Tuesday, January 26, 2016

শিক্ষাচিন্তায় বনের গাছ দেশের নদী

আবুল মোমেন

ইদানীং দেশে সাফল্য চর্চার ও সাফল্যের আপন ঢোলটি বাজানোর প্রতিযোগিতা চলছে। গণমাধ্যম হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে সাফল্যের কাহিনি, এর নায়ক এবং নায়িকাদের।
না, এতে দোষের কিছু নেই। কেবল প্রশ্ন হল, কে কোন্ মানদণ্ডে সফল, মানদ- কীভাবে কারা স্থির করছেন? শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের সাম্প্রতিক সাফল্যের কথা জোর গলায় সবাই বলে যাচ্ছি, কিন্তু তলিয়ে দেখলে সত্যিই কি সাফল্যেরই চিত্র ফুটে ওঠে? গবেষণা ভিন্ন কথা বলছে। কেননা শিক্ষা তো শিক্ষাই। পিএসসিতে জিপিএ৫ কত লক্ষ জন পেল তারও চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ঐ স্তরের অর্জন-লক্ষ্যগুলো তাদের ঠিকঠাক মতো অর্জিত হয়েছে কিনা। প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কাজ করে এমন একাধিক সংস্থার সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যাচ্ছে ২০১৪ সনে প্রাথমিক সমাপনীতে ৪২% ছাত্র ইংরেজিতে ঈ-উ মান পেয়েছে, অংকে অর্ধেকের বেশি ছাত্রের অবস্থা খারাপ, মাতৃভাষাতেও অর্জন-মান ভালো নয়। মাদ্রাসার ছাত্ররা আরবিসহ তিন ভাষাতেই অদক্ষতা নিয়ে পাশ করেছে। তারও চেয়ে ভয়াবহ বিষয় হল যেসব ছাত্র নানাবিধ কোচিং, প্রাইভেট টিউটর, নোটবই, গাইডবই নির্ভর করে পড়েছে অর্থাৎ কেবল স্কুলের ওপর নির্ভর করে থাকে নি, তারাই ফলাফল ভালো করেছে। এর অর্থ একদিকে বিনিয়োগে সমর্থ পরিবারের ছেলেমেয়েরা ভালো করছে আর অন্যদিকে স্কুলগুলো ছাত্রদের দক্ষ করে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে।
কিন্তু পিএসসি নিয়ে আসল উদ্বেগ হল শিশুবয়সে জিপিএ৫ অর্থাৎ সাফল্যের দৌড়ে লিপ্ত হয়ে পড়ায় ছেলেমেয়রা - প্রধান শিক্ষকদের ভাষ্য অনুযায়ী - প্রচণ্ড চাপের মধ্যে পড়ে গেছে, এতে প্রকৃত শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অথচ পরীক্ষায় পাশ করা সহজ হয়ে যাচ্ছে, শিক্ষায় পারিবারিক ব্যয় বাড়ছে এবং পুরো শিক্ষাই পরীক্ষাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে, মুখস্থ ও নোটবই-কোচিং-নির্ভরতা বেড়ে চলেছে। বস্তুতপক্ষে আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই, একেবারে প্রথম শ্রেণি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত, সম্পূর্ণ পরীক্ষা-কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। তাতে ছাত্ররা আদতে সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তরই শেখে। ফলে কোনো বিষয়েই তাদের পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জিত হয় না। এটি পরীক্ষায় পাশ করা এবং জিপিএ৫ পাওয়ার পদ্ধতি হতে পারে, কিন্তু জ্ঞানার্জনের পথ হতে পারে না। এভাবে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তৈরি সম্ভব নয়।
এই ব্যবস্থার ভিতর দিয়েও কিছু মেধাবী ছাত্র বেরিয়ে আসতে পারে, তারা দেশে-বিদেশে স্বদেশের মুখ উজ্জ্বল করে। আমরা গৌরবের সাথে তাদের সাফল্য উদযাপন করতে থাকি। অমর্ত্য সেন তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ দ্য কান্ট্রি অব ফার্স্ট বয়েজ-এ একে নাম দিয়েছেন ফার্স্ট বয় সিনড্রোম। এ প্রবণতার ফলে শিক্ষায় আম ছাত্রদের অন্তত প্রাথমিকের সকল অর্জন-লক্ষ্য পূরণ এবং শিক্ষায় সবার জন্যে সমান সুযোগ সৃষ্টির মত দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। অথচ জাতিসঙ্ঘ, ইউনেস্কো এবং ইউনিসেফের সদস্য-রাষ্ট্র হিসেবে এবং শিশু অধিকার সনদের স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে এসব দিকে নজর দেওয়ার কথা ছিল। সেই সনদ অনুযায়ী (আর্টিকেল ৩১) আমরা তো তাদের খেলাধূলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, শিল্পচর্চা ও অন্যান্য বিনোদনমূলক ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু আমরা বরং শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে তাদের সেসব অধিকার একে একে হরণ করে নিচ্ছি। এসবই পিএসসি-জেএসসি এবং জিপিএ-৫ এর দৌরাত্ম্যের নিষ্ঠুর ফলাফল। আমরা দৃশ্যমান সাফল্যের পিছনে ছুটতে ছুটতে তার পেছনে লুকিয়ে থাকা অদৃশ্যপ্রায় কিন্তু নিতান্ত বাস্তব সংকটগুলো দেখতে পাই না বা দেখতে চাই না। কিন্তু তার প্রতিফল তো দীর্ঘমেয়াদী এবং ভয়ঙ্কর। কারো শৈশব যদি ভয়ঙ্কর চাপের মধ্য দিয়ে কাটে এবং যে সাফল্যের জন্যে সে চাপটা নেয় তা যথাযথভাবে অর্জিত না হলে তার মনের অবস্থা কী হতে পারে আমরা কি সেটা ভাবি? অধিকাংশের জন্যে এটাই তো পরিণতি। যে শিশু না খেলে না গেয়ে না এঁকে তার কল্পনাকে না ছুটিয়ে, অবসরকে ইচ্ছামতো একটু না কাটিয়ে কেবল পরীক্ষার প্রস্তুতিতে আর পরীক্ষা দিয়ে কাটায় তার মনে কত ক্ষোভ কত বেদনা কত হীনম্মন্যতার বীজ জমা হয় তা আমরা খেয়াল করি না। কেবল বলি সমাজে এত অস্থিরতা কেন, সবাই কেন স্বার্থপর হয়ে উঠছে, হয়ে পড়ছে হিংসুটে ঝগড়াটে, স্বার্থপর এবং নিষ্ঠুর? কেনইবা বাড়ছে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ?
