Wednesday, December 28, 2016

নাসিকের অভিজ্ঞতা, জাতীয় রাজনীতিতে প্রত্যাশা

আবুল মোমেন

নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনটি সরকার একটা টেস্ট কেস হিসেবে নিয়েছিল বলে মনে হয়। অনেকের ভাষ্য মতে এসিড টেস্ট। সরকারের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে বলা যায়। ইতিপূর্বে সিলেট, বরিশাল, রাজশাহীতে এবং পরে গাজিপুরে মেয়র নির্বাচনে হোঁচট খেয়ে সরকার কৌশল পাল্টেছিল। বিশেষভাবে রাজশাহী ও গাজিপুরে পরাজয়ে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিজয় সম্পর্কে সন্দিহান হওয়ার কারণ ঘটেছিল। রাজশাহীর লিটন কাজ দিয়ে মানুষের মন এতটাই জয় করেছিলেন যে পরিচিত অনেক বিএনপিপন্থীকেও দেখেছি তাঁকে ভোট দিতে চট্টগ্রাম থেকে পরিবার নিয়ে সুদূর রাজশাহী যেতে। আর গাজিপুরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমতউল্লা খান বিএনপি প্রার্থী অধ্যাপক এম. এ. মান্নানের তুলনায় পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির কারণে জনপ্রিয় স্থানীয় নেতা ছিলেন। তাঁদের পরাজয়ে মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি-জামায়াত চক্রের নেতিবাচক ভূমিকা সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়। এমনকি তারা পরিবর্তনের জন্যে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমকেও হিসেবের মধ্যে নেয় নি। অবশ্য ঐ সময়ে সরকারের উন্নয়ন কাজ ও দেশের উন্নতির চিত্র মানুষের কাছে স্পষ্ট ছিল না। তখন মাত্র দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে উত্তরণ ঘটতে শুরু করেছে। তবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে এসব বিষয় আলোচিত হচ্ছিল। কিন্তু স্থানীয় ভোটার পর্যায়ে তখনও তা ততটা দৃষ্টিগোচর হয় নি। ফলে সরকারের দাপটে অসহায় বিএনপি যেন সহানুভূতি টেনেছিল মানুষের।
এর পরে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচন হয়েছে তিনটি - ঢাকার দুটি এবং চট্টগ্রামের একটি। এবারে প্রার্থী নির্বাচনে সরকার দলীয় পরিচয়ের বৃত্ত থেকে বাইরে থাকতে পেরেছিল। তবে নির্বাচনে বিএনপির জন্যেও সম-সুযোগের ক্ষেত্র তৈরি ছিল এমন কথা বলা যাবে না। ভোটাররা সরকারের উন্নয়নের বারতাটা ততদিনে পেতে শুরু করেছে, আবার সরকারের কঠোর অবস্থানের মুখে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা ও অপারগতাও অস্পষ্ট থাকে নি। ভোট কম পড়েছিল, প্রতিদ্বন্দ্বিতাও হয় নি। বিএনপি অভিযোগ তুলে মাঠ ছেড়ে দিয়েছিল।
এর পরে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন প্রায় একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। এর ফলে বহু কষ্টে অর্জিত গণতান্ত্রিক ভোটাধিকারের কার্যকারিতা সম্পর্কে জনমনে সংশয়ের কারণ ঘটেছিল। মানুষ ভোট বা নির্বাচনে আগ্রহ হারাতে থাকে।
এ সময়ে আরো দুটি ঘটনা ঘটে। সত্যিই দেশে উৎপাদন, বিশেষত কৃষি উৎপাদনে চমকপ্রদ সাফল্য অর্জিত হয়ে সাধারণের জীবনে স্বস্তি এসেছে। শহরগুলোয় রাস্তাঘাট, উড়ালপুল, দৃষ্টিগোচর হতে শুরু করেছ, সারা দেশে সড়ক যোগাযোগে ব্যাপক কার্যকর উন্নয়ন ঘটেছে। সরকারও এ সাফল্যকে এই প্রথম ভালোভাবে প্রচারণায় কাজে লাগাতে পেরেছে। মানুষ সরকারের প্রতি, বিশেষভাবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা ফিরে পেতে থাকে।
অপর বিষয়টি হল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, শাস্তি ও শাস্তি কার্যকরের পাশাপাশি এই সূত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে প্রচারণার নতুন পরিবেশ তৈরি। এতে নতুন প্রজন্ম, যারা নতুন ভোটার হচ্ছে - তাদের প্রায় সত্তর হাজার এবারে নাসিক নির্বাচনে ভোটার ছিলেন - তারা বিএনপির জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধ থাকার বিষয়টি ভালোভাবে নেয় নি। আমার ধারণা এরা নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে আইভির পক্ষে ভোট দিয়েছে।
তৃতীয় একটি বিষয়ও নজরে রাখা দরকার। গত প্রায় আট বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের ভাবমূর্তি আরো বাড়াতে পেরেছেন। প্রথম থেকেই, সেই বিডিআর ঘটনা থেকে, তিনি সাহস ও দক্ষতার সাথে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন ও মোকাবিলা করেছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তাঁর নেতৃত্ব প্রশংসিত ও স্বীকৃত হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার বিষয়ে বিএনপির অস্পষ্ট সন্দেহজনক ভূমিকা খুলে ধরার ব্যাপারে তাঁর দৃঢ়তা শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে।
স্বীকার করতেই হবে স্বাধীনতার পরে এই প্রথম যেন সবরকম প্রশাসনিক শাখা ও স্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষেরা বেশি সংখ্যায় দায়িত্বে এসেছেন। মনে হয় বিচার বিভাগও এক্ষেত্রে সঠিক অবস্থানে আছেন।
অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সুফল সাধারণের হাতে আসতে থাকলে নিম্ন পর্যায়ে দলীয় রাজনীতির অন্ধ অনুসারী থাকার প্রবণতা কমে আসে। সাধারণত রাজনীতি অল্প কিছু মানুষের জন্যে লাভজনক বিষয় হয়, অধিকাংশকে এ থেকে লাভ আদায়ে অনেক ঝুঁকি ও অপবাদ সইতে হয়। এর চেয়ে নানা রকম উদ্যোগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা অর্জনের পথগুলো এখন অনেকটা দৃশ্যমান। তরুণরা আজ রাজনীতির চেয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আগ্রহী হচ্ছে বেশি। তারা জানে বর্তমান স্থিতিশীলতা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শক্ত হাতের শক্তিশালী শাসন এক্ষেত্রে বেশি কার্যকর হবে। ফলে বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলেও আম মানুষ, বিশেষত উদীয়মান তরুণ উদ্যোক্তা ও তারুণ্যশক্তি, এ নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় নি। আপাতত ঘামাবে বলেও মনে হয় না। এ অবস্থায় বাংলাদেশে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটানো বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া বিএনপি যদি জামায়াত ও ইসলামি ঐক্য জোটের মত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়ে প্রশ্নবিদ্ধ দলগুলোকে সঙ্গে রেখে জনগণকে কাছে টানতে চায় তাহলে খুব কাজ হবে না।
শেখ হাসিনা প্রায় একক সিদ্ধান্তেই বড় রকমের ঝুঁকি নিয়ে তাঁর প্রশাসন ও রাজনীতি পরিচালনা করছেন। তিনি সর্বাধিক জোর দিয়েছেন অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর, তাতে বিশেষত জ্বালানি খাতের উন্নয়নের প্রশ্নে - অনেক মহলের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়েও - বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর প্রকল্পগুলো এগিয়ে নিতে চান। কিন্তু এর কোনো কোনোটি, অন্তত রামপাল প্রকল্প, শেষ হওয়ার আগেই তাঁকে ভোগান্তিতে ফেলতে পারে, কারণ এটি সত্যিই বিশ্ব-ঐতিহ্য সুন্দরবনকে ক্ষতিগ্রস্ত  করবে। তবে আপাতত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লে ও সঞ্চালন ঠিকঠাকভাবে চললে তিনি লাভবান হবেন। শহরে দৃশ্যমান উন্নয়নে জোর দিচ্ছেন, গ্রামেও উন্নয়দের ছোঁয়া পৌঁছে গেছে, তাও দৃশ্যমান ভাবেই। সামাজিক সব সূচকে উন্নতি দৃশ্যমান - গড় আয় আর গড় আয়ুর অগ্রগতি এককথায় চমকপ্রদ।
শেখ হাসিনা এখন দুর্নীতি দমনের বিষয়ে আন্তরিক হতে পারেন। তাঁর আত্মবিশ্বাস এতটাই বেড়েছে যে দলের অনেক বিশৃঙ্খলাকারী সদস্যের বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়ার অগ্রাধিকার মেনে নিচ্ছেন। এতে যুবলীগ-ছাত্রলীগের আধিপত্য বিস্তারের ও বিত্ত অর্জনের অবৈধ তৎপরতা কমে এলে আওয়ামী লীগ আরো লাভবান হবে। অবস্থান শক্ত হওয়া এখন সরকার মানবাধিকার ও আইনের শাসনের বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারেন। এতে যেসব অপবাদ ও অপশক্তির বোঝা বইতে হয় তা থেকে দল মুক্তি পাবে। সেটা আখেরে আওয়ামী লীগ ও তার সরকারকেই লাভবান করবে।
এবারে নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে সুকৌশলে শামীম ওসমানকে দমানো হয়েছে। নির্বাচনের আগেপড়ে তিনি অনেক বাগাড়ম্বর ও নাটকীয় চমকের আশ্রয় নিলেও বস্তুত তাকে সম্পূর্ণ উপক্ষো করেই নারায়ণগঞ্জ মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিশাল বিজয় অর্জন করেছেন। এটা নারায়ণঞ্জের ভবিষ্যত রাজনীতির জন্যে একটি নাটকীয় পরিবর্তনের বারতা দিচ্ছে বলেই মনে হয়।
এ নির্বাচন থেকে জাতীয় নির্বাচনের জন্যেও কিছু বারতা তো পাওয়া গেল। নির্বাচনে বিজয়ী হতে টাকা কিছু লাগলেও পেশিশক্তির প্রয়োজন নেই। সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়াও সুষ্ঠু নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বিজয়ী হতে পারে, সাথে প্রয়োজন দলীয় কোন্দল ও স্থানীয় স্বার্থের বিরোধগুলোকে কাটিয়ে ওঠার মত পরিকল্পনা, সর্বোপরি সত্য হল যোগ্য ও সৎ প্রার্থীই বিজয়ী হন।
এই বারতা বিএনপি আওয়ামী লীগ উভয় দলের জন্যেই এসেছে। উভয় দল মিলে যেভাবে গণতন্ত্র ও নির্বাচনী ব্যবস্থার অবক্ষয় ঘটিয়েছিল এখন তা থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ এসেছে, সময় তৈরি হয়েছে। এভাবেই তো একটা দেশ এগিয়ে যায়।
বর্তমান বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ পর্যায়ে। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। আশার কথা রাষ্ট্রপতি বড় দুই দলের আস্থায় আছেন এবং আমরা আশা করি তিনি সে আস্থার ভালো প্রতিদান উভয় দলকেই দেবেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোনোরূপ হস্তক্ষেপ ছাড়া অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের সাহস অর্জন করেছে - এটাই আজ বড় কথা। তবে তা পূর্ণতা পাবে যদি এই  সাহস দেশকে আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন থেকে একটি স্বাধীন মর্যাদাপূর্ণ নির্বাচন কমিশন উপহার দিতে পারে। তার পরীক্ষা যদি নারায়ণগঞ্জে হয়ে থাকে, তাহলে তাতে সরকার ও কমিশনকে সকলেই পাশ মার্ক দেবেন। ইতোমধ্যে পর্যবেক্ষকরা সকলেই তা দিয়েছেন ,দিচ্ছেন।
শেষে দুটি কথা বলতে হয়। প্রথমত, রাজনীতি সৎ লোকের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এবারে জোরদার করা হোক। দ্বিতীয়ত, দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখতে হলে দেশের  অপর বড় দল বিএনপিকে তাদের প্রশ্নবিদ্ধ রাজনীতি নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনকে স্থায়ীভাবে বিতাড়ন করতে চাইলে গণতান্ত্রিক রাজনীতির অংশীদার বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দলকেও যে কোনো রকম প্রশ্নবিদ্ধ রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
আশা করি এই পরাজয়ের জন্যে গৎবাঁধা সমালোচনার পথে না হেঁটে বিএনপি তাদের জন্যে সৃষ্ট নতুন চ্যালেঞ্জগুলো বুঝে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে।

