর নেতাদের আবির্ভাব হল? এটা জানা দরকার।
মুক্তিযুদ্ধ সর্বপ্রথম আমাদের তরুণদের ব্যাপকহারে অস্ত্রের সাথে পরিচয় ঘটিয়েছে, বাড়ি ছেড়ে তারা রণাঙ্গনের অভিজ্ঞতা পেয়েছে, তখনই যুদ্ধ, হত্যা, রক্ত, মৃত্যুর সাথে পরিচয় ঘটেছে। মানবজীবনের এ কোন স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা নয়। স্বাধীনতার পরে অনেকেই অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেলেও অনেক মুক্তিযোদ্ধা তা পারে নি। তখনই রাজনীতিতে অস্ত্র ও অস্ত্রবাজদের ব্যবহার কিছু কিছু ঘটতে শুরু করে। আমাদের নেতৃবৃন্দ এই অস্থির উচ্চাভিলাষী তরুণদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর বা সংশোধনের পথ দেখায় নি।
তবে পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে পঁচাত্তরের পরে, যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে জেনারেল জিয়া সেনাতন্ত্র চালু করলেন। তাঁর ও এরশাদের আমলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার প্রক্রিয়ায় রাজনীতিতে কালোটাকা, অবৈধ অস্ত্র এবং অনিয়মের পথ খুলে যায়।
দুই আমলেই সর্বোচ্চ চাপ ছিল আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ব্যবস্থা সবই আক্রান্ত হয়েছিল এ সময় প্রায় দেড় দশক ধরে। পাশাপাশি নিজেদের রাজনৈতিক উত্থান নিশ্চিত করার জন্যে তারা জামায়াত ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছে, যুদ্ধাপরাধ থেকে দায়মুক্তি দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার করেছে। কিন্তু এটুকুতেই তাদের রাজনৈতিক অপকর্ম শেষ হয় নি। রাজনীতিতে কালোটাকা, সামরিক হস্তক্ষেপ, নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসনকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার, রাজনীতিতে ঘুষ-দুর্নীতি ও ক্ষমতার সর্বোচ্চ অপব্যবহার এবং আধিপত্য বিস্তারের জন্যে প্রয়োজনে সশস্ত্র ক্যাডার সৃষ্টিসহ গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথকে কলুষিত-কদর্মাক্ত করেছে।
এর সাথে পাল্লা দিয়ে অস্তিত্ব রক্ষা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগে জেলায় জেলায় জন্ম নিয়েছে বিতর্কিত ব্যক্তিরা। স্বৈরাচারের পতন হয়েছে, দেশে গণতন্ত্র এসেছে, কিন্তু সামরিক স্বৈরাচারের সৃষ্ট রাজনৈতিক ব্যাধির সংক্রমণ, ক্ষত, পুঁজ আমরা এখনও বহন করে চলেছি। তারই সর্বশেষ নমুনা যুবলীগের মিল্কি বা তারেকের মৃত্যু।
নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবি, হরকতুল জিহাদের মত দলগুলো বিএনপি-জাপার রাজনীতির ধারাবাহিকতাতেই উঠে এসেছিল। কেবল এরা নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ে বারবার বর্ণিত হয়েছে জামায়াতে ইসলামি একটি সন্ত্রাস-নির্ভর দল যারা কিনা বিএনপির প্রধান মিত্র।
১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত রাজাকার ও আলবদরের মত ঘাতক বাহিনী গঠন করে, শান্তি কমিটির মত দালাল সংগঠন গড়ে তুলে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, জবরদস্তি চালিয়ে এবং হিন্দুদের মুসলমান বানানোর মত জঘন্য সব যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হয়েছিল। ১৯৭১-এর পত্রপত্রিকার খবরে এবং জামায়াত নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতেই তাদের এসব অপরাধের সাক্ষ্য রয়েছে। তারা এদেশে রাজনীতি করতে চায় কিন্তু দেশ ও দেশবাসীর বিরুদ্ধে কৃত অপরাধের জন্যে ক্ষমা চাইতে রাজি নয়, ভুল স্বীকারে আগ্রহী নয়। তারা মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে বাংলাদেশকেই অস্বীকার করে, তারা সংবিধানের নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। এদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নস্যাৎ করে তালেবানি বিপ্লব ঘটাতে চায়। তাদেরকে দীর্ঘকাল পোষণ করার পরিণতিতে দেশে হেফাজতিদের মত ধর্মান্ধ শক্তির উত্থান ঘটেছে যারা কেবল নারীবিদ্বেষ নয় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ (পবিত্র কোরান পোড়ানোসহ) নারী নির্যাতনের মত সন্ত্রাসে জড়িয়ে যাচ্ছে। আর ক্ষমতার লোভে বিএনপি এইসব অপশক্তির সাথে আঁতাত করেছে।
দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে সন্ত্রাসমুক্ত করার পথে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধর করার দাবি অনেক দিনের। আপাতত নির্বাচন কমিশনে দলের নিবন্ধন বাতিল হল।  কিন্তু আজ জামায়াত নিষিদ্ধ হলেও রাজনীতি সন্ত্রাসমুক্ত হবে না। দুর্নীতি ও সন্ত্রাস হাত-ধরাধরি করে প্রশাসন ও সমাজের সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে। তা আশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে গণতান্ত্রিক রাজনীতি থেকেও। সেটা বন্ধ করতে হবে।
স্বৈারাচার বিরোধী আন্দোলনের অধ্যায় নব্বইতে শেষ হয়েছে। সেই দেড়দশকে যেসব সশস্ত্র ক্যাডারদের উত্থান হয়েছে তাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আত্মস্থ করার চেষ্টা সুফল দেয়নি। বরং গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সেটি একটি ধারা হয়ে বসেছে। বড় দলের ছাত্র-যুব সংগঠনে এ ধরনের নেতা-পাতিনেতার উদ্ভব অহরহ হয়ে চলেছে। তারাই মিল্কি, তারাই তারেক, তারাই তাদের ঊর্ধতন নেতা। দেখা যাচ্ছে ওয়ার্ড পর্যায়ের রাজনীতি এভাবে কলুষিত-বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। তার প্রভাব ক্রমেই উপরের স্তরেও ছড়িয়ে পড়ছে।
দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে জামায়াতের মত সন্ত্রাস-নির্ভর সংগঠন নিষিদ্ধ হতে পারে, কিন্তু সেই সাথে গণতান্ত্রিক দলগুলোর সন্ত্রাস-নির্ভরতা বন্ধ করতে না পারলে লাভ হবে না। এ দুটোই আজ সময়ের চাহিদা।

Saturday, July 27, 2013

ভাবতে হবে কওমি-শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত নিয়ে

আবুল মোমেন




আমরা সকলেই জানি মানুষের মধ্যে এমন কিছু রিপু আছে যা তাকে পশুতে (তুলনাটা ঠিক নয়, কেবল বাংলা বাগবিধিমাত্র) অর্থাৎ অমানুষে পরিণত করতে পারে। রিরংসা বা যৌনকামনা রিপুগুলির মধ্যে অন্যতম। লালসা, রিরংসা, ক্রোধ ইত্যাদি কোনো রিপুর দাসত্ব প্রকৃত মানুষের কাছে কাম্য নয়। প্রকৃত শিক্ষা ও সংস্কৃতি মানুষকে শেখায় এসবকে নিয়ন্ত্রণ করতে, জয় করতে। এটাই মনুষ্যত্ব।

ইসলাম ধর্মও এই শিক্ষাই দেয়। পবিত্র কোরানেও বলা হয়েছে শয়তান মানুষকে কুপথে চলার প্ররোচনা দেয়। এ থেকে আত্মরক্ষা করে চলার জন্যে বরাবর সাবধান করা হয়েছে। ব্যাভিচার ও লাম্পট্য সম্পর্কে কোরান কেবল সাবধান নয়, কঠোর শাস্তির বিধানও দিয়েছে। মানুষের সমাজ ও সভ্যতার গড়ে ওঠা, উন্নত হওয়া ও টিকে থাকার কারণ রিপুর দাসত্ব নয় বস্তুত রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করে ইতিবাচক গুণাবলীর চর্চা।
আমার এই জানাবোঝার আলোকে দেশের কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান নবতিপর বৃদ্ধ আহমদ শফি সাহেবের বক্তব্য শুনে রীতিমত তাজ্জব হয়ে গেছি। তিনি পুরুষদের কেবল রিরংসা তথা যৌনকামনার দাস হওয়াই স্বাভাবিক বলেন নি, তা না হলে তার পৌরুষ সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাহলে তাঁর বিচারে পুরুষের ধর্ম রিরংসা-বৃত্তির দাসত্ব করা? লাম্পট্যই পুরুষের যোগ্যতার মাপকাঠি? ওটা কি শয়তানের দেখানো পথ নয়?
