Saturday, July 27, 2013

ভাবতে হবে কওমি-শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত নিয়ে

আবুল মোমেন




আমরা সকলেই জানি মানুষের মধ্যে এমন কিছু রিপু আছে যা তাকে পশুতে (তুলনাটা ঠিক নয়, কেবল বাংলা বাগবিধিমাত্র) অর্থাৎ অমানুষে পরিণত করতে পারে। রিরংসা বা যৌনকামনা রিপুগুলির মধ্যে অন্যতম। লালসা, রিরংসা, ক্রোধ ইত্যাদি কোনো রিপুর দাসত্ব প্রকৃত মানুষের কাছে কাম্য নয়। প্রকৃত শিক্ষা ও সংস্কৃতি মানুষকে শেখায় এসবকে নিয়ন্ত্রণ করতে, জয় করতে। এটাই মনুষ্যত্ব।

ইসলাম ধর্মও এই শিক্ষাই দেয়। পবিত্র কোরানেও বলা হয়েছে শয়তান মানুষকে কুপথে চলার প্ররোচনা দেয়। এ থেকে আত্মরক্ষা করে চলার জন্যে বরাবর সাবধান করা হয়েছে। ব্যাভিচার ও লাম্পট্য সম্পর্কে কোরান কেবল সাবধান নয়, কঠোর শাস্তির বিধানও দিয়েছে। মানুষের সমাজ ও সভ্যতার গড়ে ওঠা, উন্নত হওয়া ও টিকে থাকার কারণ রিপুর দাসত্ব নয় বস্তুত রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করে ইতিবাচক গুণাবলীর চর্চা।
আমার এই জানাবোঝার আলোকে দেশের কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান নবতিপর বৃদ্ধ আহমদ শফি সাহেবের বক্তব্য শুনে রীতিমত তাজ্জব হয়ে গেছি। তিনি পুরুষদের কেবল রিরংসা তথা যৌনকামনার দাস হওয়াই স্বাভাবিক বলেন নি, তা না হলে তার পৌরুষ সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাহলে তাঁর বিচারে পুরুষের ধর্ম রিরংসা-বৃত্তির দাসত্ব করা? লাম্পট্যই পুরুষের যোগ্যতার মাপকাঠি? ওটা কি শয়তানের দেখানো পথ নয়?
ইসলাম সম্পর্কে যাদেরই সামান্য ধারণা আছে তারাই জানেন, তাঁর এ বক্তব্য ইসলামের শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত, ভুল ও বিকৃত ব্যাখ্যা। আমরা ব্যথিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে লক্ষ্য করি, শফি সাহেবের বক্তব্য নিয়ে যখন প্রতিবাদ ও বিতর্ক সৃষ্টি হয় তখন প্রথমে তাঁর অনুসারীরা ও পরে তিনি নিজে একই বক্তব্যের পক্ষে আবার সাফাই গেয়েছেন। অর্থাৎ পৌরুষ সম্পর্কে এটাই তাঁদের অবস্থান।
পরে ভেবে দেখেছি, এরকম বক্তব্য এক শ্রেণির মওলানা দীর্ঘকাল ধরে দিয়ে আসছেন। গত পঞ্চাশ বছরে অনিয়ন্ত্রিত মাইকের দৌরাত্ম্যে যত ওয়াজ-নসিহত শুনেছি তাতে সাধারণত বক্তা মওলানারা যে তিনটি বিষয়ের সমালোচনা করেন তার মুখ্য হল নারী। তাঁদের বক্তব্য শফি সাহেবের বক্তব্যের মতই অশ্লীল ও আদিরসাত্মক হয়ে থাকে। অন্য দুটি সমালোচনার বিষয় হল বিধর্মী (বিশেষত পৌত্তলিক বলে হিন্দুধর্ম) এবং আধুনিক জীবন (যার মাধ্যমে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিও সমালোচিত হয়)।
ইতিহাসে আমরা দেখি ইসলামের নবী বরাবর সমকালীন ও পারিপার্শ্বিক বাস্তবতাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। এটা ছিল সে আমলে ইসলামের এক অন্তর্নিহিত শক্তি যার বলে নবী ও তাঁর পরবর্তী কালে ইসলামের চমকপ্রদ বিজয় ও বিস্তার ঘটেছিল। হযরত ওমর (রা.) এর সময় থেকে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত মুসলিম সভ্যতার অগ্রগতি হয়েছে। আর তার স্বর্ণযুগে, সাধারণভাবে বলতে পারি, নবম-দ্বাদশ শতাব্দীর মুসলিম জ্ঞানী-বিজ্ঞানীদের অসামান্য সব অবদান বিশ্বসারস্বতসমাজ শ্রদ্ধার সাথে চর্চা করে থাকে আজও। তখন কায়রো, বাগদাদ, কর্ডোভায় মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় যেসব উচ্চতর বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল তা সারা বিশ্বে যুগান্তরের বার্তা নিয়ে এসেছিল। এরই প্রভাব পড়েছিল ইউরোপীয় রেনেসাঁসে যার প্রভাবে সারা বিশ্বে ধীরে ধীরে রাষ্ট্র, সমাজ, জীবন, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে নতুন ধারার সূত্রপাত হয়েছে।