***

Thursday, December 15, 2016

আইনের আশ্রয়ে নয় সঠিক লক্ষ্যাদর্শেই শিক্ষার মুক্তি

আবুল মোমেন

সরকার কোচিং-টিউশনি এবং নোটবইয়ের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান থেকে পিছু হটে এলো। শিক্ষামন্ত্রী এ নিয়ে প্রায় জেহাদে নেমেছিলেন, কিন্তু বাস্তবতা, বা তারও চেয়ে বেশি, নোটবই ও কোচিং ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে, নমনীয় হতে বাধ্য হলেন।  বর্তমানে সংশোধিত যে খসড়া আইনটি মন্ত্রীপরিষদে গেছে তার যেটুকু পত্রিকায় পড়েছি (প্রথম আলো, ৭ নভেম্বর ২০১৬) তাতে বোঝা গেল এ আইনের আওতায় কোচিং, টিউশনি, নোটবই সবই বহাল থাকবে। অর্থাৎ কঠোর আইন করে এবং জেহাদ ঘোষণা করেও এগুলো বন্ধ করা যায় নি। যেসব কারণে আইন ও প্রচারণা সত্ত্বেও এসব বন্ধ করা যায় নি তা বিবেচনায় নিয়েই ব্যবস্থা নিলে ভালো হত।
সাধারণভাবে এ প্রশ্ন ওঠাই স্বাভবিক যে, একজন ছাত্রকে কেন তার পাঠের বিষয়গুলো বুঝতে পাঠ্যবই, শ্রেণিকক্ষের পাঠ ও বিদ্যায়তনের শিক্ষকের সহযোগিতার বাইরে আরও বাড়তি সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হবে? এটা স্বাভাবিক নয়। কিন্তু আমাদের দেশে স্কুল-শিক্ষা প্রবর্তনের আদিকাল থেকেই গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা ছিল। রবীন্দ্রনাথ ছেলেবেলা বইতে তাঁর সেজদা ছাড়াও এন্তার গৃহশিক্ষকের বর্ণনা দিয়েছেন। গল্প-উপন্যাসেও আমরা গৃহশিক্ষকদের কথা পাই। এঁরা সাধারণত  গ্রাম থেকে শহরে উচ্চ শিক্ষার জন্যে এসে সম্পন্ন গৃহস্থবাড়িতে থেকে সে বাড়ির ছেলেমেয়েদের পড়ানোর বিনিময়ে থাকা-খাওয়ার সংস্থান করতেন ও নিজের পড়াশুনা চালিয়ে যেতেন যা জায়গির নামে পরিচিত। ঊনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দুসমাজে আর বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে মুসলিমসমাজে এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে। প্রশ্ন তোলা যায়, গৃহশিক্ষকের প্রয়োজন হত কেন? শুরুতে সমস্যাটা ছিল এ ধরনের আনুষ্ঠানিক অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে অভিভাবকদের প্রত্যক্ষ পরিচয়ের অভাব। ফলে উচ্চতর শ্রেণির ছাত্ররা একাজে সহায়ক হতো, এবং বিনিময়ে তাদেরও আবাসন ও আহার্যের সংস্থান হত। তাছাড়া বিংশশতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত শহরে খুব সীমিত সংখ্যক পরিবারের বসবাস ছিল, কর্তারা মেসে বাস করে জীবিকা নির্বাহে অথবা জীবন উপভোগে সময় ব্যয় করতেন। তাই গ্রাম থেকে এনে সন্তানকে কোনো গৃহস্থ বাড়িতে থাকতে দিতেন। গ্রামীণ পরিবারে বহুকাল ধরেই স্কুলগামী শিশুরা ছিল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম প্রজন্ম। বাবা-মা তাদের দেখভালে অক্ষম ছিলেন এবং উপযুক্ত কাউকে, প্রায়ই নবীন কোনো শিক্ষককে, বাড়িতে থাকতে দিয়ে বা টাকার বিনিময়ে গৃহশিক্ষক হিসেবে রাখতেন।
গৃহশিক্ষকতা ব্যক্তির জন্যে সাময়িক পেশা হলেও এরকম কর্মপ্রার্থীর নিত্য চাহিদা ও জোগান থাকায় এর একটা ধারাবাহিকতা এ সমাজে বরাবর ছিল। বলা যায় এ পেশা আমাদের সামাজিক সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে যুক্ত।
বিষয়টা আমাদের দেশের ক্ষেত্রে জটিল এবং বিশিষ্ট হয়ে উঠল এ কারণে যে আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দুশত বছর অতিক্রান্ত হলেও আমাদের সমাজ শিক্ষা বা লেখাপড়া বা পঠনপাঠন কিংবা জ্ঞানার্জনকে এর - অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও এতদ্সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি, সনদপত্র ইত্যাদির - বাইরে জীবনের সাথে যুক্ত বা জীবনে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারে নি। শিক্ষা এক জীবনবিযুক্ত প্রক্রিয়া, এর একমাত্র লক্ষ্য ও মোক্ষ হল ডিগ্রি ও সনদপত্র, জীবনকে তাৎপর্যময়, আনন্দময় করে তোলার রসদও যে এখান থেকেই আসবে; এখান থেকেই মানুষটার ভাবনার জগৎ, বিবেচনার বোধ ও ক্ষমতা, ধৈর্য, মমতা, সহিষ্ণুতা, ঔদার্য, সহানুভূতি, সেবাপরায়নতা ইত্যাদি মানবিক গুণাবলী অর্জিত হবে তার ভাবনা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে আর নেই। একসময় শিক্ষা মহৎ আদর্শ লালন করত, শিক্ষকরা সে আদর্শের প্রতিভূ ছিলেন। এখন তাকে আমরা বেশিরকম বৈষয়িক বিবেচনায় বেঁধে ফেললাম।
এদিকে ছাত্রত্ব শেষ করার পর কাউকে তো আর বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষা দিতে হয় না, কিন্তু জীবনে পদে পদে বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, মানবিকতাসহ বিভিন্ন দক্ষতা ও মূল্যবোধের পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয়। সেসব পরীক্ষায় যে আমরা ভালো করছি না তা সমাজের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এর দায় শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা এড়াতে পারে না।
পরীক্ষা, পাঠ্যবই ও সিলেবাস এবং জিপিএ-৫ কেন্দ্রিক যে শিক্ষা তাতে কারো শিক্ষার্থী সত্তার কোনো গুরুত্ব নেই, সমস্ত জোরটা গিয়ে পড়ে পরীক্ষার্থী হিসেবে তার দক্ষতার ওপর। স্কুল (এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) পরীক্ষা ও পাঠ্যবইয়ের বাইরেও আরো নানা বিষয়ে ছাত্রকে অবহিত, আগ্রহী ও দক্ষ করে তোলার কথা। সেখানে সে খেলবে, মিশবে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি করবে, এবং স্কাউট-গাইড করবে, দেশ এবং  বিদেশের কথাও জানবে, কোনো কাজে যুক্ত হবে ইত্যাদি।
কিন্তু কী এক জাতিগত তাড়নায় সকলেই বুঝেছেন যে, শিক্ষার লক্ষ্য হল পরীক্ষায় ভালো ফল করা, ক্রমে তা-ই একমাত্র লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে! সেদিক থেকে স্কুলকে টেক্কা দিয়ে পরীক্ষার ফলার্জনের আর্থিক বাজারটি দখলে নিয়েছে কোচিং সেন্টার। স্কুল শিক্ষকরা স্কুলে মনোযোগ না দিয়ে ব্যাচ পড়ানোর দিকে মন দিয়ে শিক্ষাবাজার থেকে মুনাফা নিচ্ছেন। আর জায়গির ও গৃহশিক্ষকতা যাদের গতি হত তারা দল বেঁধে কোচিং সেন্টার দিয়ে শিক্ষাবাজারের সবচেয়ে সফল বণিকে পরিণত হয়েছে। এখানে শিক্ষার্থীরা কেবল পরীক্ষা দেয়, ওরা বলে মডেল টেস্ট। এভাবে ছাত্ররা দক্ষ দুরন্ত পরীক্ষার্থীতে রূপান্তরিত হয়।
এভাবে তারা ভালো ফলও করে, কিন্তু বিনিময়ে অর্থ ছাড়াও আরো মূল্য দেয়, তাহল তার পড়াশুনার ইচ্ছা, জ্ঞানার্জনের আগ্রহ, সেটা আদতে অংকুরেই ঝরে যায়, অবিকশিত থেকে যায়। সে সংবাদপত্র বা প্রচারপত্র ছাড়া আর কিছুই পড়তে পারে না। বই-পুস্তক পাঠে মনোযোগও দিতে পারে না, আনন্দও পায় না। আমরা এভাবে পাঠ্যবইয়ের বাছাই করা অংশের (কেননা দক্ষ কোচ নির্দিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকুর প্রশ্নের উত্তর শেখান) ভাসা ভাসা ধারণা নিয়ে শিক্ষিত জাতি গঠন করছি! আখেরে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চকচকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও অধূনা তরুণরা না পারে শুদ্ধ বাংলা শুদ্ধ ইংরেজি লিখতে, না পারে জাতির শ্রেষ্ঠ কৃতি সম্পর্কে বলতে কিংবা পারে না বিখ্যাত মনীষীদের কথা বা জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে ।
আমাদেরই ব্যবস্থার কারণে ছাত্র-অভিভাবক উভয়ের কাছেই স্কুলের চেয়ে কোচিং সেন্টারের গুরুত্ব বেড়ে গেছে। যেসব স্কুল ভালো ফল করছে খোঁজ নিলে দেখা যাবে তারাও কোচিং-এর অনুকরণে সাপ্তাহিক, মাসিক, বিষয়ভিত্তিক, অধ্যায়ভিত্তিক হরেক পরীক্ষার জালে ছাত্রদের বেঁধে রেখেছে। আইন দিয়ে এ ফলের লোভ আর পরীক্ষার মড়ক ঠেকানো যাবে না এবং এদের জ্বালানি নোটবইও বন্ধ হবে না। যদি শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য হয় পরীক্ষা তাহলে কেবল যে শিক্ষার উদ্দেশ্য খণ্ডিত সীমিত হয়ে পড়ল তা নয়, এই সংকীর্ণ কিন্তু লোভনীয় উদ্দেশ্যকে ঘিরে বাণিজ্য তৈরি হওয়া স্বাভাবিক, তৈরি করা সহজ। যদি ছাত্রের অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানবিক গুণাবলী-দক্ষতা অর্জনের দায়ও শিক্ষার ওপর থাকত তবে কোচিং সেন্টার বা গৃহশিক্ষক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে টেক্কা দিতে পারত না।
আমি যে বিষয়টি এখানে বলতে চাইছি তা কেবল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবেচ্য নয়, এটি হল জাতি গঠনের প্রশ্ন। আমরা কি পরীক্ষা পাশের সংকীর্ণ মাপকাঠির ভিত্তিতেই জাতিগঠন করব নাকি আরও ব্যাপ্ত পরিসরে মানুষকে বিবেচনায় নেব সেটি আগে ঠিক করতে হবে। পরীক্ষা পাশই যদি মাপকাঠি হয় তবে কোচিং-নোট বই ব্যবসা কখনো বন্ধ করা যাবে না। এটি জাতির জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়।
আমরা কি লক্ষ্য করছি শিশুরা পালে পালে যেসব কোচিং সেন্টারে ছুটছে সেগুলো একজাতের কারাগার, স্কুলগুলো হল বন্দিশালা আর বাড়িগুলো বহুতল ভবনে খাঁচার মত ঝুলে থাকে। আর মাঠ, অবসর, বন্ধুবান্ধব, যোগ্য নেতা, শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা ছাড়া শিশুরা কেবল পরীক্ষার ঘানি টানছে। শৈশবের জন্যে বড়দের কাছ থেকে একটু মায়া একটু সহানুভূতি দরকার, ভাবনা দরকার, পরিকল্পনা চাই। সেটা দিতে আমরা বড় কার্পণ্য করছি। সোনার ডিম পাড়ার জন্যে তৈরি হওয়ার আগেই হাঁসগুলোকে বন্ধ্যা করে দিচ্ছি।
প্রত্যেকের বাড়ির পরিবেশ ঠিক করা রাষ্ট্রের কাজ নয়, কিন্তু স্কুলের ভূমিকা ঠিক করা সম্ভব। তবে তার আগে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক করতে হবে। জাতিগতভাবে আমাদের বুঝতে হবে যে পাঠ্যবইয়ের বাছাই অংশের নোট পড়ে শিক্ষিত জাতি গঠন এবং যথার্থ মানুষ তৈরি করা সম্ভব নয়। বরং এই খণ্ডিত বিকৃত শিক্ষার বাইরে থেকে হয়ত মানুষ হওয়া সম্ভব।

মূল জায়গাটা ঠিক করে স্কুলকে সেভাবে গড়ে তুললে আপনিই মানুষ কোচিং-নোট বইয়ের পিছনে কড়ি ঢালবে না, শ্রম দেবে না। আর তারপরে শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্যটা শিশুদের জন্যে আরও সৃজনশীল সব উপকরণ ও কাজের চ্যালেঞ্জ ভিত্তিক হয়ে উঠবে, তাতে মেধাবীরা অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারবে। জাতি ও শিক্ষার নাভিশ্বাস থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।

***

Saturday, December 10, 2016

গা ভাসিয়ে নাকি গা লাগিয়ে পাব রোকেয়াকে?

আবুল মোমেন


বাংলাদেশে বেগম রোকেয়ার ভাবমূর্তি এখন উজ্জ্বল। হয়ত বলা যায় বাঙালি মুসলিম সমাজের তিনিই শীর্ষ নারী ব্যক্তিত্ব। তাঁর নামে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় আছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রিনিবাস হয়েছে, রাজধানীতে সড়কের নামকরণ হয়েছে তাঁর নামে। জনজীবনে বেগম রোকেয়া এভাবে প্রতিষ্ঠিত আজ।
বেগম রোকেয়ার সাহিত্যের বড় ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে আছে নারীর অবরোধমুক্তি। পর্দাপ্রথার আতিশয্যকে তিনি কষাঘাত করেছেন সাহিত্যে - বিশেষত অবরোধবাসিনীর পত্রে। দ্বিতীয় বিষয় ছিল ধর্মের নামে নারীর স্বাধীনতা ও অধিকার ক্ষুণ্ন করার বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ।
তবে বাংলাদেশে তাঁর জীবনের মূল ব্রত নারী শিক্ষার প্রসার আজ ঘটে চলেছে - এই ভেবে আত্মপ্রসাদ পাওয়া যেতে পারে। তবে এটি ঘটছে যুগের নিয়মে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কার্যক্রমের সাথে তাল মিলিয়ে। কিন্তু এ প্রশ্নটা না ভুললেই নয় - নারী, এবং ছেলেরাও, বর্তমান বাংলাদেশে যে শিক্ষা পাচ্ছে এবং শিক্ষা পেয়ে যেভাবে বড় হচ্ছে বেগম রোকেয়া কি তার কথাই ভেবেছিলেন?
আজ বাংলাদেশের সমাজমৃত্তিকায় জঙ্গিবাদ বীজ বপন করেছে, ধর্মান্ধতা শক্তিশালী হয়েছে এবং সাম্প্রদায়িকতা বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। রোকেয়া এসবের বিরুদ্ধেই লিখেছেন, বলেছেন এবং কাজ করে গেছেন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে স্বামীর কাছ থেকে প্রেরণা ও সহযোগিতা উভয়ই পেয়েছিলেন। সম্ভবত তাই নারী-পুরুষের সমতা ও অংশগ্রহণে সমাজের কল্যাণ তিনি দেখেছেন।
বাংলাদেশ নানামুখী পথে চলছে। তবে মুসলিম সমাজের বড় একটি অংশ নারীকে অবরোধবাসিনীই দেখতে চাইছে। যদিও একদিক থেকে প্রায় রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্নের রাজ্যের মতই আজকের বাংলাদেশ যেখানে প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিরোধী নেত্রী, সংসদের বিরোধী নেত্রী, সংসদের উপনেতা, স্পিকার, বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, উচ্চ আদালতের একাধিক বিচারপতি মহিলা তবুও আমরা জানি এটি রোকেয়া কল্পিত ও কথিত নারীস্তান নয়। রীতিমত পুরুষস্তান। রোকেয়া পুরুষতন্ত্রকে সমালোচনার হুল ফোটানোর জন্যেই এক নারীস্তানের কল্পলোক সৃষ্টি করেছিলেন - অবরুদ্ধ নারীর আর্তনাদ ও ফরিয়াদ যেন তাঁর  জোরালো লেখায় অন্যভাবে প্রকাশ পেয়েছিল।
আজ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে এত এত নারী, শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেয়েদের প্রাধান্য সত্ত্বেও বলতে হবে, সাধারণের সমাজে নারীর অবস্থান রোকেয়ার ভাবনাকে উপহাসই করছে। নারী নির্যাতন বাড়ছেই কেবল। নারীর নিরাপত্তা আজ সবচেয়ে ভঙ্গুর অবস্থায় আছে।
তাঁর স্বপ্নের পথ থেকে অপসৃয়মান এ সমাজে তবুও রোকেয়া স্মরণীয় ব্যক্তি, শ্রদ্ধেয় নাম, ইতিহাসের বরেণ্য চরিত্র। ব্যস এটুকুই। অর্থাৎ বাহ্য স্বীকৃতি দিয়েই আমরা খালাস। সমাজবাস্তবতা তো তাই বলে। তাঁর শিক্ষা গ্রহণ করছি না আমরা, তাঁর লক্ষ্য ও আদর্শ বাস্তবায়নে আমরা অপারগ।
রোকেয়ার সৃষ্ট সাহিত্য পাঠেই তাঁকে পাওয়া যাবে, রোকেয়ার জীবনেই মিলবে তাঁর জীবনাদর্শের শিক্ষা। কিন্তু এ সমাজে একালে যেন নাম নেওয়াই যথেষ্ট, আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপনেই দায়িত্ব শেষ হয়।
বেগম রোকেয়ার ভাবমূর্তি নতুন প্রজন্মের কাছে - যারা তাঁর নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয় পড়ে, ছাত্রী নিবাসে থাকে - কীভাবে পৌঁছায়, নির্মিত হয়? হয় কি? এ সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। যেটুকু ধারণা হয় তা হবে রোকেয়াকে লজ্জা দেওয়ার সামিল।
রোকেয়ার নি:স্বীকরণের মাধ্যমে এক নামসর্বস্ব রোকেয়াকে তৈরি করে নেওয়া হল কি? নামসর্বস্ব রোকেয়ার নামে জয়ধ্বনি দেওয়া সহজ। তাঁর বইয়ের পাতা খুললে, তা পড়লে, চিন্তার সাথে পরিচিত হলেই বিপদ। তাহলে নিশ্চিন্তে গা ভাসানো যাবে না। আমরা কি গা ভাসিয়েই চলব নাকি রোকেয়ার তুল্য না হলেও তাঁর অনুসারী হয়ে গা লাগিয়ে কাজ করে তাঁর ঋণ স্বীকার ও শোধ করব।


***

Sunday, November 20, 2016

গণতন্ত্র: আদর্শহীন ব্যবস্থা?