ইসলাম সম্পর্কে যাদেরই সামান্য ধারণা আছে তারাই জানেন, তাঁর এ বক্তব্য ইসলামের শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত, ভুল ও বিকৃত ব্যাখ্যা। আমরা ব্যথিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে লক্ষ্য করি, শফি সাহেবের বক্তব্য নিয়ে যখন প্রতিবাদ ও বিতর্ক সৃষ্টি হয় তখন প্রথমে তাঁর অনুসারীরা ও পরে তিনি নিজে একই বক্তব্যের পক্ষে আবার সাফাই গেয়েছেন। অর্থাৎ পৌরুষ সম্পর্কে এটাই তাঁদের অবস্থান।
পরে ভেবে দেখেছি, এরকম বক্তব্য এক শ্রেণির মওলানা দীর্ঘকাল ধরে দিয়ে আসছেন। গত পঞ্চাশ বছরে অনিয়ন্ত্রিত মাইকের দৌরাত্ম্যে যত ওয়াজ-নসিহত শুনেছি তাতে সাধারণত বক্তা মওলানারা যে তিনটি বিষয়ের সমালোচনা করেন তার মুখ্য হল নারী। তাঁদের বক্তব্য শফি সাহেবের বক্তব্যের মতই অশ্লীল ও আদিরসাত্মক হয়ে থাকে। অন্য দুটি সমালোচনার বিষয় হল বিধর্মী (বিশেষত পৌত্তলিক বলে হিন্দুধর্ম) এবং আধুনিক জীবন (যার মাধ্যমে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিও সমালোচিত হয়)।
ইতিহাসে আমরা দেখি ইসলামের নবী বরাবর সমকালীন ও পারিপার্শ্বিক বাস্তবতাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। এটা ছিল সে আমলে ইসলামের এক অন্তর্নিহিত শক্তি যার বলে নবী ও তাঁর পরবর্তী কালে ইসলামের চমকপ্রদ বিজয় ও বিস্তার ঘটেছিল। হযরত ওমর (রা.) এর সময় থেকে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত মুসলিম সভ্যতার অগ্রগতি হয়েছে। আর তার স্বর্ণযুগে, সাধারণভাবে বলতে পারি, নবম-দ্বাদশ শতাব্দীর মুসলিম জ্ঞানী-বিজ্ঞানীদের অসামান্য সব অবদান বিশ্বসারস্বতসমাজ শ্রদ্ধার সাথে চর্চা করে থাকে আজও। তখন কায়রো, বাগদাদ, কর্ডোভায় মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় যেসব উচ্চতর বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল তা সারা বিশ্বে যুগান্তরের বার্তা নিয়ে এসেছিল। এরই প্রভাব পড়েছিল ইউরোপীয় রেনেসাঁসে যার প্রভাবে সারা বিশ্বে ধীরে ধীরে রাষ্ট্র, সমাজ, জীবন, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে নতুন ধারার সূত্রপাত হয়েছে।
আবারও বলি, এই ধারার বীজতলা তৈরিতে মুসলিম সভ্যতার অবদান অত্যন্ত মৌলিক ও বিপুল।
আমরা জানি হালাকু খানের হাতে বাগদাদের পতন আর শেষ ক্রুসেডে স্পেনের মুসলিম শাসকের পরাজয় ঘটলে মুসলমানদের এই জ্ঞানবিজ্ঞান সাধনায় ভাঁটা শুরু হয়। আর অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার বৈশ্বিক নেতৃত্ব, বিশ্বমান এবং এর ধারা ধরে রাখা সম্ভব হয় নি।  বরং ধীরে ধীরে মুসলিম মনীষা অস্তমিত হয়েছে।
তবে ভারতবর্ষে মুঘল শাসনের মাধ্যমে ইসলামি সভ্যতার উদার মানবিক রূপটার চর্চা অব্যাহত ছিল। ইসলামি সভ্যতার বিজ্ঞান চর্চার ধারাটি ইউরোপ পুরোপুরি গ্রহণ করেছে। আর ইরানি-তুরানি প্রভাবে উপমহাদেশে বেশি চর্চিত হয়েছে কাব্য, শিল্প, স্থাপত্য, উদ্যানের মত সুকুমার শিল্প এবং সেই সাথে উদার মানবিক সুফি দর্শন।