আমাদের সমাজে গবেষণার গুরুত্ব নেই বললেই চলে। ফলে বর্তমান কাজের পরিণতি বুঝতে পারি দূর ভবিষ্যতে যখন ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে যায়। ফলে তাৎক্ষণিক সাফল্য দেখাতে পারলেও আখেরে খুব লাভ হয় না আমাদের।
বিনামূূল্যে সবার জন্যে প্রাথমিক শিক্ষা দিতে আমরা সাংবিধানিকভাবেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, কিন্তু এ প্রতিশ্রুতি কীভাবে পালন করব তা তো কেবল ঘোষণার বিষয় নয়, কর্ম ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনা এবং দেশের বাস্তব অবস্থার ভিত্তিতেই নির্ধারণ করতে হবে। শিক্ষা মূলত একটি সামাজিক কাজ। অর্থনৈতিকভাবে বহুধাবিভক্ত এ সমাজে নানা রকম বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। সরকারও দীর্ঘকাল ধরে তার সাথে তাল মিলিয়েই চলেছে। ফলে শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারও বৈষম্য ও বিভক্তিকে জিইয়ে রাখছে। প্রাথমিক পর্যন্ত অন্তত একধারায় শিক্ষা প্রচলনের অঙ্গীকার পূরণে সরকার হাল ছেড়ে দিয়েছে বলেই মনে হয়। মাধ্যমিকেও সরকারই বৈষম্য পুষছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের (ব্যানবেইজ) জরিপেই দেখা যাচ্ছে ক্যাডেট কলেজে ছাত্রপিছু সরকারের বার্ষিক ব্যয় যা বেসরকারি স্কুলে তা কুড়ি ভাগের এক ভাগও নয়। এতটা বৈষম্য রেখে মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়া কি সম্ভব! আজ পর্যন্ত কিছুতেই আমরা শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জাতীয় আয়ের অভীষ্ট ৬ শতাংশে পৌঁছুতে পারলাম না। তা রয়েছে ৩ শতাংশের কাছাকাছি। এ সরকার শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে যে আশাবাদ সৃষ্টি করেছিলেন আজ ছয় বছর পরেও তার মৌলিক সুপারিশ পূরণে এগুনো যায় নি।
সরকার মাধ্যমিক পর্যন্ত সব ছাত্রকে প্রতি বছর বিনামূল্যে বই দিচ্ছেন। এটা একটি চমকপ্রদ অর্জন নিঃসন্দেহে। কিন্তু এর কয়েকটি দিক নিয়ে সত্যিই ভাবা দরকার। সত্যিকারের শিক্ষিত মানুষ তথা শিক্ষিত জাতি তৈরি করতে হলে তাদের পড়াশুনা কেবল পাঠ্য বইয়ের মধ্যে সীমিত করে রাখলে চলবে না। কিন্তু আশৈশব পড়াশুনার যে পরীক্ষাকেন্দ্রিক পদ্ধতির ভিতর দিয়ে তারা বেড়ে ওঠে তাতে  আমাদের বাস্তবতা হল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কেউই আর পাঠ্যবইও পড়ে না, অন্য বই পড়া দূরের কথা। তারা কেবল প্রশ্নের উত্তর শেখে। বস্তুতপক্ষে এই প্রক্রিয়ায় কারো পাঠাভ্যাস তৈরি হয় না। অমর্ত্য সেন তাঁর পূর্বোক্ত বইয়ের  নাম প্রবন্ধে দেখিয়েছেন উনিশশতকের মাঝামাঝি (১৮৭২) জাপানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যখন শুরু হয় তখন তাদের দেশে বইয়ের প্রকাশনায় বিপ্লব ঘটে যায়।  দেখা যাচ্ছে ১৯১৩ নাগাদ, যখন জাপান যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেনের চেয়ে অনেক দরিদ্র, তখনই ব্রিটেনের চেয়ে অনেক বেশি এবং আমেরিকার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি বই ছাপছে। যদিও তাদের জনসংখ্যা তখন যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেকেরও কম।
