Friday, February 6, 2015

শাঁখের করাতে কাটা পড়ছে জনগণ

আবুল মোমেন

দুই বড় দল ক্ষমতার রাজনীতিই করে এমনটাই আমরা জানি। কিন্তু বর্তমানে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে তার পেছনে রাজনৈতিক মতাদর্শের ভূমিকা আছে বলে মনে হয়।  কেউই বিশ্বাস করবেন না যে বিএনপি-আওয়ামী লীগ আদর্শের জন্য লড়ছে। না তারা ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যেই মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এর সাথে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব মিশে গেছে। ক্ষমতার লড়াই চালিয়ে যেতে যেতে উভয় দলই এরকম ঝুঁকিপূর্ণ বাস্তবতা তৈরি করেছে। ফলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার যেমন ক্ষমতা ছাড়া বা হারানোর ঝুঁকি নিতে চায় না তেমনি বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় ফেরার মরণকামড় ছাড়তে চাইছে না।
দুই দলের এই চাপান-উতোড়ে মানুষের ভোগান্তি অবর্ণনীয় জায়গায় পৌঁছেছে - কাজকর্ম স্থবির, আয়-উপার্জনে টান, বাজার ঊর্দ্ধমুখী, আমদানি-রপ্তানি দুইই কমছে, কৃষি উৎপাদকদের সর্বনাশ হচ্ছে। সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠছে পেট্রোল বোমার ভয়াবহতা। এই নিষ্ঠুর বীভৎস দৃশ্য তাকিয়ে দেখা যায় না, সহ্যাতীত, বেদনা ও কষ্টে মোহ্যমান করে দেয়।
শিশুদের হাল্কা মারামারি কখনও বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেলে বড়রা এসে থামিয়ে দেন। সমস্যা হল বড় দুই দলকে তো নয় তাদের কাণ্ডকারখানাকেও শিশুতোষ বলা যাবে না। অনেকেই বলছেন তারা পরস্পর যুদ্ধাবস্থা চালিয়ে রাজনীতিতে অপরাধ-দুর্নীতি টেনে এনেছেন। চট করে বলা যায় দুর্নীতিযুক্ত  অপরাধপ্রবণ রাজনীতির পরিণতি এটা।
তা না হয় বলা গেল। কিন্তু মুক্তির পথ কি? বিএনপি-জামাতের এ নাশকতাময় রাজনীতির ডাকে জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়ে দাবি আদায় করে দেবেন এমনটা নিশ্চয় খোদ দলগুলোও আশা করে না। অতিষ্ঠ জনগণ সরকারের পক্ষে স্বতস্ফূর্তভাবে নামবে না। সম্ভবত বিএনপির আশা অতীতের মত সামরিক বাহিনির হস্তক্ষেপে তারা আন্দোলন সম্মানজনকভাবে থামাতে পারবে ও অচিরেই একটি অবাধ মুক্ত নির্বাচনের সুযোগ পাবে। সরকার মনে করছে পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি-আনসারসহ হাতে মওজুদ বাহিনির সাহায্যে নাশকতা দমাতে পারবে এবং এবারও সংকট উৎরানো যাবে।
জনগণের ধারণা সামরিক বাহিনি সহজে হস্তক্ষেপ করবে না, আবার জনমনে ভয় বিভিন্ন বাহিনির সাহায্যে সারাদেশে নাশকতা বন্ধ করা কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ হবে। ততদিনে জনদুর্ভোগ যে পর্যায়ে পৌঁছাবে তাতে পরিস্থিতির অবনতির আশংকা জনগণ তাড়াতে পারে না।
এ একেবারে শাঁখের করাত। দু দিকেই কাটছে। কাটছে কারণ স্বাধীনতার আগে, বিশেষত ষাটের দশকে, জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শের যে ঐক্য এবং নেতৃত্ব ও দলের প্রতি আস্থা সৃষ্টি হয়েছিল স্বাধীনতার পরে তা দিনে দিনে ক্ষয় পেয়েছে। এখন জনগণ রাজনৈতিকভাবে বেশ বিভ্রান্ত, নেতৃত্ব ও দল সম্পর্কে তাদের আস্থায় ভাঁটা চলছে। বিভ্রান্তি ও অনাস্থা জনগণের মধ্যে এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা ও ঔদাসীন্য তৈরি করে। বাংলাদেশ এই বাস্তবতার শিকার হয়েছে - রাজনীতিবিদরাই এ জন্যে দায়ি, আওয়ামী লীগ বিশেষভাবে। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলের তো নিরংঙ্কুশ জনপ্রিয়তা ভোগ করে যাওয়ার কথা অন্তত কুড়ি বছর। ষড়যন্ত্র হয়েছে সত্য, কিন্তু নেতৃত্ব ও দলও জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারে নি - সেটাও বুঝতে হবে।