কিন্তু ইংরেজ আগমনের পর এ ধারাও বন্ধ হয়ে যায়। ঔপনিবেশিক শোষণের কবলে পড়েছিল মধ্যপ্রাচ্যও। এরপর থেকে মুসলিম সমাজের নেতৃত্ব চলে যায় এমন সব আলেমদের হাতে যাঁরা মৌলিক ও সৃজনশীল চিন্তা, দর্শন ও তত্ত্বের নবতর ব্যাখ্যা এবং সময়ের সাথে পরিবর্তিত বাস্তবতাকে বুঝতে পারেন নি, বা চান নি। তাঁরা ইসলামকে প্রথমত, পুঁথিগত মুখস্থবিদ্যার মধ্যে আবদ্ধ করেছেন এবং দ্বিতীয়ত, তাঁদের চেনাজানা গণ্ডির বাইরের ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠা ভিন্নধর্ম, ভিন্ন সংস্কৃতির সাথে বিনিময়ের সাহস হারিয়ে চরম রক্ষণশীলতার পথ ধরেছেন। তাঁদের হাতে পড়ে দিনে দিনে ইসলাম এক স্থবির প্রাচীন রক্ষণশীল ও কট্টর ধর্ম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। রাজনৈতিক ও বৈষয়িক ক্ষেত্রে যতই কোণঠাসা হয়েছে ততই এরা ইসলামকে আরও কট্টর স্থবির এবং পরিশেষে জঙ্গিরূপ দেওয়ার চেষ্টা শুরু করে। ওয়াজ-নসিহতে কান পাতলে এক শ্রেণির মওলানার ক্রুদ্ধ কণ্ঠে শুনবেন জেহাদের আস্ফালন, প্রতিপক্ষকে বিনাশের জন্যে যুদ্ধের ডাক। পারিপার্শ্বিক ও বর্তমান বাস্তবতা সম্পর্কে কোন রকম ধারণা ছাড়া এসব কথা সমাজে অযথা উত্তেজনা ছড়ায়। আর এভাবে ইসলামের সহনশীল, উদার, মানবিক শিক্ষা উপেক্ষিত হয়ে এদের হাতে এক ঝগড়াটে, জঙ্গি, নারী বিদ্বেষী ইসলামের আত্মপ্রকাশ ঘটছে। এটা প্রকৃত ইসলাম নয়।
কীভাবে মওলানারা বলেন ইসলাম বিপন্ন? ইসলাম যদি আল্লাহর ধর্ম হয়ে থাকে তবে তা রক্ষার মালিক তিনিই। বস্তুত এরকম ভাবনা মনে শুধু তখনই আসবে যখন কারও ইমান হবে দুর্বল।
ইসলাম কখনও বিপন্ন নয়, হতে পারে না। তবে মুসলিম সমাজ বিপন্ন। আর তার কারণ আহমদ শফির মত মওলানারা। যাঁরা মানুষের রিরংসার মত রিপুর ভজনা করেন। এ তো তাঁর অনুসারীদের শয়তানের হাতে সোপর্দ করার শামিল। এ জন্যে তাঁকে ধিক্কার না জানিয়ে উপায় নেই। সকল মানুষ, মুসলমান তো বটেই, শয়তানের কুমন্ত্রণা যেন পরিহার করে সত্যিকারের মনুষ্যত্বের পথে এগুতে পারে সেটাই কাম্য হওয়া এবং সেই পথেই সবার চলা উচিত।
আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে আমি যে পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভিতর দিয়ে এসেছি তা আমাকে শিখিয়েছে নারীকে বন্ধু, সহকর্মী, সহমানবের মর্যাদায় গ্রহণ করতে।
কওমি মাদ্রাসার বিপুলসংখ্যক শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত ও দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের জন্যে দেশের সুধীজনের এখনই সোচ্চার হওয়া উচিত।








Monday, July 8, 2013

প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে সঠিক ক্রিয়ার পথ খোলা

আবুল মোমেন

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল আগের চারটির ধারাতেই হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লাহ খান আগে কখনও নির্বাচনে পরাজিত হন নি, আর গাজীপুরও আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল।
