Wednesday, March 18, 2015

সৃজনশীলতার পক্ষে আরেক ধাপ

আবুল মোমেন

গতকালের পত্রিকায় বলেছিলাম রাজনীতিতে সৃজনশীলতা প্রয়োজন। দেশের আন্দোলনরত প্রধান বিরোধী দলের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলেছিলাম। কারণ দেশ অচল না হলেও এক ধরনের অস্বস্তির মধ্যে রয়েছে জনগণ তাদের আন্দোলনের ফলে।  আর আন্দোলনের ডাক দিয়ে খোদ বিএনপি নিজেই জটিল আবর্তে হাবুডুবু খাচ্ছে। পরিস্থিতি দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না অল্প কয়েকজনের জেদের প্রতিফলন ঘটছে এই কাগুজে আন্দোলনে।
আমরা বিরোধী মতামতের প্রতি সরকারের অনুদার কর্তৃত্ববাদী ও দমনমূলক ভূমিকা সমর্থন করি না, সমালোচনা করি। কিন্তু প্রধান বিরোধী দলের আন্দোলনের সাথে দেশব্যাপী যেভাবে পুড়িয়ে মানুষ মারা ও অন্যান্য নাশকতা চালানো হচ্ছে তাকে কিছুতেই সমর্থন জানানো যায় না। তদুপরি এর ফলে সরকার বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দমনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। এতে নেতা-কর্মীরা এবং দল প্রচণ্ড চাপের মধ্যে পড়ে গেছে। আন্দোলনের অনুষঙ্গ এই ভয়ঙ্কর তৎপরতা চলতে দিয়ে সরকারকে আলোচনায় বসতে বলা যায় হয়ত, কিন্তু সরকারের পক্ষে তা শোনা কি সম্ভব?
পরিস্থিতি যা তাতে বিএনপিকেই কর্মী-নেতাসহ দলকে চাঙ্গা করার ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকার ধাপে ধাপে নিজের ক্ষমতা বাড়িয়ে নিতে পেরেছে বিএনপি নির্বাচনের পর থেকে একের পর এক সরকারকে ওয়াক ওভার দেওয়ার ফলে। এখনও নেপথ্যে থেকে যেভাবে কাগুজে আন্দোলন চালাচ্ছে তাও এক ধরনের ওয়াক ওভার।  সরকার ও বাহিনীগুলো তৎপরতা চালানোর যথেষ্ট জায়গা পাচ্ছে। আর যদি বিএনপি-জামায়াত এ পর্যায়ে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় নামে তাহলে তার তাপ লাগছে এবং ভোগান্তি পোহাচ্ছে জনগণ। অর্থাৎ সে আন্দোলন যতটা না সরকারের বিরুদ্ধে তারচেয়ে বেশি কার্যকর হবে জনগণের বিরুদ্ধে। তাতে জনগণ নিশ্চয় বিএনপির ওপর অসন্তুষ্ট হবে, ক্ষুব্ধ হবে।
এখন বিএনপির জন্যে বাংলা প্রবাদ ‘সবুরে মেওয়া ফলে’ই খাটবে। তবে তাদের নিশ্চেষ্ট বসে থেকে অপেক্ষা করলে চলবে না। দল গুছানো এবং সঠিক কার্যক্রম নির্ণয়ই প্রথম কাজ। তারেক রহমান নেতৃত্বে দূরদর্শিতার পরিচয় দিচ্ছেন না। আপাতত ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার চেয়ে সংগঠন এবং এদেশের রাজনীতি বোঝেন এমন নেতাদের ওপর ভরসা করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তাঁরাই বসে করণীয় সম্পর্কে দলের নেত্রীকে সঠিক পরামর্শ দিতে পারবেন। এ ধরনের নেতাদের মধ্যে যোগাযোগ হওয়া এবং তাঁদের মতামতকে দলে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার। তারপর সর্বস্তরে দলকে গুছিয়ে তুলতে হবে মূলত এলাকার গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নেতৃত্বে। এরপর জনগণকে সম্পৃক্ত করে রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতে হবে। সরকারের সঙ্গে বৈঠকে যেতে পারলে বিএনপি লাভবান হবে। বৈঠক সফল হলে লাভ তো হবেই, আর তখন ব্যর্থ হলে তার দায় সরকারের ওপর পড়বে। ফলে বৈঠকে বিএনপির হারানোর কিছু নেই।
একঘেয়ে কাগুজে আন্দোলনের কারণে জনগণের দুর্ভোগ বাড়ছে, দেশের ক্ষতি হচ্ছে এবং এর দায় বিএনপির ঘাড়ে চাপছে। এ ধরনের ভ্রান্ত এবং নেতিবাচক কাজ দলের স্বার্থেই বিএনপির বন্ধ করা উচিত।


