Sunday, November 10, 2013

দুই নেত্রীর ফোনালাপ কি অচলাবস্থাই বাড়াল?

আবুল মোমেন

কথা ছিল প্রধানমন্ত্রী ফোনে বিরোধী নেত্রীকে সংলাপের আমন্ত্রণ জানাবেন। এর আগে ঢাকায় ১৮ দলীয় জোটের জনসভায় খালেদা জিয়া ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সংলাপের জন্যে যোগাযোগের সময় বেধে দিয়ে ২৭-২৮-২৯ অক্টোবর ৬০ ঘণ্টার হরতালের ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন। স্বভাবতই মানুষ প্রধানমন্ত্রীর ফোন এবং তার ফলাফল নিয়ে উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তা থেকে বেরুবার আশায় বসেছিল।
শেখ হাসিনা সময় পেরুনোর আগেই ২৬ তারিখ সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ ফোন করেছিলেন। দুই নেত্রীর ফোনালাপ চলেছে ৩৭ মিনিট ধরে!
বুঝতে অসুবিধা নেই, এ আলাপ আমন্ত্রণ এবং তা গ্রহণ বা প্রত্যখ্যানের মধ্যে শেষ হতে পারে নি। দেশের দুই শীর্ষ নেত্রীর ফোনালাপ সেদিন রাতেই নেটে ছড়িয়ে পড়ে। পরের দিন কিছু কিছু বৈদ্যুতিন টিভি চ্যানেল সম্পূর্ণটা প্রচার করে। আর ২৮ তারিখ প্রায় সব পত্রিকাতেই আলাপের পুরোটাই ছাপিয়ে দেওয়া হয়।
শুনে-পড়ে বলতে হয়, আলাপ তো নয় বাদানুবাদ হয়েছে। তাতে বিএনপির কিছু সিনিয়র নেতা প্রথমে বিব্রত বোধ করেছিলেন মনে হয়, কারণ দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব কাজটাকে শিষ্টাচার বহির্ভূত আখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের আপত্তিটা বুঝতে অসুবিধা হয় না, কারণ বিবাদে জড়িয়ে তাঁর নেত্রী প্রতিপক্ষকে অভিযোগের বাণে লাগাতার চাপে রাখতে গিয়ে শিষ্টাচার লঙ্ঘনে অনেক এগিয়ে ছিলেন। শব্দালঙ্কার নিয়ে যারা কাজ করেন তারা এ বাদানুবাদের মধ্যে ব্যঙ্গ, বিদ্রƒপ, শ্লেষ, পরিহাস, টিপ্পনি ইত্যাদির ভিয়েন খুঁজে পাবেন, তবে সব ছাপিয়ে বোঝা যাচ্ছিল খালেদার উষ্মা, মেজাজ তাঁর একেবারে তেতে ছিল। হাসিনা এই তপ্ত বর্ষণের ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু বলার সুযোগ পেয়েছেন তা প্রতিপক্ষকে শান্ত বা আশ্বস্ত করার কাজ করে নি - আগুনে জ্বালানিই পড়েছে।
বিবাদে জড়িয়ে গেলে সময় কোন দিকে বয়ে যায় তা খেয়াল থাকে না। ফোনে তো দু’মাথায় দু’জন মানুষই কথা বলছেন, তা-ও দুই দলের এমন দুই শীর্ষ নেতা যাঁদের ওপর কিছু বলার রেওয়াজ বা অধিকার কোনো দলে কারুরই নেই। ফলে মধ্যস্ততার কোনো সুযোগই ছিল না। শেষে ক্লান্ত প্রধানমন্ত্রী জরুরি সভার কথা টেনে বহু প্রতিক্ষিত সংলাপের ইতি টানেন। ফোন-রঙ্গ শেষে বা ফোন-রণাঙ্গণ থেকে ফিরে বিরোধী নেত্রী প্রতীক্ষারত সহকর্মীদের কাছে মেয়েলি উদযাপন করে হয়ত বলতে পারেন - কষে উচিত কথা শুনিয়ে দিয়েছি! হতে পারে, কারণ দু’দিন পরে সেই সিনিয়র নেতারা বলছেন বাগযুদ্ধে তাদের নেত্রীর কাছে প্রধানমন্ত্রী পাত্তা পান নি।
কিন্তু জনগণের কি এ আলাপকে যথোচিত মনে হয়েছে? বড় অংশ হতাশ হয়েছে, কেবল সংলাপের দ্বার খুলল না বলেই নয়, এর বিষয় ও ধরণটাও হতাশার কারণ। একজন বিশ্লেষকের এ বিষয়ে লেখার শিরোনাম তাই ‘এ সংলাপ না হলেই ভালো ছিল’ ; এক টিভি চ্যানেলের টক-শোর নাম রাখা হল ‘সম্ভাবনা না সম্ভব না?’