আবুল মোমেন

গণতন্ত্র আদর্শ হিসেবে হোঁচট খেয়েছে আর ব্যবস্থা হিসেবে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মানছি যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় এ ভাবনাগুলোকে হালনাগাদ করে দিয়েছে; তবে ভারতে নরেন্দ্র মোদীর বিজয় বা তুরস্কে এরদোয়ানের জুলাইয়ের ব্যর্থ অভ্যুত্থান-পরবর্তী কার্যকলাপ আগেই গণতন্ত্রকে কাঠগড়ায় তুলেছিল।
গণতন্ত্রের বাঁধা বুলি আমরা পাকিস্তান আমল থেকেই শুনে এসেছি। সত্যিই পাকিস্তান শাসিত হয়েছে স্বৈরাচারী কায়দায় - কখনো সরাসরি সাময়িক কর্তৃত্বে কখনো বেসামরিক ছদ্মবেশে। গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যূত্থানকে শেষ পর্যন্ত রণাঙ্গন অবধি টেনে আনতে হয়েছে সেই জগদ্দল ভাঙবার জন্যে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা এনেছি - মূল লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র ও অধিকারহীন পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক স্বাধীন দেশে বসবাস।
পাকিস্তান আমল আর নেই, সেকালের চেয়ে অনেক ভালো আছি তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু আমাদের চলমান গণতন্ত্রে আদর্শ গুরুত্ব হারিয়েছে, এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যথেষ্ট ঘাটতির মধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশ্ন হল, এর চেয়ে ভালো বিকল্প কি বর্তমান ব্যবস্থায় পাওয়া সম্ভব? যদি না হয়, তাহলে ব্যবস্থা পাল্টানোর প্রশ্ন উঠবে।
সেই প্রশ্নটা মাথায় রেখে আমরা যে তিন নেতার কথা গোড়ায় বলেছি তাদের প্রসঙ্গে একবার আসি। ট্রাম্প বিজয়ের জন্যে আমেরিকাকে আবার মহান বানানোর যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন তাতে আফ্রিকান-আমেরিকান, হিস্পানিক জনগোষ্ঠী, এশীয় এবং মুসলিম অভিবাসীদের প্রতিপক্ষ দাঁড় করিয়ে বস্তুত জনসংখ্যার ৭০ ভাগ শ্বেতাঙ্গ-মার্কিনিদেরই তাঁর পক্ষভুক্ত করতে চেয়েছেন। অর্থাৎ অভিবাসী-নির্ভর দেশটি যে ঐতিহ্যগতভাবে সব ধর্মবর্ণের মিলনপাত্র হয়েই মহান হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে তাকেই জবাব দিয়ে অর্থাৎ বিদায় করেই ট্রাম্পের মহান রাষ্ট্র তৈরি হবে! নরেন্দ্র মোদী ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে হিন্দুত্ববাদের জিগির তুলেই বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। এরদোয়ান তুরস্কের প্রশাসন ও জনজীবনে আধুনিক প্রগতিশীল অংশকে দুর্বল - সম্ভব হলে ধ্বংস - করে দেওয়ার জন্যে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সুযোগটাকে যে কোনোভাবে সর্বোচ্চ কাজে লাগাচ্ছেন।
এঁরা তিনজনই গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসেছেন - ট্রাম্পকে যদিও আরো দুমাস অপেক্ষা করতে হবে ক্ষমতা ভোগ করার আগে। ট্রাম্প মোদী এরদোয়ান নির্বাচিত হয়েছেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, ভোটারদের রায়ে, কিন্তু সে রায় পক্ষে পেতে তাঁরা প্রচারণায় যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন তা কি গণতান্ত্রিক আদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ?
বিষয়টা দাঁড়ালো এই যে, আদর্শের কোনো প্রয়োজন নেই, ব্যবস্থার ফায়দা যেভাবে আদায় করা যায় সেভাবেই করো। ফলে প্রচারণায় রাজনৈতিক আদর্শের কথা মূল্যহীন,. আক্রমণের বিষয় হতে পারে, ধর্ম, জাতি, সম্প্রদায়। এতকাল এসব ছিল অজুহাতের মত, কোনো ঘটনার প্রেক্ষাপটে আলোচিত বিষয়, যেমন টুইন টাওয়ারে হামলার জন্যে কতিপয় সন্ত্রাসী দায়ী যারা মুসলিম এবং মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ। ট্রাম্প কথার মারপ্যাঁচে যান নি, সরাসরি প্রতিপক্ষ কারা চিনিয়ে দিয়েছেন। এরদোয়ানও প্রতিপক্ষ ঘায়েল করতে গিয়ে নিজের স্বরূপও খুলে ধরেছেন। মোদী অত্যন্ত সুকৌশলে তাঁর গোপন এজেণ্ডা হিন্দুত্ববাদকে এখনো গণতন্ত্রের আবরণে ঢেকে চলেছেন। যদিও বলা যায় রাষ্ট্রে তাঁর কর্তৃত্ববাদী চেহারা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।
প্রশ্ন হল ব্যবস্থার ন্যায্যতার কী মূল্য যদি আদর্শের (এবং মূল্যবোধের) ন্যায্যতা টিকতে না পারে? আদর্শের অনুপস্থিতি কার্যত মূল্যবোধের অবক্ষয় ডেকে আনে। আর মূল্যবোধের ক্ষয় পাওয়ার অর্থ মনুষ্যত্বের গভীর সংকট সৃষ্টি হওয়া। সমাজে সেই সংকট নানাভাবে ফুটে উঠছে, কেবল আমাদের দেশে নয়, বিশ্বব্যাপীই তা চলছে।
দেখুন, আমরা আলোচনার নিজস্ব গতি ও পরিণতিতে কোথায় এসে পৌঁছেছি। কবুল করতে হচ্ছে যে গণতন্ত্র চলছে তাতে তো মনুষ্যত্বের সংকট তৈরি হচ্ছে। ভোটের মূল্যেই মানুষের মূল্য নির্ধারণ করে দিচ্ছে যে রাজনীতি তার নিজের কোনো মূল্যবোধ নেই।
এই রাজনীতি আদতে দেশ ও মানুষের সেবার অধিকারের সাথে কর্তৃত্বের চাবিকাঠিও বিজয়ীর হাতে তুলে দেয়। সেবা একটি মূল্যবোধ, তাই এর কেতাবী কিংবা আলংকারিক মূল্য আছে, কিন্তু প্রকৃত মূল্য হল ক্ষমতার এবং তা খাটানোর অধিকার কতটা ভোগ করা যাচ্ছে তার। তাই সব বিজয়ীই চায় প্রশ্নাতীত ক্ষমতা ও অবস্থান, অর্থাৎ জবাবদিহিতা-মুক্ত স্বাধীন অধিকার।
ট্রাম্পের পক্ষে মোদি বা এরদোয়ানের মত বেপরোয়া হওয়া সম্ভব হবে না বলেই ভাবতে চাই। কারণ প্রায় সোয়া দুশ বছরের আমেরিকান গণতন্ত্র অনেকগুলো সফল প্রতিষ্ঠান গড়েছে এবং সেই সাথে অনেক সচল প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধও তৈরি করেছে। সমাজে এসবের শিকড় যথেষ্ট গভীর, একজন ট্রাম্প একটি নির্বাচনে জয়ী হয়ে তা উপড়াতে পারবে বলে বিশ্বাস হয় না। ভারতেও মোদীকে অনেক ক্ষেত্রে আপস কিংবা গতি শ্লথ করতে হয়েছে, কারণ তাদের সামাজিক প্রতষ্ঠান ও নাগরিক সমাজের সবটা আপসকামী নয়, স্বাধীন অবস্থান রক্ষায় ও আদর্শিক লড়াইয়ে অনেকেই প্রস্তুত এবং তাতে শামিল হচ্ছেন।
তুর্কিরা পুরোনো যোদ্ধা জাতি, আবার তেমনি সমাজ সুপ্রাচীন সুফি-আধ্যাত্মিকতার ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। সেখানে কট্টরপন্থীদের ওপর অতিনির্ভরতার ফলাফল কী দাঁড়াবে বলা মুশকিল। তবে তাদের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য বেশ বিবর্ণ, আতাতুর্ক চেয়েছিলেন রাতারাতি আধুনিক ইউরোপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে। জবরদস্তি ছাড়া তা সম্ভব ছিল না। আর তাই তুরস্কের গণতন্ত্রের খুঁটি ছিল সামরিক বাহিনি, বা জেনারেলদের ইচ্ছাধীন!
এবার বোধহয় বাংলাদেশের দিকে চোখ ফেরাতে পারি। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার প্রয়াস হোঁচট খায় দুই তরফে - দলীয় লোকজনের ব্যক্তিস্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং জাসদের হঠকারী অতি বা প্রতি বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে তাঁকে, অনিচ্ছায় হলেও, বিশেষ ক্ষমতা আইনপ্রয়োগ করে কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকেই যেতে হল। এখন সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত, সরকার ও দলের অন্যদের ক্ষমতা-যোগ্যতার চেয়েও আনুগত্যের গুরুত্ব যে বেশি, তা স্পষ্টই বোঝা যায়। তদুপরি তাঁর জীবনও নিরাপদ নয়, তাঁকে বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনির বেষ্টনিতেই চলাচল করতে হয়। এ বাস্তবতায় আদর্শগত বিচারে নিশ্চয় গণতন্ত্রের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে।
শেখ হাসিনার দেশপ্রেম তর্কাতীত, মানুষের জন্যে ভালোবাসা নিয়েও কোনো প্রশ্ন নেই, হয়ত গণতান্ত্রিক আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রতি তাঁর অন্তরের শ্রদ্ধাবোধেও কমতি নেই।
যদি গণতন্ত্রকেই সাক্ষী মেনে প্রশ্ন করা যায় এ মুহূর্তে বাংলাদেশে তাঁর বিকল্প কে আছেন? না, অনেকের মনে যে নামটি রয়েছে সেই খালেদা জিয়াকে বলা যাবে না, ঠিক যেভাবে শেখ মুজিবের বিকল্প হতে পারেন না জিয়া - এও এখন সেরকমই। কারণ বাংলাদেশের নিয়তি পাকিস্তান হওয়া নয়, তাকে বাংলাদেশই হতে হবে। আমরা স্বপ্ন দেখি আমাদের বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠবে। তবে তারও চেয়ে জরুরি হল বাংলাদেশের স্বতন্ত্র স্বকীয় দর্শনটি স্পষ্ট করা যতে এদেশে রাজনীতির ভিত্তিরেখাটি স্পষ্টভাবে দাঁড় করানো যায়। কেবল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা একাত্তরের ইতিহাস স্বয়ংক্রিয়ভাবে এ কাজ করে দেবে না।
তবে তার আগে স্বীকার করতে হবে যে দেশ এবং বিশ্ব বর্তমানে এমন একটা ঘূর্ণিপাকের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে যখন গণতন্ত্রের আব্রূটুকু বাঁচানোকেই নেতারা যথেষ্ট ভাবছেন, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের কথা আপাতত তুলে রাখছেন। এ নিয়ে স্বভাবতই অনেকেরই অভিযোগের কমতি নেই। ঠিক আছে, কিন্তু সত্যিই যে ঘূর্ণিপাকে জেরবার হওয়া যুগান্তরেই আছি আমরা তা তো অস্বীকার করা যাবে না।  ঘূর্ণিস্রোতে বেসামাল তরণীতে একনায়কের উত্থান ঘটা অস্বাভাবিক নয়।
তাহলে, আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে এটা সত্যিই গণতন্ত্রের আকাল। আকালের গণতন্ত্র তার বৈভব দেখাতে চাইছে বৈষয়িক চাকচিক্যে, তারই বহর ও নহর দেখছি আমরা। এর প্রবাহে সারা দেশে গণতন্ত্রের ক্ষুদে ক্ষুদে অতন্দ্র প্রহরীরা যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে দখল বুঝে নিচ্ছে। গণতন্ত্রের আব্রূ রক্ষা হচ্ছে কিনা জানি না। কিন্তু বুঝি যে, জিয়াউর রহমানের ফর্মুলাই জয়ী হচ্ছে, রাজনীতি-রাজনীতিকদের জন্যে কঠিন হয়ে পড়েছে, প্রক্রিয়ার মধ্যে টিকে থাকার কৌশল হিসেবে বণিকদের রাজনীতিক জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন নয়ত নিজেরা বণিক হয়ে টিকে থাকার লড়াই করছেন।
অবশ্য গণতন্ত্র আদতে ক্ষমতার রাজনীতি নয়, অধিকারের রাজনীতি। সবার, বিশেষত দুর্বল ও প্রান্তিকজনের, আজকের দিনে গাছপালা, পশুপাখি, মাছ, কীটপতঙ্গ, এমনকি নদী-পাহাড়-জলাশয়ের অধিকার রক্ষার জন্যেও শর্ত আরোপ হতে পারে, কারো ক্ষমতার জন্যে নয়। এ অর্থে রাজনীতি ও গণতন্ত্রের পরিসর বাড়ছে।
আসুন, আমরা কথা ও কাজে এক হয়ে সবার অধিকার আদায়ের কথা ও কাজে নেমে পড়ি। সেটাই গণতন্ত্রের দাবি আমাদের কাছে।