আবারও বলি, এই ধারার বীজতলা তৈরিতে মুসলিম সভ্যতার অবদান অত্যন্ত মৌলিক ও বিপুল।
আমরা জানি হালাকু খানের হাতে বাগদাদের পতন আর শেষ ক্রুসেডে স্পেনের মুসলিম শাসকের পরাজয় ঘটলে মুসলমানদের এই জ্ঞানবিজ্ঞান সাধনায় ভাঁটা শুরু হয়। আর অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার বৈশ্বিক নেতৃত্ব, বিশ্বমান এবং এর ধারা ধরে রাখা সম্ভব হয় নি।  বরং ধীরে ধীরে মুসলিম মনীষা অস্তমিত হয়েছে।
তবে ভারতবর্ষে মুঘল শাসনের মাধ্যমে ইসলামি সভ্যতার উদার মানবিক রূপটার চর্চা অব্যাহত ছিল। ইসলামি সভ্যতার বিজ্ঞান চর্চার ধারাটি ইউরোপ পুরোপুরি গ্রহণ করেছে। আর ইরানি-তুরানি প্রভাবে উপমহাদেশে বেশি চর্চিত হয়েছে কাব্য, শিল্প, স্থাপত্য, উদ্যানের মত সুকুমার শিল্প এবং সেই সাথে উদার মানবিক সুফি দর্শন।
কিন্তু ইংরেজ আগমনের পর এ ধারাও বন্ধ হয়ে যায়। ঔপনিবেশিক শোষণের কবলে পড়েছিল মধ্যপ্রাচ্যও। এরপর থেকে মুসলিম সমাজের নেতৃত্ব চলে যায় এমন সব আলেমদের হাতে যাঁরা মৌলিক ও সৃজনশীল চিন্তা, দর্শন ও তত্ত্বের নবতর ব্যাখ্যা এবং সময়ের সাথে পরিবর্তিত বাস্তবতাকে বুঝতে পারেন নি, বা চান নি। তাঁরা ইসলামকে প্রথমত, পুঁথিগত মুখস্থবিদ্যার মধ্যে আবদ্ধ করেছেন এবং দ্বিতীয়ত, তাঁদের চেনাজানা গণ্ডির বাইরের ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠা ভিন্নধর্ম, ভিন্ন সংস্কৃতির সাথে বিনিময়ের সাহস হারিয়ে চরম রক্ষণশীলতার পথ ধরেছেন। তাঁদের হাতে পড়ে দিনে দিনে ইসলাম এক স্থবির প্রাচীন রক্ষণশীল ও কট্টর ধর্ম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। রাজনৈতিক ও বৈষয়িক ক্ষেত্রে যতই কোণঠাসা হয়েছে ততই এরা ইসলামকে আরও কট্টর স্থবির এবং পরিশেষে জঙ্গিরূপ দেওয়ার চেষ্টা শুরু করে। ওয়াজ-নসিহতে কান পাতলে এক শ্রেণির মওলানার ক্রুদ্ধ কণ্ঠে শুনবেন জেহাদের আস্ফালন, প্রতিপক্ষকে বিনাশের জন্যে যুদ্ধের ডাক। পারিপার্শ্বিক ও বর্তমান বাস্তবতা সম্পর্কে কোন রকম ধারণা ছাড়া এসব কথা সমাজে অযথা উত্তেজনা ছড়ায়। আর এভাবে ইসলামের সহনশীল, উদার, মানবিক শিক্ষা উপেক্ষিত হয়ে এদের হাতে এক ঝগড়াটে, জঙ্গি, নারী বিদ্বেষী ইসলামের আত্মপ্রকাশ ঘটছে। এটা প্রকৃত ইসলাম নয়।
কীভাবে মওলানারা বলেন ইসলাম বিপন্ন? ইসলাম যদি আল্লাহর ধর্ম হয়ে থাকে তবে তা রক্ষার মালিক তিনিই। বস্তুত এরকম ভাবনা মনে শুধু তখনই আসবে যখন কারও ইমান হবে দুর্বল।
ইসলাম কখনও বিপন্ন নয়, হতে পারে না। তবে মুসলিম সমাজ বিপন্ন। আর তার কারণ আহমদ শফির মত মওলানারা। যাঁরা মানুষের রিরংসার মত রিপুর ভজনা করেন। এ তো তাঁর অনুসারীদের শয়তানের হাতে সোপর্দ করার শামিল। এ জন্যে তাঁকে ধিক্কার না জানিয়ে উপায় নেই। সকল মানুষ, মুসলমান তো বটেই, শয়তানের কুমন্ত্রণা যেন পরিহার করে সত্যিকারের মনুষ্যত্বের পথে এগুতে পারে সেটাই কাম্য হওয়া এবং সেই পথেই সবার চলা উচিত।
আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে আমি যে পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভিতর দিয়ে এসেছি তা আমাকে শিখিয়েছে নারীকে বন্ধু, সহকর্মী, সহমানবের মর্যাদায় গ্রহণ করতে।
কওমি মাদ্রাসার বিপুলসংখ্যক শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত ও দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের জন্যে দেশের সুধীজনের এখনই সোচ্চার হওয়া উচিত।