কিন্তু জীবন তো থেমে থাকতে পারে না, অচলাবস্থাও আসলে থেমে থাকে না। প্রতিদিনই অচলাবস্থার ধরনের কিছু না কিছু পরিবর্তন ঘটে চলেছে।
যেদেশে গণমাধ্যম-বাতিক সংক্রামকভাবে বর্ধিষ্ণু আর টিভি চ্যানেলে বিস্ময়করভাবে গান-নাটকের চেয়ে খবর ও টক-শো বেশি জনপ্রিয় সেখানে এ ধরনের ঘটনা তো মহার্ঘ সওদা। টক-শো, কলাম এবং খবরে মতামত দিতে দিতে দেশের বিশিষ্টজনরা ব্যস্ত দিন এবং রাত কাটাচ্ছেন। রাতও কাটাতে হয় কারণ সবচেয়ে জনপ্রিয় টক-শোগুলো নাকি অধিক রাতেই জমে। বিশুদ্ধ নিরপেক্ষতা এক্ষেত্রে একেবারে নিরামিষ ব্যাপার, তর্ক জমে আলোচকরা পক্ষ নিয়ে ভাগ হয়ে গেলে।
বার বার মুখ পুড়লেও আশায় বুক বাঁধতে বাংলাদেশের মানুষের জুড়ি নেই। মনে হয় বিএনপি এখন দু’ভাবে সংলাপের দরজা খোলার কথা ভাবছে - একদিকে রাজপথের  আন্দোলনকে আরও জোরদার করবে তারা আর অন্যদিকে বিদেশি কূটনীতিকদের দূতিয়ালিতে লাগাবে। আওয়ামী লীগের চিন্তা আপাতত একটিই - গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখা।
ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনের মাধ্যমে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসার ঘটনা বাংলাদেশে আগে ঘটে নি। প্রথমবার ক্ষমতার মেয়াদ পূরণ করে আত্মবিশ্বাসী হাসিনা সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনে নেমেছিলেন। এই একবার ছাড়া গণতান্ত্রিক আমলেও কখনওই শান্তিপূর্ণভাবে এক সরকার থেকে পরবর্তী সরকারে ক্ষমতা হস্তান্তর হয় নি। বিস্তর জলঘোলা করে ধ্বংসাত্মক রাজনীতির পথ বেয়েই নির্বাচন হয়েছে। ২০০১ এর অভিজ্ঞতা এবং গত ৬ মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বেশ বড় ব্যবধানে হারার কারণে এবারে হাসিনা স্বভাবতই খুব সতর্ক হয়ে পা ফেলছেন।
আমাদের অনেকেরই ধারণা ছিল সাম্প্রতিক এই বিজয়গুলোকে আগামী নির্বাচনেও বিজয়ের ইঙ্গিত হিসেবে ধরে নিয়ে বিএনপি মোটামুটি একটা মুখ বাঁচানো সংলাপ সেরে দ্রুত নির্বাচনেই যেতে চাইবে। এখন মনে হচ্ছে বেগম জিয়ার আরও কিছু হিসেব আছে। হতে পারে পুত্রদের মামলামুক্ত হয়ে দেশে ফেরার ব্যবস্থা, হতে পারে জোটের গুরুত্বপূর্ণ শরিক জামায়াতের অনুকূলে কিছু ছাড় আদায় বা হতে পারে নির্বাচনে যাওয়ার আগে তিনি রাজপথের আন্দোলন থেকে সুস্পষ্ট বিজয় পেতে চান। সম্ভবত তারই প্রভাব পড়েছে তাঁর ফোনালাপে - তিনি কথার লড়াইয়ে জিততে চেয়েছেন।
এসবের মধ্যেও আসল কথা হল, বাংলাদেশ এবার সত্যিই কঠিন রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যেই পড়েছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছেন ইতিহাসের বেশ কিছু বকেয়া দায় মেটানোর প্রতিশ্র“তি দিয়ে। তার প্রধান হল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের আলোকে স্কুলের পাঠ্যবই পরিমার্জন, গণমাধ্যমসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমন ইত্যাদিও এ দায়ের অংশ। সেই সাথে একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নও দেখিয়েছিলেন তিনি। তাতে অন্তত দুই দশক পরে নবপ্রজন্মের তরুণদের ভোট টানতে পেরেছিল আওয়ামী লীগ। লীগের বড় জয়ের পিছনে এটাই ছিল মুখ্য। শেষের বিষয়টি ছাড়া বাকি সব বিষয়ে জামায়াত ও ধর্মান্ধ দলগুলো সরাসরি বিপক্ষে, বিএনপি তাদের অভিভাবক হিসেবে কথার মারপ্যাঁচ চালিয়ে শেষ পর্যন্ত একই অবস্থান ধরে রাখছে।