                                                                          *****

Sunday, November 13, 2016

সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নিয়ে আগাম ভাবনা

আবুল মোমেন

চট্টগ্রাম শহরের জনসংখ্যার হিসেব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এক মত হতে দেখা যায়  না - ৪৫ থেকে ৬০ লাখ পর্যন্ত শোনা যায়। আমরা ধরে নিতে পারি ৫০ লাখ। একটা তথ্য দিয়ে কথাটা শুরু করি।
দু’মাস আগে গিয়েছিলাম পাশের ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায়। জনসংখ্যা ৬ লাখ। আমরা চট্টগ্রামের সঙ্গীত সংগঠন রক্তকরবীর অনুষ্ঠান করলাম রবীন্দ্রভবনের দুই নম্বর মিলনায়তনে। এই আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলে আসনসংখ্যা ৬শর বেশি। ভবনের প্রধান হলের ধারণ ক্ষমতা এগারশর বেশি। রাস্তার বিপরীত দিকে আছে সুকান্ত একাডেমি। তাতে ৩৫০ আসনের আধুনিক মিলনায়তন ছাড়াও লাইব্রেরি, গ্যালারি রয়েছে। পাঁচ বছর আগে ওখানে সেমিনার করেছিলাম রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবাষির্কী উপলক্ষে। এর বাইরে আছে নজরুল কলাক্ষেত্র - এই আধুনিক মিলনায়তনটিতে আসন সংখ্যা নয়শ। টাউন হলও বেশ ভালো। পুরোনো রাজবাড়িতে জাদুঘরের পাশাপাশি সংস্কার করে আধুনিক মিলনায়তনও তৈরি হয়েছে।
একটি শহরের নাগরিক জীবনে সুস্থ আনন্দ ও বিনোদনের জন্যে আধুনিক মিলনায়তন অপরিহার্য। মিলনায়তনের সংখ্যা, সুযোগ-সুবিধা ও তার মান দেখে বোঝা যায় নগরটি সাংস্কৃতিকভাবে অত্যন্ত জীবন্ত।
আগরতলার চেয়ে জনসংখ্যার বিচারে প্রায় আট গুণ বড় চট্টগ্রাম শহরে একটি মাত্র আধুনিক মিলনায়তন আছে, থিয়েটার ইন্সটিটিউট, যার আসনসংখ্যা মাত্র ২৮০। এছাড়া শিল্পকলা একাডেমির কিছু সংস্কার ও আধুনিকায়ন হয়েছে। কিন্তু আসন সংখ্যা সেই ৩০০-৩৫০।
এককালে যখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মিলনায়তনের রেওয়াজ ছিল না তখন চট্টগ্রামে অন্তত ৪টি মিলনায়তন বেশ চালু ছিল - মুসলিম হল, ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউট, ওয়াপদা মিলনায়তন, জেমসেন হল। এছাড়া সেন্ট প্লাসিডস্ ও সেন্ট মেরিজ স্কুলের মিলনায়তনও বিভিন্ন সময়ে নাটকসহ সাংস্কৃতিক কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এসব মিলনায়তনে তখন নিয়মিত নাটক ও বিচিত্রানুষ্ঠান হত। বর্তমানে দুটি মাত্র মিলনায়তন চালু থাকলেও তাতে কিন্তু প্রতি সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান থাকে না। অন্যান্য হল, মুসলিম হল, জেমসেন হল, ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউটের ব্যবহার আর তেমন হয় না। বলা যায় নগরে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে ভাঁটা চলছে। এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মিলনায়তনগুলোতেও আগের মত সাংস্কৃতিক কার্যক্রম হয় না। শুনেছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মোজাম্মেল স্মৃতি মিলনায়তনটি অব্যবহার্য পড়ে থাকতে থাকতে তার মেঝেতে ঘাস গজিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত হলটি পরিত্যক্তই হয়েছে কি?
সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের এই ভাঁটার কালে এখানকার ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোও ধুঁকে ধুঁকে চলছে। অধিকাংশ নাটকের দল নামসর্বস্ব - কালেভদ্রে মঞ্চে নাটক করে।
চট্টগ্রাম বেতার ও টেলিভিশনও মান বজায় রেখে চলতে পারছে না। এই বাস্তবতায় মেধাবী তরুণ শিল্পীরা সকলেই ঢাকামুখী হয়ে পড়েছে। এর ফলে ঢাকার বাইরে সারাদেশের সবকটি জেলা শহরই সাংস্কৃতিকভাবে ক্ষয়িষ্ণু, প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম দেশের প্রধান বন্দর নগরী হিসেবে গড়পড়তা সবার মধ্যে থাকার কথা নয়, এটা চট্টগ্রামের দুর্ভাগ্য।
আজকে জঙ্গিবাদের উত্থানের ফলে সকলেই উপলব্ধি করছেন যে দেশের সব জেলায় সর্বত্র সাংস্কৃতিক উজ্জীবন প্রয়োজন। সে হিসেবে দেশের দ্বিতীয় প্রধান নগরী ও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের দিকে সবার মনোযোগ দেওয়া দরকার।
আশার কথা সরকার অর্থাৎ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় মুসলিম হল ও শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে একটি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স হলে ভালো হয়। এখানে একটি অন্তত হাজার আসনের মূল মিলনায়তন, একটি চারশ আসনের নিরীক্ষামূলক নাটকের হল, একটি তিনশ আসনের সেমিনার হল, একটি একশ আসনের লেকচার হল, একটি প্রদর্শনী কক্ষ, একটি নগর জাদুঘর, একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনী কক্ষ, একটি সংস্কৃতি বিষয়ক লাইব্রেরি এবং একটি সাংস্কৃতিক আর্কাইভ থাকলে ভালো হয়। তাছাড়া বেশ কিছু মহড়া কক্ষ, সভাকক্ষ থাকতে পারে। সম্ভব হলে জনা বিশেকের সাংস্কৃতিক দল থাকার উপযোগী ডরমিটরি, চারজন বিশিষ্ট ব্যক্তি থাকার মত অতিথি কক্ষ থাকা দরকার। আর থাকবে ভালো মানের কেন্টিন।
আমরা আশা করব চট্টগ্রামকে বুঝ দেওয়ার মত কোনো সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স-এর কথা সরকার ভাবছেন না। একটি বিকাশমান আধুনিক নগরীর চাহিদা বিবেচনা করেই এটি তৈরি হওয়া দরকার।
প্রধান মিলনায়তন ও নাট্য মিলনায়তন এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে ব্যালে নৃত্যসহ বিদেশি সাংস্কৃতিক দলের অনুষ্ঠান ও অত্যাধুনিক নিরীক্ষামূলক নাটক এতে মঞ্চায়ন করা সম্ভব হয়।
এটিকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম যেন সাংস্কৃতিকভাবে জেগে ওঠে সেটাই চট্টগ্রামের মানুষের মাথায় রাখা দরকার। কেবল স্থাপনা বা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কিছুই হবে না যদি না স্থানীয় মানুষ মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করে কমপ্লেক্সকে চাঙ্গা রাখতে পারেন, নাগরিকদের সুস্থ বিনোদন দিতে পারেন।
এটি পরকিল্পনার জন্যে যোগ্য ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিতে হবে। মূল একজন পরিচালক ছাড়াও নাটক ও সঙ্গীত বিভাগের দু’জন উপ-পরিচালক থাকতে পারেন। এছাড়া প্রয়োজনীয় অফিস স্টাফ তো থাকবেনই। 
শেষ কথা হল কেবল ভবন তৈরি করলে চলবে না, এখানে বছরব্যাপী কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দও থাকতে হবে। নয়ত অনেক অর্থের বিনিয়োগ অনর্থক হয়ে যাবে। কারণ নিজস্ব আয় দিয়ে উন্নত মানের সংস্কৃতি চর্চা সম্ভব নয়। পৃথিবীর কোনো দেশেই তা হয় না এর জন্য সবসময়ই ভর্তুকির প্রয়োজন হয়। এ বিষয়টি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।

****


Wednesday, November 9, 2016

শিক্ষাকে বলি দিয়ে শিক্ষার বিস্তার?