একই দিনে অনুষ্ঠিত দেশের অন্যান্য জায়গায় তিনটি মেয়র নির্বাচনের একটিতে বিএনপি প্রার্থী ও অন্য দুটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। এই ধারাটি শুরু হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচন থেকে।
তবুও সবটা মেলালে বলা যাবে না যে দেশে বিএনপির পক্ষে হাওয়া উঠেছে। কিন্তু এটা নিশ্চিত, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমেছে ভোটারদের মনে। তারই প্রতিফলন ঘটছে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে, আর তাতে আওয়ামী লীগ হারছে, বিএনপি জয়ী হচ্ছে।
যদি তুলনামূলক আলোচনা করা যায় তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যাবে বর্তমান সরকার তার পূর্ববর্তী সরকারের চেয়ে অনেক বেশি ও ভালো কাজ করেছে। এমনকি বিএনপি মনোভাবাপন্ন অনেক ভোটারও ব্যক্তিগত আলাপে বলেছেন চার সিটি মেয়রের মধ্যে অন্তত দু’জন স্ব স্ব শহরের উন্নয়নে কাজ করেছেন বলে তাঁরাও ভিন্ন মতের এসব প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু তারপরেও তাঁদের পরাজয় ঠেকানো যায় নি।
দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগের ইতিবাচক অর্জনকে নেতিবাচক ‘অর্জন’ চাপা দিয়ে দিয়েছে। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে সরকার প্রধান ও তাঁর দলের আক্রোশমূলক ভূমিকা জনগণ পছন্দ করে নি। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হল সুযোগ থাকলে যে কোন গৌরবের ভাগীদার হওয়া। সরকার এ জনমনস্তত্ত্বের বিপরীতে চলেছে। পদ্মা সেতু হোক এটাই জনগণ কামনা করেছিল, তাই এটি দীর্ঘায়িত ও অনিশ্চিত হওয়ায় মানুষ সরকারের ওপর বিরক্ত হয়েছে। হলমার্ক কেলেংকারিসহ ডেস্টিনি, ইউনিপে বা স্টক মার্কেটের বিপর্যয়ে সরকার বুদ্ধিমত্তার সাথে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান দিতে পারে নি। ইসলাম ও আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলেম ও অ্যাকাডেমিক পরিমণ্ডলে অনেক বিতর্ক হয়, কিন্তু এসব বিষয় আম জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ এরকম একটি নাজুক বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ থেকে জনগণকে খেপিয়ে তোলার রসদ পেয়ে গেছে ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতিকরা। সব মিলে মানুষের প্রতিক্রিয়াকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চালিত করার মত রসদ ও জ্বালানি ধীরে ধীরে সঞ্চিত হয়েছে সাধারণের মধ্যে।
ফলে বলা যায়, সাম্প্রতিক স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে এই প্রতিক্রিয়ার বহি:প্রকাশ আমরা দেখছি। ঘুরে দাঁড়াতে হলে আওয়ামী লীগকে নির্ভর করতে হবে মানুষের শুভবুদ্ধিজাত ক্রিয়ার ওপর। প্রতিক্রিয়ার প্রতিবিধানে সঠিক ক্রিয়াই ঔষধ।

- কী হতে পারে সঠিক ক্রিয়া?
