Sunday, September 28, 2014

আরবদেশে মুক্তি কোন্ পথে?

আবুল মোমেন

কয়েকটি ছোট ছোট প্রশ্ন তোলা যাক।
সাদ্দাম হোসেনকে একনায়কত্বের পথে শক্তি জুগিয়েছে কে?
ইরানের বিরুদ্ধে সাদ্দামকে অস্ত্রসজ্জিত করে যুদ্ধে ঠেলেছে কে?
আফগানিস্তানের তালিবানদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সংগঠিত করেছে কে?
ওসামা বিন লাদেন ও আল-কায়েদার পৃষ্ঠপোষক ছিল কে?
পিএলও-র বিপক্ষে হিজবুল্লাহর উত্থানে মদত দিয়েছিল কে?
ইজরায়েলকে আরবদের বিরুদ্ধে একতরফা পক্ষপাতমূলক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে কে?
এ ছ’টি প্রশ্নের উত্তর একটিই - যুক্তরাষ্ট্র।
আজ এটা পরিস্কার এই সব মানুষ ও সংগঠনের উত্থান সেসব অঞ্চলের জন্যে কল্যাণকর হয় নি।
আরও কয়েকটি প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক বলেই উত্থাপন করা দরকার।
ইরাকে আক্রমণ চালানোর জন্যে গণ-ধ্বংসাত্মক অস্ত্র মওজুদের অজুহাত কি সত্য ছিল?
প্যালেস্টাইনি নেতা ইয়াসির আরাফাতকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়া কি সঠিক ছিল?
ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পরে ইরাকে কি শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে?
একতরফা ব্যবস্থার মাধ্যমে আফগানিস্তান সমস্যার কি যথাযথ সমাধান করা গেছে?
চারটি প্রশ্নেরই উত্তর একই - না।
আমরা দেখছি এ সব অঞ্চলে ভোগান্তি আরও বেড়েছে, প্রাণহানি অব্যাহত রয়েছে, রক্তপাত ও ধ্বংস চলছেই। শত্র“তারও অবসান হচ্ছে না।
উপরের প্রশ্নোত্তর পর্বের পটভূমিতে যদি মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বিভীষিকা আইএস বা ইসলামিক স্টেট দলের ভূমিকা বিচার করি তাহলে পশ্চিমা প্রচারণার ওপর-ভাষ্যে ভুলে গেলে বোধহয় চলবে না। তলিয়ে বিচার করা দরকার।
বহুকাল ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হচ্ছে অন্যান্য আরব দেশের মত সিরিয়াতেও বশংবদ সরকার কায়েম। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করে শিখণ্ডি সরকার বসিয়ে বিপুল তেলসম্পদের বখরা ভালোভাবে আদায় হয়েছে। এ অঞ্চলে এখন একমাত্র হাতছাড়া রয়েছে সিরিয়া। দীর্ঘদিন নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েও সার্থক হয় নি যুক্তরাষ্ট্র। পুরোনো সম্পর্কের জের ধরে মধ্যপ্রাচ্যে শেষ সমর্থক-রাষ্ট্রকে রক্ষায় রাশিয়া এখনও আন্তরিক। ইরানও রয়েছে পাশে। যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক কোনো যুদ্ধে আর জড়াতে চায় না। বিশেষত ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধে মার্কিন সৈনিকদের প্রাণহানি, পেশাগত নৈতিকতাচ্যুতি, এবং আহতদের মানসিক বৈকল্য ও বিপুল খরচের চাপ মার্কিন ভোটারদের একই ধরনের অভিজ্ঞতার প্রতি বিরূপ করে রেখেছে। কিন্তু সিরিয়াকে অমনি ছেড়ে দিতে রাজি নয় যুক্তরাষ্ট্র, হস্তক্ষেপের ফিকিরেই ছিল পরাশক্তিটি।
এমন সময়ে আকস্মিকভাবে ইরাক থেকে উত্থান ঘটল ভয়ঙ্কর মতাদর্শের আইএস। তারা একটি অঞ্চলে রাতারাতি ইসলামি খেলাফতই প্রতিষ্ঠা করে ফেলল! তারপর এমন জঙ্গি নিষ্ঠুর অমানবিক আচরণ শুরু করল যা কোনো ধরনের ইসলামি দল-উপদলের পক্ষেও সমর্থন করা সম্ভব নয়। লক্ষ্য করবার বিষয় আইএসকে সমর্থন করার মত কোনো স্বীকৃত মুসলিম সংগঠন নেই। আবার সকল বিরুদ্ধতাকে হেলায় অগ্রাহ্য করে আইএস তার মানবতাবিরোধী অপরাধ চালিয়েও যাচ্ছে। কোনো রাষ্ট্রশক্তি এবং কোনো বড় সাংগঠনিক শক্তির সমর্থন ছাড়াই আইএসের অমানবিকতার অগ্রাভিযান অব্যাহত রয়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে মানবিক বিপর্যয়ের মাত্রা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।
এবার যদি আমরা প্রশ্নটা তুলি - আইএসের আকস্মিক উত্থান এবং এত বাধার মুখেও অগ্রাভিযানের পিছনে কে?