ফলে এ প্রসঙ্গে আমার দ্বিতীয় বক্তব্য হল, যেহেতু একদিকে সরকারের সামর্থ্য সীমিত আর অন্যদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে এবং সচেতনতা বাড়ার ফলে সন্তানের শিক্ষায় বিনিয়োগে আগ্রহ বেড়েছে তাই সকলকে বিনামূল্যে বই দেওয়ার অর্থ হয় না। নয়ত এবারের মত বইয়ের মুদ্রণ-বাঁধাইয়ের মান খারাপ হওয়া ঠেকানো যাবে না। এ বছর অনেক বই শিশুরা পুরো বছর টেকাতে পারবে না, কোনো কোনো বই পড়া দুষ্কর। বরং স্কুলভিত্তিক জরিপ চালিয়ে শুধুমাত্র অভাবী পরিবারের সন্তানদেরই বিনামূল্যের বই দেওয়া উচিত। আর সামর্থ্যরে ভিত্তিতে বইয়ের মূল্য প্রদানে সরকার অভিভাবকদের বিভিন্ন মাত্রায় রেয়াত দিতে পারেন। তাতে যে সাশ্রয় হবে সে টাকা শিশু-কিশোরদের উপযোগী বইয়ের প্রকাশনায় ভতুর্কি দেওয়া যায়, স্কুলে স্কুলে পাঠাগার গঠনে বিনিয়োগ করা যায়।
বই নিয়ে তৃতীয় কথাটি হল - প্রতি বছর নতুন বই দিতেই হবে? আমাদের বহুকালের সংস্কৃতি হল বৃহত্তর পরিবারের বড় জনের বই ছোটরা পড়বে, এমনকি স্কুল উদ্যোগী হয়ে বই সংরক্ষণ করে তা বিতরণও করতে পারে। এ জন্যে বইয়ের কাগজ ও ছাপা-বাঁধাইয়ের মান উন্নত হতে হবে। তবে এ ব্যয় বছর বছর সকলকে বিনামূল্যে সব বই দেওয়ার চেয়ে অনেক কম হবে, কিন্তু উপকার হবে ঢের বেশি। শুধু যে বছর পাঠক্রমে পরিবর্তন আসবে সে বছর সবার জন্যে নতুন বই ছাপালেই চলবে।
এতে চতুর্থ বিষয়টি পরিষ্কার হবে। এ বিষয়ে অধ্যাপক কায়কোবাদ প্রথম আলোয় তাঁর সাম্প্রতিক একটি লেখায় আলোকপাত করেছেন। আমি আরেকটু যোগ করছি। সম্প্রতি একটি জার্মান গবেষণাপত্রে পড়েছিলাম সহনীয় মাত্রার পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারও নিষিদ্ধ করে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে শুধু কাগজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে বছরে বন কাটার পরিমাণ যে হারে বাড়বে তাতে কয়েক বছরেই বিশ্ব বনশূন্য হয়ে যাবে। শুধু তা নয়, কাগজ তৈরি করতে যেসব রাসায়নিক ব্যবহার হয় তা বর্জ্য হয়ে পানিতে মেশে এবং ফলে নদী ও জলাশয় দূষণের মাত্রা দ্রুত বাড়তে থাকবে। তাই জোর দিতে হবে পুনর্ব্যবহারযোগ্য পলিথিন ব্যবহারের ওপর আর মানুষকে শেখাতে হবে ব্যবহৃত ব্যাগ যথাস্থানে পরিত্যাগের বিষয়টি। সম্প্রতি বিবিসিতে ফিচার ছবি দেখেছিলাম ভারতে কীভাবে ব্যবহৃত পলিথন সংগৃহীত হয় এবং তা পুনরায় ব্যবহার করে মগ, জগ ও অন্যান্য সামগ্রী তৈরি হয়।
সাফল্যের ঝলক দিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে চিন্তাকে বিরাম দিয়ে লাভ নেই, আমাদের চাই টেকসই সাফল্য,  ফার্স্টবয় সিনড্রোমে (এ ক্ষেত্রে জিপিএ৫ সিনড্রোম) না ভুগে বিবেচনায় নিতে হবে সবার স্বার্থ, সবার সাফল্যকে। বিবেচনায় নিতে হবে দূর ভবিষ্যতের পরিণতিও। তবেই শিক্ষাচিন্তায় কেন বনের গাছের কথা, দেশের নদীর কথাও প্রাসঙ্গিক তা আমাদের বিবেচনায় আসবে।

***




Thursday, January 14, 2016

২০১৫ থেকে ২০১৬ : উত্তরণের সোপান

আবুল মোমেন

সদ্য শেষ হওয়া বছরটা কেমন গেল?