আবুল মোমেন

প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা থাকছে - শিক্ষামন্ত্রীর কথায় অন্তত তাই মনে হচ্ছে। শিক্ষাবিদদের চাপাচাপিতে সরকার  একবার এ পরীক্ষাটি বন্ধ করার কথা বলেও আবার মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তে তা বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বছরের জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা মাত্রই শেষ হয়েছে। এর পরে নিশ্চয় উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
সরকারকে শিক্ষায় ধনী-মধ্যবিত্ত-দরিদ্র, মহানগর-মফস্বল-গ্রাম-চরাঞ্চল-পার্বত্য এলাকাবাসী ইত্যাদি সকল পর্যায়ের নাগরিকের অন্তর্ভুক্তির বিষয় মাথায় রাখতে হয়। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় একবার আমাকে বলেছিলেন পরীক্ষাকে সরকার একটি উৎসবে রূপ দিতে পেরেছে এবং  দেখা যায় গ্রামাঞ্চল-চরাঞ্চলের শিশুরাও অভিভবকদের সাথে হেঁটে, ভ্যান বা রিকশায় দল বেঁধে সেজেগুজে পরীক্ষার হলে যায়। এই উৎসবের আমেজ তাদের উৎসাহ বাড়ায়, ভয় দূর করে এবং সব মিলে শিক্ষা বিস্তারে সহায়ক হয়। তাছাড়া এখনও অনেক ছেলেমেয়ে, বিশেষত মেয়েশিশু, প্রাথমিকেই ঝরে যায়। পরীক্ষা এবং সনদপত্র তাদের অন্তত এটুকু পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রমে ধরে রাখতে সহায়ক হবে।
তাঁর কথায় যে সত্যতা নেই তা নয়। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পরিবর্তে তারা একটি পাব্লিক পরীক্ষা দিচ্ছে এবং সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকলের চেষ্টায় তাতে উৎসবমুখর পরিবেশও সৃষ্টি করা গেছে। তাহলে অসুবিধাটা কোথায়?
শিক্ষায় সনদপত্র একটি নগদপ্রাপ্তি, এর কিছু মূল্য হয়ত জীবনে কখনও মিলতেও পারে - যদিও ইদানীং কোনো প্রাতিষ্ঠানিক চাকুরি কেবল প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা পাশের সনদ দিয়ে জোটে না। তার জন্যে নিদেনপক্ষে জেএসসি সনদপত্র  লাগবে। দিনে দিনে সেটারও মূল্য থাকবে না। বাস্তবতা হল এখন ডিগ্রি পাস করেও অনেকে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকুরি করছেন। চাকুরির বাজার সম্প্রসারিত হলেও বাস্তবতা এরকমই থাকবে।
শিক্ষার মূল কাজ তো সনদপত্র অর্জন নয়, প্রাথমিক বা নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ে তা তো নয়ই। এমনিতেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বড় দুর্বলতা হল এর পরীক্ষাকেন্দ্রিকতা। পরীক্ষাকে ঘিরেই পড়াশুনার আয়োজন চলতে থাকায় ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক ত্রয়ী মিলে পরীক্ষা-উপযোগী বা পরীক্ষাবান্ধব একটা ব্যবস্থা দাঁড় করিয়েছে। পিএসসি ও জেএসসি এই প্রবণতাকে জোরদার করেছে।
পরীক্ষার ভিত্তিতে পড়াশুনা চলতে থাকলে তার ফলাফল কী হয় সেটা আমরা বাস্তবেই হাতে হাতে পাচ্ছি। আমি দেশের বিভিন্ন পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান ভর্তি পরীক্ষার ভয়াবহ ফলের ওপর জোর দেব না। এটি একটি  চরম বাণিজ্যিক এবং অমানবিক ব্যবস্থা, এটি ভর্তিচ্ছুক ছাত্রের  মেধা ও যোগ্যতা যাচাইয়ের কার্যকর মাধ্যম নয়। এতে গোড়া থেকেই বাদ দেওয়ার কৌশল গুরুত্ব পায়, অবজেক্টিভ প্রশ্নের এক ঘণ্টার পরীক্ষায় উচ্চ শিক্ষার প্রস্তুতি বোঝাও মুশকিল।
তবে মাঠ পর্যায়ে জরীপের মাধ্যমে প্রাথমিকের অর্জন মান যাচাইয়ের যে কাজ ক্যাম্পে ও সরকারের উদ্যোগে হয়েছে তার ওপর নির্ভর করা যায়। এতে দেখা গেছে অর্জন মান সন্তোষজনক, ছাত্রদের বড় অংশ - শতকরা ২৫ ভাগ থেকে ৫০ ভাগ - মাতৃভাষা ও গণিতে দুর্বল, ইংরেজিতে তো বটেই। আমরা বাস্তবক্ষেত্রে পরীক্ষা করে দেখেছি সরকারি প্রাথমিকে অর্জন মানের অবস্থা শোচনীয় - ভাষা, গণিত এবং সাধারণ জ্ঞানে বয়সের তুলনায় মান অনেক কম।
আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করার মত। ইদানীং দেশের শিল্প ও বাণিজ্যিক উদ্যোক্তারা বিশেষজ্ঞ ছাড়াও ব্যবস্থাপক, তত্ত্বাবধায়ক হিসাবরক্ষকের মত মাঝারি স্তরে বিদেশিদের নিয়োগের দিকে ঝুঁকেছে। ভারত, শ্রীলঙ্কা, এমনকি পাকিস্তান থেকেও অনেকেই এ ধরনের চাকুরিতে আসছেন। অন্য একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার বাড়ছে।
শিক্ষার মান আসলেই যে কমেছে তা বোঝা যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানের অবনতিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের উচ্চ শিক্ষার মুখ্য প্রতিষ্ঠান। বিশ্বে এর অবস্থান পাঁচশ-র মধ্যেও নেই। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা - সম্ভবত একমাত্র বুয়েট ব্যতীত - আরও তলানিতে রয়েছে। গবেষণার সংখ্যা ও মান, গবেষণা পত্রিকার স্বীকৃতি ধরলেও আশাব্যঞ্জক কিছু পাওয়া যায় না।
এসব তথ্য ও বক্তব্যের অর্থ অবশ্য এ নয় যে আমাদের ছাত্রদের মেধা ও মান খারাপ। না তা নয়। তা যে নয় তার প্রমাণ আমাদের তরুণরা দেশে ও বিদেশে অহরহ দিচ্ছে। কিন্তু দেশের প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ক্রমেই সেই সুযোগ কমে আসছে।
মূলধারার উচ্চ শিক্ষা যেভাবে চলছে তাতে ছাত্রদের বড় অংশ নিজের পছন্দের বিষয় পড়ার সুযোগ পায় না। ফলে তারা গোড়া থেকেই অনিচ্ছুক ও উদাসীন ছাত্র। তাদের একমাত্র লক্ষ্য থাকে কোনোভাবে এম. এ. পাশ করে সর্বোচ্চ ডিগ্রির সনদ অর্জন। তাদের লেখাপড়া সীমাবদ্ধ থাকে আসন্ন পরীক্ষার সম্ভাব্য পাঁচ-ছটি প্রশ্ন জানা, তার উত্তর মুখস্থ করার মধ্যে। এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে উচ্চ শিক্ষার যে উদ্দেশ্য - পুঙ্খানুপুঙ্খ জানা, বিশ্লেষণ করতে শেখা এবং নতুন ধারণা ও ভাবনা উপস্থাপন - তার কোনো অবকাশ এখানে থাকে না। পরীক্ষার বাইরে ছাত্রের তেমন কিছু করার নেই, জ্ঞান বা মনন চর্চার বিভিন্ন উপায়ের সাথে তাদের পরিচয় ঘটে না। ফলে আড্ডা, নেশা, অপরাজনীতি, মেয়েদের পেছেনে লাগা ইত্যাদি বিচিত্র ক্ষয়িষ্ণু কাজে তাদের তরুণ্য বয়ে যায়। এটি জাতীয় অপচয়।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয় - যা তিনি নিজের শিক্ষা সম্পর্কে বলেছিলেন - আমাদের শিক্ষার প্রায় সবটাই লোকসানি মাল। সরকার এবং বিশ্বব্যাংক-এডিবিসহ বিদেশি অনেক সংস্থা শিক্ষাখাতে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে বেশ অনেক বছর ধরে। তাতে স্কুলের ঘরবাড়ির উন্নতি হয়েছে, বিনামূল্যে উন্নত মুদ্রণের ভালো বই দেওয়া সম্ভব হচ্ছে, ছাত্রীদের উপবৃত্তি  ও স্কুল পোশাক দেওয়া হচ্ছে, সীমিত আকারে দুপুরের খাবার চালু হয়েছে, বাথরুম-পানি সরবরাহের উন্নতি হচ্ছে, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত আগের চেয়ে ভালো, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণও বেড়েছে। কিন্তু এসব উন্নয়নের ফলাফল শিক্ষায় দৃশ্যমান হচ্ছেনা। আমি বলব, নিচের পর্যায় থেকেই শিক্ষাকে পরীক্ষা-কেন্দ্রিক করে রাখার ফলেই এই বিপুল আয়োজন, শ্রম  এবং ব্যয়ের যথার্থ সুফল আমরা পাচ্ছি না।
পরীক্ষার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে যে ব্যবস্থা তা চালু রেখে শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানোর প্রবণতা, কোচিং সেন্টারের দৌরাত্ম্য এবং নোটবইয়ের রমরমা ব্যবসা বন্ধ করা যাবে না। কারণ ছাত্রদের অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার দায়িত্ব নেন না, হয়ত বাস্তব কারণ আছে তার। প্রথমত, আমাদের প্রাথমিকের ছাত্রদের বড় অংশই শিক্ষাবঞ্চিত বা স্বল্পশিক্ষিত বাবা-মায়ের সন্তান যারা সন্তানের শিক্ষার প্রস্তুতিতে সাহায্য করতে পারেন না। তদুপরি শিক্ষিত-শিক্ষা বঞ্চিত সকল বাবা-মা বাড়তি উপার্জনের চাপে থাকেন নয়ত কর্মক্লান্ত হয়ে ফিরে আর সন্তানকে সময় দিতে চান না। গৃহ-শিক্ষক বা কোচ নিজের কৃতিত্ব প্রকাশের একমাত্র উপায় হিসেবে পান পরীক্ষার ফলাফলকে যা তাঁর যোগ্যতা-দক্ষতার জ্বলজ্বলে প্রমাণ হাজির করতে পারে। এ প্রক্রিয়া একদম প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু হয়ে উচ্চতর স্তরেও চলতে থাকে।
এটি বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, এভাবে ছাত্রদের মৌলিক চিন্তার ক্ষমতা, সবরকম সৃজনশীলতা নষ্ট তো হয়ই উপরন্তু তাদের আত্মবিশ্বাস, যোগ্যতা দক্ষতারও ঘাটতি থেকে যায়।
কেন ঘাটতি থাকে তা বোঝাও কঠিন নয়। পরীক্ষার পড়া হয় প্রশ্নের ভিত্তিতে - সম্পূর্ণ একটি গল্প, অধ্যায় বা ধারণার সাথে পরিচয় এতে গুরুত্ব পায় না, গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ঐ পরীক্ষাটিতে নির্দিষ্ট গল্প বা অধ্যায় থেকে কোন প্রশ্নটি আসতে পারে সেটি। দক্ষ কোচরা বিভিন্ন বছরের প্রশ্ন ঘেঁটে সেটি বের করেন এবং সেই প্রশ্নের তাঁদের তৈরি উত্তরটি ছাত্রকে শেখান। পরীক্ষার ভালো ফলেই যেহেতু মোক্ষ তাই এ ধরনের সফল শিক্ষক ও কোচিং সেন্টারের ওপর অভিভাবকদের আস্থা বাড়ছে এবং তা এখন স্কুলের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকরাও এতে আর্থিকভাবে লাভবান হন, ফলে তাঁরাও তাই চান। শিক্ষা বলতে ক্রমে পরীক্ষাই একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠেছে - কোচিং সেন্টারগুলো এবং তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে সফল স্কুলগুলোও অনবরত বছর জুড়ে মডেল টেস্ট নিতে থাকে। এভাবে ছাত্ররা পরীক্ষা-দক্ষ হয়ে ওঠে।  যত অন্ধ আনুগত্যে ছাত্ররা এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে ততই তারা নিজের, বাবা-মার, স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করবে। যদিও - আবারও রবীন্দ্রনাথের ভাষায় - শিক্ষার হদ্দমুদ্দ সারা হয় ততদিনে।
পরীক্ষাকে যতই উৎসবের রূপ দেওয়া হোক না কেন নিরন্তর পরীক্ষার ড্রিলের ভিতর দিয়ে জীবনের প্রস্তুতিপর্ব পার করে একজন তরুণ শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে - সে শৈশব থেকেই একজন পরীক্ষার্থী, শিক্ষার্থী নয়। বরং যখন তার শিক্ষাজীবন শেষ হয় তখন দেখা যায় তার জ্ঞান ভাণ্ডারে তেমন সঞ্চয় জমে নি। কারণ চাপের মধ্যে সে মুখস্থ বা বারংবার অভ্যাস করে যে বিদ্যা আয়ত্ব করেছে তার সাথে আত্মবিকাশ-আত্মপ্রকাশের তেমন সম্পর্ক না হওয়ায় পরীক্ষার পর শেখা বিষয়গুলো তাদের কিছুই মনে থাকে না। আজকাল দেখা যায় প্রথম শ্রেণির পড়া দ্বিতীয় শ্রেণিতে আসতে আসতে অনেকটাই ভুলে যায় শিশুরা। জ্ঞান যে একদিকে পুঞ্জিভূত হয় আর অন্যদিকে তার ব্যবহারে জানা-বোঝা তথা আলোকনের একটি প্রক্রিয়ায় মানুষটা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে তা আর হতে পারে না। ছাত্রদের থুড়ি পরীক্ষার্থীদের জানার, পড়ার, বোঝার আগ্রহ নষ্ট হয়ে যায়, ফলে অধিকাংশ মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরে কোনো বই পড়ার তাগিদ বোধ করেন না। অনেকে দীর্ঘক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন না, অনেকে আবার বিষয়, ভাবনা বা ধারণার জটিলতায় খেই হারান, বিশ্লেষণের ঘূর্ণিপাকে অনেকেরই পড়ার আগ্রহ তলিয়ে যায়। আমাদের শিক্ষা তার ব্যবস্থার গুণে ছাত্রের পড়ার আগ্রহ অংকুরেই নষ্ট করে দেয়।
এভাবে সরকারের ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মেধাভিত্তিক সমাজ তৈরি করা সম্ভব হবে না। এভাবে বিপুল অর্থ এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের শৈশব থেকে তারুণ্য এবং প্রতিভা ও মেধার অপচয় হতে দেওয়া কি ঠিক? শিক্ষার বিস্তার চলছে ঠিকই, তবে তার মূল্য শুধছি শিক্ষাকেই বলি দিয়ে।


****

Thursday, November 3, 2016

জেলহত্যার প্রেক্ষাপটে

আবুল মোমেন


কাল সারাদেশে জেলহত্যা দিবস পালিত হবে। এদিন বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের হাতে জেলে বন্দী চার জাতীয় নেতা নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন। এক রাতে একই বর্বর আক্রমণের শিকার তাঁরা। মৃত্যুর এই ঘটনা যেন তাঁদের এক সূত্রে গেঁথে দিয়েছে। তাঁরা চারজনই বঙ্গবন্ধুর অনুসারী ও সহকর্মী, জীবনের শেষপর্বে খুনী মোশতাকের সকল হুমকি অগ্রাহ্য করায় তাঁরা খুনীদের কাছ থেকে একই রকম ঘৃণা ও ভীতি অর্জন করেছিলেন। আর তাদের হাতে একই ভাগ্য তাঁরা অর্জন করেছিলেন। ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডির পর যখন অনেক প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা মোশতাকের সহকর্মী হয়েছেন তখন তাঁরা কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মর্যাদা রক্ষা করেছেন। যারা আপোস করেননি তাদের নেতা হিসেবে এই চারজন খুনীদের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হলেন। এটা বীরত্ব ও ত্যাগের মহান উদাহরণ। সেদিক থেকে সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দিন আহমেদ, মনুসর আলী ও কামরুজ্জামান আমাদের জাতীয় নেতাই শুধু নন, জাতীয় ইতিহাসের চার নায়কও বটে। বঙ্গবন্ধু যদি মহানায়ক হয়ে থাকেন তাহলে এঁরা নায়ক।
’৭৫-এর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তন ও সেই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় আদর্শের পরিবর্তন হলেও দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা নিশ্চিহ্ন করা যায় নি। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক অঙ্গনে বরাবর সক্রিয় ছিল, ‘৮১ তে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা দলের হাল ধরার পর ধীরে ধীরে এই রাজনীতি তার ভিত্তি ফিরে পেতে থাকে। সেই সঙ্গে পেশাজীবী এবং শিল্প-বুদ্ধিজীবীগণ একযোগে মাঠে নামার পর পরিস্থিতি পুনরায় অনুকূল হয়। আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় রয়েছে। এ সময় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার যেমন হয়েছে তেমনি জেলহত্যার বিচারও কাম্য। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকারও সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। এটা খুবই আশার কথা।
দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর দলের নেতৃত্ব দিয়ে আর তিন দফা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে শেখ হাসিনা আজ অনেক পরিণত, আত্মবিশ্বাসী। তিনি যেমন একদিকে দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন তেমনি অন্যদিকে ইতিহাসের যাত্রাপথ কলঙ্ক মুক্তও করে চলেছেন। ফলে জাতি তাঁর কাছ থেকে রাষ্ট্রনেতা হিসেবে অনেক চমকপ্রদ সাহসী ভূমিকার পাশাপাশি ঐতিহাসিক ভূমিকা প্রত্যাশা করে।
আইনগত বিচারের পাশাপাশি এই ঘটনা ও এতে শহীদ চার নেতার রাজনৈতিক মূল্যায়নও একান্ত প্রয়োজনীয়। ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবসটি মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বদানকারী চার নেতার মৃত্যু দিবস হিসেবে জাতীয়ভাবে পালিত হওয়া উচিত। বস্তুতপক্ষে সাত নভেম্বর নয় ৩ নভেম্বরই ছুটি থাকা উচিত, এবং দিনটি জাতীয় নেতা হত্যার দিবস হিসাবে পালিত হওয়া উচিত। সাতই নভেম্বর বরং মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস হিসেবে পালিত হতে পারে আলোচনা সভা, সেমিনার ইত্যাদির মাধ্যমে।
১৯৭১-এর দিনগুলোর কথা স্মরণ করে আমরা প্রবাসী সরকারের প্রাণপুরুষ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা জানাব।
সেই সঙ্গে বলবো, বিশাল ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের জন্যে তাজউদ্দিন আহমেদ বিশেষভাবে স্মরণীয় ব্যক্তি। বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা, স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা ও অনুপস্থিত থেকেও তাঁর দৃঢ়তা, সাহস ও ত্যাগের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, আর তাজউদ্দিন আহমদ আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের রূপকার। এই মেধাবী সাহসী স্থিতধী দেশপ্রেমিকের আরো ব্যাপক মূল্যায়ন ও স্পষ্ট স্বীকৃতি পাওয়া উচিত ছিল। এ কথা দূর থেকে বলা ঠিক হবে কিনা জানি না, কিন্তু তবু মনে হয়, দীর্ঘদিন খুব কাছাকাছি থেকে দেখার ফলে মনে হয় যে, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী স্তরেও বিষয়টি যেন পরিষ্কার নয়। তাজউদ্দিন আহমেদের নাম আওয়ামী লীগ অঙ্গনে সাধারণত জেলহত্যা প্রসঙ্গেই উঠে থাকে ও আলোচিত হয়। চার জাতীয় নেতার কাউকে ছোট না করেও বলব কেবলমাত্র তাঁদের একজন হিসেবেই তাজউদ্দিনের নাম উচ্চারিত হলে তাঁর প্রতি সুবিচার হয় না। এখন মৃত্যুর প্রসঙ্গেই যেন তিনি একমাত্র স্মরণীয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের কথা ভেবে আমরা কি বলবো না মৃত্যুর চেয়ে তাঁর জীবন অনেক বড়ো ও সার্থক। যে মানুষটা প্রায় এককভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের, তাঁর সে মূল্যায়ন আজও বাকি রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের তরফ থেকে কিছু কিছু কাজ যে একদম হয়নি তা নয়, কিন্তু আওয়ামী লীগকেও তো নেতৃবৃন্দের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। স্থানান্তরের পর আজ ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা স্মরণে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের সেই কক্ষকে জাতীয় স্মারক হিসেবে গণ্য করে রক্ষাণাবেক্ষণ করার ব্যবস্থা হয়েছে। তবে এর বাইরে জেলহত্যায় নিহত নেতাদের স্মরণে একটি স্মৃতি স্তম্ভ হতে পারে ঢাকার কোথাও। আর মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্বদানের জন্য তাজউদ্দিনের নামে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠান ও কোনো স্মারক নির্মিত হতে পারে। 
আরেকটি কথা এই প্রসঙ্গে বলতে চাই বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধুর নামে বিশ্বশান্তি ও সমঝোতার ক্ষেত্রে অবদানের জন্য একটি দ্বিবার্ষিক আন্তর্জাতিক পদক প্রবর্তন করতে পারেন। সেই সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমেদের নামে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিসংগ্রামে অবদানের জন্য সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে একটি আঞ্চলিক পদক প্রবর্তন করা যায়।
আর, সকল রকম ধোঁয়াটে অবস্থা ও বিভ্রান্তি থেকে সকলের ভাবমূর্তি, বিশেষত তাজউদ্দিন আহমেদের ভাবমূর্তি, স্পষ্ট করে তোলা দরকার - যে কাজ আওয়াগী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করলে ভালো হয়।