উত্তরটা কী হতে পারে বলে আপনারা ভাবছেন? উত্তর কিন্তু একটিই Ñ আগের অঘটনগুলোর ধারাবাহিকতা এখানেও ক্ষুণœ হয় নি। বলা যায়, কলকাঠি যুক্তরাষ্ট্রই নাড়াচ্ছে, সঙ্গে যথারীতি মিত্ররাও রয়েছে। ফ্রান্স ও অষ্ট্রেলিয়া ইতোমধ্যে আইএসের ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে। পশ্চিমে যারা বসবাস করেন, তাদের মধ্যে যাদের চোখকান খোলা তারা পুঁজিবাদী বিশ্বের এসব চালাকি ভালোই ধরতে পারছে। তাদের মধ্যে যারা তরুণ, যাদের রক্ত গরম, তারা অনেক সময় এত অন্যায় দেখে নিজেদের ধরে রাখতে পারে না। তারা প্রতিকারের জন্যে আরেকটি ভুলের ফাঁদে পা দেয়, যেমন করে অতীতে তালিবান ও আল কায়েদায় ভুলে এভাবে শিক্ষিত ছেলেরা জেহাদী যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু পুঁজিবাদের হাতে সৃষ্ট এসব জঙ্গি সংগঠনের প্রাণভোমরা কখনও তারা হাতছাড়া করে নি। তারা মূলত পুঁজিবাদের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহৃত হওয়ার জন্যেই সৃষ্ট। প্রয়োজনে ফুরানোর পর যথারীতি তাদের ধ্বংস করেও দেওয়া হয়েছে। এখন তালিবান আল কায়েদার যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাদের বাগাড়ম্বরের ক্ষমতাটুকই আছে, সমান তালে লড়ে পুঁজিবাদী বিশ্বকে পরাস্থ করার কোনো ক্ষমতাই নেই।
আইএস ব্যাপক হৈচৈ বাধিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ভালোভাবে জায়গা করে দেওয়ার উপলক্ষ তৈরি করে দিয়েছে। তারাও আসরে নেমে পড়তে দেরি করে নি। প্রথমে বারাক ওবামা তাঁর ভোটারদের আশ্বস্ত করে বললেন, আমরা এবার আর স্থলবাহিনী পাঠাব না, কেবল বিমান আক্রমণ চালিয়েই কাজ সারব। সেভাবেই শুরু হল। এবারে তাঁদের সামরিক কৌশলবিদ আসরে নেমেছেন। তাঁদের কণ্ঠে একটু একটু শোনা যাচ্ছে যে শুধু বিমান আক্রমণ চালিয়ে সম্ভবত কাজ হবে না, এক পর্যায়ে স্থলবাহিনী পাঠাতেই হবে। এদিকে বিমান আক্রমণ এবং তাতে বেশ ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও আইএস তার নিষ্ঠুর জঙ্গি কার্যক্রম জোরদার করে চলেছে। ফলে পুঁজিবাদী মিত্রশক্তির মধ্যপ্রাচ্যে ঢুকে পড়ার উপলক্ষটা আরও ভালভাবে তৈরি হয়ে গেল।
আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি, যথাসময়ে আইএসের পরিণতিও তালিবান ও আলকায়েদার মতই হবে। কেবল দেখতে হবে পুঁজিবাদের তাদের কতটুকু এবং কতদিন লাগবে।
মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে মনে রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে রয়েছে সৌদিআরব, মিশর, কুয়েত, জর্ডান, প্রভৃতি আরববিশ্বের প্রভাবশালী ধনী মুসলিম দেশ।