***

শিক্ষা কিংবা রাজনীতি ছেলেখেলা নয়

আবুল মোমেন

আমরা নিশ্চিত জানি কোনো রাজনৈতিক দলই শিশুদের প্রতি বিরূপ নয়। শিশুদের ক্ষতি হোক এমনটা কেউ চাইতে পারে না।
কিন্তু বিরোধী দলের ডাকে যে হরতাল-অবরোধ চলছে তাতে একতরফাভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। কারণ হরতাল মোটামুটি কাগুজে আন্দোলনে পরিণত হয়েছে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যতীত বাকি সবই চলছে। স্বাভাবিকভাবে চালু থাকা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিএনপি নেতা ও সমর্থকদের কল-কারখানা এবং বাণিজ্যিক অফিসও রয়েছে। শুধু হতে পারছে না পড়াশুনা।
এটা বলে বোঝানোর দরকার নেই শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হলে জাতি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যারা আজ বিরোধী দলে আছেন তারা একদিন সরকারে যাবেন, যেমন অতীতে ছিলেন ক্ষমতায়। তাঁদেরই দেশ চালাতে প্রয়োজন হবে শিক্ষিত দক্ষ কর্মীদল। আজকের শিশু ও শিক্ষার্থীরাই তো দেশের ভবিষ্যত। দেশের ভবিষ্যত নষ্ট করে দেশের মানুষের উপকার করা তো সম্ভব নয়। শিশুদের জন্যে এটি একটি অরাজক পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যতই পড়া দেওয়া হোক, বাড়িতে পড়তে বসুক, সেটা ঠিক নিয়মিত স্কুলে যাওয়ার মত সুফল দেবে না। ব্যক্তিগত যোগাযোগের সূত্রে জানতে পারি যে শিশুরা স্কুলের নিয়মের বাইরে চলতে চলতে পড়তেই চায় না। এ বয়সে এভাবে পড়ায় মন বসে না, খেলার দিকে মন পড়ে থাকে। এ খেলাও কোনো কাজের খেলা হবে না। তাদের তো মাঠে গিয়ে ঠিক মতো খেলার উপায় নেই। ঘরের মধ্যে ডানপিটেমি হয়, খেলা হয় না। কারণ খেলাও একটা নিয়মবদ্ধ শৃঙ্খলার বিষয়।
রাজনীতিও একটা ডিসিপ্লিন। রাজনীতি করেই রাজনীতিবিদ দেশ শাসন করবেন, দেশকে আইনের মাধ্যমে শৃঙ্খলায় চালাবেন। রাজনৈতিক আন্দোলনের নিয়মনীতি আছে। এ কোনো ছেলেখেলা নয়। মানুষের প্রাণহানি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অংশ হতে পারে না। ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের সময় পাঞ্জাবের চৌরিচৌরাতে কয়েকটি প্রাণহানি ও নাশকতার ঘটনা ঘটলে এর নেতা মহাত্মা গান্ধি সারা ভারতবর্ষের অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
আজ এদেশে শুধু পেট্রোল বোমায় পুড়ে মারা গেছে শ’খানেক মানুষ। এ বীভৎস কাণ্ড চলছে দু’মাসের ওপর। কিন্তু সাধারণের প্রাণঘাতি এ ‘আন্দোলন’ চলছেই। রাজনৈতিক আন্দোলন নিয়ে এবং মানুষের প্রাণ নিয়ে ছেলেখেলা কিছুতেই চলতে দেওয়া উচিত নয়।
একইভাবে সরকারি বাহিনীর ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে ছেলেখেলা এবং মানুষের প্রাণ নিয়ে ছেলেখেলাও অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত। বন্দুকযুদ্ধেও কম প্রাণহানি হয় নি।
এভাবে দিনে দিনে আমরা আইনের বাইরে বলে যাচ্ছি। রাজনীতিকদের টানাপোড়েনে দেশটাই কি আউটল হয়ে যাবে নাকি!
আমাদের আইনের কাছে নিয়মের কাছে ফিরতে হবে। সর্বত্র শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নয়ত শাসক থাকবেন, তাঁদের শক্ত শাসনদণ্ডও চলবে, কিন্তু তার তলে তলে ও ফাঁকে ফাঁকে সমাজে অরাজকতা ছড়িয়ে পড়বে। ক্ষমতার অপব্যবহার বাড়বে, অপরাধ বাড়বে। মানুষের জীবনে শান্তি স্বস্তি চলে যাবে।

***