***

Tuesday, November 1, 2016

চরিত্রহীন সমাজের বিকৃতি

আবুল মোমেন


দিনাজপুরের নিতান্ত শিশু পাঁচ বছরের পূজার ওপর যে বর্বর অত্যাচার হয়েছে তা যে কোনো বিবেকবান মানুষকেই ঘা দিয়েছে। এক নিষ্পাপ শিশুর ওপর এমন মর্মান্তিক আঘাত এদেশে আরও অনেক হয়েছে। প্রতিবারই সচেতন মানুষ শিহরিত হয়েছেন, এবং দোষী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। তবে সময় সবকিছুকেই ভুলিয়ে দেয়, আর আমাদের মত সমস্যাসঙ্কুল সমাজে মানুষের স্মৃতি, বিবেক, দায়িত্ববোধ সবই সংকট ও সময়ের প্রহারে প্রখরতা হারিয়ে দ্রুত অসাড় হয়ে যায়। আবার কোনো বীভৎস ক্রুঢ়তা তাকে জাগিয়ে তোলে। বলা বাহুল্য সেও অল্প সময়ের জন্যে, কিংবা বলা যায় নতুনভাবে ঘুমিয়ে পড়াতেই এই জেগে ওঠার একমাত্র সার্থকতা।
শিশুটির ওপর বিকৃত যৌন আক্রমনের জন্যে অভিযুক্ত ব্যক্তি সাইফুল ইসলাম তাদের প্রতিবেশী, তিন সন্তানের জনক যাদের দুজন কন্যা সন্তান এবং তাকে অবোধ শিশুটি নিশ্চিন্তে বড় আব্বু বলে সম্বোধন করত। এ ঘটনায় নাড়া খেয়ে আমাদের দায়িত্ব সচেতনতা যদি কেবল দোষীদের পাকড়াও করার, কঠোর শাস্তি প্রদানের দাবি আর সাধারণভাবে মূল্যবোধের অবক্ষয়, তারুণ্যের দিশাহীনতা, সামাজিক অস্থিরতা ইত্যাদি লক্ষ্যহীন অসার বুলিতে শেষ হয় তবে সমাজের অবক্ষয় ও অসাড়তারই প্রমাণ মেলে।
এই অবস্থার জন্যে ঢালাওভাবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অবক্ষয়, শিক্ষা-সংস্কৃতির ব্যর্থতাকে দায়ী করা যায়। কিন্তু এতো শ্লোগান বিশেষ, যা সবাই বলছে, এবং শিখে নিয়ে সবাই বলতে সক্ষম। যে অপরাধকে পৃষ্ঠপোষকতা করে, যে স্বয়ং অপরাধকর্মে লিপ্ত হয় সকলেই এসব শ্লোগান রপ্ত করে নিয়ে এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য নষ্ট করে দেয়। এভাবে অসচেতন ও সংবেদনাহীন সমাজ মূল্য ও নৈতিকতা-নিরপেক্ষ তথা চরিত্রহীন হয়ে পড়ে।
একটা বীভৎস অপরাধের পরিচয় পেয়ে শিউরে উঠেও এ সংকটকে গভীরভাবে বুঝে নিতে হয়। সংকটটা এখানেই যে ব্যক্তির পতন ঠেকানোর জন্যে এখানে কোনো সামাজিক প্রতিরোধ নেই। যেসব প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে সামাজিক প্রতিরোধ দানা বাঁধতে পারত, যেমন প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, সংবাদপত্র, রাজনৈতিক সংগঠন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ইত্যাদি সকলই যে ভিতরে ভিতরে চরিত্রহীন হয়ে পড়েছে। সবার ওপরে কি থাকবে রাষ্ট্রযন্ত্রের গভীরে বাসা-বাঁধা দুর্নীতিগ্রস্ততা? কিন্তু কথা হল এই দূষিত বাস্তবতা আপনা আপনি আমাদের কল্পনার অভীষ্ট আদর্শ অবস্থায় তো আর পৌঁছাবে না, এর জন্যে সমস্যাকে অনুধাবন ও বিশ্লেষণ করাই প্রাথমিক দায়িত্ব। তবেই নিরাময়ের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব। সে কাজ ক্ষুদ্র পরিসরেও শুরু হতে পারে। কিন্তু শুরু হওয়াটা জরুরি।
আমাদের সমাজে দুর্বল স্থান অনেক। দারিদ্র বা অশিক্ষা হয়ত কমবে। কিন্তু সাংস্কৃতিকভাবে প্রধান তিনটি দুর্বলতা সহজে কাটবে বলে মনে হয় না। প্রথমত এ সমাজ নৈতিকভাবে দুর্বল ও আপসপ্রবণ, দ্বিতীয়ত এ সমাজ আইন ও নিয়মের প্রতি কেবল উদাসীন নয় তা অমান্য করার মধ্যে গৌরব বোধ করে এবং তৃতীয়ত এ সমাজে সুস্থ স্বাভাবিক যৌন চেতনা, রুচি ও জীবনের চর্চা হয় নি। সে অর্থে সমাজ ভিতরে ভিতরে চরিত্রহীন হয়ে পড়েছে।
এই চরিত্র-খোয়ানো সমাজ স্বাভবতই দিনকে দিন অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে - অপরাধীকে লালন করে এবং অপরাধ দমন ও নির্মূলের সকল উদ্যাগকে অকেজো করে দিয়ে। এই অবস্থায় পুরুষশাসিত সমাজে অপ্রতিহত হয়েছে পুরুষের প্রাধান্য, কোণঠাসা হয়েছে নারী। সংখ্যালঘু নারী আর কন্যাশিশু এ সমাজে খুবই দুর্বল। তাহলে সংখ্যালঘু সমাজের কন্যাশিশুর অবস্থান সমাজে সবচেয়ে দুর্বল। ইসলামে নারীর সমানাধিকার স্বীকৃত এ নিয়ে বাদানুবাদে না গিয়েও সহজেই দেখিয়ে দেখা যায় এ সমাজে কীভাবে ধর্মের নামে এবং ঐতিহাসিক প্রথার দোহাই দিয়ে পুরুষই সমাজের একচ্ছত্র কর্তা হয়ে বসেছে। আইনের বিধানকে কাজে লাগিয়ে লড়াই করার সুযোগও কম, কারণ পুরুষতন্ত্র নারীকে দমনে সর্বশক্তি কাজে লাগাবে। তার হাতে ধর্ষণ ছাড়াও আরও অত্যাচারের শক্তি মওজুদ আছে।
কিন্তু দিনাজপুরের বড় আব্বুর কীর্তি কোনো ব্যাখ্যাতেই মেলানো যায় না। পাঁচ বছরের শিশুকে ধর্ষণ - কোন পর্যায়ের অপরাধ তা এ সমাজকেই বুঝতে হবে। কিন্তু এমন ঘটনা নতুনও  তো নয়। শিশুদের ধর্ষণ ও তারপরে হত্যার ঘটনা বহু বহু ঘটেছে এদেশে। এটা বিকৃতি, চরম বিকৃতি এবং মানুষের নৃশংস পশু হয়ে ওঠার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
মানতেই হবে এ সমাজমানস গভীরভাবে রোগাক্রান্ত, এটি অসুস্থ সমাজ। যে সমাজে অবোধ কন্যাশিশুও নিরাপদ নয় সেটি কীভাবে মানুষের সমাজ বলে দাবি করবে? এটি নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং এ ঘটনা এ সমাজের পুরুষতন্ত্রের বিকৃত যৌনক্ষুধার গভীরতাকেই তুলে ধরে। এমন সমাজের বৈষয়িক উন্নতি হলেও মানবিক অধ:পতন ঠেকানো মুশকিল হবে।
আমরা আবারো বলব, সঠিক শিক্ষা চাই, সামাজিক শিষ্টাচারসহ সুস্থ সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও পরিবেশ চাই। মানবিক সমাজের সুস্থ সংস্কৃতির ধারায় শিশু পরম আদরের পাত্রী। তার অবমাননা, নিষ্ঠুর পীড়ন আমাদের সকল উচ্চাভিলাষী কথা আর উন্নয়নের বুলিকে উপহাস করে। অহঙ্কারী আহাম্মক সমাজকে চপেটাঘাত বসিয়ে দেয়। বোধোদয় হবে কি আমাদের?