এখানে বাংলাদেশের রাজনীতির একটা বিষয় বুঝে নেওয়া দরকার। একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, যে-দুটি মূলধারায় রাজনীতি চলছে দেশে তার বিপরীতমুখিতার ভিত্তি হল আওয়ামী লীগ ও এন্টি আওয়ামী লীগ রাজনীতি। পঁচাত্তরের পর থেকেই এটিই বাস্তবতা। এর মধ্যে ১৯৯০ পর্যন্ত সামরিক ও ছদ্ম সামরিক-গণতন্ত্রের মধ্যে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফেরার সুযোগ ছিল না। ১৯৯৬-এ প্রথমবার ক্ষমতায় এসে হাসিনা বিরোধীদে সাথে মোটামুটি আপস-সমঝেতা করেই চলেছেন। কিন্তু এবারে ক্ষমতায় এসে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, পাঠ্যবই পরিমার্জনসহ ইতিহাসের বকেয়া দায় মেটানো ও ইতিহাস-শুদ্ধিকরণের কাজে হাত দিয়েছেন। পাশাপাশি জঙ্গি দমনেও আন্তরিক ছিলেন। এর ফলে দেশে প্রায় একাত্তরের অবস্থা তৈরি হয়েছে। কারণ দুটি ক্ষেত্রেই জামায়াত-বিএনপি অভিযুক্ত হয়েছে। ফলে যা ১৯৯০ থেকে এযাবৎ কেবল দুটি ক্ষমতালিপ্সু দলের মধ্যেকার সেয়ানে সেয়ানে মোকাবিলার বাইরে যায় নি তা আকস্মিকভাবে দু’পক্ষের ইতিহাস ও আদর্শের ভিন্নতা খুলে ধরেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এলে এবং বিএনপি জামায়াত ও ধর্মান্ধদের না ছাড়লে তাদের অবস্থা খুব সঙ্গীন হবে।
তাই এক দলকে এই ধারা ধরে রাখতে এবং অন্য দলকে এর থেকে বেরুতে হলে ক্ষমতায় যেতে হবে। এ কারণেই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে কোনো পক্ষই এতটুকু ছাড় দিতে চাইছে না। বরং বলা যায় স্ব স্ব  অবস্থানে থেকে দুই দলই পরাজয়ে অপারগ এবং তাই ছাড় দিতে অক্ষম।
বিএনপির জন্যে সমীকরণ আরও জটিল কারণ ক্ষমতায় বসে ক্ষমতার জন্য তৈরি দলকে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে সচল রাখা মুশকিল। অতীতে মুসলিম লীগের পরিণতি আমরা দেখেছি। অবশ্য তা বলে বিএনপি দুর্বল হয়ে গেলেও এন্টি আওয়ামী লীগ রাজনীতির অবসান হবে না। জামায়াত রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকলেও তারা এবং নানান ধারার ধর্মীয় গোষ্ঠী সমাজে উত্তরোত্তর শক্তিশালী হয়েছে। তারা সমাজে সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাজনীতির জোরালো প্রতিপক্ষ দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। মুসলিম সমাজে আলোকন-নবায়নের কাজ খুব ফলপ্রসূভাবে না হওয়া পর্যন্ত অবস্থার উন্নতি হবে বলে মনে হয় না।
মুশকিল হল নানা কারণে আমজনগণ ও ছাত্রতরুণরা প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আর আগ্রহী নয়। জ্বলন্ত চুলা আর তপ্ত কড়াইয়ের এই ফাঁড়া থেকে তারা বেরুতে চায়। দুই পক্ষের কারও ওপর তাদের আস্থা নেই, কেউই তাদের দলে টানতে পারছে না। তাতে অবশ্য মন্দের ভালো হিসেবে হয়ত গৃহযুদ্ধের আশংকা দূর হয়। কিন্তু আপাতত রাজনৈতিক অঙ্গনের ঈশানে থমথমে মেঘের আনাগোনা বাড়তে থাকবে বলেই মনে হয়।


1 comment:

  1. বিকল্প ব্যতীত কোনোই বিকল্প নেই!

    ReplyDelete