২০১৫ শুরু হয়েছিল দুর্যোগ ও অনিশ্চয়তা নিয়ে। পেট্রোল বোমা ও হরতালের আতঙ্কের মধ্যে। দগ্ধ মানুষ আর মৃত্যুর বিভীষিকা সাথে করে।
এ পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ, অমানবিক এবং দুঃস্বপ্নের মত। এর পেছনে ছিল রাজনীতি, ক্ষমতার রাজনীতির অন্ধ প্রতিহিংসা। কোনো আন্দোলন ছিল না। সংগঠন বা কর্মীরা তৈরি ছিল না। কর্মসূচিগুলো যে-রাজনীতিকে ধারণ করেছে তা জনগণকে কেবল উপেক্ষা করেনি, প্রতিপক্ষ বানিয়ে ছেড়েছিল।
এভাবে বিএনপি বছরটা শুরু করেছিল দলের জন্যে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করে। আর তাদের জন্যে বছরটা শেষ করলেন খোদ বেগম জিয়া ও তাঁর সংখ্যালঘু শাগরেদ গয়েশ্বরচন্দ্র মিলে দলের ভাবমূর্তি ও রাজনীতি উভয়ই প্রায় শেষ করে দিয়ে। যখন দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে ও রায় কর্যকর হচ্ছে তখন তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং শহীদদের, বিশেষত বুদ্ধিজীবীদের-বুদ্ধিসুদ্ধি নিয়েই উপহাস করেছেন। এরপরে বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের ফসল স্বাধীন বাংলাদেশে কীভাবে রাজনীতি করবে? তাদের বক্তব্যের সারবস্তু ও মর্ম মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশকে অসম্মান ও অস্বীকৃতির সামিল, যা পাকিস্তান আজও করে আসছে। তারা কি বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর ব্রত নিয়ে রাজনীতি করছেন? আমাদের তো তাহলে সাবধান হতে হয়, দেশবাসীকেও সাবধান করে দিতে হয়।
এ ধরনের রাজনীতি স্বাধীন বাংলাদেশে ষড়যন্ত্র বলেই গণ্য হবে। সাধারণ মানুষই এর জবাব দিচ্ছে, দিয়ে যাচ্ছে। না, তারা রাজনীতি করছে না। বরং রাজনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজের কাজ করে যাচ্ছে। কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা - তিন ক্ষেত্রে অগ্রগতিতে সারা বিশ্বকে চমকে দিয়েছে। দেশের সব শিশু এখন স্কুলে ভর্তি হচ্ছে, দেশে এখন স্কুলগামী শিশুর সংখ্যা সাড়ে চারকোটি - যা ইউরোপের অধিকাংশ দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। সেই সকল ছাত্রকে সরকার বছরের প্রথম দিনে বিনামূল্যে সকল পাঠ্যবই দিচ্ছে, যার সংখ্যা তেত্রিশ কোটির বেশি। ভাবা যায়! স্কুলের মেয়ে-শিশুদের উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে, বিনামূল্যে দুই প্রস্ত করে স্কুল-পোশাকও দিচ্ছে সরকার। এও অভাবনীয়। নবজাতক মৃত্যু, মাতৃমৃত্যুর হার দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন এসে গেছে, গড় আয়ু ভারতের চেয়ে বেশি। আর একাত্তরের স্বাধীনতার সময় সাড়ে সাতকোটি জনসংখ্যার খাদ্যের সংস্থান যে দেশ করতে পারত না সে দেশ আজ দ্বিগুণ মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করে উদ্বৃত্ত দেশ। ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে অষ্টম আর মাছে পঞ্চম, কিন্তু গত এক বছরে এ দুই খাতে অর্থাৎ ফল ও মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। এ অবস্থায় যে-রাজনীতি তার বাড়া ভাতে ছাই দিতে আসবে তাকে সে দুয়ো দেবেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা বাতিল করে বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন নানা শর্তের চাপের মধ্যে রাখলেও তৈরি পোশাক খাতে উৎপাদন ও রপ্তানি আয়ে তার প্রভাব পড়ে নি। উদ্যমী বাঙালরা এসব মারপ্যাঁচ ও ব্যবসায়িক চালকে অকেজো করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ এখন ৩০ বিলিয়ন ছুঁয়েছে।
এসবই তো বাংলাদেশেই সম্ভব হয়েছে। যেমন করে হয়েছে জিয়াউর রহমানের মেজর থেকে জেনারেল হওয়া, রাষ্ট্রপতি হওয়া! এ সবই তো বাংলাদেশেরই অবদান। তার সূত্র ধরেই তো বেগম জিয়ার উত্থান বা রাজনীতি, প্রধানমন্ত্রী কি বিরোধী নেত্রী হওয়া। তিনি যদি খোদ মুক্তিযুদ্ধকে, যা কিনা বাংলাদেশের জন্মক্ষেত্র, আঁতুড়, তাকে খাট করেন, তার ধাত্রীদের মধ্যে শহীদদের অস্বীকার করেন, দেশের জনককে না মানেন তাহলে কীভাবে এদেশে সুস্থ রাজনীতি করবেন?
