Sunday, January 12, 2014

পাঁচ অংকের নাটক

আবুল মোমেন

এই নির্বাচন অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু প্রশ্ন হল এই দায় জাতির ঘাড়ে চাপল কীভাবে? এ কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, আমাদের চোখের সামনেই ধাপে ধাপে এই নাটকীয় প্রশ্নবিদ্ধ দায়টি তৈরি হয়েছে। প্রেক্ষাপটটা বিচার করলে কারণ, দায়ি এবং সমাধান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া  যেতে পারে। মনে হচ্ছে ঠিক পাঁচ অংকের নাটকের মতই আমরা এটা সাজাতে পারব। প্রতি অ্যাক্ট বা অংকে অনেক দৃশ্য আছে, কিন্তু কলামের স্বল্প পরিসরে অত খুঁটিনাটিতে আমরা যাব না।
১.
নাটকের গোড়া পত্তন হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে। এ ব্যবস্থা নিয়ে দ্বিমত থাকাই স্বাভাবিক, আমি নিজেও গোড়া থেকে এর বিরোধী ছিলাম কারণ এটি রাজনীতিবিদদের সততাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। এবং এটি পরে রাজনীতিবিদদের আরও চতুর অসততার পথে নিয়েছে ও নতুনতর সংকট সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু এ নিয়ে প্রধান বিরোধী দল ও প্রাসঙ্গিক অন্যান্যদের সাথে আলোচনা করে তাদের মতামত বিবেচনায় নিয়ে তারপর সিদ্ধান্তে আসাই সঙ্গত ছিল। বলা যায় প্রধানমন্ত্রী একাই এ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছেন।
না নাটকটি এত সরল নয় যে প্রথম অংকেই কারণ, দায়ি ও সমাধান খুঁজে পাব। আর একটু এগুতে হবে। বিএনপি অবশ্য পরাজয়ের পর জনতার দরবারে বৃহৎ দল হলেও সংসদে ক্ষুদ্র শক্তির বিরোধী দল হিসেবে নিজেদের ভূমিকা নির্ধারণে ব্যর্থ হয়েছে। বর্জন যে মূলমঞ্চেও অনুপস্থিতিজনিত শূন্যতা সৃষ্টি করে তা দলের নেতৃত্ব ভেবে দেখেনি। বিএনপি নেত্রী এবং সিনিয়র নেতৃবৃন্দ মাঠপর্যায়ের আন্দোলন পরিচালনায় দক্ষ না হওয়ায় তাঁরা সরকারি বাধার মুখে ঠিক মত প্রতিরোধ আন্দোলন গড়তে পারেন নি। ফলে তাদের একটা এলেবেলে অবস্থায় নির্বাচনের সময় এসে পড়েছে। ততক্ষণে নাটকের দ্বিতীয় অংকের পর্দা উঠে গেছে, আমরা তাতে প্রবেশ করব।
২.
দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার দেশের নাগরিকসমাজের বহুদিনের দাবি পূরণ করে মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে। বিচার শুরু হওয়ার পর স্বভাবতই বিএনপির জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামের সব বড় নেতা এবং দলটি যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হল। বিএনপির দু’জন নেতাও অভিযুক্ত হলেন। জামায়াত বরাবর তাদের পূর্ব অবস্থানেই থেকেছে। এখনও সে অবস্থানে থেকেই মামলা নিয়ে দেশেবিদেশে সরকারবিরোধী রাজনীতি করে চলেছে। বিএনপি ট্রাইব্যুনাল ও এর কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিষয়টা প্রশ্নবিদ্ধ করতে গিয়ে সহোদর জামায়াতের সমব্যথীর ভূমিকা নিয়ে নিজের অবস্থানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ট্রাইব্যুনালের কিছু কিছু মামলার রায় ঘোষণার পর থেকে জামায়াত পুরোপুরি ধ্বংসাত্মক ভূমিকায় ফিরে যায়। নির্বাচনী সহিংসতা পর্যন্ত তাদের ভূমিকার সাথে একাত্তরের ভূমিকার সামঞ্জস্য পাওয়া যায়। একই কায়দায় হিন্দু সম্প্রদায় ও তাদের বসতভিটা এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক ও তাদের বাড়িঘর জামায়াত-শিবির কর্মীদের টার্গেট হয়ে পড়ে। একইভাবে খুন, ধর্ষণ, জখম, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ইত্যাদি চালিয়ে যাচ্ছে। এবারে এর সাথে যুক্ত হয়েছে নির্বিচারে বৃক্ষ কর্তন। বিএনপি বরাবর জামায়াতকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে, এমনকি সর্বশেষ নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বেগম জিয়া সমর্থনের সাফাই গাইলেন। এই অবস্থা ইতিহাসের মুখ খুলে দেয়।
ফলে নাটকের তৃতীয় অংকের পর্দা উঠেছে আমাদেরকে নিকট ও অনতিনিকট ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে।
৩.
পচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করে জেনারেল জিয়া আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতি দাঁড় করাতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জাতির আকাক্সক্ষা মূল্যায়ন না করে প্রায় প্রত্যাখ্যাত পরাজিত পাকিস্তানি ধারার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু করলেন। তাঁর দলে যেমন পথহারা চিনপন্থী বামরা যোগ দিয়েছিলেন তেমনি দলে এসেছেন মুসলিম লীগ ও সেই মানসিকতার লোকজন। দলের অবস্থান শক্ত করার জন্যে তিনি জামায়াতে ইসলামি ও ধর্মান্ধ দলগুলোকে পুনর্বাসিত করলেন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত দুই দশক ধরে এই রাজনীতি চলেছে। একাত্তরের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচার যেমন তেমনি পচাত্তরের আত্মস্বীকৃত হত্যাকারীদের বিচারের পথ রুদ্ধ ছিল এই দীর্ঘ দুই দশক। কিন্তু দেশের বিবেকবান মানুষদের বিবেচনায় এসব ঘটনা জাতির জীবনে কলঙ্ক এবং এগুলোর বিচার হওয়া আবশ্যিক। এ নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে নাগরিকসমাজ আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে আসছেন। এসব অপরাধের বিচার জাতির জন্যে ঐতিহাসিক, নৈতিক, আইনগত দায় হিসেবে বিবেকের বোঝা হয়েছিল। কুড়ি বছর পরে ক্ষমতায় ফিরে আওয়ামী লীগ সরকার সে দায় পূরণের বাধাগুলো সরিয়ে পচাত্তরের খুনের বিচার শুরু করেন। কিন্তু পরের নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে বিএনপি অসমাপ্ত বিচার কাজ বন্ধ করে এবং একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও শেখ হাসিনাকে হত্যার ঘৃণ্য অপচেষ্টার প্রকৃত আসামীদের আড়াল করার দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের ভূমিকাকে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। এখনও দলটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে দায়িত্ব-এড়ানো কৌশলি উত্তর দিয়ে গা-বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে প্রথম থেকে যুদ্ধাপরাধী, দালালদের নিয়ে দল গড়া, পাকিস্তানপ্রীতি, ভারতবিরোধিতা, সরকারি কাজে সাম্প্রদায়িক বিবেচনায় চলা, মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে ঔদাসীন্য, বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি বিরূপতা, একাত্তর ও পচাত্তরের অপরাধীদের দায়মুক্ত করার কৌশল, জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধ রাজনীতির ধারাবাহিকতায় সমাজের শিল্পী-সাহিত্যিক ছাত্র-তরুণসহ সচেতন অংশের চোখে বিএনপি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। এই পটভূমিতে নাটকের চতুর্থ অঙ্কের পর্দা উঠলে আমরা বর্তমান আন্দোলনের সম্মুখীন হব।
৪.
চতুর্থ অংকে দেখা যাচ্ছে মঞ্চে শুধু তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুই একমাত্র বিষয় নয়, বরং সরকারবিরোধী আন্দোলন যে ধ্বংসাত্মক রূপ নিয়ে মঞ্চ কাঁপাচ্ছে তার মূল কার্যকারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জরুরি বিবেচ্য ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা ১৯৭১ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৮ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের এবং প্রতীক্ষার ফসল হিসেবে জাতির দায় মেটানোর এই উদ্যোগ সচেতন সকলকে স্বস্তি এনে দিয়েছে। দেখা গেল দেশের তরুণ সমাজ এ বিষয়ে অত্যন্ত উৎসাহী এবং কোনোরূপ ছাড় দেওয়ার বিপক্ষে। জনগণ, বিশেষত তরুণ সমাজের এই ইচ্ছার গুরুত্ব অসীম। বিএনপি ঘটনাবলীর এই গতিপ্রকৃতি উপলব্ধি করেছে বলে মনে হয় না। তারা নাটকে নতুন চরিত্রের জোরালো আবির্ভাব (তরুণ সমাজ) এবং এর গতিপ্রকৃতির মোড় ঘোরানোর বিষয়টি বিবেচনায় নেয় নি। বরং পুরোনো অভ্যাসগত জেদ, বিরোধিতা ও বর্জনের লাইনেই থেকে দলের ভূমিকাকে জামায়াতের সাথে একাকার করে ফেলেছে। এই পরিস্থিতি আমাদের নিয়ে যাচ্ছে নাটকের পঞ্চম ও শেষ অঙ্কে।
৫.