আরব দেশগুলোতে আধুনিক শিক্ষা এখনও সাধারণের মধ্যে ছড়ায় নি। ফলে প্রথা এবং সংস্কৃতির প্রাচীন ধারার ঘোর থেকে জনগণ মুক্ত হয় নি। এসব দেশের শাসকদলের কাছে - তা রাজতন্ত্র স্বৈরতন্ত্র বা ছদ্মগণতন্ত্র, যা-ই হোক Ñ জনগণের এই পরিণতিই কাম্য। রাজা-প্রজার সম্পর্কের বাইরে এসব দেশে গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ এখনও সম্ভব নয়। নির্বাচনও এরকম সমাজে স্বৈরতন্ত্রী ও ধর্র্মান্ধদেরই ক্ষমতায় পাঠায়। গণতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতা, মানবাধিকার, নারীর সমানাধিকার, আইনের শাসন ইত্যাদির পক্ষে সমাজমানসকে তৈরি করার জন্যে কোনো সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন এসব দেশে এখনও হয় নি। ফলে বেশিরভাগ দেশে শরিয়ার নামে এমন সব রীতি চালু রয়েছে যা সমাজের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করছে। এতে ধনী দেশ হওয়া সত্ত্বের সাধারণ মানুষ শিক্ষা ও চেতনায় অগ্রসর হচ্ছে না। তাতে ইসলামের মূল শিক্ষা ও নবীর মূল চেতনার পরিপন্থী হয়ে পড়ছে সমাজগুলো। তাদের নেতৃত্বের পুঁজিবাদের তাঁবেদারির ফলে আজ ইসলাম ও মুসলিম জনগণ চরম প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ে গেছে। তাদের সাথে সরাসরি যোগ দিয়ে কিংবা এদের সৃষ্ট তথাকথিত ধর্মীয় সংগঠনে জুটে গিয়ে মুক্তির পথ মিলবে না। এর জন্যে প্রয়োজন সমাজ সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কার, এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লব। এটা জেহাদী জোশ দিয়ে অর্জিত হবে না, এটা সম্ভব হবে প্রত্যেক দেশে সচেতন মানুষ একাট্টা হয়ে নিজ নিজ দেশে সমাজ ও সরকার পরিবর্তনের কাজ করলে। তার ভিত্ তৈরি করে দেবে আধুনিক জনশিক্ষার প্রসার।
পশ্চিমের অস্ত্র কিনে, ভাড়াটে সৈন্য দিয়েও একাজ হবে না। নবীর দেখানো পথ জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে নিজেদের যোগ্যতা ও শক্তি বৃদ্ধি করে সমাজের নবায়নের মাধ্যমেই এটা অর্জন সম্ভব। পথটা সহজ বা সংক্ষিপ্ত নয়, দীর্ঘ ও বন্ধুর। সবাই জানি বড় কিছু অর্জন করতে হলে কঠিন পথে বিপুল ত্যাগেই তা মেলে। আর তার জন্যে যথাযথ হাতিয়ার প্রয়োজন। সেটি আপাতত একে ৪৭, রকেট লাঞ্চার, কামান-বাজুকা নয়। তার আগে দরকার জ্ঞানের আলোয় নির্মিত দূরদর্শী প্রজ্ঞাপূর্ণ নেতৃত্ব ও আলোকিত অনুসারীর দল। এই নেতৃত্বই নিজ দেশের জনগণকে জাগিয়ে তুলে ঐক্যবদ্ধ করবে। অর্থাৎ দূরদর্শী জ্ঞানী গণনায়কের প্রয়োজন আজ আরব দেশগুলোতে। এটাই তাদের মুক্তির একমাত্র পথ।

***