ত্রিশ লক্ষ নাম জানা ও অজানা শহীদদের প্রতি অসম্মান দেখিয়ে আর দেশের বুদ্ধিজীবীদের বিদ্রƒপের পাত্র মনে করলে কীভাবে এদেশের নেতা হবেন তিনি? তাঁর চিন্তাজগতে বাংলাদেশ কি আদতে একটি জাল দেশ? প্রকৃত দেশ তাহলে কোনটি, কাদের প্রকৃত নেতা তিনি? পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশনের স্বপ্ন দেখেন নাকি তিনি?
যাঁরা প্রকৃত রাজনীতিবিদ তাঁদের বোঝার কথা ২০১৫ সাল বাংলাদেশ-নদীটির স্বখাতে স্বমহিমায় পুনর্বাসিত হওয়ার বছর। ১৯৭১-এর মত এ কাজে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ এবং ঠিক ১৯৭১-এর মতই এতে যুক্ত হয়েছে এবং বিপুলভাবে অবদান রেখেছে দেশের আপামর জনগণ। এই জনগণের মধ্যে ঠিক ১৯৭১-এর মতই সাধারণ কৃষক-মজুরদের ভূমিকা প্রধান। তারা সেদিন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছিল আর দেশের কল্যাণে প্রাণ দিতে কসুর করে নি। এখনও তারাই অর্থনীতির রণক্ষেত্রে যোদ্ধার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যারা বরাবর বৈরী প্রকৃতি, ভাঙনপ্রবণ নদী ও অস্থির ভূমির সাথে লড়াই সংগ্রাম করে জীবন কাটিয়েছে তাদের জন্যে জীবনসংগ্রাম তো বটেই, যে কোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণেও অভিনবত্ব নেই। তাদের জীবনে কোনো চ্যালেঞ্জই অসাধ্য নয়। একাত্তরে যেমন আমেরিকার সপ্তম নৌ বহরের রক্তচক্ষুকে তারা হেলায় উপেক্ষা করে জয়ী হয়েছে আজ অর্থনীতির সংগ্রামে তারা জিএসপি প্রত্যাহারের চোখ রাঙানোকেও পরোয়া করে নি। তারা এগিয়ে গেছে। না, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার অভিযাত্রাকে আর থামানো যাবে না।
তাহলে কি মামলা খারিজ? জামায়াত, পাকিস্তান , খানিকটা যুক্তরাষ্ট্র, আইএস-জেএমবি ও অন্যান্য জঙ্গি, এমনকি খালেদা জিয়া ও তাঁর দল কি হাল ছেড়ে দেবে? পথে আসবে?
সেটা দেখার বিষয়। ইতিহাস কখনও একমুখী পথে চলে না, রাজনীতিতেও শেষ কথা নেই। ফলে গা-ছাড়া ভাব একদমই পরিহার করতে হবে, আত্মসন্তুষ্টিতে ভোগার কোনোই অবকাশ নেই। বরং আরও দৃঢ়তার সাথে সামনের পথ চলতে হবে। সেদিক থেকে ২০১৬ সাল হবে দৃঢ় সংকল্পের বছর। সকল বাধা ঠেলে সামনে এগুনোর বছর। আর মনে রাখতে হবে একাত্তরে বিজয়ের পরে যেসব কারণে প্রতিপক্ষ, প্রতিক্রিয়ার শক্তি প্রত্যাঘাত হানতে পেরেছিল, আমাদের অর্জনগুলো ধ্বংসে প্রবৃত্ত হয়ে সফল হয়েছিল সেসব কথা। প্রথমত, জাতির মধ্যে আজ যে আশা, আংশীদারিত্ব এবং ঐক্য বোধ তৈরি হয়েছে তাকে বজায় রাখতে হবে ও জোরদার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দেশে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও গতিশীল করার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। তৃতীয়ত, মিত্রদের ও সমমনাদের চিনতে হবে এবং কাজে লাগাতে হবে। চতুর্থত, কোনো অবস্থাতেই সব অর্জনের কৃতিত্ব আওয়ামী লীগের ঘরে জমা করার প্রবণতা পরিহার করতে হবে। পঞ্চমত, অবশ্যই দুর্নীতি, দলীয়করণ, অদক্ষতার হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হবে।
মানুষ আশা নিয়ে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যেন আস্থাশীল আজ। তাদের সে বারতা তাঁকে এবং তাঁদের দলের ও সচেতন নাগরিকদের সকলকে বুঝতে হবে।
সেই সাথে বেগম জিয়া এবং তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের ইতিহাসের এই প্রকৃত ধারা বুঝতে হবে। বাংলাদেশের, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের, রাজনীতিই তাঁদের করতে হবে। মানুষের আশা সেই রাজনীতিই তাঁরা শুরু করবেন - দেরিতে হলেও।
***



উন্নয়ন হলেও সুখ অধরা থাকছে

আবুল মোমেন

বাংলাদেশ এগুচ্ছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। উন্নয়নের বিবেচনায় অনেক বিশেষজ্ঞের কাছেই বাংলাদেশ এক বিস্ময়। এই বিস্ময়কর চমকপ্রদ অগ্রগতির জন্যে জনগণের সঙ্গে সরকার, বিশেষভাবে প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই ধন্যবাদ পাবেন।