নাটকের সব পাত্র মঞ্চে এসেছেন, সব ঘটনা মঞ্চে ঘটেছে। দেখা যাচ্ছে সমস্যাটা একমাত্রিক নয়, অন্তত দ্বিমাত্রিক। বর্তমান ইস্যু তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর বকেয়া ইস্যু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে ঘিরে নাটক জমে উঠেছে। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুটি মূলত দুই বড় দলের ক্ষমতার লড়াইয়ের অংশ, আর যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুটি জাতির ঐতিহাসিক নৈতিক দায়মুক্তির বিষয়। মানতেই হবে পরের ইস্যুটি এ নাটকে আবেগ ও বিবেকি বিবেচনার যে দুয়ার খুলে দিয়েছে তা আগেরটিকে বিষয়ের গুরুত্ব ও ব্যঞ্জনায় ছাপিয়ে যায়। কেননা শেখ হাসিনা দ্বিদলীয় দ্বন্দ্বে বিষয়টি সীমাবদ্ধ রাখেন নি, তাকে জাতীয় রূপ দিতে পেরেছেন। বর্তমান বাস্তবতায় নিছক একটি নির্বাচন যতটা গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে অধিকতর গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে জাতির যাত্রাপথ ঠিক করা ও রাখা। ফলে একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মূল্য গুণে জাতি যদি তার দীর্ঘকালের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা শোধরাতে পারে তবে তার মূল্য অবশ্যই বেশি হবে। নির্বাচনের ইস্যুতে আওয়ামী লীগ যদি খলনায়ক হয় তো জাতীয় ইস্যুতে সে-ই নায়ক। দুর্ভাগ্যের বিষয় বিএনপির ক্ষেত্রে বিষয়টি উল্টোও দাঁড়াচ্ছে না। কারণ তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু আদায় করতে গিয়ে তারা যে ধ্বংসাত্মক আন্দোলন চালু করেছে তাকে কোনোভাবেই নায়কোচিত কাজ বলা যাবে না।
৬.
এবার দর্শকদের মতামত দেওয়ার পালা। যারা অন্ধ আওয়ামীপন্থী তারা এই সুযোগে বিএনপিকে ধ্বংস করতে চাইতে পারে। যারা অন্ধ বিএনপিপন্থী বা আওয়ামী-বিরোধী তারা আবার একাত্তর বা একুশে আগষ্টের কায়দায় হত্যা ও ধ্বংসাত্মক পথে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে চাইতে পারে। গণতন্ত্রের স্বার্থে এর কোনোটাই ঠিক হবে না।
তাহলে পথ কোনটি? পথ হল, বিএনপিকে বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা মেনে তারপর আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করার রাজনীতি সাজাতে হবে। এটি দেশের শান্তি, স্থিতি, সমৃদ্ধি এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়া বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে আওয়ামী লীগের একটি যোগ্য প্রতিপক্ষ দল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আর আওয়ামী লীগকে গণতন্ত্রের স্বার্থে সবধরণের গা-জোয়ারি দখলদারি মানসিকতা ছেড়ে বিরুদ্ধশক্তিকে জায়গা দিয়ে গণতন্ত্র চর্চার মানসিকতা দেখাতে হবে। আর যে নাগরিকগণ অনর্গল কথা বলছেন, সমাধান বাতলাচ্ছেন তাঁদের উচিত হবে বাগাড়ম্বর ছেড়ে দুই বড় দলের মধ্যে সমঝোতার আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া, এ কাজে দূতিয়ালী করা। তা না হলে দেশ, জনগণ, গণতন্ত্র, ভবিষ্যত এবং ইতিহাসের কাছে তাঁরা সবচেয়ে বেশি দায়ি থাকবেন।