***


Saturday, October 22, 2016

স্বাধীনতার ভবিষ্যত ও গণতন্ত্রের বর্তমান

আবুল মোমেন

স্বাধীনতা অর্জন যেভাবে আমাদের স্বপ্ন ও প্রতিজ্ঞায় পরিণত হয়ে একটা জাতীয় চেতনার রূপ নিয়েছিল গণতন্ত্রও তদ্রুপ। গণতন্ত্র অর্জনের স্বপ্ন বাঙালির রাজনীতিতে বহুকালই কেন্দ্রীয় উপাদান। স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবে ধরা দিলেও গণতন্ত্রের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাচ্ছে। এ কথা বিএনপির প্রতিধ্বনি হিসেবে বলা নয়। তেমনটা শোনাতে পারে বলেই এ নিয়ে একটা ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার।
বিএনপিই বাংলাদেশের অপর প্রধান দল। কিন্তু এই দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনায় - অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তা, ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক চেতনা ইত্যাদি - বিশ্বাস করে কিনা সে বিষয়ে জনমনের সন্দেহ অমূলক নয়। দ্বিতীয়ত, দলটি গঠনতান্ত্রিকভাবেই অগণতান্ত্রিক এবং গণতন্ত্রের মূল্যবোধের কোনো প্রতিফলন তাদের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক সাহিত্যে নেই। এ সব সমালোচনার ন্যায্যতা প্রমাণের জন্যে দৃষ্টান্ত রয়েছে হাতের কাছে। ২০০১-২০০৬ সনে বিএনপি ক্ষমতায় এলো জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে, যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানাল, জঙ্গিবাদীদের আড়াল করল যাতে তারা সমাজে শক্ত ঘাঁটি গড়তে পারে। তাছাড়া পুরোনো পাকিস্তানি ধারার হিন্দু ও ভারতবিরোধী সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে উশকে দিল। এক-এগারোর ঘটনায় বোঝা গেল তাদের এ ভূমিকা সেনাবাহিনীও পছন্দ করে নি, তারা পাকিস্তানি লিগেসি  আর বহন করতে রাজি নয়। সমাজেও ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতি নিয়ে সংবেদনশীলতা যথেষ্ট থাকলেও সাধারণভাবে ধর্মের নামে হানাহানি রক্তারক্তি মানুষ পছন্দ করে না।
আজ স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতা নির্ধারণ করছে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্ম। আগের মতোই তাদের মধ্যে সামরিক ও বেসামরিক আমলা, প্রতিষ্ঠিত ধনিক গোষ্ঠীর নতুন প্রজন্ম ও নতুন উঠতি ব্যবসায়ী এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের বিশাল তরুণসমাজের শিক্ষিত অংশ - এমনকি স্বল্পশিক্ষিত ও শিক্ষাবঞ্চিত অংশও রয়েছে। এরা বিশ্বমুখী ও ভবিষ্যতমুখী। এরা জানে তাদের বর্তমান ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি এবং আগামীর সম্ভাবনার মূলে রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। এরাও পূর্ববর্তী প্রজন্মের মত ধর্মচর্চায় আগ্রহী কিন্তু তাদের মধ্যে জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হয় সামান্য সংখ্যকই, অধিকাংশই পূর্বপ্রজন্মের মতই ধর্মকে জঙ্গিবাদ পর্যন্ত টেনে নেওয়ার ঘোর বিরোধী। এদের মধ্যে ভারত সম্পর্কে সন্দিগ্ধতা-সতর্কতা থাকলেও নির্বিচারে ভারতবিরোধিতায় গা-ভাসানোর বিপদ ও অসম্ভাব্যতা তারা বোঝে - কারণ এ প্রজন্ম ভাববাদ ও আদর্শবাদের চেয়ে বাস্তবের বোধের দ্বারাই চালিত হয়।
যাদের কথা ওপরে বলা হল তাদের অধিকাংশই সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত অংশ, বাকি যারা দারিদ্র্যের মধ্যে আছে তাদের জীবনের প্রধান বিবেচ্য ব্যক্তিগত বৈষয়িক উন্নতি। ফলে জামায়াত বা জঙ্গিবাদ কিংবা পাকিস্তানপন্থী রাজনীতি এ সমাজে প্রধান বা শক্তিশালী ধারা হবে না। দেশের একটি প্রধান দল এই বাস্তবতা অনুধাবনে ব্যর্থ হলে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সংকট গভীর হতে থাকে। অনেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধের গতানুগতিক বক্তব্যে বিরক্ত হতেন এবং দলটিকে অতীতমুখী আখ্যা দিয়ে থাকেন। কিন্তু অতীতেও দেখা গেছে সময়ের দাবি অনুযায়ী আওয়ামী লীগ প্রয়োজনে নাম, নীতি, কর্মসূচি, বক্তব্য সব তাতেই পরিবর্তন এনেছে। একে রাজনৈতিক সৃজনশীলতা আখ্যা দেওয়া যায় এবং তাতেই দলটি নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে আজো বড় দল হিসেবে টিকে আছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ধাত্রী সংগঠন মুসলিমলীগসহ পরবর্তীকালের বহু দল হয় বিলুপ্ত হয়েছে অথবা ক্ষয় পেয়ে অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু এবং প্রায় সম্পন্ন করে আওয়ামী লীগ প্রমাণ দিতে পেরেছে যে মুক্তিযুদ্ধ ও একাত্তর এই স্বাধীন বাংলাদেশে নিছক ইতিহাস নয়, সমকালীন রাজনীতির প্রাসঙ্গিক বিষয়। সেদিক থেকে বলতে হয় জামায়াতকে দোসর বানিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি প্রচ্ছন্ন সহানুভূতি এবং বাংলাদেশের ইতিহাস  ও গৌরবময় ঐতিহ্য নিয়ে অস্বচ্ছ অবস্থানে থেকে বিএনপি বরং অতীতচারী তামাদি চিন্তার দলে পরিণত হচ্ছে। মনে হচ্ছে বিলুপ্ত মুসলিম লীগের খোলসে সেজে দলটি একই পরিণতির দিকে যাচ্ছে।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতির এই বাস্তবতায় দেশে জঙ্গিবাদের হামলা শুরু হয়েছে। ১ জুলাইয়ে গুলশান হলি আর্টিজানের ঘটনার পর এটি জাতীয়ভাবে গুরুতর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জঙ্গিদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সংখ্যাগত শক্তি, অস্ত্রশক্তি, অর্থবল সব মিলিয়ে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক সমাজ নির্মাণের স্বপ্নকে তারা যেন বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করেছে। এটাও সত্য এদের ধাত্রী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের ভূমিকা অস্পষ্ট নয়। আবার এই জামায়াতের সাথে বিএনপি জোটবদ্ধ।  এখানেই বাংলাদেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন, কিংবা মানবাধিকারের ইসু্যূগুলো রাহুগ্রস্ত হয়ে পড়ে। জঙ্গিরা এসবকে পশ্চিমা ধ্যানধারণা হিসেবে মানে না। জামায়াতের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ একটি কৌশলগত চাল, কেননা তাদের ভিতরকার নীতি-আদর্শ তো একই। উভয়েই তো ওয়াহিবি ধারার সালাফিপন্থী। বিএনপি নীতিগতভাবে এ আদর্শের দল না হলেও ক্ষমতার রাজনীতির কৌশল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এদের সহায়তা নিয়ে আসছে। এই সুবিধার রাজনীতিই এদেশে জঙ্গিবাদের ঘাঁটি গাড়তে সাহায্য করেছে।
মুশকিল হল ইসলামের আদিভূমির ও এর প্রতিবেশী মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার কোনো মুসলিম সমাজেই যথার্থ সমাজ সংস্কার হয় নি। মুসলিম বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সুফিসাধক ও অন্যান্য পণ্ডিতদের  বিশাল অবদান সত্ত্বেও ইউরোপের জাগরণের প্রেক্ষাপটে অর্থাৎ চতুর্দশ শতাব্দী থেকে অবক্ষয়, স্থবিরতা ও চিন্তার দৈন্যের প্রতিফলন ঘটেছে এসব রাষ্ট্র ও সমাজে। ইউরোপ-বিজেতা মুসলিম জাতি ধীরে ধীরে সেসব রাজ্য হারাল, নিজেদের স্বাধীনতা খোয়াল এবং একসময় নিজেদের সমাজকে অন্ধকারে ঠেলে দিল।
সেই স্থবিরতা ও অন্ধকারের খেসারত দিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলো। তাদের সরকারগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সাথে যত দহরম-মহরমই করুক না কেন নির্বাচনে দেখা যায় কট্টরপন্থী ধর্মান্ধ দলগুলোই বিজয়ী হয়। এ বাস্তবতা কামাল আতাতুর্কের তুরস্কে, গামাল নাসেরের মিশরে, বেন বেল্লার আলজেরিয়ায় কিংবা আরব বসন্তের সূতিকাগার তিউনিশিয়ায় একইভাবে সত্য। মুসলিম বা মুসলিমপ্রধান দেশে সামাজিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে হলে ধর্মান্ধ শক্তির উত্থান সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে।
আমরা জানি বাংলাদেশ ঠিক এসব দেশের মত নয়। দীর্ঘ মানবতাবাদী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা আজও বজায় থাকায় দেখা যাচ্ছে কিছু তরুণ নানা কারণে - যার কিছু সঙ্গতও বটে - জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হলেও আমসমাজ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে বাস্তবতা হল, বাংলাদেশকে কট্টর ইসলামপন্থার জঙ্গি ও প্রথাগত - উভয় ধারার রাজনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে আজ। এই বিশেষ সময়কে বিবেচনায় রেখেই গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইন শাসনের সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে। অর্থাৎ এই সতর্কতা যেমন প্রয়োজন তেমনি এই সংগ্রামও জরুরি। বাস্তবতাটা শাঁখের করাতই - দুধারী, দেখতে হবে জঙ্গি ও জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষক ধর্মান্ধ শক্তি যেন মাথাচাড়া না দেয়, আবার সরকারও যেন কর্তৃত্ববাদের যূপকাষ্ঠে আত্মবলী না দেয়। এই পাহারাদারীর দায় নাগরিক সমাজের।
এই বিস্তৃত ব্যাখ্যার পটভূমিতেই দেখতে হবে আমার এ নিবন্ধের প্রথম বক্তব্যটি - স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ হলেও গণতন্ত্রের স্বপ্ন আজ অধরা থেকে যাচ্ছে।
একথা বলা যাবে না যে আমরা একেবারে অগণতান্ত্রিক সমাজে পড়ে আছি। অনেক ক্ষেত্রেই গণতন্ত্রয়ান হচ্ছে। কিন্তু জঙ্গিবাদের হুমকির মুখে জননিরাপত্তা এবং স্বাধীনতা ও এর চেতনা ও মূল্যবোধ রক্ষার প্রশ্নগুলো মুখ্য হয়ে ওঠে। অপর প্রধান দল বিএনপি তো এমন কোনো প্রমাণ দেয় নি যে এসব তাদের হাতে নিরাপদ। বাংলাদেশ এত বড় ঝুঁকি নিতে পারে কিনা সেটা বড় প্রশ্ন। আমরা লক্ষ্য করছি ক্রমাগতই সরকার এবং তার বাহিনিগুলোর ক্ষমতা বেড়ে চলেছে। সরকার-প্রধান অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছেন। কঠোর গণতান্ত্রিক নীতির আলোকে এ নিয়ে আপত্তি করা স্বাভাবিক। কিন্তু সরকার তার ক্ষমতা, বা তার চেয়ে সঠিক হয় বলা, যে জনগণের বিপুল ত্যাগে অর্জিত স্বাধীনতা ও দেশের লক্ষ্যাদর্শকে রক্ষা করার জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে।
বাস্তবতা এমনটাই যে সুষ্ঠু নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে বাংলাদেশের সম্ভাব্য যে বাস্তবতা তা বর্তমান অবস্থার চেয়ে অনেক খারাপ বলেই মনে হয়। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জামায়াত ও জঙ্গিরা অতীতের মত ক্ষমতার অংশীদার হবে, প্রশ্রয় পাবে - এমন দুশ্চিন্তার জোরালো ভিত্তি আছে। এই পরিণতি বর্তমান স্থিতি নষ্ট করতে পারে, এমনকি গণতন্ত্রের সমাধি রচনার কারণ হতে পারে।
একথার আশা করি সরল কোনো সিদ্ধান্ত টানবেন না কেউ। বিষয়গুলো আরো জটিল। আমি গণতন্ত্রের জন্যেই সওয়াল করতে বসেছি। কিন্তু এখানে কট্টরপন্থা, আধাসামন্ত সংস্কৃতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতির অবক্ষয় এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এসব কাজ সরকারের ওপর চাপিয়ে সমাজ নিশ্চেষ্ট থাকলে কাজ হবে না। সমাজ থেকেই সংস্কার আন্দোলন শুরু করতে হবে।
গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ আদর্শ অর্জনের জন্যে সরকারকে দায়ি করে দায়িত্ব সম্পাদনের চাইতেও জরুরি হল সমাজকে এর জন্যে তৈরি করা। সে কাজে সমাজ থেকেই আন্দোলন হওয়া দরকার। আমরা লক্ষ্য করি জনসম্পৃক্ত এ ধরনের আন্দোলন একদম বিফলে যায় নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ওসমানি উদ্যান রক্ষা, চট্টগ্রাম আদালত ভবন রক্ষা, এমনকি ইদানিং আমরা দুর্নীতি দমন কমিশনকেও আগের তুলনায় অনেকটাই সক্রিয় হতে দেখছি। সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনও বিফলে যাবে বলে মনে করি না। সমাজ যদি মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের যৌক্তিকতার পক্ষে জনমত তৈরি করে অভিন্ন জাতীয় স্কুল শিক্ষা প্রবর্তনের পরিবেশ তৈরি করতে না পারে তবে গণতন্ত্রের সংকট সহজে কাটবে না। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নানা মাত্রায় চলতেই থাকবে, যার উপজাত হিসেবে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ উভয়ই প্রাণশক্তি ফিরে পেতে থাকবে।
গণতন্ত্রের স্বপ্ন পূরণের কাজ সমাজ থেকেই শুরু করতে হবে। সমাজকে অন্ধ বিশ্বাসের সংস্কৃতিতে ফেলে রেখে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সফল করা মুশকিল।

***

Sunday, September 25, 2016

সমাজ সংস্কার ছাড়া ধর্মান্ধতার বিপদ কাটবে না

আবুল মোমেন

বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে এমন কতকগুলো গ্রন্থি আছে যা মোচন করা কঠিন, এবং মোচন ব্যতীত এগুনোও কঠিন। অবিভক্ত ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনার উত্থান-পর্বে বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তার একদিকে ছিল ভারতভিত্তিক ভাবনা অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক স্বাতন্ত্র্যের চেতনা। ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলে তখনকার মত ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার রাজনীতি জয়ী হয়েছিল। আবার যখন পাকিস্তানি অপশাসন ও উৎপীড়নে অতিষ্ঠ পূর্ব বাংলার শিক্ষিত জনগোষ্ঠী জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছিল সেই জাগরণকে তখনকার বৈশ্বিক ও জাতীয় পরিম-লের সুস্থ ও শক্তিশালী বামপ্রগতিশীল চিন্তার প্রভাবে অসাম্প্রদায়িক পথে পরিচালিত করা গিয়েছিল। জাতীয়তাবাদী জাগরণ অনেকটাই ভাবাবেগের ওপর নির্ভর করে রীতিমত বিপ্লবী পরিণতি ঘটাতে সক্ষম, কিন্তু রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনা একটি দীর্ঘস্থায়ী বাস্তবসম্মত কার্যক্রম। এর নীতি-আদর্শিক ভিত্তিগুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট ও দৃঢ় করে নিতে হয়। আমার ধারণা ভাবাবেগের ওপর নির্ভর করে আমরা স্বাধীনতার মত অনেক বড় অর্জন সাধনে সক্ষম হয়েছি বটে, কিন্তু বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার আদর্শিক নীতিগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দিতে পারি নি।
পূর্ববঙ্গবাসীর জন্যে পাকিস্তান থেকে পৃথক হওয়া অবধারিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তারা কী ধরনের রাষ্ট্র গঠন করবে সে বিষয়ে ভাসা ভাসা কথা কিংবা আপ্তবাক্য উচ্চারণের বেশি যথার্থ যুক্তি বিচার দিয়ে বিশ্লেষণ করে বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশ ঘটে নি। এ অবস্থায় অসাম্প্রদায়িক অবস্থান সম্পর্কে সহজেই ভারতপন্থী বা হিন্দুঘেঁষা রাজনীতির অপবাদ দেওয়া সম্ভব হয়েছে, আবার দেশের সিংহভাগ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে একেবারে কট্টর ইসলামপন্থী পশ্চাৎপদ অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রচিন্তাও মাথাচাড়া দিচ্ছে। এটি বর্তমানে জঙ্গি রূপও নিচ্ছে। এ অবস্থায় একটি আধুনিক বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সাফল্যের জন্যে জনগণের মনে সঠিক লক্ষ্যাদর্শের বীজ বপন করা জরুরি।
একটা বিষয় সহজেই লক্ষ্য করা যায়, ভাষা আন্দোলন থেকে ধাপে ধাপে জাতীয় জাগরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যেই। এই নীতি-আদর্শের সাথে যুক্ত বিভিন্ন উপাদানকে ভালোভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয় নি বলে এর একটা দুর্বলতা থেকে গেছে বলে মনে হয়। কিন্তু এ থেকেও আমরা বাংলাদেশের কেমন লক্ষ্যাদর্শ হওয়া উচিত তার একটা উত্তর খুঁজতে পারি। যদি আমরা এ অঞ্চলের ইতিহাসের দিকে নজর দিই তাহলে দেখব বাঙালি কোনো কালে শাস্ত্রপন্থী কট্টর জনগোষ্ঠী ছিল না, একটা কৃষিজীবী সমাজ যেভাবে মাটি-জল ও প্রকৃতির সাথে মিশে মানুষে মানুষে পারস্পরিক সহযোগিতার বন্ধনে থেকে সফল হয় এখানে পরিবেশ তেমনটাই ছিল। এখানকার প্রকৃতি পরিবর্তমান হলেও মানুষের জন্যে অত্যন্ত উদার ও সম্পন্ন ছিল। এ মানুষ প্রকৃতিলগ্ন, ভাববাদী এবং মানবিক। বাঙালির একান্ত অধ্যাত্ম সাধনা - যেমন হিন্দুর গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন, মুসলিমদের বিভিন্ন ধারার সুফি সাধনা, বৌদ্ধদের তান্ত্রিক ধারাসমূহ, এবং এ অঞ্চলের নিজস্ব আউলবাউল সহজিয়া সাধনা - বিচার করলে তাতেও পাওয়া যাবে এর প্রকৃতিলগ্নতা , ভাববাদ ও মানবিক আবেদন ইত্যাদি। ষোড়শ শতকের বৈষ্ণব কবির সবার উপরে মানুষ সত্য এ ঘোষণার ঔদার্য দেখে যেমন তেমনি সপ্তদশ শতকের মুসলিম কবির মাতৃভাষা-প্রেমের আগুন দেখেও চমকে যেতে হয়। এই ইহজাগতিক মানবিক উদার ঐতিহ্যের ধারা থেকেই বাংলাদেশে একটি অসম্প্রদায়িকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রণোদনা পাওয়া সম্ভব। বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্তর্নিহিত প্রবণতা এই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে মানবিক উদার হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল।
সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ছাড়াও আমরা যদি পাকিস্তান আমলের রাজনৈতিক গতিধারা লক্ষ্য করি তাহলেও দেখব বায়ান্ন, চুয়ান্ন, বাষট্টি (ছাত্র আন্দোলন), ছেষট্টি, ঊনসত্তর (গণ-অভ্যূত্থান), সত্তর (নির্বাচন) ও সবশেষে একাত্তরের রাজনৈতিক প্রেরণা ছিল এই একইভাবে একটি অসাম্প্রদায়িক উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। সেভাবেই স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে বাহাত্তরের সংবিধান রচিত হয়েছিল।
বায়ান্ন থেকে উপরিকাঠামোয় বা বহিরঙ্গে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জাগরণের ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটেছে যে ইতিহাসে জমে ওঠা বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক ইস্যুর গ্রন্থিমোচন করার অবকাশ যেন পাওয়া যায়নি। কিংবা সে রকম প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা আমাদের নেতৃত্ব ও বুদ্ধিজীবীসমাজ দেখাতে পারে নি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে তার একেবারে ওপরে আছে ক্ষমতা ও বিত্তের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এটা লুটেরা ধনী ও সাধারণ লুটেরা শ্রেণীর দ্বারা রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের প্রক্রিয়া। কিন্তু তা প্রশ্রয় পেয়েছে যখন স্বাধীন বাংলাদেশকে তার অর্জিত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক এবং উদার মানবিকতার ধারা থেকে সরিয়ে এনে ধর্মভিত্তিক মুসলিম জাতীয়তাবাদে রূপান্তরের চেষ্টা শুরু হয় তখন থেকে। মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে ব্যর্থ করার এই চেষ্টা যে বিফল হয় নি তারও দুটি কারণ আছে। একদিকে রয়েছে স্বাধীনতার অর্জনকে যথার্থভাবে উপলব্ধি ও ব্যবহারে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা, বামপ্রগতিশীল শিবিরের বিভক্তি ও অবক্ষয়, পশ্চিমের উদার গণতান্ত্রিক দেশসহ বিশ্বব্যাপী রক্ষণশীলতার উত্থান, বাজার অর্থনীতির সুবাদে ভোগবাদী মানসিকতার প্রবল জোয়ার, সর্বোপরি মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম জাতি সম্পর্কে পশ্চিমের ভ্রান্তনীতি মিলে ক্রমে ক্রমে পঁচাত্তরের পরে সূচিত রূপান্তরণের রাজনীতি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এটি এখন জঙ্গিবাদী রূপ ধারণ করে সমাজে বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি এই বাহ্য ঘটনাবলীর অনুষঙ্গ হিসেবে বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তায় অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তির ফলে সৃষ্ট অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে।
এই দুর্বলতা রেখে দিয়ে উন্নয়ন সম্ভব হলেও গণতান্ত্রিক বিকাশে কোনো জাতি এগুতে পারে না। এর ফলে ক্ষমতা ও বিত্তকে কেন্দ্র করেই মূল রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে, মানুষের অধিকার, আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের শক্ত ভিত্তি ইত্যাদি চর্চা ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বাইরে থেকে যাচ্ছে। এভাবে দেশে কাঠামোগত ও ভোগবিচারে উন্নয়ন ঘটলেও মানবিক বিকাশ ও প্রকৃত মুক্তির পথ সংকুচিত হয়ে আসে।
আমরা ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধ করেছি - যুগপৎ স্বাধীনতা ও মুক্তি চেয়েছি। স্বাধীনতা দেশের হয়, তা হয়েছে, মুক্তি লাভ করে মানুষ, তা এখনও অধরা থেকে গেছে। স্বাধীনতাকে সব মানুষের জন্যে অর্থবহ করতে হলে অবশ্যই অর্থনৈতিক উন্নয়ন জরুরি, তা আবার মানুষের জন্যে প্রকৃত মুক্তির পথও অনেকটা সুগম করে দেয়। কিন্তু তারপরেও আরও কাজ বাকি থাকে। মানুষকে চিন্তা করার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। এটা কঠিন কাজ। এটি যথাযথভাবে সম্পন্ন না হলে ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় জঙ্গিবাদের বিপদ সহজে কাটবে না। রাষ্ট্র আইন করে বা শাস্তির বিধান দিয়েও মানুষের মনের পরিবর্তন বা সমাজমানসের রূপান্তর বাস্তবে ঘটাতে পারবে না। এর জন্যে চাই সমাজ সংস্কারের আন্দোলন, সাংস্কৃতিক জাগরণ। শেখ হাসিনা যদি সত্যিই তাঁর পিতার এবং লক্ষ লক্ষ শহীদের স্বপ্নের বাংলাদেশ কায়েম করতে চান তবে তাঁকে আজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই কাজটিই করতে হবে। সে কাজ শুরু করার জন্যে এটিই যথার্থ সময়।







Thursday, August 11, 2016

বিবেক হারালে মানুষের থাকে কি?