এরপরে কি আর কথা থাকবে না? ইংরেজ বাঘা বুদ্ধিজীবী বার্ট্রা- রাসেল-এর বাহ্যরূপ ও বাস্তবতা - এপিয়ারেন্স অ্যা- রিয়ালিটি-যুক্তিজালের গোলকধাঁধায় না ঢুকেও বলা যায় - বোধহয় থাকবে। ছোট্ট দেশ, সার্কের সদস্য রাষ্ট্র ভূটানের রাজা তা-বড় অর্থনীতিবিদ ও দুঁদে উন্নয়ন বিশারদদের  সূচকগুলোতেই কিন্তু সন্তুষ্ট থাকেন নি। তিনি নতুন ভাবনার জোগান দিয়েছেন। দেশের উন্নয়নের হদিশ নেওয়ার প্রচলিত মাপকাঠি জিডিপি জিএনপি - অর্থাৎ মোট দেশীয় উৎপাদন মোট জাতীয় উৎপাদন ইত্যাদিতে উন্নয়নের সম্পূর্ণ চিত্র উঠে আসে বলে মনে করেন না তিনি। রাজা ওয়াংচুক মনে করেন প্রথমত, মানুষের উন্নয়নের চাহিদা কেবলমাত্র বস্তুগত বিষয়ে সীমিত থাকতে পারে না, দ্বিতীয়ত, উন্নয়নের চাহিদার রূপ ও মান দেশভেদে ভিন্ন ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। তবে তাঁর মতে সব মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য এক - সুখ। তাই তিনি বলেছেন, কোনো দেশের উন্নয়ন বোঝার মাপকাঠি হবে জিএনএইচ - গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস, মোট জাতীয় সুখের পরিমাপ। শুনেছি জাতিসঙ্ঘ জিএনএইচের স্বীকৃতি দিয়েছে।
ভূটানের স্বাস্থ্যোজ্জ্বল হাসিখুশি মানুষদের অল্পদেখার অভিজ্ঞতায় বেশ সুখি আর সমাজটাকেও শান্তিপূর্ণই মনে হয়েছে। ওদের বিষয়ে বেশি বলার অধিকার আমার নেই। তবে আমরা সবাই জানি গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ ঐতিহ্যগতভাবেই অল্পে তুষ্ট, আশুতোষ। পশ্চিমা একটি জরিপেও দেখা গেছে সুখের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ ওপরেই আছে। এর অর্থ এদেশের জনগণ বা সাধারণ মানুষ মোটামুটি সুখেই আছে।
এই জরিপের ফল কি সত্য? বাস্তব চিত্র কি এতে উঠে এসেছে? আবারও আমরা রাসেলের গূূঢ় তর্কের মুখোমুখি হই - বাহ্যরূপ আর বাস্তবতায় কি ফারাক আছে? জানি জরিপ আর পরিসংখ্যান অনেক সময় বোকা বানায় আমাদের, ডাহা মিথ্যাও বলতে পারে। তাছাড়া সুখ বা শান্তির মত বিমূর্ত এবং নিতান্ত মনোজগতের বিষয়ে পরিমাণগত ধারণা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। তবে উন্নয়নের প্রচলিত অধিকাংশ সূচকেই বাংলাদেশের চমকপ্রদ সাফল্য অর্জিত হলেও, এবং সেসব অর্জনকে একটুও খাটো না করে বাস্তবতার আলোকেই বলা যায়, বাংলাদেশের বহু মানুষ সুখেও নেই শান্তিতেও নেই।
দেশে অনেক ধরনের বৈষম্য বিরাজ করছে এবং তাতে এক পক্ষ অন্য পক্ষের আধিপত্যের কারণে বঞ্চিত বা বঞ্চিত-শোষিত উভয়ই হচ্ছে। অনেক উন্নয়ন হলেও বাংলাদেশের সমাজ কাঠামো সামন্ত ধাঁচের, ধর্মসংস্কারশাসিত এবং মোটা দাগে রক্ষণশীল ও পুরুষতান্ত্রিক। এমন সমাজে নারী সর্বস্তরেই - কর্মক্ষেত্র থেকে সংসার, শৈশব থেকে বার্ধক্য, সধবা থেকে বিধবা ইত্যাদি - বৈষম্যের শিকার, স্বভাবতই অনেকেই নিগ্রহ ও লাঞ্ছনার শিকার এবং প্রায় ঢালাওভাবে পুরুষতন্ত্রের যৌন পীড়নের আতঙ্কে কাটাতে বাধ্য হয়। তার সুখ বড় ঠুনকো, ভাসা-ভাসা, অনেক সময় মেকি এবং ছেলে-ভুলানো ছলনার বেশি নয়।
বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বহুকাল ধরেই - সেই পাকিস্তান আমল থেকেই - বৈষম্যের শিকার। কখনও রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উভয় প্রকার বৈষম্যের শিকার তারা। দীর্ঘকাল ধরে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় কেবল বৈষম্যের কারণেই নয়, বঞ্চনা-লাঞ্ছনা-নিপীড়নের ফলে ভয়ার্ত জীবন কাটাচ্ছে। তারা যে অসুখি তার কিছু স্পষ্ট পরিসংখ্যানগত হিসেবও হাজির করা যায়। ১৯৪৭ সনে দেশ ভাগের সময় তৎকালীন পূর্ববঙ্গের হিন্দু জনসংখ্যা ছিল এদেশের মোট জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশ। পাকিস্তানে ছিল রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতা, ১৯৬৫-র পরে যার গভীরতা ও ব্যাপ্তি কেবল বেড়েছে। ১৯৭১- এ স্বাধীনতার পরে এই সংখ্যা নেমে যায় ২২-২৩ শতাংশে। দ্বিজাতিতত্ত্বকে অগ্রাহ্য করে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আদিবাসী মিলে মুক্তিযুদ্ধ করে যে স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি হল তাতেও সংখ্যালঘুর বিড়ম্বনা থেমে থাকে নি। অনেকেরই সম্পত্তি হাতছাড়া হয়েছে, জনসংখ্যা ক্রমাগতই কমে বর্তমানে দশ শতাংশের নিচে। সুখে থাকলে কেউ দেশ ছেড়ে যায়?