প্রথম কাজ শত্র“ কমানো, এবং দ্বিতীয় কাজ বন্ধু বাড়ানো। যাদেরকে দূরে ঠেলা হয়েছে, পর বানানো হয়েছে তাদের সাথে সংযোগ ও আস্থার সম্পর্ক তৈরির কাজ শুরু করতে হবে। যারা বন্ধু ছিল তাদেরকেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দূরে ঠেলেছে। এরশাদ বা জোটের অন্যান্য শরিকদের যথার্থ মর্যাদা ও গুরুত্ব দেওয়া হয় নি, দলের মধ্যে যাদের কণ্ঠস্বরে স্বাধীন সত্তার পরিচয় মেলে তারা উপেক্ষিত হয়েছেন, এমনকি যেসব বুদ্ধিজীবী-সংস্কৃতিকর্মীর ভূমিকা বরাবর আওয়ামী লীগের অনুকূলে তাঁদের সামান্য সমালোচনা সইতে না পেরে ঢালাওভাবে তাঁদেরও দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
তার ওপর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডহীন আওয়ামী লীগের নামে দৃশ্যমান কাজ হচ্ছে ছাত্র-যুবলীগের টেণ্ডারবাজী-দখলদারির প্রতেযোগিতা - যা জনসমাজকে শংকিত, বিচলিত করে চলেছে। সব মিলে সুশাসন ব্যাহত হয়েছে।
জনগণের আবেগ ও মনস্তত্ত্বকে বুঝতে পারাই হল রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রথম কাজ। পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে তারা ক্ষমতাসীন সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট। সে অসন্তুষ্টির প্রকাশ ঘটাচ্ছে ভোটের মাধ্যমে। এই নেতিবাচক কাজটি বিএনপির জন্যে ইতিবাচক হয়ে আসছে। জনগণ ব্যাপক হারে বিএনপিপন্থী হয়ে গেছে তা নয়, মূলত এটা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রত্যাখ্যানের ভোট। বিএনপির জন্যে এটাকে কাজে লাগানো সহজ, তবে তা টেকসই ও সুদূরপ্রসারী কোনো ফল দেবে না। টেকসই ও সুদূরপ্রসারী যে ভালো ফল মিলছে তাহল সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশনের সামর্থ্য। আমরা বোধহয় ভোট জালিয়াতির পর্ব পেরিয়ে এসেছি।
মুশকিল হল রাজনীতিতে প্রতিক্রিয়ার তীব্র বহি:প্রকাশ ঘটার কারণে আমাদের দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সহজে আসবে না। যে দল জনগণকে ইতিবাচকভাবে সক্রিয় করে রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশীদার করতে পারবে তারাই শেষ পর্যন্ত দেশ ও গণতন্ত্রের উপকার করতে পারবে। তাই রাজনীতিতে জনগণের ভাবাবেগকে পুঁজি করার দিনকে পিছনে ফেলে তাদের ভাবনাচিন্তা ও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের পথ তৈরি করতে হবে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে যত রকম পাব্লিক ফোরাম আছে সেগুলো সক্রিয় থাকা, তাদের ভালোকথা ও কাজকে গ্রহণ করার ব্যবস্থা থাকলে সে রাজনীতি অবশ্যই এগিয়ে যাবে। ক্ষমতান্ধ রাজনীতি তো আবদ্ধতা তৈরি করে যা জনবিচ্ছিন্নতা ঘটায়। এর পরিণতি কারও জন্যেই শুভ হতে পারে না।