আবুল মোমেন

কুমিল্লার নাট্যকর্মী কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যার পর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। তাতে আশা জেগেছিল যে অপরাধী বা অপরাধীরা যতই শক্তিশালী হোক তারা ধরা পড়বে এবং বিচার ও শাস্তি এড়াতে পারবে না। ঘটনার সাড়ে চারমাস পরে তনুর মায়ের উপলব্ধি হল কন্যার ওপর অত্যাচারকারী ঘাতকেরা রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী। নয়ত, কুমিল্লা সেনানিবাসের মত নিরাপদ স্থানে সংঘটিত এমন বর্বর হত্যাকাণ্ডের কুলকিনারা আজও হবে না কেন?
কত বছর হয় কিশোর ত্বকী হত্যার? হায়, আমাদের স্মৃতিতে ত্বকীর নিষ্পাপ মুখটি জ্বলজ্বল করলেও তার হত্যাকাণ্ডের বিচার থেমে থাকার অপরাধ আমরা ভুলে যাচ্ছি। সেবারেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যাপক লেখালেখির মাধ্যমে দেশব্যাপী প্রতিবাদ হয়েছিল। মনে হয়েছিল এক লড়াকু পিতা তাঁর সন্তান হত্যার বিচার পাবেন। ঘটনা গড়িয়েছে নিজস্ব গতিতে, এবং একসময় সন্তান হত্যার বিচারপ্রার্থী পিতাকেই ঘটনা পরম্পরায় মামলার সম্মুখীন হয়ে জেলেও যেতে হয়েছে!
এদেশে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদবে? দেশে বিচার যে নেই তা নয়, অনেক মামলার বিচার হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে, অনেকের বিরুদ্ধে রায় কার্যকরও হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়ে রায় কার্যকর হয়েছে। আরো হচ্ছে। এসব জঘন্য অপরাধের বিচার বহুদিন বন্ধ ছিল, অনেক ক্ষেত্রে মামলাও করা যায় নি, অপরাধীদের জন্যে দায়মুক্তির আইনও ছিল। সেসব বাধা পেরিয়ে আমরা এসব অপরাধের বিচার পেয়েছি, পাচ্ছি।
আমাদের উচ্চ আদালত অনেক ক্ষেত্রেই স্বত:প্রণোদিত হয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যে মামলা করেছে, বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা রাষ্ট্রের অন্যান্য শাখা ও বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছে। তেমনি এক নির্দেশনার ভিত্তিতে পুলিশ নারায়ণগঞ্জের এক হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের অবমাননার বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। সংশ্লিষ্ট শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের অবমাননার দৃশ্যটি কেউ ধারণ করেছিল এবং তা সেই সূত্র থেকে সকল বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রদর্শিত হয়েছে, ভিডিও ক্লিপটি ছড়িয়ে পড়েছিল সোশ্যাল মিডিয়াতে। দেশবাসী দেখেছে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে থেকে স্থানীয় এমপি কীভাবে একজন প্রধান শিক্ষককে কান ধরে উঠবস করিয়ে হেনস্থা করছেন। এ ঘটনা সারা  দেশে আলোড়ন তুলেছিল, ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় হস্তক্ষেপ করে শিক্ষকের চাকুরি রক্ষা করলেন, তাঁর মর্যাদা পুনরুদ্ধারেও ভূমিকা রাখলেন।
ঐ সময় আত্মপক্ষ সমর্থন করে এমপি সেলিম ওসমান বলেছিলেন শিক্ষকের ওপর উত্তেজিত জনগণ এতই মারমুখী হয়ে উঠেছিল যে তাঁকে এরকম একটা শাস্তি দিয়ে তিনিই কোনো মতে প্রাণে রক্ষা করেছেন, উপস্থিত জনতাকেও শান্ত করেছিলেন। কিন্তু এখন আদালতের নির্দেশে তদন্ত চালিয়ে পুলিশ এ ঘটনায় এমপির কোনো সংশ্লিষ্টতাই খুঁজে পায় নি!
তাহলে দেশে সেই কাল এসে গেল যখন নিজের চোখ ও কানকেও অবিশ্বাস করতে হবে! চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জনের উপায়ও থাকল না! ক্ষমতাবানের ক্ষমতা কতদূর হতে পারে তার দৃষ্টান্ত কিছু কিছু মানুষ আগেও পেয়েছে। কিন্তু মানুষের চোখে দেখা তথ্যকে এবং বিশ্বাসকে এভাবে দলে থেঁৎলে দেওয়ার নমুনা আর দ্বিতীয়টি নেই। বিচিত্র নয় যে ঘটনার শিকার সংখ্যালঘু মানুষটির ওপর মানসিক চাপ প্রয়োগ করে তাঁর কাছ থেকেও এ বাবদে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে! কথা উঠতে পারে ভুক্তভোগী নিজেই ঘটনা অস্বীকার করলে অন্যে আর কী করবে?
কিন্তু এমনটা হওয়া উচিত হবে না। আমরা দেশ ও এর ভবিষ্যতের স্বার্থে আদালতের দিকে তাকিয়ে থাকব পুনরায় স্বত:প্রণোদিত হয়ে দুর্বলের পাশে দাঁড়াবার আশা নিয়ে। যে ঘটনা মানুষের মনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল, মানুষের বিবেক ও মর্যাদাবোধকে নাড়া দিয়েছিল, সমাজের অত্যন্ত মান্য ব্যক্তিরাও শিক্ষকের অপমানকে নিজেদের গায়ে নিয়েছিলেন। এর সাথে যেমন সত্যের টিকে থাকবার একটা ব্যাপার আছে তেমনি রয়েছে জাতির বিবেকের টেকা না টেকার প্রশ্ন।
ঘটনাটি ঘটে নি এ কথা তো বলা যাবে না, কেউ না কেউ সেদিন কাজটা করিয়েছিল, এমপি সেলিম ওসমানও সেখানে উপস্থিত ছিলেন - এসবই তো সত্য, এসবই ঘটনা। ঘটনা অস্বীকার করা যাচ্ছে না, তাই কি বলা হচ্ছে কেউ কিছু বোঝার আগে আকস্মিকভাবে ঘটে গেছে? এই আকস্মিকতার তত্ত্ব কার মাথা থেকে এসেছে? কারো মাথা থেকে তো নিশ্চয় এসেছে এবং তিনি নিশ্চয় অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি। আমরাও প্রভাবশালীর ক্ষমতার দৌড় কতদূর, সেটাই বুঝতে আইছি।  ফলত ঘটনা এখানে শেষ হয় না, নতুন মোড় নিয়ে নতুনভাবে শুরু হয়। আমরা তাই এ বিষয়ে আদালতের পরবর্তী ভূমিকার দিকে তাকিয়ে থাকব।
বিষয়টা গুরুতর। কেবল এটি নয়, তনু, ত্বকী, মিতুর হত্যাকাণ্ডের মত ঘটনাগুলো রহস্যে আবৃত হয়ে থাকলে মানুষের মনে হবে আইনের জন্যেও অনেক স্থান, প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি দুর্ভেদ্য। এতে বিচার বিভাগের ক্ষমতা সম্পর্কে জনধারণায় চিড় ধরে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতি হল, এতে জাতির বিবেক এবং সত্যবোধ ক্ষয় পেতে থাকে। সত্য ও মিথ্যাকে একাকার হতে দিলে, করা সম্ভব হলে সে সমাজে অপরাধ ঠেকানো মুশকিল, জঙ্গিবাদের প্রবণতার কাছেও তা দুর্বল থাকবে। আর বিবেক অস্বীকৃত হলে, বিবেককে অকার্যকর করে দিলে অর্থাৎ বিবেকের মৃত্যু ঘটলে সেটি আর মানুষের সমাজ থাকে কি?
মানুষ খুন হচ্ছে আকছার, বেঁচে থাকা মানুষের সম্মানও খুন হচ্ছে, এরপর বাড়তে বাড়তে পুরো জাতির বিবেক খুন হয়ে যাবে, মানুষের সত্যবোধ লুণ্ঠিত হবে। হয়তবা এসবও হচ্ছে, আমাদের ভোঁতা চেতনা অসাড় হয়ে যাচ্ছে বলে বুঝতে পারছি না। আমরা কথায় কথায় চরিত্র গঠনের কথা বলি, নৈতিক শিক্ষার কথা বলি। চরিত্র কিংবা নীতিবোধ পুঁথিগত শিক্ষা থেকে আসে না, বই পড়ে বিষয়টা জানা হয়, জানা হয় যে সদা সত্য কথা বলিবে। কিন্তু সেই নীতিবোধ চরিত্রে ধারণ করা যায় দৃষ্টান্ত থেকে। তাই রোল মডেলের কথা ওঠে, সমাজে দৃষ্টান্ত দেওয়ার মত মানুষের আকালের কথা বলে আমরা আফশোস করি। সমাজে প্রতিনিয়ত কপটতার আশ্রয় নিয়ে মিথ্যার জয় ঘটছে, ভ-ামি ও চাতুর্য সাফল্যের পথ তৈরি করছে, এমনকি অন্যায় ও অপরাধই জয়ী হচ্ছে বারংবার।
তার মধ্যেও সমাজ কেন টেকে? টিকে থাকে ছিটেফোঁটা দৃষ্টান্তের ওপর। যুদ্ধাপরাধীদের দম্ভ ও আস্ফালন শুনতে শুনতে মানুষ একসময় বিশ্বাস হারিয়েছিল যে এদের বিচার কোনো দিন এদেশে হতে পারবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হল, এবং মানুষের হৃতবিশ্বাস ফিরে এলো। ইয়াসমিন হত্যার বিচার পেয়েও মানুষ আশাবাদী হয়ে উঠেছিল।
সমাজমানস কোনো কোনো ঘটনায় ত্বরিত এবং প্রবল প্রতিক্রিয়া জানায়। কারণ ঘটনা তার সংবেদনশীলতার জায়গায় প্রবল ধাক্কা দেয়,  তার বিবেককে নাড়া দেয়। সেসব ঘটনায় পারস্পরিক যোগাযোগ ছাড়াই সারাদেশে একযোগে মানুষ একইভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকে। মানুষের এই প্রতিক্রিয়া, এই সংহতির মধ্য দিয়ে জাতির বিবেক কথা বলে। এ হল জাতীয় বিবেকের সত্যাশ্রয়ী ভূমিকা।
খুব সাম্প্রতিক কালে ত্বকী ও তনুর হত্যাকা- সাড়া দেশকে নাড়া দিয়েছিল। এ ছিল দুটি কিশোর-কিশোরীর অন্যায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জাতির বিবেকের তীব্র হাহাকার ও ক্ষোভের প্রকাশ। আর সম্প্রতি শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তের অন্যায় অবমাননায় জাতির বিবেক শিক্ষকের মর্যাদার প্রশ্নে এক হয়ে প্রতিকার চেয়েছিল। এসব ঘটনা কেবল ভুক্তভোগী ব্যক্তির বা তাদের পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ঘটনা নয়। এতো জমিজমার খুনের মামলা নয়, দাম্পত্যকলহের উত্তেজনার ফলে ঘটা খুনের মামলাও নয়। সব হত্যাই অপরাধ, তবুও অনেক ক্ষেত্রে দোষ-দায় নিয়ে সওয়াল চলে, কিন্তু তনু-ত্বকীর হত্যাকাণ্ড, যেমন রাশেদ-রাকিব-সাগর হত্যায়, তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করার কিছু নেই।
নিরাপরাধ শিশু-কিশোরদের হত্যা তাই মানুষকে এতো পীড়িত করে, তার বিবেক প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। একইভাবে একজন প্রধান শিক্ষকের প্রকাশ্যে অবমাননা জাতি মেনে নিতে পারে নি। তা যদি জাতিকে মানতে বাধ্য করা হয় তবে সেটা হবে জাতির গালে চপেটাঘাত, তার বিবেক ও সত্যবোধকে হত্যা করার সামিল। বিবেক ও সত্য এমন বিষয় যে তা কোথাও চলবে আবার কোথাও অচল হয়ে থাকবে এমন সুবিধাবাদ বা আপোসের নীতি চলতে পারে নি।
আমাদের জানতে হবে যে এ জাতির সত্যবোধ কি আছে নাকি নেই। জানতে হবে এটি কি বিবেকবোধসম্পন্ন জাতি নাকি নয়।
ইতিহাস বলে, সব কাল একরকমভাবে যায় না। কোনো কোনো কাল আসে যখন আপাত উন্নতি ও বৈভবের নিচে মনুষ্যত্বের কঙ্কাল তৈরি হতে থাকে। সেটা সময়মত বোঝা যায় না, বাহ্য চাকচিক্যে মোহগ্রস্ত মানুষ বিবেকের হাহাকার ও কাতরোক্তি শুনতে পায় না।
বিবেক হারালে ধনী হোক, জ্ঞানী হোক, সে তো আর মানুষ থাকে না। জাতিও কি তবে মানুষের জাতি থাকে?

***