আমাদের পাহাড়ের প্রতিবেশী তেরটি আদিবাসী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাস্তবতা কী? ১৯৪৭ সনে গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালির সংখ্যা ছিল ২ শতাংশ। বর্তমানে সেখানে সমতলের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ। নিজ দেশে পরবাসী ওরা। তারপরে তাদের দিক থেকে স্বায়ত্বশাসন, বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন-সংগ্রাম এবং সরকারের দিক থেকে সামরিক অভিযানসহ জল অনেক দূর গড়িয়েছে। ১৯৯৭ সনে সম্পাদিত শান্তিচুক্তির দুই দশক পূর্ণ হলেও কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে পাহাড়ীদের মনে সুখে আসে নি। বস্তুত কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ থেকেই তাদের জীবনে সুখ কমতে শুরু করেছে, বাংলাদেশ আমলে তা হ্রাসের হারই বেড়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে জিয়াউর রহমানের বাঙালি অভিবাসন নীতির ফলে তা চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে, যা শান্তিচুক্তিও ঠেকাতে পারে নি।
ইদানিং সংবাদপত্রে প্রায়ই পড়ি সমতলের আদিবাসীদের চরম ভোগান্তির নানা খবর। মাত্রই গত ২৪ ডিসেম্বর ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে পড়লাম সিলেটের উরাং জাতির রাজাসহ সবার দুরবস্থার কথা। তাদের জমিজমা ভূমিদস্যুদের হাতে গ্রাস হতে হতে এখন বিশ শতাংশও নেই। স্বয়ং রাজা ও তাঁর পরিবার দারিদ্র্যের প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছেছেন। একই অবস্থা সাঁওতাল-গারোসহ সমতলের ৪৩টি আদিবাসী ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর। তারা ভিটোহারা, জমিহারা হয়ে যাচ্ছে। তার ওপর নারীরা অহরহ যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে  এবং কোনো বিচারই পাচ্ছে না। আমরা নিশ্চিতভাবে জানি দেশের আদিবাসী বলুন কি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলুন, তারা কেউ সুখে নেই।
খ্রিস্টান ও বৌদ্ধরা এতদিন এভাবে ভাবে নি, কিন্তু রামুর ঘটনা এবং যাজক ও গীর্জার ওপর হামলার পর তাদেরও মনে শান্তি ও সুখে টান পড়তে শুরু করেছে।
দেশের ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মধ্যে অতি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী আহমদিয়া সম্প্রদায় বেশ কয়েক বছর ধরে কট্টর সুন্নিদের হুমকি ও হামলার সম্মুখীন হচ্ছে। বড়দিনে তাদের একটি মসজিদে বোমা-হামলা হয়েছে। একইভাবে দেশের আরেক ক্ষুদ্র মুসলিম সম্প্রদায় শিয়াদের একটি মসজিদেও হামলা হয়েছে, মুয়াজ্জিন নিহত হয়েছেন এবং বেশ কয়েকজন মুসল্লি আহত হয়েছেন। আমরা কি কেউ খবর নিয়েছি দেশে আরও যেসব মুসলিম ক্ষুদ্র গোষ্ঠী আছেন, যেমন বাহাই, বোরা, ইসমাইলিয়া এঁরা কেমন আছেন? বাস্তবের আলামত বলে, তাদের মনে সুখ থাকার কথা নয়।
যদি আমরা শিশু রাজন, রাকিব, রবিউলদের কথা মনে করি তবে শিউরে উঠে কবুল করতে হবে এ সমাজ শিশুবান্ধব নয়। তাছাড়া শিক্ষা জীবন যেভাবে পরীক্ষা ও জিপিএ ৫-এর দাপটে কেবল কোচিং, মুখস্থ ও পরীক্ষার শৃঙ্খলে পরিণত হয়েছে তা শিশুর দৈনন্দিন জীবনের সুখ নষ্ট করেছে। আর অপহরণ-মুক্তিপণ-নেশা-সাইবার অপরাধ-যানজটের মিলিত ফল হলো শিশুদের জীবনে নেই অবকাশ, নেই স্বাধীনতা। খেয়াল করলে দেখা যাবে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে এদেশের শিশুরা শৈশবহারা, অসুখি। কিশোর-কিশোরীরাও একই বাস্তবের শৃঙ্খলে ও চাপে সুখি কৈশোর থেকে বঞ্চিত।
হয়ত বাস্তববাদী ভাবছেন - সুখ শান্তি মানসিক ব্যাপার, তা ব্যক্তিগত সাধনায় অর্জন করতে হয়। না আমরা জানি এ বাস্তব নয়, বাস্তবের বাহ্যরূপ মাত্র। কথাটা আমরা তুলেছি তুচ্ছ মানুষের নগণ্য জীবনের সামান্য চাহিদার আলোকেই। এ সমাজে যারা জীবনে ভোগের কিছুই না চেয়ে আপন আনন্দে সাধনমার্গে বিচরণ করতে চান সেই বাউল-ফকির পীর-মুর্শিদ সহজিয়া সাধকরাও কি সুখে আছেন? তাঁদের দাঁড়ি-চুল কেটে লাঞ্ছিত করা হয় নি? হুমকির মুখে রাখা হয় নি?