ভ্রম সংশোধনের একটি চেষ্টা হয়েছিল বাকশাল গঠনের মাধ্যমে, কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে, তার আগেই জাতি বিভক্ত হয়ে পড়েছে, ফলে এই উদ্যোগের সমালোচনা আজ অবধি চলছে। ২০০৮ সনে ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা আরেকবার পুরোনো ভ্রান্তি থেকে তাঁর দল ও দেশকে বের করে আনার কথা ভেবেছেন। কিন্তু মনে হচ্ছে ষাটের দশকের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগাচ্ছেন না তিনি। তখনও নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ থাকলেও অন্যান্য সমমনা দল, গোষ্ঠী, নাগরিকসমাজের ভূমিকা ছিল স্বাধীন, স্বতস্ফূর্ত এবং রাজনীতির পরিপূরক। এখন যেন নেতৃত্ব এবং দলীয় প্রাধান্য প্রকট, সর্বত্র দলীয়করণের ছাপ পড়ে গেছে। এভাবে নাগরিকসমাজের স্বাধীনতা, স্বতস্ফূর্ততা এবং সর্বোপরি মর্যাদা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাজনৈতিক দল যেমন মানুষের আস্থা হারিয়েছে তেমনি আস্থা ও মর্যাদা হারিয়েছে নাগরিকসমাজও। একই অবস্থা পেশাজীবী গোষ্ঠীসমূহের। এই পরিণতি ঘটেছে রাজনৈতিক দল ও নাগরিকসমাজের যোগসাজশেই। কিন্তু এতে কেউই লাভবান হয় নি, কিন্তু ব্যক্তির নানা পদ-পদবী পুরস্কার-স্বীকৃতি লাভ হয়েছে হয়ত। বিপরীতে সংকটকালে দেশকে রক্ষা করার মত কোনো মানুষ থাকল না দেশে। একটি জাতি ও দেশের জন্যে এ হল চরম সর্বনাশা পরিণতি। জনগণের জন্যে এ যেন ভোঁতা ছুরিতে জবাই হওয়ার প্রাণান্তকর অভিজ্ঞতা। ফলে এ তো দীর্ঘমেয়াদী হওয়াই স্বাভাবিক।
এত হতাশার মধ্যেও একটা আশার কথা বলতে চাই। মানবসমাজে কখনও সব সম্ভবনা শেষ হয়ে যায় না। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার, এমনকি উত্তরণের প্রয়াসে কত সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটে। গত সিকি শতাব্দীর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা-অস্থিরতার মধ্যেও দেশের মানুষ উৎপাদন বাড়িয়েছে বিস্ময়কর গতিতে, বিভিন্ন সামাজিক সূচকে চমকপ্রদ সাফল্য এনেছে, এমনকি এর মধ্যেই প্রবৃদ্ধিও ছয় শতাংশের কাছাকাছি ধরে রেখেছে। ফলে এই মানুষের ওপর আস্থা রাখা যায়।
সাধারণ মানুষ কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী, তারা অনবরত কাজ করেই চলে বলে এত হরতাল-অবরোধ-নাশকতার মধ্যেও দেশ এবং জীবন একভাবে চলে যাচ্ছে। এত অনিশ্চয়তা-অস্থিরতার মধ্যেও বৈদেশিক মুদ্রার মওজুদ বেড়েছে, প্রবৃদ্ধির মাত্রাও ঠিক আছে। কাজে বিশ্বাস করার অর্থ হল ফলে বিশ্বাস করা  - অর্থাৎ ফলপ্রসূ কাজ হওয়া চাই। রাজনীতিবিদরা প্রচুর কথা বলেন, সে তুলনায় কাজ কম করেন। ফলপ্রসূ কাজ আরও কম। নিস্ফলা বাগাড়ম্বরে জনগণের আস্থা নেই। এভাবে অনেক দিন ধরেই চলতে থাকায় জনগণ রাজনীতি ও রাজনীতিবিদে আস্থা হারিয়েছে। কথামালার রাজনীতি নাগরিকসমাজকেও গিলে ফেলেছে - তাঁরা এখন গণমাধ্যমে কথায় মশগুল। এতে জনগণ বেশ বিরক্ত।
দুই দলের দুই রাজনীতির মধ্যে, আমার ধারণা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতির প্রতি নবপ্রজন্মসহ অধিকাংশ মানুষের আকর্ষণ আছে। কিন্তু এ রাজনীতির প্রতিভূ হয়ে বিরাজমান আওয়ামী লীগ তাদের সেভাবে আকৃষ্ট করতে পারে না, পারছে না তাদের আস্থা অর্জন করতে। অপরপক্ষের দুর্দশা আরেকটু বেশি - তাদের সমর্থক ও ভোটার আছে, কিন্তু সংগঠন ও কর্মী নেই। ফলে তাদের আন্দোলন ভাড়াটে নাশকতাকারীদের হাতে চলে গেছে। এ কারণেই সরকার মনে করতে পারছে যে সরকারি বাহিনি দিয়েই এই অপকর্মভিত্তিক রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ করা সম্ভব হবে।
হয়ত হবে। কিন্তু তাতে এই ধারার রাজনীতি বন্ধ হবে না। মুসলিম লীগের ভরাডুবি, এমনকি বিলুপ্তির পরে বিএনপির উত্থান সম্ভব হয়েছে। এমনকি জামাতের সমর্থকও দেশে রয়েছে। ফলে জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলা এবং নাগরিকসমাজকেও স্বাধীনভাবে ভূমিকা পালনের সুযোগ দেওয়া জরুরি। সেভাবে যে রাজনৈতিক জাগরণ সম্ভব, জাগ্রত জনতার যে ঐক্য সম্ভব তা জাতিকে উত্তরণের পুষ্টি দেবে, প্রেরণা দেবে।
বাংলাদেশের জন্য শর্টকাট পথে সমাধান নেই, দীর্ঘমেয়াদী কাজের প্রস্তুতি নিতে হবে। নিষ্ক্রিয়তার জড়তা কাটিয়ে নাগরিকদের সরব সক্রিয় হতে হবে।