মুক্তচিন্তার মানুষরা জানেন তাঁদের পথটি দুর্গম। তবুও কেউ কি ভাবতে পারে এই একবিংশ শতাব্দীতে, স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতক পরেও, তাদের চিন্তা নয় জীবনই আশংকার মধ্যে থাকবে!
তদুপরি দেশের প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী, দু'বারের প্রধামন্ত্রী এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রীই যদি দেশের জন্মযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেন, জাতির জনককে হেয় করেন, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের অবমাননা করেন তখন সচেতন দেশপ্রেমিক মানুষের মনে সুখ থাকে কীভাবে?
দুটি সামান্য নগণ্য কথা বলে শেষ করতে চাই।
প্রথমত, বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশের যে চমকপ্রদ অগ্রগতি হয়েছে তাকে অস্বীকার করি না, বর্তমান সরকার যে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন উন্নয়নের পথে তাও অস্বীকার করার কারণ নেই, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি কার্যকরের কৃতিত্ব ভুলবার নয়, এবং এই কর্মযজ্ঞে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে যোগ্য নেতৃত্ব দিচ্ছেন তা-ও মানতে দ্বিধা নেই। এসব সাফল্যে অনেকের মত আমিও স্বস্তি পাই, আনন্দিত হই। এদেশের মানুষের, বিশেষত তরুণদের, প্রাণশক্তির ওপরও আমি ভীষণভাবে ভরসা করি। সঠিক দিকনির্দেশনা পেলে তাদেরই পক্ষে যে দেশের অর্থাৎ সমাজ ও সমাজমানসের প্রকৃত রূপান্তর ঘটানো সম্ভব সে বিশ্বাস আমার আছে। ফলে আমি নিরাশাবাদী নই, এখনও আশাবাদী, তবে উদ্বিগ্ন আশাবাদী। আমাদের বুঝতে হবে সুখ, শান্তি সরকার একা এনে দিতে পারবে না।
দ্বিতীয়ত, সমাজকে প্রাচীন সংস্কারে বন্দি রেখে, নারীকে পুরুষতন্ত্রের দাপটে রেখে, শিক্ষাকে পরীক্ষার শৃঙ্খলে বেঁধে, গণতন্ত্রকে ক্ষমতার দুর্গে আটকে, চিন্তার গতিপথে অন্ধবিশ্বাসের অর্গল এঁটে সমাজমানসের রূপান্তর করা যায় না। মনের গহীনে আলো প্রবেশ না করলে অন্ধকার কাটবে কীভাবে? এমনটা চলতে থাকলে সে সমাজে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের সৃষ্টি হয়। আশংকার কথা, এদেশে মুক্তচিন্তার মানুষ তৈরিতে ভাঁটা চলছে, বিপরীত ¯স্রোত বরং বেশ জোরদার বলেই মনে হয়। সমাজের আলোকন (এনলাইটেনমেন্ট) ছাড়া অগ্রগতি সম্ভব নয়। এ কাজ সরকারের নয়, সমাজের অগ্রসর মুক্তিচিন্তার মানুষের। তবে এই আলোকনের সাথে সাথে তাকে টেকসই ও তার অগ্রগতি নিশ্চিত করতে যে কাঠামোগত সংস্কার, পরিবর্তন, নবায়ন প্রয়োজন তা সরকারের দায়িত্ব। সে কাজ অনেকটা হচ্ছে বটে কিন্তু আলোকন ব্যতীত কেবল কাঠামোগত উন্নয়নে মানবিক সমাজ নির্মাণ হবে না। এসব কাজ আরব্ধ রেখে উন্নয়নের বাহ্যরূপে চমকপ্রদ পরিবর্তন ঘটলেও প্রকৃত সুখ অধরাই থেকে যাবে। সে রকম আলামত এ সমাজে প্রকট হয়ে উঠছে - সেটাই ভয়ের বিষয়।


***